Sunday, 10 April 2022

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। নিমাই ভট্টাচার্য। ১০.০৪.২০২২. Vol -701. The blogger in literature e-magazine


নিমাই ভট্টাচার্য


জন্ম ১০ এপ্রিল ১৯৩১ 

যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ।এবং১৯৪৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। 

নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। দেশভাগের পর তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী হন। অতঃপর তিনি কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন।

নিমাই ভট্টাচার্য ভাগ্যের নির্মম অদৃষ্টে সাড়ে তিন বছর বয়সে মাতৃহীন হয়ে ভীষণ কষ্টে পিতার সীমিত আয়ের মধ্যে ভর্তি হন কলকাতা কর্পোরেশনের ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন কলেজে কিছুদিন পড়ালেখা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে তিনি যশোরের সম্মিলনী ইন্সটিটউশনে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করেন। নিমাই ভট্টাচার্যের পিতা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নিজেও যশোরের সম্মিলনী ইন্সটিটিউশনের ছাত্র এবং পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন কলকাতা গমনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। পরবর্তীতে দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য তাঁর পিতার সাথে পুনরায় কলতায় যান এবং সেখানে আবারো রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং সেখান থেকেই তিনি আই.এ পাস করেন এবং ১৯৫২ সালে বি.এ পাস করেন।

নিমাই সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তার কর্মজীবন শুরু হয়।এবং তিনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর দিল্লিতে ভারতীয় পত্রিকার রাজনৈতিক-কূটনৈতিক-সংসদীয় সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ভারতের অনেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিদেশ সফর করে নিউজ কাভার করেছেন। ১৯৬৩ সালে তার লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং তা ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে।এরপর, তার চারটি উপন্যাস একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

নিমাইয়ের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৫০ -এর অধিক। বাংলা সাহিত্যে মেমসাহেব উপন্যাসটি তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা। মেমসাহেব গ্রন্থ অবলম্বনে ১৯৭২ সালে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার এবং অপর্ণা সেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য

বইগুলো হল:

মেমসাহেব
মিনিবাস
মাতাল
ইনকিলাব
ব্যাচেলার
ইমনকল্যাণ
ডিফেন্স কলোনী
প্রবেশ নিষেধ
কেরানী
ভায়া ডালহৌসী
হকার্স কর্নার
রাজধানী এক্সপ্রেস
নিমন্ত্রণ
নাচনী
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান
ডার্লিং
ম্যাডাম
ওয়ান আপ-টু-ডাউন
গোধুলিয়া
প্রিয়বরেষু
আকাশ ভরা সূর্য তারা
মোগল সরাই জংশন
ইওর অনার
ককটেল
অনুরোধের আসর
যৌবন নিকুঞ্জে
শেষ পরানির কড়ি
হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স
পথের শেষে

মৃত্যু - ২৫ জুন ২০২০ একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক, সাংবাদিক।

নিমাই, ফাল্গুনী, নীহাররঞ্জন—নামগুলো বললে সাহিত্যবোদ্ধাদের অনেকেই নাক সিটকায়। আমি ভেবে দেখেছি, দস্তয়েভ্‌স্কি, তলস্তয়, ও হেনরি, মোপাসাঁ, চেখভ পড়ার পরও আগে যাঁদের নাম বললাম, তাঁদের লেখার প্রতি আমার আকর্ষণ একটুও কমে না। যে বয়সে ওঁরা আমার কাছে এসেছেন, সে বয়সে ওঁদের ভাবনা ও ভাষায় মুগ্ধ হয়েছি। কে কতটা উচ্চমার্গের লেখা লিখেছেন, তা নিয়ে বিচারে বসিনি। নিমাই ভট্টাচার্যকে আমরা ওই সব তত্ত্বজ্ঞানীর আলোচনায় ছেড়ে দেব না; বরং নিজের মতো করেই তাঁকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব।

‘জার্নালিস্টের জার্নাল’ বইটায় নিমাই ভট্টাচার্য তাঁর দারিদ্র্যের কথা যে নিরাসক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেন, তা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। নামগোত্রহীন এক সস্তা পত্রিকার রিপোর্টারের প্রতি আশপাশের মানুষের অবহেলার গল্পটি তিনি এমন ভঙ্গিতে বলেছেন, যাতে তাঁর প্রতি যেন করুণা না হয়। এক শ টাকা মাইনের রিপোর্টার, যিনি দিল্লি থেকে আশি টাকা পাঠাচ্ছেন কলকাতায় থাকা পরিবারের জন্য, ২০ টাকা দিয়ে কায়ক্লেশে কাটিয়ে দিচ্ছেন সময়; তিনিই যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বাড়িতে যাচ্ছেন, তখন প্রধানমন্ত্রীকন্যা ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে পাচ্ছেন স্নেহ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না। পোশাকে–আশাকে ও চেহারায় দারিদ্র্য ফুটে ওঠা এই যুবককে দেখে যখন নেহরু জেনে নিলেন তাঁর আর্থিক অবস্থা, তখন সেটা বুঝতে দিলেন না নিমাইকে। শুধু নিজের সঙ্গে বসিয়ে কফি খাওয়ালেন, স্যান্ডউইচ খাওয়ালেন, এবং বলে দিলেন, এখন থেকে এই ছেলের অবাধ অধিকার থাকবে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে। দিনে এক বেলা খাওয়া নিমাইয়ের জন্য সে ছিল এক বিশাল ব্যাপার।

আরও একটি ব্যাপার সে বই থেকেই প্রথম জানা। বাঙালি স্বভাব। খুব ছোট এক পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন বলে দিল্লির বড় বড় বাঙালি সাংবাদিক নিমাইকে পাত্তাও দিতেন না। নিজেরা পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন একে-অন্যকে, কিন্তু নিমাইয়ের দিকে ভ্রুক্ষেপও করতেন না। একদিন সংসদ অধিবেশন থেকে বের হয়ে অন্য সাংবাদিকদের এড়িয়ে নিমাইয়ের কাঁধে হাত রেখে কথা বলতে বলতে চললেন নেহরু। জানিয়ে দিলেন, ছেলেটা তাঁর খুব কাছের। এরপর থেকে নিমাইয়ের কদর বেড়ে গেল সাংবাদিক মহলে। জাতে উঠলেন নিমাই।

সাংবাদিক পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বলে আমাকে বরং নিমাই ভট্টাচার্যের সাংবাদিক জীবনটাই আকর্ষণ করত বেশি। ‘মেমসাহেব’ থেকে উঠে এসে দোলা বৌদি যে কখনো কখনো মনের পক্ষপাত পেতেন না, তা সত্য নয়। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘মেমসাহেব’ বইটি কীভাবে লেখা হলো, সত্যিই মেমসাহেব বলে কেউ ছিলেন কি না, সে প্রশ্নগুলো আগ্রহের জন্ম দিত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সে উত্তরগুলো পেয়ে জানার ইচ্ছে মিটেছে। ১৯৭২ সালে উত্তম–অপর্ণা অভিনীত ‘মেমসাহেব’ চলচ্চিত্রটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখনো চাইলে দেখে নেওয়া যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ছবিটি এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কেন যেন নিমাই আমার বেশি আপন হয়েছেন তাঁর সাংবাদিকতার বর্ণনা দিয়ে। এমনও হতে পারে, সেখানে ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া মানুষদের দেখা পাই বলে আকর্ষণটা বেশি।
নিমাই ভট্টাচার্যের সৃষ্টিতে কখনো এমন কিছু তরল উপস্থাপনাও নেই, যার জেরে তাঁকে আমরা বাজারচলতি সাহিত্যিক বলে অভিহিত করতে পারি। সমাজবিজ্ঞানকে সমাজবীক্ষণে রূপান্তরিত করার এক ধরনের অদ্ভুত জাদুস্পর্শ নিমাই ভট্টাচার্যের সামগ্রিক সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে। অথচ এই বহুমুখী উপস্থাপনায় একটিবারের জন্যও কোনো প্রচারকামিতার গড়নে নিজের সাহিত্যকে উপস্থাপিত করেননি নিমাই ভট্টাচার্য।

দেশভাগ তাঁর জীবনের এক স্থায়ী ক্ষত ছিল। জন্মভূমির প্রতি তৃষ্ণাও তাঁর ছিল অন্তহীন। সেই তৃষ্ণা নিবারণের উদ্দেশ্যে জন্মভূমি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্যায়ের সঙ্গে নিমাই ভট্টাচার্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। দিল্লিতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় তাঁর ভূমিকার সাক্ষ্য হিসেবে সৈয়দ হাসান ইমামের মতো ব্যক্তিত্ব এখনো আমাদের মধ্যে আছেন।

এই সংযোগকে কিন্তু নিমাই ভট্টাচার্য ব্যবহার করে গেছেন বাঙালির সর্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ এবং সম্প্রীতির প্রতি এক ধরনের প্রবল অনুরাগ হিসেবে। এই অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে, কেবল সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে যে তিনি তাঁর সামগ্রিক চেতনাকে আবদ্ধ রেখেছেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সাহিত্য যাতে বইয়ের আলমারির একটি সম্ভ্রান্ত সামগ্রী হিসেবেই না থেকে যায়, তার বদলে সব পাঠকের, বিশেষ করে বাঙালি হৃদয়ের অন্তস্তলের বস্তু হয়ে উঠতে পারে বই, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি ছিল না নিমাই ভট্টাচার্যের।

প্রান্তিক চরিত্র, নিম্নবর্গীয় চরিত্র, সেই সঙ্গে অভিজাত—অত্যন্ত উচ্চমার্গের, উচ্চ কৌলীন্যের চরিত্রকে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের সৃষ্টিতে। তবে কখনোই উচ্চমার্গের প্রতি, উচ্চবর্ণের প্রতি, উচ্চ ধনগৌরবের প্রতি নিজের আকর্ষণ তিনি প্রকাশ করেননি। এ ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষপাতিত্ব ছিল উচ্চচিন্তা, উচ্চমান, উচ্চ চেতনার প্রতি। তাঁর অনুরক্তি ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং একেবারে প্রান্তিক মানুষদের জন্য।

প্রান্তিকতার বিনির্মাণের বেলায়ও কিন্তু নিমাই ভট্টাচার্য এমন কোনো চরিত্রকে, এমন কোনো বিধি ব্যবস্থাকে উপস্থাপিত করেননি, যার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তাই নিমাই ভট্টাচার্যের কোনো সৃষ্টিকেও কল্পিত এক ধরনের ইউটোপিয়ার পরিচায়ক হিসেবে ধরে নিতে পারি না। সহজ সরল বাস্তবতার মধ্যে, প্রখর রাজনৈতিক অথচ কোনো প্রকারের দলীয় আনুগত্য নয়, কিন্তু আদর্শবাদের প্রতি অনুরাগ, মনুষ্যত্বের প্রতি অনুরাগ, পরধর্মসহিষ্ণুতা, প্রীতি, ভালোবাসা, সম্প্রীতির জন্য আকুতি ছিল তাঁর সৃষ্টির সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য।

====={={{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}}}}}}}==






No comments: