শম্ভু রক্ষিত।
১৯৭১ সলের শেষদিকে কোনও এক বিকেলে কফিহাউসের টেবিলে শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। সে বছরই ওর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’সময়ের কাছে আমি বা কেন মানুষ’ বেরিয়েছে। গ্রন্থটি আমাকে দিয়েছিল কি না মনে নেই। তবে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘প্রিয়ধ্বনির জন্য কান্না’ আমাকে দিয়েছিল কফিহাউসে বসেই। দিনটিকে এখনও মনে করতে পারি। মনে থাকার কারণ বইটি নিয়ে শম্ভুর সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। আমাকে অনেকক্ষণ ধরে শম্ভু ‘প্রিয়ধ্বনি’র জন্য তার ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষার কথা খুব আবেগপ্রবণ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছিল। শম্ভু তখন থাকত হাওড়ায়, ফলে অনেক সময় পর্যন্ত কফিহাউসের আড্ডায় থাকতে পারত।
শম্ভু রক্ষিত বললেই ছোটখাটো চেহারার অনুজ্জ্বল মানুষটির চেহারা সবার চোখে ভাসে। তবে অগোছালো বেশবাস, কখনও বেশ মলিন, জীর্ণ কাঁধের ব্যাগ, যা প্রায় মাথার ওপর ওঠানো, গালে না-কামানো কয়েকদিনের দাড়ি, গ্রামীণ সরলতা ইত্যাদি দেখে কেউ যদি শম্ভুকে বিচার করতে বসেন, নির্ঘাৎ ভুল করবেন। এই আপাত অগোছালো, সরল ও ভবঘুরে শম্ভু আসলে আদ্যন্ত আত্মমর্যাদাপূর্ণ একজন মানুষ। জীবনযুদ্ধের লড়াকু সৈনিক। মর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন, দুর্বার ও জেদি। আর্থিক সঙ্গতিহীন অথচ আত্মরক্ষায় উদাসীন, নিরাপত্তাহীন অথচ ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী, কর্মহীন অথচ কর্মসংস্থানের জন্য হতোদ্যম। সংবাদপত্র জগতের এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, তিনি শম্ভুকে সাতের দশকেই খবরের কাগজে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন, শম্ভু হেসে এড়িয়ে গেছে। এই ছিল শম্ভু রক্ষিত। তার হাসিই ছিল তার ওই চারিত্র্যের প্রতীক, সমাজ ও ক্ষমতাকে তাচ্ছিল্য করার প্রতীক।
শম্ভুর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ হয়ে আছে দেশে জরুরি অবস্থার সময় তার বিদ্রোহ। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর লাগাম পরানোর চেষ্টা হয়েছিল। আর এক প্রতিষ্ঠানবিরোধী জ্যোতির্ময় দত্ত অনুশাসন অগ্রাহ্য করে তাঁর সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকার জরুরিশাসন বিরোধী সংখ্যা প্রকাশ করেন। তখনকার দৃষ্টিতে এ ছিল গর্হিত অপরাধ। এই পত্রিকায় লিখেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত। আর আমাদের শম্ভু ইন্দিরা গান্ধিকে মনে রেখে কবিতা লিখেছিল— ‘বুড়ি হুম’। এঁদের সবার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। প্রথমে গৌরকিশোর ও বরুণ সেনগুপ্ত গ্রেফতার হন, তারপর ধরা হয় জ্যোতির্ময়কে, এবং সবশেষে শম্ভুকে। অদ্ভুতভাবে, জেলে শম্ভুর কাছ থেকে কোনও তথ্য বের করতে পারেনি পুলিশ। সে ছিল নির্ভয় ও দৃঢ়চিত্ত। ব্যক্তিগতভাবে যারা তাকে দেখতেন, তারা কি কখনও এই শম্ভুকে চিনতেন?
যে মানুষ রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানকে হেসে অবজ্ঞা করতে পারে, বিদ্রোহ করতে পারে, তার পক্ষে সাহিত্যের কোনও ক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির কাছে কবি হিসেবে আত্মসমর্পণ বা অনুগ্রহভিক্ষা মৃত্যুর সামিল। শম্ভু এই মৃত্যুর কাছে নিজেকে তুলে দেয়নি। যে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তার বিদ্রোহ, সে কী করে সাহিত্যপ্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী হবে? চিরবিদ্রোহীকে প্রতিষ্ঠানও দূরে রাখতে চায়।
কবিতাতেও শম্ভু স্বতন্ত্র, যে কাব্যভাষা আয়ত্ত তার, তা সাধারণ জনপ্রিয়তার পরিপন্থী। জনচিত্ত আহ্বানের দায় সে কখনও নিজের ওপর তুলে নেয়নি। ফলত ভক্তজনের আনুকূল্য পাওয়ার কথা তার ছিল না। সাতের দশকে শম্ভুর কবিতা বেশ জটিল ও আপাত দুর্বোধ্য অথচ আবেগধর্মী এমন ভাবতেন অনেকেই। মনে পড়ছে, ১৯৭৩ অথবা ৭৪ সালে আমাদের চেনাজানা কারও আহ্বানে মহাজাতি সদনের এক কবিসভায় গেছি শম্ভু ও আমি। দুজনেই গেছি কফিহাউস থেকে। আমাদের পাশে বসেছিলেন সাধনা মুখোপাধ্যায়, যিনি সেসময় দেশ পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা লিখতেন, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। আমি শম্ভুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়ামাত্র বলে উঠলেন, ‘আমি আপনার কবিতা পড়ে ঠিক বুঝতে পারি না কিন্তু আমার মনে হয় আপনার কবিতার মধ্যে একটা বিশেষ কিছু আছে।’ এই বিশেষ কিছুর সন্ধান পাঠককে করে যেতে হয় ভালো কবিতার মধ্যে, আপাত কাঠিন্যের মধ্যে। শম্ভুর ‘প্রিয়ধ্বনির জন্য কান্না’ থেকে একটি কবিটা এইরকম:
স্থিতিশীল মুদ্রা ও পালক ও পশুপাখীর রূপায়ণ হে অন্যরূপ
কয়েক শত বৎসর, কেউ নতুন কৌশল খুঁজে আর পারে
আমি মেরুবিন্দুর অবস্থান-নিচে, অনুকরণে রূপায়িত; প্রকৃতই বিরাট যারা
ধ্বংস নিয়ে কান্তনগরের রত্নমন্দিরেরই মতো দেহ রূপায়ণ করেছিল
চিরকাল ভেঙে ভেঙে প্রত্যুষের আবর্তের মধ্যে সমাসীন যেন
প্রকৃতই অনুমান সমানুপাতিক রক্ষিত প্রস্তরে, সম্বন্ধীয়
গণনার পাহাড় লুপ্ত হয়ে— যেমন রূপালী অবস্থান
ভৌগোলিক আধোঘুমে সৌন্দর্যমণ্ডিত— অপরিসীম ধৈর্য আকস্মিকভাবে
পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে ঈষৎ স্থূল রূপায়ণে
উষ্ণতর উদ্ভাসিত পাহাড় প্রয়োগগত লুপ্ত হয়ে গড়িয়ে যায়
প্রীতিময়ী সরস্বতী তুমি, নানারকম ধারণা কো মতামত প্রকাশ করে যাও
রঙে ও সবুজে বরফস্তূপে, বিস্ময়কর অভিকর্ষের সম্ভারে
যেমন নিয়মের কোনখানে পদার্থের বা ভূমিকম্পের পূর্বাভাষ দেওয়ার সার্থকতা
শব্দের পুনরাবৃত্তি, সিনট্যাক্সের বিপর্যয়, আকস্মিক বিপরীতধর্মী শব্দের ব্যবহার শম্ভুকে আমাদের সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিল বলেই সে কবি হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কবিতাটিকে প্রেমের কবিতা বলতে চাইবেন না কেউ। ওর আর একটি কবিতার শেষ অংশ উদ্ধৃত করছি:
আমি এক বন্দীর জীবনযাপন করেছি, তুমি আমায় ইশারা দাও
আমি সারাদিন দু’হাত আলোকিত করে লজ্জাহীন ঘুমিয়ে পড়েছি
আমি আলোকবিন্দু সম্মুখে রেখে পরিশ্রান্ত হয়ে শান্ত হতে চাইআমি প্রায় নগ্ন কৃষ্ণকায় মানুষ,
আমি গৈরিক জানালার নীচে মাংশাসী ফুলের মত
তোমাকে গ্রাস করতে আশ্চর্য উৎসুকআমার শাশ্বত আনন্দ হয় যখন দেখি তোমার চোখে রূপের আকর
আমি তোমার শাপে জরাগ্রস্ত হয়েছি, তুমি আমার বাধা পেরিয়ে যাও
তুমি স্থির, নিঃশব্দ রক্তমাংস, তোমার যৌনাঙ্গকে আমার প্রণতি
তোমার উন্মুখ স্তনে মুখ দিয়ে আমি ব্যবধাহীন বেঁচে রয়েছি
আমি এতদিন আত্মায় বিশ্বাসী ছিলাম, তোমায় গর্ভবতী করে রেখেছিলাম
আমি চন্দ্রমাশীতল রাত্রে খুঁজেছিলাম তোমার গাল আমার পাশে
আমি উত্তরঙ্গ জলোচ্ছ্বাসে তোমাকে ভাসিয়ে দিয়ে বলেছিলাম—সব মানুষ জন্মকাল থেকে সমান
যে কবি বলতে পারে— ‘কবিতা ছাড়া অন্য কোনও পবিত্রতায় আমার বিশ্বাস নেই’, তার নিজের কবিতা সম্পর্কে বিশ্বাসী হওয়াই স্বাভাবিক। তবু প্রকৃত কবির মতো শম্ভু জানত কবির নিয়তি। কতটা স্বচ্ছ দৃষ্টি থাকলে লেখা সম্ভব— “আমরা সকলেই পরীক্ষা দিতে বসেছি, খাতা জমা রেখে যেতে হবে, মহাকাল কাকে কত নম্বর দেবে তার ওপরেই নির্ভর করছে কবি ও কবিতার ভবিষ্যৎ। খাতা জমা দিয়ে চলে যাব, চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পর খাতাগুলো দেখা হবে, যদি সারবস্তু থাকে পাস করবেন, না হলে গোল্লা।” শম্ভুর পক্ষেই এই ভাষায় কথা বলা সম্ভব।
সম্প্রতি পৃথিবী ছেড়ে তার কল্পিত মহাপৃথিবীর দিকে পাড়ি দিয়েছে শম্ভু রক্ষিত, আমাদের প্রায় পঞ্চাশ বছরের বন্ধু। আমি নিশ্চিত জানি যে পরীক্ষার কথা ও বলে গেছে, সেই মহাকালের হাতে পাসমার্ক ঠিক পাবে।
সৈয়দ কওসর জামাল.
কবি ও প্রাবন্ধিক
কবিতা ১.
আমি স্বেচ্ছাচারী
এইসব নারকেল পাতার চিরুনিরা, পেছন ফিরলে,এরাও ভয় দেখায় ।
কিছুই, এক মিনিট, কিছুই জানি না সাম্যবাদী পার্লামেন্ট জনশ্রুতি সম্পর্কে বা ।
চণ্ডাল কুকুরদের আতীনাদ আমাকে ঘিরে—এবং আমাকে আলবৎ জানাতে হবে, আলবৎ আমাকে
ডুবতে দিতে হবে, যেতে দিতে হবে যেখানে যেতে চাই না , পায়চারি করতে দিতে হবে ।
আমার গলা পরিষ্কার—আমি স্বেচ্ছাচারী—কাঁচের ফেনার মধ্যে চুল—স্পষ্ট করে কথা বলতে দিতে হবে
আর কথাবার্তায় তেমন যদি না জমাতে পারি সেরেফ
পায়চারি করে ঘুরে বেড়াবো—সমস্ত পৃথিবীর মেঘলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ।
ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে । ঘামের জল ধুয়ে–শুদ্ধভাবে আমি সেলাম আলয়কুম জানিয়ে
পায়চারি করে ঘুরে বেড়াবো ১ থেকে ২ থেকে ৩,৪,৫ গাছের পাতার মতো । রিরংসায় ।
মাটিতে অব্যর্থ ফাঁদ পেতে রেখে । রাস্তায় । ব্রিজের ফ্ল্যাটে । ট্রেনে,
যে কোনো কিশোরীর দেহে । শেষ রাতে—পৃথিবীর মানচিত্র এঁকে, কেবল স্থলভাগের
হু-হু করে জেট প্লেনে আমি যেতে চাই যেখানে যাবো না, এর ভেতর দিয়ে,
ওর ভেতর দিয়ে–আর । হুম । এক ধরনের ছেনি শাবল আমি চাই–
যা কিছুটা অন্যরকম, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানান্দের নয়–ঠিক
খেলার মাঠে স্টার্টারের পিস্তলের মতো–রেডি–আমি বাঘের মতন লাফিয়ে পড়ব । খবরদার ।
কবিতা ২.
সোনার দাসী
অনেক দূর দেশ ঘুরে আমার সোনার দাসী আসে
আমি সংক্ষিপ্ত গলিপথ থেকে ঘরে কোলে করে নিয়ে আসি তাকে।
সোনার দাসী,যাকে প্রজাপতির মত দেখতে-
আমি চোখ বুজে শুঁকি যার টকটকে লাল সিল্কের জামা,গর্ভের শিরা
যার শুকনো অল্প চুল মাথার ওপর দুভাগ হয়ে
আমার কানের পাশে জটার মত ঝোলে।
আমার ঘরে লোহার খাট,জামাকাপড় রাখার দেরাজ
দেয়ালের মধ্যে মার্বেল পাথর বসানো কয়েকটা ড্রয়ার
এবং আখরোট কাঠের ওপর খোদাইকাজ করা ছোট্ট একটা টেবিল
যেন স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে থাকে।
আমি অবৈধ কার্পেট পুঁথি,ছেঁড়া কাপড় সোনার দাসীকে পরাই।
আমি হেসে তার সঙ্গে কথা বলি,তার জন্য আমার নিশ্বাস,
আঙ্গুলের সাদা হাড় তাকে দেখাই,তার জন্য আমার জলস্তম্ভ
এবং আমার জন্য তার দ্বিতীয় সত্তা অনেক দূরে চলে গেছে।
আমি সোনার দাসীর মনের কথা চিন্তা করি,সগর্বে উদাসীন হই
ফলে সোনার দাসী ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে
বায়ুমণ্ডলের মতো তাকে মনে হয়
সে রঙিন বাদ্যযন্ত্র ও টুপি নিয়ে আমার সঙ্গে আমার সঙ্গে লড়াই লড়াই খেলে
আমি দেখি তার দীর্ঘস্পন্দিত খেলা,দীর্ঘ অঙ্গসঞ্চালনও করি
সোনার দাসীর অনুপক্রীড়ায় এখন আমার মূর্ত শরীর-
আমার ও সোনার দাসীর খেলা দেখে নিরাবরণ বুড়িরা উঁচুবাড়ি থেকে
বেরিয়ে আসে,সোনার দাসীকে তারা দয়াময়ের বাতাস দিতে থাকে
তাকে ঘিরে ধরে পাথরের পতগ লাগানো ওদের গুলবদন সম্ভ্রম।
চতুর্দিক দেখা বারুদের মতন সোনার দাসী শীতল মনে হাই তোলে
তার নিহিত চোখের ভেতর হতে অনর্গল রশ্মিকণা আসতে থাকে
তার জালি চোখ,উত্তপ্ত লাল ঠোঁট-ঝালর লাগানো স্মৃতি-
তার শরীরে আমার বেদনা মাখানো গন্ধ
আমি ও সোনার দাসী আমরা দুজনে এখনও স্পষ্ট,স্ফীত
আহরিৎ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে যাই প্রায়ই নিচে।
কবিতা ৩
তোর ঈশ্বরের নাম বল
আমার মৃত্যুর পর তোকে আর যন্ত্রণার তাঁত বুনতে হবে না
বল দেখি,আমার লেখা গল্পের,আঁকা-মানচিত্রের মধ্যে তুই কে?
এক রাত্তির জেগে ছেঁড়া কাঁথায় নকশা তুলেছিলি রাশ রাশ জুইঁ
কি সুন্দর,এসেছে শরৎ,গন্ধনাচনের দিন এলো,তবু তুই-
কার জন্যে কী?তুই রোদ্দুরে গেলেই আমার সর্বাঙ্গ বিদ্ধ হবে
অত্যন্ত না হলে আমার শরীর ক্রুসে সেঁটে গেঁথে লটকে দিস!
আমি বাঁচি,তুইও বাঁচিস,তোর জন্যে আমি,আমার জন্যে কী?
আকাশ তোর অরণ্যকুয়াশা ছাড়া কিছুই না,ধু ধু আর জল
আমার সন্দেহ,না তোর রগড়?
আগে তুই বেশ ছিলি,সোনার চেয়ে দামি মুক্ত আলো ফেলেছিলি-
আমার জন্যে বাজিয়েছিলি মিষ্টি অরগ্যান-আজ বিক্ষত হলাম।
শান্তির শত্রু,আক্রোশের ভ্রূণকে পুড়িয়ে খুন করবি,বেশ কর
এবং তোর ঈশ্বরের নাম বল।
আর পৌরুষপ্রাপ্তির আগে ক্ষিপ্ত অঙ্গারে জ্বলে যাই যাই পালাই
আর যদি না পালাই,বিন্দু হয়ে যদি না মিশি বিস্মৃতির গুহায়-
তুই আমার দেহে দুর্ধর্ষহিম মেঘকুয়াশার ভল্ল গিঁথে দিস!
আমার মৃত্যু তোর কি?আলোর গহীন থেকে তুই কি আঁকি দেখিস!
কবিতা ৪.
পাঠক,অক্ষরগুলি
আমি বেশ কয়েকটি অক্ষরকে নিয়ে
সোনালি নস্যি রঙের ফ্রককোট পরে
বিষুবরেখার কয়েক ডিগ্রি ওপরে উঠেছি
বিটকেল শিক্ষার্থীসুলভ তাদের হাত
আঁচড়ের সাহায্যে আমাকে এমন ব্যবহার করছে
এবং আমার ছ'মিটার চওড়া দোলনের ওপর
তারা এমন ভারি নম্র অন্তহীন খেলা খেলছে
যে তাদের ত্রস্ত শঙ্কিত ঐক্যবদ্ধ নীলবর্ণের গ্রীবার ওপর
কপনি তুলতে হয়েছে
তারা আমার অন্তর্হিত যুক্তির ধাপ দিয়ে
নৈঋত ছায়ার পরিধি থেকে এসে
লবণের বরফখণ্ডের ওপর
তারপর তারা আমার কায়াহীন হাতের ওপর
আমি কোনো বীভৎস মুহূর্তে অক্ষরগুলির বোঝাও নামিয়ে নিয়েছি
তাদের মধ্যে কোথাও সৃজনীশক্তি লুকিয়ে আছে কিনা দেখবার জন্যে
অতি সুস্বাদু মাছ দিয়ে তাদের করেছিও বাতাস
বস্তুত তাদের রূপসী হৃদয় রম্বস,বৃত্ত,সামন্তরিক গড়ন নিয়েছে
পাঠক,অক্ষরগুলি এলেমদার,উদ্যত এখন
একটু হেসে আমাকে ব্যাখ্যা করতে পারছে
অসম্ভব উৎস থেকে বেরিয়ে এসে
মন্থর আশ্বস্ত পায়ে
অগোচর লক্ষ্যে হারিয়ে যেতে পারছে
আমার শাশ্বতের মূল টেনে আনতে পারছে
কবিতা ৫
রাজনীতিবিদরা
রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক রাজধানীতে বাস করে
রাজনীতিবিদরা এক বিভবশালী বিবুধের দ্বারে বসে
প্রেরণাপূর্ণ নরক সৃষ্টি করে
রাজনীতিবিদরা দেশপ্রেমসমৃদ্ধ গ্রাম ও শহরের মানুষদের শেখায়
'নিতান্তই দলের একজন লোক'-তাদেরই দুর্দশার হেতু
যারা কোন শিশুদর্শকদের হয়ে ছবি আঁকে না
বা লাথিয়ে খামচে চেঁচিয়ে হাড় ভাঙবার যোগাড় করে না
রাজনীতিবিদরা সাধারণত তাদের উপর নির্ভর করে না
জনগণ নামক শ্রবণযন্ত্রে সাড়া জাগাবার উদ্দ্যেশ্যে
রাজনীতিবিদরা কাগজে বেতারে পাঠায়
দেশ স্বাধীনতা পৃথিবী মঙ্গল বিষয়ে বিষ-অভিজ্ঞতা
রাজনীতিবিদরা রচনা করে এখনও কারাগার
পশু-সংস্করণ,রাক্ষস খোক্কসের সৃষ্টি-রহস্যের আদিকান্ড
তারা আধা পুরোন সমাজের মায়াপঞ্জিকার ভেতরে এখনও লুকিয়ে থাকে...।
নাগরিক অন্তঃসারশূন্য মেকী উজ্জ্বলতা ও প্রচারসর্বস্ব অশ্লীলতার যাবতীয় তমসা থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে বসে থেকে যিনি অকুতোভয়ে উচ্চারণ করেন,"আমরা সকলেই পরীক্ষা দিতে বসেছি, খাতা জমা রেখে যেতে হবে, মহাকাল কাকে কত নম্বর দেবে তার ওপরেই নির্ভর করছে কবি ও কবিতার ভবিষ্যত, খাতা জমা দিয়ে চলে যাবো, চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পর খাতাগুলো দেখা হবে, যদি কিছু সারবস্তু থাকে, পাশ করবেন, নাহলে গোল্লা!!" সেই কবি শম্ভু রক্ষিতের পিতৃপুরুষের ভিটে মেদিনীপুর জেলার সুতাহাটা থানার বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামে, জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ই আগস্ট হাওড়ার ১১, ঠাকুরদাস দত্ত বাই লেনে মাতুলালয়ে। পিতা নন্দলাল রক্ষিত ছিলেন ব্যবসায়ী, হাওড়ার দাশনগরে তাঁর একটি লোহার সিন্দুকের কারখানা ছিলো। মা রাধারানী দেবী ছিলেন গৃহবধূ। কবির প্রাথমিক শিক্ষা সুতাহাটার পূর্ব শ্রীকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বৃত্তি পরীক্ষা পাশ করে হাওড়ার কদমতলায় চলে আসার পর মাধ্যমিক স্কুল জীবন শুরু হয় ব্যাঁটরা মধুসূদন পালচৌধুরী স্কুলে। তিনি পরবর্তীতে নরসিংহ দত্ত কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেও প্রথাগত শিক্ষার প্রতি প্রভূত অনাগ্রহের কারণে তা সম্পূর্ণ করেন নি।
বিশুদ্ধ কবির জীবনকে তার কবিতা থেকে পৃথক করে দেখা পাপাচারেরই নামান্তর হয়, হাংরি আন্দোলন নিয়ে কবির তুমুল আগ্রহের ফলশ্রুতি ছিলো নিজস্ব সম্পাদনা ও প্রকাশনায় হাওড়ার বাড়ি থেকে প্রচারিত হওয়া "ব্লুজ" পত্রিকা, অক্ষয়কুমার রমনলাল দেশাই সম্পাদিত "Violation Of Democratic Rites"-এর তৃতীয় খন্ডে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯৭৬ সালে পুলিশ শম্ভু রক্ষিতের উপর হাজতে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিলো আর তারপর বিনা বিচারে তাঁকে আট মাস আটক রাখা হয়েছিলো, ১৯৬৪ সালে শুরু হওয়া মামলার জেরে "ব্লুজ" পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়, হাংরি জেনারেশনের রূপকার মলয় রায়চৌধুরী শম্ভু রক্ষিতকে "সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত কবি" স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন-.. ... " শম্ভুর একটি লেখা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন করে গজিয়ে ওঠে তা এক রহস্য,কবিতা বিশেষটি আরম্ভ করে শম্ভু ক্রমশঃ ভঙ্গুর ডিকশানের মাধ্যমে তার গঠনবিন্যাসের ল্যাবিরিন্থে নিয়ে যান, ছবি পুরো গড়ে ওঠার আগেই অন্য ছবিতে চলে যান,ষাট,সত্তর,আশি,নব্বই দশকের কবিতার যে ধারা তার সঙ্গে শম্ভুর কবিতার মিল নেই, তিনি নিজের বাক্য সাজানোর কৌশল গড়ে ফেলেছেন এবং তা থেকে কখনও সরে যাননি,আশে পাশে নানারকম আন্দোলন ও শৈলী নিরীক্ষা সত্বেও"...... মলয় রায়চৌধুরীর বিশ্লেষণ অনুসারে শম্ভু রক্ষিতের কবিতাগুলি রাইজ্যোম্যাটিক, বহুরৈখিক, ম্যাক্সিমেলিস্ট, ফ্র্যাগমেন্টারি, নন-টাইটেল হোল্ডিং, আয়রনিকাল এবং অবশ্যই টেকনিক্যালি আঁভা গার্দ।
মাত্র তেইশ বছর বয়সে "তুমি কণিকা ও সূর্যের মধ্যে বিন্দু ও বিস্ফোরণজাত গোলাপ" -এর মতো লাইন সংবলিত শম্ভু রক্ষিতের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না' (১৯৭১) তে আমরা অসম্ভব দার্শনিক প্রৌঢ়তার আভাস পাই "তোমার নিঃসঙ্গতা আমায় উপহার দেয় দীর্ঘ আনন্দময় সমাধি', কবি রমিত দের বিশ্লেষণে স্বেচ্ছায় মূলধারার বাইরে থেকে যাওয়া কবি শম্ভু রক্ষিতকে ইতিহাসের অমরত্বে উত্তীর্ণ হতে দেখি--".....তার নিজস্ব এক দূরত্বের ধারণা,এক অননুকরণীয় ভাষা,আত্মভেদী শব্দকোষ যা চিরমুক্ত প্রবাহ থেকে প্রবাহমানে,আরম্ভ থেকে সে চলেছে নতুন আরম্ভের দিকে,অহংকারের দিকে,তার ভাষা নিরাকার,দর্শন থেকে শুরু করে মহীলতার পরাবাস্তববাদ-গভীরতায় ঠাসা তার কবিতাগাথা,তার কোলাহল,তার লবনমুক্ত তন্ময়তা,বাংলা কবিতার স্রোতের বিপক্ষে তিরিশ দশক ধরে গড়ে তোলা তার ঘর-মাটি-আলো-জল যা তাকে সারস্বতের গুণগ্রাহিতা নয় বরং শিখিয়েছে বিশুদ্ধ কবিতার জনক হিসাবে নিজেকে অতি নিপুণভাবে প্রবীণ করে তোলা।"
এই অবধি তার 8 টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে,'সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ', 'প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না', 'রাজনীতি', 'পাঠক,অক্ষরগুলি', 'সঙ্গহীন যাত্রা', 'আমার বংশধররা', 'আমি কেরর না অসুর', 'ঝাড় বেলুনের জোট', ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর গল্প সঙ্কলন 'শুকনো রোদ কিংবা তপ্তদিন অথবা নীরস আকাশ প্রভৃতি' এবং একমাত্র উপন্যাস 'অস্ত্র নিরস্ত্র' (১৯৮০)। তিনি আমেরিকা নিবাসী বাংলাদেশের সাহিত্যানুরাগীদের দেওয়া 'শব্দগুচ্ছ' পুরস্কার প্রাপ্ত। তাঁর কবিতা ইংরেজি ও হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন "সত্তরের আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান ও সম্ভাবনাময় কবি শম্ভু রক্ষিত", শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন "তার কবিতা সমকালের পাঠকরা সেভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও আগামী দিনের পাঠকরা সঠিক মূল্যায়ন করবে।" গত চল্লিশ বছর ধরে আজও এই কবি নিজে প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে ছাপা অবধি "মহাপৃথিবী" নামের ব্যতিক্রমী কবিতা পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন। তাঁর অমোঘ উচ্চারণ ------
"কবিতা ছাড়া অন্য কোনও পবিত্রতায় আমার বিশ্বাস নেই"
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment