অজিত দত্ত
কুসুমের মাস
তুমি ফুল ভালোবাসো? লাল ফুল? চোখে যাহা লাগে?
কঠিন সৌন্দর্যে যার নয়ন সে হয় প্রতিহত?
তুামি ভালোবাসো ফুল? শেফালিকা সৌরভ-আনত?
যে-ফুল ঝরিয়া পড়ে ক্ষীণাঙ্গুলে স্পর্শিবার আগে?
আননে লেগেছে তব কেতকীর সৌরভ-দুকূলে?
হৃদয়ে কি বাজিয়াছে প্রগল্ভা হেনার উচ্চহাসি?
তুমি ভালোবাসো ফুল? কদম্ব সে বরষা-বিলাসী?
অথবা কুণ্ঠিতা কন্যা আতসীর কোমল মুকুল?
আমিও কুসুমপ্রিয়। আজিকে তো কুসুমের মাস।
মোর হাতে হাত দাও, চলো যাই কুসুম-বিতানে।
বসিয়া নিভৃত কুঞ্জে কহিব তোমার কানে-কানে,
কানন ফুলে ভরিয়াছি জীবনের মধু-অবকাশ।
লঘুপদে চলো যাই, কেহ যেন আঁখি নাহি হানে,
নিঃশ্বাসে জাগে না যেন তন্দ্রাস্তব্ধ রাতের বাতাস।।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘কুসুমের মাস’-এর কাব্যভাষার চলনকে বলেছিলেন ‘মদির মন্থরতা’। সাধুরীতিকে যে এত সুললিত করে তোলা যায়, দুরূহ শব্দনিক্ষেপও যে মায়াভারে এত নত হতে পারে, অজিত দত্ত না থাকলে আধুনিক বাংলা কবিতা কি তা জানতে পারত? অথচ ‘কুসুমের মাস’-এর পরের কাব্যগ্রন্থ থেকে তিনি যে সেই সাধুরীতিকে বর্জন করতে থাকলেন, তার কারণ কি পাঠকের প্রত্যাখ্যান? তার কারণ কি এটা যে শেষপর্যন্ত বাংলা কবিতার দুনিয়া ‘ওয়ান বুক ওয়ান্ডার’ করেই রেখে দিল তাঁকে? তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পাতালকন্যা’-তে চলিত ভাষায় বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া চলিতভাষাই তাঁর অবলম্বন হয়ে উঠল। অবশ্য বরাবর তিনি কমই লিখেছেন। এক-একটা কাব্যগ্রন্থের মধ্যে সময়ের ব্যবধান অনেকটাই। ভাষারীতির স্বাভাবিক বদল সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ পাঠক তাঁকে ‘পুরনোপন্থী’ ভাবেন এমন একটা বিশ্বাস, একটা অভিমানই হয়তো বা, তাঁর মনের মধ্যে ছিল। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন - “…নতুন কোনো বই হাতে তুলে দেবার সময়ে বলতেনই একবার : ‘তোমাদের অবশ্য ভালো লাগবে না এসব। আমি তো আর আধুনিক নই।”
“ঠিকই, প্রাচীনতা মাখানো এর শব্দসাজ,” লেখেন শঙ্খবাবু। আর লেখেন এই ‘প্রাচীনতা’ বিষয়ে অজিত দত্তের অস্বস্তির কথা - “আমাদের ছাত্রজীবনে তাঁর ‘কুসুমের মাস’ যে অনেকেরই হাতে হাতে ঘুরত, পুরোনো ধাঁচের শব্দ আর সাধু ক্রিয়াপদ সত্ত্বেও যে সে-বই থেকে এ ওকে শুনিয়ে দিতাম কোনো কোনো লাইন, সেকথা জেনে খুব প্রবোধ পেতেন তা নয়, বলতেন, ‘সে তো কোন আদ্যিকালের কথা! এখন তো আর ওরকম লিখি না।
১৯৩০ সালে অজিত দত্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ কুসুমের মাস প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু সতীর্থ। তিনি বুদ্ধদেব বসুর সাথে যৌথভাবে প্রগতি নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। পরে কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠী তে যোগ দেন। অজিত দত্ত নিয়মিত কল্লোল পত্রিকায় লেখালেখি করতেন, তিরিশের দশকে কল্লোল অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা সাহিত্য পত্রিকা। ১৯৪৬ সালে তার নষ্ট চাঁদ প্রকাশের পরের বছর দেশ পত্রিকায় রৈবত ছন্দ নামে ধারাবাহিকভাবে তার মন পবনের নাও প্রকাশিত হয়। অজিত দত্ত সমসাময়িক বাংলা কবিতা, ছন্দ চিন্তা, রবীন্দ্র বিষয়ক ভাবনা, বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের রচনার মূল্যায়ন, শিল্পসাহিত্য ভাবনা এবং শিশুসাহিত্য সম্পর্কিত ৫০টি প্রবন্ধ লেখেন। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকা কবিতা গোড়াপত্তনেও অজিত দত্তের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এই পত্রিকার তিনি অন্যতম প্রধান লেখক ছিলেন। ‘দিগন্ত’ নামে একটি প্রকাশনী সংস্থা গড়েছিলেন তিনি। ‘দিগন্ত’ সাহিত্য বার্ষিকী সম্পাদনা করেছেন।
অজিত দত্ত ১৯০৭ সালের ২ ৩ নভেম্বর ঢাকার বিক্রমপুরে (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র চার বছর বয়সে তার পিতা অতুলকুমার দত্ত মারা যান। তার মা হেমালিনী দেবী ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী।
১৯২৪ সালে ঢাকার কিশোরীলাল জুবিলী স্কুল থেকে অজিত দত্ত প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন এবং জগন্নাথ কলেজে বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯২৬ সালে তিনি কলকাতা চলে যান এবং বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার বড়ো ভাই মারা গেলে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে ভর্তি হন। অজিত দত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে বি.এ এবং ১৯৩০ সালে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
অজিত দত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী পদে যোগদান করে তার কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুদিন পরেই তিনি কলকাতায় রিপন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৩৪ সালে স্কুল ছেড়ে তিনি রিপন কলেজে যোগদান করেন। ১৯৩৬ সালে রিপন কলেজ ছেড়ে দিয়ে ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপানশন বোর্ডে এসিস্ট্যান্ট পাবলিসিটি অফিসার পদে যোগ দেন এবং সেখানে তিনি ১০ বছর চাকরি করেন। এখানে পদোন্নতি না হওয়ায় চাকরি ছেড়ে ক্যালকাটা ন্যাশনাল ব্যাংকের অধিকর্তা শচীন ভট্টাচার্যের ১২/১৪টি কনসার্নের পাবলিসিটি অফিসার হন। এখানেও ১০ বছর চাকরি করে ১৯৫৬ সালের ২১শে আগস্ট তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনায় যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন।
অজিত দত্তের প্রকাশিত গ্রন্থ,
কাব্য গ্রন্থ
কুসুমের মাস (১৯৩০)
পাতাল কন্যা (১৯৩৮)
নষ্ট চাঁদ (১৯৪৫)
পূর্ণনবা (১৯৪৬)
ছড়ার বই (১৯৫০)
ছায়ার আলপনা (১৯৫১)
জানালা (১৯৫৯)
কবিতা-সংগ্রহ (১৯৫৯)
শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭০)
সাদা মেঘ কালো পাহাড় (১৯৭১)
প্রবন্ধগ্রন্থ
জনান্তিকে (১৯৪৯)
মন পবনের নাও (১৯৫০)
সরস প্রবন্ধ (১৯৬৮)
বাংলা সাহিত্যে হাস্যরস (প্রবন্ধ, ১৯৬০)
কথা-ভারতী (অনুবাদ)
দুর্গাপূজার গল্প (অনুবাদ)
নিজের কবিতা সংগ্রহের ভূমিকায় কবি লিখেছিলেন, “অন্য যাঁদের আবাল্য বন্ধু ও সতীর্থ এবং সমধর্মা কবিরূপে জেনেছিলাম, তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বটুকু ছাড়া আর কোনো সমধর্মীতা আজ আর খুঁজে পাই না। সেজন্য নিজেকে বড়ো নিঃসঙ্গ মনে হয়।” ‘পোয়েট অব থার্টিজ’-এর অনুসরণে ‘তিরিশের কবি’ বলতে বাংলা কাব্যসাহিত্যে যে প্রজন্মকে আমরা ধরি, প্রতিভার দিক থেকে অজিত দত্তের তাঁদের মধ্যে গণ্য না হবার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। কিন্তু বুদ্ধদেব-জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে-অমিয় চক্রবর্তীর পর আর কোনও নাম আমরা উচ্চারণ করি না। এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে, সময়ের সঙ্গে বন্ধুতা হয়নি অজিত দত্তের। কিন্তু তা কি শুধুই ভাষার কারণে? অন্তরে অন্তরেও একরকম নিঃসময়ের তপস্যা করতেন বোধহয় তিনি। তাই পরে ভাষাভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করেও একরকম ব্রাত্য থেকে গেছেন। সময়ের রুটম্যাপের সঙ্গে কিছুতেই পদক্ষেপ মেলেনি তাঁর। প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত তিনি আসলে অতি-নিভৃত অনুভবের কবি। ভিতরপানে তাঁর দৃষ্টিপাত এতই গভীর, ভেসে ওঠার চেষ্টা করেননি কখনও তিনি। বা পারেননি। সেই অতলকে চিনে নিতে চাইবার কথা ছিল না কি আমাদের কবিতা-প্রেমীদের। !
কবিতা পাঠ ,:
মালতী ঘুমায়...
বৈশাখী হাওয়ার বেগে তারাগুল্লি কাঁপিতেছে
ক্ষীন-শিখা প্রদীপের মতো,
- এখন বাহিরে কত রাত?
নিশীথের হাওয়া আজ আফিমের নেশার মতন,
( মালতীর চুলগুলি চোখের পলকে চুমু খায়),
বাতাসে আসিছে ভেসে দূর হতে অস্পষ্ট গুঞ্জন,
( ঘুম এসে নয়নে জড়ায়)।
পত্রের মর্মর আর শোনা যায় বাতাসের স্বর,
নিঃশ্বাসে কাঁপিয়া ওঠে ক্ষুদ্র তারা, ক্ষীনায়ু প্রহর।
( ঘুম কি ভাঙিয়া যাবে কপালে রাখিলে হিম হাত?)
- এখন বাহিরে কত রাত?
একরাশ কালোচুল উতরোল এ-বাতাসে
একেবারে হল এলোমেলো ;
- এবার বৈশাখী ঝড় এলো!
কাঁপিছে দালান কোঠা সমুদ্রের জাহাজের মতো,
(বাতাস সরায়ে দিলো লঘু হাতে বুকের আঁচল)
এখনি ঝাপটে ছিঁড়ে উড়িয়া পড়িবে তারা যত।
( শুভ্র বাহু, পাটল কপোল)।
বাতাসে আসিছে ভেসে জল-কণা ঘরের ভিতরে,
সমস্ত আকাশ এসে জানালার কাছে ভিড় করে।
( নেমেছে চুমার মতো ঘুম ওর পলকের ‘পর’)
- এলো কাল বৈশাখীর ঝড়!
ঘুমন্ত দৈত্যের পুরী অকালে জেগেছে আজ,
রক্ষা নাই, নাই আর গতি,
( জেগে যেন ওঠে না মালতী!)
পাতালের যত নাগ আকাশে মেলিছে লক্ষ ফণা,
(সাবধানে সবগুলি জানালা দিয়েছি বন্ধ করে),
এ কী হুলুস্থুলু কান্ড! আকাশে যে গ্রহ রহিল না।
( আমি আছি বসিয়া শিয়রে)।
লক্ষ দৈত্য ব্রম্ভান্ডেরে ছিঁড়িয়া ফেলিছে কুটি কুটি,
তুলিয়া ধরেছে তারা বিদ্যুতের মশাল দেউটি ;
আমি জানি, কার খোঁজে নাগদৈত্য ছুটিতেছে রাগে।
( ভয়, যেন মালতী না জাগে)।
ওই শোনো দুড় দুড় লক্ষকোটি নাগদৈত্য
ঊর্ধ্বশ্বাসে পলাইছে ত্রাসে,
- মত্ত ঝড় শান্ত হয়ে আসে।
শাখার উন্মাদ নৃত্য ধীরে ধীরে হয়েছে মন্থর,
( বিদ্যুৎ গিয়েছে ছুঁয়ে মালতীর কম্পিত চুমায়),
ঝাপটে ঝরিছে পাতা, স্বচ্ছ হয়ে আসে দিগন্তর,
( অপরূপ! মালতী ঘুমায় )।
শঙ্কিত ডানার নিচে পৃথিবীরে লুকাইয়া কোলে
আশঙ্কায় কাঁপে রাত্রি, দুটি তারা ভয়ে আঁখি খোলে।
( স্বপ্নে উঠিয়াছে কেঁপে মালতীর আরক্ত অধর)
শ্রান্ত হয়ে এল মত্ত ঝড়।
মেঘমুক্ত স্বচ্ছাকাশে তারাগুলি ফুটিতেছে
শুভ্রদল শেফালির মতো,
- এখন বাহিরে রাত কত?
দেবতা নিক্ষেপি বজ্র তাড়ায়েছে অমঙ্গল যত,
(পৃথিবী হয়েছে হিম মালতীর ঘুমের লাগিয়া)।
এলায়ে পড়েছে রাত্রি নিদ্রাক্লান্তা মালতীর মতো,
( আমি আজ থাকিব জাগিয়া)।
ঘুমায় দূরের বন, ঘুমে ঝরে কুসুমের জল,
ঘুমায় পাথার-পুরী, ঘুমাইছে ক্লান্ত দৈত্যদল,
( জাগিয়া উঠিবে না তো ধরি যদি ওর দুটি হাত?)
- এখন বাহিরে কত রাত?
( বই;- কুসুমের মাস- ১৯৩০)
ছায়া...
কাল রাতে একলা আঁধার পথে শহরতলীতে
দেখলুম অদ্ভুত মেয়ে এক।
সেখানে অশত্থ ঝোপ নিঃধুম ছবির মতন,
এতটুকু হাওয়া নেই, জোছনাও ফোটে নি তখন,
দেখলুম আকাশের ময়লা আলোতে
আবছা ছায়ার মতো মেয়ে এক
যদিও বাতাস নেই, তবু যেন দেখলুম অদ্ভুত,
উড়ছে হাল্কা চুল, উড়ছে হাওয়ার মতো, আবছা।
যদিও জোছনা নেই তবু যেন দেখলুম অদ্ভুত,
পাপড়ির মতো তার চোখের পলক নত, আবছা।
নিঃঝুম জটবাঁধা অশত্থের ঝোপের ছায়ায়
ওড়নার মতো তার মুখখানি অর্ধেক ঢাকা,
দেখেছি অলক তার, দেখেছি পলক তার, আর
দেখেছি শরীর তার বাঁকা।
কালকে আবছা রাতে দেখেছি যে অদ্ভুত শহরতলীতে,
বিছানায় শুয়ে তাই ঘুম নাই চোখে এতটুকু;
যদিও ছিলো না হাওয়া, যদিও ওঠে নি চাঁদ কাল,
যদিও দেখে নি তার মুখ ।। ( বই;- কুসুমের মাস- ১৯৩০)
পুলিশ...
নিঝুম নিশুতি রাতে যখন ঘুমোয়ে থাকে কবি,
নবোঢা ঘুমায় যবে, নব-প্রেম-মুগ্ধা ঘুম যায়,
নক্ষত্র-খচিত-কেশা শর্বরীরে কে দেখে তখন?
নিদ্রার গুন্ঠন তুলি ধরা পানে কে তখন চায়?
তখন সে শিহরিত ছায়ার আড়ালে
চকোর ফুকারে যদি, দোয়েলায় দেয় যদি শিস,
কান পেতে শুনে ভাবে দূরে কোথা হুইসল বাজে-
একমাত্র জাগরুক রাস্তার পাহারা পুলিশ।
দেখে না সে আকশের জ্যোসস্নার জরির ওড়না
শ্লথ হয়ে খসে গেছে নতজানু মর্তকরপুটে,
দেখে না সে ফুলগুলি সহসা মেলিতে চায় ডানা
দিবসের নিদ্রা হতে তারার চুম্বনে জেগে ওঠে।
জানে না সে ঘাসগুলি শিশিরে হয়েছে মখমল,
বাতাসে ঝরিছে পাতা, তার সে রাখে না কোনো খোঁজ,
তবুও নিশীথ রাত্রে নিদ্রিত ধরার প্রতিনিধি
পুলিশ একাকী জাগে রোজ।
শরতের শিশিরের কণাগুলি ঝলমল করে
চুনির মণির মতো চাঁদের আলোর নিচে নিচে,
পুলিশ তাকায়ে ভাবে নিশ্চয় রক্তই হবে,
খুন ভেবে শশব্যস্ত হয়ে ওঠে মিছে?
রাত্রির বিজন বনে পরীদল খেলা করে রোজ,
গাছের পাতারা ডেকে কথা কয়, পাখি দেয় শিস,
তার মাঝে সারারাত চোরের ভাবনা ভেবে জাগে
রাস্তার পাহারা পুলিশ!.............. ( বই;-পাতালকণ্যা-১৯৩৮)
নষ্টচাঁদ...
এ-আষাঢে শেষ হোক কান্নার বন্যা
ও-আষাঢে লেখা যাবে মেঘদূত,
কবছর মন দিয়ে করো ঘরকন্না
বুড়োকালে প্রেম হবে অদ্ভুত।
মুখোমুখি বসে শুধু সকালে ও সন্ধ্যায়
দম্পতি-সুখ বলো হয় কার?
সংসার-ধর্মেতে যে মেয়েরা মন দ্যায়
পৃথিবীতে তাদেরি তো জয়কার।
মেয়েমানুষের বেশি মন থাকা উচিত না,
আমাদের মন তাই পারিনেকো সামলে।
রুদ্র-গ্রীষ্মে আকাশে থাকেই তো তৃষ্ণা
সব মিটে যাবে চোখের বর্ষা নামলে।
দুটো পয়সার সাশ্রয় কিসে হবে
সেদিকে বরং পারো যদি চোখ রাখতে,
বুড়ো হয়ে যদি বেঁচে ও বর্তে রবে
পাকা-বাড়ি করে সেখানে পারবে থাকতে।
শখ-টখ যত সবই জেনো ছেলেমানুষি
কুড়ির পরে কি ও-সব রাখতে আছে?
জীবন তো নয় সুখের জোয়ারে পানসি,
আসল প্রশ্ন প্রানটা কী ভাবে বাঁচে।
হঠাৎ সেদিন গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি
আগ্নেয়গিরি মেঘের চূড়ায় গলিত চাঁদের ধারা।
পাশ ফিরে শুই ; চাঁদের ভেল্কি সবই জানা গেছে মেকি,
মিথ্যে শরৎ , নেহাৎই মিথ্যে আকাশ-ছড়ানো তারা।
তুমি পাশে থাকো রুপোর কাঠিতে মূর্ছিতা চিরদিন-
গৃহিনী-সচিব-শিষ্যা এবং-এবং কি জানি কী যে,
জানি না, জানতে চাইনে, জানলে রোজগার হবে ক্ষীন,
চাঁদ তো উপোসে মরে না, কিন্তু বেঁচে থাকা চাই নিজে ।।
( বই;-নষ্টচাঁদ-১৯৪৫)
আমি...
রাত্রি আর প্রভাতের মধ্যবর্তী দুর্জ্ঞেয় সেতুর
অন্ধকার প্রান্তে আমি সম্মুখ-পথিক,
হেমন্তে উড্ডীন যেন শ্যামাকীট, ভ্রান্ত-দিগ্বিদিক,
শূণ্য আস্ফালনে সুচতুর।
আমি ভোগী গৃধু, তবু নমস্য শ্রদ্ধেয়,
আমি স্বগর্চ্যুত দেব,পাপ তবু সহায় আমার,
জোনাকির আলোবৎ সৌরদীপ্তি আমারি আত্মার,
আমার নিন্দিত যা তা অবশ্যি হেয়।
আমি সত্যবেত্তা, আমি মান্য ও মানিত,
আমি সুখ শান্তিদাতা ভবিষ্যতে, বর্তমানে যদি
আমার ইঙ্গিতে দুঃখ-দুর্দশার চূড়ান্ত অবধি
অন্যলোকে ভোগ করি মোরে করে প্রীত।
আমি অন্ধ, তবু আমি পথের নির্দেশ করি দান,
হিংস্র আমি, শান্তি তবু আমারি কবলে,
একা আমি, তবু শ্রেষ্ঠ নির্বোধের দলে।
মানব-আত্মার আমি যথা-ইচ্ছা করি অপমান।
সৌন্দর্যের ধ্বংসকারী,বিকেলের নিষ্ঠুর বিজেতা,
তবু আমি হৃদয়ের ঐশ্বর্যের একক ভাণ্ডারী,
দুর্বল, তথাপি আমি পৃথিবীতে ছিঁড়ে দিতে পারি,
আমি নেতা .।
।( বই;-পূনর্ণবা-১৯৪৬)
নেশা...
আফিঙের লাল ফুলে যেন এক অলস মৌমাছি
স্বপ্ন দেখে আর দেখে। শিহরিত পাখার রেশমে
রোদের সোনার বুটি বুনে যাওয়া শেষ হয় ক্রমে,
সূর্য বুঝি গেল চলে পশ্চিম-প্রান্তের কাছাকাছি।
ভুলের সূতোয় গাঁথা জীবনের সরু মালাগাছি
এখনি শকায়ে যাবে সংসারের সর্বভুক হোমে।
আয়ুর প্রবাহে আঁকা যত ছবি স্বপ্নের কলমে
যতক্ষন না হারায়, মনে হয় যেন বেঁচে আছি।
রামধনুরঙে মেশা এই নেশা অভিশাপ আনে,
ব্যর্থতায় মুছে যায় ধর্ম-অর্থ-সমাজ-সংসার
ভুলের দ্বিতীয় স্বর্গ তবু গড়ে চলি বারবার,
স্রষ্টার যে প্রতিদ্বন্ধী মুক্তি তার কাছে কোনখানে?
কৃতিত্বে কি কর্মে যার নাই দাম, নাই কোন মানে
নেশার সে নির্বাসনে খুঁজি চিরন্তন অধিকার ।।
১৯৭৯ সালে ৩০ ডিসেম্বর তিনি তার কলকাতার ২০ রাসবিহারী এভিনিউ এর বাড়িতে পরলোক গমন করেন।
=====================÷===========
No comments:
Post a Comment