তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
( ২৩.৭.১৮৯৮ - ১৪.৯.১৯৭১)
********************************"**"****** Donik sabder methopath. Vol - 77.
Thursday. Dt - 23.7.2020 .
new . " Tennyson.
রক্তকরবী নাটকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মহাকবি বাল্মীকির রামায়ণ রূপকার্থের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন, এক যুগ সংঘর্ষের কাহিনী। রাম কৃষি সভ্যতার প্রতীক ।রাবণ শিল্প সভ্যতার। যজ্ঞ ভূমিকর্ষণ কালে লাঙ্গলের ফলা চিহ্ন থেকে উত্থিতা লক্ষ্মী দেবীর অংশোদ্ভূত সীতা হলেন সোনার ধান। তাকে নিয়ে যে রক্তক্ষয়ী লংকাকান্ড , অপহরণের জন্য স্বর্ণমুদ্রা স্বর্ণ মারীচের প্রলোভন এবং রাবণের শক্তির চাতুর্য্য । সেই যুগ সংঘর্ষের এবং সভ্যতা - সংঘাতের দ্বান্দ্বিক রূপ। ঠিক যেমন করে শতাব্দীপ্রাচীন অবক্ষয়িত জমিদারি প্রথার অবসানে প্রজাতন্ত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই , আধুনিক সভ্যতা- সংঘাতের দ্বান্দ্বিক রূপ, সেই রূপের রূপকার হলেন - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
" ভালোবেসে মিটল না আশ, কুলাল না এ জীবনে,হায় ! জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবনে ? " ( কবি) ।
সময়ের নিরিখে প্রথম
বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে প্রাতঃস্মরণীয় প্রথিতযশা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । যিনি বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের যথার্থ উত্তরসূরী। আবার ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকোবিদ। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার আলোকবর্ষ যখন ক্রমশ বিলীয়মান, শরৎচন্দ্রের অন্তিম যাত্রা সূচিত , সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতিতে আধুনিক পালাবদলের অস্থিরতা পরিলক্ষিত - এমনই যুগসন্ধিক্ষণের সময় পর্বে তিনি স্বমহিমায় সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হলেন।
১৮৯৮ সালের ২৩ শে জুলাই শুক্রবার ব্রহ্মমুহূর্তে জন্ম গ্রহণ করেন বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে অবক্ষয়িত জমিদার বাড়িতে। পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা প্রভাবতী দেবী ধর্ম পরায়ন ও আদর্শনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। জমিদারি নিয়ম মেনে প্রাত্যহিক তারা মায়ের পূজা অর্চনা হত। কথিত আছে জ্যেষ্ঠ পুত্রের অকাল মৃত্যুতে তারা শোকাহত হয়ে তারা মায়ের কাছে পুত্র সন্তান প্রার্থনা করেন, সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে মায়ের কৃপায় তার জন্ম হয়েছিল বলে ঈশ্বর দত্ত নাম তারাশঙ্কর। বাল্য বয়সে তিনি পিতা কে হারিয়ে মা ও বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে বড় হতে থাকেন জমিদারি কায়দায়। গ্রাম্য পাঠশালায় বাল্যকালের শিক্ষালাভ শেষ করেন । পরে ১৯১৬ সালে লাভপুর যাদব লাল হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় তিনি গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ থাকায় ১৯৩০ সালে গ্রেপ্তার হন পরে মুক্তি পান। নানা কারণে স্বাস্থ্যের অবনতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তি কামনায় জড়িয়ে পড়েন হলে পড়াশোনা শেষ হয়নি তার। ১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে যান সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করতে আগ্রহী পরে ওই বছরই তার প্রথম উপন্যাস চৈতালি ঘূর্ণি প্রকাশ পায়। কল্লোল পত্রিকায় তার "রসকলি "গল্প প্রকাশিত হয়েছে।। যা তার প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৯৪০ সালে কলকাতার বাগবাজারে ভাড়ার বাড়িতে সপরিবারে চলে আসেন। ১৯৪১ সালে তিনি বরাহনগরে বসবাস করেন। ১৯৪২ সালে বীরভূম জেলার সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন এবং ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।রাজনৈতিক মতাদর্শে তিনি একজন নিষ্ঠাবান কংগ্রেস কর্মী সেই সূত্রে সমাজ সেবা জনগণের উপকার নানান কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৫২ সালে বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী আট বছর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ১৯১৬ সালে উমাশশী দেবীর সঙ্গে শুভ পরিণয় আবদ্ধ হন। তিন কন্যা দুই পুত্রকে নিয়ে তাঁর পরিবার - বুলু, বাণী, গঙ্গা আর সরিৎ ও সনৎ কুমার। নানান কর্মকাণ্ড ও দীর্ঘ সাহিত্যকর্ম রেখে মাত্র ৭৩ বছর বয়সে ১৪ ই সেপ্টেম্বর,১৯৭১ সালে মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের পর মৃত্যু বরণ করেন।
রচনা কর্ম :
উপন্যাস :
চৈতালি ঘূর্ণি (১৯২৮), পাষাণপুরী, নীলকন্ঠ, রাই কমল ,আগুন ,ধাত্রীদেবতা ,কালিন্দী ,গণদেবতা ,কবি, পঞ্চগ্রাম ,সন্দীপন পাঠশালা ,অভিযান ,হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, নাগিনী কন্যার কাহিনী, আরোগ্য নিকেতন, সপ্তপদী রাধা, নিশিপদ্ম, একটি চড়ুই পাখি ও কালো মেয়ে, মঞ্জুরি অপেরা, ভুবনপুর হাট, ফরিয়াদ নব দিগন্ত, সুতপার তপস্যা প্রভৃতি।
গল্পগুচ্ছ :
ছলনাময়ী, জলসাঘর, তিন শূন্য, বেদেনী দিল্লিকা লাড্ডু, জাদুকরী, হারানো সুর ,রামধনু মাটি পাথর, মানুষের মন, দীপার প্রেম, এক পশলা বৃষ্টি প্রভৃতি
স্মৃতিকথা :
আমার কালের কথা, বিচিত্র স্মৃতি কাহিনী, আমার সাহিত্য জীবন ( ১ম ও ২ য়),
কৈশোর স্মৃতি।
প্রবন্ধ গ্রন্থ :
সাহিত্যের সত্য, ভারত বর্ষ ও চীন, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী।
নাটক সমূহ :
কালিন্দী, দুই পুরুষ ,পথের ডাক, বিংশ শতাব্দী দ্বীপান্তর, যুব বিপ্লব, কালরাত্রি প্রভৃতি
কাব্যগ্রন্থ : ত্রিপত্র
প্রহসন:- চকমকি
ভ্রমণ : মস্কোতে কয়েকদিন।
চলচ্চিত্রায়ন :
জলসাঘর ও অভিযান - সত্যজিৎ রায় অগ্রদানী -পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
আগুন -অসিত সেন
আরোগ্য নিকেতন -বিজয় বসু
গণদেবতা - তরুণ মজুমদার
ধাত্রীদেবতা- কালি প্রসাদ ঘোষ
রাই কমল- সুবোধ মিত্র
সপ্তপদী -অজয় কর
হাঁসুলী বাঁকের উপকথা ও বেদেনী-
তপন সিংহ । প্রভৃতি
সম্মাননা :
শরৎ স্মৃতি পুরস্কার -ক.বি ১৯৪৭
জগত্তারিণী স্বর্ণপদক- ক.বি ১৯৫৬
রবীন্দ্র পুরস্কার -১৯৫৫
সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার - ১৯৫৬
জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।
পদ্মশ্রী উপাধি ।
পদ্মভূষণ উপাধি।
অবদান :
ছোট বা বড় যে ধরনের মানুষই হোক না কেন !তারাশঙ্কর তাঁর সব লেখায় মানুষের মহত্ত্বকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক পরিবর্তনের ঘাত-প্রতিঘাতে বাস্তবসম্মত চিত্র এঁকেছেন গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে। তাই তাঁর লেখায় জায়গা পেয়েছে- বীরভূম বর্ধমান অঞ্চলের সাধারণ মনুষ্যজাতি ও উপজাতি - সাঁওতাল ,বাগদি ,বোষ্টম, বাউরী, ডোম ও কবিয়াল নানান সম্প্রদায় । গ্রাম জীবনের ভাঙ্গন কিংবা নগরজীবনের বিকাশ কোনটাই বাদ পড়েনি, মানব মনের অনুভূতির অভিসারে ।তাই পাঠকের হৃদয়াঙ্গম সহজেই ঘটে। তাঁর সাহিত্যকর্মকে চির জাগরুক করে রাখে।যেমন করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি পুতুল নাচের ইতিকথা, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী আরণ্যক ইচ্ছামতী একান্ত মৌলিক ভাবনার অভিসার তেমনি তারাশঙ্করের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা গণদেবতা পঞ্চগ্রাম একটা অস্থির সময় পর্বের প্রতিফলন যেখানে মানবীয় অস্তিত্ব নৈরাজ্য নৈরাশ্য অনিশ্চয়তা শঙ্কা ও মনস্তাপে আত্মপ্রতারণা নির্বিঘ্নে পরিণত। তাই মানিকের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের যে রোগ বিভূতিভূষণের প্রকৃতি দর্শনের সঙ্গে জীবনবোধ তাই , পাশাপাশি তারাশঙ্করের আঞ্চলিক জীবনবোধ ও সামন্তচেতনা যেন নতুন সংযোজন , যা শরৎচন্দ্রের আবেগময় উপন্যাসের মদিরতা থেকে আধুনিক জীবনবোধ রচনায় উন্নীত করে। তারাশঙ্করের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা এক মহাকাব্যিক রচনা । বিচিত্র সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বহুবিধ চরিত্রের সমাবেশে ,বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের চিরাচরিত অন্ধতা ও বিশ্বাস ফুটে ওঠে - নিবিড় ঘন বাঁশ বনের অন্ধকারে। সেই প্রাচীন অন্ধকার দুর্গ ভেদ করে শাসিত কাহার সমাজের নেতৃত্ব বনোয়ারির জীবনধারা যেন নতুন যুগের সূচনা করে। তাই লেখক যুগসন্ধিক্ষণের ও যুব সংঘর্ষের নির্মম রূপকার হয়েও সমাজতান্ত্রিক শক্তির শেষ প্রতিনিধি জমিদারি গড় ভেঙে গড়ে তোলেন যন্ত্রসভ্যতার শিল্পিত ইমারত যথার্থ জীবন সাহিত্যের প্রাসাদ ভূমি। তাই তো বলতে হয় - "His style for the most part is simple clear and vigorous."
সেক আসমত
ইংরেজি সাহিত্যে সাম্মানিক , মেধাবী ছাত্র।
No comments:
Post a Comment