"আমার মনের গহন বনে
পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী
নারী-অপ্সরী সঙ্গোপনে!
ফুলেরি ছায়ায় বসে তার দুই চরণ মেলি
বিজন-নিভৃতে মাথা হতে দেয় ঘোমটা ফেলি,
শুধু একবার হেসে চায় কভু
নয়ন কোণে,
আমারি মনের গহন বনে।"
বিংশ শতাব্দীর এক জন বিখ্যাত বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক এবং সাহিত্য সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। কাব্যচর্চা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও পরে সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, নিপুণ বিশ্লেষণ ও ভাবগম্ভীর ভাষার মহিমায় মোহিতলালের সমালোচনাধর্মী গ্রন্থগুলো ধ্রুপদী সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। শিল্প-সাহিত্যের নানা সমস্যা আলোচনায় তাঁর ছিল নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, মতবাদ। ফলে কবি ও প্রবন্ধকাররূপে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জুলাই তিনি প্রয়াত হন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, মোহিতলাল মজুমদার ১৮৮৮ সালের ২৬ অক্টোবর নদীয়ার কাচঁড়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
মোহিতলাল মজুমদার (জন্ম : ২৬ অক্টোবর, ১৮৮৮ – মৃত্যু : ২৬ জুলাই, ১৯৫২) প্রথম জীবনে কবিতা লিখলেও পরবর্তী জীবনে সাহিত্যসমালোচক হিসেবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মোহিতলাল মজুমদারের পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত বলাগড় গ্রাম। তাঁর বাবার নাম নন্দলাল মজুমদার। নন্দলাল ছিলেন কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের জ্ঞাতি ভাই। মোহিতলালের কৈশোর এবং বিদ্যালয়জীবন বলাগড় গ্রামেই অতিবাহিত হয়।ছোটবেলায় তিনি কিছু দিন চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার কাছে হালিশহরে মায়ের মামাবাড়িতে অবস্থান করে সেখানকার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। মোহিতলাল চার-পাঁচ বছর বয়সে কাশীরাম দাসের মহাভারতের সঙ্গে পরিচিত হন। নয় বছর বয়সে তাঁর রোমান্স পাঠে আগ্রহ জন্মায়। বারো – তেরো বছর বয়সেই পলাশীর যুদ্ধ এবং মেঘনাদ বধ কাব্য পড়ে শেষ করেন। তিনি বলাগড় বিদ্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯০৮ সালে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ পাস করেন। কিন্তু অসুবিধায় পড়ে এম.এ পড়া ছেড়ে দেন। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার তালতলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯১৪ সালে সরকারি জরিপ বিভাগে কানুনগো পদে চাকরি গ্রহণ করেন। তিন বছর তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পুনরায় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা কর্মে নিয়োজিত থাকেন। ১৯৪৪ সালে অধ্যাপনার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন মোহিতলাল।তারপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। পরে বঙ্গবাসী কলেজে গিরিশ সংস্কৃতি ভবনে অধ্যাপনায় যোগ দেন।
মোহিতলাল মজুমদারের সাহিত্যচর্চার শুরু ‘মানসী’ পত্রিকার মাধ্যমে। পরে ভারতী ও শনিবারের চিঠিসহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়ও তিনি নিয়মিত লিখতেন। বীরভূমি পত্রিকায় কবিতা প্রবন্ধ অনুবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম দিকের কবিতায় স্বপ্নবিহবল তরুণ মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বেদনা মনোরম ছন্দে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির পশ্চাতে নিজস্ব কাব্যাদর্শ, সৌন্দর্যবোধ ও আধ্যাত্মিক মতবাদ ক্রিয়াশীল ছিল। অবশ্য এই আধ্যাত্মিক মতবাদটি খুব স্পষ্ট নয় বৈষ্ণবতত্ত্বের সঙ্গে বেদান্তের একটা সমন্বয়ের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। ভাবসাধনার দিক থেকে মোহিতলাল ভোগসর্বস্ব দেহবাদী কবি।
দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে তাঁর কাব্যচর্চায় দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব দেখা যায়। এ ছাড়াও, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যাযের় কবিতার ছন্দোমাধুর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। মোহিতলাল কিছু কাল ভারতী গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক ছিলেন। তিনি শনিচক্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্র পরবর্তী কাব্যে কবি মোহিতলালের স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য সমালোচক হিসাবেও তাঁর সবিশেষ খ্যাতি ছিল। ভাষারীতির বিশুদ্ধতা নিয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ ও নিষ্ঠা ছিল। শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলি দেখানোর ক্ষেত্রে তাঁর একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাঁর মননধর্মিতা এবং কবিসুলভ ভাবাত্মক বিচারবোধ সমালোচনা সাহিত্যকে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলিতে ‘কৃত্তিবাস ওঝা’, ‘সব্যসাচী’, ‘শ্রী সত্যসুন্দর দাস’ ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।
বাংলা কাব্যে বিদেশী শব্দ, বিশেষ করে আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগে মোহিতলালের বিশেষ কৃতিত্ব ছিল। তিনি ইংরেজি সাহিত্যেও সুপন্ডিত ছিলেন। বাংলা ছন্দ ও অলঙ্কার বিষয়ে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। মোহিতলাল রবীন্দ্রকাব্যের একজন রসজ্ঞ ও মর্মজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তবে পরবর্তীতে শনিবারের চিঠির দলে যোগ দিয়ে তিনি রবীন্দ্রবিরোধী হয়ে ওঠেন। কাব্য বিচারে তিনি পঞ্চাশ-উত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখেননি। তিনি বঙ্গ সাহিত্য-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ আসনে মাইকেল ও বঙ্কিমচন্দ্রকে বসানোর চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই এই বিতর্কিত সাহিত্যপ্রতিভার কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বঙ্গসাহিত্য প্রসঙ্গে মোহিতলাল সৃজনধর্মী ও সৃষ্টিশীল আলোচনা করে গেছেন.
ভারতী’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র অনুসারী যে কবি সমাজ রাবীন্দ্রিক রোমান্টিক মোহ মদির পরিবেশে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন, মোহিতলাল সেই বলয়ে প্রবেশ না করে নতুন কালের বাস্তবতার জয়ধ্বজা ওড়ালেন- যা ত্রিশের দশকে প্রকাশিত ‘কল্লোল’ পত্রিকার কাব্যাদর্শকে অনেকক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কল্লোলপন্থীদের দেহকেন্দ্রিক প্রেম ভাবনার অনুপ্রেরণা মহিতলালই। ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত মোহিতলালকে তাই ‘আধুনিকোত্তম’ বলেছেন। ‘কবিতা’ পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘আমাদের তরুণ বয়সে যখন রবিদ্রোহিতার প্রয়োজনীয় ধাপটি আমরা পার হচ্ছিলাম তখন যে দু’জন কবিকে আমরা তখনকার মতো গত্যন্তর খুঁজে পেয়েছিলাম, তাঁদের একজন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আর একজন ‘বিস্মরণী’-র মোহিতলাল। কিন্তু বাংলা কাব্যে দেহবাদের প্রবক্তা হয়েও মোহিতলাল কিন্তু যাযাবরী উদ্দামতাকে প্রশ্রয় দেননি। তাই ‘কল্লোল’-এর কবিদের কাছে ‘দ্রোণাচার্য’ হয়েও তার সঙ্গে মোহিতলালের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কল্লোল গোষ্ঠীর তীব্র নিরাশা আর আদিমতার আসক্তিতে তিনি ছিলেন নিঃস্পৃহ। কল্লোলীয়দের সঙ্গে মোহিতলালের এই ছিল প্রাথমিক পার্থক্য। মোহিতলালের বিদগ্ধ কবি-মানসে শেষ পর্যন্ত ‘কাম’ দেহকে আশ্রয় করে সার্থক হয়ে উঠেছে। কিন্তু কল্লোলীয়দের কামের জন্যই দেহে, অথচ সেই সম্ভোগের মধ্যে নেই কোন আধ্যাত্মিক তৃপ্তি। এমিল জোলার Naturalism, লরেন্সের সেক্স ও ঈডিপাস তত্ত্ব, লেডি চ্যাটার্লির সন্সকার-মুক্তি, ক্লুট হামসুনের ‘ক্ষুধা’ ইত্যাদি সব কিছুই তাঁর কাছে ভোগ্য ও আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু মোহিতলাল দেহের সৌন্দর্য-ধ্যানেই শেষ পর্যন্ত তন্ময় হয়ে ভালোবাসার মহিমা উপলব্ধি করেছেন, “আমার দেবতা সুন্দর সে যে, পূজা নয়-ভালোবাসি।” মানুষের মাঝে দেবতার, দেহের মাঝে আত্মার স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতার ভাববৃত্ত পূর্ণ হয়েছে। কবিতার ভাবানুসঙ্গ ও রূপনির্মিতিতে মোহিতলাল ক্ল্যাসিকপন্থী। তাঁর কবিতায় বলিষ্ঠ ভাবচেতনা ভাস্করের কারুকার্যে সুগঠিত। হয়ত অনেক সময় ভাবাবেগের প্রাবল্য আছে, কিন্তু তা দৃঢ়তায় পূর্ণ, কবিতার আঙ্গিকের সঙ্গে সামঞ্জস্যময়। খেয়ালী কল্পনা ও লঘু ভাবনার অবসর সেখানে নেই। মননের দীপ্ত বিলাসে, আত্মকেন্দ্রিক আভিজাত্য এবং ব্যক্তি চেতনার সজাগ অভিমান কবি মহিতলাল আজও রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে যেন এক নিঃসঙ্গ দৃষ্টান্ত।
মৌলিক গ্রন্থ, সমালোচনা ও সম্পাদিত গ্রন্থ মিলিয়ে মোহিতলাল মজুমদারের প্রকাশিত গ্রন্থ অনেক। কবি মোহিতলালের জীবনকাল ১৮৮৮ থেকে ১৯৫২। প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘দেবেন্দ্রমঙ্গল’ ১৬টি সনেট নিয়ে প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রি.। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ছন্দচতুর্দশী’ ৫৪টি সনেট নিয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রি.। এই কালসীমার মধ্যে রচিত তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল-ক) কাব্যগ্রন্থ- ১) দেবেন্দ্র-মঙ্গল (১৯২২) ২) স্বপন-পসারী (১৯২২) ৩) বিস্মরণী (১৯২৭) ৪) স্মরগরল (১৯৩৬) ৫) হেমন্ত-গোধূলি (১৯৪১) ৬) ছন্দ চতুর্দশী (১৯৪১) (সনেট সঙ্কলন) ৭) কাব্য মঞ্জুষা তন্মধ্যে – ‘দেবেন্দ্র-মঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থটি ছিল আত্মীয় ও কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রশস্তিমূলক ১৬টি সনেটের সঙ্কলন। খ) প্রবন্ধগ্রন্থ- ১) আধুনিক বাংলা সাহিত্য (১৯৩৬) ২) সাহিত্যকথা (১৯৩৮) ৩) বিবিধ কথা (১৯৪১) ৪) বিচিত্র কথা (১৯৪১) ৫) সাহিত্য বিতান (১৯৪২) ৬) বাঙলা কবিতার ছন্দ (১৯৪৫) ৭) বাঙলার নবযুগ (১৯৪৫) ৮) জয়তু নেতাজী (১৯৪৬) ৯) কবি শ্রীমধুসূদন (১৯৪৭) ১০) সাহিত্য বিচার (১৯৪৭) ১১) বঙ্কিমবরণ (১৯৪৯) ১২) রবি-প্রদক্ষিণ (১৯৪৯) ১৩) শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র (১৯৫০) ১৪) জীবন জিজ্ঞাসা (১৯৫১) ১৪) বাঙলা ও বাঙালী (১৯৫১) ১৫) কবি রবীন্দ্র ও রবীন্দ্র কাব্য (প্রথম খণ্ড ১৯৫২, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৫৩) ১৬) বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস (১৯৫৫)। বঙ্গদর্শন পত্রিকা তৃতীয় পর্যায়ে মোহিতলালের সম্পাদনায়ই প্রকাশিত হয়।
তাঁর কাব্যে প্রেমপরিবেশে তাই ফুল, মালা, স্রগ্ধ-চন্দন ইত্যাদি অনিবার্যভাবে স্থান নিয়েছে। ‘তিমির তীর্থে’ পথিক কবি ‘দেহ’-কে ক্ল্যাসিক কবির মতোই মন্দির বলেছেন এবং প্রেমকেও ক্ল্যাসিকাল পূজার মনোবৃত্তিতেই দেহোপাসনা বলেছেন বারংবার। বলা বাহুল্য এইখানেই শিল্পী হিসেবে সমকালীন কবিদের তুলনায় মোহিতলালের এতখানি স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা। তাঁর কাব্যে ক্লাসিক্যাল ভঙ্গি এবং রোমান্টিক ভাবের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর মানস-লক্ষ্মী কবিতার প্রথম কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপ -
“আমার মনের গহন বনে
পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী
নারী-অপ্সরী সঙ্গোপনে!
ফুলেরি ছায়ায় বসে তার দুই চরণ মেলি
বিজন-নিভৃতে মাথা হতে দেয় ঘোমটা ফেলি,
শুধু একবার হেসে চায় কভু
নয়ন কোণে,
আমারি মনের গহন বনে। ”
মোহিতলাল নারীর মোহিনীরূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন-
“সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি মিথ্যা সনাতনী
সত্যেরে চাহিনা তবু সুন্দরের করি আরাধনা”
সমালোচকগণ বলছেন, মোহিতলালের মানসলক্ষ্মী কোন বিদেহী রোমান্টিক সৌন্দর্যে প্রবর্তনা না হয়ে ‘স্পর্শরসিক’ কবির স্পর্শ বন্ধনেই ধরা পরবে-কবির এরকম আকাঙ্ক্ষাতেই রবীন্দ্রনাথের মানসসুন্দরী ও মোহিতলালের মানসলক্ষ্মী দুই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যলোকবাসিনী হয়ে উঠেছে। এখানেই ভোগবাদী মোহিতলালের ইন্দ্রীয়ময় দেহসৌন্দর্যবাদের বৈশিষ্ট্য। দুরন্ত দেহবাসনার উত্তাল তরঙ্গেই প্রেয়সী নারীর সৌন্দর্যসম্মোহন উপভোগ করেছেন মোহিতলালঃ-
‘সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি মিথ্যা সনাতনী
তবুও তার আকর্ষণ কবির কাছে দুর্বার; কেননা,
কটাক্ষ ঈক্ষণ তার হৃদয়ের বিশল্যকরণী;
স্বপনের মনিহারে হেরি তার সীমন্ত রচনা
নিপুণা নটিনী নাচে, অঙ্গে অঙ্গে অপূর্ব লাবণি
স্বর্ণপাত্রে সুধারস, না সে বিষ? কে করে শোচনা
পান করি সুনির্ভয়ে, মুচকিয়া হাসে যবে ললিতলোচনা।’
নব্যতান্ত্রিক মোহিতলালের জীবনের আদর্শ তাই নীলকণ্ঠ, রবীন্দ্রনাথের মতো নটরাজ নয় এবং ‘স্বপনপসারী’র ‘পাপ’কবিতায় তিনি লিখেছেনঃ-
‘ত্যাগ নহে, ভগ,-ভোগ তারি লাগি, যেই জন বলীয়ান।
নিঃশেষে ভরি’ লইবারে পারে এত বড় যার প্রাণ!
যে জন নিঃস্ব, পঞ্জরতলে নাই যার প্রাণধন
জীবনের এই উৎসবে তার হয়নি নিমন্ত্রণ!’
‘স্মরগরল’ কাব্যের নাম কবিতায় প্রথমেই লিখেছেনঃ
‘আমি মদনের রচিনু দেউল-দেহের দেউল ‘পরে
পঞ্চশরের প্রিয় পাঁচ-ফুল সাজাইনু থরে থরে।
দুয়ারে প্রাণের পূর্ণকুম্ভ-
পল্লবে তার অধীর চুম্ব,
রূপের আবীরে স্বস্তিক তায় আঁকিনু যতন ভরে।’
এইজন্যই কবি মোহিতলালের কাছে নারীসৌন্দর্য তার ‘জায়া’ রূপের মধ্য দিয়েই উপভগ্য।
‘তাই আমি রমণীয় জায়ারূপ করি উপাসনা।’
রবীন্দ্রনাথের ‘রাতে ও প্রভাতে’ কবিতায় দুই ভিন্নরূপে রমণীর জায়ারূপ এবং কল্যাণসুন্দর গৃহিণীরূপকে আলাদা করে দেখেছেন। কিন্তু মোহিতলাল দেখেছেন-
‘বধূ ও জননী পিপাসা মিটায় দ্বিধাহারা
রাধা ও ম্যাডোনা একাকারা।’
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে বলা হতো চলমান বিশ্বকোষ। অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতি এই সবগুলো বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দেয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠসমূহের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অনেকেই একবাক্যে তাঁর মেধা এবং ধী-শক্তির অন্যন্যতা স্বীকার করেছেন। এই নিভৃতচারী, অনাড়ম্বর জ্ঞানসাধক মানুষটি সারাজীবন কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। তিনি ব্যক্তি মানুষটি কেমন মুষ্টিমেয় অনুরাগীর বাইরে অনেকেরই ধারণা নেই। এই অনুরাগীদের একজন আহমদ ছফা। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ছাত্র। দীর্ঘ মেলামেশার ফলে প্রফেসর রাজ্জাককে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার দুলর্ভ সুযোগ হয়েছে তাঁর। আর সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই ছফা লিখেছেন 'যদ্যপি আমার গুরু'। অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে খোলামেলা, তীক্ষ্ম, গভীর এবং সরস গ্রন্থ। আহমদ ছফা'র সাথে আলাপচারিতায় নানা বিষয় নিয়ে বলেছেন প্রফেসর রাজ্জাক। আহমদ ছফা প্রাণবন্ত ভাষায় সেগুলো উল্লেখ করেছেন 'যদ্যপি আমার গুরু'তে। আমার প্রিয় বই এটি। তাদের আলাপচারিতার মোহিতলালের প্রসঙ্গটি পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই। আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘কবি জসীমুদ্দীনের প্রসঙ্গ ধরে কবি মোহিতলালের কথা উঠলো। মোহিতলাল মজুমদার পূর্ববাংলার উচ্চারণরীতি বরদাশত করতে পারতেন না। কবি জসীমুদ্দীনের একটা কবিতার বইয়ের নাম ছিল ধান খেত। মোহিতবাবু ব্যঙ্গ করে বলতেন জসীমুদ্দীন ধান খেতো। মোহিতলালের জিভের মধ্যে বিষ আছিল। তাঁর ঠাট্টা রসিকতা এমনভাবে ছড়াইয়া পড়ল জসীমুদ্দীন বেচারার জান যাওনের দশা। একদিন আমি মোহিতবাবুরে চ্যালেঞ্জ কইরা বইলাম। কইলাম, আপনে জসীমুদ্দীনরে এত ঠাট্টা করেন ক্যান্। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যদি জসীমুদ্দীনের উপর এক অধ্যায় লেখা অয়, আপনেরে নিয়া লেখব মাত্র চাইর লাইন।’
===={{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆¶¶¶}}}}}}}}}}}======
No comments:
Post a Comment