বিশ্বময়ী মা
সুবীর ঘোষ
মা রাখীদেবী বললেন-- তোরা আয় খেয়ে নে, দুধ যে ঠান্ডা হয়ে গেল ।
তপন বলল--মা শহীদুরকে দেবে না তো । ও আমাকে জলদি আউট করে দিয়েছে ।
মা--ও আবার কী কথা ! তুমি বল সামলাতে পারনি তাই আউট হয়ে গেছ ।
তপন--না মা, ও আমাদের বাড়িতে খাবে না ।
মা-- তাই আবার হয় না কী ? ওর মা বাড়ি নেই । আমার কাছে ওকে রেখে গেছে । ওকে খেতে দেব না ?
এরপর শহীদুর এসে বলল --মাসি ওকে তুমি খেতে দিয়ে দাও । আমি না-হয় পরে খাব । নইলে ও আমাকে মারবে ।
মা বললেন --মারুক তো দেখি । আমি আছি না ?
ওরা খেয়ে বেরিয়ে গেলে রাখীদেবী বেরোলেন । রাস্তায় বীথির সঙ্গে দেখা ।
রাখী বললেন --কী রে বীথি যাচ্ছিস কোথায় ?
বীথি--আমি যাচ্ছি নাপিতবউকে খবর দিতে । মা আজ আলতা পরবে । বৌদি তুমি কোথায় চললে ?
রাখী বললেন ---বামুনপাড়ার তিনুদিকে আজ দুপুরে খেতে বলেছি । ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব ।
বীথি--চল না বৌদি মাঝের পাড়ার জগদ্ধাত্রী ঠাকুরটা দেখে যাই । শুনলাম না কী খুব ভালো হয়েছে ।
এরপর ওরা প্যাণ্ডেলে গিয়ে ঠাকুর দেখল । প্রণাম করার সময় রাখীদেবী মনে মনে বললেন --
মা মা গো, জগন্ময়ী মা । ঘরে ঘরে সব মা-ই যেন জগন্মাতা হয়ে ওঠে । আমিও যেন শুধু আমার সন্তানের নয়, সবার মা হয়ে উঠতে পারি।
************************
কবিতার মা, গদ্যের মা // বিশ্বজিৎ রায়
মা বলেছিলেন, "আমি যেমন তোর মা,
এই মাটিও হচ্ছে তেমন, তোর মা",/
বাবা গান শিখিয়েছিলেন," ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা"-----/
সেই থেকে আমার বেড়ে ওঠা গ্রাম, আমার বেঁচে থাকার শহর, /
মানচিত্রে এঁকে রাখা দেশের মাটিকে আমি /
মাতৃ জ্ঞানে পুজা করি, শ্রদ্ধা করি,/
এই মা-ই আমার আশ্রয়ের সুখ, প্রাণের আরাম...
###
এসব কথা স্বপ্নে - কবিতায়-- স্মৃতিডুবে লেখা ----/
কিন্তু, যখন দুপায়ে দাঁড়িয়ে, চোখ খুলে
চারদিক দেখতে দেখতে গদ্য লিখি, /
তখন সেই মা-ই হয়ে ওঠেন রক্তাক্ত, সন্ত্রস্ত, ক্ষতবিক্ষত,/
দলা পাকিয়ে পড়ে থাকেন অন্ধকার খালের ধারে,/ পাটক্ষেতে অথবা পরিত্যক্ত ভাঙা ঘরে---/
যখন উদ্ধার করা হয় তাকে, তখন তার চোখমুখ অন্ধকার ভরা, /
বোবা, ফ্যাকাশে, চলত শক্তিহীন-----/
####
গদ্যপাতায় তখন উপসংহার লিখি ---
"মা, আমি তোমার এক ক্লীব সন্তান, /
তোমার এই অবস্থার জন্য আমি বা /
আমার মতো শান্ত,ভদ্র, নিরাপদবিলাসি সন্তানরাই দায়ী,
আমাদের ক্ষমা করে দিও মা ---/
##
" আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকেনা" ....
-------
মা
অমিত কাশ্যপ
মা শুয়ে আছেন। বাবা-কাকারা ব্যস্ত। বাড়িময় লোক। পিসিমা শুধু বলল, খাটের পাশটি থেকে উঠবি নি। উঠলেই তোর মা চলে যাবে।
মা তো চলেই গেছে। সেদিন বুঝিনি। কয়েকদিন পর এটা করবি না, ওটা করবি না। লক্ষ্মীটি, এই বেলা এইগুলো খেয়ে নেয়ে, ওই বেলা অন্যকিছু করে দেব।
কয়েকদিন পর মা'র একটা ছবিতে ধূপ ধুনো মালা দিয়ে পুজো হল। তারপর দেওয়ালে টাঙিয়ে বাবা বলল, রোজ স্কুলে যাবার সময় প্রণাম করবি। স্কুল থেকে এসে দেখবি মা এসে গেছে।
মা আর আসেনি। এখনো প্রণাম করি। জানি মা আর আসবে না।
কর্তব্য
তপনকুমার গোস্বামী
----”মাসিমা শুনছেন " শুনে সরমা থমকাল। ঘোলাটে চোখ তুলে বলল---" আমায় কিছু বলছ বাবা! " হারু বলল---" কিছু মনে করবেন না মাসিমা। প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে দেখি একটা ছেলে আপনাকে খুব যত্ন করে ব্যাঙ্কে নিয়ে আসে। কিন্তু ফেরার সময় আপনাকে এভাবে ধুকতে ধুকতে যেতে হয়। তা ওই ছেলেটি কী আপনার কেউ হয় মাসিমা? " সরমা অবাক গলায় বলল--- " কী বলছ বাবা? কেউ হয় মানে! ওই তো আমার সোনার চাঁদ। আমার শিবরাত্রির সলতে। আমার বেটা দুলু। মানে দুলাল। "
এবার হারু আবার হয়ে যায়। বলে----"আপনার ছেলে! তা প্রতিমাসের নির্দিষ্ট সময়ে মা'কে যত্ন করে ব্যাঙ্কে নিয়ে আসে কী পেনশনের টাকা তুলতে? " সরমা বলল--- " হ্যাঁ বাবা। ওই পেনশনের টাকা কটাই তো সম্বল!" হারু গলায় শ্লেষ এনে বলল--- " ও! তাই মা'কে যত্ন করে আনে পেনশনের টাকার জন্যে ! আর টাকাটা হাতানো হয়ে গেলেই...।" সরমা আঁতকে উঠে বলে ---"ছিঃ! ওরকম বলে না বাবা! ছেলে তার কর্তব্য করছে আর আমি আমার। আমি যে ওর মা! দুলু যে আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন! "
মা
আলোক মন্ডল
পাড়ার জঙ্গল সাফ করতে
পুরো মঙ্গলবারটাই কেটে গেল।
ফিনফিন হাওয়ায় সাফসুতরা উঠোন।
মা বলল,খোকা এক বালতি জল দে তো
এ বেলা স্নানটা সেরে ফেলি!
দেখি অশোক গাছটা আরও সবুজ হয়ে উঠল।
মা
নন্দিনী সরকার।
এ কী মাতৃদিবস!!
মা তো মেয়ের নামান্তর।
ঘুমোয় জননী শিশুর মতো ,
শিশুই হয়েছে জননী।
নিজ গর্ভে ধারণ করা সন্তান
লালন করে জন্মদাত্রীকে।
এই কি বিধাতার লিখন!
না কি কালচক্র?
আবর্তে ঘুরতে থাকে শৈশব যৌবন বার্ধক্য।
কন্যা- জায়া- জননী- রূপে--
এক ধাপ থেকে অপর ধাপে
উত্তরণ।
নাকি বিলীনের কাছাকাছি !
নবীনের জন্য স্থান ছেড়ে যাওয়া?
ভাবলে আশ্চর্য লাগে-
না ভাবলেই ফক্কা।
শরীরের সাথে সাথে মনের রূপান্তর ,
ভালবাসা স্নেহ বকুনির পাঁচ ফোড়নে
মাঝে মাঝে ঝাঁজ লাগে,
চোখ জ্বালা করে,
মন বিবশ হয়।
আবার আনন্দে আদরে শুকিয়ে যায়
চোখের জল,
তুমি আর আমি মিলে হয়ে যাই
একাকার --
কে মা কে মেয়ে বোঝা ভার।।
অণুগল্প
মায়ের কথা || জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
প্রবল হাততালির শব্দ শুনে মঞ্চের দিকে তাকালো সুদীপ।দেখলো এক অত্যন্ত
সুবেশ ভদ্রলোক বক্তব্য রাখছেন এবং মাঝে মাঝেই হাততালির বন্যা ছুটছে।
বক্তব্য শুনে সুদীপ বুঝলো,আজ মাতৃদিবস,সন্তানের জীবনে মায়ের অবদান কত
গুরুত্বপূর্ণ এবং মায়ের ঋণ জীবনে শোধ হয় না -- সেই কথাই তাঁর উৎকৃষ্ট ভাষায় বলছেন বক্তা।
পাশের শ্রোতার কাছে সে জানলো বক্তার নাম নিতাই রায়,তিনি এই শহরের
একজন গণ্যমান্য মানুষ।
তাঁর ব্যক্তিত্ব আকর্ষণীয়,দরাজ কণ্ঠ,বক্তব্য মনোমুগ্ধকর।
একসময় বক্তব্য শেষ হয়,হাততালি যেন আর থামে না।
ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে সুদীপ দেখে সামনে এক বৃদ্ধা,দীন মলিন বেশে
দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন।
সে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,আপনি কাঁদছেন কেন মাসিমা?
নিতাইবাবুর বক্তব্য শুনে সবাই হাততালি দিচ্ছে আর আপনি কাঁদছেন!
-- বাবা যারা হাততালি দিচ্ছে তারা কেউ আমার ছেলে নয়,কিন্তু ওই
নিতাইকে আমি পেটে ধরেছি ,মানুষ করেছি। বলার সময় ও কত সুন্দর করে বলে
আর আমি ওর মা -- আমার অবস্থা দ্যাখো!
‘মা’ বিষয়ক সংকলন
‘মা’/ আজমীরা প্রামাণিক
মা মানে তো একই অঙ্গে দশটা মাসের বাস,
বেঁচে থাকার জন্য নেওয়া বিশুদ্ধ প্রশ্বাস।
কষ্ট সয়ে সন্তানকে আলোর দেশে আনা,
স্নেহ চুম্বন ও মমতায় বুকের কাছে টানা।
মা মানে তো কোলে মাথা, শাসন এবং আদর,
দারুন শীতে আগলে রাখা উষ্ণতারই চাদর।
মুক্ত আকাশ, নিদ্রাহীনা প্রহর গোনা রক্ষী,
ঘুম পাড়ানি গান আর ঘুম জাগানো পক্ষী।
বিপদ বালাই তুচ্ছ করা একই নারীর বন্ধন,
নিরাপদ আশ্রয়ের একটাই অবলম্বন।
মাথার ‘পরে বটের মত দাঁড়িয়ে থাকা ছাতা,
মারন রোগে বাঁচিয়ে দেওয়া বনৌষধির পাতা।
মা মানে তো খাঁটি সোনা, জীবন দায়ী জল,
অপুষ্টিতে জোগান দেওয়া পুষ্টিদায়ক ফল।
মা মানে তো অষ্টপ্রহর হাসনুহানার গন্ধ,
অচল রথের সচল চাকা, ভালোবাসায় অন্ধ।
মা যে প্রধান বিচারপতি, হীরে মানিক পান্না,
তোলে মুখে হাসির জোয়ার থামিয়ে সকল কান্না।
মা মানে তো মহাসাগর, হাতের মুঠোয় বিশ্ব,
মা বিহনে রাজা-উজির সবাই জেনো নিঃস্ব।
*" মা "*
***""""""""***
কলমে - দেবাশিস চক্রবর্ত্তী ।
*************************
বাবাকে তো হারিয়েছি সেই
জীবন শুরুর প্রাতে ,
মা যে আমায় জড়িয়ে ছিল
সারাটা দিন রাতে ।
কোন সে পথে চললে আমায়
মানুষ বলবে লোকে ,
শিখিয়েছিল সইতে ব্যাথা
সকল দুঃখ শোকে ।
যন্ত্রনাটা নিজেই সয়ে
আমার সুখের ত্বরে,
তিলে তিলে করলো বড়ো
আমায় যত্ন করে ।
মাগো- বড়ো আমি হলাম ঠিকই
মানুষ হলাম কৈ ?
দেখতে মানুষ হলেও আমি
ভালো মানুষ নই ।
তাইতো তুমি আমায় ছেড়ে
চলে যেতে পারো,
মনে আছে সালটা ছিল
দু হাজার বারো ।
পারিনি তো রাখতে তোমায়
আমার পূজার ঘরে ,
হারিয়ে তোমায় তাইতো কাঁদি
অন্তরে অন্তরে ।
কেন আমায় একলা ফেলে
চলে গেলে মা ?
জানি, তোমার মতো বন্ধু আমি
কোথাও পাবো না ।
আর একবার মাগো তোমায়
ফিরে যদি পেতাম ,
যাবার সময় হাত ধরে মা
তোমার সাথে যেতাম ।
এসে ছিলাম তোমার ত্বরে
যেতাম তোমার সাথে ,
দেখত সবাই , দুটি তারা
জ্বলছে গভীর রাতে ।
*************************
মা
গোবিন্দ মোদক
'মা' বলতে একটি কথা মনে রেখো ভাই,
ছোট্ট একটি শব্দ হলেও তুলনা তার নাই।
মা যে হন গর্ভধারিণী, স্নেহময়ী জননী,
বুক ভরা তাঁর স্নেহ-আদর ভালোবাসার খনি।
মা যে হন মমতাময়ী, স্নেহে ভরা বুক,
প্রাণটা খুলে মাকে ডেকে ভীষণই হয় সুখ।
মা যে হন স্তন্যদায়িনী, মানবী-ঈশ্বরী,
বাৎসল্য স্নেহাদরে আমাদের রাখেন ভরি।
মা যে হন মানবী-দেবী, স্নেহে পাগলপারা,
অতলান্ত মমতায় যাঁর হৃদয় আছে ভরা।
মায়ের নেই আদি-অনাদি, মা যে শাশ্বত,
স্নেহের ছোঁয়ায় মুছিয়ে দেন সন্তানের ক্ষত।
সন্তানের ব্যথায় কাতর সেই সে হলেন মা,
পৃথিবী ঘুরেও যাঁর তুলনা কোথাও পাবে না।।
'মা
প্রেমেশ প ন্ডা
মা হল সচ্চিদানন্দ ।
মা কখনো হয় না মন্দ।
মা হলো এক পৃথিবী আলো,
মা হল সব ভালোর ভালো।
মা মানেই শান্তি ,
মা মানেই আশ্রয়-
মা হল অফুরন্ত শক্তি।
মা আমার বৃদ্ধা,
মা আমার শ্রদ্ধা
চিরদিন থাকে ভক্তি।
মায়ের মমতাবোধ
সুমন লস্কর
প্রেমিকা বললো, ' তুমি যদি তোমার মায়ের হৃদপিন্ডটা আমাকে উপহার দিতে পারো তবেই তোমার প্রেমের প্রস্তাবে আমি রাজি '। সুতীক্ষ্ণ চুরি দিয়ে প্রেমিক উপড়ে ফেলল মায়ের হৃদপিণ্ড। সে চলেছে প্রেমিকার কাছে , হতে মায়ের দেহ থেকে সদ্য ওপড়ানো হৃদপিণ্ড, মনে খুশি।হটাৎ হোচট খেলো প্রেমিক, হাত থেকে ছিটকে পরলো মায়ের হৃদপিণ্ড। হৃদপিণ্ড বলে উঠলো, ' আহা! বাছা, লাগেনিতো!'
সর্বংসহা
খুকু ভূঞ্যা
আঁচলে আগুন নিয়ে পথ হাঁটছে তিনি কয়েকশো মাইল
চাওয়া পাওয়ার হিসেব না করে জীবনকে যতভাবে ভাঙা যায়--
ভাঙতে ভাঙতে পাথর অথবা কয়লার ভেতর থেকে
একটুকরো হীরেরূপী আলোর সন্ধানে এতো সংগ্ৰাম--
এতো আত্মক্ষয়--
ঘামের ঐশ্বর্যে সাজানো পথে হাঁটতে হাঁটতে
আশ্চর্য মন্দির,সতীপীঠ
তিনি জননী, সর্বংসহা
আমাকে মাটি করো,কর্ষন করো
ধরিত্রীর সীতাচিহ্ন থেকে উঠে আসুক ভূমিজা
ঐহ্যিকের তুচ্ছতা চুরমার করে একটি অগ্নিপিণ্ড বেরিয়ে আসুক
চোখের ঘরে শুয়ে থাক আদিগন্ত তেজরাশি
ধানশোক ভুলিয়ে বজ্রকঠিণ করো,দহিত জীবন সেরে উঠুক---
মা
দুর্গাদাস মিদ্যা।
যেখানেতে দেখি যাহা
মায়ের মতন আহা
সুধামাখা নামটি নাই।
খুব ছোটবেলায় এই কবিতাটি পড়েছিলাম। কে
রচনা করেছিলেন তাও ভুলে গেছি তবে মায়ের
কথা এলেই এই কটি লাইন সাজানো দাঁতের মতো উঠে আসে আর হাসিতে চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। মা মানে এমন এক স্নেহময়
মুরতি যা ভাবলে সারা শরীরে এমন এক আনন্দ তরঙ্গ বয়ে যায় যেন খিলখিলিয়ে ওঠে
সারা জগৎ।
মা এত সংক্ষিপ্ত শব্দে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন বোধ উঠে আসে। সময়ে অসময়ে যে আঁঠার মতো জড়িয়ে থাকে সে আমার মা। শুধু একটা কথা
ভাবুন
মা মানে কোন মিথ্যা নয়। জন্মের আগে থেকেই
যাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা সে কে ----মাই তো। এইযে মা তার কোন অলটারনেটিভ নেই।
বাবা বদলে যেতে পারে কিন্তু মায়ের বদল হয় না
মাতৃত্বের বদল হয় না। আমরা যে ভাষায় কথা বলি সেটা মাতৃভাষা কেন? কেন পিতৃ ভাষা নয়?
এই প্রশ্ন তো আর এমনি উঠে আসে না। যে কোন শিশু তার মায়ের ভাষাতেই কথা বলে।
কারণ মা তার সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু।
কোন মানুষ বেঁচে থাকতো যদি জন্মলগ্নে মায়ের বুকের দুধ না পেত? অতএব বুঝতেই পারছেন attachment টা কোথায়।?
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে তিনি একটি গভীর সত্য উপলব্ধির কথা বলেছিলেন----Give me good mother I will give you a good nation. এ এক চরম সত্য কথা। মায়ের চরিত্র দিয়েই জাতির চরিত্র তৈরি হয়। যখন আমরা বিপদে পড়ি তখন মা-ই প্রথম উচ্চারিত হয় আমাদের কন্ঠে। আনন্দে যখন মাকে জড়িয়ে ধরি তখন সর্ব প্রাপ্তির এক
আনন্দ ধারা বয়ে যায়। সন্তান শব্দ উচ্চারিত হলেই এক মায়ের ছবি উঠে আসে। মা এই শব্দ যে খুব লঘু শব্দ তা নয় তা যদি হোত তাহলে পৃথিবীর সাথে মায়ের তুলনা করা হোত না।
মাকে নিয়ে অজস্র কথা লেখা যায় কারণ মা সসাগরা ধরিত্রী। মাকে প্রণাম।
অনুগল্প....
------------------
জায়গা.....
---------------------- সুকান্ত আচার্য্য।
জানালার কাছে বসে উদাস মনে পুরোনো কথা ভাবছিলেন আরতি দেবী। দেখতে দেখতে চোখের সামনে একমাত্র ছেলে বড় হলো। লেখাপড়া শিখে বড় কোম্পানী তে চাকরি পেল, বাড়িতে বৌমা এল। না, কখনোই তিনি বৌমাকে নিজের কাছে আটকে রাখেন নি। ছেলে কলকাতায় একা ফ্ল্যাটে কি করে থাকবে! নাতিটাও হয়েছিল ঠিক তার বাবার মত ফুটফুটে। যেদিন তার স্বামী দেহ রাখলেন তার ঠিক একমাসের মধ্যে ছেলে এসে বলল যে গ্রামের বাড়ি, জমিজমা সব বিক্রি করে দেবে। ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়ার জন্ত্রনাতে এই ভেবে স্বস্তি পেলেন, শেষ জীবনটা না হয় নাতির সঙ্গে হেসে খেলে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস!
এইসব ভাবতে ভাবতে বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ার টেকারের ডাক কানে এলো, "জলখাবারের সময় হয়েছে"। এই ডাকটি হয়তো বৌমার কাছ থেকে শুনতে চেয়েছিলেন। চোখ মুছতে মুছতে টেবিলে রাখা স্বামীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললেন," দেখেছো, মায়ের এতটুকু পেটে ছেলের জায়গা হয়, তবু ছেলের এতবড় ফ্ল্যাটে মায়ের জায়গা হয়না"।
জন্মদাগ
সোনালী মিত্র
এখনও বাতাসে তোমার শরীরের ঘ্রান
কতো পথ হেঁটে গেছো, তবুও তুমি ছুঁয়ে
আছো আমাকে।
তোমাকে পাওয়া অনুভবে পূর্ণতা ঢেলে দেয় অমৃতধারা।
চেতনায় উজ্জীবিত তুমি
দুচোখ ঐ অসীমে আমার
অজস্র তারার ভীড় ঠেলে স্পর্শে
প্রবেশ করো ।
যে শূন্যতা ছড়িয়ে গেছো চতুর্পাশে
ভাবিনি একদিনও,
নদী হয়ে ছুঁয়ে আছো, অবগাহন করি
জন্মদাগ মায়ের গভীরে
তুমি যে বিশ্ব আসন।
মা কোথায়?
চন্দন মাইতি
ভাটিতে পুড়ছে মাটি, প্রসূত ইট।
কাঁচা বাড়ির কোলে জাগায় অট্টালিকা।
কামারের নেহাই পিঠ পেতে সয় হাতুড়ি,
সৃষ্টি করে নবজাতক।
স্রোতস্বিনী, সভ্যতার গর্ভধারীণি বেগবতী,
কলুষিত, অক্লান্ত নিরহংকারীনি।
বারিধারা প্রসবিনী, গর্জনকারীনি।
উদ্ভিদ ও প্রাণী পাড়ার পিপাসা হরণী।
ক্ষুদ্র বীজ, উর্বর মাটি
স্পন্দনের ঘাঁটি।
পল্লব, কুঁড়ি, ফুল, ফল, বীজ উদগীরনি।
মৃত্তিকা জাত, মৃত্তিকা প্রহরীনি।
রং- পেনসিল তুলির চালকে,
অক্ষর ও শব্দের মেকানিকে।
কোনখানে নেই তিনি?
যেখানে কলমের আঁচড় পড়ে না
সেখানেও থাকেন অসীমা তিনি।
পাঁচালিপাঠিকা আমার মা
গৌরাঙ্গ শ্রীবাল
শুধু মধুসূদন দত্ত'র মা কিংবা 'পথের পাঁচালী'র অপুর মা সর্বজয়া নয়, আমার মাও কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত, লক্ষ্মীর পাঁচালী প্রভৃতি বইপত্র পড়তে পারত। মায়ের যখন বিয়ে হয় দশম শ্রেণীর ছাত্রী। মাধ্যমিক দেওয়া হয়নি। বিয়ে স্বামী দাম্পত্যজীবন সংসার সন্তান এসব বুঝে ওঠার আগেই স্বামীর বাড়িতে চলে এল পালকিতে বউ হয়ে।
মায়ের বিয়ে নিয়ে দাদামশাইয়ের সঙ্গে বড়োমামার মনোমালীন্য। মায়ের বিয়ের পর অনেকদিন পযর্ন্ত বড়োমামা আমাদের বাড়িতে আসেনি। বড়োমামার আপত্তি মায়ের অল্পবয়সে বিয়ে দেওয়া নিয়ে, বড়োমামা চেয়েছিল মা আপাতত মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দিক। দাদামশাইয়ের সিদ্ধান্ত ছিল মেয়েদের এত পড়াশুনা খুব একটা কাজের নয়, তার উপরে মা-মরা মেয়ে, পাত্রপক্ষ এগিয়ে এসেছে যখন। 'মা-মরা' বলতে আমার মায়ের পাঁচ-ছ-বছর বয়সে মায়ের মা অর্থাৎ আমার দিদিমা মারা যায়। মায়ের পালকিতে করে বউ হয়ে আসা মিথ্যা নয়। বাবা যখন বিয়ে করতে যায় তখন বরকনের জন্য পালকির চল ছিল। আজ থেকে চল্লিশ-একচল্লিশ বছর আগেকার কথা।
যতদূর মনে পড়ে আমার মা বেশ সুর করে রামায়ণ লক্ষ্মচরিত্র পড়ত। শ্রোতা হিসেবে ছিল ঠাকুমা, দাদু, পাশের বাড়ির বড়ো ঠাকুমা মাঝেমধ্যে বাবাকাকা, পঞ্চানন জেঠুও শুনত। পঞ্চানন জেঠু আমাদের বাড়িতে কাজের জন্য থাকত। তার বাড়ি নন্দীগ্রামের গড় কমলপুর। সেও এইসব বই পড়তে পারত। মাকে মেয়ের মতোই যত্নআত্তি করত দাদুঠাকুমা। আমার ঠাকুমা নিজের হাতে ঘরকন্নার কাজ শিখিয়ে দিয়েছিল মা'কে। বাবা, মেজোকাকাও মাঝে মাঝে পাঁচালি খুলে সুর তুলত। বাবা-কাকা-জেঠুর গলা যেমন একটু বেশি উদাত্ত, লয় ছিল দ্রুত, মায়ের ছিল ধীর লয়ের সুরেলা কণ্ঠস্বর।
মায়ের মুখে রামায়ণের সীতার দুঃখের কথা শুনে ঠাকুমার চোখে জল চিকচিক করতে দেখতাম। তারা মনে করত তাদের থেকে সীতার জীবনের দুঃখ অনেক বেশি। রাজকুমারী সীতার বাবা ছিল রাজা, স্বামী ছিল রাজপুত্র, রাজপাট ছিল, দেবশিশুর মতো সন্তান ছিল, তবুও সে ভিখারিনী। বনেজঙ্গলে কুঁড়েঘরে কেটে গেছে অনেকটা জীবন। তারপরেও তাকে স্বেচ্ছায় যেতে হয়েছে পাতালপুরির অন্ধকারে।
মূলত খেটে খাওয়া গ্রামবাংলার নারীদের কাছে ঘরসংসার ছিল পাতালপুরির অন্ধকারের মতো। হাতে অর্থ ছিল না, স্বচ্ছলতার সুখ ছিল না, ছিল না মনের শান্তি। তবে একটা ভালোবাসা ছিল। যে ভালোবাসায় এত অভাব-অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকত। সীতাও চেয়েছিল, আমার মা, ঠাকুমারাও তাই চাইত। সীতার অন্তিম পরিণতি দেখে নিজেদের জীবনের কথা ভেবে নীরবে চোখের জল ফেলত। আমার মা-ঠাকুমার তো সীতার বৈভবের মতো কিছুই ছিল না।
দেখতাম দাদুও কেমন থম মেরে বসে আছে। সে কি সীতার দুঃখে, না, রামচন্দ্রের কৃতকর্মের কথা জন্য, না-কি রামের জীবনের আয়নায় নিজের অক্ষম মুখ দেখে? এই অক্ষমতা আমার বাবার মধ্যেও সক্রিয় ছিল। মাঝে মাঝে আমার মা'কে আমি কাঁদতে দেখেছি মধ্যরাতে। মায়ের বড়োমুখ করে কারও কাছে বলার ও দেখানোর কিছুই ছিল না। ঘরের বড়োবউ, এইটুকুই যা পাওয়া। না ছিল সোনার গয়না, না ছিল একটা সুন্দর ঘর, না ছিল বাবার ভালো উপার্জন, তার উপরে আমি ছাড়া তাদের দুটি মেয়ে। ছোটোবোনকে নিয়ে বাবার অসন্তোষ ছিল মায়ের আরও দুঃখের কারণ। অথচ আমার ছোটোবোনই একদিন হয়ে ওঠে অত্যন্ত স্নেহের সোনামণি।
রামায়ণ ছাড়াও মায়ের প্রিয় পাঠ্য পাঁচালি ছিল 'লক্ষ্মী-চরিত্র'। এই বই পড়ে মা বেশি সুখ পেত। এর কাহিনীর সঙ্গে মাঠাকুমা নিজেদের একাত্ম করে ভাবত। লক্ষ্মীর পাঁচালির যে ব্যাপারটা মা'কে বেশি টানত তা হল এই বইয়ে বর্ণীত লক্ষ্মীর ব্রতের নিয়মনীতি। মা-ঠাকুমা মনে করত এইসব নিয়মনীতি ভক্তিভরে বা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলে, মেনে চললে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি হয়, সংসারের সবাই সুখে থাকে। অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসের বৃহস্পতিবার ছিল লক্ষ্মী-চরিত্র পাঠের ভালো দিন। সেই পাঁচালির একটি কাহিনীর নাম আমার এখনো মনে আছে 'বিনন্দ রাখালের পালা'।
পাঁচালি ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের গল্প উপন্যাস পড়ার প্রতিও আমার মা'র ঝোঁক ছিল বেশ। বিশেষ করে শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাসের প্রতি টান ছিল প্রবল। শরৎচন্দ্রের মেজদিদি, বড়দিদি, বিরাজবউ, দেনাপাওনা, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ প্রভৃতি গল্প-উপন্যাসের নাম মায়ের মুখে মুখে ঘুরত। মায়ের মুখেই শুনেছি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা উপস্থাপিত শরৎচন্দ্রের 'বিন্দুর ছেলে' উপন্যাসের নাট্যরূপে অমূল্য চরিত্রে মা অভিনয় করেছিল। আমার বাংলা অনার্স ক্লাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস হিসেবে পাঠ্য ছিল 'চোখের বালি'। মাও উপন্যাসটি পড়েছিল। পড়ার পর বলেছিল 'এই উপন্যাস তোদের পড়ানো হয়'? মায়ের এই জিজ্ঞাসার কারণ অনুমান করতে পারি। মায়ের রক্ষণশীল মানসিকতা 'চোখের বালি' মনস্তাত্ত্বিক প্রেম গ্রহণ করতে কোথায় একটু বাধোবাধো ঠেকছিল। যদিও মনস্তাত্ত্বিকতা সম্পর্কে আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।
আরও কিছু কিছু বইপত্র মা পড়েছে। তার এই পড়াশুনার প্রভাব আমরা ভাইবোনেরা অনেকখানি পেয়েছি। আমাদের বর্ণপরিচয়, প্রাথমিক শিক্ষাটা মায়ের কাছেই। মা ভাত রান্না করতে করতে, মুড়ি ভাজতে ভাজতে, ঘুমাতে যাওয়ার আগেও পড়াত, শ্লেট-পেনসিলে লেখাত। যখন কোনো একটা বিষয় না পারতাম মা হাতের কাছে যা পেত তাই দিয়ে পিঠে বসিয়ে দিত। এখনো সে যন্ত্রণা পিঠে অনুভব করি। সন্তানের শরীরে যদি মায়ের হাতের প্রকৃত স্পর্শ লেগে থাকে তা হল ওই প্রহারগুলো। একসময় বাবা-মা'র শাসন সন্তানের চরিত্র গঠনে সহায়ক ছিল, আজকের শাসন সন্তানকে বিগড়ে দেয়, বিপথে চালিত করে।
আমার পুথিপাঠিকা মা'কে অনুসরণ করে ও দাদুর অনুপ্রেরণায় আমিও এসব ধর্মীয় কাহিনীসম্বলিত বইপত্র কিছু কিছু পড়েছি। অসুস্থ দাদুকে পড়ে শুনিয়েছি শ্রীমদভাগবত গীতা ও ভাগবতের বাংলা অনুবাদ। এখন আমার মা মধ্যবয়সী প্রৌঢ়া। চোখের সমস্যার জন্য কম দেখতে পায়। বইয়ের ছোটো ছোটো ছাপা অক্ষরগুলো পড়তে খুব অসুবিধা হয়। এখনো পাঁচালি পাঠে কিংবা পড়াশুনায় মায়ের মন আছে। ছোটো লেখা যেহেতু পড়তে পারে না, সেহেতু আমার মেয়ের প্রাথমিকের 'অ আ ক খ'র বইপত্র উলটেপালটে দেখে। অর্থাৎ আমার প্রথম গৃহশিক্ষকের মতো আমার মেয়েরও প্রথম গৃহশিক্ষক আমার পাঁচালিপাঠিকা মা।
শ্রীচরনেষু
মা,
নীতা সরকার
অনেক দিন পর তোমায় চিঠি লিখছি।
তুমি কেমন আছো মা।
কতবছর হয়ে গেল তোমার দেখা পায়নি।
তোমার কথা খুব মনে পড়ে।
তুমি তো আমার কথা ভাবেনা।
আমাকে মনেই পরে না তোমার।
মনে আছে মা, ছোটো বেলার কথা,
তোমার কোলে বসিয়ে ভাত খাওয়াতে,
চুলে বিনুনি করে দিতে। ঘুমাবার সময়
মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে গান গাইতে।
কি সুন্দর ছিল তোমার গানের গলা।
কিন্তু সংসারে জন্য কিছুই করতে পারলে না তুমি।
সারাজীবন শুধু মুখবুজে থাকলে।
এখন আমি বড় হয়েছি।
তোমার কষ্টটা বুঝতে পারি।
করার তো আর কিছুই নেই।
তোমাকে এখন কোথায় পাবো।
তোমাকে ছাড়া আমার আর ভালো
লাগে না মা।
ইতি---
তোমার তিন্নি।
আমার কালো মা///
সঞ্জয় সোম
আমার কালো মা। আমার কোমর পড়া মা। উঠোনে মুড়ি ভাজতো।
দুপুরে সুর করে রামায়ন মহাভারত পড়তো।মন দিয়ে শুনতাম ভীমের কথা।কর্ণের কথা।
কালো পায়ে পরতো আলতা।
জোড়া পায়ের আলো ছড়িয়ে পড়তো
আমাদের ঘরময়
বিকেলে যখন কর্মস্থল থেকে ফিরতাম
দেখতাম জননী বসে আছেন মাসিমাদের পুলে
মা'কে লিখে শেষ করতে পারিনি
কোনও শব্দকেই যথেষ্ট মনে হয়নি
যিনি গর্ভে ধারণ করেছেন
তাঁকে আমরা ধরি
কোন্ শব্দে??
আমাদের স্বদেশ মা এখন ভাগাভাগির মা
থাকে শতছিন্ন কাপড়ে
মায়ের কাছে শোনা কর্ণকথা গেঁথে আছে মনে
সাইকেলের হাওয়া কমে গেলে,
নীচু হয়ে সাইকেলের ভালটিউব দেখি
ফিরে আসে মনের গভীরে থাকা
দাতাকর্ণ মহাবীর কর্ণের ছবি
মা
কলমে সুপ্রিয়া মুখার্জী
আগে এই বাড়িটায় ঠিক
সময়ে ভোর নামত।
আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখতাম
চৌকাটে জল দেওয়া,উঠোনটা ওজল দিয়ে ধোয়া।
তুলসি গাছ গঙ্গা জলে স্নান সেরে নিয়েছে।
জ্বলছে ধূপকাটি,সেই গন্ধ বলত,মা আছে।
ছাদের উপরে সাদা,ধূসর রঙের পায়রাদের ভিড়
মা তার নিজের হাতে চাল,গম ছড়িয়ে দিয়েছে।
কুয়াশারা শাড়ি জড়িয়ে
নির্ভয়ে নেমে এসেছে
আমার মায়ের ফুল গাছের ওপর।
এখন এই বাড়িতে বাতাস
হয়ে ভেসে আছে
আমার মা।
তোমার জীবন ধারাপাতে
নব কুমার মাইতি
তোমার জীবন ধারাপাতে সহস্র মানুষের ভিড়ে
আমি বিন্দু থেকে গেছি , বৃত্ত হতে পারিনি
তোমার ভাবনার রঙিন বর্ণাঢ্য আকাশে চন্দ্রভূক অমাবস্যা থেকে গেছি , পূর্ণিমার চাঁদ হতে পারিনি
তোমার স্বপ্নের সুরভিত স্বর্গোদ্যানে পারিজাত হতে পারিনি ,পলাশ হয়ে ফুটেছি
তোমার প্রেমের সোনালী স্বপ্নের দেশে পুরুষ থেকে গেছি, আদ্যন্ত প্রেমিক হতে পারিনি
তোমার হৃদয় উদ্যানের সবুজ বাগিচায়
গোলাপ ফোটাতে পারি নি ,ক্যাকটাসে ভরে গিয়েছে
তোমার ভালোবাসার রোমান্টিক অভিধানে
ভালোলাগা থেকে গেছি ,বুঝি ভালবাসতে পারিনি
তোমার না পাওয়ার বেদনার সকরুণ ক্রন্দনে
অশ্রু মোছাতে পারিনি ,কেবল অশ্রু বানে ভেসেছি
তোমার অন্তহীন অভিমানের আকুল আর্তনাদে
বড়ই ব্যাকুল হয়েছি ,হারিয়েছি অসীম অনন্তলোকে!
মা
নন্দিনী সরকার
মা মানে অনেক আদর, আগলে
রাখা কেউ,
মা মানে বুকের ভেতর সমুদ্দুরের
ঢেউ।
মা মানে হাসি কান্না ঝগড়া আড়ি
ভাব,
মা মানে দিনের শেষে নেইকো
ক্ষতি লাভ।
মা মানে মাথার উপর বিশাল গাছের
ছাওয়া,
মা মানে যেটা খুশি সবটুকু যায়
চাওয়া।
মা মানে নিজের থেকেও ভাবে
আমার কথা,
মা মানে লাগলে আমার, মা যে
পায় ব্যথা।
মা মানে সেই তো বোঝে হারালো
যার মা,
মা মানে গো যার কাছে পাই
নিশর্ত ক্ষমা।
মা
মুকুলরঞ্জন চক্রবর্তী
কাহিনী -কাঞ্চনতলা-বাদু-কোলকাতা-একশো আঠাশ।ফোন/হোয়াটসএ্যাপ নম্বর-8240700528
বাবা গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে তাঁর বাসগৃহে আমাদের স্থায়ীভাবে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করল।মা আর আমি খড়ের চালের বাতাটা একটানে খুলে ফেললাম।আমাদের দীর্ঘদিনের বৃদ্ধা গোরু মঙ্গলাকে কাঁদতে কাঁদতে মা বলল,'শহরে চললাম রে মঙ্গলা, আর দেখা হবে না! বাতার খড়গুলো খাস আর রাতে শিবতলার আটচালায় চলে যাস'।মঙ্গলা কি বুঝল জানিনা।শুধু দেখলাম তার চোখ দিয়ে টস টস করে জল গড়িয়ে পড়ছে।
নৌকা ছেড়ে দিয়েছে--হঠাৎ দেখলাম মায়ের ন্যাওটা দেশী কুকুর কেল্টু তীরবেগে দৌড়ে এসে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নৌকার কাছে আসতে চাইল।মা পাগলিনীর মত কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলল,'ওরে কেল্টু ডুবে যাবি- বাড়ি যা!!' কেল্টু আস্তে আস্তে ফিরে গেল!! নৌকাটা পল্লেপাড়ার কাছে আসতেই পাড়ের কাছ থেকে বৃদ্ধা মঙ্গলা গোরু হাঁক পাড়ল,''হাম্বা-হাম্বা-হাম্বা!!'' মা হতাশস্বরে আকুল কেঁদে বলল,''বাবুল শোন শোন শোন, মঙ্গলা মা মা বলে ডাকছে!! এখানকার আকাশ, বাতাস,নদী সবাই যে আমাকে মা বলে ডাকছে।আমার কিছু করার নেই---অভাব আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রে, অভাব নিয়ে যাচ্ছে!''
মায়েদের কথা
সুব্রত ভট্টাচার্য
মুড অফ নিয়েই বাড়ি ফিরল রজত।
স্ত্রী মোনালিসার চোখে সহজেই ধরা পড়ল। তক্ষুণি তক্ষুণি রজতকে কিছুই
জিজ্ঞাসা করল না। রাতে মোনালিসা যখন বিছানায় এল তখন রজতই বলল, "জানো তো অরুণ ক-দিন অফিসে আসছিল না। ফোনও বন্ধ করে রেখেছিল। আজ ওর বাসায় গেলাম।
গিয়ে শুনলাম, ওর বউ আট মাসের মেয়েকে ফেলে রেখে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে ! অরুণের আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই। শ্বশুরবাড়ির লোকজন লজ্জায় ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। প্রতিবেশীরাই এখন মেয়েটাকে সামলাচ্ছে ! "
" সে কী গো, এ কেমন মা ! "
ঘটনাটা শুনেই মোনালিসার বুকটা টনটন
করে উঠল। চোখের কোণে জল এল। বিয়ের পাঁচ বছর হল। এখনও কোল শূন্য।
" কাছেপিঠে হলে না- হয় আমিই দেখতাম। আহা রে ! "
সপ্তাহখানেক পর।
রজত দরজা খুলেই দেখে এক যুবতি। সঙ্গে বছর দুয়েকের ছেলে। দারিদ্রের ছাপ
পোষাকে। শরীরে। ভিক্ষা চায় না। কাজ চায়। মোনালিসা খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
জানা গেল --- মেয়েটির বর ওকে ছেড়ে অন্যের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে! মেয়েটি ছেলেটিকে মানুষ করতে চায়।
মোনালিসা রজতের মুখের দিকে তাকায়।
অথ মা সমাচার
===============
মধুমিতা নস্কর
মা ছাড়া জীবন হয় না।তাই তো জীবনের প্রতিটা বাঁকে মা এর ছোঁয়া না পেলে আমাদের চলে না।আমাদের জীবনে মা এর রূপ এক নয়।বহুরূপে তিনি থাকেন জীবনজুড়ে।সুখে দুখে,হাসি- কান্নায়,ঝড়- ঝাপটায়।আমাদের জন্মদাত্রী মা যেমন থাকেন তেমনি পালিতা-মা,সারোগেসি-মা,ঠাকুমা, দিদিমা,জেঠিমা, কাকীমা, মাসিমা,পিসিমা,মামীমা,শাশুড়ি-মা এর স্নেহ মমতার পরশ আমাদের ওপর ঝরে পড়ে।আমরা দেশকে "মা" বলে যেমন ডাকি,ভালোবাসি তেমনি মাতৃভাষাকেও ভাষা-মা বলে মনে করি। মা শব্দটি ছোট হলেও এর ব্যাপকতা আকাশের মতো।মা মানে আবেগ,নিখাদ ভালোবাসা। মা মানে নিজে অভুক্ত থেকে সন্তানের জন্য দুমুঠো ভাত হাঁড়িতে তুলে রাখা।মা মানে শান্তি। মা মানে শাসনের আড়ালে মঙ্গলকামনা।মা মানে স্নিগ্ধ পরশ।মা মানে জ্বর কপালে জলপট্টি, মা মানে বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়া সন্তানের জন্য উদবিঘ্ন দুটি চোখ। মা মানে বিশ্ব,মা মানে শুধুই আশীর্বাদ
আমার মা / লোপামুদ্রা ভট্টাচার্য ---------------------------------------------- তুমি যেন মা শিউলিফুল, রাত্রি শেষে ঝরে সুবাস তুমি ছড়িয়ে দাও হৃদয় মন ভরে । ঘরের মাঝে চারদিকেতে তাকাই যদি আজ দেখি শুধু মা ছড়িয়ে আছে কত হাতের কাজ! বিছানার এ চাদরটিতে ফুল তুলেছ তুমি, উলের বোনা পোশাকটিকে জড়িয়ে ধরে চুমি। শীতের রাতে শরীর ঢাকে ওই নকশী কাঁথা, কত না শ্রমে বানানো সে যে রক্তঘামে গাঁথা। তোমার হাতে তৈরী যত নাড়ু-নিমকি ম।
দুঃখিনী মা আমার (আঞ্চলিক কবিতা)
কলমে – শ্রীলিম
রচনা – ১০ ভাদ্র ১৪২৭, ২৭ আগস্ট ২০২০।
স্থান – বালিয়াপুর, আসানসোল
দুঃখিনী মা আমার্ দুখেই গেল তুর্ কাল্ কেটে,
সুখ্ কাকে বলে দ্যাখ্লি নাই তুই নিজের্ চৈখে।
যখন্ মাঝেমধ্যে হাসি দ্যাখ্তুম্ তুর্ মুখের্ কুনে,
কি যে ভাল লাইগ্থ আমার্ তা ঈশ্বর্ই জানে।
খুশির্ খবর্ এইল্য যখন্ তখন্ তুই শয্যাশায়ী,
বড় ছিলার্ বিয়া দিয়ে বৌয়ের মুখ্ দেইখ্যে গেলি।
ছুটু ছিলার তখনও ছিল অনেক্ পড়া বাকি,
শেষ্ দ্যাখা না করেই তাকে দিয়ে গেলি ফাঁকি !
এখন্ সে করিত্কর্মা, টুগ্দু ল্যাখাল্যাখিও করে,
তবুও তুখে ভুইল্তে লারে পরিচিত জনের্ ভিড়ে।
মায়ামমতার্ কাঙাল্ সে যেখানে সেখানে ছুটে,
যেখানেই পায়্ ভালবাসা সেইখানেই যেয়ে জুটে।
মায়া কৈরে আর্ কটা বছর্ মা যেতিস্ সবুর্ কৈরে,
দ্যাখ্তে পেতিস্ লাল্ টুক্টুইকা বড় লাত্নির মুখ।
ছুটুরও সব্ দ্যাখ্তে পেতিস্ থাক্তিস্ সুখের সংসারে,
সারা জনম্ খ্যাইট্যে গেলি শেষে না হয়্ পেতিস্ টুগ্দু সুখ্ !
মাতৃ বৃক্ষ/অজিত জানা
বৃক্ষ আঁচলের স্নেহ ছায়ায় জুড়ায় পরাণ
মাতৃঅন্তপ্রাণ সন্তান পায় জান
বুকচেরা কাতর যন্ত্রণায় কত যে আপন
দমবন্ধ প্রাণে আশার সিঞ্চন
মরমী হৃদয়ের ঝর্ণা ধারায়
চুঁইয়ে পড়ে বাৎসল্য কিরণ
মিস্টিক স্পর্শে ভালোবাসার শিহরণ
নিবিড় নৈকট্যে মাধুরী প্রাণ
নির্ঘুম রাতে মাতৃ বৃক্ষের জাগরণ
পাথরে কুসুম কানন
"বিস্মৃত পূর্বসূরী"-গড়ে ওঠে বৃদ্ধাশ্রম
জীবিত রক্তের সম্পর্ক-ভুলোনা নর-নারী
আমার মা
ড.নির্মল বর্মন -ডি.লিট
আজ সারা সকাল ঘুরেছি কবিতা মায়ের পিছনে
শব্দ গুলো কাঁদছে আর ফিরে যাচ্ছে
বাতাসে উড়ছে তাদের বিষাদঘন পালক
টিভিতে শুধুই করোনার ছবি
আজ ৭ই মে ২০১১ সকাল সাতটা সাতচল্লিশে
আমার মা আর আমার নেই!
তারপর থেকেই শুধু কান্না আর কথা
যারা মাকে চিনত বা চিনত না
মিডিয়ার সামনে সকলেই কথায় ব্যস্ত
এত ভির নার্সিংহোম দ্যাখেনি কখনো
এই সময়ে যে কথা বলছে
সে কীভাবে শুরু করেছে মনে পড়ছে না
শব্দ গুলো কাঁদছে আর হারিয়ে যাচ্ছে
বারবার উচ্চারিত হল মৃত্যুর সময়
কান্না আর কথা দিয়ে কবিতা হয় না!
মা
বিমল মণ্ডল
নিখাদ পরিচয়ের বিকল্প নেই
'মা' শব্দে বাঁধা আছে।প্রাচীনকাল থেকে মানুষের জন্মের পরিচয়।
নিখাদ এই শব্দের তুলনা নেই
মানুষ জন্মের পরে 'মা' প্রথম ভাষার প্রথম পুরুষ
জীবনের অবিশ্রান্ত বাহু অবলম্বন; প্রেরিত মায়ের ভালবাসা
নিখাদ এই মায়ের কোন পরিচয় নেই
সমস্ত ব্যথার আঁধারে
আরেকটি আত্মশক্তি
নিশ্চিত দুটো বাহুর শিরায় শিরায়
মায়ের কয়েক'শো টি চোখ
যা দিয়ে সজ্জিত রাখে
উচ্ছ্বসিত সম্মিলিত হাসি
এখানে নিখাদ 'মা' শব্দের বিকল্প নেই।
মায়া চরাচর
জয়দেব মাইতি
--------------
উঠোন জুড়ে জ্বালিয়ে রাখা আলো
হৃদয় ভরা কথার কত কলি
হাজারো তারার আলোয় ভরা মুখ
মা' গো তোমায় আদর করে বলি।
জঠর জুড়ে আগলে আমায় রেখে
আলো দিলে ১০ মাসের পর
অসম লড়াই জগৎ সারা জানে
আমায় নিয়ে জাগাও বিশ্ব ঘর।
শৈশব -কৈশোর পেরিয়ে সময় কাল
তোমার কাছে ছোট্ট আজও আমি
ভালোবাসার দুয়ার আগলে রেখে
চোখে হারাও আগের মতো তুমি।
বিশ্ব সংসার সবই মা' ময়
মায়ার আঁচল এমনই তুমি ঢাকো
তোমার ছায়ায় তোমার মায়ায় রেখে
মা গো তুমি হৃদয় জুড়ে থেকো।
পরমেশ্বরী মা
শ্রাবণী বসু
অন্ধকার জলের ভিতর
অনন্ত সাঁতার থেকে তুলে এনে
আলোর সাথে ,মাটির সাথে,
আকাশের সাথে
আলাপ করিয়ে দেন - মা।
তাঁর অপত্য স্নেহ
নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো
ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর ।
স্তনের ভিতর খাদ্যের গোলাঘর
শিশুর জন্য মজুত সেখানে
ক্ষুধা হরণকারী সুধা।
যিনি প্রাণ দিয়েছেন তিনি যদি ঈশ্বর হন
তাহলে একমাত্র ঈশ্বর বলে
আমি যাকে মানি
তিনি মা ছাড়া আর কেউ না।
◦

◦
No comments:
Post a Comment