"মেলাবেন, তিনি মেলাবেন
ঝড়ো হওয়ার আর পোড়ো বাড়িটার ,
ঐ ভাঙ্গা দরজাটা মেলাবেন "
আধুনিক যুগের বন্ধ্যাত্ব ও নিষ্ফলা যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত বিশ্বাসের জীর্ণ পৃথিবীতে কবি অন্তরের আর্তনাদে বলে উঠেছেন।
"......শত শতাব্দী
তরুণ বনশ্রী
নির্জন মনশ্রী
তোমায় শোনাই উপস্থিত ফর্দে আরো আছে
দূর সংসারে এলো কাছে
বাঁচবার সার্থকতা।"
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ ১০ এপ্রিল তারিখে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম হয়েছিল মামা বাড়িতে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে। তার পুরো নাম অমিয় চন্দ্র চক্রবর্তী।, তার পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী উচ্চ শিক্ষিত; তিনি ইংরেজিতে এম. এ. এবং বি.এল. পাস করে আসামে গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মা অনিন্দিতা দেবী ছিলেন সাহিত্যিক -- তিনি "বঙ্গনারী" ছদ্মনামে প্রবন্ধ-নিবিন্ধ প্রকাশ করতেন। তিনি সংস্কৃতে পারদর্শী ছিলেন আর চার সন্তানকে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন নিজেই। গৌরীপুরের সংস্কৃত টোল থেকে প্রখ্যাত পণ্ডিতকে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন কালিদাস, ভবভূতি, ভারবি প্রমুখের রচনা পাঠের সুবিধার্থে। এভাবেই অমিয় চক্রবর্তী শৈশবেই ব্যাকরণে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। অমিয় চক্রবর্তীর বয়স যখন অল্প তখন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অরুণ চক্রবর্তী আত্মহত্যা করে. ভাইয়ের মৃত্যুতে তীব্র শোকে আক্রান্ত হন অমিয় চক্রবর্তী। তার স্বভাবে চিরস্থায়ী পরিবর্তন আসে; চঞ্চলতা ও ক্রীড়ানুরাগ তিরোহিত হয়ে আসে অন্তর্মুখীনতা; তিনি স্বল্পবাক ও ভাবুক হয়ে ওঠেন। এরপর কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেন আর থাকতেন মামার বাড়িতে। উচ্চ শিক্ষিত মামাদের সংস্পর্শে তরুণ অমিয় চক্রবর্তীর মানস জগৎ আলোকিত হয়ে ওঠে। তার বড় মামা নিখিলনাথ মৈত্র হয়ে উঠেন তার "চিন্তা-কল্পনার প্রধান অধিনায়ক।" সঙ্গীত ও সাহিত্যে তার বিশেষ অণুপ্রেরণা ছিল। বন্ধুস্থানীয় সেজ মামা সোমনাথ মৈত্রের প্রভাবও ছিল বেশ। তিনিই অমিয় চক্রবর্তীকে বীরবল ও সবুজপত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তার ভাষায় : “সবুজ পত্রের আসরে এবং পরে বিচিত্রার সভ্যরূপে সাহিত্যে সঙ্গীতের প্রেরণা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হল।”কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর হাজারিবাগে আইরিশ মিশনের সেন্ট্ কোলাম্বাস কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, বটানিতে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই বিশ্বভারতীর কাজে কর্মে জড়িয়ে পড়লেন ঘনিষ্ঠভাবে। ফলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার যে আশৈশব স্বপ্ন তার ছিল তা’ এক নিমেষে উবে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হলো সংর্কীণ। তিনি এম. এ. পরীক্ষা দিলেন বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে নয়, পাটনায় প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে। শেষাবধি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রী লাভ করেন তিনি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। অবশ্য পরে আবারো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হয়। তিনি বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়ল কলেজের ছাত্র হিসেবে ১৯৩৪-৩৭ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন, কবি টমাস হার্ডির কাব্য নিয়ে গবেষণার জন্য ডি. ফিল. লাভ করেন ১৯৩৭-সালে.অমিয় চক্রবর্তী তিরিশের অন্যান্য কবিদের তুলনায় ভিন্নরূপ ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন।
শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন: “অমিয়-র কোনো নিজস্ব পত্রিকা অথবা গোষ্ঠী ছিল না। ক্ষীণকায় মৃদুভাষী মানুষটির কিছু গভীর প্রত্যয় ছিল, কিন্তু বিতর্কে তিনি অনাগ্রহী অথবা আস্থাহীন। অপরপক্ষে জীবনানন্দের মতো তিনি সঙ্গ-বিমুখ ছিলেন;- বস্তুত নরনারী, পশুপাখি, শহরগ্রাম, বিশ্বের বিচিত্র অধিবাসী এবং বিভিন্ন অঞ্চলের হরেক রকম প্রাকৃতিক রূপ সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল ছিল অপরিসীম। সঙ্গ ভালোবাসতেন, কিন্তু সব সময়েই মনে হয় তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্র এক গভীর নিরাসক্তি তাঁকে সচল রাখত। প্যাশন বা আবেগের আতিশয্যকে তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে।অমিয় চক্রবর্তী তাঁর জীবনের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট-সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তিরিশের পঞ্চকবির মধ্যে তিনি অন্যতম একজন। অন্য চারজন হলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে।
সাহিত্যের অপরিবর্তনীয় বিশিষ্টতা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন -' সাহিত্যের কাজ আজ যা, কাল ও তাই ছিল অর্থাৎ সত্য বলা সবখানেই সত্য বলা নিজের জীবনের অন্তর যোগে নিঃসৃত যে প্রকাশ সেই আন্তরিক সর্বাধিক সত্য ফুটিয়ে তুলতেই লেখক সাহিত্যিকতা ।"
তিনি ছিলেন মনুষ্যত্বের কবি. তাঁর বিশ্বাস ছিল -" মানুষের সমাজে যখন নানা উগ্র মতাবলম্বী দর্শনের প্রাদুর্ভাব হয় তখনই শিল্পসৃষ্টির প্রশস্ত কাল । রাষ্ট্রিক ও ধর্ম তাত্ত্বিকের খন্ডিত ব্যাখ্যায় জীবনের স্বপ্ন ছবি চোখে হারিয়ে যায় সেই ছিন্ন দর্শী ভিড়ে এসে দাঁড়ান কবি যিনি চক্ষুষ্মান ।সম্পূর্ণতার ফিরিয়ে আনেন তিনি একটি স্বচ্ছ স্ফটিক প্রাত্যহিক এর যথাযথ নিরীক্ষণ করা শিল্পীর ধর্ম ।"
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যার সান্নিধ্য এতোটাই ঘনিষ্ঠ ছিল, একটি চিঠিতে তিনি বলছেন - তোমার সঙ্গে এমন একটা নিবিড় যোগ হয়ে গিয়েছিল যে এ বয়সে তার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা সহজ নয় কিন্তু তরুণ জীবনকে এমন করে আঁকড়ে থাকা অত্যন্ত নিষ্ঠুর অত্যন্ত অন্যায়।"
কোভিদ মধ্যে বিশ্বব্যাপী দর্শনের নানান প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ উপমা উপকরণ আমরা প্রত্যক্ষ করি তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে কখনো বা সাধারন ব্যাকরণের নিয়ম কে উপেক্ষা করে কখনো মৌলিক বৈশিষ্ট্য তা নিয়ে আবার কখনো ছন্দের গভীর হৃদস্পন্দনে সৃষ্টি করে চলেন তার চারুকলা কারুকলা আঙ্গিকের যথাযথ সম্পদ বিশিষ্ট কবি হকিংস এর মত তাকে কাব্যের ঝংকার ও গদ্যের ভঙ্গির সার্থক মিলন করতে দেখেছি আমরা বাক্য গঠনের দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে এক কথায় বিজ্ঞান চেতনার কষ্টিপাথরে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দর্শন কে মেলাতে চাইলেও মরমিয়া বাদ কে গুরুত্ব দিয়ে কবি চেতনায় অতপ্রত ভাবে জড়িয়ে ধরেছেন নিসর্গ প্রকৃতি ও তার নৈসর্গিক চিত্রকল্প।
কাব্য :
কবিতাবলী (১৩৩২ বঙ্গাব্দ?),উপহার (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ),খসড়া (১৯৩৮),এক মুঠো (১৯৩৯),মাটির দেয়াল (১৯৪২),অভিজ্ঞান বসন্ত (১৯৪৩),দূরবাণী,পারাপার (১৯৫৩),পালাবদল (১৯৫৫),ঘরে ফেরার দিন (১৯৬৪),হারানো অর্কিড,পুষ্পিত ইমেজ,অমরাবতী,অনিঃশেষ
গদ্য রচনা:
চলো যাই (১৯৬০),সাম্প্রতিক,পুরবাসী, পথ অন্তহীন,অমিয় চক্রবর্তীর প্রবন্ধ সংগ্রহ।
সম্মাননা :
ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬০) - চলো যাই গদ্যগ্রন্থের জন্য পদ্মভূষণ (১৯৭০),সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার (১৯৬৪) - ঘরে ফেরার দিন কাব্যগ্রন্থের জন্য
।
মৃত্যু -১২ জুন, ১৯৮৬ সাল।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -338. Dt -10.4.2021
২৭ চৈত্র,১৪২৭. শনিবার
=================================
No comments:
Post a Comment