পরিমল গোস্বামী
বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের এক জায়গায় বলেছিলেন--'পাষাণে যে মূর্তি অঙ্কিত হয়, পাষাণ নষ্ট না হইলে তাহা আর মিলায় না।' পরিমল গোস্বামীর 'সমগ্র স্মৃতিচিত্র' পড়তে গিয়ে এ কথাই মনে পড়ে। এই বিশাল গ্রন্থে যে বিপুল স্মৃতির সঞ্চয় তিনি উপস্থিত করেছেন তা পড়তে পড়তে সুহৃদ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর একটি চিঠির কথা মনে পড়ে যেখানে পরিমল গোস্বামীকে তিনি ঠাট্টা করে 'স্মৃতিদিগ্গজ' আখ্যা দিয়েছিলেন। আত্মজীবনী, ডায়েরি, জার্নাল রচনার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এগুলো হতে পারে intimate অথবা anecdotal. প্রথম ধরন মিলবে সুইফট-এর Journal to Stella, দ্বিতীয় ধরনের পরিচয় আছে বসওয়েল-এর Journal of a Tour to the Hebrides এর মধ্যে। তৃতীয় একটি ধরন হয়তো লক্ষ্য করা যাবে যেখানে ব্যক্তিগত বা ঘটনাগত প্রসঙ্গের সঙ্গে রচনাকার উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বা ঘটনা বা চরিত্রের মূল্যায়ন করতে প্রবৃত্ত হন। পরিমল গোস্বামীর এই মহাগ্রন্থে এমন রচনা প্রচুর আছে। এই স্মৃতিচিত্রণের সামান্য পরিচয় পাঠকের সামনে উপস্থিত করব। কিন্তু তার আগে পরিমল গোস্বামীর বিচিত্রসত্তা ও লেখক জীবনের কথা বলে নিতে চাই।
কারণ, আজকের পাঠক নানা কারণে এই সব বিচিত্রকর্মা, বন্ধুবৎসল, সংস্কৃতিসতর্ক, মানুষগুলিকে ভুলতে বসেছেন। প্রকাশককে ধন্যবাদ, কারণ এই গ্রন্থ পরিমল অনুধ্যানে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষকেও উজ্জীবিত করে তুলতে সহায়ক হবে। ১৮৯৭ র জাতক এই বিচিত্র মানুষটি ছিলেন সাহিত্যিক শিক্ষক বিহারীলাল গোস্বামীর পুত্র। তিনি প্রবন্ধ, ব্যঙ্গাত্মক ও কৌতুক বিস্তারী গল্প ও রসরচনায় প্রসিদ্ধ ছিলেন। স্মৃতি বিষয়ক রচনা বাদেও তাঁর লেখা বই - ঘুঘু, মারকে লেঙ্গে, ম্যাজিক লণ্ঠন, সপ্তপঞ্চ, পথে পথে, রবীন্দ্রনাথ বাঙালি বাংলাভাষা ও নানা নিবন্ধ, পুরুষের ভাগ্য, রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, তাঁর গল্প সঙ্কলনের সংখ্যা আট, যার মধ্যে রঙ্গব্যঙ্গ আর গোয়েন্দা গল্প আছে। প্রবন্ধ সংকলন একটি। প্রবন্ধ ও রম্যরচনার বই দুটি। কিশোর পাঠ্য বই পাঁচটি সংবাদ টিপ্পনীসমৃদ্ধ বই দুটি, ভ্রমণ কাহিনী একটি, নাটক তিনটি, অনূদিত বই দুটি, ফোটোগ্রাফি সংক্রান্ত বই দুটি, সম্পাদিত বই দুটি। সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত 'সমগ্র স্মৃতিচিত্র' এই বইয়ের শেষে পরিমল গোস্বামীর প্রকাশকালসহ সমগ্র গ্রন্থতালিকা থাকা দরকার ছিল। প্রথমত: পরিমলবাবুর বিচিত্র পরিচয়দানে; দ্বিতীয়ত: এই লেখাগুলি স্মৃতিচিত্রণের পরিপূরক। পরিমল গোস্বামী শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের অধীনে পরীক্ষণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন, বাংলা বানান নিয়ে উদ্বেগ ও মমতা প্রকাশ করেছেন। এম.এ. পাশ করার পর থেকেই প্রবাসী, শনিবারের চিঠি প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে ও রবিবারের আসরে কাজ করেছিলেন। 'এক কলমী' ছদ্মনামে বহুদিন যুগান্তর পত্রিকার পাতায় সরস ও ব্যঙ্গরচনা লিখেছেন।
