‘এ মোর অত্যুক্তি নয়, এ মোর যথার্থ অহংকার,
যদি পাই দীর্ঘ আয়ু, হাতে যদি থাকে এ লেখনী,
কারেও ডরি না কভু,......
সম্মুখে থাকুন বসে পথ রুধি রবীন্দ্রঠাকুর,
আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষ্ণ আলো,
যুগসূর্য ম্লান তার কাছে’। (আবিষ্কার)
জীবন এবং মৃত্যু, ড্রয়িং-রুম ও ফুটপাথ, বৈভব ও দারিদ্র্য, জাগতিক কামনা-বাসনা এবং বৈরাগ্য সব কিছুকেই এক কলমে ধরার হিম্মত বাংলা সাহিত্যে যাঁরা দেখাতে পেরেছেন, তাঁদের অন্যতম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে সেপ্টেম্বর, নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য তাঁর পরিবারের আদি নিবাস ছিল বর্তমান মাদারিপুর জেলায়। তাঁর বাবা রাজকুমার সেনগুপ্ত নোয়াখালী আদালতের আইনজীবী ছিলেন। এই কারণে তাঁর শৈশব, বাল্যজীবন, ও প্রাথমিক শিক্ষা নোয়াখালীতেই সম্পন্ন হয়।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তিনি কলকাতায় অগ্রজ জিতেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কাছে যান এবং সেখানকার সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
১৯২১ সালে প্রবাসী পত্রিকায় নীহারিকা দেবী ছদ্মনামে অচিন্ত্যকুমারের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এর ভিতর দিয়ে কল্লোল যুগের অন্যতম এই লেখকদের আবির্ভাব ঘটে। এই সময় থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি তাঁর কাব্য চর্চা অব্যাহত ছিল। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে সাউথ সাবার্বান কলেজ (বর্তমান আশুতোষ কলেজ) থেকে আই. এ. এবং ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বি. এ. পাস করেন। ১৯২৫ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব নেন।
এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম. এ পাশ করেন ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং বি. এল ডিগ্রী লাভ করেন ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর প্রথম উপন্যাস বেদে প্রকাশিত হয় ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অস্থায়ী মুন্সেফ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ক্রমে সাব-জজ, জেলা জজ ও ল’ কমিশনের স্পেশাল অফিসার পদে উন্নীত হয়ে ১৯৬০ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
এই সময় থেকে চাকারির পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রাখেন। এবং দ্রুত বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বিশেষ করে উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। বিচারবিভাগে চাকরির বদৌলতে তিনি বাংলাদেশের নানা স্থানে ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সংস্পর্শে আসেন এবং এইসূত্রে অন্তরঙ্গ পরিচিতজনদের জীবনের নানাবিধি দিক তাঁর কাহিনীতে উঠে এসেছে নিপুণভাবে।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে জানুয়ারি মৃত্যবরণ করেন।
গ্রন্থাবলি :
অচিন্ত্যকুমারের গ্রন্থসংখ্যা প্রায় সত্তর। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের তালিকা নিচে দেওয়া হল।
উপন্যাস
বেদে (১৯২৮)
কাকজোৎস্না (১৯৩১)
বিবাহের চেয়ে বড় (১৯৩১)
প্রাচীর ও প্রান্তর (১৯৩২)
প্রথম কদমফুল (১৯৬১)
জীবনীগ্রন্থ
পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ (চার খন্ড ১৯৫২-১৯৫৭)
বীরেশ্বর বিবেকানন্দ (তিন খণ্ড, ১৯৫৮-৬৯)
এহেন অচিন্ত্যকুমারের জীবনের মোড় ঘুরে যায় একদিন সন্ধেবেলা স্ত্রী নীহারকণার সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়ে। তখন চাকরিসূত্রে আসানসোলে ছিলেন তিনি। বেহুলা আর লখিন্দরের বাসরঘরে যে ভাবে ঢুকে পড়েছিল সাপ, অচিন্ত্যকুমার আর নীহারকণার দাম্পত্যেও সে ভাবে ঢুকে আসে একটি সাপ। ঘাসের ভিতর থেকে এসে সে ছোবল দিয়ে যায় নীহারকণাকে। প্রায় জনশূন্য এলাকায় স্ত্রীকে কী ভাবে বাঁচাবেন ভেবে, পাগলপারা অচিন্ত্যকুমার একটি গাড়ি দেখতে পান। সাহায্যের জন্য গাড়ির চালককে অনুরোধ করলে তিনি এগিয়ে আসেন এবং নীহারকণাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান। দ্রুত সুচিকিৎসা পেয়ে নীহারকণা জীবন ফিরে পান। কৃতজ্ঞ অচিন্ত্যকুমার যখন গাড়ির চালককে ধন্যবাদ জানাতে যান, তখন সেই চালক অচিন্ত্যকুমারকে উপহার দেন ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’র দুটি খণ্ড।
এই ঘটনার পর থেকেই আধ্যাত্মিকতাকে অন্তরে অনুভব করতে শুরু করেন অচিন্ত্যকুমার। যে লেখক যৌনতাকে জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ ভাবতেন, সেই অচিন্ত্যকুমারই রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাণী আর দর্শনের গভীরে অবগাহন শুরু করেন। তারই ফলস্বরূপ তুমুল জনপ্রিয় ‘পরমপুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ’। এর পরে ‘পরমা প্রকৃতি শ্রী শ্রী সারদামণি ’, ‘বীরেশ্বর বিবেকানন্দ’, ‘অখণ্ড অমিয় শ্রীচৈতন্য’, ‘রত্নাকর গিরিশ্চন্দ্র’ ইত্যাদি অনেক বই অচিন্ত্যকুমার লিখেছেন, যা ধর্মচেতনার উপরেই আধারিত।
শিশু সাহিত্যিক হিসেবে অচিন্ত্যকুমারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল ‘ডাকাতের হাতে’, ‘দুই ভাই’ এবং ‘ঘোরপ্যাঁচ’। বিদেশি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রেও অচিন্ত্যকুমার পিছিয়ে থাকেননি। ন্যুট হ্যামসুন, হেলেন কেলার কিংবা বরিস পাস্তারনাকের রচনা বাংলায় প্রাণ পেয়েছে অচিন্ত্যকুমারের হাত ধরেই।
তাঁর ‘নতুন তারা’ নাটকটিও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, তিনি ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে কলকাতার একটি সংবাদপত্রে কাজও করেছেন। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় অচিন্ত্যকুমার কমেন্ট্রি করতেন, প্রতিবেদনও লিখতেন। ক্রিকেটের উপরে একটি বইও আছে তাঁর, ‘মৃগ নেই মৃগয়া’
স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ
কল্লোলযুগ (১৯৫০)
গল্পগ্রন্থ
টুটা-ফুটা (১৯২৮)
কাঠ খড় কেরোসিন (১৯৪৫)
চাষাভুষা (১৯৪৭)
হাড়ি মুচি ডোম (১৯৪৮)
একরাত্রি (১৯৬১)
ছোটগল্প সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমার বলেছিলেন, “ছোটগল্প লেখবার আগে চাই ছোটগল্পের শেষ। কোথায় সে বাঁক নেবে কোন কোণে ... শেষ না পেলে ছোটগল্পে আমি বসতেই পারব না। শুধু ঘটনা যথেষ্ট নয়, শুধু চরিত্র যথেষ্ট নয়। চাই সমাপ্তির সম্পূর্ণতা…’
‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাশ তখন তাঁর পত্রিকার কারণে বিশেষ জনপ্রিয়। তিনি লিখেছিলেন, ‘Buddhabeb and Achintya have given up making waves in the water (জলকল্লোল) and have taken up creating sexually charged waves instead’. (বুদ্ধদেব আর অচিন্ত্য জলকল্লোলের বদলে যৌনকল্লোল তৈরিতে ব্যস্ত)
লেখকের এই ভাবনা তাঁর গল্পের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। গল্পের উপস্থাপনা ও অগ্রগতির পাশাপাশি এমন শিল্পসম্মত সমাপ্তি খুব বেশি চোখে পড়ে না। এই গুণের জন্যই হয়তো অচিন্ত্যকুমারকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন বিষ্ণু দে। কোনও কোনও পাঠকের মতে, অচিন্ত্যকুমার সারা জীবনই একটু বাঁকা চোখে দেখতে চেয়েছেন সমাজ, সময়কে.
কাব্যগ্রন্থ
অমাবস্যা (১৯৩০)
‘অমাবস্যা’ অচিন্ত্যকুমারের প্রথম প্রকাশিত কাব্য। প্রমথনাথ বিশী এই বইটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন যে, প্রেমের কবিতা সংকলনের নাম ‘অমাবস্যা’ দেখে প্রথমে তিনি চমকিত হয়েছিলেন। পরে দেখা গেল, আসলে ওই অমাবস্যা কালচেতনার নিরেট অন্ধকারে ছাওয়া যৌবন- প্রেমমিলন- উৎসুকতার উপরেও যা দীর্ঘ ছায়া ফেলে। “মিলনের রাতে উঠানের কোণে জ্বলিছে বিরহবাতি, জ্যৈষ্ঠের রোদে কপাল কুটিছে অমাবস্যার রাতি”। (মিলনের রাত)
আমরা (১৯৩৩)
প্রিয়া ও পৃথিবী (১৯৩৬)
নীল আকাশ (১৯৪৯)
পূর্ব-পশ্চিম (১৯৬৯)
উত্তরায়ণ (১৯৭৪)
নাটক
একাঙ্ক নাট্য-সংকলন (১৯৪৫)
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি জগত্তারিণী পুরস্কার লাভ করেন। এই বৎসরেই পান রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার ও শরৎচন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার।
১৯২৩ সালে প্রবর্তিত কল্লোল পত্রিকার কর্ণধার ছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ ও গোকুলচন্দ্র নাগ।
যে সময়ে কল্লোলের আবির্ভাব তখন বাঙলা সাহিত্যের দিগন্ত সর্বকোণে কবি রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে প্রোজ্জ্বল। কল্লোল যুগের নাবিকদের মূল লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্র বৃত্তের বাইরে সাহিত্যের একটি মৃত্তিকাসংলগ্ন জগৎ সৃষ্টি করা। কল্লোল যুগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট ছিল রবীন্দ্র বিরোধিতা. কবিতার ক্ষেত্রে যাদের নাম কল্লোল যুগের শ্রেষ্ঠ নায়ক বিবেচনায় প্রচারিত তারা হলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে। এই পাঁচজন বিশিষ্ট কবিকে একসাথে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব। এ পঞ্চপাণ্ডবই ছিলেন মূলত কল্লোল যুগের কাণ্ডারি। তবে কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সঞ্জয় ভট্টাচর্য, অবনীনাথ রায় প্রমুখ অনেকেরই ভূমিকা
হরপ্রসাদ মিত্র বলেছিলেন, “তাঁকে বুঝতে হলে তাঁর কালের সেন্টিমেন্ট উপেক্ষা করা চলবে না”। অন্য ভাবে বললে, বলতে হয়, কালের হাওয়ায় বিচলিত অচিন্ত্যকুমারের নিজস্ব সেন্টিমেন্টই তাঁকে কালস্রোতে ভাসিয়ে নিয়েও শেষ পর্যন্ত মিশে যেতে দেয়নি। শব্দ সংগ্রহ, শব্দ নির্মাণ কিংবা বাক্যবন্ধ গঠনেই নয়, ছন্দ-স্পন্দ সৃষ্টিতেও অচিন্ত্যকুমার বাংলা কবিতারই ঐতিহ্যবা
কবিতা ।
ছন্নছাড়া
গলির মোড়ে একটা গাছ দাঁড়িয়ে
গাছ না গাছের প্রেতচ্ছায়া —
আঁকাবাঁকা শুকনো কতকগুলি কাঠির কঙ্কাল
শূন্যের দিকে এলোমেলো তুলে দেওয়া,
রুক্ষ রুষ্ট রিক্ত জীর্ণ
লতা নেই পাতা নেই ছায়া নেই ছাল-বাকল নেই
নেই কোথাও এক আঁচড় সবুজের প্রতিশ্রুতি
এক বিন্দু সরসের সম্ভাবনা ।ওই পথ দিয়ে
জরুরি দরকারে যাচ্ছিলাম ট্যাক্সি ক’রে ।
ড্রাইভার বললে, ওদিকে যাব না ।
দেখছেন না ছন্নছাড়া ক’টা বেকার ছোকরা
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে–
চোঙা প্যান্ট, চোখা জুতো, রোখা মেজাজ, ঠোকা কপাল–
ওখান দিয়ে গেলেই গাড়ি থামিয়ে লিফট চাইবে,
বলবে, হাওয়া খাওয়ান ।ওরা কারা ?
চেনেন না ওদের ?
ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের –এক নেই রাজ্যের বাসিন্দে ।
ওদের কিছু নেই
ভিটে নেই ভিত নেই রীতি নেই নীতি নেই
আইন নেই কানুন নেই বিনয় নেই ভদ্রতা নেই
শ্লীলতা-শালীনতা নেই ।
ঘেঁষবেন না ওদের কাছে ।কেন নেই ?
ওরা যে নেই রাজ্যের বাসিন্দে–
ওদের জন্যে কলেজে সিট নেই
অফিসে চাকরি নেই
কারখানায় কাজ নেই
ট্রামে-বাসে জায়গা নেইমেলায়-খেলায় টিকিট নেই
হাসপাতালে বেড নেই
বাড়িতে ঘর নেই
খেলবার মাঠ নেই
অনুসরণ করবার নেতা নেই
প্রেরণা-জাগানো প্রেম নেই
ওদের প্রতি সম্ভাষণে কারু দরদ নেই–
ঘরে-বাইরে উদাহরণ যা আছে
তা ক্ষুধাহরণের সুধাক্ষরণের উদাহরণ নয়,
তা সুধাহরণের ক্ষুধাভরণের উদাহরণ–
শুধু নিজের দিকে ঝোল- টানা ।
এক ছিল মধ্যবিত্ত বাড়ির এক চিলতে ফালতু এক রক
তাও দিয়েছে লোপাট ক’রে ।তাই এখন পথে এসে দাঁড়িয়েছে সড়কের মাঝখানে ।
কোথ্বেকে আসছে সেই অতীতের স্মৃতি নেই ।
কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেই বর্তমানের গতি নেই
কোথায় চলেছে নেই সেই ভবিষ্যতের ঠিকানা ।সেচ-হীন ক্ষেত
মণি-হীন চোখ
চোখ-হীন মুখ
একটা স্ফুলিঙ্গ-হীন ভিজে বারুদের স্তুপ ।আমি বললুম, না ওদিক দিয়েই যাব,
ওখান দিয়েই আমার শর্টকাট ।
ওদের কাছাকাছি হতেই মুখ বাড়িয়ে
জিজ্ঞেস করলুম,
তোমাদের ট্যাক্সি লাগবে ? লিফট চাই ?
আরে এই তো ট্যাক্সি, এই তো ট্যাক্সি, লে হালুয়া
সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল ওরা
সিটি দিয়ে উঠল
পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি চল পানসি বেলঘরিয়া ।
তিন-তিনটে ছোকরা উঠে পড়ল ট্যাক্সিতে,
বললুম কদ্দুর যাবে ।
এই কাছেই। ওই দেখতে পাচ্ছেন না ভিড় ?
সিনেমা না, জলসা না, নয় কোনো ফিল্মি তারকার অভ্যর্থনা ।
একটা নিরীহ লোক গাড়িচাপা পড়েছে,
চাপা দিয়ে গাড়িটা উধাও–
আমাদের দলের কয়েকজন গাড়িটার পিছে ধাওয়া করেছে
আমরা খালি ট্যাক্সি খুঁজছি ।
কে সে লোক ?
একটা বেওয়ারিশ ভিখিরি ।
রক্তে-মাংসে দলা পাকিয়ে গেছে ।
ওর কেউ নেই কিছু নেই
শোবার জন্য ফুটপাথ আছে তো মাথার উপরে ছাদ নেই,
ভিক্ষার জন্য পাত্র একটা আছে তো
তার মধ্যে প্রকান্ড একটা ফুটো ।রক্তে মাখামাখি সেই দলা-পাকানো ভিখিরিকে
ওরা পাঁজাকোলা করে ট্যাক্সির মধ্যে তুলে নিল ।
চেঁচিয়ে উঠল সমস্বরে –আনন্দে ঝংকৃত হয়ে–
প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে ।রক্তের দাগ থেকে আমার ভব্যতা ও শালীনতাকে বাঁচাতে গিয়ে
আমি নেমে পড়লুম তাড়াতাড়ি ।
তারপর সহসা শহরের সমস্ত কর্কশে-কঠিনে
সিমেন্টে-কংক্রিটে ।
ইটে-কাঠে-পিচে-পাথরে দেয়ালে-দেয়ালে
বেজে উঠল এক দুর্বার উচ্চারণ
এক প্রত্যয়ের তপ্ত শঙ্খধ্বনি–
প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে
সমস্ত বাধা-নিষেধের বাইরেও
আছে অস্তিত্বের অধিকার ।ফিরে আসতেই দেখি
গলির মোড়ে গাছের সেই শুকনো বৈরাগ্য বিদীর্ণ ক’রে
বেরিয়ে পড়েছে হাজার-হাজার সোনালি কচি পাতা
মর্মরিত হচ্ছে বাতাসে,
দেখতে দেখতে গুচ্ছে গুচ্ছে উথলে উঠছে ফুল
ঢেলে দিয়েছে বুকের সুগন্ধ,
উড়ে এসেছে রঙ-বেরঙের পাখি
শুরু করেছে কলকন্ঠের কাকলি,
ধীরে ধীরে ঘন পত্রপুঞ্জে ফেলেছে স্নেহার্দ্র দীর্ঘছায়া
যেন কোনো শ্যামল আত্মীয়তা ।
অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখলুম
কঠোরের প্রচ্ছন্নে মাধুর্যের বিস্তীর্ণ আয়োজন ।
প্রাণ আছে, প্রাণ আছে– শুধু প্রাণই আশ্চর্য সম্পদ
এক ক্ষয়হীন আশা
এক মৃত্যুহীন মর্যাদা ।
আজি রজনীতে
আজি রজনীতে জানালার ধারে ফুটেছে আমার হেনা,
ওর পানে চেয়ে মনে পড়ে সেই বলেছিলে,—ভুলিবে না !
আছ কি নিদ্রাগত,
চোখের পাতায় ঘুম নেমেছে কি আমার স্নেহের মত ?
সফেনপুঞ্জা তটিনীর নীরে তুমি নবেন্দুরেখা,
দুখ-জাগানিয়া কোন্ বাঁশরীর অস্ফুট গীতলেখা !
শেষবিস্তারপান্ডুর তব স্তনকোরকের জ্যোতি,—–
শিথিল শিথানে কারে মোহিয়াছো—ব্রীড়ায় বেপথুমতী !
গোপন মিলন সুখে
মৃণালমৃদল দুটি বাহু দিয়ে জড়ায়েছো কা’রে বুকে !
পল্লবরাগতাম্র অধরে কার তরে এত মধু,
কা’র করে লীলাকমল তুমি গো, কার তুমি লীলাবধূ !
তনুতট উচ্ছল
শিশিরশীতল কপোলে পড়েছে বিচূর্ণকুন্তল !
হেথায় আঁধার নেমেছে নিবিড় কাকপক্ষের মত,
মনে আনে কা’র কালো দুটি আঁখি মমতায় সন্নত !
ফুটেছে ব্যথার হেনা,—–
কেন ঘুমাইলে, —- আমার মতন কেন তা’রে চিনিলে না ?
উদ্বাস্তু
চল, তাড়াতাড়ি কর,
আর দেরি নয়, বেরিয়ে পড় বেরিয়ে পড় এখুনি।
ভোররাতের স্বপ্নভরা আদুরে ঘুমটুকু নিয়ে
আর পাশ ফিরতে হবে না।
উঠে পড় গা ঝাড়া দিয়ে,
সময় নেই-
এমন সুযোগ আর আসবে না কোন দিন।
বাছবাছাই না ক’রে হাতের কাছে যা পাস
তাই দিয়ে পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে নে হুট ক’রে।
বেড়িয়ে পড়,
দেরী করলেই পস্তাতে হবে
বেরিয়ে পড়-ভূষণ পাল গোটা পরিবারটাকে ঝড়ের মতো নাড়া দিলে।
কত দূর দিগন্তের পথ-
এখান থেকে নৌকা ক’রে ষ্টিমার ঘাট
সেখান থেকে রেলষ্টেশন-
কী মজা, আজ প্রথম ট্রেনে চাপবি,
ট্রেনে ক’রে চেকপোষ্ট,
সেখান থেকে পায়ে হেঁটে-পায়ে হেঁটে-পায়ে হেঁটে-
ছোট ছোলেটা ঘুমমোছা চোখে জিঞ্জেস করলে,
সেখান থেকে কোথায় বাবা?
কোথায় আবার! আমাদের নিজের দেশে।
ছায়াঢাকা ডোবার ধারে হিজল গাছে
ঘুমভাঙা পাখিরা চেনা গলায় কিচিরমিচির করে উঠল।
জানালা দিয়ে বাইরে একবার তাকাল সেই ছোট ছেলে,
দেখলে তার কাটা ঘুড়িটা এখনো গাছের মগডালে
লটকে আছে,
হাওয়ায় ঠোক্কর খাচ্ছে তবুও কিছুতেই ছিঁড়ে পড়ছে না।
ঘাটের শান চ’টে গিয়ে যেখানে শ্যাওলা জমেছে
সেও করুণ চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করছে, কোথায় যাবে?
হিজল গাছের ফুল টুপ টুপ ক’রে এখনো পড়ছে জলের উপর,
বলছে, যাবে কোথায়?
তারপর একটু দূরেই মাঠে কালো মেঘের মত ধান হয়েছে-
লক্ষীবিলাস ধান-
সোনা রঙ ধরবে ব’লে। তারও এক প্রশ্ন- যাবে কোথায়?
আরো দূরে ছলছলাৎ পাগলী নদীর ঢেউ
তার উপর চলেছে ভেসে পালতোলা ডিঙি ময়ূরপঙ্খি
বলছে, আমাদের ফেলে কোথায় যাবে?
আমরা কি তোমার গত জন্মের বন্ধু?
এ জন্মের কেউ নই? স্বজন নই?তাড়াতাড়ি কর- তাড়াতাড়ি কর-
ঝিকিমিকি রোদ উঠে পড়ল যে।
আঙিনায় গোবরছড়া দিতে হবে না,
লেপতে হবে না পৈঁঠে-পিঁড়ে,
গরু দুইতে হবে না, খেতে দিতে হবে না,
মাঠে গিয়ে বেঁধে রাখতে হবে না।
দরজা খুলে দাও, যেখানে খুশি চলে যা’ক আমাদের মত।
আমাদের মত! কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?
তা জানিনা। যেখানে যাচ্ছি সেখানে আছে কী?
সব আছে। অনেক আছে, অঢেল আছে-
কত আশা কত বাসা কত হাসি কত গান
কত জন কত জায়গা কত জেল্লা কত জমক।
সেখানকার নদী কি এমনি মধুমতী?
মাটি কি এমনি মমতামাখানো?
ধান কি এমনি বৈকুন্ঠবিলাস?
সোনার মত ধান আর রুপোর মতো চাল?
বাতাস কি এমনি হিজলফুলের গন্ধভরা
বুনো-বুনো মৃদু মৃদু?
মানুষ কি সেখানে কম নিষ্ঠুর কম ফন্দিবাজ কম সুবিধাখোর?
তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো-
ভূষণ এবার স্ত্রী সুবালার উপর ধমকে উঠল:
কী এত বাছাবাছি বাঁধাবাঁধি করছ,
সব ফেলে ছড়িয়ে টুকরো-টুকরো ক’রে এপাশে-ওপাশে বিলিয়ে দিয়ে
জোর কদমে এগিয়ে চলো,
শেষ পর্যন্ত চলুক থামুক ট্রেনে গিয়ে সোয়ার হও,
সোয়ার হতে পারলেই নিশ্চিন্তি।
চারধারে কী দেখছিস? ছেলেকে ঠেলা দিল ভূষণ-
জল-জংলার দেশ, দেখবার আছে কী!
একটা কানা পুকুর
একটা ছেঁচা বাঁশের ভাঙা ঘর
একটা একফসলী মাঠ
একটা ঘাসী নৌকো-
আসল জিনিস দেখবি তো চল ওপারে,
আমাদের নিজের দেশে, নতুন দেশে,
নতুন দেশের নতুন জিনিষ-মানুষ নয়, জিনিস-
সে জিনিসের নাম কী?
নতুন জিনিসের নতুন নাম-উদ্বাস্তু।ওরা কারা চলেছে আমাদের আগে-আগে-ওরা কারা?
ওরাও উদ্বাস্তু।
কত ওরা জেল খেটেছে তকলি কেটেছে
হত্যে দিয়েছে সত্যের দুয়ারে,
কত ওরা মারের পাহাড় ডিঙিয়ে গিয়েছে
পেরিয়ে গিয়েছে কত কষ্টক্লেশের সমুদ্র,
তারপর পথে-পথে কত ওরা মিছিল করেছে
সকলের সমান হয়ে, কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে,
পায়ে-পায়ে রক্ত ঝরিয়ে-
কিন্তু ক্লান্ত যাত্রার শেষ পরিচ্ছেদে এসে
ছেঁড়াখোঁড়া খুবলে-নেওয়া মানচিত্রে
যেন হঠাৎ দেখতে পেল আলো-ঝলমল ইন্দ্রপুরীর ইশারা,
ছুটল দিশেহারা হয়ে
এত দিনের পরিশ্রমের বেতন নিতে
মসনদে গদীয়ান হয়ে বসতে
ঠেস দিতে বিস্ফারিত উপশমের তাকিয়ায়।
পথের কুশকন্টককে যারা একদিন গ্রাহ্যের মধ্যেও আনেনি
আজ দেখছে সে-পথে লাল শালু পাতা হয়েছে কিনা,
ড্রয়িংরুমে পা রাখবার জন্যে আছে কিনা
বিঘৎ-পুরু ভেলভেটের কার্পেট।
ত্যাগব্রতের যাবজ্জীবন উদাহরণ হয়ে থাকবে ব’লে
যারা এত দিন ট্রেনের থার্ড ক্লাসে চড়েছে
সাধারণ মানুষের দুঃখদৈন্যের শরিক হয়ে
তারাই চলেছে এখন রকমারি তকমার চোপদার সাজানো
দশঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে
পথচারীদের হটিয়ে দিয়ে, তফাৎ ক’রে দিয়ে
সমস্ত সামনেওয়ালাকে পিছনে ফেলে
পর-ঘর বিদেশী বানিয়ে।
হ্যাঁ, ওরাও উদ্বাস্তু।
কেউ উৎখাত ভিটেমাটি থেকে
কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে।আরো আগে, ইতিহাসেরও আগে, ওরা কারা?
ঐ ইন্দ্রপুরী-ইন্দ্রপ্রস্থ থেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে
হিমালয়ের দিকে-
মহাভারতের মহাপ্রস্থানের পঞ্চনায়ক ও তাদের সঙ্গিনী
স্ব- স্বরূপ- অনুরূপা-
যুদ্ধ জয় ক’রেও যারা সিংহাসনে গিয়ে বসল না
কর্ম উদযাপন ক’রেও যারা লোলুপ হাতে
কর্মফল বন্টন করল না নিজেদের মধ্যে,
ফলত্যাগ করে কর্মের আদর্শকে রেখে গেল উঁচু ক’রে,
দেখিয়ে গেল প্রথমেই পতন হল দ্রৌপদীর-
পক্ষপাতিতার।
তারপর একে একে পড়ল আর সব অহঙ্কার
রূপের বিদ্যার বলের লোভের-আগ্রাসের-
আরো দেখাল। দেখাল-
শুধু যুধিষ্ঠিরই পৌঁছয়
যে হেতু সে ঘৃণ্য বলে পশু বলে
পথের সহচর কুকুরকেও ছাড়ে না।
রবীন্দ্রনাথ
আমি তো ছিলাম ঘুমে,
তুমি মোর শির চুমে
গুঞ্জরিলে কী উদাত্ত মহামন্ত্র মোর কানে-কানে !
চলো রে অলস কবি
ডেকেছে মধ্যাহ্ন-রবি
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।চমকি উঠিনু জাগি’
ওগো মৃত্যু-অনুরাগী
উন্মুখ ডানায় কোন অভিসারে দূর-পানে ধাও,
আমারো বুকের কাছে
সহসা যে পাখা নাচে——
ঝড়ের ঝাপট লেগে হয়েছে সে উন্মত্ত উধাও।দেখি চন্দ্র-সূর্য-তারা
মত্ত নৃত্যে দিশাহারা,
দামাল যে তৃণশিশু, নীহারিকা হয়েছে বিবাগী,
তোমার দূরের সুরে
সকলি চলেছে উড়ে
অনির্ণীত অনিশ্চিত অপ্রেমেয় অসীমের লাগি’ |আমারে জাগায়ে দিলে,
চেয়ে দেখি এ-নিখিলে
সন্ধ্যা, ঊষা, বিভাবরী, বসুন্ধরা-বধূ বৈরাগিণী ;
জলে স্থলে নভতলে
গতির আগুন জ্বলে
কূল হ’তে নিলো মোরে সর্বনাশা গতির তটিনী |তুমি ছাড়া কে পরিতো
নিয়ে যেতে অবারিত
মরণের মহাকাশে মহেন্দ্রের মন্দির-সন্ধানে ;
তুমি ছাড়া আর কার
এ-উদাত্ত হাহাকার—–
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে |
পুব-পশ্চিম
তোমার শীতলক্ষ্যা আর আমার ময়ূরাক্ষী
তোমার ভৈরব আর আমার রূপনারায়ণ
তোমার কর্ণফুলি আর আমার শিলাবতী
তোমার পায়রা আর আমার পিয়ালী
এক জল এক ঢেউ এক ধারা
একই শীতল অতল অবগাহন, শুভদায়িনী শান্তি।
তোমার চোখের আকাশের রোদ আমার চোখের উঠোনে এসে পড়ে
তোমার ভাবনার বাতাস আমার ভাবনার বাগানে ফুল ফোটায়।তোমার নারকেল সুপুরি অশোক শিমুল
আমার তাল খেজুর শাল মহুয়া
এক ছায়া এক মায়া একই মুকুল মঞ্জরী |
তোমার ভাটিয়াল আমার গম্ভীরা
তোমার সারি-জারি আমার বাউল
এক সুর এক টান একই অকূলের আকূতি
তোমার টাঙ্গাইল আমার ধনেখালি
তোমার জামদানি আমার বালুচর
এক সুতো এক ছন্দ একই লাণ্যের টানা-পোড়েন
চলেছে একই রূপনগরের হাতছানিতে।আমরা এক বৃন্তে দুই ফুল, এক মাঠে দুই ফসল
আমাদের খাঁচার ভিতরে একই অচিন পাখির আনাগোনা।
আমার দেবতার থানে তুমি বটের ঝুরিতে সুতো বাঁধো
আমি তোমার পীরের দরগায় চেরাগ জ্বালি।
আমার স্তোত্রপাঠ তোমাকে ডাকে
তোমার আজান আমাকে খুঁজে বেড়ায়।আমাদের এক সুখ এক কান্না এত পিপাসা
ভূগোল ইতিহাসে আমরা এক
এক মন এক মানুষ এক মাটি এক মমতা
পরস্পর আমরা পর নই
আমরা পড়শী —আর পড়শীই তো আরশি
তুমি সুলতানা আমি অপূর্ব
আমি মহবুব তুমি শ্যামলী।আমাদের শত্রুও সেই এক
যারা আমাদের আস্ত মস্ত সোনার দেশকে খন্ড-খন্ড করেছে
যারা আমাদের রাখতে চায় বিচ্ছিন্ন করে বিরূপ করে বিমুখ করে।
কিন্তু নদীর দুর্বার জলকে কে বাঁধবে
কে রুখবে বাতাসের অবাধ স্রোত
কে মুছে দেবে আমাদের মুখের ভাষা আমাদের রক্তের কবিতা
আমাদের হৃদয়ের গভীর গুঞ্জন ?
তুমি আমার ভাষা বলো আমি আনন্দকে দেখি
আমি তোমাদের ভাষা বলি তুমি আশ্চর্যে দেখ
এই ভাষায় আমাদের আনন্দে -আশ্চর্যে সাক্ষাৎকার
কার সাধ্য অমৃতদীপিত সূর্য-চন্দ্রকে কেড়ে নেবে আকাশ থেকে?আমাদের এক রবীন্দ্রনাথ এক নজরুল।
আমরা ভাষায় এক ভালোবাসায় এক মানবতায় এক
বিনা সুতোয় রাখীবন্ধনের কারিগর
আমরাই একে অন্যের হৃদয়ের অনুবাদ
মর্মের মধুকর, মঙ্গলের দূত
আমরাই চিরন্তন কুশলসাধক।।
স্বাধীনতা
চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারছি না :
আমার প্রকাশ্য গৃহচূড়ে উড়ছে আমার স্বদেশের পতাকা—–
তিমিরমুক্ত অম্বরের অভিমুখে
উথ্বিত হচ্ছে আমার নিরুদ্ধ আত্মার প্রথম উদার সম্ভাষণ
আমার জন্মের প্রথম জয়ঘোষণা।
এক প্রান্তে গম্ভীর গৈরিক
অনপনেয় দুঃখের ঔদাস্য আর অপরিমেয় ত্যাগের প্রসন্নতা ;
অন্য প্রান্তে উল্লাস-উজ্জ্বল সবুজের অপর্যাপ্তি
অমিত জীবনের সৃজনসৌন্দর্যের উদ্ভাবন ;
মধ্যস্থলে তুষারসঙ্কশা শুভ্রতা
কর্মের নির্মলতা ও অনবদ্য অন্তরমাধুর্যের প্রতীতি।
আর সেই শুভ্রতার অন্তরে ঘননীল অশোকচক্র,
সমস্ত অলাতচক্রের ঊর্ধ্বে
শান্তির স্থির বাণী
দিকে-দিকে দেশে-দেশে মৈত্রীর আমন্ত্রণ;
শোকশূন্য সময়ের ঘূর্ণ্যমানতার প্রতীক
বর্তমান থেকে বৃহত্তর ভবিষ্যতের
মহত্তর সম্ভাবনায় নিয়ত-আবর্তিত
উড়ছে আমার ধ্রুব বিশ্বাসের ধ্বজপট
আমার বীজমন্ত্রের বৈজয়ন্তী।কত দুর্গম পর্বত ও কত কন্টকক্লেশিত অরণ্য পার হয়ে
কত দুঃসহ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে
অভ্রান্তলক্ষ্যে চলে এসেছ তোমরা,
দৃঢ় হাতে বহন করে এনেছ এই পতাকাকে।
কত রোষকষায়িত কশা, কত বলদর্পিত বুট
কত বর্বর বুলেট
ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে তোমাদের,
কিন্তু বজ্রমুষ্টি শিথিল করতে পারেনি,
স্খলিত করতে পারেনি তোমাদের পতাকার উদ্ধতি,
নমিত করতে পারেনি তোমাদের দুষ্পরাজেয় প্রতিজ্ঞা।
মায়ের বুকে সন্তানের মত
পক্ষিচঞ্চুপুটে তৃণখন্ডের মত
বারুদের বুকে বহ্নিকণার প্রত্যাশার মত
বহন করে এনেছে এই পতাকা
যাতে আমি প্রোথিত করতে পারি আমার প্রকাশ্য গৃহচূড়ে।
নবীনারম্ভের নিশ্বাসে বিস্তার করতে পারি বুক,
জজ্জ্বল উপলব্ধিতে উদ্ধত করতে পারি মেরুদন্ড।লেখনীকে বিশ্বাস করতে পারছি না
যা আমি আজ লিখছি এই মুহূর্তে।
কত বাক্য রুদ্ধ হয়ে গেছে তোমাদের কন্ঠে
দলিত হয়েছে কত অরুন্তদ আর্তনাদ
স্তব্ধ হয়েছে কত বঞ্চিত বুকের দ্রোহবাণী।
সত্যভাষের সেই অধিকারকে তবু বিধ্বস্ত হতে দাওনি,
বহন করে এনেছ এই পতাকা
এই উদাত্ত বীরবার্তা ;
তন্দ্রিত আকাশে মুক্ত করে দিয়েছ
সিতপক্ষ কলহংসের কাকলি,
যাতে আমি পেতে পারি আমার ভাষা
লেখনীতে অপরাঙ্মুখ তীক্ষ্ণতা।তাই আজ এই পতাকাকে যখন প্রণাম করি
প্রণাম করি তোমাদের দুর্জয় বীর্যবত্তাকে।
স্মরণ করি তোমাদের
যারা ফাঁসির রজ্জুকে মনে করেছে কন্ঠলগ্ন কোমল ফুলমালা
মৃত্যুতে দেখেছ অমরত্বের রাজধানী।
স্মরণ করি তোমাদের
নাগ-নক্ষত্র যাদের যাত্রা,
যারা কারাকক্ষে নিয়তিনির্দিষ্ট হয়ে
যাপন করেছে অবিচ্ছেদ্য অন্ধকার,
আকাঙ্ক্ষার অগ্নিতেজে তপ্ত রেখেছ বক্ষঃস্থল,
জতুগৃহদাহে দেখেছ ইন্দ্রপ্রস্থের নির্মিতি।
আর তোমাদের স্মরণ করি
সেই সব অগণন নানহীন পথিক পদাতিকের দল,
নির্বিশঙ্ক জীবনের আহ্বানে
পদে-পদে রক্তচিহ্নিত করেছ পথ-প্রান্তর-জনপদ,
ঘরে ঘরে জ্বেলেছ
জায়া-জননীর হাহাকারের দাবাগ্নি।
যাতে আমি জীবনে পেতে পারি মর্যাদা
অমূল্য মূল্যবোধ।
যাতে হাতে পেতে পারি তেজিষ্ঠ লেখনী
কন্ঠে পেতে পারি দুর্বার কলস্বন
আর প্রকাশ্য গৃহচূড়ে এই অপ্রকল্প পতাকা।।
প্রিয়া ও পৃথিবী
নিঃশঙ্ক, নিঃশব্দপদে একদিন এসেছিলে কাছে
ঈপ্সিত মৃত্যুর মতো, নয়নে যেটুকু বহ্নি আছে,
অধরে যেটুকু ক্ষুধা — সব দিয়ে লইলাম মুছে
লোলুপ লাবণ্য তব; দিনান্তের দুঃখ গেলো ঘুচে,
উদিলো সন্ধ্যার তারা দিগ্বধূর ললাটের টিপ।
কদম্বপ্রসব-সম জ্ব’লে ওঠে কামনাপ্রদীপ,
যুগ্ম দেহে ; শ্মশানে অতসী হাসে, নিকষে কনক ;
মেঘলগ্ন ঘনবল্লী আকূল পলকে নিষ্পলক।
কঙ্করে অঙ্কুর জাগে, মরুভূতে ফুটিলা মালতী—-
তুমি রতি মূর্তিমতী, আর আমি আনন্দ-আরতি।
দেহের ধূপতি হ’তে জ্ব’লে ওঠে বাসনার ধুনা
লেলিহরসনা, তবু কালো চোখে কোমল করুণ।
শুভ্র ভালে খেলা করে তৃতীয়ার ম্লান শিশু শশী,
তোমার বরাঙ্গ যেন সন্ধ্যাস্নিগ্ধ, শ্যামল তুলসী।
ভুজের ভুজঙ্গতলে হে নতাঙ্গী, নির্ভয় নির্ভরে
তোমার স্তনাগ্রচূড়া কাঁপিলো নিবিড় থরথরে।
স্ফুরত্প্রবাল ওষ্টে গূঢ়ফণা চুম্বন-উত্সুক,
এপারে রক্তাশোক, অন্য তটে হিংসুক কিংশুক।
শ্লথ হ’লো নীবিবন্ধ, চূর্ণালক, শিথিল কিঙ্কিণী,
কজ্জলে মলিন হ’লো পান্ডু গন্ড, কাটিলো যামিনী।
দূরে বুঝি দেখা দিলো দিগ্বালার রজত-বলয়,
বলিলাম কানে-কানে : ‘মরণের মধুর সময়।’
আজি তুমি পলাতকা, মুক্তপক্ষ পাখি উদাসীন,
ক্লান্ত, দূর নভোচারী দিগন্তের সীমান্তে বিলীন।
বিদ্যুৎ ফুরায়ে গেছে, কখন বিদায় নিলো মেঘ,
অবিচল শূন্যতার নভোব্যাপী নিস্তব্ধ উদ্বেগ
আবরিয়া রহিয়াছে হৃদয়ের অনন্ত পরিধি
চাহি না ঘৃণিত মৃত্য, তব গুপ্ত হীন প্রতিনিধি।
নীবিবন্ধ শিথিলিতে কটিতটে যদিও কিঙ্কিনী,
বাজে আজো, কজ্জলে মলিন গন্ড, তবু, কলঙ্কিনী,
চাহি না অতীত মৃত্যু | নভস্তলে অনিবন্ধনীবি
ঘুম পায় পার্শ্বে মোর বীরভোগ্যা প্রেয়সী পৃথিবী।
তারে চাই ; তাহারি সুধার তরে অসাধ্য সাধনাস,
বিস্মিত আকাস ঘিরি’ সুস্মিত, সনীল অভ্যর্থনা,
অজস্র প্রশ্রয় | মৃত্তিকার উদ্বেলিত পয়োধরে
সম্ভোগের সুরাস্রোত ওষ্ঠাধরে উচ্ছসিয়া পড়ে,
শস্য ফলে, নদী বহে, ঊর্ধ্বে জাগে উত্তুঙ্গ পর্বত,
হাস্য করে মৌনমুখে উলঙ্গ, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
আয়ুর সমুদ্র মোর দুই চক্ষে, মৃত্যু পদলীন,
তোমার বিস্মৃতি দিয়া পৃথিবীরে করেছি রঙিন।
নক্ষত্র-আলোক হ’তে সমুদ্রের তরঙ্গ অবধি
ব’হে চলে একখানি পরিপূর্ণ যৌবনের নদী।
তারি তলে করি স্নান, নাহি কূল, নাহি পরিমিতি,
তুমি নাই, আছে মুক্তি, পৃথ্বীব্যাপী প্রচুর বিস্মৃতি।
প্রথম যখন
প্রথম যখন দেখা হয়েছিল, কয়েছিলে মৃদুভাষে
‘কোথায় তোমারে দেখেছি বলো তো,—- কিছুতে মনে না আসে।
কালি পূর্ণিমা রাতে
ঘুমায়ে ছিলে কি আমার আতুর নয়নের বিছানাতে ?
মোর জীবনের হে রাজপুত্র, বুকের মধ্য়মণি,
প্রতি নিশ্বাসে শুনেছি তোমার স্তব্ধ পদধ্বনি !
তখনো হয়তো আঁধার কাটেনি,—সৃষ্টির শৈশব,—–
এলে তরুণীর বুকে হে প্রথম অরুনের অনুভব !’
আমি বলেছিনু, ‘জানি,
স্তবগুঞ্জন তুলি তোরে ঘিরে হে মোর মক্ষিরানী !’
যাপিলাম কত পরশ তপ্ত রজনী নিদ্রাহীন,
দু’চোখে দু’চোখ পাতিয়া শুধালে, ‘কোথা ছিলে এতদিন ?’
লঘু দুটি বাহু মেলে’
মোর বলিবার আগেই বলিলে ; ‘যেয়ো না আমাকে ফেলে।’আজি ভাবি ব’সে বহুদিন পরে ফের যদি দেখা হয়,
তেমনি দু’চোখে বিশ্বাসাতীত জাগিবে কি বিস্ময় ?
কহিবে কি মৃদুহাসে,
‘কোথায় তোমারে দেখেছি বলো তো, কিছুতে মনে না আসে।।’
রোগ শয্যায়
মলিন দিনের মাধুরী হেরিয়া মধুর হয়েছে মন
রোগ শয্যায় একা শুয়ে আছি একান্ত অকারণ।
তবু সবি লাগে ভালো,
বিদায় বেলায় গোধূলির চোখে মৃদু মুমূর্ষ আলো।
পাশের ছাতের আলিসা হইতে কাপড়টি নিতে আসা,
পথে যেতে যেতে দু’টি বন্ধুর দরদী দরাজ হাসা
তৃণের ডগায় ছোট আলোটুকু, একটি তারকা ফোটে,
শুক্ নো পাতাটি নীড়ে ফিরে-যাওয়া ভীরু শালিকের ঠোঁটে !
শুয়ে রোগ শয্যায়
আকাশের চোখে ক্লান্ত কাকুতি মোর চোখে পৌঁচায়।
কোমল করিয়া ডাকেনিক’ কেহ, জ্বালেনিক’ দীপ-শিখা,
আজিকে আঁধারে তারাটীর সনে মোর মুখ-চন্দ্রিকা !সন্ধ্যা কোমল কায়া
ছোট বোনটির মতো পাশে বসে’ নয়নে করুণ মায়া !
তুনি কি এখন চঞ্চলপদে গৃহ আচরণে রত,
তোমার চোখে কি সন্ধ্যা নেমেছে আমার স্নেহের মত ?
শুয়ে আছি চুপচাপ,
কান পেতে শুনি রাতের পাখায় বাজে আজি কি বিলাপ।
তোমারে ভুলিয়া গেছি
তোমারে ভুলিয়া গেছি,—–পরিপূর্ণ, পরিতৃপ্ত আজি মোর মন,
আমার মুহূর্তগুলি উড়ে চলে লঘুপক্ষ বকের মতন।
তোমারে ভুলিয়া গেছি নভচারী শ্রান্ত ডানা ধীরে বুজে আসে।
কূলের কুলায়ে হায়—কুয়াশার ঘুম ভাঙে চৈত্রের বাতাসে।
শ্মশান ঘুমায়ে আছে, আষাঢ়ের অশ্রু জলে নিভে গেছে চিতা,
শীতার্ত বিশীর্ণ নদী—নাহি আর আবেগের অমিতব্যয়িতা।
হাতে আজ কতো কাজ : ভুলে গেছি কখন ফুটেছে ছোট জুঁই,
ক্ষুদ্র গৃহনীড় ছেড়ে কখন বিদায় নিল চটুল চড়ুই।
তোমারে ভুলিয়া গেছি— উদ্বেগ-উদ্বেল তনু লভেছে বিশ্রাম,
প্রতীক্ষার ক্লান্তি হতে লভিয়াছি শূন্যতার আরোগ্য আরাম।
রৌদ্রের দারিদ্র মাঝে ভুলে গেছি নক্ষত্রের মধুক্ষরা চিঠি,
গায়ে হলুদের দিনে, ভুলে গেছি, পরেছিলে হলুদ শাড়িটি।দ্বার রুদ্ধ করি নাকো— জানি আর বাজিবে না ভীরু করাঘাত,
রজনীর সুপ্তিশেষে জানি শুধু দেখা দিবে প্রসন্ন প্রভাত।
তোমারে ভুলিয়া গেছি — জীবনেরে তাই যেন আরো বড়ো লাগে,
অনুর্বরা মৃত্তিকার রুক্ষদহ ভরে গেছে আতাম্র বিরাগে!
তোমায়ে মানায় কি-বা সিন্দুরেতে, কে বা জানে! হাতে এত কাজ!
বেদনার অপব্যয়ে গড়িব না, ভয় নাই, বিরহের তাজ।
ছিলাম সঙ্কীর্ণ গৃহে, চলে গিয়ে, ফেলে গেলে এত বড়ো ফাঁকা,
আমার কানের কাছে মুহুর্মুহু বেজে চলে মুহূর্তের পাখা।
তোমারে ভুলিয়া গেছি,—-কে জানিত এর মাঝে এতো তৃপ্তি আছে,
আমার বক্ষের মাঝে মহাকাশ বাসা বেঁধে যেন বাঁচিয়াছে।∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment