Saturday, 25 September 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। ব্রাত্য বসু। ২৫.০৯.২০২১. Vol -506 The blogger in literature e-magazine.

"সংস্কৃতিকর্মীরা হচ্ছে ‘নৈতিকতার প্রতিনিধি’। মানুষের মাঝে নীতিবোধ সৃষ্টিতে কাজ করে যাওয়া। সে তিনি মন্ত্রী হোন কিংবা আর অন্য কেউ। তিনি যদি তা না করেন তবে সাংস্কৃতিক কর্মী লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবেন।"

বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় বঙ্কিম একবার লিখেছিলেন যে "দৃশ্যকাব্য সচরাচর কথোপকথনেই রচিত হয় এবং রঙ্গাঙ্গনে অভিনীত হইতে পারে, কিন্তু যাহাই কথোপকথনে গ্রন্থিত এবং অভিনয়োপযোগী, তাহাই যে নাটক বা তচ্ছেনীস্থ, এমত নহে। এ দেশের লোকের সাধারণতঃ উপরোক্ত ভ্রান্তিমূলক সংস্কার আছে। এই জন্য নিত্য দেখা যায় যে, কথোপকথনে গ্রন্থিত অসংখ্য পুস্তক নাটক বলিয়া প্রচারিত, পঠিত এবং অভিনীত হইতেছে। বাস্তবিক তাহার মধ্যে অনেকগুলিই নাটক নহে।" 

ব্রাত্য বসু 

জন্ম ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯, কলকাতা. একজন ভারতীয় বাঙালি নাট্যকার, নাট্য পরিচালক, অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ.অধ্যাপক ড. বিষ্ণু বসু এবং মাতা শিক্ষাবিদ্ ড. নীতিকা বসু। তাঁর সম্পূর্ণ নাম ছিল ব্রাত্যব্রত বসু রায় চৌধুরি। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য অধ্যয়ন করার পর কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপক রূপে যোগ দেন। গণকৃষ্টি নামে এক থিয়েটার গ্রুপে সাউন্ড অপারেটর হিসেবে তার নাট্যজীবন শুরু হয়েছিল.২০০৮ সালে তিনি 'ব্রাত্যজন' নামে নিজস্ব একটি থিয়েটার গ্রুপ গঠন করেন.

উৎপল দত্তের নাট্য রচনার পর এ দেশের প্রথিতযশা দু চারটি নাট্যগোষ্ঠী নাট্য রূপান্তরের চর্চায় ঝুঁকেছিলেন। তার বড় একটা কারণ ছিল সময় উপযোগী নাটকের অভাব। তারপর আশির দশকে বাংলা নাট্যসাহিত্য সমৃদ্ধ হল মোহিত চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র - এঁদের নাট্যচর্চায়। আর ছিলেন বাদল সরকার এবং আরও অনেকে। স্মৃতিতে ধারণযোগ্য নাটক এঁরা নিশ্চয়ই রচনা করেছেন এবং এ বিষয়ে সহমতের অভাব হবে না। সাম্প্রতিক কালের নাট্যচর্চার বিবর্তনে ব্রাত্য বসু একটি জাম্পিং ঝপাং। কেননা বাংলা নাটকের অনেকখানি পরিবর্তন ঘটল তাঁর কলমের জোরে। ব্রাত্য বসুর প্রথম নাটক দেখি 'অশালীন'। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে নাটকের এরকম একটি নাম এবং দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসময় অভিব্যক্তির চোরাটান আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল কোনো এক সন্ধ্যায় অকাদেমিতে 'অশালীন' অভিনয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে। তারপর 'অরণ্যদেব', 'মুখোমুখি বসিবার', 'শহর ইয়ার', 'উইঙ্কল টুইঙ্কল', 'ভাইরাস এম্‌', 'সতেরোই জুলাই' এবং আরো নানা নাটক রচনা পরিচালনা ও অভিনয়ে ব্রাত্য স্বমহিমায় ভাস্বর এবং তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে দ্রুত।


 তিনি কালবেলা সহ একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। 

দশ বছর পর তিনি পুনরায় সিনেমা নির্দেশনার কাজ করছেন যার নাম "ডিকসেনারি"।

অভিনয়

নামসাল
গ্যাংস্টার২০১৬
ডবল ফেলুদা২০১৬
অ্যাবি সেন২০১৫
নাটকের মত২০১৫
যোগাযোগ২০১৫
পারাপার২০১৪
এক এক্কে দুই২০১৪
মহাপুরুষ ও কাপুরুষ২০১৩
বালুকাবেলা ডট কম২০১২
তিন কন্যা২০১২
মুক্তধারা২০১২
হেমলক সোসাইটি২০১২
হ্যালো মেমসাহেব২০১১
ইচ্ছে২০১১
তারা২০১০
কালবেলা২০০৯
হারবার্ট‌২০০৬

তিনি দু'টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন: রাস্তা ও তারা। প্রথমটির বিষয়, এক যুবকের সন্ত্রাসবাদী হয়ে ওঠা, এবং দ্বিতীয়টির বিষয়, সমাজ ও প্রেমের ব্যর্থতা। 

১৯৯৮ সালে তিনি শ্যামল সেন স্মৃতি পুরস্কার ও ২০০০ সালে দিশারী পুরস্কার অর্জন করেন। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে দমদম কেন্দ্র থেকে পুনরায় বিজয়ী হয়ে এখন রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। 




বিশেষ আলোচনা। 

ব্রাত্য বসুর নাটৈকব্রত
প্রভাত কুমার দাস


ব্রাত্য বসুর নাটক থেকে নাট্যে নতুন শতাব্দীর অন্তর্ঘাত; শম্পা ভট্টাচার্য; প্রথম প্রকাশ: ২০১৫, দীপ প্রকাশন - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ১০২; ISBN:


প্রথম দর্শনে বইটির কৃশ চেহারা দেখে কিছুটা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, বাংলা নাট্যক্ষেত্রে যাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন করার চেষ্টায় এটি লেখা—বোর্ডবাঁধাই সত্ত্বেও মাত্র একশো-দু পৃষ্ঠায় লেখকের পক্ষে তা সম্পন্ন করা সম্ভব কিনা! কেননা, পঞ্চাশ প্রাপ্ত হওয়ার আগেই তাঁর স্বীকৃতির পরিব্যাপ্তি আজ সুপ্রমাণিত—হিসেব মতো বাইশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম মঞ্চাবতরণের সূচনা ধরে, এখনো কালগত ভাবে পঁচিশ স্পর্শ করেনি। পাঁচ বছর পরে, যখন তিনি একই সঙ্গে নাটককার, নির্দেশক, অভিনেতার কাজ নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন—সেই সূচক সময় থেকে হিসেব করলে এখনো তাঁর মঞ্চ-সম্পৃক্তি পূর্বোক্ত তিনটি বৃত্তির দু-দশকও পূর্ণ হয়নি। ভণিতা ছেড়ে আসল প্রসঙ্গে এসে বইটির দীর্ঘ শিরোনাম উল্লেখ করি—ব্রাত্য বসু: নাটক থেকে নাট্যে নতুন শতাব্দী অন্তর্ঘাত, লিখেছেন শম্পা ভট্টাচার্য। পেশায় অধ্যাপক—কিন্তু অনেকদিন তিনি পত্র-পত্রিকায় মূলত নাট্য ও নাটক বিষয়ে প্রবন্ধাদি লিখে বহুতর চর্চায় নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। এছাড়াও, নাটক ও নাটককার প্রভৃতি অবলম্বন করে একাধিক গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। বোধ হয়, আলোচ্য বই, সংখ্যার হিসেবে তাঁর লেখা তৃতীয়। প্রজ্ঞার বিচারে নয়—বাঙালি সমাজে যেখানে প্রতিভার মূল্যায়ন করা হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বয়সের দিক থেকে কতটা প্রবীণ পঙ্‌ক্তিতে তিনি অন্তর্ভুক্ত সেই নিরিখে, সেখানে প্রৌঢ়তায় পৌঁছানোর আগেই এই অনুভূতি প্রশংসার্হ উদ্যোগ বলতেই হয়।

যে সংশয়ের কথা দিয়ে এই আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে—সেটা নিছক কথার কথা। কেননা শুধু পৃষ্ঠাঙ্কের পরিসর থেকে কোনো বইয়ের উৎকর্ষ বিচার করা বাতুলতা, তা সত্ত্বেও এই প্রসঙ্গ এল শুধু এইটুকু ভেবে—বহুদিন ধরে বাংলা মঞ্চে ব্রাত্যর প্রণোদনায় যে–সব কাজ সংঘটিত হয়েছে—কোনটিই নিছক নিয়মরক্ষা বা ছোট মাপের কাজ নয়। তাঁর প্রবর্তিত কোম্পানি থিয়েটার, ব্রাত্যজন নাট্যপত্র, প্রচার উদ্যোগের বহুমুখী আয়োজন, আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব, আলোচনা সভা, সম্মান সংবর্ধনা জ্ঞাপন, প্রকাশনা—এই সময়ের আর কোনো দল কিংবা অধিনায়ককে আয়োজন করতে দেখিনি। এসব কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেও—নাটক লেখা, নির্দেশনা বা নটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। আর, এসবের বাইরেও নিয়মিত যে-কাজটা তিনি করে যাচ্ছেন—বর্তমানে জীবিত বরিষ্ঠ নাট্যজনদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, অজস্র উপাদানে সমৃদ্ধ এইসব কথোপকথনগুলি ভবিষ্যকালের শিকড়-সন্ধানী গবেষকদের নিশ্চয় প্রভূত কাজে লাগবে। এ ধরনের কাজে লিপ্ত থাকলে, এমন নয় যে সেটা নাট্যক্ষেত্রে তাঁকে প্রভূত প্রতিষ্ঠা এনে দেবে—বোঝা যায় এসব কিছুর ভেতরে একটা গভীর আত্মতৃপ্তি লাভই একান্ত আকাঙ্ক্ষার।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই ব্রাত্য—লেখা অভিনয় ও পরিচালনা—এই তিনটি কাজ করে আসছেন। এবং পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছে তিনি তাঁর স্থিত উপলব্ধির কথায় তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি একেবারে ভেতর থেকে বুঝেছি এই তিনটে কাজ পুরোটা নিয়েই আমি—সাফল্য ও ব্যর্থতা সহ। তিনটে কাজই একেবারে সৃজনের গভীরে গিয়ে একাকার, অপৃথগ্‌যত্ননিবর্ত। ভালো-মন্দ, সাদা-কালো, পারা-না-পারা, সাফল্য ও ব্যর্থতা, মেঘ ও রৌদ্র সমেত। তবে এই তিনটে কাজই আমি করতে চাই, তাদের ভালোবাসতে চাই, তাদের থেকে কমবেশি প্রত্যাশার বা অপমান বা অবহেলা পেলেও তাদের আঁকড়ে ধরতে চাই। যতদিন পারি।'

এই ব্রাত্য বসুর আপাতত সামগ্রিক নাট্যচর্চা অবলম্বন করে কেন এই বই লিখলেন, সে বিষয়ে লেখক স্বয়ং খুব অল্প কথায় নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সারাংশ উল্লেখ করেছেন শুরুতে। কীভাবে আমাদের জীবনে দৈনন্দিনের এক একটা মুহূর্ত আগুনের আঁচ আর উত্তাপকে তাঁর নাটকের ভিতরে সঞ্চার করিয়ে দিতে পারেন তারই প্রমাণ প্রস্তুত করতে চেয়েছেন লেখক। সে-সব ঘটনার প্রতি আমাদের উদাসীনতা, ভয় কিংবা আর্তনাদ আমরা বুঝেও বুঝতে পারি না—ব্রাত্যর নাট্যে সেগুলিরই প্রত্যাবর্তন দেখে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে পারি। চক্ষুষ্মান হয়ে উঠি। শম্পা বলেছেন, ‘তাঁর লেখায় অবচেতনা, চেতনা, অধিচেতনা, কৃষ্ণবর্ণ পাতাল, রঙিন পৃথিবী, সুদূরের নীলিমা, ব্যক্তির সংকট, সভ্যতার স্বর্ণালী মুহূর্ত সব মিলেমিশে যাবে। তাঁর লেখা থেকে পাঠকরা অনেক সময় খুঁজে নিতে পারেন তাদের জীবনে সদৃশ কোনো গভীর মুহূর্ত, সেইটাকে ভেবে নিতে পারেন প্রধান বা একমাত্র। তাঁর নাটক পড়ে আমরা অন্তর্দীপ্ত হই’। এই মন্তব্যের দৃষ্টান্তে আমরা বুঝতে পারি—লেখক এখানে আলোচনাকে প্রতিষ্ঠা দিতে মূলত তাঁর নাটকগুলির মুদ্রিত পাঠ অনুসরণ করেছেন। এখন দেখতে হবে অধ্যায়ক্রমে তাঁর আর দুটি কাজের প্রসঙ্গ কীভাবে এসেছে, কিংবা আদৌ এসেছে কিনা!

চারটি অধ্যায়—প্রতিটিই কাব্যিক মেজাজে বেঁধে দেওয়া এক একটি নতুন শিরোনাম, তাঁর বিশ্লেষণকে একটা ভরকেন্দ্রে স্থাপন করেছে যেন। ‘রাত্রির পালক খসে খসে যায় দিগন্তের দিকে’—ব্রাত্যর নাটক যে ‘বহমান সময়ের যাত্রা বা চলা’—এক প্রকার জার্নি সেটা প্রতিপন্ন করার জন্য লেখক ব্রাত্যরই ভাষা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন: ‘একটি নাটক আসলে তাঁর পরে নাটকটির খসড়া। একটি বুনে তুলেছে আর একটিকে, সেও আসলে তারও পরেরটির মতোই অসম্পূর্ণ।' তাঁর নিজের কথা: ‘সারাজীবন আসলে আমি একটা নাটকই লিখে চলেছি’। প্রথমতম চেষ্টা রূপান্তরিত নাটক দিয়ে—ওরা পাঁচজন; কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যেই অশালীন লিখে যে নতুন যাত্রাপথে পা রেখেছিলেন, পরবর্তী পরিক্রমায় তা ক্রমশ স্পষ্টতা পেয়েছে। শালীন আর অশালীনের সীমারেখা ভেঙে দিয়ে—আসলে রক্ষণশীলতার অভ্যস্ত দুর্গে আঘাত হেনে নতুন এক বিষয় ভাবনার সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিলেন। ঠিকই, ‘একটা নতুন চিন্তা আর চেতনা প্রকাশিত হল এ নাটকে’। ১৯৯৬ থেকে ২০০১—এই পাঁচবছর, ব্রাত্য যে-সব নাটক লিখেছেন অশালীন; মুখোমুখি বসিবার; চতুষ্কোণ, শহর ইয়ার বিশেষত প্রথমোক্ত রচনা তিনটিতে নষ্ট দাম্পত্যের সংকট কীভাবে তীব্র হয়েছে তা বুঝতে চাওয়া হয়েছে। কীভাবে নাটকে ‘ব্যক্তির উথালপাতাল হৃদয়’ সম্পর্কের টানাপোড়েনে তীব্র আকুতি লাভ করেছে তা নিছক তাত্ত্বিকতার গালভরা যুক্তি সাজিয়ে বুঝতে যাওয়া উচিত নয়। ‘মানুষের মন ও মনন, চাওয়া ও পাওয়া সোজা সাপটা কথা চলে তার নাটকে’। কীভাবে, আলোচ্যগ্রন্থে লেখকের বক্তব্যে সেটা অন্যতম উপজীব্য হয়ে উঠেছে।

এই যে ব্যক্তি মানুষের যন্ত্রণা—অবক্ষয়িত সমাজ বদলের মধ্যে পড়ে, ক্ষতবিক্ষত হতে হতে মানুষ মনে মনে প্রশ্ন তৈরি করতে চায়—আপাতদৃষ্টিতে বাইরের থেকে হয়তো রাজনৈতিক নাটকের একটা আদল আছে—কিন্তু সেটাই এ নাটকের শেষ কথা নয়। ইতিহাসবোধের ভিতর থেকে তৈরি হওয়া এই যে সব্যসাচী সেন—একে কেবল কালের হিসেবে বিচার করা যায় না, চিরকালীন সত্য সন্ধানের পথে দেশকালসমাজের আবর্তনের প্রকৃত চেহারাটা স্পষ্ট করে দেয় যেন। শম্পার পর্যবেক্ষণ সঙ্গত: ‘কালোকে আলোর চেয়ে উজ্জ্বল বানিয়ে তত্ত্ব খাড়া করে মেলানোর কথা নেই এখানে। এই নাটকে পাঠক যেন নিজের মুখোমুখি বসার সুযোগ পায়। পাঠক শান্ত হয়ে নিজের দিকে, সমাজের দিকে ফিরে তাকাতে পারে অন্তত: একবার’। স্বয়ং ব্রাত্যও এটাকে যে কোনোমতে রাজনৈতিক থিয়েটার মনে করেন না—সে অভিমত যথার্থ। আসলে তাঁর নাটকের গভীরে লুকিয়ে থাকে যে নিরাপত্তাহীন অসহায়তা—সেটা নিছক রাজনৈতিক অসহায়তা নয়—বরং ‘মহাকাব্যিক অসহায়তা’ বললেই তার ব্যাপ্তি মহত্তর সংজ্ঞায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এক আশ্চর্য আত্মসমালোচনার পথেই ব্রাত্যর কলম থেকে তাই লেখা হয়েছে পেজ ফোর-এর মতো নাটক। সমকালীন সাংস্কৃতিক বাস্তবতার উপস্থাপনার জন্যই এই রচনা হয়ে উঠেছে ‘টক উইথ দ্য টাইম’। আলোচ্য অধ্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘একটা ঠিকঠাক প্রশ্ন করতে পারাটাও সমান জরুরী’। কিন্তু কাকে? হয়তো এ-নাটকের পাঠক, কিংবা এ-নাট্যের দর্শক—নিজেকে।

পরিসর ছোটো হলেও লেখক ব্রাত্য বসুর নাটক লেখার ধারাবাহিক পর্যায়—প্রায় এক–একটি নাটকের ক্রম অনুযায়ী আলোচনা করেছেন। পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত কিংবা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত নাটকের সংক্ষিপ্তসার, চরিত্রের পারস্পরিক অবস্থান—সমাজ-রাজনীতির প্রেক্ষিতের মধ্যে তাদের টানাপোড়েনের ধরন, যতদূর সম্ভব পাঠককে একটা নির্দেশ দিতে চেয়েছেন। এ-বইতে তাঁর লিখিত রূপটাই অনুসরণ করা হয়েছে—নাট্যের সামগ্রিকতার মধ্য দিয়ে নির্দেশক ব্রাত্য বসুর বিষয়ে খুব কিছু বলার চেষ্টা করেন নি। যদিও গত উনিশ বছর ধরে নাট্য বিষয়ক আলাপ আলোচনার পাশাপাশি তাঁর নাটক দেখেছেন ও পড়েছেন বলে জানিয়েছেন। তবে অস্বীকার করা যায় না সেই দুরূহ কাজে পূর্ব প্রস্তুতি ও নাটক দেখাকালীন গৃহীত নোট না রাখলে শুধু স্মৃতির উপর নির্ভর করে নাটক থেকে নাট্যে যাবার বিবরণ ঠিক ভাবে নিয়ে আসা যায় না। হয়তো গ্রন্থনামের সীমা শুধু নাটকের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নিলে এ প্রশ্ন উঠত না। তবে, স্বয়ং নাটককার—পত্রপত্রিকায়, গ্রন্থে নিজের রচনাকালীন সময় বিষয়ে এত উপাদান তৈরি করে দিয়ে চলেছেন—তাঁর বিষয়ে আগ্রহী গবেষক অনেক কিছুই সহজে পাবেন। শম্পা এই গ্রন্থে আলাপচারী ব্রাত্যর অনেক কথাই ব্যবহার করেছেন নিজের যুক্তি-প্রমাণকে যথাযথ করে তুলতে।

তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ের নাম যথাক্রমে: ‘তোমার মন কেন্দ্রবদ্ধ হোক তোমারই হারিয়ে যাওয়া মনে’ এবং ‘যে যার জীবনের ভেতর দিয়ে নিজের মতো করেই হেঁটে যায়’। যদিও নিজের নাটকে সচেতনভাবে কাব্যভাবনা প্রয়োগ করতে চান না বলেই ব্রাত্য বলেছেন—কিন্তু শম্পা যে বলেছেন: নাচ, গান, ছবি, কবিতা সকলের সম্মিলিত রূপ নাটক। তাই তাঁর নাটকে কবিতার ব্যবহার নাটকের দ্যোতনাকে প্রলম্বিত করতে সাহায্য করেছে বহুগুণ।’—এ প্রতিপাদ্যে সায় দিতে আমার অন্তত কোন আপত্তি নেই। বরং বিকেলে ভোরের সর্ষে ফুল-এর প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিধানযোগ্য মন্তব্য উদ্ধৃত করা যায়: ‘কখনও কবিতা থেকে সৃষ্টি হয় ব্রাত্যর নাটক। কবিতা সেখানে মশালচির দায়িত্ব পালন করে, কখনও চরিত্ররা কথা বলে কবিতার ভাষায় কেননা কবিতার দ্যোতনা সীমাহীন, আবার কখনো কবিতা ও নাটকের মুখোমুখি সংঘর্ষে জন্ম হয় তৃতীয় কোন মাত্রা’।

বিষয় ভাবনার দিক থেকে ব্রাত্য বসুর নাটকে একঘেয়ে হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না—এটা তাঁর সৃজনশীলতার একটা বড়ো জোর। নিজেকে ভেঙেই গড়ে তোলার এই চেষ্টাই তাঁকে অনবরত জীবন্ত থাকার পথ দেখিয়েছে। এই চলার পথেই দর্জিপাড়ার মর্জিনারা কিংবা হেমলেট দ্য প্রিন্স অফ গরানহাটা বাংলা মঞ্চে অভূতপূর্ব আবির্ভাব হিসেবে দেখা দিয়েছে। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় যে বলেছেন: ‘হেমলেট কোনো অর্থেই হ্যামলেট-এর রূপান্তর বা পুনর্নিমাণ নয়; কিন্তু যাঁরা হ্যামলেট পড়েছেন তাঁরা এই চকিত স্পর্শ বা প্রতিধ্বনির প্রসাদে অন্য একটা মাত্রা পেয়ে যান। কানের ভিতর দাঁড়িয়ে কালোত্তরে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা ব্রাত্য বসু তাঁর নাটকে বার বার প্রমাণ দিতে পেরেছেন। আর, সেটা বলা যায় না—শুধু একটি মাত্র নাটকই তাঁকে সেই যোগ্যতার স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। গ্রন্থকারের বিশ্লেষণ এ-বইয়ের পাঠককে এই বিশ্বাসের সামনে এনে দাঁড় করায়ঃ 'কৃষ্ণগহ্বর' শেষ হয় অংশুমানের বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তায়। এইভাবে “হেমলাটে” প্রোথিত হয় “কৃষ্ণগহ্বরে’র বীজ। ‘পেজ ফোরে’ রোপিত হয় ‘হেমলাটে’র মতো মহীরুহের চারা। একটি নাটক থেকে বেরিয়ে আসে আর একটি নাটক। একটি একক সূত্রবদ্ধতায় প্রোথিত হয়ে যায় সমস্ত নাটকগুলির অকৃত্রিম ধারাবাহিকতা”।

নতুন শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ব্রাত্য বসুর নাটক বাংলা মঞ্চে সাফল্যের বিচারে, অন্তত দর্শক সমাগমের পরিসংখ্যানে এখন শীর্ষস্থানে। কিন্তু রুদ্ধসংগীত তাঁকে যে খ্যাতি দিয়েছে—আজ ছ’বছর অতিক্রম করেও তা অবিচল আছে তো বটেই, পরপর আরো যে সব নাটক লিখেছেন তারও জনপ্রিয়তা কিছু কম নয়। এমন কি, যখন বিকেলে ভোরের সর্ষে ফুল; সুপারি কিলার-এর মতো নাটকে যখন কোনোভাবে নাট্যের সঙ্গে তাঁর সংযুক্তি নেই—তখনও। যখন অভিযোগ শোনা গেছে—বাংলা মঞ্চ নাটকের অভাবে রক্তাল্পতায় ভুগছে, কে না বলবে যে ব্রাত্য সেই অপবাদের বিপ্রতীপে সিনেমার মতো কিংবা কে? লিখে—ক্রমাগত তাঁর প্রতিষ্ঠার পক্ষে এক একটা অননুকরণীয় দৃষ্টান্ত পেরিয়ে যাচ্ছেন। তার উপরে প্রথমোক্ত নাট্যে অভিনেতা হিসেবে কৃতিত্বের প্রমাণ—তাঁর নির্দেশক সত্তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রায় সমান সমান।

‘ইতিহাস আর বর্তমানের মধ্যে সেতু বন্ধনের নাটক’ হিসেবে রুদ্ধসংগীত-এ ব্রাত্য জীবিতাবস্থায় কিংবদন্তি দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনকে কেন্দ্র করে একটা সময়কে তাঁর নিজের সময়ে এনে স্থাপন করেছেন। আবার সিনেমার মতো নাটক যে চমকপ্রদ বিনোদন করে নাটককে গড়ে দর্শক মনোরঞ্জনের নতুন পথ খুঁজতে চাওয়ায় নাটককারের আকাঙ্ক্ষাকে সীমাবদ্ধ করে রাখেনি—তিনি যে উত্তমকুমারের মতো মধ্যবিত্তের এক আইকনের প্রতি সশ্রদ্ধ নীরব অভিবাদন জানাতে এই নাট্যার্ঘ্য প্রস্তুত করেছেন—তা বাংলা সিনেমার একশো বছরের সময়ে দাঁড়িয়ে এক অত্যাশ্চর্য সৃজন হয়ে উঠেছে। শম্পা যে বলেছেন: ‘এ নাটকে ভাষার নিজস্ব একটা দীপ্তি আর গতি রয়েছে, তাঁর আকর্ষণ পাঠকের কাছে অপ্রতিরোধ্য’। একেবারে ঠিক।

এই আলোচনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে—কিন্তু সে-চেষ্টায় এখন বিরতি দিতে হচ্ছে। লেখক এ-বইয়ে নাটককার ব্রাত্যকেই প্রাধান্য দিয়েছেন—কিন্তু তাঁর নাট্যের ষোলটি রঙিন আলোকচিত্র ছেপে পাঠকের সামনে একটা আলাদা আকর্ষণ গড়ে দিয়েছেন। দু-পাতার একটি ভূমিকা লিখেছেন আর এক নির্দেশক-নট-নাটককার শেখর সমাদ্দার। অনেকের মতো তিনিও যে বুঝেছিলেন—‘ব্রাত্য হয়ে উঠবেন নব্বই-পরবর্তী বাংলা থিয়েটার ও বাংলা নাটকের সবচেয়ে সুউচ্চ চূড়াটির নাম। হ্যামলিনের বাঁশির ডাকে তাঁর আহ্বানে বয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের নতুন সময়ের বাংলা থিয়েটার’। এই মন্তব্যের যাথার্থ্য নিহিত আছে এ-বইয়ের চারটি অধ্যায়ে।

সবশেষে বলতে হয়—এ বইয়ে কিছু কিছু বক্তব্য স্পষ্ট করতে আরো একটু বিশদ বিশ্লেষণ দরকার ছিল। যেমন: ‘গত শতকের ষাটের দশক থেকে উৎপল দত্তের নাট্যরচনার পর থেকে এদেশের প্রথিতযশা দু’চারটি নাট্যগোষ্ঠী নাট্য রূপান্তরের দিকে ঝুঁকেছিলেন। তার বড় একটা কারণ ছিল সময়োপযোগী নাটকের প্রভাব’। তাই কি? প্রভাব না অভাব? এ বই, এ আলোচনা তৈরি করতে হয়তো আর একটু বেশি সময় দিতে পারলে ভালো হত—মুদ্রণ প্রমাদ এড়ানো অনেকটা সহজ হতে পারত। তাঁর কালানুক্রমিক নাটক লেখার তালিকা যদি পরিশিষ্ট হিসেবে যুক্ত থাকত—তাতে পাঠক, ব্রাত্যর ধারাবাহিকতা বোঝার অধিকন্তু তথ্য এক সঙ্গে পেতেন। যদিও উল্লেখ্য—লেখক প্রায় ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট নাটকের আলোচনায় প্রকাশকাল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রযোজনার সাল-তারিখও জানিয়েছেন। আমি নিশ্চিৎ, ব্রাত্য বাংলা নাটকের ইতিহাসে ইতিমধ্যে যে-স্থায়ী আসন অর্জন করেছেন—সেটি অবধারণ করার জন্য এ-বই কাজে লাগবে। সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা ভেবেই লেখক নিশ্চয় এর পরবর্তী সংস্করণের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত হবেন। আর, সে-সময় নিশ্চয় খেয়াল করবেন—প্রথম প্রচ্ছদে ‘ব্রাত্যবসুর’ জায়গায়, আখ্যা পত্রের ‘ব্রাত্য বসু:’ কোনটা শিরোনামে রাখবেন।

(পরবাস-৬০, অগস্ট ২০১৫)

==={==={{{{{========{{{{{{====={{{{{{{===

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...