ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ব বিশারদ, সামরিক নীতি নির্ধারক এবং লেখক। তাকে লরেন্স অব অ্যারাবিয়া নামেও ডাকা হয়, তিনি নিজ নামের আদ্যক্ষর টি.ই. ও বেশ পছন্দ করতেন। তিনি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ সামরিক তৎপরতা চালিয়েছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উসমানীয় খিলাফতের বিরুদ্ধে অভিযানে আকাবা বিজয়। সে সময়ে মধ্য প্রাচ্যের সামরিক তৎপরতা নিয়ে লিখেই তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। তাকে মধ্যপ্রাচ্য তথা আধুনিক আরব বিশ্বের জনক বলা হয়.
লরেন্সের বাবা স্যার টমাস চ্যাপম্যান এবং মা সারা ম্যাডেন। ম্যাডেন ওয়েস্টমিথে চ্যাপম্যানের কন্যাদের পরিচারিকা ছিলেন। এই পরিচারিকাকে নিয়েই চ্যাপম্যান আয়রল্যান্ড থেকে পালিয়ে আসেন। তাদের ঘরে পাঁচ সন্তানের জন্ম হয় যার মধ্যে লরেন্স দ্বিতীয়। ১৮৯৬ সালে পরিবারটি অক্সফোর্ডে স্থায়ী হয় এবং লরেন্স সেখানেই হাই স্কুল এবং জেসাস কলেজে পড়াশোনা করে। তার প্রথম আগ্রহের বিষয় ছিল মধ্যযুগের সামরিক স্থাপত্য। ফ্রান্স, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনে ক্রুসেড যোদ্ধাদের সামরিক দুর্গ বিষয়ে অধ্যয়ন করে তিনি একটি অভিসন্দর্ভ লিখেন যা তাকে ১৯১০ সালে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে সম্মান সহ ডিগ্রি এনে দেয়। ১৯৩৬ সালে তার এই অভিসন্দর্ভটি "ক্রুসেডার ক্যাসেল্স" নামে প্রকাশিত হয়। অবশ্য বইটি বেনামে প্রকাশিত হয়েছিল। অক্সফোর্ডের প্রত্নতত্ত্ববিদ ডেভিড জর্জ হোগরাথের অনুগ্রহে তিনি ম্যাগডালেন কলেজ থেকে ভ্রমণ ফেলোশিপ পান। এই ফেলোশিপ নিয়ে ইউফ্রেটিস নদী তীরের কার্কেমিশে যান। উদ্দেশ্য ছিল সেখানে হিত্তীয়দের ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা খননের মাধ্যমে উদ্ধার করা। ১৯১১ থেকে ১৯১৪সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রকল্পে কাজ করেন। প্রথমে হোগরাথের অধীনে কাজ করলেও পরবর্তীকালে ছিলেন লিওনার্ড উলির অধীনে। যখন কোন কাজ থাকতো না তখন তিনি নিজের খেয়ালে আশেপাশের অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন, ভাষা এবং জনগণ সম্বন্ধে ধারণা লাভের জন্য।
১৯১৪ সালের প্রথম দিকে লিওনার্ড উলি এবং ক্যাপ্টেন এস এফ নিউকম্বের সাথে সিনাই-এর উত্তরাঞ্চলে অভিযানে বের যান। এর অবস্থান সুয়েজের পূর্বদিকে তুর্কী সীমান্তের কাছে। বৈজ্ঞানিক অভিযান হলেও এর মাধ্যমে মূলত গাজা থেকে আকাবা পর্যন্ত মানচিত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। অর্থের যোগান দিয়েছিল "প্যালেস্টাইন এক্সপ্লোরেশন ফান্ড"। এই মানচিত্র নির্মাণের কাজ পরবর্তীকালে তাকে প্রভূত সহায়তা করেছিল। এই অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনা ও কার্যকারিতা লিখেন লরেন্স ও উলি একসাথে। এটি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে এবং ১৯১৫ সালে "দ্য ওয়াইল্ডারনেস অফ জিন" নামে প্রকাশিত হয়।
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পর লরেন্স লন্ডনের যুদ্ধ বিষয়ক দপ্তরের মানচিত্র বিভাগে বেসামরিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার দায়িত্ব ছিল সিনাইয়ের এমন একটি মানচিত্র প্রস্তুত করা যা যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে দেবে। ১৯১৪ সালের মধ্যে তাকে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কায়রোতে বদলি করা হয়। আরব সংক্রান্ত বিষয়াদিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তির যথেষ্ট অভাব ছিল, তার উপর লরেন্স স্বয়ং তুর্কী অধিকৃত আরব ভূমিতে ভ্রমণ করে এসেছেন। তাই কায়রোতে তার কাজের মধ্যে ছিল গোয়েন্দা তৎপরতায় সাহায্য করা, বন্দীদের সাক্ষাৎকার নেয়া, মানচিত্র অঙ্কন, শত্রু সীমানার ভিতরে অবস্থানরত গুপ্তচরদের থেকে আসা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং তুর্কী সেনাবাহিনীর উপরে একটি হ্যান্ডবুক তৈরী। তার এখানকার কার্যকাল প্রায় এক বছর। ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তার দু ভাই, উইল ও ফ্র্যাংক ফ্রান্সে যুদ্ধাবস্থায় মারা যায়। লরেন্স বুঝতে পারেন, সেখানকার থেকে পশ্চিম অনেক বেশি উত্তাল।
সে সময়ে মধ্য প্রাচ্যে সামরিক তৎপরতা পরিচালনার জন্য ব্রিটিশরা মিশরকে ব্যবহার করতো। কায়রোতেই ছিল সামরিক বাহিনীর দপ্তর। ব্রিটিশ রাজনৈতিক কূটনীতিবিদ লরেন্সকে মধ্য প্রাচ্যে যাবার জন্য রাজী করান। লরেন্সও বুঝতে পেরেছিলেন, তুরস্কের সাথে জার্মানির মৈত্রীর রহস্য ও অগ্রগতি আবিষ্কার করতে হলে এর বিকল্প নেই। এ উদ্দেশ্যে ১৯১৬ সালের অক্টোবরে লরেন্স কূটনীতিক স্যার রোনাল্ড স্টর্সের সাথে এক অভিযানে আরবে যান। মক্কার আমীর হুসাইন ইবন আলি জুন মাসে তুর্কীদেরবিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন যাকে আরব বিদ্রোহ নামে অভিহিত করা হয়। স্ট্রর্স ও লরেন্স হুসাইনের এক পুত্র আবদুল্লাহ'র সাথে কথা বলে এবং অপর পুত্র ফাইসালের সাথে বিস্তারিত আলাপ করার অনুমতি পায়। ফাইসাল মদিনার দক্ষিণ-পূর্বে এক আরব বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল। নভেম্বরমাসে লরেন্স কায়রোতে ফিরে এসে সেখানকার সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, আরব গোত্রগুলোর সাথে সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে স্বর্ণ এবং সম্পদের বিনিময়ে তাদের মন জয় করতে হবে এবং তাদেরকে স্বাধীন আরবের স্বপ্ন দেখাতে হবে। কায়রো থেকে তিনি মদিনার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং সেখানে গিয়ে ফাইসালের সেনাবাহিনীতে লিয়াজোঁ ও রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন।
যুদ্ধ থেকে ফিরে লরেন্সের মূল কাজ ছিল কূটনীতিক, শিক্ষার্থী এবং গবেষক হিসেবে। ১৯১৯ সালে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আরবের স্বাধীনতার জন্য লবিং করেন এবং এরপর সিরিয়া ও লেবাননকে সমগ্র আরব থেকে পৃথকীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। অবশ্য এ অবস্থান ছিল অনেকটাই দুর্বল। একইসাথে তিনি নিজের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার কাজ চালিয়ে যান। এ কাজ ছিল অক্সফোর্ডের অল সোল্স কলেজের ফেলোশিপ নিয়ে করা গবেষণার অংশ। সাত বছরের জন্য এ ফেলোশিপ লাভ করেছিলেন এবং তথ্য জোগাড়ের কাজ করেন ১৯১৯ সালের নভেম্বরে। এরই মধ্যে তার যুদ্ধ কাহীনী জনপ্রিয় হয়ে উঠে। লাওয়েল টমাস নামক এক মার্কিন যুদ্ধকালীন সাংবাদিক ও প্রতিবেদক তার উপরে বিশেষ সচিত্র বকতৃতামালা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল, "উইথ অ্যালেনবাই ইন প্যালেস্টাইন অ্যান্ড লরেন্স ইন অ্যারাবিয়া"। এই সচিত্র প্রতিবেদন তাকে পরিচিত করে তোলে এবং জনপ্রিয় বেশ কিছু অনুষ্ঠানের জন্ম দেয়।
যুদ্ধ বিষয়ক দপ্তরে তার বন্ধু স্যার ফিলিপ চেটউডের সহায়তায় ১৯২৩ সালের ১২ই মার্চ রয়েল ট্যাংক কর্পস-এ প্রাইভেট (সাধারণ সৈনিক) হিসেবে যোগ দেন। এর আগে বিমান বাহিনীতেও তিনি প্রাইভেট ছিলেন। বেশ আশ্চর্যের বিষয়, এক সময়ের লেফটেন্যান্ট কর্নেল লরেন্স হলেন প্রাইভেট। প্রথমে বিমান বাহিনীতে প্রাইভেট হিসেবে তিনি জন হিউম রস নামধারণ করেছিলেন, আর এবার ট্যাংক কর্পসে প্রাইভেট হিসেবে "টি ই শ" নাম ধারণ করলেন। তার মতে হঠাৎই এ নামটি তার মনে আসে। এর সাথে অবশ্য একটি কাকতাল রয়েছে। ১৯২২ সালেই লরেন্স জর্জ বার্নার্ড শ'র সাথে পরিচিত হন এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। আর ১৯২৭ সালেই লরেন্স আইনগতভাবে টি ই শ নামটি গ্রহণ করেছিলেন। ডর্সেটের কোভিংটন ক্যাম্পে রিপোর্ট করার মাধ্যমে তিনি "ক্লাউড হিলের" পাশে একটি বাড়ি পান। এ বাড়িতেই জীবনের বাকিটা সময় ছিলেন। বন্ধুদের পরামর্শে ডর্সেটে বসে তিনি সেভেন পিলার্স বইয়ের আরেকটি সংস্করণ প্রস্তুত করেন। এই বন্ধুদের মধ্যে বার্নার্ড শ'ও ছিলেন। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত এই সংস্করণটির মাত্র ১২৬টি কপি প্রকাশিত হয় এবং সবগুলোও বিশেষভাবে চিত্রিত ছিল।
লরেন্সের শেষ জীবন কেটেছে রাজকীয় বিমান বাহিনীর সিপ্লেন এবং সমুদ্রগামী জাহাজকে ঘিরে। অবশ্য তাকে উড়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। এয়ারক্রাফ্টম্যান হিসেবে তিনি ইংলিশ চ্যানেল থেকে উত্তর সাগর অবধি গিয়েছেন। এসময় উচ্চ গতিসম্পন্ন সিপ্লেন-টেন্ডার ওয়াটারক্রাফ্টের উপর কাজ করেন এবং এগুলো ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারকারী ম্যানুয়াল প্রস্তুত করেন। ১৯৩৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিমান বাহিনীর চাকুরি ছেড়ে ক্লাউড্স হিলে ফিরে আসেন। ৪৬ বছর বয়সী লরেন্সের মনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন যা মূলত নতুন নতুন প্রকাশনাকে ঘিরে। অবশ্য তার মনে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছিল। তার বন্ধু লেডি অ্যাস্টরকে এ সম্বন্ধে বলেছিলেন, "there is something broken in the works . . . my will, I think"। ১৩ই মে এক মোটর গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হন। দুর্ঘটনার পর আর জ্ঞান ফিরেনি এবং ৬ দিন পর মৃত্যুবরণ করেন। তার ভবিষ্যতের সকল সমস্যার অবসান হয় সেই সাথে।
চলচ্চিত্র
১৯৬২ সালে ডেভিড লিন পরিচালিত ইংরেজ চলচ্চিত্র লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া মুক্তি পায়। লরেন্সের জীবনী নিয়ে নির্মিত এই মহাকাব্যিক চলচ্চিত্রে লরেন্সের চরিত্রে অভিনয় করেন পিটার ও'টুল। অবশ্য টুলের উচ্চতা বাস্তবের লরেন্স থেকে বেশি।
১৯৯০ সালে আ ডেঞ্জারাস ম্যান: লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া নামে একটি টেলিভিশন চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এতে লরেন্সের চরিত্রে অভিনয় করেন "রাল্ফ ফিয়েনেস"। তার উচ্চতাও বাস্তবের লরেন্সের থেকে বেশি।
১৯৯২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত টেলিভিশন সিরিজ "দ্য ইয়াং ইন্ডিয়ানা জোন্স ক্রনিক্ল"-এ লরেন্সের চরিত্র রয়েছে। সেখানে এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন জোসেফ বেনেট ও ডগলাস হেনশল।
১৯৮২ সালের টেলিভিশন সিরিজ "ভয়েজার্স!"-এ লরেন্সের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাডসন স্কট।
রচনাবলী
লরেন্সের লেখা
সেভেন পিলার্স অফ উইজডম - আরব বিদ্রোহের সময় লরেন্সের অভিজ্ঞতা
রিভল্ট ইন দ্য ডেজার্ট - সেভেন পিলার্স অফ উইজডমের সংক্ষেপিত রূপ।
দ্য মিন্ট - রাজকীয় বিমান বাহিনীতে কর্মজীবন নিয়ে
ক্রুসেডার ক্যাসেল্স - লরেন্সের অক্সফোর্ড অভিসন্দর্ভ
দ্য অডিসি অফ হোমার - গ্রিক থেকে লরেন্সের অনুবাদ
দ্য ফরেস্ট জায়ান্ট - অঁদ্রি লা ক্যোবুর ফরাসি ভাষার উপন্যাসের অনুবাদ
দ্য লেটার্স অফ লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া - ম্যালকম ব্রাউন কর্তৃক নির্বাচিত ও সম্পাদিত
দ্য লেটার্স অফ টি ই লরেন্স - ডেভিড গার্নেট সম্পাদিত
লরেন্স সম্বন্ধে লেখা
লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া অ্যান্ড হিজ ওয়ার্ল্ড - রিচার্ড পার্সিভাল গ্রেভ্স লিখিত
লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া: দ্য ব্যাট্ল ফর দ্য অ্যারাব ওয়ার্ল্ড - জেমস হস পরিচালিত
টি ই লরেন্স বাই হিজ ফ্রেন্ড্স - লরেন্সকে যারা চিনতেন তাদের মতামত.
==========∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆==========
No comments:
Post a Comment