পূর্ণিমা ব্রত ও বাঙালি জীবন
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বৈশাখ মাসের এই পূর্ণিমা দিবসে মহামানব বুদ্ধের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে দিনটি ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’ নামে খ্যাত। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের এ দিনে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন, ৫৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এ দিনে তিনি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে জগতে বুদ্ধ নামে খ্যাত হন এবং ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এ দিনে তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্বলাভের মধ্য দিয়েই জগতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়।
বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, পূর্বজন্মে বোধিসত্ত্ব সকল পারমি পূরণ করে সন্তোষকুমার নামে যখন স্বর্গে অবস্থান করছিলেন, তখন দেবগণ তাঁকে জগতের মুক্তি এবং দেবতা ও মানুষের নির্বাণ পথের সন্ধান দানের জন্য মনুষ্যকুলে জন্ম নিতে অনুরোধ করেন। দেবতাদের অনুরোধে বোধিসত্ত্ব সর্বদিক বিবেচনাপূর্বক এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় স্বপ্নযোগে মাতৃকুক্ষিতে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমায় জন্মলাভ করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল লুম্বিনী কাননের শালবৃক্ষ ছায়ায় উন্মুক্ত আকাশতলে। তাঁর নিকট জাতি, শ্রেণি ও গোত্রের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। তিনি মানুষকে মানুষ এবং প্রাণীকে প্রাণিরূপেই জানতেন এবং সব প্রাণসত্তার মধ্যেই যে কষ্টবোধ আছে তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। তাই তিনি বলেছিলেন ‘সবেব সত্তা ভবন্তু সুখীতত্তা’ জগতের সব প্রাণী সুখী হোক। এই মর্মচেতনা জাগ্রত করা এবং এই পরম সত্য জানার জন্য তিনি ২৯ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন। সত্যের সন্ধানে পরিভ্রমণ করতে করতে এক সময় তিনি গয়ার উরুবেলায় (বুদ্ধগয়া) গিয়ে নিবিষ্টচিত্তে সাধনামগ্ন হন। দীর্ঘ ছয় বছর অবিরাম সাধনায় তিনি লাভ করেন সম্যক সম্বুদ্ধ বা বুদ্ধত্ব। সেদিনও ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।
বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধদেব জীবের মুক্তি কামনায় ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ নামে জীবনের সর্ববিধ ক্লেশ থেকে মুক্তির উপায় আবিষ্কার করেন। তিনি চতুরার্যসত্য নামে খ্যাত এক তত্ত্বে জীবনে দুঃখের উৎপত্তি ও দুঃখভোগের কারণ এবং দুঃখ থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করেন। মুক্তির এই পথনির্দেশনাকে বলা হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা আটটি আর্যপথ। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর তিনি প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করে তাঁর এই ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেন। রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, কুলীন-অন্ত্যজ সর্বশ্রেণীর মানুষের নিকট মুক্তির কথা তুলে ধরে তিনি জগতে এক নতুন ধর্মাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। আশি বছর বয়সে হিরণ্যবতী নদীর তীরে কুশিনারার মল্লদের শালবনে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগপূর্বক তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।এই মহাপরিনির্বাণ লাভের ক্ষণও ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।
বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে বৌদ্ধরা বুদ্ধপূজাসহ পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপাঠ, সূত্রশ্রবণ, সমবেত প্রার্থনা এবং নানাবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তারা বুদ্ধানুস্মৃতি ও সংঘানুস্মৃতি ভাবনা করে। বিবিধ পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। বৌদ্ধ বিহারগুলিতে বুদ্ধের মহাজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাসহ ধর্মীয় সভার আয়োজন করা হয়। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও নানা উৎসবমুখর আনুষ্ঠানিকতার ধুম পড়ে যায়। এই পূর্ণিমাকে ঘিরে অনেক বৌদ্ধবিহারে চলে তিনদিনব্যাপী নানামুখী অনুষ্ঠান। বৌদ্ধধর্মীয় পর্ব হিসেবে এ দিনে সাধারণ সরকারি ছুটি থাকে। রেডিও, টেলিভিশনে প্রচার করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ সংখ্যা কিংবা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন বিহার ও সংগঠন কর্তৃক স্মরণিকা, ম্যাগাজিন ও স্মারকগ্রন্থও প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন গ্রামে ও বিহারে এদিন মেলা বসে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামের বৈদ্যপাড়া গ্রামের বোধিদ্রুম মেলা বিখ্যাত ।
ভারতীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পারম্পর্যে এক উজ্জ্বল পূর্ণিমালোকিত দিন। এই দিনে আমি জন্মগুরু, শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু নির্বিশেষে শিক্ষার সমস্ত উৎসমুখকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। আর স্নেহ-ভালোবাসা জানাই, সেই প্রবহমান ধারার নিম্নমুখ অর্থাৎ ছাত্র-শিষ্য-বিদ্যার্থীদের।
প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল গুরুমুখী। যার কেন্দ্রাচার ছিল আষাঢ়ী গুরুপূর্ণিমা উদযাপন।"গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরর্দেবো মহেশ্বরঃ।/ গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নম।।" জ্ঞান সমুদ্রের সমস্ত স্রোত গুরুর থেকে নেমে আসছে। তিনিই সব হয়েছেন। তিনিই চৈতন্যস্বরূপ। ড. রাধাকৃষ্ণণও সেই সনাতনী ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুসারী ছিলেন, যার জন্মদিনে জাতীয় শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ ই সেপ্টেম্বর।
উপনিষদে আছে 'সোহহম', আমিই সেই, 'I am He'। এটা কোন আমি? আমি দু'প্রকার: প্রত্যক্ষ আমি বা 'অহং'। যাকে বলতে পারি 'একলা আমি', 'স্বার্থগত আমি'; রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'কাঁচা আমি'; স্বামীজী বলছেন 'ছোট আমি'।
আর একটি হচ্ছে অপ্রত্যক্ষ আমি বা 'ভূমা'। এ হল 'বড় আমি', 'পাকা আমি', সকল আমির সমষ্টিগত আমি। ‘আমার’ এই নিত্য পথ পরিক্রমা। কে দেখাবেন পথ? আমার গুরু, আমার শিক্ষক। আমার মধ্যেই সব আছে। তা সুপ্তিতে আছে। স্বামীজী বলছেন, "Education is the manifestation of perfection already in man". গুরু বা শিক্ষক হচ্ছেন একটি 'উশকো কাঠি'। বৌদ্ধশাস্ত্রে আছে 'ব্রহ্ম বিহার' কর। ছোট আমির মধ্যে বড় আমির প্রকাশ মধুর কর। নিজের মধ্যে অন্যের জন্য মৈত্রী পোষণ কর।
শিক্ষক ছাত্রের ক্ষেত্রে এটা কি হবে? শিক্ষক-শিক্ষকে কি হবে? ছাত্রে-ছাত্রে কি হবে? উপনিষদে আছে -- " ওঁ সহনাববতু সহনোভুনক্তু সহবীর্যং করবাবহৈ/ তেজস্বীনাবোধিতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ। / ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।"
আমরা শিক্ষক-ছাত্র সমভাবে বিদ্যার্জন করব; সমভাবে বিদ্যার ফল লাভ করব; সকলে সুস্থ-সবল নীরোগ জীবনযাপন করব; কেউ কারো প্রতি বিদ্বেষী হব না; আমাদের মধ্যে সকল শান্তি-সুখ বিরাজিত হোক।
বিদ্যাগার থেকে পূর্ণ মানুষ হয়ে বেরোতে হবে -- নিজেকে অবিরত চিনে, নিজেকে জেনে, নিজের চিন্তা চেতনাকে উপলব্ধি করে। তবেই কিন্তু বৈজ্ঞানিক ঘটনাবলীকে নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারব।কারো ধার করা চিন্তা নয়, চিন্তা চুরি করে নয়। স্বাধীন চিন্তাধারা না এলে জ্ঞান-বিজ্ঞান পরিপুষ্ট হবে না। উল্টোদিকে জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে যা মণি-মাণিক্য খুঁজে পেলাম তাকে জীবনের প্রয়োজনে আনতে হবে; জীবনের সমস্যা সমাধানের কাজে লাগাতে হবে।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।
রাখি পূর্ণিমা
রাখীপূর্ণিমা ভারতের একটি উৎসব। এই উৎসব ভাই ও বোনের মধ্যে প্রীতিবন্ধনের উৎসব। হিন্দু, জৈন ও শিখরা এই উৎসব পালন করে। এই দিন দিদি বা বোনেরা তাদের ভাই বা দাদার হাতে রাখী নামে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। এই রাখীটি ভাই বা দাদার প্রতি দিদি বা বোনের ভালবাসা ও ভাইয়ের মঙ্গলকামনা এবং দিদি বা বোনকে আজীবন রক্ষা করার ভাই বা দাদার শপথের প্রতীক। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব উদযাপিত হয়। চিতোরের বিধবা রানি কর্ণবতী মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করে একটি রাখী পাঠিয়েছিলেন। এর পর থেকে এই উৎসবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
রাখীবন্ধন উৎসবের দিন দিদি বা বোনেরা তাদের ভাই বা দাদার হাতের কবজিতে রাখী নামে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। পরিবর্তে ভাই বোনকে উপহার দেয় এবং সারাজীবন তাকে রক্ষা করার শপথ নেয়। এরপর ভাই-বোন পরস্পরকে মিষ্টি খাওয়ায়। উত্তর ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে সহোদর ভাইবোন ছাড়াও জ্ঞাতি ভাইবোন এবং অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যেও রাখীবন্ধন উৎসব প্রচলিত। অনাত্মীয় ছেলেকেও ভাই বা দাদা মনে করে রাখী পরানোর রেওয়াজ রয়েছে।
পৌরাণিক রাখীবন্ধন
কৃষ্ণ ও দ্রৌপদী -
মহাভারতে আছে, একটি যুদ্ধের কৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে পাণ্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। এতে কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে যান। দ্রৌপদী তাঁর অনাত্মীয়া হলেও, তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বোন বলে ঘোষণা করেন এবং দ্রৌপদীকে এর প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। বহু বছর পরে, পাশাখেলায় কৌরবরা দ্রৌপদীকে অপমান করে তাঁর বস্ত্রহরণ করতে গেলে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে সেই প্রতিদান দেন। এইভাবেই রাখীবন্ধনের প্রচলন হয়।
বলিরাজা ও লক্ষ্মী
অন্য একটি গল্পে রয়েছে, দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বালির রাজ্য রক্ষা করতে চলে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিকে বলেন, তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। যতদিন না স্বামী ফিরে আসেন, ততদিন যেন বলি তাঁকে আশ্রয় দেন। বলিরাজা ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দিতে রাজি হন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলিরাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে-- বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখীবন্ধন হিসেবে পালন করে।
সন্তোষী মা -
বলিউডের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র জয় সন্তোষী মা-এ (১৯৭৫) রক্ষাবন্ধন সংক্রান্ত একটি গল্প বলা হয়েছে। রাখীবন্ধনের দিন গণেশের বোন গণেশের হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। এতে গণেশের দুই ছেলে শুভ ও লাভের হিংসে হয়। তাদের কোনো বোন ছিল না। তারা বাবার কাছে একটা বোনের বায়না ধরে। গণেশ তখন তাঁর দুই ছেলের সন্তোষ বিধানের জন্য দিব্য আগুন থেকে একটি কন্যার জন্ম দেন। এই দেবী হলেন গণেশের মেয়ে সন্তোষী মা। সন্তোষী মা শুভ ও লাভের হাতে রাখী বেঁধে দেন।
ঐতিহাসিক রাখীবন্ধন
মহামতি আলেকজান্ডার ও পুরু রাজা সম্পাদনা
একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী, ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতে। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।
রানি কর্ণবতী ও সম্রাট হুমায়ুন
