জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
নবনীতা দেব সেন
==========®®®®®®========≠======
Doinik Sabder Methopath
Vol -250. Dt -13.01.2021
২৯ পৌষ,১৪২৭. বুধবার
*****************************************
"দুই হাত বাড়িয়ে বললুম
কে আছ ? কোলে নাও।
তুমি কোলে নিলে।
...............................
দুর্বার ছড়িয়ে পড়লুম
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে রেণু রেণু হয়ে মিলিয়ে গেলে
তুমি
আমার প্রথম ও একমাত্র
আশ্রয়। "
আধুনিক জটিল জীবনযন্ত্রণার নিঃসঙ্গতাবোধ ও অতীতচারী মনোভাব কবির নিজস্বতাকে চিনিয়ে দেয়। গভীর জীবন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি বাস্তব প্রেক্ষাপট বলেন -
" আসল কথাটা আর জানা হয় নি
জেনেছি এদিক সেদিক আশপাশ ছালবাকল
জেনেছি পূর্ব এবং পাশ্চাৎ
আসল কথাটি কেবল জানা হয়নি।"
তিনি নবনীতা দেবসেন। ১৩ জানুয়ারী ১৯৩৮ সালে দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্থান পার্কে তার বাবা- মা'র 'ভালবাসা' গৃহে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা নরেন্দ্র দেব ও মাতা রাধারানী দেবী সেযুগের বিশিষ্ট কবি দম্পতি। ছেলেবেলায় এক বিশেষ সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া উনি হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, ফরাসী, জার্মান, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষাগুলি পড়তে পারেন। গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস, লেডি ব্রেবোর্ণ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর , হার্ভার্ড, ইণ্ডিয়ানা (ব্লুমিংটন) ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন।
১৯৭৫- ২০০২ তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও বেশ কিছুকাল বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। তাকে তুলনামূলক সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট অথরিটি মানা হয়। যাদবপুরে তিনি কবি বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহধন্য ছাত্রী ছিলেন।
১৯৯৯ সালে তিনি সাহিত্য একদেমি পুরস্কার পান। তাঁর আত্মজীবনী মূলক রম্যরচনা 'নটী নবনীতা' গ্রন্থের জন্যে। এছাড়াও তিনি মহাদেবী বর্মা ও ভারতীয় ভাষা পরিষদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।২০০০ সালে উনি পদ্মশ্রী সন্মানে ভূষিত হন।
১৯৫৯ এ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম প্রত্যয়' প্রকাশিত হয় ও প্রথম উপন্যাস 'আমি অনুপম' ১৯৭৬ এ। কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস মিলে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩৮।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য - স্বাগত দেবদূত, তিন ভুবনের পারে, নারী তুমি অর্ধেক আকাশ, ভালোবাসা কারে কয়, মেদেয়া এবং, শব্দ পড়ে টাপুর টুপুর, সাত কন্যের দেশে প্রভৃতি।
তিনি নিয়মত বিভিন্ন পত্র পত্রিকা -কৃত্তিবাস, কবিতা, পুর্বাশা, শতভিষা, উত্তরা, একক, উত্তরসূরী, কবিপত্র , সাহিত্যপত্র প্রকৃতি তে
লেখালেখি করেছেন।
১৯৬০ এ তিনি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ (পরবর্তীকালে নোবেলজয়ী) অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ও তাদের দুই কন্যা। জ্যেষ্ঠা অন্তরা সাংবাদিক ও সম্পাদক এবং কনিষ্ঠা নন্দনা অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী।
লেখাপড়া, এত পাণ্ডিত্য, কখনোই ছাত্রদের কাছে খোলসা করেন নি, যেন নিতান্তই সাধারণ মানুষ, “ভালো করে মাতৃভাষা শেখো। ভারতীয় সাহিত্য সংস্কৃতি জানো।”
তিনি জানতেন। নানা দেশে, প্রতি বছর বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা দিয়ে, কলকাতায় ফিরে বলতেন, “আর ভাল্লাগে না।” না লাগলেও, তাঁরই ছাত্রী নূপুর চৌধুরি (বিয়ের পরে বিশ্বাস) একবার বলেন, “দিদির ভালো না লাগার কারণ স্বদেশ-টান, মাতৃভাষা।”রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় একক। গান বাদে নবনীতার বিচরণ কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা, ভ্রমণ, আত্মকথা, শিশু সাহিত্যেও অনন্য।
এক ছাত্রের অভিজ্ঞতা -
খারাপ ছাত্রকে মাস্টাররা খুব বকাঝকা করেন, শাসন করেন। আদরও করেন, অনাদরও। একদিন বললেন, “হোস্টেলে (বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে) থাকিস, ভালো কিছু খাস না, আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসবি।” নানা পদের খাবার, নিজেরই রান্না করেন। অতিথি এক বিদেশিনীও। পরিচয় করিয়ে দিলেন, ভাষা এই, “আমার ছাত্র, খারাপ ছাত্র, ইংরেজি জানে না।” বিদেশিনীর কী কথা, সঠিক মনে নেই, একটি বাক্য কানে বাজে, “ইউ আর আ গুড টিচার, বাট ইয়োর স্টুডেন্ট ইজ নট, সো…”।
অন্য কোনো ছাত্রকে নয়, এই খারাপ ছাত্রকেই, “কাল সন্ধ্যায় বাড়িতে আসবি।” সেদিন ছিল ভাইফোঁটা। নবনীতার দুই কন্যা পিকোলো (অন্তরা দেবসেন) এবং টুম্পা (নন্দনা সেন) ভাইফোঁটা দিলেন। হয়ে গেলুম ‘দাদা’। একবার ভাইফোঁটা দিলেই দাদা। পরের বছর আবার। তার মানে, পাকাপোক্ত ‘দাদা’ হয়ে গেলুম। নবনীতা মাস্টারনি নন, ‘দিদি’ নন, হয়ে গেলেন জননী।
স্বাধীনতাপ্রিয় নবনীতার আপসহীন যাপনে অবশ্য স্বেচ্ছাচারের বিকার ছিল না। আত্মসংযমী প্রকৃতির উদাতায় তাঁর নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনন্যতা লক্ষণীয়। সে শিক্ষাও তাঁর মায়ের কাছেই পেয়েছিলেন। রাধারানি দেবী মেয়েকে আঁচলে করে মানুষ না করলেও প্রেমে স্বাধীনতা দিয়েও তার যাপনের সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় অমর্ত্য সেনের সঙ্গে নবনীতার প্রেম নিবিড় হয়ে ওঠে সেখানে মেয়ের প্রতি মায়ের নির্দেশ ছিল: ‘তিনটি জায়গায় যাওয়া যাবে না। পর্দা টাঙানো কেবিনওয়ালা রেস্তরাঁয়, সন্ধ্যার পরে লেকের ধারে আর সিনেমায়।’
সেই প্রেম বিবাহে গড়ায় ১৯৫৯-এ এবং সতেরো বছরে ১৯৭৬-এ বিবাহবিচ্ছেদও ঘটে। অথচ সেই আঘাত নবনীতাকে নারীবাদী বিদ্রোহে সক্রিয় করেনি। বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল আজীবন। ১৯৯৮-এ অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তিতে নবনীতার আনন্দোচ্ছ্বাসে অভাব ছিল না। অমর্ত্য সেনকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। আবার সে-সময়ের প্রেক্ষিতে একটি স্মরণীয় ছোটগল্পও লেখেন ‘জরা হটকে, জরা বাঁচকে, ইয়ে হ্যায় নোবেল মেরি জান’। অন্য দিকে, সেই সময়ে তাঁর সমসাময়িক বলিষ্ঠ নারীকণ্ঠ কবিতা সিংহের মৃত্যুতেও শোকপ্রকাশে এগিয়ে গিয়েছেন। সর্বত্র তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ, স্বাধীনচেতা মনের প্রকাশ, বিদ্রোহহীন বিপ্লবের প্রয়াস আজীবন সচল ছিল।
২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর ৮১ বছর বয়সে কলকাতায় তাঁর নিজের বাড়িতে প্রয়াত হন তিনি।
################################
No comments:
Post a Comment