সমসাময়িক আরেক তরুণ কথাসাহিত্যিক সন্তোষ ঘোষ মনে করতেন বিমল কর সুবোধ ঘোষ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থান করছেন; পরে বিমল তাঁর এক লেখায় স্বয়ং স্বীকার করেছেন যে, তিনি এই দুই অমর গুণী শিল্পীর কোন কিছুই অনুসরণ করতে পারেননি। আসলে বিমল কর-এর কোন গল্পই করুণ সরল রেখায় পূর্ণ বলয়িত হয়নি। গল্পে তার ঘটনা কোন সময় সামান্য থাকলেও চিন্তাবোধ গল্পের ঘটনাকে করে তোলে অসামান্য। আর এখানেই বিমল করের উপার্জিত হয়েছে সাফল্যের স্বাতন্ত্র্যময়তা। বলা বাহুল্য তিনি আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীদের একজন।
নতুন চেতনা প্রবাহের গল্পমালার উদগাতা হিসেবে সেই সময় সাহিত্য জগতে যে আলোড়ন উঠেছিল, তার উচ্ছ্বাস এখনো বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে মিলিয়ে যায়নি। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বারবার খেয়াল করে দেখা গেছে এই আন্দোলন এখন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকারদের একটি প্রিয় বিষয়। পঞ্চাশের দশকে তার এই আন্দোলন দুটি কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে, প্রথমত: পূর্বজ অগ্রজ লেখকদের ঘটনা প্রধান কিংবা চরিত্র প্রধানের রীতি অগ্রাহ্য করে গল্পের ভেতরদেশে প্রবেশ করলেন আন্তবাস্তবতার রহস্যময় বেদনাময় পর্ব এবং তাঁর গল্পের নায়ক-নায়িকারা স্বাভাবিক আট দশটা বাঙালি মহিলাদের মত ব্যথা-বেদনার পথিক নন, আর পাশাপশি গল্পের নায়করা মনের মধ্যে ডুব দিয়ে তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালাতে থাকে বেঁচে থাকা জীবনের আত্ম বিশ্লেষণে।
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২১ উত্তর ২৪ পরগণার টাকীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জ্যোতিষচন্দ্র কর এবং মাতা নিশিবালা কর।
বিমল করে জন্ম কলকাতায় নয়; আসানসোলে। এই জন্য তার গল্পে কলকাতার উপস্থিতি খুব কম এসেছে। কলেজ জীবন পৌঁছাবার আগ পর্যন্ত তাঁর কিশোরবেলা কেটেছে আসানসোলে, কালিপাহাড়ি, বরাকর ও কুলটি অঞ্চলে। পড়াশোনার জন্য চলে আসেন কলকাতায়। বিমল কর লেখক হবেন এই রকম বাসনা তার প্রথম জীবনে ছিল না। তবে খুব ভালো পাঠক ছিলেন। তার বিশাল পড়ালেখা ছিল সমকালীন দেশী-বিদেশীদের গল্প উপন্যাস। বলতে গেলে নাক ডুবিয়ে এই সমস্ত উপন্যাস পাঠে বিমল কর নিজেও বেশি উপকৃত হয়েছেন। আর তরুণরাই ছিল তার সার্বক্ষণিক বন্ধু। তবে এর পর নানা জায়গায় জীবিকার পথে পাড়ি দিয়ে বিখ্যাত দেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে চাকরির সুবাদে ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় আমৃত্যু নিয়মিতভাবে গল্প উপন্যাস লিখে গেছেন।
১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত প্রথম ছোটগল্প অম্বিকানাথের মুক্তি প্রবর্তক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত পরাগ পত্রিকায় সহ সম্পাদকের কাজ পান । সহ সম্পাদক হিসাবে তিনি পশ্চিমবঙ্গ ও সত্যযুগ পত্রিকায় কাজ করেন । ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত প্রথম ছোটগল্প সংকলন বরফ সাহেবের মেয়ে প্রকাশিত হয় । সেই বছরেই দেশ পত্রিকার বিভাগীয় প্রধান হিসাবে যোগ দেন । এই পদে তিনি ১৯৮২ সাল অবধি ছিলেন।এছাড়া তিনি শিলাদিত্য এবং গল্পপত্র পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
ছোটদের জন্য তার রচিত একটি চরিত্র অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিসিয়ান কিঙ্কর কিশোর রায় বা কিকিরা । কিকিরার উপন্যাস পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত হত।
তার রচিত বেশ কয়েকটি কাহিনীতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে । যেমন বসন্ত বিলাপ, হ্রদ ( চলচ্চিত্র), বালিকা বধূ, (যেটি হিন্দিতেও নির্মিত হয়েছিল) যদুবংশ, ছুটি (এটি তৈরি হয়েছিল তার খড়কুটো উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে)।
বিমল কর অসময় উপন্যাসের জন্য ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন । এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র পুরস্কার, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহ দাস পুরস্কার পান । তিনি দুবার আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছিলেন । তিনি বহু ছোটগল্প এবং কিশোর উপন্যাসও লিখেছিলেন।
উপন্যাসের নাম | রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ ( কিশোর) | অন্যান্য | গোয়েন্দা গল্প | নাটক |
---|---|---|---|---|
নিম ফুলের গন্ধ | ওয়ান্ডার মামা | এক ভৌতিক মালগাড়ী আর গার্ড সাহেব | কিকিরা সমগ্র ১ | ঘুঘু |
কুশীলব | গজপতি ভেজিটেবল সু কোম্পানী | কেউ কি এসেছিলো | কিকিরা সমগ্র ২ | |
অসময় | অলৌকিক | ম্যাজিশিয়ান | কিকিরা সমগ্র ৩ | |
সান্নিধ্য | শীষের আংটি | ভুনি কাকা'র চৌরশতম | ||
দংশন | হারানো জীপের রহস্য | মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি | ||
খড়কুটো | কিশোর ফিরে এসেছিলো | বন বিড়াল | ||
মোহ | মন্দাগড়'এর রহস্যময় জোৎস্না | একটি ভুতের ঘড়ি | ||
দ্বীপ | হারানো ডাইরীর খোঁজে | |||
প্রচ্ছন্য | কালবৈশাখের রাত্রে | |||
এ আবরণ | রাবণের মুখোশ | |||
স্বপ্নে | একটি ফটো চুরির রহস্য | |||
নিরস্র | নীল বানরের হার | |||
অশেষ | একটি অভিশপ্ত পুঁথি ও অষ্ট ধাতু | |||
বালিকা বধূ | পাখী ঘর | |||
দেয়াল | বাঘের থাবা | |||
মল্লিকা | জাদুকরের রহস্যময় মৃত্যু | |||
যদুবংশ | সার্কাস থেকে পালিয়ে | |||
পূর্ণ অপূর্ণ | হলুদ পালক বাধা তীর | |||
ভুলের ফাদে নবকুমার | ||||
তুরুপের শেষ তাস | ||||
সোনার ঘড়ির খোঁজে | ||||
হায়দার লেনের ১৩ নাম্বার বাড়ীর কফিন বাক্স | ||||
ঝিলের ধারে একদিন | ||||
ফুলদানী ক্লাব | ||||
সোনালী সাপের ছোবল | ||||
আজব দেশের গজব রাজা |
সিনেমা
সিনেমার নাম | সাল |
---|---|
বালিকা বধূ | ১৯৬৭ |
বসন্ত বিলাপ | |
বালিকা বধূ (হিন্দি ) | ১৯৭৬ |
যাদুবংশ এবং ছুটি ( খড়কুটো ) | ১৯৬৭ |
দিল্লাগি | ১৯৭৮ |
বনভূমি |
কোঁচাধারীর নাম বিমল কর। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র। শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে জানা যায়, ‘‘আড্ডা শেষ হলে বিমলদার চ্যালাচামুণ্ডাদের অর্থাৎ আমাদের প্রধান কাজ ছিল ওঁকে বাসে তুলে দেওয়া। বাসে তুলতে আমাদের প্রায় আধ ঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিট লেগে যেত! একেবারে ফাঁকা বাস না হলে উনি উঠতেই পারতেন না।’’ এক সাক্ষাৎকারে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অকপটে স্বীকার করেছিলেন, এই মানুষটা না থাকলে তিনি বা তাঁর মতো অনেকেই লেখা নিয়ে এগোনোর কথা চিন্তা করতে পারতেন না। তাঁর আজও বিস্ময় এই ভিতু মানুষটা কী করে কলকাতার রাস্তায় নিজে ড্রাইভ করতেন! আরেক খ্যাতনামা শ্রী সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিচারণে জানা যায়, ‘‘বিমলদার একটা ফিয়াট গাড়ি ছিল। রাস্তা ফাঁকা থাকলেও থার্ড গিয়ারের উপরে গাড়ি চালাতেন না। পাছে দুর্ঘটনা ঘটে! তাই প্রায়ই বিবেকানন্দ রোডে গিয়ে আনন্দ পাবলিশার্সের বাদলদাকে (বসু) ডেকে গাড়ির নানা সমস্যা জানাতেন। একদিন বাদলদা হেসে বললেন, ‘আপনাকে গাড়ি চালাতে হবে না, আমি ড্রাইভার দিচ্ছি।’ বিমলদা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।’’ বিমানে চড়তে হবে বলে বিদেশ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়েও তাতে সাড়া দেননি বিমল কর! বইমেলায় একা যেতেন না। রাস্তা পার হতে সঙ্গী লাগত। দাঁত তুলতে গেলে সঙ্গে যেত চার-পাঁচ জন। বাড়িই ছিল তাঁর কাছে শান্তির জায়গা। ‘ভ্রমণ’ শব্দটা থেকে তফাতেই থাকতেন লেখক।
ভালোবাসা এক আনন্দময় অনুভব। মৃত্যু তার বিপরীত। মৃত্যুর অনুভব কখনোই আনন্দ দিতে পারে না। আবার মৃত্যুর পর মৃত্যু চিন্তায় শঙ্কিত সুধাময় নানান দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুভয়কে জয় করে জীবনকে ভালোবেসেই। রাজেশ্বরী পর্বে মূলত প্রেম-ভালোবাসার-আনন্দের পরীক্ষা নিরীক্ষা চললেও অন্তরালে সুপ্ত ছিল যে আশঙ্কা—অন্য এক মৃত্যুর। কেননা, রাজেশ্বরীর প্রতি মুগ্ধতা—যাকে তার মোহ মনে হয় সে সম্পর্কে বন্ধু পরিমলকে জানিয়েছিল, ‘ভোগদখলের পর একদিন আমি ক্লান্ত হবনা, আমার আনন্দ উবে যাবে না!’ এও ত এক মৃত্যুচিন্তা—আনন্দের মৃত্যুচিন্তা! হৈমন্তী পর্বেও একই ভাবনায় শঙ্কিত। আসলে জীবন তো সবকিছু নিয়েই— ভালোবাসা—আনন্দ—মৃত্যু, সব। এই জীবনের মধ্য থেকে জীবনের অংশীদার হয়ে, শুধু আনন্দকে বিচ্ছিন্ন করে পাওয়া কি সম্ভব? তাই গল্পের শেষটি বড় চমৎকার। কাঠামোটি ‘চতুরঙ্গ’র মতো বলেছি, কিন্তু যে কথা বলা হয় নি—গল্পের কথন ভঙ্গিটি ‘তেলেনাপোতা আবিস্কার’-এর মতো কিছুটা। অবশ্য প্রথম কথক পরিমলই পাঠককে দাঁড় করায় দ্বিতীয় কথকের মতো। তাই শেষে পাঠকের প্রতি পরিমলের আবেদন— ‘যদি কোন দিন সুধাময়ের সঙ্গে দেখা হ, তাকে বলবেন, তার লেখকবন্ধু পরিমলের বড় ইচ্ছে সুধাময় যেন জানায় সে কি তার সমস্ত জীবনে সেই সুধাকে পেয়েছে যার জন্য ওর এত আকুলতা…?”
বিমল করের অধিকাংশ গল্পেই মৃত্যু, অসুখ কিংবা এই দুই একই সঙ্গে এসেছে বারবার। একবারে প্রথম দিকের গল্প— ‘অম্বিকানাথের মৃত্যু’(১৯৪৩) থেকেই। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এই প্রসঙ্গ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এমন আরো আছে। ‘আঙুরলতা’, ‘যক্ষ’, ‘ইঁদুর’, ‘অশথ’, ‘নদীর জলে ধরাছোঁয়ার খেলা’… অনেক অনেক। সে আলোচনা পৃথকভাবে একটি গ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে। আপাতত সে চিন্তা নেই। অতএব এ লেখার মৃত্যু এখানেই।
বিমল কর ৮২ বছর বয়েসে তাঁর বিধাননগরের বাসভবনে মারা যান । তিনি মৃত্যুকালে স্ত্রী তিন মেয়ে এবং এক ছেলে রেখে গিয়েছেন।
=============∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆============
No comments:
Post a Comment