একটি জনপ্রিয় গল্প অনুযায়ী, চিতোরের রানি কর্ণবতী ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠান। গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে বিধবা রানি কর্ণবতী অসহায় বোধ করেন এবং তিনি হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কর্ণবতীর রাখী প্রেরণে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। তবে হুমায়ুনের সেনা পাঠাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাহাদুর শাহ রানির দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ রানি কর্ণবতী ১৩,০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন চিতোরে পৌঁছে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে দুর্গ থেকে উৎখাত করেন এবং কর্ণবতীর ছেলে বিক্রমজিৎ সিংকে সিংহাসনে বসান। সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে রাখী প্রেরণের কথা অবশ্য জানা যায় না। কোনো কোনো ঐতিহাসিক রাখী পাঠানোর গল্পটির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন। তবে মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী লোকগাথায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাখী বন্ধন
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখী বন্ধন উৎসব পালন করেছিলেন। তিনি কলকাতা, ঢাকা ও সিলেট থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই ও বোন কে আহ্বান করেছিলেন একতার প্রতীক হিসাবে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য।
সেই সময় দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা চরম পর্যায়ে ছিল। আমরা আজ ১৫ ই আগস্ট ২০১৯ সালে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করছি। কিন্তু ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে হিন্দু ও মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একতা আনার জন্য রাখী বন্ধন উৎসব পালন করা হয়েছিল।
উনিশ শতকে আমাদের বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায়ে ছিল যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে অপরিমিত ভয়ের কারণ। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তারা বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করবে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ সহ গোটা ভারতের বিভিন্ন নেতা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিল এবং বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।
১৯০৫ সালের জুন মাসে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯০৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গভঙ্গ জন্য আইন পাশ করা হয়। এই আইন কার্যকরী হয় ১৬ ই অক্টোবর, ১৯০৫।
শ্রাবণ মাসে হিন্দু ভাইবোনদের মধ্যে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বোধ জাগিয়ে তোলা এবং ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য আহ্বান করেন।
কার্তিক পূর্ণিমা
শাস্ত্র মতে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা অত্যন্ত শুভ দিন
এই বছর এই তিথি পালিত হচ্ছে অগ্রহায়ণ মাসে
বিশেষ এই তিথিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রথম শিখ গুরু নানক
এই পূর্ণিমা তিথিতে গঙ্গা স্নান করলে সারা বছরের গঙ্গা স্নানের পূণ্য লাভ হয়
প্রতিবছর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতেই পালিত হত শিখ গুরু নানকের জন্ম জয়ন্তি তিথি। তবে এই বছর কার্তিক মাসে নয় এই তিথি পালিত হচ্ছে অগ্রহায়ণ মাসে। বিশেষ এই তিথিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রথম শিখ গুরু নানক। তাই এই পবিত্র দিনের হিন্দু ধর্মে বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। মনে করা হয় দীপাবলির পরের এই পূর্ণিমা তিথিতে গঙ্গা স্নান করলে সারা বছরের গঙ্গা স্নানের পূণ্য অর্জণ করা যায়। এই বছরে বিশেষ এই তিথি পড়েছে ইংরেজির ৩০ নভেম্বর ২০২০ সোমবার।
গুরু নানক দেব ছিলেন শিখ ধর্মের প্রথম গুরু। গুরু নানক দেবের এই জন্মবার্ষিকী পালিত হয় সারা বিশ্বে। হিন্দু শাস্ত্র মতে এই দিনে চাঁদের আলোয় থাকে ইতিবাচক শক্তি। আর বিশেষ এই তিথিতে উপবাস করলে মেলে এক হাজার অশ্বমেধ এবং একশোটি রাজসিক যজ্ঞের সমান পুণ্য। শিখ সম্প্রদায় এই দিনটি গুরু পরব উৎসব হিসেবে পালন করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত শিখদের এই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে পালিত হয়। অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে এই দিন পালিত হয় বিশেষভাবে।