পরিমল গোস্বামীর লেখা ছাড়াও শখ ছিল ক্যামেরা বিষয়ে। বহু খ্যাতনামা ব্যক্তির ছবি তুলেছেন, বহু বিচিত্র নাট্য ও অন্য মুহূর্তের ছবি তুলেছেন; দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই ছবির কোনো সংগ্রহ নেই, যা, সন্দেহ নেই, সাংস্কৃতিক জগতের ইতিহাস রচনায় মূল্যবান সহায়ক হত। রেডিয়ো সংসর্গে থাকার ফলে বহু শিল্পী ও মনীষির সাদা কালো ছবি তুলেছেন, যার কয়েকটি এখনও আকাশবাণীর বিভিন্ন কক্ষে শোভা পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাভাষায় ফোটোগ্রাফি শিক্ষার দুটি বই লিখেছিলেন (ক্যামেরার ছবি, আধুনিক আলোকচিত্রণ), বই দুটি সচিত্র, যা অতীব মূল্যবান।
সুধীর চক্রবর্তী মন্তব্য করেছেন—'আত্মস্মৃতির থেকে এসব বৃত্তান্ত পড়ার ফাঁকে আমাদের জানা হয়ে যায় যে ছোটবেলা থেকে পরিমল ছিলেন ডানপিটে স্বভাবে। যথেচ্ছ ভ্রমণ, ঘুড়ি ওড়ানো, ম্যাজিক দেখা, সাঁতার আর গান শোনার ফাঁকে ফাঁকে চলেছে সব কটি পত্রিকা পাঠ, লেখালিখি, লেখাছাপা এবং বিজ্ঞান অন্বেষা।' পরিমল শান্তিনিকেতনের কলাভবনে গিয়ে ছবি আঁকার তালিম নিয়েছেন নন্দলাল বসুর কাছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর আঁকা অপটু পোর্ট্রেট দেখে চিত্ররহস্যের মূল কথা বুঝিয়ে দেন। কৈলাস বসু স্ট্রিটের বাসাবাড়িতে সপরিবার বাস করেছেন, নানা কর্মস্থলে গেছেন হেঁটে বা বাসে-ট্রামে। এই বাসাবাড়িতে এসেছেন বহু বিখ্যাত ব্যক্তি। কলেজে পড়ার সময়ে ভাষাতত্ত্ব পড়েছেন শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছে, পরে শিশিরকুমার এসেছেন বহুবার তাঁর সঙ্গে গল্প করতে। অভিনয়, গানের আসর, নবপ্রযুক্তি ও যন্ত্র, ম্যাজিক, ছাপাখানা—সবকিছুই ছিল তাঁর আগ্রহের অন্তর্গত। স্মৃতিচিত্রগুলিতে সান্নিধ্যের অন্তর্গত বিঝ্যাত ব্যক্তিদের তালিকা বিস্ময়করভাবে বিপুল। তার মধ্যে লেখক, অভিনেতা, বিজ্ঞানী ছিলেন অনেকে।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রেরণায় গড়ে তোলেন 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ'। অনেক গুণী মানুষকে তিনি হাজির করেছিলেন, আগ্রহের বিষয় করে তুলেছিলেন। আজ সেই গুণী মানুষটি সম্পর্কে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি এ বড়ো দুর্ভাগ্যের কথা।
আলোচ্য বইটি পরলোকগত লেখকের যাবতীয় স্মৃতিমূলক রচনার সংকলন, যাতে পাই—স্মৃতিচিত্রণ, দ্বিতীয় স্মৃতি, আমি যাঁদের দেখেছি, পত্রস্মৃতি, যখন সম্পাদক ছিলাম, পুনর্যাত্রা স্মৃতিপথে—এই ছটি বই। প্রথম বই স্মৃতিচিত্রণ, যা শুরু হয় পাবনা জেলার সাতবেড়ে গ্রামে বাল্যস্মৃতি দিয়ে। ১৯০০ কিংবা ১৯০১-এর ফুটবল খেলার স্মৃতি, পাঠশালা বিবরণ, হেডমাস্টার পিতা বিহারীলালের কাছে ইংরেজি ও বাংলা বিদ্যাসূচনা, বাড়ির বিচিত্র পত্রিকা, জলছবি, ডাকঘরে যাওয়া, ডাকে কাগজ ও নানা জিনিস আনানো, রবীন্দ্রনাথের খান বারো বইয়ের প্যাকেট পাওয়ার কথার সূচনা, তারপর কলের গানের কথা, টিকেদারের আতঙ্ক, ১৯০৫-এর মাইনর স্কুল, প্রথম ম্যাজিক দর্শন, পদ্মাদর্শন, থিয়েটার দর্শন, বলতে বলতে পল্লীগ্রামে স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউয়ের কথা, হিন্দু মুসলমানকে পৃথক করার মতলবের কথা আসে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দৈনিক চার পয়সার বাজার ও মাসিক পাঁচটাকায় সংসার আজকে আশ্চর্য মনে হবে। গ্রামে দলাদলি ছিল, গ্রাজুয়েট (তাঁর গ্রামে) মাত্র তিনজন আর ছিল উন্মাদনা-বিস্তারী প্রকৃতি। পল্লিঝড়ের ভয়াবহ মূর্তি, মাছধরা, ঘুড়ি ওড়ানো, খেলাধূলা, বাধ, সাপ, কুমিরের অভিজ্ঞতা। ১৯০৮-এ লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি পোস্টকার্ড আসে পিতা বিহারীলালের কাছে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আমন্ত্রণ নিয়ে, কিন্তু যাওয়া হয়নি। অতি বাল্যেই তিনি মুকুল, প্রকৃতি, শিশু প্রভৃতি পত্রিকার গ্রাহক হন। তাঁর জীবনে অন্যতম স্মরণীয় হয়—প্রথম কলকাতা দর্শন (১৯১০), পঞ্চম জর্জ দর্শন (১৯১২), হ্যালির ধূমকেতু দেখা (১৯১০)। এছাড়া পাই হাইস্কুলে পাঠ্য-স্মৃতি, রতনদিয়ার স্মৃতি (এখানে ছিল লেখক রবীন্দ্র মৈত্রের বাড়ি)। অরবিন্দ ঘোষকে দেখেন প্রথম দশকে। গ্রামশিকারীদের বাঘ মারার সবিস্তার বর্ণনার পাশে পাশে আসে বাজনা শেখা, সাইকেল চড়া শেখার কথা। মাঝে মাঝে তিনি উল্লেখ্য চরিত্র এঁকেছেন (হরিপদ সান্যাল, মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়, হরেন্দ্র রায়, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র)। খুব ছোট বয়সে পাবনার 'সুরাজ' কাগজে লেখা শুরু স্থানীয় সংবাদ। হিমালয় সম্পর্কে রহস্যময় আকর্ষণ বর্ণিত হল দার্জিলিং যাত্রায়। তার কাঞ্চনজঙ্ঘার অভিনবত্বে দিশাহারা, ভাষাহীন সৌন্দর্যে মোহাবিষ্ট হবার মনোভাব পরে চাপা পড়ে যায়। ম্যালেরিয়ার কারণে হাওয়াবদল, ডাক্তার রসিকলাল দত্তের প্রেসক্রিপশন, ধর্মতলার স্মিথ স্ট্যানিস্ট্রিট-এর দোকান থেকে পেটেন্ট ওষুধ কেনা, বন্ধু প্রবোধ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি সাহেবগঞ্জে হাওয়াবদল যাওয়ার ফাঁকে একালের পাঠক সেকালের কলকাতা, বিলুপ্ত ওষুধের দোকান, সাহেবগঞ্জের সেকালীন আবহাওয়ার কথা জানতে পারেন। বনফুলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ১৯১৪তে। পরিমল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এভাবে - ' এ যুদ্ধে ভারতবর্ষের জনসাধারণের কোনো দুশিন্তা ছিল না। তারা বসে বসে কেবল গুজব রটাত। যারা কাজের লোক তারা অবশ্য নিরব তৎপরতায় এই উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ টাকা করছিল। তারপর ১৯১৬ সালে যখন বাঙালি তরুণদের ডাক পড়ল যুদ্ধক্ষেত্রে, তখন বাঙালি জাতির যেন আরও একটা জাগরণের যুগ এল। প্রথম বাঙালি দল ফরাসি চন্দননগর থেকে গেল যুদ্ধে, তারপর ব্রিটিশ বাংলার ডাবল কোম্পানি, ফর্টিনাইনথ রেজিমেন্ট। গ্রামে গ্রামে রিক্রুটমেন্টের উৎসাহ, যুদ্ধের চাঁদার উত্তেজনা।' (পৃ. ৪৫) এরপর তিনি একে একে রাজশাহী কলেজের (১৯১৫), পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের (১৯১৫-১৬) পঠন ও শিক্ষকদের কথা বলেন। পদ্মার ঝড়ের কবলের বর্ণনার সূত্রে আসে ভূতের ভয়ের কথা—'ভূতের ভয় নামক কোনও ভয়ের যে কোনও অস্তিত্ব নেই আমার মনে এ নিয়ে নিঃসন্দেহ হয়েছি।' বইটির ২য় পর্ব শুরু গণপতি চক্রবর্তীর ম্যাজিক ও হস্টেলস্মৃতি দিয়ে। জানান—'গল্প বা উপন্যাস পাঠে আমার আকর্ষণ ছিল না, আমার শুধু প্রবন্ধ পড়তে ভাল লাগত।' (পৃ. ৫৬) তাঁর প্রথম চাকরি একমাসের জন্য— হেডমাস্টারি, বেতন ত্রিশ টাকা। তারপর পুনরায় পঠনে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে ও বাস বিদ্যাসাগর হস্টেলে। রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখার বিবরণে (পৃ. ৬০-৬২) আছে রবীন্দ্রের 'তেজোদৃপ্ত আবৃত্তি'র কথা, তাঁর বক্তৃতা শোনার কথা। পরে আসে বিচিত্রায় রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতা পাঠ, রেডিয়োতে জন্মদিনে আবৃত্তির কথা (পৃ. ১৭১-১৭৩) ১৯১৮ সালে কলকাতায় ডেঙ্গুজ্বর ও ভূমিকম্পের বিবরণ (পৃ. ৭০-৭২) থেকে তখনকার ডেঙেলাপিং ও চলিত ক্যামেরার কথা জানা যায়। চিত্রশিল্পে তাঁর আগ্রহের প্রসঙ্গে এক প্রবন্ধের উল্লেখ করা যায় - 'আমাদের চিত্রশিল্পের বর্তমান অবস্থা' উপাসনা, মাঘ ১৩২৭ শান্তিনিকেতন যাবার অভিজ্ঞতা, মুজতবা, অনিলচন্দ প্রভৃতির সঙ্গে আলাপ হয়, সে-সময় রবীন্দ্রনাথের নেওয়া সব কটি ক্লাসই তিনি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি ক্লাসে পড়ান জাপানি কবিতা, 'হাইকাই' ও 'লিরিক এপিগ্রাম' জাতীয় কবিতা ছিল রবীন্দ্রের প্রিয়। পরিমল বলছেন 'ঋণশোধ' নাটক দেখার কথা নন্দলাল বাসুর শিক্ষাপদ্ধতির কথা, দিনেন্দ্রনাথের গান শেখানোর কথা।
কলকাতায় তিনি থিয়েটার দেখছেন ১৯১২-১৩ থেকে, ফলে দর্শকের চোখে নাট্য-এর একটা নমুনা পাওয়া যাবে এখানে, আছে 'বিসর্জন' নাটকে জয়সিংহরূপী রবীন্দ্রের নাটকের কথা। সরকারি আর্ট স্কুলে অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের কাছে ভর্তি হবার বাসনা প্রকাশ করেন, শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন ঈশ্বরীপ্রসাদ বর্মা। শর্টহ্যাণ্ড শিক্ষার কথা আছে এক জায়গায়। বনফুল বিষয়ে নানা জায়গায় লিখেছেন, সেগুলো মেলালে বনফুল চিত্রায়ণ, মূল্যায়ণ, অনেক ব্যক্তিগত অজানিত প্রসঙ্গ জানা হয়ে যায়। আর আছে বনবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কথা। বস্তুতঃ বনবিহারীকে বাঙালির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন পরিমল গোস্বামীই, বনফুল তাঁর দাদার কথাকে শিল্পায়িত করেছেন 'অগ্নীশ্বর' উপন্যাসে। পূর্বে তাঁর ব্যঙ্গগল্প লেখার কথা বলেছি। ১৯২৬ সালে মাসিক বসুমতীতে তাঁর প্রথম বড় ব্যঙ্গ গল্প প্রকাশিত হয় একথা উল্লেখ করেছেন। এবং 'লেখা তখনকার দিনে আমাদের কাছে সম্পূর্ণ 'আনন্দাৎ', উপার্জনেচ্ছায় কদাপি নয়'। (পৃ. ১১০) জোড়াসাঁকোয় 'নটীর পূজা' অভিনয় ও তার তাৎপর্যের কথা আছে ১১২-১১৪ পৃষ্ঠায়। আছে নবীন (বসন্ত) অভিনয় দেখার কথা ১৯৩২-এ (পৃ. ১৩১-১৩৩) সমাজ বিষয়ে তাঁর রচনা একাধিক, ১৯৩০-এ সেসব ছাপা হত 'বঙ্গলক্ষ্মী' পত্রিকায়। একাধিক মৃত্যু, মৃত্যুচিন্তার সঙ্গে আসছে সরোজনলিনী, নারীমঙ্গল সমিতি প্রসঙ্গ। শনিবারের চিঠিতে তাঁর প্রবেশ ১৯৩২-এ যার ৫ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যায় অর্থাৎ পৌষ ১৩৩৯-এ বার হয় তাঁর ব্যঙ্গ গল্প - 'নৌকা-খণ্ড'। কৌতুক রচিয়তা একদা ভাগলপুর নিবাসী আশুদের সঙ্গে আলাপ, তাঁর লেখা ইত্যাদির প্রসঙ্গ আছে, বস্তুতঃ এই সব গৌণ সাহিত্যিকব্ররন্দের কথা, একাধিক জনের কথা আমরা পরিমল গোস্বামীর এই স্মৃতিচিত্রণ সমষ্টির মধ্যে পাব। রাজনীতি এড়িয়ে চলতেন - প্রধানত স্বাস্থ্যের জন্য, অংশত মানসিক গঠনের জন্য।
বঙ্গশ্রী পত্রিকা সহ কয়েকটি পত্রিকা অফিসে আড্ডার কথা বলেছেন তিনি, সেখানে যারা হাজিরা দিতেন, তাদের রচনা বৈশিষ্ট্যের কথাও এ বই থেকে জানা যায়। আছে সেনোলা কোম্পানিতে, রেডিয়োতে আড্ডার কথা।
বিভূতিভূষণের সঙ্গে সম্বলপুর যাত্রার বিবরণ আছে ১৩৮-১৪৪ পৃষ্ঠায়, যাতে সহ-ভ্রমণ আরো অনেকের কথা আছে। গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, ব্রজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমল হোম, শরদিন্দু, নলিনীকান্ত সরকার, শৈলজানন্দের সিনেমা জীবন, ব্যঙ্গ লেখক হিসেবে গোপাল হালদার, শৈল চক্রবর্তীর চিত্রশিল্প, নীরদচন্দ্র চৌধুরীর 'নূতন পত্রিকা', প্রভৃতির প্রসঙ্গায়ন সরস ও সহজভঙ্গিতে কমবেশী বিস্তারে পরিমলবাবুই হাজির করেছেন। বাংলা সংস্কৃতি সৃজনে এদের ভূমিকা বিরাট নয়, কিন্তু তুচ্ছ করার-ও নয়। প্রমথ চৌধুরীর ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের কথা আছে, 'অলকা' পত্রিকার কথাও। এই গৌণ পত্রিকা সমূহের গুরুত্ব এ ধরনের বই থেকেই অনুমিত হতে পারে। পরিমল শুধু লেখালিখি, সম্পাদকীয় রচনা করেছেন, তা নয়, অমর মল্লিকের একটি ছবির সংলাপ রচনায় সাহায্য করেন। যুদ্ধের গোড়ায় (১৯৪০) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক হন, সিনেমা সমালোচনা ও সে উপলক্ষে নানা হলে সিনেমা দেখা কর্তব্যকর্ম ছিল। আর ছিল ফটো তোলার নেশা - 'প্রতি ছুটিতে কলকাতার পথে পথে, নদীর ধারে ধারে, চিড়িয়াখানায়, শিবপুরের বাগানে, কলকাতার বাইরে মাঠে মাঠ, ক্যামেরা নিয়ে ঘুরেছি। ছবির সংখ্যা হয়েছে কয়েক হাজার।' (পৃ. ১৮১) তখন চালু ছিল বারোয়ারি উপন্যাস লেখা, 'পঞ্চদশী' নামের উপন্যাসের ৭ম অধ্যায়টি তাঁরই লেখা, আগে পরে আরো অনেক নামী কথাসাহিত্যিক ছিলেন। এই স্মৃতিকথা সূত্রেই জানি কলকাতায় বোমা পড়ে ১৯৪২র ২০, ২১, ২২, ২৪ ডিসেম্বর। 'মহামন্বন্তর' নামে দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে একটি গল্প সংকলন সম্পাদনা করেন, যার ভূমিকা লিখেছিলেন গোপাল হালদার। যুদ্ধের অফিসে কাজ এর পাশে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের টানে যেতে হত থিয়েটার জগতে - 'রঙমহল সংবাদ' নামে পাক্ষিক পত্রিকার সম্পাদক হন (১ আগস্ট, ১৯৪৩, ১ম সংখ্যা) এরপর 'নতুন পত্র' নামে আর একটি কাগজ, যদিও এটি অল্প দিন পরেই বন্ধ করতে হয় অনুমতি আনার জটিলতায়। এ বইটি সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, এটি স্বীকারোক্তি নয়, 'আমি এঁকেছি স্মৃতি ছবি', 'অনেক বিচ্ছিন্ন টুকরোর ছবি' যার তুলনীয় বই আর মনে পড়ে না।
পরের বইটি হল - 'দ্বিতীয় স্মৃতি'। এ বইটির প্যাটার্ন ও প্রথমটির অনুরূপ। এর প্রথমেই আছে - ১৯৪৫ এর স্বরূপ। অর্থাৎ ১৯৪৫ ও তার পরবর্তী স্মৃতি আসছে; যা 'আগের যুগের চেয়ে আকাশ-পাতাল তফাত।' ওঁর লেখার ধরন হলো সিরিয়াস ও মজার জিনিষের সহাবস্থান। যেমন, এখানে ১৯৪৫ এর স্বরূপের পর 'সাময়িকী দপ্তরে হনুমান'। আবার তার পরে কিছু প্রসঙ্গ - বিদেশী ও স্বদেশী যুদ্ধ কথা। দ্বিতীয়টি হল - কলকাতার দাঙ্গা। এরপরই জয়ন্তীর জঙ্গলে ভ্রমণ বৃত্তান্ত। লেখক জানান - ১৯৪৬ থেকে 'বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে বই পড়ার ইচ্ছাটা খুব বেড়ে যায়।' (পৃ. ২১৪) তারপর স্বাধীনতা ঘোষণা বৃত্তান্ত। এর পাশে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত কথা, যা পুনরায় অন্য বইতেও পাওয়া যাবে। শরৎ-এর পর প্রকৃতি-বিজ্ঞানী গোপাল ভট্টাচার্য ও বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কথা। এই সব প্রতিষ্ঠান আমাদের সারস্বত সাধনার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ, কিন্তু কৌতূহলী পাঠকের কৌতূহল নিরসনে এমন বইতেই সাহায্য পাওয়া যাবে। ল্যান্সডাউন ও সিমলা ভ্রমণের কথাও মেলে এই পর্যায়ে। মাঝে মাঝে স্মৃতির বিস্তার থেকে উদ্ভাসিত অনেক প্রসঙ্গও আছে। যেমন—বিলাত যাত্রাপথে গিরিজা মুখোপাধ্যায়ের ১৯৩১র ৮ অক্টোবরের চিঠি। এর থেকে বোঝা যায় সবসময়ে তিনি কালানুক্রম অনুযায়ী চলেননি। ১৯৩৮-এ হেমলতা দেবীর চিঠিও সে-কথা প্রমাণ করে। মোহিতলাল, যতীন্দ্র সেনগুপ্ত, বিভূতি বন্দ্যো, সজনীকান্তর পত্র, 'পত্রস্মৃতি' বইয়ের পরিপূরক। শিশির ভাদুড়ী প্রসঙ্গ এই বইতেও আসে। ব্যক্তি শিশিরের মনোবেদনা, শিল্পী শিশিরের কৌতুক ও নানা অন্তরঙ্গ আলোচনায় এই নাট্যচরিত্রটিকে এতোদিন পরেও প্রত্যক্ষ করা যায়। ১৯৫২তে যুগান্তর সাময়িকীতে তিনি 'বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না' নামে একটি ধারাবাহিক লেখা লিখিয়েছিলেন নানাজনকে দিয়ে। সে লেখাগুলি মারফৎ রচয়িতাদের ভূত ও অলৌকিকত্ব বিশ্বাস সম্পর্কে, সাধারণ মানুষের চেতনা সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা যায়। রাজশেখরের দাদা শশিশেখরের দক্ষতা সম্পর্কে খুব কম সংখ্যক জন লিখেছেন। শশিশেখরের নিজের লেখার পাশেই পরিমল গোস্বামীর এই লেখা রাখা যেতে পারে। সঙ্গে শশিশেখরের চিঠিগুলি রচনাকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। এর পাশেই রাজশেখর, ব্যক্তি ও শিল্পী, রাজশেখর-বন্ধু যতীন্দ্রকুমার সম্পর্কে অনেক কথা আছে যা সাহিত্যিক এই মানুষটিকে চিনতে সাহায্য করে। চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, তাঁর বিজ্ঞান-ঔৎসুক্যের পাশেই সাহিত্যপ্রীতির সমন্বয়ে তিনি রাজশেখর ঘরানার মানুষ। বনবিহারী প্রসঙ্গ এই বইতেও যথেষ্ট। এই দুটি রচনা পড়ার পরই অনেক বাঙালি বনবিহারীর বিবিধ রচনার শক্তিমত্তায় আকৃষ্ট হন। ১৯৬২-তে চীনের সঙ্গে ভারতের সংঘাতের ছোট্ট একটু প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। শ্লেষ করে বলেছেন—'আজ ড্রাগনধর্মী চিনের আক্রমণে নতুন আর একটা যুগের সূচনা হতে চলল, এ যুগকে তাই অভিনন্দন জানাই।' (পৃ. ৩০৬-০৭) কিন্তু সত্যই কি নতুন যুগ সূচিত হয়েছিল, শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রতিক্রিয়াই বা কিরূপ সে প্রসঙ্গ অবশ্য এখানে নেই। হেমেন্দ্রকুমার রায়-ও ছিলেন বহু বিচিত্রতার সাধক, তাঁর মজাদার ছন্দিত চিঠি অতুলনীয় যার পরিচয় পৃ. ৩০৭-এ। এই প্রসঙ্গে শেষ ব্যক্তিত্ব - ডেনিশ বিজ্ঞানী নীলস বোরের মৃত্যু প্রসঙ্গ। এ-বইয়ের শেষে বিনয়ের সঙ্গে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন—'এ পর্যন্ত যা কিছু লিখেছি তার কি কিছু দাম আছে?' আমরা আগেই বলেছি একটা যুগের সাংস্কৃতিক-সামাজিক ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে এইসব লেখার দাম যথেষ্ট, কারণ এখানে এমন অনেক বিষয় উল্লিখিত যা অপরিহার্য উপকরণ, বিশ্বস্ত উপস্থাপন, যা অন্যত্র পাওয়া যাবে না।
তৃতীয় বই—'আমি যাঁদের দেখেছি'র পৃথক পৃথক অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী, বিহারীলাল গোস্বামী, রাজশেখর বসু, শরৎচন্দ পণ্ডিত, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, বনবিহারী মুখোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নলিনীকান্ত সরকার, শিশিরকুমার ভাদুড়ি, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময়ী দেবী, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, কাজি নজরুল ইসলাম, সজনীকান্ত দাস—এঁরা প্রত্যেকেই সংস্কৃতি-জগতের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। রচনাগুলিতে পরিমলবাবু তাঁর ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের কথা দিয়ে শুরু করেছেন এবং পরে তাঁদের প্রতিভার মূল্যায়ন করেছেন। পূর্বের দুটি বইতে, এবং পরে কোনো কোনো বইতে এঁদের অনেকে হাজির। কিন্তু যেমন—নজরুল প্রসঙ্গে—'বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ হতে দেখলাম। অথচ যাকে না যায় বোঝা, না যায় বোঝানো।' (পৃ. ৪৮৯) যেমন—সজনীকান্ত প্রসঙ্গে—'নিপাতনে সিদ্ধ সজনীকান্ত, আসলে কাউকে সত্যই নিপাত করেননি। ব্যঙ্গ সাহিত্য রচনার পরিমাণ তাঁর খুব বেশি নয়। কিন্তু কৌতুক সাহিত্য অজস্র। এবং শনিবারের চিঠিতে যে সংবাদ সাহিত্য রচনায় অসাধারণ শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, তা অনেকখানিই সংবাদ এবং তারও বেশি কৌতুক। নিপাতনের জন্য আক্রমণও আছে, কিন্তু তার পরিমাণ সামান্য, কারণ ব্যক্তিগত কোনো স্থায়ী বিদ্বেষ তাঁর ছিল না বিপক্ষের প্রতি।' (পৃ. ৪৯৮) যেমন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে - 'বিভূতিবাবুর মধ্যে মোটামুটি দুটি পরস্পরবিরোধী সত্তা অত্যন্ত স্পষ্ট দেখা গিয়েছে। আমি পিটার প্যানের সঙ্গে তাঁর একটি দিনের তুলনা করি। তফাত এই যে, পিটার প্যান কিশোর হয়ে থাকবে বলেই পণ করেছিল, বিভূতিবাবুর কিশোর মন তাঁর চরিত্রগত।" (পৃ. ৪৬৩)
যেমন—ব্রজেন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে—'ব্রজেন্দ্রনাথের কর্মনিষ্ঠা অতুলনীয়। গবেষণা কাজ তিনি একক শক্তিতে আপন গরজে চালিয়ে বহু বিস্মৃত জিনিস শুধু উদ্ধার করেছেন তাই নয়, তাদের কালানুক্রমিকভাবে বিন্যাস করেছেন এবং ভবি্ষ্যত গবেষকদের কাছে তা অতিশয় মূল্যবান করে তুলেছেন।' (পৃ. ৪৬০) সুনীতিকুমার প্রসঙ্গে—'পাণ্ডিত্য যাঁর বেশি তিনি উগ্রভাবের হন, অথবা মিতবাক হন, গম্ভীর প্রকৃতির হন, এই জাটিয় সব ধারণা সুণিতিকুমার তাঁর জীবনে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন... ... (সুনীতিকুমার) ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।' (পৃ. ৪৫২)
চতুর্থ বই—পত্রস্মৃতি—বিরাট বই। ৫৫টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ২৮০ পৃষ্ঠার বই। পরিমল গোস্বামীর স্মৃতি যেমন বিস্ময়করভাবে গভীর ও প্রখর, তেমনি পত্রসংরক্ষণ—তা-ও কম বিস্ময়ের নয়। লেখক যে অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ, তা বোঝা যায়, এক একজন ব্যক্তির চিঠি এক এক অধ্যাইয়ে রাখার মধ্যে। লেখক ঠিকই বলেছেন—পুরোনো চিঠি অনেকদিন পর পাঠে 'বিচিত্র আলোড়ন' জাগায়। আর জেগে ওঠে, বিশেষ কনটেক্সট (context)। এই কনটেক্সটও আজকের পাঠকের ভাবনাচিন্তায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারে। লেখক আরো বলেছেন এ-বইয়ের চিঠি-স্মৃতি শুধু খ্যাত লোকেদের নিয়ে নয়। এই বড়ো বইয়ের সামান্য কিছুমাত্র এখানে উল্লেখ করব। কালিদাস রায় লিখছেন, হঠাৎ গুজব রটেছে তিনি মারা গেছেন, কয়েকটি স্কুলে এ-কারণে ছুটিও হয়ে গেছে। এ চিঠি পেয়ে পরিমলবাবু যুগান্তরে কিছু মজা করেন। তাঁর 'আধুনিক ব্যঙ্গ পরিচয়' বইতে কালিদাস রায়ের ওপর একটি অধ্যায় আছে। বিপ্লবী বারীন্দ্র ঘোষের চিঠিসূত্রে আসে তাঁর জীবন বিষয়ে স্বউল্লিখিত তথ্যাদি। প্রসঙ্গতঃ বারীন্দ্র সম্পর্কে বাল্যকালেই গড়ে ওঠে 'একটা রোমাঞ্চকর শ্রদ্ধা।' সুধাকান্ত রায়চৌধুরী রবীন্দ্র-পার্ষদদের অন্যতম। কিন্তু তার সম্পর্কে জানতে হলে পরিমল গোস্বামীর এই রচনাটি অতীব সহায়ক। সুধাকান্ত বন্ধু পরিমলকে অনেক সময়ে একান্ত ব্যক্তিগত অনুভবও ব্যক্ত করেছেন। যেমন—'আমার মন সজীব আছে সত্য, কিন্তু এই মনটা প্রত্যহ তিক্ত হয়ে ওঠে এক একবার সাংসারিক বিচিত্র জটিলতার আঘাতে।' (পৃ. ৫৩১) সুধাকান্তের আরো অনেক চিঠি অনাগ্রহী ব্যক্তির হাতে সমর্পিত হয়ে চিরতরে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে একথা শুনেছি তাঁর পুত্রের মুখে। এইসব অনুজ্জ্বল কর্মীরা হারিয়ে গেলে তা হবে যথেষ্ট বেদনার। পূর্বে উল্লিখিত প্রকৃতি-বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের চিঠি পড়তে হবে পূর্ব-বর্ণিত তাঁর জীবন ও স্বভাব বৃত্তান্তের সঙ্গে। শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী বা কালীকিঙ্কর ঘোষ দস্তিদার অতুল বসু সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু যা আমাদের উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে আগ্রহ জাগাবে,যে আগ্রহ নিয়ে পাঠককে প্রবেশ করতে হবে তাঁদের শিল্পের জগতে। যেমন; কালীকিঙ্কর প্রসঙ্গে - 'শিল্পীর নির্লিপ্ততা আমি তাঁর মধ্যে যতটা দেখেছি এমন আর কোথাও দেখিনি। ক্রমাগত ছবি আঁকছে আর যেখানে বসে আঁকছে সেখানেই তা ফেলে চলে যাচ্ছে,তার প্রতি আর তার কোনো মোহ বা টান নেই। (পৃ. ৫৪৩) অতুল বসুর সম্পর্কে পরিমল বাবুর কথা হল - মানুষের 'স্বভাব বৈশিষ্ট্যকে (শিল্পী) একটি স্থির চিত্রের মধ্যে ধরতে চেষ্টা করেন' যে নৈপুণ্য অতুল বসুর প্রতিকৃতিতে সুন্দরভাবে প্রকাশিত।
- রবীন পাল
(পরবাস-৫০, ফেব্রুয়ারি, ২০১২) সংগৃহীত।
========{{{{{{{{============={{{{{{{{==
No comments:
Post a Comment