"নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহি রে
ওগো আজ তোরা
যাসনে ঘরের বাহিরে। "
বা
"লেবু পাতার করমচা
যা বৃষ্টি ধরে যা ।"
এক অপরূপ মায়াকানন । চারদিকে তার অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি। এ দেশে রয়েছে ছয়টি ঋতু। যা ভিন্ন রূপের ঢালি নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। যার অপার সৌন্দর্য আমাদেরকে মুগ্ধ করে। তবে ছয়টি ঋতুর কথা বই পুস্তকে লিখা থাকলেও তিনটি ঋাতু আমাদের বেশি আকৃষ্ট করে। তা হলো - গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। এই তিনটি ঋতুতে প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে। তবে রূপসী বাংলার কবি জীননানন্দ দাসের কবিতায় প্রধান্য পেয়েছে ’হেমন্ত’ ঋতুর কথা। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সাথে মানব জীবনেও নতুনত্বের ছোঁয়া লাগে। আর তা উঠে এসেছে এদেশের প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের কবিতা ও গানে। গানে এসেছে হালকা চালে, কিন্তু কবিতায় এসেছে বিভিন্ন রঙে-ঢঙে, বিভিন্ন ব্যাঞ্জনায়, বিভিন্ন রূপে।
বাংলা কাব্যভূবনে যে দুটি ঋতুর আনাগোনা আর শোরগোল বেশি পাওয়া যায় তা হল, বসন্ত ও বর্ষা। বলা হয়ে থাকে ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত। বসন্তে গাছের ডালে কোকিল ডাকে, ফুল ফোটে, প্রকৃতি সাজে নতুন নানা প্রসাধনে। তার যেন একটাই ইচ্ছা নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা, প্রাণীকুলের মনে প্রেম জাগানো। বসন্তের কার্যপ্রণালী বিশেষত একমুখীন। অপরদিকে বর্ষার আবেদন চতুর্মুখীন। বর্ষার অপরূপ দৃশ্য যেমন আমাদের মনে কুহক জাগায় এর ঠিক উল্টোদিকে বিষাদও এনে দেয়। বর্ষা যেমন নতুন শিহরণে জাগরিত করে, আবার ডুবাতেও পারে তার উদারতায়। বর্ষার এই চতুর্মুখীনতার কারণেই বোধহয় অন্যান্য ঋতুর ছেয়ে এর গ্রহণযোগ্যতা আর গুরুত্ব বেশি। যার মায়াবী রূপ আমাদেরকে মোহিত করে, আন্দোলিত করে শিহরিত করে। যার দর্শণে আমাদের হৃদয়-মন পুলকিত হয়। বিশেষকরে বর্ষার উথালি-পাথালি ঢেউ আমাদের হৃদয়-মনকে সিক্ত করে। কখনো আমরা হারিয়ে যাই স্বপ্নলোকে, আবার কখনো বা প্রিয়ার দর্শন লাভের জন্য আমরা উদগ্রিব হয়ে উঠি। আবার কখনো বা প্রিয়তমার বিচ্ছেদ ব্যাথায় বর্ষার বৃষ্টির মতো চোখের পানি ঝরতে থাকে আমাদের কপোল বেয়ে। তখন যেন মনের অজান্তেই আমাদের অবুঝ মন গেয়ে ওঠে-এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায় ॥ -(রবীন্দ্রনাথ, বর্ষার দিনে)
বর্ষা নিয়ে কালিদাস রচনা করেছেন বিখ্যাত মহাকাব্য ’মেঘদূত’। মেঘকে সেখানে বন্ধু বলা হয়েছিল। অথচ একজন ফরাসি কবি যাকে আধুনিক কবিতার জনক বলে কেউ কেউ অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন-
বিরক্ত বর্ষার মাস অবিরল সমস্ত শহর
অফুরন্ত পাত্র থেকে ঢালে তার ঠান্ডা অন্ধকার।
-(অনুবাদ, বুদ্ধদেব বসু)
জানি না কালিদাসের সমাধীতে নৈবদ্য আকারে বর্ষা সারাক্ষণ ঝরে কি না। তবে বর্ষার আজীবনের ঋণ তাঁর কাছে। আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং যদি না রামগিরি পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে যেত, আর সে মেঘ দেখে যক্ষের মনে না জাগতো প্রিয়া বিরহের যাতনা, তবে কি মেঘ কিংবা এই বর্ষা হতো কাব্য দেবীর যোগ্য রসদ। আসলেই হতো না। কালিদাসের শুরুটা আর শেষ হল না, লিখে ফেললেন পুরো দুস্তর ’মেঘদূত’ নামক একটি মহাকাব্য।
বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন: ’বর্ষা ও বিরহ এই বিষয় দুটি ভারতীয় কাব্যে আজ পর্যন্ত প্রধান হয়ে আছে; তার একটি মুখ্য কারণ, সন্দেহ নেই, ’মেঘদূত’র আবহমান প্রতিপত্তি। উভয়ের উৎসমূল বাল্মীকি হতে পারেন, কিন্তু অন্য নানা প্রসঙ্গ থেকে কালিদাস এই দু’টিকে বিযুক্ত করে নিয়েছিলেন বলেই তারা উত্তর সাধকের পক্ষে বিশেষভাবে ব্যবহার্য হলো।’
পুরনো ভারতীয় সাহিত্যে কবিরা বর্ষাকালকে বিরহের কাল হিসেবেই বিবেচনা করতেন। কারণ, ভারতে বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে পথঘাট ও মাঠপ্রান্তর বর্ষার জলে ডুবে যেতো। চলাচলের জন্য সেরকম কোনো যানবাহন তখন ছিল না। প্রবাসী স্বমীরা বর্ষা নামার নামার আগেই বাড়ি ফিরতেন, বণিকেরাও তাই করতেন। কিন্তু কেউ যদি বর্ষার আগে বাড়ি ফিরতে না পারতো তাহলে তাকে পুরো সাত-আট মাসই কাটাতে হতো নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে। বর্ষাকে নিয়ে লিখা হয়েছে প্রচুর প্রেম ও বিরহের কবিতা। এ জন্যই বর্ষাকে বিরহের কাল বলা হয়।
বৈষ্ণব কবিদেরকেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায়। বর্ষাকে তিনি দিলেন স্থিতিস্থাপকতা। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে একাধিকবার। বিদ্যাপতির বিরহের কবিতায় বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে, যা নতুনত্ব পায় মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতায়। সেখানে বর্ষা এসেছে রাধিকার প্রেমকে উসকে দেবার জন্য। বিশেষ করে অভিসার আর বিরহ পর্বে এ বর্ষা যেন প্রেমানলে ঘৃতের ছিটা। বৃষ্টির বর্ষনের সঙ্গে সঙ্গে রাধার কন্ঠে বেজে উঠেছে-
এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইলো বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধূয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরান ফাটে। (চন্ডীদাস)
অন্যখানে রাধা বলেছে-
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর। -(বিদ্যাপতি)
এখানে বৃষ্টির জল যেন রাধার চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়ছে। যা পৃথিবীর সকল প্রেমিকাকেই ব্যাকুল করে তোলে।
অথবা-
তিমির দিগভরি ঘোর যামিণী
অথির বিজুরিক পাতিয়া
মত্ত দাদুরী, ডাকিছে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া।
বিদ্যাপতি কহে কৈসে গোঙাইবি
হরি বিনে দিন রাতিয়া। -(বিদ্যাপতি)
উপরের কবিতায় রাধার মনের প্রেম, কামনা-বাসনা আরো উসকে দিয়েছে বর্ষা। এখানেই বর্ষার স্বর্থকতা। বাংলা সাহিত্যে একমাত্র বর্ষারই বিচিত্র ও স্বার্থক ব্যবহার হয়েছে বাংলা কবিতায়। বর্ষা কখনো নিটোল প্রেমের অনুঘটক, কখনোবা কামনা-বাসনা জাগানিয়। আবার কখনো প্রকৃতির রূপ বর্ণনায়, কখনো শৈশব বা কৈশোরের সোনালি স্মৃতির দর্পণ। আবার বর্ষা কখনো বা স্বয়ং নারী। কোথাও বা প্রেমকে অঙ্কুরিত করে এই বর্ষাই। ফুলে ফলে সুশোভিত, কুহুকহু পাখির ডাক আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অকুল পাথারে।
রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় বর্ষার কবি আর জীবনানন্দকে হেমন্তের। তঁরা দু’জন এই দুই ঋতুকে তাদের মনের মাধুরী মেশানো কাব্যভাষা দিয়ে ঋদ্ধ করেছেন। বর্ষার আবেদন যে এত বেশি সুধাময় হয় তা রবীন্দ্রনাথই প্রথম আমাদের সামনে খোলাসা করেছেন। কালিদাসের মেঘদূত আর রবীন্দ্রনাথের বর্ষাপ্রীতি আমাদের কবি সাহিত্যিকদেরকে বড়ই ভাবুক ও প্রেমিক করে তুলেছে। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান এর প্রকৃতি অংশে বর্ষা ও শরৎ ঋতুর উপর যথাক্রমে ১২০+২২= ১৪২টি গান-কবিতা দেখতে পাওয়া যায়। এরপর বসন্ত-৮৯টি, হেমন্ত-৪টি, শীত-১০টি ও গ্রীষ্মের উপর-১৬টি গান দেখতে পাওয়া যায়।
ড. আফসার আহমদ বলেছেন-’বাংলাদেশের আকাশকে আমার কাছে বর্ষার বাবার বাড়ি মনে হয়। এই মনে হওয়াটাও রবীন্দ্রনাথের গানের প্রভাব।’ তিনি যখন যখন গেয়ে উঠেন-
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে, হৃদয় নাচে রে।
শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস
কলাপের মতো করেছ বিকাশ
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে ॥
তখন সত্যিই আমাদের মন ও নেচে উঠে। ’বর্ষার দিনে’ কবিতার শেষে তিনি বলেছেন-
ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,
বিজুলি থেকে বিজুলি চমকায়।
সে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়॥
রবীন্দ্রনাথের ’মেঘদূত’ কবিতায় এসেছে বিদ্যুৎ চমকের কথাও-
আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর,
দুরন্ত পবন অতি-আক্রমণে তার
অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার।
বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘবার
খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া ॥
অথবা-
দেখিছ না, ওগো সাহসিকা,
ঝিকিমিকি বিদ্যুতের শিখা ?
মনে ভেবে দেখো তবে এ ঝড়ে কি বাঁধা রবে
করবীর শেফালিমালিকা ?। (ঝড়ের দিনে )
’কৃষ্ণকলি’ কবিতায় কালো মেঘ আর কালো মেয়ের রূপ একাকার হয়ে গেছে-
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের ’পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ ॥
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ ॥
আর নবীনদেরকে তিনি নব প্রেরণার জেগে উঠার আহ্বান জানিয়েছেন ’বর্ষশেষ’ কবিতায়-
হে কুমার, হাস্যমুখে তোমার ধনুকে দাও টান
ঝনন রনন-
বক্ষের পঞ্জর ভেদি অন্তরকে হউক কম্পিত
সুতীব্র স্বনন।
হে কিশোর, তুলে লও তোমার উদার জয়ভেরি,
করহ আহ্বান-
আমরা দাঁড়াব উঠি, আমরা ছুটিয়া বাহিরিব,
অর্পিব পরান ॥
বর্ষায় ব্যাঙ ডাকে, ডাহুক ডাকে, বিরহীর হৃদয় ফেটে যায়। শ্যাম বিনে যে আর দিন কাটে না। শ্যামকে নিয়ে বিরহার্তি বর্ষাকালে যেন শ্যামেরই শ্যামল শরীরের আভা। রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে অবাহন করেন এভাবে-
এসো শ্যামল সুন্দর,
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা
বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে ॥
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কবিতায় বর্ষাকে এনেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসেবে। বর্ষার প্রকৃতি আর মানব প্রকৃতি এখানে একাকার। যার সাথে একাতœতা ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। ’বর্ষকাল’ কবিতায় তা ফুটে উঠেছে এভাবে-
গভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর,
উথলিল নদ-নদী ধরণী উপর।
রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অনতœরে। -(বিবিধ কাব্য)
কবি আল মাহ্মুদ বর্ষাকে দেখেছেন একটু আলাদা করে। তাঁর বর্ষা ঋতুবর্তী নারী। যা প্রকৃতিকে করে যৌবনবর্তী। ফলবর্তী হতে লোভ জাগায়। যেমন-
শুধু দিগন্তবি¯তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়,
শেওয়াপিছল আমাদের গরীয়ান গ্রহটির যায়।
-(আরব্য রজনীর রাজহাঁস; আষাঢ়ের রাত্রে)
তবে সৈয়দ শামসুল হকের ভালোবাসার রাতে নামক গ্রন্থে বর্ষাকে আমরা প্রায় দেখি সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। সেখানে বর্ষা, নারী, বীজ, কাম, কর্ষণ সব মিলেমিশে একাকার। এ যেন সৃজনের এক মহা প্রস্তুতি। কবি ওমর আলী তাঁর কবিতায় বর্ষার উল্টোপিঠে দেখেছেন। বর্ষা আমাদের শুধু পুলকিতই করে না, শঙ্কিতও করে। বর্ষার পরিণতি সুখের ইতিহাস রচনা করে না। বন্যার কালো থাবা ডুবায়, ভাসায় ভিটে ছাড়া করে ভাটির দেশের মানুষকে। ওমর অলী বর্ষার সে রূপটিই তুলে ধরেছেন তাঁর বন্যা নামক কবিতায়। যেমন-
ঘরের চালার পরে বসে আছে
মাজেদা সাজেদা কিন্তু আর কতক্ষণ
পানি তো ক্রমেই বাড়ছে চারদিকে সাঁতার।
-(গ্রামে ফিরে যাই; বন্যা)
বাংলা কবিতায় বর্ষার বন্দনা হয়েছে যুগে যুগে; সেই মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত। বর্ষা আর বৃষ্টি এখন কবিতার একটি অংশ। এমন কোনো কবি নেই বর্ষাকে কেন্দ্র করে দু’একটি পঙক্তি রচনা করেন নি। আসলে বর্ষার রূপটাই এমন যে, যা যে কোনো মানুষকেই সহজে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। সে শুধু এখন আর বর্ষামঙ্গলের স্তুতি আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সে এখন সর্বব্যাপী। সকল কবি- সাহিত্যিকদের মনে সে আসন পেতে আছে।
মহাদেব সাহা বর্ষাকে দেখেছেন অন্যভাবে। তিনি লিখেছেন-
বর্ষা, তোমাকে না হয় আরো একটু টেনে বলি বরষা,
পদাবলীর ঢংয়ে,
বর্ষা শুনে নাকি কারো মন খারাপ হয়ে যায়,
বিরহ জাগে;
আমার কিন্তু বৃষ্টি খুব ভালো লাগে, বৃষ্টি
আমার শৈশবের মতো
মেয়েরা ভিজতে চায় বৃষ্টিতে,
ভিজুক না,
মেয়েরা জলে না নামলে পদ্মফুল ফুটবে কেন?
এখানে এখন বুক-সমান জল, এখানে এখন
সাঁতার, বর্ষা,
ক্ষতি কী, বর্ষাকে যদি আদর করে বরষা বলি।
শহরে না হোক গ্রামে তো কোনো মেয়ের
নাম হতে পারে বরষা,
সেই ঝমঝম রেলগাড়ি, সেই বৃষ্টি
আমার ঘুমের উপর দিয়ে মেঘ ভেসে যায়
আমি কাঁচা ঘুমের মধ্যে থেকে ডাকতে থাকি,
বরষা, ও বরষা।
পল্লী কবি জসীমউদ্দীন বর্ষাকে দেখেছেন বাংলার সুখ-সমৃদ্ধি আর আশার আলো হিসেবে। তিনি ’পল্লীবর্ষা’ কবিতায় লিখেছেন-
বউদের আজ কোনো কাজ নাই
বেড়ায় বাঁধিয়া রসি
সমুদ্র কলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
তারে ভাষা দেয় দীঘল সুতোয় মায়াবী নকশা টানি।
বৈদেশী কোন বন্ধুর লাগি মন তাঁর কেঁদে ফেরে
মিঠে সুরে গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেড়ে।
আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে
বেণু বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে?
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-’আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে।’ কবি শামসুর রাহমান বলেছেন চমৎকার কথা- ’বর্ষাকে আমি ভালবাসি আমার প্রিয়জনের মত করে।’- এই প্রিয়জন হয়ে সবার মন রাঙিয়ে দিতে, গলায় সুর তুলতে বর্ষা আবার ফিরে এসেছে আমাদের জীবনে। বর্ষাকালে আকাশে মেঘ জমাট বাধার সাথে সাথে আমাদের মনও ভারাক্রান্ত হয়ে যায়; সে শুধু প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। হারিয়ে যায় দূর অজানায়, কল্পলোকের রাজ্যে।
পরিশেষে একথা বলা যায়, ঐশ্বর্যের ঋতু, অকৃপণ ঋতু, সমৃদ্ধির ঋতু বর্ষা। সে,সকল প্রকার জরাজীর্ণ, পাপ-তাপ আর পুরাতনকে ধুয়ে মুছে পবিত্র করে তোলে। সে যতটা না কাঁদে, তার ছেয়ে বেশি হাসে। প্রকৃতিতে লাগে যৌবনের হাওয়া। পুকুর পাড়ে ফুটে সোনালি কদম। বলক-বালিকারা তোলে শাপলা-শালুক। প্রভাতের শিউলি ফুলে ঢেকে যায় সবুজ দুর্বাঘাস। বর্ষার সাথে বাঙালীর জীবনও একই সূত্রে গাঁথা। চারদিকে সবুজের মনোলোভা রূপ আমাদেরকে মোহিত না করে পারে না। তখন আমাদের কেবল গুনগুনিয়ে গাইতে ইচ্ছে করে -
"শাওন রাতে যদি
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরাণসখা বন্ধু হে আমার ॥"
বর্ষার আবেদন যুগে যুগে অমলিন থাকবে আমাদের সাহিত্যের সাথে মনে-মননে ও হৃদয়ের মণিকোঠায়।।
"শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে ......"
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment