'দাসী' ছিল দাসাশ্রম এর মুখপত্র। দাসাশ্রম ছিল গরীব মানুষের আশ্রয়, খাওয়া থাকার জায়গা। ১৬৭/২/৩ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের বাড়িটি দাসাশ্রম। দাসাশ্রম স্থাপন করেছিলেন ১৮৯১ সালে বসিরহাট মহকুমায় জালালপুর গ্রামের মৃগাঙ্কধর চৌধুরী ও ক্ষীরোদচন্দ্র দাস। পরে এটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। ১৮৯২ সালের জুলাই মাস থেকে কলকাতায় 'দাসী' পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।
দাসাশ্রমের সেবিকারা নিজেদের দাস ও দাসী বলে পরিচয় দিতেন। সমাজের শোষিতা নারীদের বিপদমুক্ত করার প্রচেষ্টা, অনাথ ও দরিদ্রদের সেবা, রাস্তায় মরণাপন্ন মানুষের সেবা ছিল দাসাশ্রমের মূল উদ্দেশ্য। যে কাজ গান্ধীজী, মাদার টেরেসা শুরু করেছিলেন, সে কাজের পথিকৃৎ ব্রাহ্মসমাজ এবং দাসাশ্রম। সদস্যরা প্রত্যেকে মনে করতেন তারা দাস অর্থাৎ মানুষের সেবক আর তাদের মুখপত্র হল 'দাসী' পত্রিকা। মহিলাদের সেবামূলক কাজে নিয়োজিত করা দাসাশ্রমের একটা বড় লক্ষ্য ছিল। 'দাসী'-তে বারবার সেজন্য নারীদের আহ্বান করা হয়েছে। তাই জন্য হয়তো পত্রিকার নাম 'দাসী'। মানুষের সেবা করার যখনই সুযোগ পেয়েছেন রামানন্দ তখনই সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। জনহিতকর কাজে সবসময়ই তিনি প্রবল উৎসাহী ছিলেন। একটা কোনো আশ্রম কিংবা কুলি সংরক্ষণী সভা খোলার ইচ্ছে তাঁর বরাবর ছিল। অর্থাভাবে বালিকা পত্নীকে কলকাতায় আনা সম্ভব ছিল না, তখন ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন — 'মনে হল সেবাব্রতের ক্লান্তি ও কষ্ট সহিতে সমর্থ করিবার জন্য পিতা দাম্পত্য সুখ দিয়াছেন। একত্রে থাকার সুখ কল্পনা করিলাম। অমনি একটি অনাথ নিবাস কিম্বা দরিদ্র ছাত্রাবাস খুলিবার ইচ্ছা জন্মিল।' তাহলে 'দাসী' বা দাসাশ্রমের অন্তরালে রামানন্দ গৃহিণীর যে অবদান ছিল একথা অস্বীকার করা যায় না। কলকাতায় দাসাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হলে মৃগাঙ্কধর রায়চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী কমলা দেবী, ক্ষীরোদচন্দ্র দাস ও তাঁর স্ত্রী প্রভাবতী দেবী, এবং শরৎচন্দ্র রায় জামালপুর থেকে কলকাতায় এসে বাড়ি ভাড়া নেন। এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠিত হলে তার সভাপতি হন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। খোলা হল দাসাশ্রম মেডিকেল হল, চিকিৎসায় সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন নীলরতন সরকার ও প্রাণকৃষ্ণ আচার্য। এর সঙ্গে যুক্ত হল শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'সেবালয়' সংস্থা। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক দাসাশ্রম চলত স্বেচ্ছামূলক দানের উপর ভিত্তি করে। দাসাশ্রমকে সাহায্য করতেন ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, রেভারেন্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌলভি সিরাজুল খাঁ, আনন্দমোহন বসু, মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন প্রমুখ নানা ধরনের মানুষ। দাসীর প্রথম দুটি বার্ষিক সূচিপত্রে কোনো লেখকের নামোল্লেখ নেই। তাছাড়া প্রথম দিকে সম্পাদকের নামও ছাপা হত না। অথচ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শুধু পত্রিকা সম্পাদনা করতেন না। নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন এখানে। জন হিতৈষণার প্রবর্তন, দাসাশ্রমের মাসিক কার্যবিবরণ প্রচার ও দাসাশ্রমের আর্থিক সাহায্য করার জন্য পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু কেবল সেবাধর্ম-মূলক প্রবন্ধ লিখে পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা বাড়ানো কঠিন। তাই 'দাসী' পত্রিকা প্রকাশের দেড় বৎসর পরে উপন্যাস, কবিতা, বিজ্ঞান কথা, পুরাতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, গ্রন্থ সমালোচনা সবই প্রকাশ করতে থাকে। এই সময় থেকে এ পত্রিকায় রাজনারায়ণ বসু, যোগীন্দ্রনাথ বসু, সখারাম গণেশ দেউস্কর, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, অবিনাশচন্দ্র দাস — এইসব প্রখ্যাত লেখকদের রচনা প্রকাশিত হতে থাকে।
মানুষকে সেবার কাজে প্রাণিত করার জন্য কুমারী ডীন, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, ভগিনী ডোরা, গ্রেস ডার্লিং এইসব পরহিতসাধিনী য়ুরোপীয়ান মহিলাদের জীবনী যেমন 'দাসী'তে প্রকাশিত হত, তেমনই দাসী-সম্পাদক অন্ধ, মূক ও বধিরদের কষ্ট লাঘব করার ব্যাপারে তাদের পক্ষে হিতকর হতে পারে এমন নানা প্রবন্ধ লিখতেন। রামানন্দ কন্যা শান্তা দেবীর মতে — 'তিনিই (রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়) যে বাংলাদেশে অন্ধদের জন্য বাংলার ব্রেইল অক্ষর উদ্ভাবন করেন একথা পঞ্চাশ বৎসর লোকে ভুলিয়াছিল এখন ডঃ সুবোধচন্দ্র রায় নামক অন্ধ-হিতৈষী পুরুষের চেষ্টায় সে তথ্য পুনরাবিষ্কৃত হইয়াছে।' (প্রবাসী, দাসী, শ্রী শান্তা দেবী, ১৩৫১, ভাদ্র) কেবলমাত্র খ্রীষ্টীয় রীতি অনুযায়ী জনহিতকর কাজ নয়, দেশীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী জলসত্র স্থাপন, পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠা, ছায়াবৃক্ষ রোপণ এসব কাজের স্বপক্ষেও দাসীতে নানা প্রবন্ধ আছে। 'দাসী' পত্রিকা যার মুখপত্র, সেই দাসাশ্রমের সেবকেরা পথে ঘাটে বিপর্যস্ত অসুস্থ মানুষদের নিয়ে আসতেন এই সেবাশ্রমে। অস্থায়ী রোগীদের দুএকদিন পরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হত। স্থায়ী রোগীদের আশ্রমে রাখা হত। 'দাসী'তে প্রত্যেক সংখ্যার শেষে প্রকাশিত হত রোগীর পূর্ণ বিবরণ। দেখাশুনার যাতে ত্রুটি না হয় তাই রামানন্দ নিজেই দাসাশ্রমের সঙ্গে একই বাড়ির অন্য অংশে থেকেছেন। কলকাতায় তখন Little Sisters of the Poor ছাড়া আর কোনও destitute home ছিল না। কিন্তু হিন্দু দুঃস্থ বা রোগীরা সেখানে থাকতে চাইত না; তাছাড়া ৬০ বছরের কম বয়স্ক মানুষেরা সেখানে থাকতে পারতেন না। কিন্তু দাসাশ্রম ছিল যে-কোনো বয়সের দুঃস্থ ও রুগ্ন নারী পুরুষের আশ্রয় গৃহ। কমিটিতে প্রাচীনপন্থী নিষ্ঠাবান হিন্দু থাকলেও সেবক-সেবিকারা ছিলেন ব্রাহ্ম। সাধারণত সে-সময়ে বর্ণ হিন্দুরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অনাথ আতুরদের নোংরা পরিষ্কার করতে সর্বদা আগ্রহী ছিলেন না। দাসাশ্রমের কাজ শুধু কলকাতাতেই সীমায়িত ছিল না--এদের উদ্যোগে জালালপুর, বাঁকুড়ার সূর্পানগর, নলধা, কোঁড়ামারা, চেরাপুঞ্জী এসব জায়গায় সাতটা দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি হয়েছিল।
'দাসী' পত্রিকার পাতা ওল্টালে আরও নানা খবর চোখে পড়ে। ১৩০০ বঙ্গাব্দে ১৭ নং রঘুনাথ চাটুজ্যে স্ট্রীট মণিকা যন্ত্রে হরিশচন্দ্র পাল দ্বারা প্রকাশিত হওয়ার বিজ্ঞাপন যেমন আছে, তেমনই 'বর্ষ শেষ' শিরোনামে বিজ্ঞাপন — 'আগামী বৎসর হইতে 'দাসী' নূতন আকারে প্রকাশিত হইবে। লেখার উৎকর্ষ সাধনের জন্যও যথাসাধ্য চেষ্টা করা যাইবে। আগামী আষাঢ় মাস হইতে 'দাসী'র দ্বিতীয় বর্ষ আরম্ভ হইবে। দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম হইতেই দাসী প্রতি মাসে ৪০০০ করিয়া মুদ্রিত হইবে।'
তৎকালীন বঙ্গদেশের নারীদের শোচনীয় দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার কথা 'দাসী' পত্রিকা ও দাসাশ্রম বারবার অনুধাবন করেছে। কলকাতায় দাসাশ্রম প্রথম দিকে পতিতা রমণীদের কন্যাদের উদ্ধারের ভার গ্রহণ করে এইরকম কয়েকটি মেয়েকে সেখানে রেখে নানা শিক্ষা দেওয়া এবং রোগীদের জন্য সেবাধর্মে উপযোগী করে গড়ে তোলার কথা ভাবে। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। আইনের মারপ্যাঁচে এসব মেয়েদের উদ্ধার করা সহজ কাজ ছিল না। কাজেই উদ্ধার কমিটি উঠে গেল। কিন্তু সম্পাদক রামানন্দ চাটুজ্জে দাসীতে নিয়মিত 'পতিতা রমণীর দুর্দশা মোচন' 'স্ত্রী জাতির দুঃখ বিমোচন' এমনকি 'পতিত পুরুষদের উদ্ধার' বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ভাদ্র, ১২৯৯ সংখ্যায় 'দাসী' পত্রিকায় 'পতিত পুরুষগণের উদ্ধার' প্রবন্ধটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। লেখক সম্পাদকের মতে — 'সকল দেশেই দেখা যায় যে ব্যভিচার দোষে দোষী পুরুষগণের সামাজিক দণ্ড অতি লঘু, কিন্তু ব্যভিচারিণী রমণীর দণ্ড অতি কঠোর। পুরুষ রমণী উভয়েই সমাজ অপরাধী হইলেও রমণী কলঙ্কিতা নামে অভিহিতা এবং সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্তা হন। তাহাতে ফল এই দাঁড়ায়, যে নারীর একবার অধঃপতন হইয়াছে, তিনি ক্রমেই গভীরতর পাপপঙ্কে নিমগ্ন হইতে থাকেন। অপরদিকে পুরুষ শত অপরাধে অপরাধী হইয়াও ভদ্রলোকের বেশে সমাজে সর্বত্র অবাধে গতিবিধি করিয়া থাকেন এবং সেই সুযোগে, আরও কত রমণীর সর্বনাশ করেন।' 'ইন্দ্রিয়পরায়ণ পুরুষেরা হিংস্র পশুর ন্যায় নৃশংস' প্রবন্ধে লেখক ইন্দ্রিয়দাস পুরুষের হিতসাধনের জন্য সঙ্ঘ তৈরি করার কথা বলেছেন। ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যায় আছে 'আবাহন' নামে কবিতা — 'আয় লো ভগিনি, সবে মিলি আয়/ জগতের তরে ঢালি গে প্রাণ / এ জীবন কেন, ছেলেখেলা নয় / পাপীতাপী হেরে কাঁদে কি প্রাণ।' রচয়িতার নাম নেই। তবে তা সম্পাদকের নিজের অথবা হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের লেখা হতে পারে। এ-পত্রিকায় বারবার নানা লেখায় আর কবিতায় নারীদের আহ্বান করা হয়েছে সেবামূলক নানা কাজে। আশ্বিন ১২৯৯ সংখ্যায় আছে — 'আমরা প্রথম সংখ্যা 'দাসী'তে প্রকাশ করিয়াছি যে আমরা খুলনা হইতে একজন বিপথগামিনী অল্পবয়স্কা রমণীকে ফিরাইয়া সৎপথাবলম্বন করাইবার জন্য চেষ্টা করিতেছি। এই সংবাদ প্রকাশ হওয়াতে দেখা যাইতেছে যে বহু সংখ্যক হতভাগিনী রমণী আমাদের আশ্রয় পাইবার জন্য আমাদের নিকট সংবাদ পাঠাইতেছে।' এইরকম আটটি রমণীর সংবাদ আছে। কিন্তু এদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য স্বতন্ত্র আশ্রম ও তত্ত্বাবধানের জন্য উপযুক্ত দাসী পাওয়া দুষ্কর ছিল। তাই লেখকের আহ্বান — 'হায় হায়, এই সকল হতভাগিনীদের উত্তপ্ত অশ্রুবিন্দু বঙ্গদেশকে পুড়াইয়া ছারখার করিবে। বঙ্গ মাতার কি কোনও উদারপ্রাণা, প্রেমময়ী কন্যা নাই, যে আপনার প্রেম পক্ষপুটের আচ্ছাদনের নিম্নে রাখিয়া এই হতভাগিনীগণকে পাপের হস্ত হইতে, অপার যন্ত্রণার হস্ত হইতে রক্ষা করেন? কেহ যদি থাক মা এস। অগ্রসর হও।' 'দাসী' পত্রিকায় বরাবর নারীদের সমস্যা, তাদের দুর্বিপাকের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। দাসাশ্রম যেমন সে সমস্যা সমাধানে ব্রতী হয়েছে, অন্যদেরও সে কাজে যুক্ত করতে আগ্রহী হয়েছে।
সে-কালের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদক অনেক দুঃসাহসী আলাপ আলোচনা করতে উদ্যোগী হয়েছেন এ পত্রিকায়। বেশ্যাদের প্রভূত সংখ্যাবৃদ্ধি আর সামাজিক দুর্গতির কথা আছে মাঘ ১২৯৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত 'স্ত্রী জাতির দুঃখ বিমোচন' প্রবন্ধে। অনিচ্ছাকৃত ভাবে যারা বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে তাদের উদ্ধারের জন্য রামানন্দ অনেক আইনের বই পড়াশুনা করে প্রবন্ধ লিখে পাঠক সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন--'এই কলিকাতা শহরে, বেশ্যাদের নিজের বাড়ী আর কয়টা আছে? সমুদয় বেশ্যাগৃহই কোন না কোন 'ভদ্র' বাড়ীওয়ালার সম্পত্তি। কি ঘৃণার কথা। জঘন্য পাপে হতভাগিনীগণ শরীর ও আত্মা কলুষিত করিতেছে। আর তাহাদের পাপার্জিত অর্থে এই ভদ্রলোকেরা স্ত্রী পুত্র কন্যার ভরণপোষণ করিতেছে? আমাদের বোধ হয়, এই কলিকাতা শহরের বেশ্যাগৃহ সকলের একটা তালিকা করিয়া কোন বাড়ীটা কোন্ ভদ্রলোকের তাহা স্থির করিতে পারিলে খুব ভাল হয়। তাহা হইলে ঐ সকল নীতিজ্ঞানশূন্য লোকদের নাম সহিত ঐ তালিকাটি সাধারণের গোচরার্থে প্রকাশ করা যাইতে পারে।' নিঃসন্দেহে দুঃসাহসী মন্তব্য।
সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন যে নারীর অস্তিত্ব কেবল পুরুষের জন্য এটা অতি ভ্রান্ত বিশ্বাস। নারীর সর্বাঙ্গীণ উন্নতিও তেমনই আবশ্যক, নারী যেমন পুরুষের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন, পুরুষও নারীর জন্য। তারা পরস্পরের পরিপূরক। 'দাসী' পত্রিকা নারীদের জন্য ভাবনাচিন্তা করত বলে এখানে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে নারী পুরুষের ভোগ্যবস্তু মাত্র। এটা অতি পাশব ভাব যা সমাজ থেকে সমূলে উৎখাত হওয়া দরকার। এমনকি কলকাতার কোনো কোনো রাস্তায় বেড়াতে গেলে দেখা যায় যে অতি অল্প বয়সী নারীরা পতিতা নারীর বেশে দাঁড়িয়ে আছে এবং এ বিষয়ে কি করা যেতে পারে তার উত্তরও খুঁজতে চেয়েছে।
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এলাহাবাদে চলে যাওয়ার পরেও 'দাসী'র কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম ছোটগল্প 'একটি রৌপ্য মুদ্রার আত্মজীবনী' ১৮৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এখানে প্রকাশিত হয়। জগদীশচন্দ্র বসুর জনপ্রিয় প্রবন্ধ 'ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে' 'দাসী'তে প্রকাশিত হয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রা' কাব্যের দীর্ঘ সমালোচনা করেন তাছাড়া সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে দাসীতে সৌদামিনী গুপ্তা একটি কবিতা লিখেছিলেন — তার শেষ পাঁচটি লাইন ছিল এইরকম —
প্রকৃতির বিশাল প্রাঙ্গণতলে যারা
ঢালিতেছে স্বাভাবিক সঙ্গীতের ধারা
শতবার শুনেছি সে সকলের সুর;
কিন্তু মম প্রিয়তম-কণ্ঠস্বর ছাড়া
আর কিছু শুনি নাই অমন মধুর।
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মাধবিকা'র সমালোচনাও 'দাসী'তে প্রকাশিত হয়েছিল। দীনেন্দ্রকুমার রায়, দীনেশচন্দ্র সেন, জলধর সেন — এরাও ক্রমে 'দাসী'র লেখক হয়ে ওঠেন। 'দাসী'র ৪র্থ ভাগ ১১ ও ১২ নং সংখ্যায় রাজনারায়ণ বসু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জীবনী লেখেন। বঙ্কিমের বিবিধ উপন্যাসের ক্রমান্বয়ে সমালোচনা করেন বিভিন্ন সংখ্যায় হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। 'দাসী' ক্রমশ সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, সমাজ ও অর্থনীতি বিষয়ক কাগজ হয়ে দাঁড়ায়। তবে দক্ষ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নানা বিষয়ের প্রবন্ধের মধ্যে মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির কথাটুকু সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাঁর সম্পাদকীয় কলমের তীক্ষ্ণ নৈপুণ্যে সমস্ত লেখার মধ্যে একটা সাধারণ রচনারীতির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠত। অনেক সময় সামান্য লেখাকেও কেটেছেঁটে ঘষে মেজে এমন সুছাঁদ করে তুলতেন যে লেখাটি হয়ে উঠতো অনন্য সাধারণ। রামানন্দ সম্পাদিত প্রদীপ পত্রিকায় দীর্ঘ গ্রন্থ-সমালোচনা থাকত। 'দাসী'তে এর সূচনা। 'দাসী'তে রবীন্দ্রনাথের লেখা তেমন চোখে পড়ে না। 'দাসী' প্রকাশিত হবার সাত আট মাসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ 'সাধনা পত্রিকা' সম্পাদনার দায়িত্বভার নেন। হয়ত সেই কারণে সে সময়ে 'দাসী'তে তাঁর তেমন লেখা প্রকাশিত হয়নি। 'দাসী' ১৮৯৭ সালের মে মাস নাগাদ বন্ধ হয়। শেষ দিকে কিছুদিন গোবিন্দচন্দ্র গুহ 'দাসী'র সম্পাদক ছিলেন।
ফরাসী বিপ্লবের আদর্শে বিশ্বাসী রামানন্দ যখনই যে পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, তখনই মানুষের মৌলিক অধিকারের স্বপক্ষে কথা বলেছেন বারবার। 'দাসী' পত্রিকাও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
তথ্যসূত্র
১) 'দাসী' পত্রিকা -- ১৮৯২-১৮৯৭; সম্পাদক - রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়
২) 'দাসী' -- শ্রী শান্তা দেবী, প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩৫১
৩) কোরক -- রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা; বইমেলা-- ২০১৫
{ সংগৃহীত}
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment