Friday, 16 July 2021

বনমহোৎসবের দিনে বিশেষ আলোচনা পর্ব। বাংলার প্রকৃতি ও জীবনানন্দ দাশের কবিতা। ১৬.০৭.২০২১. Vol -435. The blogger in literature e-magazine

বাংলার প্রকৃতি ও জীবনানন্দ দাশের কবিতা।

"আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খ শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাকা হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠালছায়ায়; হয়তো বা হাঁস হবো- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়, / সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে:'
এক জীবন্ত দৃশ্যপট পাঠক হৃদকে গভীরভাবে রেখাপাত করে। হয়তো এই কারণেই কবি রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে চিত্ররূপময় কবিতা বলেছেন। প্রকৃতি প্রেমী এই দার্শনিক কবি প্রকৃতির মাঝে নিজেকে মিলে মিশে করেছেন‌ একাকার। হয়ে উঠেছেন‌ বাংলার শুদ্ধতম প্রকৃতির কবি, বাংলার ওয়ার্ডসওয়ার্থ ।

কবিতার উপমা বর্ণনায় জীবনানন্দ দাশ হলেন বাংলা সাহিত্যের কবি কালিদাস রায়। সংস্কৃত‌ সাহিত্যে ‘ উপমা কলিদাসস্য’ যেমন সত্য, তেমনি বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘ উপমা জীবনানন্দ দাশস্য’ চিরসত্য। বাংলা সাহিত্যে উপমা বর্ননায় কবি জীবনানন্দ দাশ যেন উপমার জাদুঘর। উদাহরণ হিসেবে তাঁর কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে,যেমন, 
‘ নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা’ , ‘
 পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’ । 
এরকম চিত্ররূপময় উপমা সৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, 
তাঁর উপমা উজ্জ্বল, জটিল ও দূরগন্ধবহ’।

১৯২৭ প্রকাশিত ঝরাপালক কাব্যগ্রন্থের কবিতা জুড়ে কবি প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করেছেন আনাচে-কানাচে আড়ালে-আবডালে। কবির প্রাণে উঁকি দিয়ে প্রকৃতি যেন খেলা করেছে অনাবিল পাড়াগাঁয়ের আদুরে গন্ধমাখা মায়া-মমতা কে ঘিরে।
১৯৩৬ সালে প্রকাশিত কবি জীবনানন্দ দাশের “ ধূসর পাণ্ডুলিপি” অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্ৰন্থ। এই কাব্যগ্ৰন্থের অন্যতম বিখ্যাত কবিতা’ মৃত্যুর আগে’ র সাথে আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘দা ফলিং অব দা লীভস’ কবিতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যু চেতনা কবির ভাবনার জগতে কতটা প্রবল তা এই কবিতা পাঠের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। ঝরা পাতা, শিরশিরে শিতল হাওয়া, ব্যাবিলনীয় ও মিশরীয় সভ্যতা, কবি জীবনানন্দ দাশের সহজাত কাব্য বৈশিষ্ট্য এবং বন্ধ্যাযুগের চিত্রকল্প অঙ্কনের ক্ষেত্রে কবির তুলন কবি নিজেই। কবি জীবনানন্দ দাশ জীবনের এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এসময় তাঁর কবিতার রঙিন চালচিত্রের পরিবর্তে হতাশা আর বিবর্ণতা ঠাই করে নেয়।যেমন কবি তাঁর ‘বিভিন্ন কোরাস’ কবিতায় বলেছেন,
 ‘ পৃথিবীতে ঢেরদিন বেঁচে থেকে আমাদের আয়ু/ এখন মৃত্যুর শব্দ শোনে দিনমান।/হদয়কে চোখঠার দিয়ে ঘুমে রেখে/ হয়তো দুর্যোগে তৃপ্তি পেতে পারে কান’। ধূসর রঙের আভা পড়ে তার কবিতার বিষয়বস্তুতে। একারণেই হয়তো অনেক সাহিত্য সমালোচক তাকে ‘ ধূসরতার কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

কবির রোমান্টিক প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর ‘ বনলতা সেন’ কাব্যগ্ৰন্থ। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটির ‘ বনলতা সেন’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবিতা এবং কবি রচিত সর্বাধিক জনপ্রিয় কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কবিতাটিতে ইংরেজ কবি ও নাট্যকার এডগার অ্যালান পো’র ‘ টু হেলেন’ কবিতার স্পষ্ট প্রভাব থাকলেও ভাব ও সৃজনশীলতার মাপকাঠিতে ‘বনলতা সেন’ এক অনবদ্য সৃষ্টি এবং কবির রোমান্টিক প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। এই কাব্যগ্ৰন্থের পরতে পরতে উপমার প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যেমন, পাখির নীড়ের মতো চোখ, শিশিরের মতো সন্ধ্যা, অন্ধকারের মতো কালো চুল, প্রভৃতি উপমার প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশকে উপমার সম্রাটে পরিণত করেছে।

সৌন্দর্য পূজারী কবি জীবনানন্দ দাশের ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত ‘ রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্ৰন্থে গ্ৰাম বাংলার প্রকৃতি, নদীনালা, খালবিল, পশুপাখিসহ বাংলার চিরায়ত উৎসব, অনুষ্ঠানের প্রতিরূপ ফুটে উঠেছে অসাধারণ কাব্যিক ভঙ্গিমায়। জনপ্রিয়তার বিচারে কবি জীবনানন্দের ‘ বনলতা সেন’ কাব্যগ্ৰন্থের পরপরই রূপসী বাংলার স্থান। এই কাব্যগ্ৰন্থের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং আলোচিত কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় কবির অভিব্যক্তি এরকম, “ আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়/ হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে,..”। পুনর্জন্মে বিশ্বাসী কবি পরের জন্মেও বাংলায় জন্মগ্ৰহণ করতে চান। এই কবিতায় কবি যেমন বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনি নিজ মাতৃভূমির প্রতি অগাধ ভালোবাসার কথা অকপটে ব্যক্ত করেছেন।

কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন ও কর্ম নিয়ে দেশে বিদেশে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যিকের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরেই জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে। বিখ্যাত মার্কিন গবেষক ক্লিনটন বি সিলি কবি জীবনানন্দ দাশের উপর গবেষণা পরিচালনা করেছেন। তিনি কবি জীবনানন্দ সম্পর্কে বলেছেন, A poet apart 
( নির্জনতার কবি)।

ক্ষণজন্মা এই মহান কবি ১৯৫৪ সাথে সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রামের ধাক্কায় আহত হন। আটদিন পর,২২ অক্টোবর নিদারুণ যন্ত্রনা ভোগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন বাংলা সাহিত্যের তিমির হননের কবি জীবনানন্দ দাশ। কবির মৃত্যুর খবর শুনে আহত হৃদয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখলেন,
  “ একটি জাহাজ ছেড়ে গেল হলো নিরুদ্বেল ও
মনের জেটির কাঠ নেই আর ওঠা-নামা মাল। যাত্রীর যন্ত্রনা গোলমাল গেছে সমস্ত সকাল ।“…..

বাংলা র প্রকৃতি এসেছে যেমন করে -
এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরছি-

১. একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে/... সেইখানে কলমীর দামে বেঁধে প্রেতিনীর মতন কেবল/কাঁদিবে সে সারারাত,- দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে/সাজায়ে রেখেছে চিতাঃ বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ/চেয়ে র’বে; ভিজে পেঁচা শান্তস্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে/শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প- ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;/চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি- শাদা শাঁখা- বাংলার ঘাস... (একদিন জলসিড়ি )

২. ‘কোথাও দেখিনি, আহা, এমন বিজন ঘাস প্রান্তরের পারে/নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে- নীল বুকে আছে তাহাদের/গঙ্গা ফড়িঙের নীড়, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা ঢের,/হিজলের ক্লান্ত পাতা,- বটের অজস্র ফল ঝরে বারে-বারে...’ (কোথাও দেখিনি আহা)

৩. ‘...বিনুনি বেঁধেছ তাই-কাঁচাপোকাটিপ তুমি কপালের ’পরে/পড়িয়াছ-তারপর ঘুমায়েছঃ কল্কাপাড় আঁচলটি ঝরে/পানের বাটার ’পরে; নোনার মতো নম্র শরীরটি পাতি/নির্জন পালঙ্কে তুমি ঘুমায়েছ,- বউ কথা কওটির ছানা/নীল জামরুল নীড়ে- জ্যোৎস্নায়- ঘুমায়ে রয়েছে যেন, হায়...’ (অশ্বত্থ বটের পথে)

৪. ‘...যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপাঁর নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে,/যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরী পাতায়,/যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,/শামুক গুগলিগুলো প’ড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-/তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,/ঠেস্ দিয়ে ব’সে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে,/তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান’। (যদি আমি ঝ’রে যাই)

৫. ‘...মৌরির গন্ধ মাখা ঘাসের শরীরে ক্লান্ত দেহটিরে রেখে/আশ্বিনের ক্ষেতঝরা কচি কচি শ্যামা পোকাদের কাছে ডেকে/র’বো আমি;- চকোরীর সাথে যেন চকোরের মতন মিলনে;/...হলুদ নরম পায়ে খয়েরী শালিখগুলো ডলিছে উঠান;...’ (এখানে ঘুঘুর ডাকে)

৬. ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে সবচেয়ে সুন্দর করুণ:/সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;/সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;/সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;/সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে,- সেখানে বরুণ/কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল...’ (এই পৃথিবীতে এক)

৭. আমি চ’লে যাব ব’লে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে/নরম গন্ধের ঢেউয়ে?/লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?/সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!/চারিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ- মৃদু কলরব;/খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;/পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল;-/এশিরিয়া ধুলো আজ-ব্যাবিলন ছাই হ’য়ে আছে’।

বিভিন্ন গ্রন্থের কবিতাগুলো থেকে অলংকারের প্রয়োগ ও দেশজ শব্দের ব্যবহার তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র। বন্ধনীর মধ্যে কবিতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে-রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে (অনুপ্রাসের প্রয়োগ, নির্জন স্বাক্ষর)মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে (সমাসোক্তির প্রয়োগ) মেঠো চাঁদ কাস্তের মতো বাঁকা, পোড়ো জমি (মাঠের গল্প) বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা, ঝিমায়েছে এ পৃথিবী, কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর, মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে জেগেছিল (পেঁচা), চড়ুয়ের ভাঙা বাসা, পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা-কড়কড়, শসাফুল, মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা, হিম আকাশের গায় খুদ খেয়ে (পঁচিশ বছর পরে) ভেসে যাবে পাথর বাতাসে, তুমি জল-তুমি ঢেউ—সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন, সাগরের জলের আবেগ, জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধূ ধূ জল তোমারে যে ডাকে, উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে, শীতরাতে,—মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন (পরাবাস্তবতার একটি উদাহরণ) নিশীথের বাতাসের মতো (সহজ), মাটি আর রক্তের কর্কশ স্বাদ, পথের আহত মাছিদের মতো, ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে পায়ে,/ঘুম ভেঙে যায় বার-বার/তোমার আমার, ফেনার কাপড়ে বুক ঢেকে, এই হাওয়া যেন হা-হা করে/হু-হু করে ওঠে অন্ধকার (অনুপ্রাসের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়) কত রাত ঝ’রে গেছে, ছেঁড়া দেহে—ব্যথিত মনের ঘায়ে/ঝরিতেছে জলের মতন, বাতাসের সিন্ধু—ঢেউ, নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে, সোনার মতন ধান, ঠাণ্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপ আমি, গান গায় সিন্ধু তার জলের উল্লাসে, রূপ যেই স্বপ্ন আনে—স্বপ্নে বুকে জাগায় যে-রস, যেখানে ফেনার গন্ধ নাই, অনেক চলার পথ নক্ষত্রের তলে, চাঁদ জেগে রয়/তারা-ভরা আকাশের তলে/জীবন সবুজ হয়ে ফলে, মাটি ধুলো কাজ করে,—মাঠে-মাঠে ঘাস (কয়েকটি লাইন) গানের সুরের মতো বিকাল, পাখির মতন কেঁপে, হিম চোখ বুজে, নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে, সমুদ্র ভাঙিয়া যায়—নক্ষত্রের সাথে কথা কয়, উষ্ণ আকাশেরে চায় সে জড়াতে, গোধূলির মেঘে মেঘ, বীণার তারের মতো পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষা, একাকী মেঘের মতো ভেসেছে সে, পাখির মতো স্থির হয়ে, নীল আকাশের আলোর গাঢ়তা, নিশীথের সমুদ্রের মতো চমৎকার, গোধূলির আলো লয়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা, সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে, হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা ল’য়ে, ঢেউ ক্ষুধিতের মতো এক সুরে, হতাশ প্রাণের মতো অন্ধকারে ফেলিছে নিশ্বাস, ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি, এইখানে অশান্ত সাগর তোমারে এনেছে ডেকে, প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে ওঠে, সন্ধ্যার আলোর মতো পশ্চিম মেঘের বুক ফুটে, সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে, জোনাকির পথ ধরে, ভোরের মেঘের ঢেউয়ে, আলো-অন্ধকার দিয়ে বুনিতেছি সিন্ধুর বিপ্লবে, তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়, ব্যথিতের স্বপ্নের মতন গোপনের চোখ, মেঘের মতো হঠাৎ চাঁদের বুকে এসে, ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে, পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে, দেহের ছায়ার মতো আমার মনের সাথে মেশে, গুহার হাওয়ার মতো বন্দী হয়ে মন তব ফেরে, এলোমেলো আধাঁরের মতো হৃদয়, ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত হয়ে, বিদ্যুতের মতো অল্প আয়ু, ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম ক্ষত, মেঘের চিলের মতো—দুরন্ত চিতার মতো বেগে ছুটে যায় (অনেক আকাশ) পাথরের মতো শাদা গা, পাষাণের মতো হাত, পদ্মা-ভাগীরথী-মেঘনা-কোন নদী সে, নিবু নিবু জ্যোৎস্না, জমানো ফেনার মতো দেখা, হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতো শুয়ে আছে, ফেনার মতন তারা ঠাণ্ডা-শাদা, ঢেউয়ের মত তারা ঢলে, বরফের কুঁচির মতন মুখ চোখ ভিজে, কাচের গুঁড়ির মতো শিশিরের জল, রূপার মতন চুল ঝিকমিক করে, মেঘের মতন চুল, ধুপের ধোঁয়ার মতো ধলা পুরীর ভেতর, চোখা—ছুরি যেন ধারালো হাতির দাঁত, যৌবন ছিঁড়ে ফেঁড়ে যায়, শরীরের ঘুণ, চোখে ঠোঁটে অসুবিধা—ভিতরে অসুখ, পরী নয়—মানুষও সে হয়নি এখনো, কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে, জটার মতো খোঁপা অন্ধকার (পরস্পর) প্রথম মেয়ের মতো—পৃথিবীর নদী মাঠ বন, যে পাতা হলুদ ছিল-তবুও হলুদ হতে হয়, অঙ্গারের মতো তেজ কাজ (জীবন) সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন, আকাশে আকাশ যাবে জ্বলে, দেহ ঝরে তার আগে ঝরে যায় আমাদের মন, পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই, রাত্রির ঢেউয়ের মতো, আলো অন্ধকারে তোমার পায়ের শব্দ, বালকের মতো এক (১৩৩৩) পৃথিবী এ গহ্বরের মতো ঘুমানো, পাণ্ডুর পাতার মতো শিশির, পায়ের পথের মতো ঘুমন্ত, পুরুষ পাখির মতো,—প্রবল হাওয়ার মতো মৃত্যু, বীণার মতো বেজে ওঠে হৃদয়ের বন, পাখির মতো ব্যথা বুকে লয়ে, বনের শাখার মতো হিম, পাখির শিশুর মতো প্রেমেরে ডেকে ডেকে, আলেয়ার মতো আলো নিয়ে, অঙ্কুরের মতো তুমি, আশার ঠোঁটের মতো, হৃদয়ের গন্ধ বা ধূপের মতো জ্বলে, হাতির হাড়ের মাঠে (সুররিয়ালিজম, প্রেম) মাটির শরীরে তার ছিল যে পিপাসা, রক্ত আর মাংসের স্পর্শসুখভরা, বালকের মতো এক—সমুদ্রের জল, রাঙা রোদ—নারীর মতন, চোখ দুটো ফের ঘুমে ভরে/যেন তার চুমো খেয়ে, এ দেহ—অলস মেয়ে/পুরুষের সোহাগে অবশ, ঝুমকো লতার মতো তার দেহ ফাঁসে, প্রণয়ীর ঠোঁটের ধারালো চুম্বনের মতো, শস্যের মতো শরীর ছিঁড়ে আহত, আগুনের মতো দুপুরের রাঙা রোদ, লাল আলো—রৌদ্রের চুমুক/অন্ধকার,—কুয়াশার ছুরি, হেমন্তের রৌদ্রের মতো ফসলের স্তন, কীটদের মতো আহত, লতার মতো চুল (পিপাসার গান) আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর, ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে, রবারের বলের মতো ছোট বুকের জীবন, খেলার বলের মতো তাদের হৃদয় (পাখিরা) পুরানো পেঁচার ঘ্রাণ, নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতর, সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষা, হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা, নির্জন মাছের চোখে, মিনারের মতো মেঘ, বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আসে, বাতাসে ঝিঝিঁর গন্ধ, রাঙা কামনার শিয়র, ধূসর মৃত্যুর মুখ (মৃত্যুর আগে) নিরালা ঢেউয়ের পাশে, গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে, সন্ধ্যা নদীর জল—পাথরের জলের ধারা/আয়নার মতো, আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া, হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার নদী (স্বপ্নের হাতে) ইত্যাদি কবিতায় এসব লোকজ উপাদান ও অলংকার ব্যবহার করা হয়েছে।

অঘ্রান-কার্তিক কবির প্রিয় সময়। বিভিন্ন উপকরণে প্রকৃতি ধরা দিয়েছে বিভিন্ন রূপে। চিল-হরিণ-জোনাকি-বেড়াল-বাদুড়, চাঁদ-নক্ষত্র-আকাশ-সাগর-নদী, ডানা-লতা-ঠাং-শরীর-পালক, ঘ্রাণ-ঘুম-নির্জনতা, হিজল-ঝাউবন, লেবু-আমলকি-দেবদারু, পাতা-ঘাস-ধান, বালি-শিশির-হাওয়া-রোদ-জ্যোৎস্না, ঝড় ঢেউ, নীল-সবুজ হলুদ, মুখোমুখি-স্তব্ধতা-অন্ধকার-নগ্ন-শাঁই শাঁই শব্দ, রূপালি ইত্যাদি ধরা দিয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়। এসব শব্দাবলী ও এরকমই একার্থক শব্দাবলীর বারবার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এগুলো প্রতীকী হিসাবেও ধরে নেওয়া যায়। নগ্ন, অন্ধকার যেমন হতাশার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে; তেমনই হিজল-ঝাউবন প্রকৃতি বা সৌন্দর্যের প্রতিনিধি। আবার স্ফটিক, নীল আকাশ ইত্যাদি জীবন-মনের উদারতা ও ঔজ্জ্বল্য প্রকাশিত হয়েছে।
রূপসী বাংলা' কাব্য গ্রন্থের 'শ্মশানের দেশে তুমি' কবিতায় পঙ্খি তার সাক্ষ্য বহন করে।

'শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ- বহুকাল গেয়ে গেছ গান/ সোনালি চিলের মতো উড়ে আকাশের রৌদ্র আর মেঘে-/ লক্ষীর বাহন যেই স্নিগ্ধ পাখি আশ্বিনের জোসনা আবেগে/ গান গায়- শুনিয়াছি রাখি পূর্ণিমার রাতে তোমার আহ্বান।'
আবার বহু ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে প্রকৃতির মিশ্রণের দারুণ সংমিশ্রণ কবির কবিতা। তিনি লিখেছেন-

'আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে/ তোমাকে দিল রূপ-/ কী ভয়াবহ নির্জন রূপ তোমাকে দিল তারা;/ তোমার সংস্পর্শের মানুষের রক্তে দিল মাছির মতো কামনা।' (আদিম দেবতারা: মহাপৃথিবী)

তিনি আরও ব্যক্ত করেছেন এভাবে-

'নিখিল আমার ভাই,/ -কীটের বুকেতে যেই ব্যথা জাগে সে বেদনা পাই;/ যে প্রাণ গুমরি কাঁদিছে নিরালা শুনি যেন তার ধ্বনি,/ কোন ফণী যেমন আকাশ বাতাসে তোলে বিষ গরজানি!/ কী যেন যাতনা মাটির বুকেতে অনিবার ওঠে রণি,/ আমার শস্য-স্বর্ণপসরা নিমেষে হয় যে ছাই!/ - সবার বুকের বেদনা আমার, নিখিল আমার ভাই।' (নিখিল আমার ভাই: ঝরা পালক)

জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে “চিত্ররূপময় কবিতা”। জীবনানন্দ দাশের কবিতার মাঝে বাংলাদেশের সৌন্দর্য ছবির মত ফুটে উঠেছে। বাংলার রূপ লাবণ্য অবলোকনের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ এক দক্ষ দার্শনিক। তাঁর কবিতার পরতে পরতে গ্ৰাম বাংলার নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য শৈল্পিক পরশে আরো জীবন্ত ও মহীয়ান হয়ে উঠেছে। কবি ছিলেন সৌন্দর্য পূজারী। প্রকৃতির মাঝে তার আরাধনা। কবি বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশকে ‘প্রকৃতির কবি’ বলে অভিহিত করেছেন। জীবনানন্দ দাশের মতো করে কোন বাঙালি কবি প্রকৃতির অপার মহিমাকে উপলব্ধি করতে পারেননি। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা দিয়ে শেষ করছি -
"তোমার কবিতাগুলো পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে”।


∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। প্রবোধচন্দ্র বাগচী । বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম পণ্ডিত, সাহিত্যের গবেষক এবং শিক্ষাবিদ। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য। Dt -18.11.2024. Vol -1055 .Monday. The blogger post in literary e magazine.

প্রবোধচন্দ্র বাগচী    (১৮ নভেম্বর ১৮৯৮ - ১৯ জানুয়ারি ১৯৫৬)  বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম পণ্ডিত, সাহিত্যের গবেষক এবং শিক্ষাবিদ। ...