Tuesday, 23 November 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী (বাণীকুমার) ২৩.১১.২০২১. Vol -565. The blogger in literature e-magazine


বাণীকুমার

১৩৬১ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ কবিগুরুর জন্মদিনে বাণীকুমার একটি স্বরচিত কবিতার মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কবিতাটির কয়েক পংক্তি –


“একদা এ বৈশাখের পরম লগ

শ্যামা বঙ্গ জননীর শোভন ভবনে চিরজীবী শিশু এক উঠিলেন জাগি

বিধাতার জ্যোতিঃ রেখা শুভ বর মা

শোভমানা ললাটিকা তিনি শিশু রবি

*    *    *    *    

বিকশিল শোভা তার রস-সৃষ্টি-লোকে

মাধুরীর ধ্যানে-স্তবে অসীম-পুলকে

অন্তহীন আয়োজন জীবন ভরিয়া 

চির যৌবনের লীলা সুধা উন্মথিয়া

হে চিরজীবিত কবি – হে চিরজীব

চিত্ত বন্দ্যনীয় নমি হে চিরনূতন ।।”



পিতৃদত্ত নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ নভেম্বর হাওড়ার কানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ বিধুভূষণ ভট্টাচার্য এবং মা অপর্ণা ভট্টাচার্য। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন বাণীকুমার। তাঁদের আদি নিবাস ছিল হুগলির আঁটপুরে।


বাণীকুমার হাওড়া জেলা বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। সেখানে শিক্ষক তথা কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে কাবিরচনায় তিনি মনোনিবেশ করেন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ইংরেজিতে স্নাতক হন। তাঁর পিতা ও পিতামহের সংস্কৃতে জ্ঞান থাকায় তিনিও সংস্কৃত বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং ‘কাব্যসরস্বতী’ উপাধি পান।বাণীকুমার (বেতারকেন্দ্রের ছদ্মনাম) ‘বৈ.না.ভ.’ , ‘আনন্দবর্ধন’, ‘বিষ্ণু-গুপ্ত’ সাহিত্যক্ষেত্রের ছদ্মনাম।


সাংসারিক চাপে পড়াশোনা বেশিদূর না করতে পারায় তিনি টাঁকশালে চাকরি করা শুরু করেন। স্মৃষ্টিশীল মননের অধিকারী হওয়ায় ১৯২৭খ্রিস্টাব্দে ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কলকাতা বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হলে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেতারকেন্দ্রে যোগ দেন। তৎকালীন সময়ে বেতারকেন্দ্রের ভারতীয় অনুষ্ঠান বিভাগের অধিকর্তা নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের আগ্রহে বেতারকেন্দ্র যোগদান করেন রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রমুখ শিল্পী। সেখানেই রাইটার স্টাফ আর্টিস্ট হয়ে বৈদ্যনাথ কাজে যোগদান করেন এবং ‘বাণীকুমার’ নামে তাঁর বেতার জীবন শুরু করেন।

মহিষাসুরমর্দিনী বেতার অনুষ্ঠানের রচয়িতা হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত। 

তাঁর রচিত কবিতা : 

  চিত্রলেখা

বিদুষী

জাগৃহী

মরু-মায়া ইত্যাদি।

 চলচ্চিত্রের সঙ্গীতকার

রাজপুত্রনাটকে এবং

 ‘ভাগ্যচক্র’, 

‘দেনা-পাওনা’, ‘

রূপলেখা’ ও ‘

দেবদাস’ ছবিতে বাণীকুমার রচিত গান গাওয়া হয়েছে। 

গ্রন্থ

 ‘সন্তান’,

 ‘সপ্তর্ষি’, ‘

গীতবল্লকী’, ‘

কথা-কথালি’

 ‘মহিষাসুরমর্দিনী’,

 ‘রায়বাঘিনী’, 

‘হাওড়া হুগলীর ইতিহাস’, ‘

স্বরলিপিকা’ (২ খন্ড) ইত্যাদি।


 তিনি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ওমর খৈয়াম’-এর বেতার নাট্যরূপ রচনা করেছিলেন।

ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি বেতার সম্প্রচারক, গীতিকার, প্রযোজক ও নাট্য পরিচালক। তিনি কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন। পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সমসাময়িক বাণীকুমার ১৯৩০-এর দশক থেকে সুদীর্ঘকাল অল ইন্ডিয়া রেডিওয় বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।


মৃত্যু - ১৫ আগস্ট ১৯৭৮ (বয়স ৭০) কলকাতা।


আলোচনা। 


বাণীকুমার ও  মহিষাসুরমর্দিনী : 



সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই টেলিভিশন বিভিন্ন বাড়িতে স্থান পেতে শুরু করে; এখন এ যন্ত্রটি নেই এরকম বাড়ি খুঁজে পাওয়া শক্ত। যদিও তার আগে এক সময়ে রেডিওই ছিল খবর ও অন্যান্য অনুষ্ঠান সম্প্রচারের একমাত্র মাধ্যম, এখন সে দায়িত্ব পালন করছে টেলিভিশন। কোন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যের উপস্থিতি দর্শকমনকে আকৃষ্ট করে অনেক বেশি; সেজন্যই রেডিওর জৌলুষ এখন অনেকটাই স্তিমিত। হয়ত এর একমাত্র ব্যতিক্রম মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। টেলিভিশনের চেয়ে আকাশবাণীর এই অনুষ্ঠানটি এখনও লোকের কাছে অনেক বেশি প্রিয়। অনুষ্ঠানের শুরুটি -


মহিষাসুরমর্দিনী। রচনা ও প্রবর্তনা – বাণীকুমার। সঙ্গীত-সর্জন – পঙ্কজকুমার মল্লিক। গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।


“আজ দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে জ্যোতির্ম্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-বার্ত্তা আকাশ-বাতাসে বিঘোষিত। মহাদেবীর পুণ্য স্তবনমন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব্ব প্রেরণা। আজ শারদ গগনে-গগনে দেবী ঊষা ঘোষণা করছেন মহাশক্তির শুভ আবির্ভাব-ক্ষণ।”

এরপর তিনবার শঙ্খধ্বনির পর শুরু হয় অনুষ্ঠান। সুপ্রীতি ঘোষের পরিশীলিত কন্ঠে গাওয়া সেই গান – “বাজল তোমার আলোর বেণু”।     


 সাধারণ মানুষের কাছে পঙ্কজকুমার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যেভাবে এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, সেই তুলনাতে একটু হয়তো আড়ালেই থেকে গেছেন বাণীকুমার। অথচ মূল অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও রচনা বাণীকুমারেরই। উপরোক্ত গানটির রচয়িতাও বাণীকুমার।


    ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে প্রথম প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানটি, কিন্তু তখন এর নাম ছিল ‘শারদ বন্দনা’। ১৯৩৪-এর ৮ ই অক্টোবর ( ১৩৪১ বঙ্গাব্দ ) মহালয়ার সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রচারিত হয়েছিল অনুষ্ঠানটি। কিন্তু এটি ঘিরে তীব্র আপত্তি ওঠে – ধর্মকে যারা চিরদিন বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়, সেই রক্ষণশীল দলের পক্ষ থেকে। প্রতিবাদের মূল কারণ ছিল – এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শোনা যাবে ? রুখে দাঁড়ালেন বাণীকুমার। গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণই করবেন এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। অন্য একটি আপত্তি ছিল মহালয়ার সকালে পিতৃতর্পণের আগেই কেন চণ্ডীপাঠ হবে ? এ কারণেই ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটি ষষ্ঠীর ভোরে প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু পরিশেষে বাণীকুমারের সিদ্ধান্ত মেনেই ১৯৩৭ সাল থেকেই মহালয়ার ভোরে প্রচারিত হয় – ‘মহিষাসুরমর্দিনী। ’



অনুষ্ঠানটি সফল ও আকর্ষণীয় করে তুলতে বাণীকুমারের সঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম অবশ্যই স্মরণীয়; বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণীকুমার ছিলেন একই বৃন্তের তিনটি ফুল। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ গীতি আলেখ্যটি পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধে বাণীকুমার নিজেই লিখেছেন –“


“মহিষাসুরমর্দিনী” আমার প্রথম যৌবনের রচনা। কিন্তু মূল রূপটির বিশেষ পরিবর্তন না ঘটলেও এই গ্রন্থের বর্তমান রূপ বহুতর তথ্য ভাবগর্ভ বিষয় এবং বেদ-পুরাণাদি-বিধৃত শ্লোকাবলী সংযোজনায় সমলংকৃত। প্রকৃতপক্ষে এই গ্রন্থ মার্কন্ডেয় সপ্তশতী চন্ডীর সংক্ষিপ্তসার বললেও অত্যুক্তি হয় না, তদুপরি এর মধ্যে আছে মহাশক্তি-সম্বন্ধে বৈদিক ও তান্ত্রিক তত্ত্বের ব্যঞ্জনা, এবং এর অন্তরে নিহিত রয়েছে শাশ্বত ভারতের মর্মকথা। ......”  

মাত্র একবারই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রচার বন্ধ হয়েছিল। দেশে জরুরী অবস্থা থাকাকালীন ১৯৭৬-এর ২৩ শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে সরিয়ে ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’ নাম দিয়ে এক বিকল্প অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। রূপদান করেছিলেন অভিনেতা উত্তমকুমার, সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর প্রভৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ স্থানচ্যুত হওয়ায় জনরোষ ফেটে পড়ে। পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বরাবরই ভোর হবার আগে রাত্রিবেলাতেই বেতারকেন্দ্রে চলে আসতেন এবং ‘মহিষাসুরমর্দিনী ’ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থেকে তারপরে যেতেন। টেপ রেকর্ডারে অনুষ্ঠান চললেও এ অভ্যাস তিনি চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ১৯৭৬ সালের পর থেকে তিনি আর কখনও রাত্রি বেলা যেতেন না। এই জরুরী অবস্থার সময়েই অপসারিত হন পঙ্কজকুমার মল্লিক ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ থেকে। অবশ্য জনসাধারণের চাহিদাকে মর্যাদা দিতে সেবছর ষষ্ঠীর দিন সম্প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ আর ১৯৭৭ থেকে স্বমহিমায় মহালয়ার ভোরে ফিরে আসে ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি রচনা ও তরঙ্গায়িত করে বাণীকুমার যে আসাধারণ কাজটি করেছিলেন তৎকালীন স্টেশন ডিরেক্টর দিলীপকুমার সেনগুপ্ত সে প্রসঙ্গে বলেছেন – –


“বাণীকুমার যদি আর কোনো কাজ নাও করতেন, তাহলেও শুধু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র জন্যই মানুষ তাকে মনে রাখত। ...... শাজাহান যেমন তাজমহল গড়েছিলেন, যা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের একটা হয়ে আছে, আমাদের বাণীদা হাওয়ায় তাজমহল গড়ে গেলেন, যা মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

এছাড়াও বেতারের প্রচারের আর তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, সেটা আমাদের জানা দরকার। তবে সেটা বলার আগে বাণীকুমারের পরিচয়টা একটু জেনে নেওয়া যাক।  


বাণীকুমারের আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। জন্ম ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে নভেম্বর। পিতা সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত ও ঐতিহাসিক বিধুভূষণ ভট্টাচার্য ও মাতা অপর্ণা ভট্টাচার্য। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। আদি নিবাস ছিল হুগলী জেলার আঁটপুর কিন্তু পরে হাওড়ায় এসেই বসবাস শুরু করেন। বৈদ্যনাথ ছিলেন হাওড়া জেলা স্কুলের ছাত্র। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। পিতা পিতামহ সকলেরই সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি ছিল এবং সম্ভবতঃ সেই কারণেই বৈদ্যনাথও সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করে ‘কাব্যসরস্বতী’ উপাধি পান। এটা পরে তার কর্মজীবনে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। সংস্কৃত পঠন উপলক্ষেই বৈদ্যনাথ বাগবাজারে পন্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর সংস্পর্শে আসেন। ইচ্ছা থাকলেও সংসারের চাপে পড়াশোনা আর বেশীদূর এগোয় নি; টাঁকশালে চাকরি নিলেন বৈদ্যনাথ।


     ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে আগস্ট বোম্বাই-এর (এখন মুম্বই) ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নামে একটি বেসরকারি সংস্থা ডালহৌসির ১নং গার্স্টিন প্লেসে একটি ভাড়া বাড়িতে রেডিও স্টেশন স্থাপন করে। সংস্থার অধিকর্তা ছিলেন স্টেপলটন সাহেব; ভারতীয় অনুষ্ঠানের তত্বাবধায়ক ছিলেন ক্ল্যারিনেট বাদক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার, সহকারী প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল। সে সময়ে রেডিওর অনুষ্ঠান শুনতে হত কানে হেডফোন লাগিয়ে। একসঙ্গে একজনই অনুষ্ঠান শুনতে পেতেন, একসঙ্গে শোনার সুযোগ ছিল না। মুষ্টিমেয় কিছু অভিজাত ও ধনী ব্যক্তির বাড়িতেই এই বিলাস দ্রব্যটি শোভা পেত। ১৯২৮ সালে ২১ বছর বয়সে বৈদ্যনাথ টাঁকশালের স্থায়ী চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’তে রাইটার স্টাফ আর্টিস্ট ( writer staff artist ) হয়ে কাজে যোগদান করেন – নাম গ্রহণ করেন ‘বাণীকুমার’। সৃষ্টিধর্মী মন নিয়ে টাঁকশালের কলম পেশা চাকরি তার বেশি দিন ভাল লাগে নি। সেটাই স্বাভাবিক। ১৯৩৬-এ প্রচার সংস্থার নাম হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ , ‘আকাশবাণী’ নাম হয় ১৯৫৭ সালে এবং ১৯৫৮-এর সেপ্টেম্বর মাসে রেডিও স্টেশন ‘আকাশবাণী ভবন’-এ স্থানান্তরিত হয়।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মতে –


“বাণীকুমার স্বল্পদৈর্ঘের সহস্রাধিক অনুষ্ঠান রচনা করে গেছেন। ‘কাব্যসরস্বতী’ বাণীকুমারের সংস্কৃতে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল বলেই তিনি সংস্কৃতে রচিত বহু কাহিনী, স্তোত্র, দেবীবন্দনার সার্থক রূপদান করতে পেরেছেন। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তার বহু অনুষ্ঠান বাঙালীর দরবারে পৌঁছে দেবার এই প্রচেষ্টা সশ্রদ্ধ প্রশংসার দাবী রাখে। অশোকনাথ শাস্ত্রীর অনুরোধে তিনি ‘আনন্দমঠে’র নাট্যরূপ দান করেন; ‘সন্তান’ নামে তার সেই নাটক শ্রোতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ”


যিনি সমস্ত জীবন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিষ্ঠার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ শ্রোতার কাছে নানা বিষয়ে বহু বৈচিত্রপূর্ণ অনুষ্ঠান পৌঁছে দিয়েছেন তার শেষ জীবন শোনা যায় সুখের হয় নি। স্টাফ আর্টিস্টদের পেনশন ছিলনা। বহু শিল্পীর ক্ষেত্রেই এটা হয়েছে। শিল্প সৃষ্টিতে নিমগ্ন থেকে বহু স্রষ্টাই তাদের ভবিষ্যত জীবনের পরিণতির কথা ভাবেন নি। এক সময়ে যাদের সবাই শ্রদ্ধা ও আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, জীবনের শেষ পর্বে তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে বিস্মৃতির গর্ভে লীন হয়েছেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট বাণীকুমার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। না, সাময়িক ভাবে হলেও তার প্রিয় অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাতিল হবার খবর তাকে শুনে যেতে হয় নি।

=={{{{{{{{{{{{{{{{=========}}}}}}}}}}}}}}}}}}}}=


No comments: