বিনয় মুখোপাধ্যায়।
( মাসিক বসুমতীর ২৫ বর্ষের ফাগুন সংখ্যায় দৃষ্টিপাত ' এর আলোচনায় লিখেছিলেন বরেণ্য সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র)
মোহিতলাল মজুমদারের মতো কঠিন-হৃদয়ের সমালোচকও দৃষ্টিপাত পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি নিজেই বঙ্গদর্শন পত্রিকায় লিখেছেন, ‘বইখানি পড়িয়া আমাদের মতো বিশ্বনিন্দুকও মুগ্ধ হইয়াছে। রচনার আরও দুটি গুণ আছে, একটি লেখকের অতিশয় সপ্রতিভ চিন্তা; আরেকটি তাহার তীক্ষ্ণ রসবোধ- ইংরেজিতে যাহাকে Sense of Humor বলে।’ কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যাযাবরের দৃষ্টিপাত পড়ে মানুষ প্রেম করতে শিখেছে’। ১৯৬০ সালে বইটির হিন্দি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
যাযাবর মূলত ছদ্মনাম। লেখকের প্রকৃত নাম বিনয় মুখোপাধ্যায়। তিনি দীর্ঘ ৩৮ বছর সাহিত্য চর্চা করেছেন। কিন্তু খুব বেশি লেখেননি। তাঁর মোট বইয়ের সংখ্যা মাত্র আটটি। দৃষ্টিপাত ছাড়া যাযাবর নামে অন্য পাঁচটি গ্রন্থ হলো: জনান্তিক (১৯৫২), ঝিলম নদীর তীর (১৯৫৪), লঘুকরণ (১৯৬৪), হ্রস্ব ও দীর্ঘ (১৯৭৩) এবং যখন বৃষ্টি নামল (১৯৮৩)। বিনয় মুখোপাধ্যায় নামে তাঁর দুটি গ্রন্থ রয়েছে। এগুলো হলো: খেলার রাজা ক্রিকেট (১৯৫৩) ও মজার খেলা ক্রিকেট (১৯৫৩)। বাংলাদেশ ও ভারতে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট নিয়ে এ দুটি গ্রন্থই প্রকাশিত হয়। সেকারণে যাযাবরকে ক্রিকেট সাহিত্যের জনক বলা হয়ে থাকে।
যাযাবরের বাবা ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় নিজেও লেখালেখি করতেন। বিবেকরঞ্জন ভট্টাচার্য তাঁর দেহলি প্রান্তে (১৯৬৬) গ্রন্থে জানান, ‘যাযাবর সাহেবের সাহিত্যপ্রীতি এসেছে বংশগতভাবে। তার পিতৃদেব স্বর্গত ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় তদানীন্তন কালের সমগ্র পত্র-পত্রিকাতেই রীতিমতভাবে প্রকাশিত করতেন আপন রচনা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার উদ্দেশ্যে কোনো বিখ্যাত কবিতা রচনা করেন’। যাযাবর শৈশব থেকে ‘রাবীন্দ্রিক আবহাওয়ায়’ বেড়ে ওঠেন। তিনি লিখেছেন, তার পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রানুরাগ ছিল অঙ্গীভূত। তাঁর বাবা নোবেল পাওয়ার পূর্ব থেকে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ছিলেন। মা মনোরমা দেবীর কাছে যাযাবর শুনতেন রবীন্দ্র-সাহিত্যের গল্পকাহিনি। শৈশবেই বাড়ির আলমারিতে দেখেছেন নৌকাডুবি, বউঠাকুরাণীর হাট, হিতবাদী প্রকাশিত রবীন্দ্রগ্রন্থাবলি। যাযাবরের স্ত্রী দুর্গা মুখোপাধ্যায়ও রবীন্দ্র-অনুরাগী ছিলেন। তাই যাযাবরের সাহিত্যে রবীন্দ্র-অনুষঙ্গ বারবার এসেছে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখেছেন, সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যাযাবর লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে মহলানবিশ দম্পতির অতিথি। সাংবাদিকতার তাগিদে সেখানে উপস্থিত হলাম। সঙ্গে সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় ও সাহিত্যিক প্রবোধ স্যানাল। বন্দেমাতরমের সুরটি যে রবীন্দ্রনাথকৃত, সেকথা সেদিন কবির কাছ থেকেই জেনেছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা হয়েছিল। জীবনের নানা পর্বে দেশবাসীর ঔদাসীন্যের কথা বিরূপতার কথা। বক্তা কবি প্রায় একক। শ্রোতা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তিনটি তথ্যান্বেষী তরুণ। নানা দিক থেকে অকারণ অভদ্র আক্রমণে কবিগুরু অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন। একদিন হৃদয়ের গভীর আবেগে লিখেছিলেন, সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এ দেশে। তিক্তকণ্ঠে বললেন, যাবার আগে ওই লাইনটি কেটে দিয়ে যাবেন।’
সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য পেয়েছেন যাযাবর। তিনি তাঁকে চাঁদপুরে এনেছিলেন। যাযাবরের আমন্ত্রণে চাঁদপুরে রবীন্দ্রনাথের জন্মউৎসবে তিনি সভাপতিত্ব করেন। যাযাবর অতুলপ্রসাদ সেনেরও সান্নিধ্য পেয়েছেন। তিনি যে কটি গান লিখেছিলেন তার পেছনে রবীন্দ্রনাথ ও অতুলপ্রসাদের গানের উদ্দীপনা ছিল। যাযাবরের একাধিক গান কিংবদন্তি গায়ক শচীন দেববর্মণ গেয়েছেন। তিনি কয়েকটি নাটকও লিখেছেন। নিজের লেখালেখি সম্পর্কে যাযাবর বলেছেন, ‘আমার কোনো নেশা নেই। শখ আছে। সাহিত্য তার মধ্যে একটি। আমার লেখার পেছনে কোনো নেশা নেই। আছে তুষ্টি। নিজের খুশিতে লিখি। মাঠে রাখাল ছেলে যেমন বাঁশি বাজায়।’ যাযাবর আনন্দ থেকেই তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, সঙ্গীত, নাটকের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ শাখায় লিখেছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নরসিংহ দাস স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫০) ও বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৮)
রচনা কর্ম :
'দৃষ্টিপাত' (১৯৪৭)
'জনান্তিকে' (১৯৫২)
'ঝিলম নদীর তীরে' (১৯৫৪)
'লঘুকরণ' (১৯৬৪)
'হ্রস্ব ও দীর্ঘ'
'যখন বৃষ্টি নাম' (১৯৮৩)
এছাড়া ক্রিকেট খেলা নিয়ে বাংলা ভাষায় তার স্বনামে লেখা গ্রন্থ দুটি হল -
'খেলার রাজা ক্রিকেট'
'মজার খেলা ক্রিকেট'
কর্মসূত্রে ও অবসর গ্রহণ করার পর তিনি সস্ত্রীক ইউরোপ ও আমেরিকায় গিয়েছিলেন। তার স্ত্রী দুর্গাদেবী ছাত্রজীবনে প্যারিসে ছিলেন। তিনি যামিনী রায়ের শৈলীতে অনেক ছবি এঁকেছেন। তার লেখা 'পুষ্পপট' বাংলাভাষায় ফুল সাজানো নিয়ে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ।
যাযাবর সাংবাদিকতার সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন। শুরুর দিকে আর্থিক জগৎ পত্রিকায় কাজ করতেন। এখানে লিখতেন ‘শ্রীপথচারী’ ছদ্মনামে। ১৯৩৭ সালে যোগ দেন অমৃতবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায়। দায়িত্ব পালন করেন যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৭৩ সালে ‘মিত্র অ্যান্ড ঘোষ পাবলিশার্স’ থেকে প্রকাশিত সাহিত্য কোষ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, যাযাবর যুগান্তরে দায়িত্ব পালনকালে নিয়মিত সামাজিক ও রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখতেন। তিনি তখনও ‘শ্রীপথচারী’ ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। সাংবাদিকতায় যাযাবর অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৪২ সাল থেকে ৫ বছর ব্রিটিশ প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। যাযাবর কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টরেট অব অ্যাডভারটাইজিং অ্যান্ড ভিজ্যুয়াল পাবলিসিটি এবং রেজিস্ট্রার অব নিউজ পেপারস- সংস্থা দুটির প্রধান ছিলেন। ইন্ডিয়ান ইনফরমেশন সার্ভিসের ডেপুটি অফিসার হিসেবে তিনি অবসর নেন। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যাযাবর মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। তিনি বলতেন, সাংবাদিকতার মধ্য দিয়েই তাঁর লেখক জীবনের সূচনা হয়েছিল।
ব্যক্তিজীবনে যাযাবর পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তাঁর জন্মস্থান ও সাল নিয়ে একাধিক তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত নিজস্ব নির্জন গ্রন্থে কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত জানান, ‘যাযাবর (১৯০৯)। পূর্ববঙ্গে জন্ম। শিক্ষাজীবন প্রধানত কুমিল্লার চাঁদপুরে কেটেছে।’ অন্যদিকে ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রসঙ্গ গ্রন্থে আজহার ইসলাম লিখেছেন, ‘যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়, জন্ম ১৯১২)। জন্মস্থান ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুর।’ ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় রাজধানীর গল্প সংকলন। এ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, ‘যাযাবরের জন্ম ১৯১২ সালে। বাংলাদেশের চাঁদপুরে।’ যাযাবরের জন্ম সম্পর্কে তাঁর ভাতিজি সুস্মিতা রায় লিখেছেন, ‘His wanderlust started long ago one January morning in 1909 in the small village of Phegunashar, now in Bangladesh.’। বর্তমানে Phegunashar গ্রামটি কোথায় তা জানা যায়নি। সুস্মিতা সেনের ভাষ্যে, যাযাবরের জন্ম ১৯০৯ সালের ১ জানুয়ারি। অন্যদিকে যাযাবর গবেষক অমলেশ পাত্র লিখেছেন, ‘যাযাবরের জন্ম তারিখটি ছিল ১১ জানুয়ারি ১৯০৯’।
খ্যাতনামা সাহিত্যিক বিনয় মুখোপাধ্যায় ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে অক্টোবর দিল্লিতে প্রয়াত হন।
=================================
No comments:
Post a Comment