জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
শম্ভু মিত্র
(২২.৮.১৯১৫ - ১৯.৫. ১৯৯৭)
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!==========!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
Doinik Sabder Methopath
Vol -107. Dt -22.8.2020
৫ ভাদ্র ,১৪২৭. শনিবার
********************//////////***************
জীবনকে তোর ভরে নিতে
মরণ আঘাত খেতেই হবে ।"
আজীবন বিশ্বাসবোধ থেকে নাট্যজগতে মাথা উঁচু করে যিনি বাঁচতে শিখিয়েছিল, সেই উদাসীন নির্লিপ্ত জীবন রসিক প্রবাদপ্রতিম নাট্যশিল্পী হলেন - শম্ভু মিত্র। গণনাট্য সংঘের শিল্পী হিসেবে নট ও নাট্যকার এবং অভিনয়ের মাধ্যমে একসময়ের থিয়েটার ও মঞ্চকে তিনি সচল রেখেছিলেন , শিল্পবোধের জন্য অগণিত মানুষের মনের মনিকোঠায় স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন- তিনি আজও।
ব্যক্তি পরিচয় -
দক্ষিণ কলকাতার ডোভার রোডে ১৯১৫ সালের ২২ শে আগস্ট তাঁর জন্ম। পিতা শরৎ কুমার মিত্র ও মাতা শতদলবাসিনী দেবী ।বাল্যশিক্ষা বালিগঞ্জ গভমেন্ট স্কুলে। স্কুল পাঠের সময় থেকে নাট্য চর্চা শুরু। অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় নাটকের প্রতি গভীর অনুরাগ, বন্ধুদের নিয়ে নাট্যচর্চার উদ্যোগ। থিয়েটারের সুপ্ত চিন্তাভাবনা। এরপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ পড়াশোনা। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে বাবা কে লুকিয়ে থিয়েটার দেখা। পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়া এবং ওখানেই পড়াশোনা ই। নাট্য রচনা ও অভিনয় করে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের চিরকালীন ঐতিহ্য ও ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।
বন্ধুদের সঙ্গে শম্ভু মিত্র
নাট্যচর্চা শুরু :
১৯৩৯ - ৪০ সাল নাগাদ রঙমহল থিয়েটারে নাট্য অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর নাট্য চর্চা শুরু । তারপর তিনি অভিনয়ের পাঠ গ্রহণ করেন কৃষ্ণ গোবিন্দ সরকারের কাছে। এই সময়ে নাট্য প্রেমী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ। ধীরে ধীরে শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও নাট্যচর্চায় অনুপ্রাণিত হতে লাগলেন। ১৯৪১ সালে যোগ দেন মিনার্ভা থিয়েটারে এবং শিশিরবাবুর সঙ্গে শ্রীরঙ্গমমঞ্চে "জীবন রঙ্গ" "উড়োচিঠি" সহ পাঁচটি নাটকে অভিনয় করেন।
রচনা সমগ্র :
১৯৪২ সালে দেশজুড়ে আগস্ট আন্দোলনের ঢেউ। জীবন যুদ্ধের স্রোতে গা ভাসিয়ে নয় , তিনি রচনা করলেন " উলুখাগড়া" নামে প্রথম নাটক। নাট্য প্রেমী সকলের মনে সাড়া ফেলে দেয় সন্ধিকালের এই নাটকটি। পরে " একটি দৃশ্যে"(১৯৪৪_৪৫), "ঘূর্ণি" (১৯৫০)," বিভাব"(১৯৫১)," অন্ধকারের নাটক"(১৯৬৪)," চাঁদ বণিকের পালা"(১৯৬৪)
বিখ্যাত নাটক, যা আকাডেমীতে প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৭৮ সালের ১৫ ই আগস্ট। "গর্ভবতী বর্তমান " (১৯৬৩) প্রভৃতি।
এছাড়া " পুতুল খেলা"," অতুলনীয় সম্বাদ ", প্রভৃতি একাঙ্ক নাটক রচনা করেন । তিনি কিছু রূপান্তরিত নাটক রচনা করেন -
"মুক্তধারা"," বিসর্জন ","ডাকঘর"," রক্ত করবী" প্রভৃতি।
অভিনয় জীবন:
১৯৪৫ সালে ১০ ই ডিসেম্বর "নবান্ন" নাটকের সহ-অভিনেত্রী তৃপ্তি ভাদুড়ীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
তৃপ্তি মিত্র
পরে ১৯৪৮ সালে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য সহ কয়েকজনের উদ্যোগে গড়ে তোলেন " বহুরূপী" নাট্যগোষ্ঠী. অমর সৃষ্টি। যা গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম নাট্যগোষ্ঠী বলে পরিচিত। প্রথম অভিনীত নাটক বিজন ভট্টাচার্যের "নবান্ন". এরপর "উলুখাগড়া ",'ছেঁড়া তার",' চার অধ্যায়' প্রভৃতি অভিনীত হতে থাকে।
' বহুরূপী' নাট্যগোষ্ঠী তো অভিনয়
১৯৫২ সালে ইবসেনের 'এনিমি আর দি পিপল" অবলম্বনে অনুবাদ নাটক " দশচক্র" অভিনীত হয় । রবীন্দ্রনাথের "চার অধ্যায় " উপন্যাসের নাট্যরূপ এর মাধ্যমে বহুরূপী নাট্য পরিক্রমা শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে "রক্তকরবী'র অভিনয়ের মাধ্যমে তা পরিণতি লাভ করে. খালের চৌধুরীর মঞ্চ, তাপস সেনের আলো এবং শম্ভু মিত্রের অসাধারণ প্রযোজনায় "রক্তকরবী" নাটক ভারতীয় নাট্যচর্চার ইতিহাসে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত করে. সমগ্র নাট্যপ্রেমী দর্শকদের কাছে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। এরপর "ডাকঘর" থেকে 'পুতুল খেলা' রবীন্দ্রনাথ থেকে ইবসেন হয় শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বে বহুরূপী ভারতীয় নাট্যচর্চা কে এক ভিন্নতর মাত্র দান করে। দান করে আত্মপ্রকাশের এক বিশিষ্ট রূপ ।একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক থিয়েটারের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করেও একান্তভাবে ভারতীয়। এরপর ষাট সত্তরের দশকে বহুরূপী তথা শম্ভু মিত্রের প্রযোজনার নানা দিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি রবীন্দ্রনাথের রাজা বা সফোক্লিসের ধ্রুপদী গ্রিক ট্রাজেডি অয়দিপাউস যেমন করেছেন তেমনি করেছেন বাদল সরকারের বাকি ইতিহাস বা ত্রিংশ শতাব্দী' কিংবা বিজয় তেন্ডুলকর এর চোপ আদালত চলছে প্রভৃতি আধুনিক নাটক । ১৯৭৮ সালে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে সংঘাত সৃষ্টি হওয়ায় তিনি চিরকালের মতো বহুরূপী ত্যাগ করেন। ১৯৭৮ সালের ১৬ জুন একাডেমিতে দশচক্র ই বহুরূপীর হয়ে শেষ অভিনয়। পরে "বিভাব " জাপানি ' কাবুকি' নাটকের অভিনব রূপান্তর করেন এবং তাতে তিনি ও তৃপ্তি মিত্র - দুজনেই অভিনয় করেন।১৯৮০ সালে বেনেডিটস এর পরিচালনায় "ক্যালকাটা রেপার্টরী' র হয়ে ' গ্যালিলিওর জীবন ' এ গ্যালিলিওর ভূমিকায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অভিনয় সর্বকালের স্মরণীয় হয়ে আছে।
রচনাশৈলী :
" শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চা ছিল জীবনচর্চা এবং জীবন চর্চা ছিল নাট্যেরচর্চা ।" নাট্যকার তাঁর রচনা রীতির মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ দিকের পরিচয় দিয়েছেন - "সবাই কেবল নিজের নিজের স্বার্থটা দেখছে দেশটার দিকে তো কেউ দেখছে না । "
সীমিত পরিসরে নাট্যকার গোটা সমাজ ব্যবস্থাও মানুষের অবক্ষয়ের চিত্র, নিষ্ঠার সঙ্গে রূপায়িত করেছেন। নাটকের মধ্যে জীবনবোধ ছিল গভীর। তিনি লিখেছেন -
" নাট্যকলার কেন্দ্রে আছে মানুষ". তিনি সমাজের বিরোধী হয়ে সুবিধা বাদীদের প্রতি কটুক্তি করেছেন -
" নিজের কাছে যা আশা করা যায় না
তা সমাজের কাছে ও আশা বৃথা।"
তিনি এ উপলব্ধি করেছেন সমাজ যত আধুনিকতার দিকে এগোচ্ছে তত টা প্রাণহীন ও কৃত্রিম হয়ে পড়ছে।
সম্মাননা :
শম্ভু মিত্র বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন উপাধিতে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ। ১৯৭৬ সালে ম্যাগসাইসাই, ১৯৮৩ সালে বিশ্বভারতী র দেশিকোত্তম। এছাড়া সম্মানিত হয়েছেন সংগীত- নাটক একাডেমি, কালিদাস ইত্যাদি পুরস্কারে।
শেষ সময়ে কন্যা শাঁওলি মিত্র
শাঁওলি মিত্র
' নাথবতী অনাথবৎ ' এর পশ্চাৎপটে থেকেছেন তবুও তাঁর আত্মমর্যাদা তিনি উল্লেখ করে গিয়েছিলেন এই নাটকে । সকলের অজান্তেই তাঁর ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী মৃত্যুর পরের কাজ সারা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ১৯ ই মে এই নাট্যশিল্পী , নতুনযুগ নিয়ে আসার, নতুন ভাবনা ভাবতে শেখানোর মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আজ শতবর্ষ পেরিয়ে এই নাট্যকার, অভিনেতা সকলের মনে সমানভাবে উজ্জ্বল ।তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি, একজন নাট্যপ্রেমী নাট্যমোদী দর্শক হিসেবে। বাংলা নাটকের আধুনিক শিল্পসম্মত রূপকার যিনি, না থেকেও এখনো নাট্যপ্রেমী দর্শকের অন্তরে -'গোপন আনন্দে' স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন।
পিতা শম্ভু মিত্র ও কন্যা শাঁওলি মিত্রের
একত্রে অনুষ্ঠান।
বিনীতা জানা
গবেষণারত মেধাবী ছাত্রী।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment