বিজন ভট্টাচার্য
"বিষয়বস্তুর এই নতুনত্ব সে যুগে সাদরে গৃহীত হলাে আর আঙ্গিকের ক্ষেত্রে বাঙলা নাটকের গতানুগতিক মঞ্চউপস্থাপনা ও প্রয়ােগ পরিকল্পনার একঘেয়েমি দুর হল। মঞ্চ ব্যবস্থা, আলাে, সাজ, রূপসজ্জা, অভিনয় সবকিছুর মধ্যে সাযুজ্য আনা হল, মঞ্চ- ব্যবস্থার সরলীকরণ হল, ব্যক্তি-অভিনয়ের পরিবর্তে দলগত অভিনয়, সবকিছুর মধ্যে নাট্যনির্দেশকের পরিকল্পনা বিষয় ও আঙ্গিককে বেঁধে নিয়ে মূল ভাবপ্রকাশের সহযােগী করে তুলতে সাহায্য করল।"
ফরিদপুর জেলার খানখানাপুরে ১৯০৬ সালে ১৭ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। ভূস্বামী পরিবারে তার জন্ম। পিতার কর্মসূত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করার সুবাদে তিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন।
তাঁর নাট্যজীবনের শুরু হয় ১৯৪০ এর দশকে। প্রচলিত বাণিজ্যিক থিয়েটারের ধারার বাইরে স্বতন্ত্র নাট্য আন্দোলনের সূচনা করেন কিছু ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক শিল্পী গোষ্ঠী । এঁদেরই সাংস্কৃতিক শাখা ছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ইণ্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন যা আইপিটিএ নামে বেশি পরিচিত। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন এই গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম সারির নাট্যকর্মী। চিন্তা, চেতনা এবং সংগ্রামের প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনার দিশারী ছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। বিজন ভট্টাচার্যের নাটক রচনা, অভিনয় এবং নির্দেশনা সাফল্য লাভ করেছিল এই গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
গণনাট্য সঙ্ঘের (সেই সময় ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ) প্রথম নাটক আগুন বিজন ভট্টাচার্যের রচনা । এই নাটকটি ১৯৪৩ সালে মঞ্চস্থ হয়েছিল। ১৯৪৪ সালে তার লেখা নাটক জবানবন্দী এবং নবান্ন অভিনীত হয়েছিল। এই নাটকগুলিতে তিনি প্রধান অভিনেতা এবং নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবর শ্রীরঙ্গম মঞ্চে নবান্নের প্রথম অভিনয় হয়। এই নাটকটির পটভূমিকা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতা, ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলন, পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গণনাট্য আন্দোলন এবং বিজন ভট্টাচার্যের নাটক বাংলা নাটক রচনা এবং অভিনয়ের এক যুগবদলের সূচনা করে।
১৯৪৮ সাল থেকে গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে বিজন ভট্টাচার্যের মতান্তর ঘটে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ তিনি বোম্বাইতে হিন্দি সিনেমার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ১৯৫০ সালে তিনি আবার বাংলায় ফিরে আসেন এবং নিজের নাটকের দল ক্যালকাটা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেও তিনি নাট্যকার, প্রধান অভিনেতা এবং নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন। এই থিয়েটারে তার রচিত নাটকের মধ্যে অন্যতম ছিল কলঙ্ক, গোত্রান্তর, মরাচাঁদ, দেবী গর্জন, গর্ভবতী জননী প্রভৃতি।
১৯৭০ সালে তিনি ক্যালকাটা থিয়েটার ছেড়ে দিয়ে কবচ-কুণ্ডল নামে নতুন দল গঠন করেন। এখানে তার রচিত নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কৃষ্ণপক্ষ, আজবসন্ত, চলো সাগরে, লাস ঘুইর্যা যাউক প্রভৃতি।
বিখ্যাত লেখিকা জ্ঞানপীঠ পুরস্কার বিজয়ী মহাশ্বেতা দেবী বিজন ভট্টাচার্যের স্ত্রী। তবে পরবর্তীকালে তারা বিবাহ বিচ্ছিন্ন হন। তাদের এক সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য যিনি ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নবারুণ ভট্টাচার্য একজন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক এবং কবি।
বিজন ভট্টাচার্য মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের জীবন সংগ্রামের কথা ও বাঁচবার কথা তার নাটকগুলির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে তিনি এই ভাবনা থেকে সরে যান। গণনাট্য সঙ্ঘ ত্যাগ এবং নিজের নাটকের দল একাধিক বার ভেঙে গড়ে তিনি তৈরি করেন। ক্রমে মার্কসীয় দর্শনের পরিবর্তে বা সঙ্গে তার রচনায় লোকায়ত ধর্ম দর্শন, হিন্দু ধর্মের সমন্বয় প্রয়াসী মানসিকতা কাজ করেছিল। চিরকালীন মাতৃকা ভাবনা তার নাটকে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়।
অভিনেতা হিসাবে বিজন ভট্টাচার্য অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। নানারকম চরিত্রকে মূর্ত করে তুলতে তিনি দক্ষ ছিলেন । নানা উপভাষার সংলাপ উচ্চারণেও তিনি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চরিত্রের মধ্যে ছিল বেন্দা (জবানবন্দী), প্রধান সমাদ্দার (নবান্ন), পবন ও কেতকাদাস (মরাচাঁদ), হরেন মাস্টার (গোত্রান্তর), প্রভঞ্জন (দেবীগর্জন), মামা (গর্ভবতী জননী), কেদার (আজ বসন্ত), সুরেন ডাক্তার (চলো সাগরে) প্রভৃতি।
নাট্যনির্দেশক হিসাবেও তিনি সমান সফল ছিলেন। গণনাট্য সঙ্ঘে তার নাটক জবানবন্দী এবং নবান্ন ছিল অসাধারণ দুটি প্রযোজনা। পরে তিনি তার নিজের গ্রুপ থিয়েটারেও বহু নাটকের সফল প্রযোজক এবং নির্দেশক ছিলেন।
রচনা কর্ম
পূর্ণাঙ্গ নাটক:
'নবান্ন' (১৯৪৪), 'জতুগৃহ' (১৯৫১), ‘গােত্রান্তর' (১৯৫৬-৫৭), 'ছায়াপথ' (১৯৬১), 'দেবীগর্জন' (১৯৪৪), 'ধর্মগােলা' (১৯৬৭), 'গর্ভবতী জননী' (১৯৭১) ইত্যাদি হল তার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ নাটক। ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলন, বন্যা, মহামারি এবং ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত নবান্ন নাটকে বিজন ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন যে, মানুষেরই শােষণ ও অত্যাচারে কীভাবে হাজার হাজার মানুষের অপমৃত্যু ঘটে। ‘গােত্রান্তর’ নাটকের বিষয় উদ্বাস্তু জীবনের সমস্যা, 'ছায়াপথ’-এর বিষয় ফুটপাথের ঝুপড়িবাসীদের জীবন। কৃষক আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত হয়েছে 'দেবীগর্জন'। বাদা অঞ্চলের আদিবাসী বেদেদের ব্রতকথা নিয়ে রচিত হয়েছে ‘গর্ভবতী জননী' নাটকটি।
একাঙ্ক নাটক:
'আগুন' (১৯৪৩), 'জবানবন্দি' (১৯৪৩), 'জননেতা' (১৯৫০), ‘লাস ঘুইরা যাউক’ (১৯৭০) প্রভৃতি হল বিজন ভট্টাচার্যের উল্লেখযােগ্য একাঙ্ক নাটক। আগুন ও 'জবানবন্দি' নাটকদুটিতে স্থান পেয়েছে বাংলার কৃষকদের দুর্দশার চিত্র।
গীতিনাট্য: '
জীয়নকন্যা' (১৯৪৮) বিজন ভট্টাচার্যের একমাত্র গীতিনাট্য। এটি মনসার ভাসান-বিষয়ক একটি গীতিনাট্য।
রূপকনাট্য:
‘স্বর্ণকুম্ভ’ (১৯৭০) হল বিজন ভট্টাচার্যের একমাত্র রূপকনাট্য।
জীবন সম্পর্কে প্রবল আশাবাদ, আদর্শবাদ এবং রাজনৈতিক চেতনার দীপ্ততায় বাংলা নাটককে জনগণের কাছে। নিয়ে যাওয়ার সার্বিক কৃতিত্ব বিজন ভট্টাচার্যের প্রাপ্য।
গণনাট্য মূলতঃ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার নাট্যকর্মীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠায় এটির মূল লক্ষ্য ছিলো তৃণমূলের গণমানুষকে নাট্যকলার মাধ্যমে সচেতন করে নিজেদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা।[১] গণনাট্য আন্দোলন বাংলার নাট্যসাহিত্যের উপর প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি এখানকার জনমানসে সাংস্কৃতিক বিকাশও সাধন করেছে।[৪]
জড়িত ব্যক্তিবর্গ সম্পাদনা
'৩০ ও '৪০-এর দশকে গড়ে ওঠা এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটির সাথে যুক্ত ছিলেন তত্কালীন ব্রিটিশ ভারতের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের প্রায় সকল নাট্যকর্মী এবং অভিনয় শিল্পিগণ।[১][৩] এই সংঘের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেনঃ বিজন ভট্টাচার্য,[৫] উৎপল দত্ত প্রমুখ।
বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যকৃতির আলােচনা-প্রসঙ্গে 'গণনাট্য আন্দোলন' বিষয়ে কিছুটা জ্ঞান থাকা আবশ্যক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অল্প পূর্বে ১৯৩৬ খ্রীঃ 'ভারতীয় প্রগতি লেখক সঙ্ঘ' প্রতিষ্ঠিত হলে প্রগতিবাদী বিশেষভাবে মার্ক্সবাদী লেখকগণ তাকে কেন্দ্র করে গােষ্ঠীবদ্ধ হতে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন সােভিয়েট রাশিয়াও যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন মার্ক্সবাদী লেখকগণ ফ্যাসিস্ট-বিরােধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘ গঠন করে জনযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন। তাদেরই প্রবর্তনায় বিজন ভট্টাচার্যের 'আগুন' (১৯৪৩) ও 'জবানবন্দী' (১৯৪৩) নাটিকাদ্বয় রচিত হয়; প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে উক্ত ফ্যাসি-বিরােধী লেখক ও শিল্পীসঘই নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে জন-সংযােগ করবার উদ্দেশ্যে 'গণনাট্য সংঘ' প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংগঠিতভাবে বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' (১৯৪৪) নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়েই গণনাট্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। যে পরিবেশে এবং সামাজিক প্রয়ােজনে বাঙলাদেশে এসময় একটা নবনাট্য আন্দোলন দেখা দিয়েছিল, সে বিষয়ে ডঃ অজিত ঘােষ বলেন "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব হইতেই সাধারণ নাট্যশালায় অবসাদ ও অবক্ষয়ের লক্ষণ প্রকটিত হইয়া উঠিল। ওই সব নাট্যশালা যে সব অসাধারণ অভিনেতা তাঁদের অদ্বিতীয় অভিনয় গুণে বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন তাহাদের কেহ কেহ পরলােক গমন করিলেন। কেহ কেহ বা রঙ্গমঞ্চ হইতে সাময়িকভাবে অবসর লইলেন। তাহাদের অভাবে রঙ্গমঞ্চের আকর্ষণ একেবারে কমিয়া গেল।..সমাজের অবস্থা দ্রুত পরিবর্তন হইতেছিল।...নাট্যশালাকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া তুলিতে পারে এমন কোন বলিষ্ঠ ভাবাশ্রয়ী উদ্দীপনাজনক নাটকও তখন রচিত হইতেছিল না। এইসব নানা কারণে সাধারণ নাট্যশালার অবস্থা তখন শােচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। নাটক ও মঞ্চকে বাঁচাইবার জন্য সাধারণ নাট্যশালার বাইরে তখন নবজীবনবাদী ও অদম্য উৎসাহী একদল নাট্যামােদী যুবকের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় নবনাট্য আন্দোলন গড়িয়া উঠিল।"
তিনি ১৯ জানুয়ারি, ১৯৭৮ সালে কলকাতায় মারা যান।
No comments:
Post a Comment