এই দিনে লক্ষ্মীপুজো বা অশ্বত্থগাছে পুজো করে প্রদীপ দান করলেও মেলে সুফল। কার্তিক পূর্ণিমায় শিবলিঙ্গে জল নিবেদন সহ শিব পুজো করলেও মেলে শিবব্রত পালনের সমান পূণ্য। মনে করা হয় এই বিশেষ দিনে গঙ্গায় স্নান এবং মৌসুমী ফলের দানকে অত্যন্ত শুভ বলে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ এই দিনে দুঃস্থদের ফল, খাদ্য ও শীতবস্ত্র দান করা পবিত্র বলে মনে করা হয়। গঙ্গাস্নানের পর সূর্য প্রণাম করা করলে পূণ্যলাভ করা যায়।
মাঘী পূর্ণিমা
যে কোনও মাসেই একটি করে পূর্ণিমার উপস্থিতি থাকে। সাধারণত অনেক পূর্ণিমা তিথিতেই বাড়িতে সত্যনারায়ণের পূজার আয়োজন করে থাকেন ভক্তেরা। কিন্তু এই মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথি একটু বিশেষ ভারতীয় ধর্মের পটভূমিকায়। এই দিনটির রয়েছে বিশেষ মাহাত্ম্য।
এই দিনটি হিন্দু ধর্মে পুণ্যস্নানের জন্য বিখ্যাত। অনেকেই প্রয়াগ, কাশী, গঙ্গা বা নিকটবর্তী জলাশয়ে স্নান করে, তর্পণ করেন বিধিমতে। এই দিনটি তীর্থভ্রমণের পক্ষেও প্রশস্ত।
মাঘী পূর্ণিমা তিথির হিন্দু ধর্মে মাহাত্ম্য:
মাঘ মাসের এই পূর্ণিমা তিথির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেবী কালী, ভগবান বিষ্ণু এবং গৌতম বুদ্ধের নাম। হিন্দু এবং বৌদ্ধ- উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই এই দিনটির মাহাত্ম্য অপরিসীম।
একদা কান্তিকা নগরে ধনেশ্বর নামের এক অপুত্রক, দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাস করতেন, ভিক্ষাবৃত্তিই ছিল তাঁর জীবিকা। কিন্তু অপুত্রক ব্রাহ্মণকে অনেকেই ভিক্ষা দিতে চাইতেন না। সে রকমই এক গৃহকর্তা একবার ধনেশ্বরকে ভিক্ষা দিতে অস্বীকার করেন। কিন্তু ব্রাহ্মণের দুরবস্থা দেখে তাঁর করুণা হয় এবং তিনি মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে দেবী কালীর আরাধনার কথা জানিয়ে দেন। সেই পরামর্শ মতো মাঘ মাসের পূর্ণিমায় দেবীকে উপাসনা করে বিপুল সম্পত্তি এবং পুত্রসুখের মুখ দেখেছিলেন ব্রাহ্মণ, তাঁর ধনেশ্বর নাম সার্থক হয়েছিল।
বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে এই তিথিটি অত্যন্ত পুণ্যদায়ক। চতুর্দশী থেকেই তাঁদের অনেকে অনবধান উপবাস শুরু করেন। এবং পূর্ণিমায় যজ্ঞ করে উপবাস ভঙ্গ করেন। এই তিথিতে সত্যনারায়ণের পূজার প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও ফুল, ফল, দূর্বা, পান, সুপারি, নৈবেদ্য, দীপ, ধূপ সহকারে বিষ্ণুর আরাধনা করলে সংসারে শান্তি বিরাজ করে।
বলা হয়, এই পুণ্যলগ্নেই গৌতম বুদ্ধ তাঁর মহাপরিনির্বাণ অর্থাৎ দেহত্যাগের কথা ঘোষমা করেছিলেন। যা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব আলোড়িত হয়, দেখা দেয় ভূমিকম্প। শিষ্যেরা ভয় পেয়ে গেলে বুদ্ধ তাঁদের আত্মোন্নতির মার্গে এবং ধর্মপথে অবিচল থাকার উপদেশ দিয়েছিলেন। সেই সূত্রে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা এই দিনে বিহারে দীপদান এবং সঙ্ঘে অন্নদান করেন।
দোল পূর্ণিমা
দোলযাত্রা হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। দোল পূর্ণিমা প্রধানত বাংলা এবং উড়িষ্যার প্রধান ধার্মিক উৎসব যা প্রতি বছর পালিত হয়। দোল উৎসবে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বৃন্দাবনে গোপীদের সঙ্গে আবির খেলায় মেতে উঠেছিলেন। এই দিনে অনেক বাড়িতেই রাধা-গোবিন্দের পুজোও করা হয়। এই পূর্ণিমা তিথি তাই অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।
দোল পূর্ণিমা বা ফাল্গুনি পূর্ণিমা অত্যন্ত শুভ তিথি বলে মনে করা হয়। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, প্রতি বছর ফাগুন পূর্ণিমা রাতে ন্যাড়া পোড়া হয়। এই বছর দোল পূর্ণিমা বাংলার ১৪ চৈত্র ১৪২৭, ইংরেজির ২৮ মার্চ ২০২১ রবিবার। দোলযাত্রার পরদিন অর্থাৎ ২৯ তারিখ সোমবার পালিত হবে হোলি উৎসব।
দোল পূর্ণিমা বা ফাল্গুনি পূর্ণিমা অত্যন্ত শুভ তিথি বলে মনে করা হয়। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, প্রতি বছর ফাগুন পূর্ণিমা রাতে ন্যাড়া পোড়া হয়। এই বছর দোল পূর্ণিমা বাংলার ১৪ চৈত্র ১৪২৭, ইংরেজির ২৮ মার্চ ২০২১ রবিবার। দোলযাত্রার পরদিন অর্থাৎ ২৯ তারিখ সোমবার পালিত হবে হোলি উৎসব।
পূর্ণিমার এই তিথিতে বিশেষ কিছু নিয়ম পালনের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে পারে সকল বাধা ও বিপত্তি। শাস্ত্র মতে মনে করা হয় ফাল্গুন মাসের এই পূর্ণিমা তিথিতে নিষ্ঠাভরে পূর্ণিমার ব্রত পালন করলে সহজেই ঈশ্বরের কৃপাদৃষ্টি পাওয়া সম্ভব হয়।
পূর্ণিমার এই তিথিতে বিশেষ কিছু নিয়ম পালনের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে পারে সকল বাধা ও বিপত্তি। শাস্ত্র মতে মনে করা হয় ফাল্গুন মাসের এই পূর্ণিমা তিথিতে নিষ্ঠাভরে পূর্ণিমার ব্রত পালন করলে সহজেই ঈশ্বরের কৃপাদৃষ্টি পাওয়া সম্ভব হয়।
এর ফলে সংসারের যাবতীয় বাধা ও বিপত্তি দূর হয়। আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব। এই কারণেই বসন্তের এই বিশেষ তিথিতে বহু হিন্দু সম্প্রদায় বাড়িতে বিশেষ পুজোর আয়োজন করে থাকেন আর্থিক উন্নতির জন্য।
তবে এই পূর্ণিমার রীতি পালনের জন্য কয়েকটি বিশেষ নিয়ম করলে সহজেই বাধা বিপত্তি থেকে মুক্তি পাবেন। জেনে নেওয়া যাক সেই নিয়মগুলি।
মনে করা হয় ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোল পূর্ণিমার দিন শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার মিলনের দিন। এই দিনের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও গোপীদের সঙ্গে অভিসারে মত্ত হয়েছিলেন। তাই এই দিনে রাধাগোবিন্দের পুজো করলে সকল মনঃষ্কামনা পূরণ হয়।
মনে করা হয় ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোল পূর্ণিমার দিন শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার মিলনের দিন। এই দিনের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও গোপীদের সঙ্গে অভিসারে মত্ত হয়েছিলেন। তাই এই দিনে রাধাগোবিন্দের পুজো করলে সকল মনঃষ্কামনা পূরণ হয়।
ব্রহ্মাবৈবর্ত পূরাণ অনুসারে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মন ভরে স্মরণ করলে ভক্তের ডাকে তিনি সারা দেন। তাই এই তিথি বিশেষ শুভ বলে মনে করা হয়।
তাই বিশেষ এই তিথিতে তাই রাধা গোবিন্দের আরাধনা করলে ঈশ্বরের কৃপাদৃষ্টি সংসারের উপর বজায় থাকে বলে মনে করা হয়।
এই বিশেষ তিথিতে যদি কোনও দুঃস্থ ব্যক্তিকে কিছু দান করেন তবে শুভ ফললাভের সম্ভাবনা থাকে বলে মনে করা হয়।
বাড়িতে পুজোর আয়োজন করে সন্ধ্যায় তুলসী মঞ্চে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করুন। ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যে সিন্নি প্রদান করুন। সকল বাধা কাটিয়ে আর্থিক উন্নতি ফিরে আসবে আপনার সংসারে।
এই দিনে স্নান সেরে দেবতার চরণে আবির প্রদাণ করুন। মনের সকল ইচ্ছের কথা জানিয়ে ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করুন, সংসারের যাবতীয় বাধা কাটিয়ে উঠতে পারবেন সহজেই।
লৌকিক ও শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠান মেনে বাঙালি ঘরের মায়েরা বধূরা কন্যারা বছরভর পারিবারিক মঙ্গলকামনায় নানা রকমের ব্রত পালন করেন। এমনকি উপবাস ও নানান উপাচার যোগে নিয়ম মেনে করে থাকেন কখনো মন্ত্র উচ্চারণ বা পাঁচালী পাঠের মধ্য দিয়েও। লৌকিক সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে এগুলি আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সধবা বিধবাদের ক্ষেত্রে নানান নিয়ম থাকলেও মনস্কামনা পূরণ ও পারিবারিক মঙ্গলকামনায় ই একমাত্র লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। পূর্ণিমা ব্রত পালন এগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment