ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক’ বলা হয় তাঁকে। সিপাহি বিদ্রোহকে ‘দি গ্রেট ইন্ডিয়ান রিভোল্ট’ বলার দুঃসাহসিকতা সে সময়ে তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন।
হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হলেন প্রথম ভারতীয় সাংবাদিক, যিনি এই দাবি তোলেন যে ভারতবর্ষীয় সমস্ত সমস্যার সমাধান ভারতবাসীকেই করতে হবে। তিনি দাবি করেন যে, ভারতে এখনই স্বায়ত্তশাসন চালু করা দরকার।
কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হত তাঁর হিন্দু পেট্রিয়ট সংবাদপত্র। তিনি এই সংবাদপত্র সম্পাদনা করেছেন ১৮৫৬ থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত। হরিশচন্দ্রের মতামতকে তখন বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিতেন ব্রিটিশ শাসকরা। তৎকালীন সরকার তাঁকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে প্রতি বৃহস্পতিবার যখন তাঁর ভবানীপুরের বাড়ি থেকে সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হত, তখন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং ওঁর বিশেষ দূত পাঠিয়ে দিতেন। তিনি কার্যত ছাপাখানা থেকেই হিন্দু পেট্রিয়ট সংবাদপত্রের একটি কপি তুলে নিয়ে যেতেন ক্যানিংয়ের কাছে।
উনবিংশ শতাব্দীর যে নবজাগরণের কথা আমরা বলে থাকি, তার অনেক সমালোচক। যাঁরা মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন, তাঁরা অনেকেই মনে করেছেন যে, এই নবজাগরণ কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি ওঁদের বিরোধিতা সময় সময় যা আক্রমণে পর্যবসিত হয়েছে। তবে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন দরিদ্র এবং কঠোর সংগ্রাম করে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন নিজের ক্ষমতায়। সেই মানুষ নীলবিদ্রোহের সময় চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদের কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। তাঁর সেই লড়াইয়ের অস্ত্র ছিল হিন্দু পেট্রিয়ট সংবাদপত্র।
হিন্দু পেট্রিয়টকে ব্রিটিশরা ভয় পেত অনেক বেশি, কারণ এটা ইংরেজিতে লেখা, একটা-দুটো কপি ইংল্যান্ডে চলে গেলে সে দেশের মানুষ সত্যটা জেনে ফেলবে, তখন সরকার বিব্রত হবে।
সম্ভবত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ই এ দেশে প্রথম সংবাদপত্র সম্পাদক, যিনি বিভিন্ন জায়গায় সংবাদদাতা বা করেসপন্ডেন্ট রেখেছিলেন। যশোহরে তাঁর সংবাদদাতা ছিলেন শিশিরকুমার ঘোষ। বিভিন্ন জায়গার সংবাদিকরা তাঁকে চিঠি পাঠাতেন, যা থেকে তিনি নীলকরদের সম্বন্ধে জানতে পারতেন এবং খবর করতেন। এটা এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, ওঁর বাড়িতে তখন সারাদিনই অত্যাচারিত, উৎপীড়িত চাষিরা এসে ওঁর বাড়িতেই থাকতেন, সেখানেই তাঁদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হত। এঁদের কারও বসতবাটি হয়তো কেড়ে নিয়েছে সরকার। ভিটেমাটি ছাড়া ওই কৃষকরা জানতেন যে এই মানুষটিই আমাদের জন্য লড়াই করছেন।
হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হলেন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে। সারা জীবন কাজ করে গিয়েছেন গ্রামের সেই সব মানুষের স্বার্থে, মার্কসীয়রা যাঁদের সর্বহারা বলেন। সেই সর্বহারা চাষিদের সঙ্গে তিনি কতটা ওতপ্রোত ভাবে মিশে গিয়েছিলেন এবং তাঁরাও তাঁকে কতটা ভালোবাসতেন নিজেদের লোক বলে তা বোঝা গেল তাঁর মৃত্যুর পরে।
এক লোককবি গান বাঁধলেন, তাঁর গানের মধ্যে ফুটে উঠল হা-হুতাশ:
নীলবাঁদরে সোনার বাংলাকরলে এ বার ছারখার অসময়ে হরিশ মলোলঙের হল কারাগার।
এই যে লোকমাধ্যমের মধ্যে এই মানুষটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। চাষিরা তাঁকে নিজের লোক বলে মনে করতেন।
যথার্থ ভাবে বলতে গেলে, ভারতে রাজনৈতিক সংবাদ প্রথম শুরু করেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এর আগে একেবারে ছিল না তা নয়, সমাজ সংস্কারের রাজনীতি ছিল। রামমোহন রায় তাঁর সংবাদপত্রগুলি চালিয়েছিলেন সমাজ সংস্কারের পথেই। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী ইংরেজি সংবাদপত্রে সামান্য ভাবে দুঃখ ও অভাব-অভিযোগ জানানো হয়েছে। এমন কথাও জানানো হয়েছে এ দেশীয়দের চেয়ে কম যোগ্যতার ‘সাদা চামড়ার লোক’কে চাকরিতে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র সম্বন্ধে ওঁদের মোহভঙ্গ হচ্ছে, কিন্তু এগুলো ইঙ্গিতে, সবই ছিল আবেদন-নিবেদন।
হরিশচন্দ্রই প্রথম সুস্পষ্ট উচ্চারণ করলেন যে, রাজনীতি জীবন বাদ দিয়ে নয় এবং রাজনৈতিক সাংবাদিতকা প্রথম প্রচলন করলেন যখন উনি প্রচার করলেন, স্বায়ত্তসাসন ভারতীয়দের অধিকার এবং যা কিছু ভারতীয়দের সমস্যা, তা সমাধানের ভার ভারতীয়দের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে সমাধানের জন্য। এ জন্য তিনিই ভারতে প্রথম রাজনৈতিক সাংবাদিকতার উদ্গাতা।
মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে এসে গ্রামের দরিদ্র মানুষের সঙ্গে এবং ভূমিহীন কৃষকের (যাঁদের অনেকে প্রোলেতারিয়ত বলে থাকেন) সঙ্গে যিনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন, তাঁদের জন্য তাঁর লেখনী সক্রিয় ছিল। তিনি তাঁর এই শ্রেণীর বেড়াটা ভেঙে ফেলে মানুষের স্বার্থটাকেই নিজের স্বার্থ করে তুলেছিলেন।
তিনি প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন। (তখনকার দিনের খানিকটা রীতি মেনে) তিনি পানাসক্তও ছিলেন। পরিবারে অশান্তিও ছিল। সব মিলিয়েই তাঁর মৃত্যু হয় মাত্র ৩৭ বছর বয়সে।
দুঃখের কথা হল, বাঙালি তো আত্মবিস্মৃত জাতি, তাই ওঁর একটা ছবিও পাওয়া যায় না। উনি কেমন দেখতে ছিলেন, তা জানার উপায় নেই। আরও দুঃখের বিষয়, ভবানীপুরে হরিশ মুখার্জি রোডে ওঁর যে বসত বাড়িটা ছিল, সেটা একসময় ঐতিহ্যবাহী ভবন বা হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের তালিকায় ছিল। কিন্তু পরে রাজনীতির নানা কারণে ওই ভবনটিকে ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে এখানে যে উনি থাকতেন এমন কোনও প্রমাণ নেই। ওই বাড়িটি ভেঙে দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখেছি যে ওই বাড়িতে ফলক লাগানো ছিল যে এই বাড়িতে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বসবাস করতেন।
যাঁরা বামপন্থী মনোভাবাপন্ন, যাঁরা নিজেদের কমিউনিস্ট বলে দাবি করেন, যাঁরা চাষিদের স্বার্থ দেখেন, তাঁরা সেই মানুষের স্মৃতিটাই ধ্বংস করে ফেললেন, যিনি সত্যিই কৃষকদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় সেই মানুষটির স্মৃতিরক্ষায় কিছুই করা হয়নি।
হরিশ্চন্দ্রের জন্ম হয় বর্তমান কলকাতা শহরের ভবানীপুরে । সেই সময় ভবানীপুর কলকাতার অংশ বলে বিবেচিত হত না । তার পিতার নাম ছিল রামধন মুখোপাধ্যায় । রামধন রাঢ়ী শ্রেণিভুক্ত ফুলিয়া মেলের একজন কুলীন ব্রাহ্মন ছিলেন । রামধনের বাড়ি ছিল বর্তমান বর্ধমান জেলার শ্রীধরপুর গ্রামে । রামধনের চার স্ত্রীর মধ্যে হরিশ্চন্দ্রের মা রুক্মিণী ছিলেন সবচেয়ে ছোট । হরিশ্চন্দ্র তার মায়ের দ্বিতীয় সন্তান।
স্কুলে পড়ার সময়েই হরিশ্চন্দ্রকে মায়ের অনুরোধে বিয়ে করতে হয়েছিল । স্ত্রী ছিলেন মোক্ষদাসুন্দরী, উত্তরপাড়ার গোবিন্দচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা । মোক্ষদাসুন্দরীর গর্ভে হরিশ্চন্দ্রের দুটি সন্তান হয়েছিল । প্রথমটি মেয়ে যার জন্মের কয়েকদিন পরই মৃত্যু হয় । দ্বিতীয় সন্তান হয় একটি ছেলে । ছেলেটি জন্মের ১৫ দিনের মধ্যেই মোক্ষদাসুন্দরীর মৃত্যু হয় । শিশুপুত্রের রক্ষনাবেক্ষনের জন্য হরিশ্চন্দ্র দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন । তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ভগবতী । ভগবতী দরিদ্র পরিবারের মেয়ে ছিলেন ।
হরিশ্চন্দ্রের সাথে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে । হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাটির জন্যই মাত্র আট বছরের মধ্যে হরিশ্চন্দ্রের খ্যাতি প্রায় সারা ভারতে ছড়িয়েছিল এমনকি ইউরোপের শিক্ষিত সমাজেও তার নাম প্রচারিত হয়েছিল । হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা প্রথম ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় । এটি ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা । এই পত্রিকার প্রবর্তক এবং প্রথম স্বত্বাধিকারী মধুসূদন রায়ের চিঠি থেকে জানা যায় যে হরিশ্চন্দ্র ছিলেন এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক । আড়াই বছর ধরে হরিশ্চন্দ্র বিনা পারিশ্রমিকে প্রায় একাই হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা পরিচালনা করেন । এরপর তিনি এই পত্রিকার স্বত্বাধিকারী মধুসূদন রায়ের কাছ থেকে হিন্দু পেট্রিয়ট প্রেস এবং কাগজের স্বত্ব কিনে নেন । হরিশ্চন্দ্র সেই সময় সরকারী কর্মচারী হওয়ায় নিজের নামে এই পত্রিকা কিনতে পারেননি । তিনি তার দাদা হারাণচন্দ্রের নামে এই স্বত্ব কেনেন । হরিশ্চন্দ্র এই কাগজে বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ মারফত বৈদেশিক সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন । এবং তিনি পত্রিকাটিকে একটি আধুনিক পত্রিকায় পরিণত করেন । তবুও ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষ অবধি এই পত্রিকা চালাতে হরিশ্চন্দ্রকে আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয় ।
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রথম থেকেই হরিশ্চন্দ্র সমাজের নিম্নতম শ্রেণির মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই শুরু করেন । তিনি সাধারণ মানুষের উপরে পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হন । বাংলার চাষীদের উপরে নীলকরদের অত্যাচার বন্ধের জন্য তিনি বাংলার উচ্চশ্রেণির মানুষদের এগিয়ে আসতে বলেন । তিনি তৎকালীন সরকারের আমদানি-রপ্তানি নীতিরও তীব্র সমালোচনা করেন । তিনি ভারত থেকে চাল, চিনি, তৈলবীজের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রপ্তানী করে মদ প্রভৃতি বিলাসদ্রব্য আমদানীর বিরোধিতা করেন । হরিশ্চন্দ্র বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বহুবিবাহ নিরোধ নিয়েও বহু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন । তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রস্তাব পুস্তকাকারে প্রকাশের সাথে সাথে এ বিষয়ে জনমত গঠনে সহায়তা করেন । হরিশ্চন্দ্র হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক রূপে স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে বহু সংবাদ ও প্রবন্ধ প্রকাশ করেন । তিনি পত্রিকাতে পতিতা সমস্যা এবং সরকারী শিক্ষানীতি নিয়েও আলোচনা করেন ।
তিনি সংস্কৃত ভাষার প্রসার এবং মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা করেন । হিন্দু প্যাট্রিয়টের সম্পাদকীয়তে প্রাচীন বাংলার সাহিত্যের উল্লেখ ও উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে বাংলা ভাষার প্রতি হরিশ্চন্দ্রের অনুরাগ ছিল । সেই সময় যে সব বাংলা বই প্রকাশিত হত তার সমালোচনাহিন্দু পেট্রিয়টে প্রকাশিত হত ।
তার রোগ ক্ষয়কাশ বা যক্ষা বলে ধরা পড়ে । হরিশ্চন্দ্র বুঝতে পারেন যে তার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। যত দিন পেরেছেন তিনি হিন্দু পেট্রিয়টের জন্য সম্পাদকীয় লিখে গেছেন । অবশেষে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুন শুক্রবার সকাল সাড়ে নটার সময়ে মাত্র ৩৭ বছর বয়েসে হরিশ্চন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । মৃত্যুর তিন মিনিট আগে হরিশ্চন্দ্র জ্বরের ঘোরে চিৎকার করে ওঠেন - ওরে পেট্রিয়ট মেশিনে ওঠাসনে, প্রুফটা আর-এক বার আমাকে দিয়ে দেখিয়ে তবে ছাপিস । এটাই হরিশ্চন্দ্রের মুখের শেষ কথা । হিন্দু পেট্রিয়টের চিন্তা তার জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তার মনে ছিল ।।
===={{==={{{{======={======={{{{{===={
No comments:
Post a Comment