দেবেশ রায়।
দেবেশ রায়ের জন্ম ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলায়, অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে। তার পিতার নাম ক্ষিতীশ রায় এবং মাতার নাম অপর্ণা রায়। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তার পরিবার জলপাইগুড়ি চলে আসেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৯ এক দশক তিনি পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তার বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গে।
তিনিই প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক, যিনি বাংলার গদ্যাখ্যানের ঐতিহ্যকে গ্রহণ না করে ইংরেজি উপন্যাসের মডেলকে বাংলা উপন্যাসের মডেল বানিয়েছেন!
কবিতায় মধুসূদনের আধুনিকতা তাঁর মৃত্যুর পরে আর চর্চিত হয়নি। মধ্যযুগের গীতিকাব্যের ঐতিহ্যকেই রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেন। তিরিশের কবিরা ইউরোপীয় কবিদের দিকে সম্মোহনের চোখে তাকিয়েছেন বটে, তবে তা মধুসূদনের মতো বাংলা কবিতার ঐতিহ্যকে একেবারেই উপেক্ষা করে নয়; কিন্তু বাংলা কথাসাহিত্য ইউরোপীয় আধুনিকতা বা মডেলের বাইরে আসতে পারেনি। এই কারণেই, সোয়াশো বছর পরে দেবেশ রায়কে নতুন ধরনের বাংলা উপন্যাস খোঁজার মিশনে বের হতে হয়।
তাঁর মননচর্চার ব্যাপ্তি ও দীপ্তি, শাণিত যুক্তি দিয়ে শাণিত গদ্যে বক্তব্য উপস্থাপনরীতি, চিন্তার স্বাবলম্বন, বিষয়ের বৈচিত্র্য বাংলা মননশীল গদ্যের মূল্যবান সংযোজন হিসেবেই পাঠ্য। রায়ের মননচর্চায় উপন্যাস নিয়ে ভাবনা এক বিশেষ দিক। প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত পাশ্চাত্য মডেল বা ফর্মকে প্রত্যাখ্যান করে বাঙালির নিজস্ব মডেলে বা ফর্মে বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেই দেবেশ রায় নতুন ধরনের উপন্যাসের খোঁজ করেন। তাঁর ভাবনার এই দিকটিই আমার নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছি মাত্র। দু-একটি জায়গায় বিরোধে জড়িয়েছি বটে, তবে সার্বিক অর্থে দেবেশ রায়ের এই মিশন আমার সমর্থনেরই জায়গা। অবশ্য এই মিশনকে ঘিরে জিজ্ঞাসাগুলোও বহুমাত্রিক। বাংলা উপন্যাসের সোয়াশো বছরের ইতিহাসের পোস্টমর্টেম করে, গ্রহণ-বর্জন-প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়ে তিনি কি শেষপর্যন্ত নিজেই কোনো পাঁকে জড়িয়ে পড়লেন কিনা? নতুন ধরনের উপন্যাসের খোঁজে বেরিয়েছেন অর্থ বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত ঐতিহ্যকে তিনি মানছেন না অথবা সন্তুষ্টি নেই। নতুন ধরনের উপন্যাসের কোনো হদিস কি তিনি আমাদের দিতে পারলেন? নাকি অতীত অনুসন্ধানের নামে বাংলা উপন্যাসের শূন্যতা, অসম্পূর্ণতা, মুমূর্ষুতাকে হাট করে খুলে দিলেন মাত্র। উপন্যাসের সংজ্ঞাহীনতার নামে তিনি নতুন কোনো সংজ্ঞা নির্মাণ করে ফেললেন কিনা? এ-ধরনের অনেক জিজ্ঞাসাই আছে বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতায়।
‘নির্বিকল্প অতীত’ নয়, ‘বহুবিকল্প অতীত’কে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সিনেমার পর্দা ওঠানোর মতো একে একে বিস্ময়, বিতর্ক, যুক্তি ও তর্কের পর্দা সরিয়ে সামনে এগিয়ে যায় দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশন। এই মিশন অবশ্যই বর্তমান সময় পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে। নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশনে বেরিয়ে কোথাও যুক্তিরহিত আবেগ দ্বারা পরাস্ত হননি দেবেশ রায়। নিজের মধ্যে কোনো ধরনের আবরণ রাখেননি অথবা সম্মোহন জাগিয়ে রাখেননি। সোয়াশো বছরের নির্মিত বাংলা উপন্যাসের অপুষ্ট শরীরের কোনো একটি জায়গাও অক্ষত রাখেননি। দক্ষ সার্জারি ডাক্তারের মতো বাংলা উপন্যাসকে ব্যবচ্ছেদ করে প্রায় নির্বিকারভাবে তিনি চিহ্নিত করে গেছেন, কোথায় কোথায় এবং কী কী কারণে বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য বা মডেল তৈরি হয়নি, এই কাজে তিনি প্রথাগত সাহিত্যের ইতিহাস লেখার ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি যুক্তিসৌধ নির্মাণ করেন।
পঞ্চাশের দশকে এক দিকে ‘পরিচয়’ আর অন্য দিকে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে এক ঝাঁক তরুণ গদ্যকার উঠে আসছিলেন, দেবেশ রায় তাঁদেরই একজন। দু-চার বছরের আগুপেছুতে তাঁর সমসাময়িক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। স্বাধীনতা তখন সবে কৈশোরের পথে হাঁটি হাঁটি পা-পা। বাংলার মসনদে কংগ্রেসি সরকার। উদ্বাস্তু আন্দোলন, বাম ছাত্র-যুব আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলনের ঘটনায় বাঙালি মধ্যবিত্তের জগৎটা আজকের তুলনায় অনেক বেশি সঙ্কটাপন্ন ছিল। ও দিকে বাংলা সাহিত্যের মহারথীরা অনেকেই তীর-ধনুক নামিয়ে রেখে বিদায় নিয়েছেন। যাঁরা তখনও সক্রিয় তাঁরাও চর্বিতচর্বণ করে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি পাঠকরা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম নতুন ভাষার জন্য ক্ষুধার্ত। অন্য দিকে বামপন্থী আন্দোলনের জোয়ার সাহিত্যেও টাটকা বাতাস বইয়ে দিচ্ছে। আধুনিক প্রজন্মের বাঙালি কবি ও গদ্যকাররা অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত।
কিন্তু এ সবের বাইরেও সক্রিয় ছিলেন একাধিক দিকে। সাম্প্রতিক সমাজ-রাজনীতির নাড়িতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর হাত ছিল। বিতর্কের যাবতীয় ঝুঁকি নিয়েও খোলাখুলি নিজের অবস্থান জানাতে কখনও পিছপা হননি।
দেবেশ রায়ের লেখালিখি নিয়ে ভাবতে হলে এ সবই মাথায় রাখতে হবে। ব্যক্তিগত ভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ফেডারেশনের রাজনীতি ও পরবর্তী কালে উত্তরবঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন। সেই সূত্রে গোটা উত্তরবঙ্গকে হাতের তালুর মতো চিনতেনও বটে। এ সবই তাঁর গল্প-উপন্যাসে ছায়াপাত করেছে। কিন্তু তাঁর লেখা নিছক এই সমস্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে আটকা পড়া বিবরণ হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছিল তাঁর নিজস্ব স্বাক্ষর বহনকারী ‘বৃত্তান্ত’। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রান্তিক জনজীবন নিয়ে সেই গত শতকের বিশের দশক থেকে অনেকেই লিখে আসছেন, দেবেশ রায় তাঁদের সকলের থেকে এখানেই আলাদা। এখানেই আলাদা ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’, ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’, কিংবা ‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’। চেনা অভিজ্ঞতার বাইরের মানুষজন, ভূ-প্রকৃতি কিংবা রাজনীতি নিয়ে লেখার জন্য ভাষা বা উপন্যাসের আঙ্গিককে যে ব্যতিক্রমী হতে হবে সে বিষয়ে তিনি দীর্ঘ লেখকজীবনের প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন। তাই তাঁর উপন্যাসের নাম হয় ‘মানুষ খুন করে কেন’ কিংবা গল্পের নাম হয় থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’। ‘মারী’ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের নাম ‘এই উপন্যাসটা লেখার সময় লেখকের কিছু প্রাইভেট অসুবিধে এবং সে বিষয়ে পাঠকদের সঙ্গে আলোচনা’। এ জাতীয় শিরোনামের উদ্দেশ্য কিন্তু নিছক পাঠকদের চমকে দেওয়া নয়। লেখকের বাড়ির বিভিন্ন সদস্যের বাড়িতে ঢোকা-বেরনোর সময়ের আলোচনা থেকে শুরু হয়ে কখন যেন উপন্যাস গড়িয়ে যায় বিশ্বায়নের রাজনীতির দিকে। নমঃশূদ্র নেতা বরিশালের যোগেন মণ্ডলের জীবনকে কেন্দ্র করে সুদীর্ঘ উপন্যাসের পাশাপাশি লিখেছেন প্রায় সম্পূর্ণ প্লটহীন একাধিক উপন্যাস। কিংবা প্লটটাকেই করে তুলেছেন উপন্যাসের অতিরিক্ত। শেষের কয়েক বছরের কিছু উপন্যাসে পাওয়া যায় আরব্য রজনী ও বিভিন্ন কিস্সার ধাঁচা।
এ সবের পাশাপাশি সম্পাদক হিসেবেও নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন, ১৯৭৯ সাল থেকে প্রায় এক দশক ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালীন তাঁর হাতে বেশ কয়েক জন নতুন লেখক তৈরি হয়েছেন। একই ভূমিকা পালন করেছেন ‘প্রতিক্ষণ’-এর সম্পাদক হিসেবেও। আবার ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশনার মাধ্যমে জীবনানন্দ দাশের গল্প-উপন্যাসকে বাঙালি পাঠক যে নতুন করে আবিষ্কার করে, তার পেছনেও দেবেশ রায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ‘পয়েন্ট কাউন্টার-পয়েন্ট’ নামে এক ইংরেজি পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন কিছু দিন। প্রাক-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন, বাংলা ভাষায় ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনী লিখছেন এবং লিখেছেন নন-ফিকশনধর্মী আরও বেশ কিছু বই।
শুরু করেছিলাম সংবাদপত্রে দেবেশ রায়ের লেখালিখির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। বস্তুত উত্তর-সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখক হিসেবে তিনি যে কোনো পেশাদার লিখিয়ের কাছে ঈর্ষনীয় উদাহরণ, পলকে যে কোনো পাঠকের মনোযোগ টানতে সক্ষম। লেখার বিষয় যা-ই হোক না কেন – ভোট রাজনীতির হিসেবনিকেশ থেকে শুরু করে বাংলা বানান, কিংবা রবীন্দ্রসংগীত থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের পরিবহণ – প্রত্যেকটা লেখাকে কলমের মোচড়ে তিনি করে তুলতে পারতেন নিজস্বতায় ভরপুর, সে লেখা হয়ে উঠত সংবাদপত্র-পাঠকের সেই দিনকার পুঁজি, আবার মতামতটাও তার মধ্যে জোরালো ভাবে চারিয়ে দিতে কসুর করতেন না।
এই মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে কী ভাবে একটা লেখায় কৈশোর বয়সে সুদূর জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা আসার যাত্রাপথের (সেই সময় উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে আসাটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না) বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন তলস্তয়ের ‘রেজারেকশন’ উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা। এই সমস্ত নিবন্ধের কোনো নির্বাচিত সংকলন দিনের আলো দেখতে পারে কি? আশা করা যায় বঙ্গীয় প্রকাশককুল ভেবে দেখবেন।
বস্তুত দেবেশ রায়ের লেখার ও বাঁচার বৃত্তটা ছিল বড়ো, বেশ বড়ো। তাই তাঁর লেখায় নেহাত ঘরোয়া রোজনামচার পাশাপাশি অনায়াসে দেখা দিতে পারত আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাজারো প্রসঙ্গ। তিনি সেই বিরল থেকে বিরলতর হতে থাকা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি যাঁরা একই সঙ্গে সাম্প্রতিকতা ও ইতিহাসে, নিজস্ব শিকড় ও দেশ-দুনিয়ার মাটিতে পা রেখে বেঁচেছেন। দিন কয়েক আগেই কলকাতা হারিয়েছে ইতিহাসবিদ হরিশঙ্কর বাসুদেবনকে। দেবেশবাবুর সঙ্গে একই দিনে বাংলাদেশে প্রয়াত হয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এঁরা সকলেই নিজেদের চর্চা ও কাজে বহুত্বের চিন্তাকে কোনো না কোনো ভাবে তুলে ধরেছেন। এই সন্ত্রস্ত ও একপেশেমির মৌলবাদে বিপর্যস্ত সময়ে দেবেশ রায়ের মৃত্যুতে এই শহরের বৈচিত্র্যের রংটা আরও দু-এক পোঁচ ফ্যাকাশে হল।
দেবেশ রায় ছিলেন অন্তত গোটা দশেক সংবাদপত্রের দৈনিক পাঠক। একাধিক বাংলা কাগজে তিনি নিয়মিত লিখতেন। তাই তাঁর কোনো গল্প-উপন্যাস কোনো দিন হাতে নিয়েও দেখেননি, বাংলা খবরের কাগজের এমন পাঠকরাও তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ঘটনাচক্রের বিচিত্র পরিহাসে বৃহস্পতিবার একটু বেশি রাতে তাঁর মৃত্যুসংবাদ আসায় পরদিন সকালের বাংলা কাগজগুলোতে তাঁর খবর যথেষ্ট জায়গা পায়নি।
১৪ মে ২০২০ সালে কলকাতার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে দেবেশ রায়ের জীবনাবসান হয়। ইতিপূর্বেই ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে কাকলি রায়ের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের একমাত্র সন্তান দেবর্ষি রায় বেঙ্গালুরু শহরে কর্মরত।
গ্রন্থ তালিকা সম্পাদনা
তিস্তাপারের বৃত্তান্ত (১৯৮৮)
মফস্বলি বৃত্তান্ত (১৯৮০)
সময় অসময়ের বৃত্তান্ত (১৯৯৩)
লগন গান্ধার (১৯৯৫)
আত্মীয় বৃত্তান্ত
শিল্পায়নের প্রতিবেদন
দাঙ্গার প্রতিবেদন
খরার প্রতিবেদন
যযাতি
তিস্তাপুরাণ
আঙিনা
ইতিহাসের লোকজন
উচ্ছিন্ন উচ্চারণ
একটি ইচ্ছা মৃত্যুর প্রতিবেদন
চেতাকে নিয়ে চীবর
জন্ম
তারাশংকর:নিরন্তর দেশ
নবেলজোড়
বেঁছে বততে থাকা
শিল্পায়নের প্রতিবেদন
মার-বেতালের পুরান
যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ
সহমরণ।
=================================
No comments:
Post a Comment