ডব্লিউ বি ইয়েটস 'এর কবিতা : সংগ্রাম ও ব্যক্তিপ্রেম।
"নানান প্রবন্ধে ইয়েটস এর জীবনের দুটো দিক তথা প্রেম এবং যুদ্ধ বিষয়ক ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলো ফেলা হয়েছে ইয়েটস কিভাবে বারবার প্রেমে নিজেকে দগ্ধ করেছে । সেই প্রেম ইয়েটস এর কবিতাতে কিভাবে এসে আঘাত হেনেছে তার উপর। ইয়েটস এর যুদ্ধ বিষয়ক ভাবনা এবং হতাশা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে সেটা লক্ষ্য করা যাবে তাঁর কবিতা দিয়ে। "
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের চার বছর, একমাস, তিনদিন পর সুদূর আয়ারল্যান্ডের স্যান্ডিমাউন্টে জন্ম নেবেন আরেকজন আশ্চর্যজনক অলৌকিক প্রতিভা। যিনি বিশ শতাব্দীর সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং আইরিশ-ব্রিটিশ সাহিত্যের স্তম্ভকে গড়ে তুলবেন নিজ কায়দায়; সুদৃঢ় করে। এক কথায় বলা যায় উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস এর হাত ধরেই আইরিশ সাহিত্য আকাশে রেনেসাঁর সূর্য উদিত হয়। তাঁর হাত আরো পোক্ত করেন লেডি গ্রেগরি, এডওয়ার্ড মার্টিন এবং অন্যান্যরা যার প্রাথমিক সূচনা হয় এবে থিয়েটার হলে। শুধুমাত্র কবিতা লেখা তাঁর কাজ ছিল না। একাধারে তিনি ছিলেন নাট্যকার, গদ্য লেখক, ফোকলোরবিদ, জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ। এই সিম্বলিস্ট কবি প্রথম জীবনে গ্রাম্য-সমাজভিত্তিক লেখা দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে তাঁর লেখায় আধ্যাত্মিকতা, গাম্ভীর্য, আয়ারল্যান্ডীয় মিথলজি, লোক-কাহিনী, সেলটিক সঙ্গীত সুরাক্রান্ত পঙক্তি ইত্যাদির তাৎপর্য গভীরভাবে ফুটে উঠে। তিনি ছিলেন দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের আশ্চর্যজনক ফসল এবং রোম্যান্টিসিজম ও মর্ডানিজমের পথ ধরে হাঁটা শ্রমী শিল্পী। কিন্তু এই দিকটা ক্রিটিকগণ নানানভাবে এড়িয়ে যান। সেটা হচ্ছে, তাঁর লেখায় রোম্যান্টিকতার উপাদান জন কিটস থেকে পার্সেল হয়ে উইলিয়াম ব্লেকের শিল্প-আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পেয়েছে।
ইয়েটস নানাভাবে কিটস এবং ব্লেকের কাছে কৃতজ্ঞও বটে। এবং, এ কথার বিরুদ্ধাচার তিনি কখনোই করেননি। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রসিদ্ধ জ্যোতিষ্ক উইলিয়াম ব্লেকের লাইন ‘O Rose, thou art sick!’ উচ্চারণ করে গেছেন।
পরপর দু’বার আইরিশ সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইয়েটস ছিলেন আইরিশ জাতীয়তাবাদ ও দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ। ১৯২৩ সালে নোবেল কমিটি প্রথম আইরিশ লেখক হিসেবে যখন ইয়েটস এর নাম উচ্চারণ করেন, সেই সাথে গভীর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়ঃ “inspired poetry, which in a highly artistic form gives expression to the spirit of a whole nation”.
এই প্রবন্ধে ইয়েটস এর জীবনের দুটো দিক তথা প্রেম এবং যুদ্ধ বিষয়ক ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলো ফেলা হয়েছে ইয়েটস কিভাবে বারবার প্রেমে নিজেকে দগ্ধ করেছে তার উপর। সেই প্রেম ইয়েটস এর কবিতাতে কিভাবে এসে আঘাত হেনেছে তার উপর। ইয়েটস এর যুদ্ধ বিষয়ক ভাবনা এবং হতাশা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে সেটা লক্ষ করা যাবে তার কবিতা দিয়ে। মূলত, সেই অনুসন্ধানেই আমরা ব্রতী হবো।
২
“It takes the whole of life to learn how to live, and–what will perhaps make you wonder more–it takes the whole of life to learn how to die.”
-Seneca
ইয়েটস বোধহয় সেনেকা’র এই কথাটিকে জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। ইয়েটস এর জাতীয়তাবাদ প্রথম থেকেই পরিলক্ষিত ছিল। রাজনীতিতে তাঁর পদার্পণ কোন অলৌকিক ঘটনা নয়। সতেরোশো শতকের শেষার্ধে অ্যাংলো-আইরিশ সংখ্যালঘু ও প্রোটেস্ট্যান্টরা আয়ারল্যান্ডে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অন্যের অধীনে নিয়ন্ত্রিত ছিল। সেখানে তাদের উপর বৈষম্য ছিল চরমে। ইয়েটস তাদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সংখ্যালঘুদের মধ্যে অধিকাংশই নিজেদের ইংরেজ বলে পরিচয় দিত; যদিও তাদের জন্ম আয়ারল্যান্ডেই। কিন্তু ইয়েটস ছিলেন তাদের থেকে ভিন্ন। তিনি নিজের আইরিশ জাতীয়তা নিয়ে কোন হীনমন্যতায় ভুগতেন না। আইরিশ জাতীয়তার ব্যাপারে তিনি একনিষ্ঠ ছিলেন।
যদিও তিনি তাঁর জীবনের চৌদ্দটি বছর লন্ডনে কাটিয়েছেন এবং প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের প্রথমার্ধে তিনি সেখানে স্থায়ী বসবাস করেছেন। তারপরও তিনি শিকড়ের টান ভুলে যাননি। তাঁর বেশিরভাগ কবিতা ও নাটকে মেটাফর হিসেবে আইরিশ পৌরাণিক কাহিনী ও আইরিশ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের হিরোদের আনাগোনা দ্যাখা যায়। একজন শিল্পী হিসেবে তিনি কখনোই তাঁর কৃষ্টি-কালচার, ঐতিহ্যকে ত্যাগ করেননি। বরঞ্চ নিজের ভেতরে ধারণ করে আলাদা সৃষ্টিশীল ইমেজ তৈরি করেছেন। নিজ দেশের প্রতি নিবেদিত ভালোবাসা না থাকলে এটা সম্ভব নয়।
ইয়েটস এর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর হিসেবে ১৮৮৬ সালের পর থেকে উল্লেখ করা যেতে পারে। ঠিক তখনই লন্ডনে তাঁর সাথে পরিচয় হয় বিশিষ্ট যুবতি, মনেপ্রাণে আইরিশ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সুন্দরী মডগানের। এই মডগানের উদ্দীপনায় উদীপ্ত হয়ে ইয়েটস আইরিশ জাতীয়তাবাদে নিজেকে উৎসর্গ করে দেন; মনে-প্রাণে। তখন তিনি রচনা করেন The Countess Kathleen (1892) নামক শ্লোক নাটক যা তিনি মডগানকে উৎসর্গ করেন। তিনি Cathleen ni Houlihan (1902) নামক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাটক লিখেন যা ১৭৯৮ সালের বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে লেখা। নাটকটি ছিল উজ্জ্বল জাতীয়তাবাদী ভাবধারা সম্পূর্ণ। নাটকের শেষ পাতায় তিনি তরুনদের উৎসাহিত করেন যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে বীরাঙ্গনা ক্যাথলিন নি হাউলিহানের জন্য এবং যারা একটি স্বাধীন ও পৃথক আইরিশ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে।
১৯২২ সালের জুন মাস থেকে ১৯২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ চলে। যার সূত্রপাত মূলত ‘আইরিশ ফ্রি-স্টেট’ তত্ত্ব থেকে। এই যুদ্ধে ইয়েটস নতুন সরকারের পক্ষ অবলম্বন করেন। তিনি আইরিশ ফ্রি-স্টেটের হয়ে ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৬ বছরের জন্য। সময়টা ছিল বড্ড উত্তাল। বিদ্রোহীদের দমন করবার জন তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়। খুঁজে খুঁজে তাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অপহরণ করে গুম করে ফ্যালা হয় অনেক বিদ্রোহীকে।
ইয়েটস এর তিনটি গুচ্ছ কবিতায় (THE GREAT DAY, PARNELL, WHAT WAS LOST) এই সামগ্রিক যুদ্ধ বিষয়ক ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। তিনটি কবিতা সর্বোপরি ১১ লাইনে লেখা। যুদ্ধের ব্যাপারে ইয়েটস এর যে মনোভাব সেটি এই কবিতাগুলোয় ফুটে উঠেছে দৃঢ়তার সাথে। কবিতাগুলোয় অপ্রয়োজনীয় সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের প্রতি তাঁর অসমর্থন ও অসন্তোষ তিব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এটি (যুদ্ধ) একটি অনর্থক প্রক্রিয়া। এটা কিছু পরিবর্তন করতে পারে না। নিপীড়িত মানুষের অবস্থান বদলে গেছে। কিন্তু, নিপীড়ন অব্যাহত আছে। পার্নেল কবিতার সেই পাথর ভাঙ্গা লোকটির মত; দেশ স্বাধীন হবে কিন্তু তাঁর ভাগ্যের ছিটেফোঁটাও কোন পরিবর্তন আসবে না। এই জন্যই ইয়েটস বারবার উপহাস করছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে এবং বলছেন, ‘বিপ্লব বলে উৎফুল্লে ফেটে যান এবং পুনঃপুন নগ্ন- তোপ দাগান!’ তিনি এটা বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি যে, তাঁর রাজা একজন ব্যর্থ রাজা এবং তাঁর সৈন্যরা সব বিপথগামী। তারা সকলে পথভ্রষ্ট। এবং, তিনি হতাশ এই কারণে যে রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে হেঁটে গিয়ে তিনি কোন হিসাব মেলাতে পারেননি।
১৯২২ সালে ইয়েটস ডাবলিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। সেসময়ে সরকার তাঁর বাড়ির দরোজায় সশস্ত্র সেন্ট্রি-পোস্ট বসান। সিনেটর হিসেবে, ইয়েটস তাঁর নিজের স্ব-জাতির অভ্যন্তরীণ উন্নতির জন্য বিশৃঙ্খলা পরিহার করে স্থিতিশীলতার দিকে জোর দেন। সিনেটর থাকা কালে ইয়েটস এর নাটক ও কবিতা গুলোর উপাদান ছিল স্থানীয় এবং সাধারণ বিষয়ে, ব্যক্তিগত ও জনসাধারণের উদ্দেশে, আইরিশ এবং সার্বজনীন ভাবনায়। এই সময়ে এক রাত্রে তিনি লিখেন “Nineteen Hundred And Nineteen” নামক কবিতা। কবিতাটি শুরু হয় ‘Many ingenious lovely things are gone’ এইরকম আক্ষেপ দিয়ে। Tower (1928) কাব্যগ্রন্থটিকে তাঁর বিখ্যাত একটি কাজ হিসেবে তুলনা করা হয়। নোবেল গ্রহণ করবার পর গুটিকয়েক সাহিত্যিকদের মধ্যে ইয়েটসও একজন যিনি নোবেল-উত্তর সাহিত্যিক জীবনে অসাধারণ কিছু কাজ করে গেছেন।
‘Politics’ কবিতাটি ইয়েটস এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। ১৯৩৮ সালের ২৪ মে যখন কবিতাটি লেখা হয় তখন স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলছে। রোম, রাশিয়াও খুব একটা ভালো নেই। হিটলারের মাথা খারাপ হবার জোগাড় প্রায়! কবিতাটির প্রথম লাইনগুলো রোম (ইতালি), রাশিয়া, স্পেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতির দিকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরো জটিল অভিপ্রায়ে ব্যক্তিগত মানুষের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে কবিতাটি ভিন্ন রাস্তায় মোড় নেয়। থমাস মানের বিখ্যাত উক্তি দিয়ে কবিতাটিকে চিহ্নিত করা যায় :
“In our time the destiny of man presents its meanings in political terms”.
যদিও ইয়েটস এর কর্মজীবনে রাজনৈতিক বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবেই এসেছে তারপরও তিনি রাজনীতিতে পক্ষপাতিত্বের অবস্থানে না থেকে একটু দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতেই বেশি পছন্দ করতেন। অবশ্য একটি চিঠিতে ইয়েটস অলিভিয়া শেক্সপীয়ারকে বলেন যে, ফ্যাসিবাদ এবং নন্দনতত্ত্বের মধ্যে একটা সম্পর্ক বিদ্যমান আছে। কিন্তু, এটাও সত্যি যে এজরা পাউন্ডের মতো ইয়েটস কখনো ফ্যাসিবাদে ঘনিষ্ঠভাবে জড়াননি।
‘Easter, 1916’ কবিতাটি ইয়েটস এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। ব্রিটিশরা আইরিশদের কথা দিয়েছিল যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেই তাদেরকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। বিনিময় হিসেবে তাদের দিতে হবে যুদ্ধের জন্য সাপ্লাই আর মানুষ। কিন্তু আইরিশরা গোঁয়ার্তুমি করেছিল।
অই বিদ্রোহের সময়ে, একটি রাজনৈতিক দলের নেতা Sinn Feiners (গ্যেলিক অর্থ ‘আমাদের নিজস্ব’) এর নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ডাবলিন ভবন দখল করে নেয় বিদ্রোহীরা। ছয়দিন টানা দখল করে রাখার পর বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের নেতা Sinn Feiners কে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ইয়েটস কিছু বিদ্রোহী নেতাদের চিনতেন। তাঁদের আত্মত্যাগ তাঁর মনকে ছুঁয়ে যায়। তাই তাঁদের সম্মান জানিয়ে এই কবিতার প্লট রচনা করেন।
ইয়েটস এর কবিতায় আইরিশ ইতিহাস, পুরাণ ও সাহিত্য বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। জার্নালিস্টিক ভাব প্রায়শই প্রকাশমান। এসবের হাত ধরে এসেছে মানুষের রাজনীতি, রাজনীতির মানুষ। ইয়েটস যে সময়কে সামনে রেখে কবিতাগুলো লিখেছিলেন, সে সময় অস্তগামী কিন্তু যুদ্ধ এখনো বিরাজমান।
৩
ভালোবাসার কথা বলতে গেলে ইয়েটস এর কোন তুলনা হয় না। একজন প্রেমের কবি এবং প্রেমিক কবি হিসেবে তাঁর গীতধর্মী লিরিক এবং ভাষার মাধুর্য আমাদের মুগ্ধ করে। ইয়েটস এর কবিতায় প্রেম কবির নিজের জীবনের দর্পণ হিসেবে আমাদের সামনে সম্মুখীন হয়। কবিতা বিশ্লেষণ করলে তাকে কয়েক পর্যায়ে ভাগ করা যায়। কবির প্রথম জীবনের কবিতাগুলো রচিত হয়েছে মধুর ও হালকা রসে, দ্বিতীয় স্তরের কবিতা ছিল বেশ ভারী ও বিষাদপূর্ণ। কেননা তখন তাঁর মাতৃভূমি আয়ারল্যান্ড যুদ্ধে লিপ্ত। ইয়েটস সেই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদদাতা। পরের দিকের কবিতাগুলোয় কেলটিক সুরের ধাঁচ, প্রেমহীনতার আক্ষেপ, রূপক হিসেবে গ্রীক মিথলজির ছোঁয়া বেশ বিদ্যমান। সব স্তরের কবিতায়-ই নানানভাবে প্রেমের প্রতি ধ্যানী মগ্নতা ছিল। ইয়েটস এর অধিকাংশ প্রেমের কবিতা অত্যন্ত সংবেদনশীল, মার্জিত ও সৌন্দর্য সংশ্লিষ্ট। ‘The lover Tells of the Rose in His heart’, ‘The White Bird’ কবিতাগুলি প্রেমের ব্যাপারে খুবই হতাশা ব্যাঞ্জক । কবির ‘Adam’s curse’ কবিতাটি তাঁর জীবন প্রবাহের দিকে ইংগিত দিয়ে যায়, যার মধ্যে রয়েছে অবাঞ্ছিত ক্লান্তিকর জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
দীর্ঘকায় লম্বা সুন্দরী মডগানের প্রতি প্রেম, তাঁর কাছ থেকে রাজনৈতিক দীক্ষা পাওয়া যেমন তাকে তীব্র অনুভূতিতে ভাসিয়েছে তেমনি ম্যাগব্রাইডের সাথে মডগানের বিয়েতে আবদ্ধ হওয়া তাকে নিদারুণ দুঃখানুভূতিতে পতিত করেছে। ১৯১৭ সালে জর্জ হাইড লী’র সাথে বিয়ে তাঁকে কবি হিসেবে আরো পরিণত করেছে। তাঁর কবিতায় কখনো প্রেম এসেছে ধারাবাহিক ভাবে আবার কখনো বিচ্ছিন্ন ভাবে। কবি ভালবাসা কেন্দ্রিক কবিতা রচনা করেছেন প্রচুর। তাঁর বেশ কিছু কবিতার শিরোনাম হিসাবে ‘প্রেম’ বা ‘Love’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ‘The pity of love’, ‘The sorrow of love’, ‘O Do not love too long’ ইত্যাদি। ইয়েটস এর প্রেমের কবিতার শৈলী হিসেবে কিছু চিহ্ন জিনিস নির্দিষ্ট করা যায়।
ইয়েটস বলছেন, ‘একজন পুরুষ কবির চিত্ত সবসময় নারী দখল করে রাখে। তাঁর কবিতার কাঠামো নারী এবং কবিতার ভিতরগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা তৈরি। এই দুই উপাদান দিয়ে গড়ে উঠে মূলত একেকটি কবিতা’। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর প্রত্যেকটি কবিতা এই দুই কাঠামোর একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে।
তিনি প্রায়ই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, প্রেমের কবিতার জন্য আলাদা ভাষা শৈলী, মাধুর্য, থিমেটিক মুড দরকার। অতোটা দগ্ধ হবার দরকার নেই যতটা তিনি মডগানকে ভালোবেসে হয়েছেন। কবিতায় আবেগের গলায় লাগাম না দিয়ে তাকে রেসের ঘোড়ার মতো ছুটতে দিতেই তিনি বেশি পক্ষপাতী। কিন্তু, আমরা দেখি বরঞ্চ উল্টোটা।
ইয়েটস এর ‘For Anne Gregory’ কবিতাটি অনেকটা সংলাপের মাধ্যমে রচিত। দু’জন স্পিকারের মধ্য কথোপকথন। স্পিকার হিসেবে দ্বিতীয় জনকে সবাই অ্যানা গ্রেগরী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু ক্রিটিকরা বলছেন, আরেকজন স্পিকার অ্যানা গ্রেগরী’র প্রেমিক, বন্ধু কিংবা অপেক্ষাকৃত কোন আত্মীয় হতে পারে। এখানে ক্রিটিকদের সাথে দ্বিমত আছে। সরাসরি বলাই যায়, আরেকজন হচ্ছেন স্বয়ং ইয়েটস নিজেই। স্পিকারের কথা বলার ধরণ থেকেই ইয়েটসকে চিহ্নিত করা যায়। ক্রিটিকরা কেনো উহ্য রাখলেন সেটা অবশ্যই বিতর্কযোগ্য আলোচনা।
কবিতাটি ভাষার দিক থেকে খুব সূক্ষ্ম ও জটিল। কিন্তু থিমটি খুব পরিষ্কার, বাস্তবিক এবং প্রজ্ঞাময়। শব্দের ব্যবহার সুরুচিপূর্ণ। অলংকারের গাঁথুনি শক্ত হয়ে কবিতার শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। এই কথা বলতে গিয়ে কেরুয়াকের একটি কবিতার উল্লেখ করা যেতে পারে:
“You have to swing /And swing and swing
A handkerchief in the/ Wind”
কবি আমাদের কাছে বার্তা পাঠাতে চেষ্টা করেছেন যে, প্রেম একটি কঠোর যাত্রা। কবি বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং সহজাত (ভেতরের) সৌন্দর্যের মধ্যে নান্দনিক তুলনা করে প্রশ্ন তুলে রেখেছেন যে, মানুষ কি তবে শেষ পর্যন্ত বাহ্যিক রূপেই মোহগ্রস্থ হয়ে থাকবে?
ইয়েটস মত প্রকাশ করেছেন যে, নারী চিত্ত বিজয়ের প্রচেষ্টা একটি নির্বুদ্ধিতার কাজ ব্যতিত কিছু নয়। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, পুরুষরা যেন নারীদের প্রতি অতি উৎসাহী ও উন্মত্ত না হয়। তিনি পুরুষদেরকে শান্তনা প্রদানের প্রচেষ্টা করতে গিয়ে বলেছেন,
‘For everything that’s lovely is.
But a Brief, dreamy, kind delight.’
কিন্তু তিনি ঠিকই মডগানকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। জবাবে মডগান তাকে এই ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেন। তখন ইয়েটস বলেছেন, মডগানকে ছাড়া তিনি সুখী হতে পারবেন না। এই কথা শুনে মডগান স্মিত হেসে জবাব দেন,
“Oh yes, you are, because you make beautiful poetry out of what you call your unhappiness, and are happy in that. Marriage would be such a dull affair. Poets should never marry. The world should thank me for not marrying you.”
এই ব্যাপারে ইয়েটস এর সমসাময়িক সতীর্থ এজরা পাউন্ড ভিন্নমত পোষণ করেন। এই বিষয়ে তাঁর উক্তিটি স্মরণযোগ্য। তিনি বলেন,
‘It ought to be illegal for an artist to marry. If the artist must marry let him find someone more interested in art, or his art, or the artist part of him, than in him. After which let them take tea together three times a week’.
তবে পরে মডগান ইচ্ছা পোষণ করেন যে, দু’জনে আন্তরিক বন্ধুত্ব নিয়ে তাঁরা পাশাপাশি বেঁচে থাকতে পারে। যদিও তাঁরা দু’জনে দীর্ঘদিন প্লাটনিক রহস্য ঘেরা বিবাহে আবদ্ধ ছিলেন কিন্তু ইয়েটস চেয়ে ছিলেন তাঁকে সামাজিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে একমাত্র তাঁরই হিসাবে পেতে।
মডগান আইরিশ অধিকার আন্দোলনে জড়িত থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। মডগানের টানা ধনুকের মতো ভ্রুর সৌন্দর্যের শিকার হয়ে ইয়েটস ভাবতে লাগলেন মডগন তার মাতৃভূমির জন্য কতটুকু করতে পারবে। কবির এই আবেগময় প্রশ্ন বার বার ফুটে উঠেছে তার ‘No Second Tory’ কবিতায়, যার ভিতরে অঙ্কিত হয়েছে মডগানের প্রতি তার তীব্র আবেগ ও ভালবাসার প্রতিচ্ছবি।
‘No Second Troy’ কবিতায় কবি চারটি প্রশ্নে বারবার তাড়িত হয়েছেন। এটি মডগানকে নিয়ে লেখা ইয়েটস এর অন্যতম সেরা কবিতা। ইয়েটস এই কবিতায় মডগানকে ধ্বংসাত্মক গ্রীক সুন্দরী হেলেনের সাথে তুলনা করেছেন। প্রথমেই তিনি নিজেই নিজেকে জিগ্যেস করছেন, কেনো তিনি মডগানকে দোষারোপ করবেন তাঁর জীবনকে বিষাদময় করে তুলবার জন্য। তারপরই তিনি ব্যাঙ্গ করে বলেন, মডগানের পক্ষে আসলে একজন শান্তিপূর্ণ মানুষ হওয়া সম্ভব কিনা তা নিয়ে কবি দ্বিধাগ্রস্থ এবং যে রূপ নিয়ে মডগান অহঙ্কার করে তা আসলে ওল্ড ফ্যাশনের অন্তর্ভুক্ত। তারচেয়ে সমসাময়িক নারীরা বেশি আকর্ষণীয় এবং স্টাইলিশ। ইয়েটস মডগানকে গ্রীক ট্র্যাজিক নাটকের চরিত্র হিসেবে তুলনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি।
শেষ পর্যন্ত ইয়েটস এই আশঙ্কাও করে বসেন যে,
‘Why, what could she have done, being what she is?
Was there another Troy for her to burn?’
এতো কিছু সত্ত্বেও ইয়েটস এর ভালবাসা মডগানকে কেন্দ্র করেই বিরাজমান ছিল। মডগানের কাছ থেকে উপেক্ষিত হওয়ার পরে কবি তাঁরই কন্যা ইসুয়েল্ট এর জন্য বিবাহ প্রস্তাব দেন। সেখান থেকেও তিনি খালি হাতে ফিরে আসেন। কবি ভাবলেন হয়তো বা বুড়ো বয়সের কারণে মডগানের কন্যা ইসুয়েল্টগান তাকে বার বার প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। এ সময় তিনি রচনা করেন ‘To a Child Dancing in the Winds’, ‘To a young Beauty’, ‘To a young Girl’ ইত্যাদি। কবি কখনো মডগানের কথা হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারেননি। তিনি রচনা করলেন ‘A man Young and Old’ এবং কাছাকাছি লিখলেন ‘A Woman Young and Old’। মডগানের প্রতি তাঁর চিরস্থায়ী ভালবাসার কথা প্রকাশিত হয়েছে ‘‘A Last confession’’ কবিতায়।
কবি জানতেন যে ইহজগতে কবির ভালবাসা মডগানকে তুষ্ট করতে পারবে না। তাই তিনি পরজগতে তাঁকে লাভ করার কল্পনা করেছেন। তিনি বলেছেন,
‘But in the grave all, all shall be renewed.
The certain that I shall see the lady
In the first loveliness of womanhood,
And with the favoure of my youth full eyes’
যদিও মনে হচ্ছে যে এসব পরজগত-পরজগত খেলায় কবি মডগানের সাথে কাল্পনিক মিলনে তৃপ্ত কিন্তু বাস্তবতা বড় কঞ্জুস। তিনি আনুধাবন করতে পারেন যে শুধুমাত্র কল্পনায় তা সম্ভব নয়। তাঁর এ বোধ প্রকাশ পেয়েছে ‘Broken Dream’ কবিতায়,
‘The last stroke of midnight dies.
All day in the one chair
From dream to dream and rhyme to rhyme I have ranged
In rambling talk with an image of air:
Vague memories, nothing but memories.’
ইয়েটস এর কবিতায় ‘Never Give All the Heart’ এই ধরনের দর্শন আমাদের ভাবিয়ে তোলে। প্রমাণ করে কবির নারী চিত্ত জয়ের ব্যর্থতার ইশতেহার। এ কবিতায় কবি নারীপ্রেমে উন্মত্ত পুরুষদের চরিত্র উন্মোচন করেছেন। তিনি মনে করেন নারীরা সাধারণ ভাবে তাদের ভালবাসার দাসদের সাথে অভিনয় বা ছলা কলার আশ্রয় গ্রহণ করেন। কবির ভাবনা একমাত্র ‘মুক ও বধির’ প্রেমিকরাই নারীদের নাটকীয় আচরণে ভুলে গিয়ে প্রেমের দরিয়ায় হাবুডুবু খেতে থাকে। এ ধরনের পুরুষেরা অবশেষে তাদের ভুল ও বোকামির আচরণ অনুধাবন করে লজ্জা পায়। কবি বলেন,
‘He that made this knows all the cost,
For he gave all his heart and lost.’
কবি তার ‘O Do Not Love Too Long’ কবিতায় দার্শনিকত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, দীর্ঘ দিনের ভালবাসা মানুষের হৃদয়ে একটি খারাপ প্রভাব বিস্তার করে। তাই তিনি বলছেন,
‘Sweetheart, do not love too long:
I loved long and long
And grew to be out of fashion
Like an old song.’
ইয়েটস আরেকটি সর্বোত্তম কবিতা হচ্ছে ‘The Wilde Swans at coole’ । এ কবিতায় জর্জ হাইড লী’র সাথে কবির বিবাহের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে। কবির অনেক গোপন ইচ্ছার সাথে অত্যন্ত আনন্দের সাথে এ মহিলা একাত্মতা পোষণ করে সাড়া প্রদান করেন যা তিনি কখনো মডগানের কাছ থেকে লাভ করেননি।
ইয়েটস এর কবিতা শেষ পর্যন্ত প্রকৃতি থেকে নারী এবং নারীকেন্দ্রিক বিষয়ের দিকেই ধাবিত হয়েছে। কিন্তু এতো কিছু সত্ত্বেও উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস একজন আধুনিক রোমান্টিক কবি ছিলেন। তিনি প্রেমের ব্যাপারে ছিলেন সব সময় অভিমানী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। যদিও কখনো কখনো মনে হয় কবি স্থলজ ও জটিলবস্তুকে কবিতায় গ্রহণ করেছেন কিন্তু সব সময়ই প্রেম তাঁর সাথে সাথে চলেছে।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment