Friday, 2 April 2021


"অতীতের ডাল-ভাত, মাছ ও মুর্গির মাংস
গরম করছি বলে ইতিহাস ঘরে এসে ঢোকে
                            দুলে ওঠে আমার এ ঘর।
বেঢপ পোশাক পরা, মাথায় মুকুট
প্রীত হয় আমার সাক্ষাতে
এমন রোদের দিন, বেলা দ্বিপ্রহর
               পরিণত হয়ে যায় থমথমে রাত-এ।
—এই নিন হাফশার্ট, জোব্বাটা খুলুন,
আমি বলি, এই নিন বুট
                পরুন পরুন।
খুশিতে আমার কাঁধে হাত দুটি রেখে ইতিহাস
বলে, তুমি তরুণ তরুণ
                            ঝক্কাস ঝক্কাস!
—জিও
দুই কাঁধে তাঁর হাত, পুনরায় উনিশ বর্ষীয়!

আমরা দুজনে বসে আহারাদি শেষ করি।
 আর তারপর
বাংলায় শুরু হয় ঝড়।"




মৃদুল দাশগুপ্ত 

১৯৫৫ সাল ৩ এপ্রিল, হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জ্যোৎস্না কুমার দাশগুপ্ত। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পূর্ণচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশনে। উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন কলেজে জীববিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হয় সাপ্তাহিক পরিবর্তন পত্রিকায়। পরে কাজ করেছেন যুগান্তরআজকাল পত্রিকাতেও।
           তাঁর প্রথম কবিতার বই জলপাই কাঠের এসরাজ ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয়। 
কবি জীবনের প্রথমে শীর্ষবিন্দু, বেলাভূমি, ভাইরাস, কৃত্তিবাস, কয়েকজন ইত্যাদি পত্রিকার নিয়মিত কবি ছিলেন।


পুরস্কার ও সম্মাননা :
১) ২০০০ সালে সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ কাব্যগ্রন্থের জন্য বাংলা অ্যাকাডেমী পুরস্কার পান।
২) ২০১২ সালে সোনার বুদ্বুদ কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান।

রচনা কর্ম:
এ ভাবে কাঁদে না
গোপনে হিংসার কথা বলি
সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ
সোনার বুদ্বুদ
ধান খেত থেকে
সাতপাঁচ
কবিতা সহায়
ঝিকিমিকি ঝিরিঝিরি
ছড়া পঞ্চাশ
আমপাতা জামপাতা
রঙিন ছড়া।


চলমান যাপন চিত্রে কবি মৃদুল দাশগুপ্ত।

১. 
হয়তো অর্ধেক পথে বাধাপ্রাপ্ত হব, পেরোব না
                                 মরু বা প্রান্তর
থেমে যাব, কখনও হব আর কোনও নদী পার
অতএব তাকাব না, ঝটিকায় উড়ে যাবে ঘর

হতে পারে তারপর আবছায়া দেখা যাবে
                                    আমাকে আবার

কোথায় কে জানে তবু চারিদিক নীল বা নীলাভ
তখন পাব না স্তন, হয়তো মেঘের গায়ে
                                   দুহাত বোলাবো

 ২.
সভয়ে আমার মন কাকুতি মিনতি করে, ছেড়ে দেয় হাল
আছাড়ি বিছাড়ি খায় দেহখানি, তবে হয়, এমন নিষ্প্রাণ
তথাপি সকল দৃশ্য
দিনরাত্রি শীত গ্রীষ্ম
অনুভূত হয় বলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে চলে কাল
আমি ক্ষত চিহ্নহীন
অতি শুষ্ক, বা রঙিন
যেখানে রয়েছি পড়ে, তা নয় শ্মশান।

আমার ওপর দিয়ে তবে কেন মেঘ যায়, ছোঁয় কেন
                                               সমুদ্রের জল
কানের ভিতর দিয়ে কেন পোকা ঢুকে যায়
               কেনবা শনাক্ত করে তারকা সকল

 ৩.
‌‍‍‍‍‍‘তুমি চন্দ্রে হাত দিয়েছিলে! গহ্বরে আঙুল দিয়ে
                                   পেয়েছিলে মধু!
চেটেছিলে চাঁদের বরফ? গড়ালে চাঁদের গায়ে, চাঁদে?
চাঁদ কী বলল, শুনি’—কন্যা জিজ্ঞাসা করে,
                          ‘বলো বলো’—হেসে বলে বধূ
চুরুট ধরিয়ে আমি ধীরে ধীরে উঠে যাই ছাদে।

‘এই তো চাঁদের লোক’—অযুত তারকারাশি একযোগে বলে
‘ওর গায়ে বালি লেগে, তা চাঁদের ওপিঠের বালি!’
‘ও চাঁদের।’ ‘ও চাঁদের’—চারিদিকে ঘন ঘন তালি
আমি উড়ে চলে যাই পুনরায় চাঁদের দখলে



৪.
যেই হস্তক্ষেপ করি তুমি বিন্দু, বৃত্তাকার হও।
হয়েই ঘুরতে থাকো, তখন বাতাস বয় শন শন শন
এ গৃহে পাড়ায় ক্রমে শহরে সদরে, টোকা দিতে
                                      পৃথিবীও ঘোরে
যেন বিপরীতে, জোরে। চন্দ্রসূর্য হতবাক হয়ে
কে আগে উদিত হবে, ভাবে।

কী কাণ্ড ঘটাও চিত্র, বিচিত্র হওয়ার পথে
                                       বন্ বন্ বন্!

গেল গেল রব ওঠে তারায় তারায় আর
                                         পাড়ায় পাড়ায়
পাহাড়ের চূড়ে যেন হায় হায়, সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে
                       হাহাকার মরু সাহারায়

পুনরায় হাত দিই, এবার এবার থামো
তখনই তো হয়ে যাও, স্তন।

 

৫.
পছন্দ হয় না বলে অপকর্মে কালি দেই ঢেলে
কী কাণ্ড প্রকাণ্ড দেশ মানচিত্র থেকে যায় মুছে
ঝপ করে নামে রাত্রি ঝকঝকে রোদের বিকেলে
সে ভয়ভীতিতে যাই অতি ঊর্ধ্বে একাকী, জাগর

তুষারে আবৃত হয় পৃথিবীর বিবিধ অঞ্চল।

একে একে সাত রাত যদিওবা যায় যায় ঘুচে
তবু না ফুরায় নিশি। মহাসূর্য করে হাহাকার
সেই ছায়া নিচে পড়ে, ক্ষোভে দোলে সকল পাহাড়

কাতর পাথর বলে, ‘থামো থামো’
অতি শূন্যে ভাসমান এক ফোঁটা জল
সে বলে, ‘এবার নামো, নইলে ধমক দেবো
                         আমি…আমি বঙ্গোপসাগর’

 

৬.
মানো বা না মানো তবে টোকা দিলে
                               ওড়ে এই ঘর
আমার এ গৃহখানি সেভাবে বানানো
তা ছাড়া বলার কথা, বিচিত্র শহর
যখন তখন রাতে বয়ে যায় জোনাকির ঝড়

এইখানে খুন হব, অথবা উল্লাসে যাব
                             জেলা কারাগারে
আমার বিশাল ছায়া তবু তো দুলবে ওই
                                   নদীর কিনারে
যে তুমি নিখোঁজ হবে, তুমি এসো
                      ঠিকানা তো জানো
আমাকে পাবে না কেউ ঘটনার পর

 

৭.
লাগো তো পিছনে লাগো গোয়েন্দা সকল
উড়ি কিনা
ডানা ছাড়া, জেট বিনা
করি কিনা দুনিয়া দখল

পিছু নাও, হাঁটো বা গাড়িতে চেপে খোঁজো খোঁজো
                                         তুমুল তল্লাশে
পদচিহ্ন আছে কিনা ঘাসে
বাতাসে গায়ের গন্ধ
কোন্ কাব্যে কোন্ ছন্দ
ধরো দেখি ছল!

কোথায় গড়ায় দেখো কোথাকার জল!

সকল সন্ধান করো, ধাও
ওই যে রোরুদ্যমানা, তার কাছে যাও

 

৮.
আবার আবার ফের পুনরায় পুনরায় ফের ফের
                                             আবার আবার
সময় হয়েছে যেন গুরুতর বিষয়ে ভাবার
শিখরে, গিরির শীর্ষে, অতলান্ত তলে বা অতলে
কোথায়বা যেতে হবে, কিভাবে যে যাব
কী দেবো তোমাকে আমি এবারের রথের মেলায়?
সে বড় চিন্তার কথা, তাও শূন্যে দপ দপ জ্বলে
যাত্রার সবুজ আলো, যে রকম পথ খুঁজে পাব
নিয়তির কোলে বসে উড়ে যাব খেলায় খেলায়
কী দেবো পৃথিবী আমি নদীতটে, সাগরবেলায়?
কী দেবো তোমাকে আমি

 

৯.
সঙ্কটে, সময়কালে কলহ-বিবাদ করো
                                    তুমিও, নীরব
ঘুমন্ত জাগ্রত দেখি কুকথায় ছোড়ো হস্তপদ
তবে তো সবাক স্তব্ধ, শাদা ধবধব
তোমার ইস্তফাপত্র দূর মহাশূন্যের সনদ।

কে পায় এবার—ভেবে অতিভারী জড়বস্তু
            কাপাস তুলোর চেয়ে ওড়ে
আগুনশলাই ছাড়া ধূম্রশলাকাখানি
                           নিজে নিজে পোড়ে

বলে চিত্র, ছোঁও ছোঁও, কাঁপে তার
                                 চক্ষুর পল্লব
পিপীলিকা দলটির শুনি কলরব

 
১০.
হয়তো অর্ধেক পথে বাধাপ্রাপ্ত হব, পেরোব না
                                 মরু বা প্রান্তর
থেমে যাব, কখনও হব আর কোনও নদী পার
অতএব তাকাব না, ঝটিকায় উড়ে যাবে ঘর

হতে পারে তারপর আবছায়া দেখা যাবে
                                    আমাকে আবার

কোথায় কে জানে তবু চারিদিক নীল বা নীলাভ
তখন পাব না স্তন, হয়তো মেঘের গায়ে
                                   দুহাত বোলাবো

 
১১.
সভয়ে আমার মন কাকুতি মিনতি করে, ছেড়ে দেয় হাল
আছাড়ি বিছাড়ি খায় দেহখানি, তবে হয়, এমন নিষ্প্রাণ
তথাপি সকল দৃশ্য
দিনরাত্রি শীত গ্রীষ্ম
অনুভূত হয় বলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে চলে কাল
আমি ক্ষত চিহ্নহীন
অতি শুষ্ক, বা রঙিন
যেখানে রয়েছি পড়ে, তা নয় শ্মশান।

আমার ওপর দিয়ে তবে কেন মেঘ যায়, ছোঁয় কেন
                                               সমুদ্রের জল
কানের ভিতর দিয়ে কেন পোকা ঢুকে যায়
               কেনবা শনাক্ত করে তারকা সকল

 

১২.
‌‍‍‍‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‘তুমি চন্দ্রে হাত দিয়েছিলে! গহ্বরে আঙুল দিয়ে
                                   পেয়েছিলে মধু!
চেটেছিলে চাঁদের বরফ? গড়ালে চাঁদের গায়ে, চাঁদে?
চাঁদ কী বলল, শুনি’—কন্যা জিজ্ঞাসা করে,
                          ‘বলো বলো’—হেসে বলে বধূ
চুরুট ধরিয়ে আমি ধীরে ধীরে উঠে যাই ছাদে।

‘এই তো চাঁদের লোক’—অযুত তারকারাশি একযোগে বলে
‘ওর গায়ে বালি লেগে, তা চাঁদের ওপিঠের বালি!’
‘ও চাঁদের।’ ‘ও চাঁদের’—চারিদিকে ঘন ঘন তালি
আমি উড়ে চলে যাই পুনরায় চাঁদের দখলে

 ১৩.
তুমি চিন্তা রূপে এসে স্ত্রী-ফড়িং উড়ে বসো ফাৎনার উপর
দিঘিজলে ছায়া পড়ে চৈত্রমাসে সূর্যাস্তবেলায়
তখন জটিল ঢেউয়ে অতীব সরল পুঁটি করে ধড়ফড়
বাকি যা বিবিধ মৎস ভয়ে চুপ তোমার খেলায়

নীলাভ রঙিন ডানা, লাজে তাতে ঈষৎ কাঁপন
অবাক শরীরখানি, টুকটুকে লাল
অতলের তলদেশে এরপর সুতো যায় শন শন শন
কে বলে অলস আমি, অযথা পুকুরপাড়ে
বসে থাকি সকাল বিকাল

 ১৪.
এই যে জগৎ দেখে নিজকানে করি ফিস ফিস
ধারণা আকার নিয়ে
উত্তর-দক্ষিণ দিয়ে
যেই ঘরে ঢুকে পড়ে
ঘোরতর জল ঝড়ে
আমাকে জাগ্রত রেখে নিদ্রা যায় মাথার বালিশ
কী করি তখন আমি
উঠি ঊর্ধ্বে নিচে নামি
দেখে এ আমার খেলা
অকারণে ভোরবেলা
খোদ সূর্য ঠুকে দেয় সদরের থানায় নালিশ
গগন-পুলিস আসে
ভরে দেয় ইতিহাসে
দামাল মেঘের দল চেটেপুটে করে দেয় আমাকে পালিশ

 ১৫.
কী করে কী হলো আমি জানি না তথাপি কোনও
                                          গোলযোগ হেতু
আমার অচেনা বলে মনে হলো আপন শহর
তখন দয়ালু এক স্ত্রীলোক বলল এসে;
                               আমি…আমি হাওড়ার সেতু
আমার ওপরে এসে পার হোন, হোক জলঝড়

আমি তাকে পেরোলাম, তবু কর্মফল
কেন ট্রেন ভুল হলো? কিছু কেন পড়ল না মনে?
কোন অলিগলি আজ নিয়ে এল হেতালের বনে?
শুঁকে কেন ছেড়ে দিল রয়াল বেঙ্গল?

      একসময় নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে তিনি দেখেছিলেন জগৎ ও জীবনকে। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত থেকে আরও নিজেকে মিলিয়ে ধরলেন প্রকৃতি পাঠশালায়, মানুষদের যাপন চিত্রে - মাটি ফুল নদী জল পাখির গান ভালোবেসে সহজ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাব্যচর্চা শুরু করলেন. কবিতার বাঁধাধরা গণ্ডিবদ্ধতায় না থেকে প্রতিবাদী মানসিকতায় নিজেকে যেমন প্রকাশ করলেন তেমনি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কবিতায় খুঁজে নিলেন নিজস্ব সংকেত। শব্দচয়নের জাদু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সৃষ্টিরহস্যে যেমন উন্মোচিত করল তেমনি তিনি মনে করেন দুর্বোধ্যতা অর্থহীনতা ও কবিতার সম্পদ কখনো হতে পারে না। কবিতার সম্পদ হয়ে উঠতে গেলে কবিতাকে পাওয়া যাবে " আপাত অর্থশূণ্য শব্দ উচ্চারনেও, এমনকি হয়ত অর্থ শূন্যতার কারণেই। শব্দ মূর্ছনাই কবিতা - বর্ণনার অতীত শব্দের জাদুতে পৌঁছানোই কবিতার কাজ।"
এখনো নিরলস তিনি কবিতার যাপন চিত্রে নিজেকে ব্যাপ্ত রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যে এসময়ের শক্তিমান কবি মৃদুল দাশগুপ্ত সকলের প্রিয়। আমরা তাঁর কবিতা আজও মুখে মুখে উচ্চারণ করি। তাঁর জীবন দৃষ্টির নানান ঘাত-প্রতিঘাতময় দর্শনে আমরা আমাদের জীবনকে জড়িয়ে,  নতুন করে কবিতার ভুবনে প্রবেশ করি।
   উনার নীরোগ ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
     শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -331.Dt -03.04.2021
২০ চৈত্র,১৪২৭. শনিবার
================================



No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...