Sunday, 30 June 2024

শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। "তোমার ভেজানো দরজা ঠেলে/ কেউ আসবে না,বোকা, কেউ কি নিজের কাজ ফেলে/ খেয়ালের কথা রাখে?"। আনন্দ বাগচী । ভারতীয় বাঙালি কবি ও উপন্যাসিক। Dt - 01.07.2024. Monday. Vol - 925. The blogger post in literary e magazine

"তোমার ভেজানো দরজা ঠেলে

 কেউ আসবে না,বোকা, কেউ কি নিজের কাজ ফেলে

খেয়ালের কথা রাখে?"



আনন্দ বাগচী

 ( ১ জুলাই ১৯৩২ - ৯ জুন ২০১২)




  ভারতীয় বাঙালি কবি ও উপন্যাসিক।



জন্ম  বাংলাদেশের পাবনা জেলার স্বাগতা গ্রামে। পিতা শ্রীচন্দ্র বাগচী এবং মাতা সজলবালা দেবী। পাঁচ ভাই বোনের সকলের বড় ছিলেন তিনি। তার উচ্চ শিক্ষা কলকাতায়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় তার সহপাঠী ছিলেন কবি দীপক মজুমদার।পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন।এম.এ পাশের পর তিনি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কর্মজীবন শুরু করেন বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজে|  বাঁকুড়ার এই কলেজে ষোল বৎসর অধ্যাপনা করার পর তিনি সাগরময় ঘোষ এর আহ্বানে দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন এবং কলকাতায় চলে আসেন। সাহিত্যজীবনের শুরুতে তিনি হর্ষবর্ধন এবং

 ত্রিলোচন কলমচির ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।

ঊনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে কবি হিসাবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করলেও উপন্যাসিক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তরুণতম কবিদের মুখপত্র কবিতা পত্রিকা কৃত্তিবাস-এর প্রথম সংখ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার এবং তিনি সম্পাদক ছিলেন। এই পত্রিকাতেই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ স্বগত সন্ধ্যা-র কবিতা গুলি প্রকাশিত হয় এবং কবি হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।কৃত্তিবাস পত্রিকার মাধ্যমে তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়বুদ্ধদেব বসুশরৎকুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে আধুনিক কবিতা আন্দোলনে নিবিড়ভাবে যুক্ত হন। এছাড়া তিনি শেষে সেতুপারাবতবৃশ্চিক প্রভৃতি পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনা করেছেন।  কবিতা উপন্যাস ছাড়াও তিনি কিশোরদের উপন্যাস, ছোটগল্প, রম্যরচনা ইত্যাদি রচনা করেছেন। প্রকাশিত রচনা ও গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -


 সাহিত্যকীর্তি

কাব্যগ্রন্থ-

স্বগত সন্ধ্যা (১৯৫৩)

তেপান্তর (১৯৫৯)

উজ্জ্বল ছুরির নিচে (১৯৭৭)

বিস্মরণ (১৯৮২)

শ্রেষ্ঠ কবিতা 

উপন্যাস ও অন্যান্য রচনা-

চকখড়ি (১৯৬৪)

আক্ষেপানুরাগ 

স্বকালপুরুষ (১৯৯২)

ফেরা না ফেরা

চাঁদ ডুবে গেল

পরমায়ু

রাজযোটক

এই জন্ম অন্য জীবন

ছায়ার পাখি

সাহিত্য প্রসঙ্গে প্রভৃতি। 

কবির স্বকালপুরুষ গ্রন্থটি হল কাব্যোপন্যাস এবং এটিই ছিল বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত প্রথম প্রচেষ্টা। 



কবি আনন্দ বাগচী ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি মীরা বাগচীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের একমাত্র পুত্র সুনন্দ বাগচী।



কবি আনন্দ বাগচী জীবনের শেষ দিকে স্মৃতি শক্তি হারিয়ে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার হালিশহরের বাড়িতে আর্থিক অনটনের মধ্যে থাকতেন। শেষে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন কল্যানীর এক বেসরকারি নার্সিংহোমে পরলোক গমন করেন।


 কেবল কবি কেন? ত্রিলোচন কলমচী বা শ্রীহর্ষ ছদ্মনামে যিনি লিখে গেলেন একের পর এক নিবন্ধ কিংবা ‘কানামাছি’, ‘মুখোসের মুখ’, ‘বনের খাঁচায়’, ‘চকখড়ি’ র মত একাধিক উপন্যাস , এবং যিনি ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার অন্যতম কিংবা দীর্ঘদিন ‘দেশ’-এর মত বিপুল প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন সেই আনন্দ বাগচীকেও আমরা মিশে যেতে দেখলাম সমকাল থেকে শূন্যে। অর্থাৎ শাশ্বত বলে সত্যিই কিছু নেই। আগে ভাবতুম ‘বিস্মৃতি’ নামের শব্দটা লিটিল ম্যাগের লেখক কবি কিংবা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাওয়া অপ্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকদেরই একমাত্র ললাট লিখন কিন্তু আনন্দ বাগচীর মত প্রাতিষ্ঠানিক একজন বহুকলমীর ধীরে ধীরে একটানা জ্বলতে থেকে আকস্মিক ফুরিয়ে যাওয়া যেন বারবার মনে করিয়ে দেয় ক্ষণকালের জড়ত্ব অতিক্রমী কেউই নন। কিন্তু পুনরজ্জীবন ও পুনর্মূল্যায়ন অবশ্যই আছে এবং সেটা স্রষ্টার থেকেও সৃষ্টির, যা ভেসে থাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝামাঝি কোনো এক ঘুরন্ত সময়চক্রে। না হলে আজ আনন্দ বাগচীর কবিতাগুচ্ছ বাকের হারানো কবিতায় সাজাতে সাজাতে যখন চোখে পড়ল কবি সেই কোন কালে লিখে গেছেন অনন্ত কালের ভাষা-“ জন্ম মৃত্যু নয়, শেষ কথা বুঝি চুপ করে থাকা”- একদা বিস্মৃতপ্রায় কবিতাটির ওপরেই বসানো রয়েছে অবিকল একটি মহাকালীন অনুভবরঞ্জিত আদল। স্নায়ুমূর্চ্ছনার মত বিস্মৃতির অন্ধকার দরজা ফুঁড়ে যখন তার মধ্যে আমরা ফিরে ফিরে আসি তখন বুঝি এ গল্পটির যে পটভূমি তার কোনো শেষ ছিলনা, যিনি হারিয়েছেন তিনি আজ অন্ধকারে আর যিনি দেখছেন তিনি যেন আলোতে বসে দুজনে দুজনের ঋণ মেটাচ্ছেন শুধু।

কবিতা/৫

গলি

হিংস্র অন্ধকারের জঠরে

পাক খায় অতটুকু গলি ; সেই গলির কোটরে

বন্দী এক পাখির জীবন !

ছোট পাখি । ডানা নাড়ে কোনমতে বাঁচার মতোন ।

আকাশে অনেক তারা। ঝিকিমিকি জোনাকি প্রহর !এখানেও ছোট ঘর । আর সেই পাখিটার কেঁপে যাওয়া স্বর ।

অনেক আলোক বর্ষ ঘুরে

সময় উড়িয়ে যায় হিমঝুরি হাওয়া ফুরফুরে !

এ আকাশ উড়ে যায় সূর্য ছুঁয়ে আরেক সূর্যতে ;

ভাড়াটে খাঁচার কোণ হতে ;

পাখির চিকন ডাক নাম হতে নামে উড়ে যায় ।

গর্ভিনী গলিটা ঘামে হিমেহিমে শীতের সন্ধ্যায়

গুমোট গোঙানিটুকু ঝাপটায় ডানা

অবিকল ছোট এই পাখির মতোন রাতকানা !

আমি সেই পাখি,

বধির আস্বাদ বাঁধি একটি নিবিড় নীড় মনে মনে নাকি !


বকুল-জ্যোৎস্না

তারা শুধু ফিরবে না, শিলাবতী পৃথিবীর রাত

সময়ের শব-ছায়া বুকে বয়, জোনাকির পাখা

শোনা যায় জ্যোৎস্নায় পুড়ে গেছে, সুখচোরা হাত

অঘ্রাণের অন্ধকারে ঘেমে ঘেমে ফিরে গেছে ফাঁকা ।কিছু সে পায়নি জানি, কিছু তার জমেনি সঞ্চয়

জীবনে বলার মত, রাত্রি জাগা বৃথা গেছে তার

এ রকমই মনে হয়, তবু সে নিজেকে করে ক্ষয়

বসন্তে শরতে হিমে ভরা-বাদরের রাতে আর ।


তারা শুধু ফিরবে না; বর্ণ-বৃত্তে ঘিরেছিল যারা,

গন্ধসুরা ওষ্ঠে তুলে ধরেছিল যারা কোন রাতে,

স্বাদিত সে সন্ধ্যারাগ আজ নেই, হল শ্রান্ত ধারা

শ্রাবণের মেঘ, জানি কেউ হাত রাখবে না হাতে।

সে-ফাল্গুনী মুছে গেছে, মাঘ-ম্লান কুয়াশার রাতে

তবু বুকে গান, কবি, বেঁধে নাকি বকুল-জ্যোৎস্নাতে ?                                         

তারা নেই

এই সব দ্রুতপদ পথের বিনুনি ভেঙে আমি

সারারাত ঘুরে ঘুরে দূরে কাছে অসংখ্য সর্পিল

স্নায়ুর ঝংকার-শ্লথ অলিগলি হেঁটে হেঁটে শুধু

আমার পিছনে এক বকুল-ব্যাকুল দীর্ঘশ্বাস

অনুভব করে গেছি, ছদ্মবেশ উন্মোচন কামী

অন্ধমীড়ে ভেঙে-পড়া শরীরের শিথিল আক্ষেপ

চোখ-ঠাসা ঘুম নিয়ে গ্যাসের পান্ডুর আলেয়ায়

সারারাত কাঁদে মন,কাঁদে রাত, ক্লান্তির করাতে

রক্তাক্ত প্রহর সব কৃষ্ণচূড়া হয়ে ফুটপাথে

ঝরে পড়ে রাতে ।।

দক্ষিণের বারান্দায় আসমানী শাড়ির আঁচল

আর নেই, মেয়েটার চুল গেছে কবে সময়ের

অন্ধকারে মিশে , আজ বাড়ির নম্বরে নেই প্রাণ

সময়ের সিঁড়ি বেয়ে ভাড়াটের দল নেমে গেছে

বিলুপ্তির গূঢ়-গর্তে। দ্বিপ্রহরে আজো ডাকে কাক

হয়ত বা ঠিক সেই নিমের ডালের পরে। রোদ

আশ্বিনে এখনো বুঝি গান হয়, ট্রামের লাইন

দাম্পতিক অবসাদে থেমে থাকে রাত্রির তলায়।

উত্তর চিৎপুরে এলে ঘুমছুট ত্রস্ত মাতালের

ক্লান্ত অসমাপিকা; দেয়ালে দেয়ালে

তান্ত্রিক যুবকের ইস্তাহার আঁটা হাত বুঝি

ক্লান্ত নয়, জানালায় আজো কোন কবি

কলমে গড়ায় কথা, ঘুম-কন্যা স্বপ্ন দ্যাখে রোজ !

(সব আছে, ঠিক আছে, তারা নেই । তারা শুধু নেই !)

কালিঘাটের পট


বাণিজ্যে ডুবেছে নৌকো; মাথা নিচু অন্ধকার ঘ এ

সমর্থ বধূর বুকে পিদিমের আলো এসে পড়ে,

অশ্লীল খেউড়ে ভাসে চতুর্দিক, ঘরের পিছনে

নোংরা পাক, কচুবন,বুনো মশা, প্রথম যৌবনে

ঝুঁকে পড়লে ছায়া পড়ে কুয়োতলায়; বুকচাপা জল,

মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা, লম্পট কলকাতা কাছে এলে

বিষন্ন ছবিতে ভরে বলিরেখা, বিবর্ণ পীতল

দেখবে, আঁচলে কাঁচ, অসাবধানী সোনা গেছে ফেলে ।

পটের ঠাকুর মুছে নট-নটী,পদ্মের পাতায়

ঘরোয়া চোখের জল, খুলে দেখি দরজার খিল

ব্যঙ্গের পঞ্চম শর, দুঃসাহসী নগর-নকশায়

বিচিত্র সংলাপে বাঁধা দাঁড়ে টিয়ে, খাঁচায় কোকিল,

বাণিজ্যে ডুবেছে নৌকো। কেঁদে হেসে কিংবা ভালোবেসে

বস্তুত সবাই মূর্খ তমস্বিনী বেদনায় এসে ।।


তাসের কান্না

চারখানা সাদা তাস একটি ভয়ের গল্প নিয়ে

রোজ রাতে খেলা করে, যখন সবুজ আলোটাও

নিভে যায়, ছাপা সুখ-দুঃখ নিয়ে বইয়ের কপাট

বন্ধ হয়, অন্ধকারে , তখন একটি মেয়ে তার

খোলা বুকে হাত রেখে সোনালী সাপের কথা ভাবে।


মৃগয়ার মত তার মনে মনে সারারাত কার

অশান্ত পায়ের ধ্বনি নগ্ন বেদনায় খেলা করে,

আকাশে জ্বলন্ত চাঁদ লাল অঙ্গারের মত স্থুল,

প্যাঁচা ডেকে যায় দূরে সীমাহীন রোমাঞ্চিত স্বরে।

বিছানাটা দিশেহারা লবণসমুদ্র চারপাশে।

এই সমুদ্রের কূলে অমনস্ক আঠার চৈত্রের

একটি পিপাসা ছিল, দ্বীপের মতন এই ঘরে,

অরণ্যের সন্মোহন, তবু তার বেলা চলে গেল,

চারখানা সাদা তাসে জীবনের অনেক সঙ্কেত

চোরা আলো ফেলে গেল, বাইরে আঠারো অন্ধকার।

শুভ্র বুকে রাঙা নখ আপন আত্মার ছবি দেখে

চমকে গেছে, মনে মনে সরীসৃপ আত্মলুন্ঠনের

রমনীয় ব্যাকুলতা, কান্নার করুণ নদী লীন

তার ভীরু কটির প্রান্তরে । দুঃখ কী যেন না পেয়ে।

সোনালী সাপের কথা তাই ভাবে একা একা শুয়ে



                 আশি বছরের সামগ্রিক জীবনে এপার ওপার দু বাংলারই আজ হয়ত কেউ কেউ তাকে ঔপন্যাসিক কিংবা জমজমাট কিশোর সাহিত্স্রষ্ঠা হিসেবে কখনও সখনও স্মৃতিচারনা করেন, কিন্তু কজন মনে রাখেন এই আনন্দ বাগচীর সাহিত্য জীবনের শুরু কবিতা দিয়েই ! চিরকালীন বাংলা কবিতার আলোচনাপ্রসঙ্গে কজনই বা উদ্ধ্বৃত করেন তাঁর অমোঘ পংক্তিদের! যেখানে আঁকা আছে একটি একা মানুষের ছবি , যে রাত জেগে পড়া করে লন্ঠনের স্তিমিত আলোয় আর পাখির বাসার মত ঘরে লুকিয়ে রাখে অস্তিত্বের চিরকালীন অনুনাদগুলি। এই একা মানুষের নাম কাউকে বলেননি আনন্দ, কোথাও লিখেও রাখেননি ,খালি আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে গেছেন সে তাঁর গোপণ কথা। এ গোপন কথা কি আমাদেরও নয়? আদিগন্ত জীবন মৃত্যুর খেলায় দাঁড়িয়ে আজও কি পৃথিবীর পথে পথে আমরা খুঁজি না সেই একা মানুষটিকে? হয়ত হাজার লক্ষ্য নিযুত কোটি বছর পরে সে আমাদেরই সরল সন্তানদের ষড়রিপু বেয়ে বেয়ে উঠে আসবে একই স্বনন খুঁজে। আসলে এখানেই একটি কবিতার কবিতা থেকে কিংবদন্তী হয়ে ওঠা। স্বয়ং কবিতাটি নয় বরং তার মধ্যবর্তী ইমেজারি গুলোর সাথে কোথাও যেন এক ধরনের যুগোত্তীর্ণ টান এভাবেই ভেসে ভেসে ওঠে অতল থেকে। আনন্দ বাগচীর কবিতায় জীবনানন্দীয় ইন্দ্রিয়বেদত্তা লক্ষ্য করা গেলেও তাকে হয়ত সুররিয়ালিস্ট তকমা দেওয়া যায়না বরং বোধের চেয়েও সেখানে পংক্তির ফাঁকে ফাঁকে লেগে থাকা সচেতন চিত্ররূপময়তা মায়াবী জাদুবলে পাঠককে ধরে রাখে।ছবি প্রসংগে যামিনী রায়কে লেখা চিঠিতে একবার রবীঠাকুর লিখেছিলেন-“ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারে আমাদের জীবনের উপলব্ধি। এজন্য তার একটি অহেতুক আনন্দ আছে। চোখে দেখি- সে যে কেবল সুন্দর দেখে বলি, খুশি হই, তা নয়। দৃষ্টির ওপরে দেখার ধারা আমাদের চেতনাকে উদ্রেক করে রাখে। সে রূপের রেখা এড়াবার জো নেই। যা মনকে অধিকার করে নেয় কোন একটা বিশেষত্ব বশতঃ তা সুন্দর হোক বা না হোক, মানুষ তাকে আদর করে নেয়। তার তার চারদিকের সৃষ্টির ক্ষেত্রকে পরিপূর্ণ করতে থাকে।“- আনন্দ বাগচীর প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই আমরা এমনই একটা করে দেখার প্রেক্ষাপট দেখতে পাই। তার চারপাশের সমস্ত পার্থিব সমস্ত প্রকৃতিকে কবি যে কেবল নিরীক্ষা করেছেন তা নয় বরং স্থল জল অন্তরীক্ষের একটা সম্পূর্ণ ক্যানভাস যেন তার বেশিরভাগ কবিতার পান্ডুলিপি হয়ে ঊঠেছে। এক একটা ছবি যার দৃশ্যগুন কেবল সময়ের নয় বরং আবহমানের দরখাস্ত জমা করে গেছে পাঠকের হাতেও। “স্যানিটোরিয়ামের চিঠি” কবিতায় আনন্দ বাগচী লিখলেন- “ পনের নম্বর বেড খালি হল। আটমাস পরে আজ রাতে/ বিছানা সরানো হলো,চ্যাপ্টা, বেঁটে ওষুধের শিশি/ মেজার গ্লাসের পাশে সারি সারি সাজানো, শিয়রে/ রিপোর্ট টেবলখানা, এখনো রয়েছে, কাল ভোরে/ সমস্ত অদৃশ্য হবে, সাদা একটি চাদর বিছিয়ে/ মৃত্যুকে আবার ঢেকে দেওয়া হবে, নতুন মানুষ বাসা বাঁধবে” ; আবার “অন্যমনে” কবিতায় তিনি লিখলেন- ‘পড়েছ অস্ফুট ছায়া মুখে চোখে পিছল বুকের/ঘাটে ঘাটে, যৌবনের বেলা যাচ্ছে কাজলা দীঘির/ জল কাঁপছে থিরথিরিয়ে , জলে ঢেউ দিও না, দিও না,/ দোলন চাঁপার মত একটি সুখের /ছায়াকে ভেঙ্গো না তুমি এই পাতাঝুরির শিশির”- জীবন থেকে মৃত্যু সমস্ত রংগুলোকেই যেন যত্ন করে অক্ষরে বিন্যাস করেছেন আনন্দ। তাঁর কাব্যের নিবিড় পাঠে আমরা একধরনের প্রতীকবাদ লক্ষ্য করতে পারি যেখানে কবি গন্ধকে স্পর্শে স্পর্শকে দৃশ্যে দৃশ্যকে শব্দে শব্দকে ধ্বনিতে পরিনত করেছেন অনায়াসে, যার ফলে অক্ষরের মাঝে উঠে আসে দৃশ্যের প্রত্যক্ষতা। প্রতীকের মধ্যে দিয়ে তিনি যে জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন সেখানে রয়েছে অনুভূতির বিপুলতা; আর এই দৃশ্যান্তরের শেষে এসে পাঠকও যেন জীবনের মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার রসদ খুঁজে পায়; শুরু হয় কবিতার পুনরুজ্জীবন। 


মনীন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন না-“উৎকৃষ্ট কবিতার দুর্মর জীবনীশক্তি অনেকটা যেন সেই বিশুষ্ক পদ্মবীজের মতো, যা হাজার হাজার বছর পরেও অনুকূল ক্ষেত্রে পুঁতলে আবার বেঁচে ওঠে, ফুল ফোটায়”-হয়ত আনন্দ বাগচীর বিস্মৃতপ্রায় এসব কবিতার কাছেও যোগ্য পাঠক ফিরে ফিরে আসবে একদিন নতুন অনুসন্ধান নিয়ে নতুন পূনর্মূল্যায়ন নিয়ে। হয়ত সেদিন ভুল প্রমানিত হবে কবির নিজেরই পংক্তি- “তোমার ভেজানো দরজা ঠেলে/ কেউ আসবে না,বোকা, কেউ কি নিজের কাজ ফেলে/ খেয়ালের কথা রাখে ?















==================================