জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
না থাকলে বাঙালি গীতা-রহস্যের হদিশ পেত না। সংস্কৃত নাটকের বিপুল ভাণ্ডার অধরাই থেকে যেত। বঞ্চিত থাকত পাশ্চাত্য সাহিত্যের রস আস্বাদন থেকে। গিরিশ ঘোষের আগে বঙ্গ রঙ্গালয়ের জনপ্রিয়তাকে তিনিই গড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে বাঙালি স্বদেশিয়ানার প্রথম পাঠ নিয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষের হাত ধরে বিপ্লবী যুগ শুরু হওয়ার অনেক আগে তিনিই প্রথম বাঙালিকে ‘গুপ্ত সমিতি’ গড়তে শিখিয়ে ছিলেন ‘হামচুপামুহাফ’ গঠনের মধ্য দিয়ে। নিজের অন্তঃপুরিকা স্ত্রী কাদম্বরীকে চিৎপুরের রাস্তা দিয়ে ইডেন গার্ডেনসে ঘোড়া ছুটিয়ে নারী স্বাধীনতা সম্বন্ধে সচেতন করেছিলেন। বাঙালিও যে চাইলে ব্যবসা করে প্রতিপক্ষ ইংরেজ ব্যবসাদারদের পাততাড়ি গোটানোর ব্যবস্থা করতে পারে, তাও প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তিনি। বিদ্বজ্জন সমাগম, সঞ্জীবনী সভা, সারস্বত সমাজ গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যসেবার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আর সেই সঙ্গে গড়ে দিয়েছিলেন বাঙালির গর্বের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
রবীন্দ্রনাথের ‘জ্যোতিদাদা’, সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর ‘নতুন’ ও ইন্দিরা দেবীর ‘নতুন কা’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম ৪ মে, ১৮৪৯ সালের মধ্যরাতে (২২ বৈশাখ, ১২৫৬)। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাদেবীর পঞ্চম পুত্র। সে ছিল এমন এক সময়, যখন জোড়াসাঁকো ঠাকুর বংশের বিত্ত ও বৈভবে টান পড়েনি। মুঘল ও ইংরেজ সংস্কৃতি মিলেমিশে ছিল সাধারণ ভারতীয়দের জীবনে। আবার তাঁর জন্মের সাত মাস পরে ২১ ডিসেম্বর ১৮৪৯, দেবেন্দ্রনাথ তাঁর মধ্যম ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ-সহ ২১ জন ভক্তবন্ধুকে নিয়ে বিধিমতো প্রতিজ্ঞা পাঠ করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। সেও এক সন্ধিক্ষণ।
বাল্যকালে দাদা হেমেন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন। পরে তিনি সেন্ট পল'স ও মন্টেগু'স স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৮৬৪ সালে হিন্দু স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও লেখক রমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন তাঁর সহপাঠী। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ফার্স্ট আর্টস পড়ার সময় থিয়েটারে আকৃষ্ট হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
ছাত্রাবস্থাতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থিয়েটারের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি একটি পারিবারিক নাট্যদল গঠন করে নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করেন। তাঁর জ্ঞাতিভ্রাতা গণেন্দ্রনাথ ১৮৬৫ সালে স্থাপন করেন জোড়াসাঁকো নাট্যশালা। এই নাট্যশালায় প্রথম যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল, সেটি হল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই নাটকে অহল্যাদেবী নামে এক সাহসী রানির ভূমিকায় অভিনয় করেন। প্রথম জীবনে নাট্যাভিনয়ে সাফল্য তাঁকে নাট্যকার হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে।
গণেণ্দ্রনাথ হিন্দু মেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি অল্পবয়সে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে এ কাজে যুক্ত করেন। নবগোপাল মিত্রের অনুরোধে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন। পুরো প্রক্রিয়াটি তার মনে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলে এবং তিনি দেশাত্মবোধক নাটক রচনা করতে শুরু করেন। এছাড়াও তিনি রসাত্মক নাটক রচনার রীতি চালু করেন। তিনি নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্দেশ্যে একটি সাংস্কতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন বিদ্বাজন-সমাগম নামে ১৮৭৪ সালে। এই প্রতিষ্ঠানটি রবীন্দ্রনাথকে তার প্রথম দিকের নাটক ও নৃত্যনাট্য প্রদর্শনে সাহায্য করে। প্রতিষ্ঠার নবম বছরে তিনি হিন্দু মেলার সম্পাদক নিযুক্ত হন। পুরুবিক্রম পাঞ্জাবের সাহসী রাজা পোরাসএর জীবনী নিয়ে রচিত, যিনি বাংলা ভাষায় পুরু নামে পরিচিত। পুরু আলেক্সাণ্ডারএর মুখোমুখি হন। বেঙ্গল থিয়েটার নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন করে ১৮৭৪ সালে।
সরোজিনী একটি বিয়োগান্তক নাটক বা ট্রাজেডি যা একজন রাজপুত রমণীর আত্মহত্যার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। শত্রুদের কাজে যুদ্ধে পরাজিত হবার পর আত্মসম্মান হারানো ঠেকাতে তিনি একাজ করেন। সরোজিনী রাজস্থানরাজস্থানের মেয়োয়ারের রাণা লক্ষণ সিংয়ের কন্যা ছিলেন। আলাউদ্দিন খিলজির হাতে রানা পরাজিত হবার পর সরোজিনীসহ অনেকেই আত্মহত্যা করে।
সরোজিনীর সাথে রবীন্দ্রনাথের জীবনী জড়িত আছে। নাটকটি যে ঘরে রচনা হত, তার পাশের ঘরে কিশোর রবীন্দ্রনাথ সংলাপ শুনতেন। সরোজিনী তৈরির সময় রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করেন, সরোজিনী জ্বলন্ত আগুনে হেঁটে আত্মাহুতি দিতে যাচ্ছে এই দৃশ্যটির পিছনে উক্তি ব্যবহার না করে গান ব্যবহার করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ নাটকটির জন্য একটি গানও রচনা করেন এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাকে সাহায্য করেন।
অশ্রুমতি কিংবদন্তিমূলক নাটক। এই নাটকে একটি হিন্দু মেয়ে একটি মুসলমান ছেলের প্রেমে পড়ে, মেয়েটি ভালবাসা ও পিতার প্রতি কর্তব্যের বাঁধার সম্মুখীন হয়। রাজস্থানের রাণা পরিবার উল্লেখিত তাদের বলে দাবি করে এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হয়।
অলীক বাবু নাটকে বিধবা বিবাহের সামাজিক পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে। প্রথা ও শ্রেণীবিভেদের বিরুদ্ধে প্রেমের উপাখ্যান উঠে এসেছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকে। তার নাটকগুলো বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মঞ্চে নিয়মিতভাবে প্রদর্শিত হয়ে চলেছে।
অনুবাদ ও সম্পাদনা
১৮৬৭ সালে বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আহমেদাবাদে থাকার সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেতার বাজাতে ও ছবি আঁকতে শেখেন। তিনি ফরাসি ও মারাঠি ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করেন। বিভিন্ন ভাষার বই, বিশেষ করে নাটক তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। ইংরেজি থেকে মার্কাস অরেলিয়াসএর মেডিটেশনস ও শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার অনুবাদ করেন। পিয়েরে লোতি ওথিওফিল গুটিয়ার ছাড়াও তিনি ইতিহাস, দর্শন, ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস ও ছোট গল্প ফরাসি ভাষা থেকে অনুবাদ করেন। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে তিনি সতেরটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত নাটক বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। এর মধ্যে কালিদাসের ‘’অভিজ্ঞান শকুন্তলম’’ ও ‘’মালতী মাধবা ও সুদ্রকের "মৃচ্চাদিকা" উল্লেখযোগ্য্।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ “ভারতী” নামে একটি নতুন ম্যাগাজিনের প্রস্তাব করেন ১৮৭৭ সালে। দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদক থাকলেও মূলত তিনিই পত্রিকাটি চালাতেন। ১৯০২-০৩ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক সংগঠন, সরস্বত সমাজের তিনি অবদান রাখেন। সংগঠন বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ৪৬ খণ্ড সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে প্রচুর অনুবাদও রয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সবসময় তার বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে অনুষ্ঠিত সাহিত্য মজলিশে অংশ নিতেন। অন্যান্য অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী, জগদীন্দ্রনাথ রায়, লোকেন্দ্রনাথ পালিত, শরৎকুমারী চৌধুরানী ও প্রমথ চৌধুরী।
সংগীত
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শৈশবে বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীত বিষয়ে তালিম নেন। তিনি পিয়ানো, ভায়োলিন, হারমোনিয়াম ও সিতার বাজানোতে দক্ষ ছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সঙ্গীত বিপ্লবে মূল ভূমিকা ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। সাহিত্য ও সংগীতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গী ছিলেন অক্ষয় চন্দ্র চৌধুরী। পরে রবীন্দ্রনাথ তাদের সাথে যোগ দেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সুরারোপ করতেন ও পিয়ানো বাজাতেন এবং অক্ষয় ও রবীন্দ্রনাথ সুরগুলোতে কথা যোগ করতেন। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য মায়ের খেলায় ব্যবহৃত ২০ টি গানের সুরকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
দ্বিজেন্দ্রনাথ বাংলা সঙ্গীতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নোটেশনের ধারার পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটান। তিনি গান ও স্বরলিপি নিয়ে একটি বই রচনা করেন এবং বেশ কিছু সুরকার যেমন, দ্বারকিন এটিকে স্বরলিপিগীতিমালা হিসেবে প্রকাশ করেন। ১৮৭৯ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিনাবাদিনী একটি সঙ্গীত বিষয়ক ম্যাগাজিন চালু করেন যা বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি গণিত বিষয়ক আরেকটি ম্যাগাজিন সঙ্গীত প্রকাশিকাও প্রকাশ করেন। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রার্থনার জন্য বেশকিছু গানের সুরারোপ করেন। এদের কিছু কিছু হিন্দুস্তানী ক্লাসিকাল সঙ্গীতের থেকে গৃহীত হয়েছে।ভারতের সঙ্গীতের জন্য ১৮৯৭ সালে তিনি ভারতীয় সঙ্গীত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তার গানগুলো সিডিতে পাওয়া যায়।
কলকাতার অগ্রগণ্য সংগীতবিদ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী রাজেশ্বর মিত্র বলেন, "এই সময়েও আমরা ঠাকুর বাড়ির সঙ্গীত ও নাট্যসংস্কৃতির উত্থান লক্ষ্য করি, যা সেসময়কার অন্যান্য বাড়ি থেকে পরিমার্জিত ও উজ্জ্বল। এই উন্নতির প্রকল্প করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ"।
অঙ্কন
অঙ্কন ও স্কেচ করার দিকে আগ্রহী ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। নিজের পরিবারের অনেক সদস্যের পোর্ট্রেট তিনি অঙ্কন করেন। তার অঙ্কিত রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন প্রকারের স্কেচ আছে। তার প্রায় ২০০০ টি স্কেচ রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ভারতীতে প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালে। উইলিয়াম রথেনস্টেইন তার কাজগুলো দেখে চমৎকৃত হন এবং তার আরো স্কেচ দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ একবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আঁকা প্রচুর পরিমাণ স্কেচ ইংল্যাণ্ডে প্রদর্শনের জন্য নিয়ে যান। রথেনস্টেইন খুশি হয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাজের উপর “টুয়েণ্টি-ফাইভ কলোটাইপস ফ্রম দি অরিজিনাল ড্রয়িংস অফ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর” নামে একটি বই ইংল্যাণ্ডে প্রকাশিত করেন।
ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড
দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে খ্যাত ছিলেন। তার অত্যধিক উপার্জন ও শৌখিন জীবনযাপনের জন্য তিনি “যুবরাজ” নামে পরিচিত ছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নীল চাষ করে অর্থ উপার্জন করতে পেরেছিলেন। জার্মানীতে রাসায়নিক নীল উদ্ভাবিত হবার পর তিনি তার নীলচাষের ব্যবসা চালিয়ে নিতে পারেননি। তিনি তার লভ্যাংশ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। সে সময়ে খুলনা ও বরিশালের ভেতর দিয়ে স্টিমার চলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তিনি স্টিমারের শেল বা আচ্ছাদন ক্রয় করেন এবং ইঞ্জিনের সাথে যোগ করে সরোজিনী নামে ১৮৮৪ সাল থেকে চালু করেন। ফ্লোটিলা নামে একটি ইংরেজ কোম্পানিও একই ব্যবসা শুরু করে এবং দ্রুতই সবার ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছড়িয়ে পড়ে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আরো চারটি স্টিমার ক্রয় করেন। এগুলো তার প্রতিষ্ঠান থেকে স্বদেশী, ভারত, বাংলালক্ষী ও লর্ড রিপন নামে চালু হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানই ভাড়া কমাতে শুরু করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যবসায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেন, তবে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হন। ১৮৮৯ সালে হুগলি নদীতে যাত্রার সময় স্বদেশী একটি জেটির সাথে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দ্রুত ডুবে যায়। এমতাবস্থায় ফ্লোটিয়া বাকি তিনটি স্টিমারের জন্য উপযুক্ত মূল্য ঘোষণা করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেগুলো বিক্রি করে প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে বেরিয়ে আসেন।
১৮৬৯ থেকে ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক ছিলেন। তিনি ব্রাহ্ম সংগীতকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে আদি ব্রাহ্ম সমাজ সংগীতবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
তার উদ্যোগে একটি গোপন সমাজ "সঞ্জীবনী সভা" প্রতিষ্ঠিত হয়। খুব সম্ভবত ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। এই সমাজ ম্যাচের কাঠি তৈরি এবং হাতে পাকানো কাপড় চালু করার চেষ্টা করেন।
স্ত্রীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলন
স্ত্রীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সে যুগে অপরিকল্লপিত বিষয় ছিল। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে লোকের সমালোচনাকে উপেক্ষা করে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন: তাঁর নিজের নিজের সংসারে পর্দা প্রথাকে তিনি আমল দেন নি, স্ত্রীকে সকলের সম্মুখে বের করতেন, তাঁকে নিয়ে প্রকাশ্যে সান্ধ্যভ্রমণে বের হতেন এবং নিজের শিক্ষা ও শিল্পরুচি দিয়ে স্ত্রীকে সুশিক্ষিতা করে তুলেছিলেন। তিনি তার স্ত্রীর শিক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তাকে কলকাতার মাঝে অশ্বারোহণের প্রশিক্ষণ দেন, যা তার সমসাময়িক রক্ষণশীল সমাজবিরোধী।
বিবাহ ও পরবর্তী জীবন
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন সুখের হয় নি। ১৮৬৮ সালের ৫ জুলাই কাদম্বিনী নামে একটি কিশোরীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়; ঠাকুরবাড়িতে নববধূর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কাদম্বরী দেবী (১৮৫৯-১৮৮৪)। ইনি দেবর রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী ছিলেন এবং স্বামীর এই কনিষ্ঠ ভ্রাতাটিকে এত স্নেহ করতেন যে কবি সারা জীবন তাঁর অজস্র প্রসঙ্গে তাঁর উল্লেখ করেছেন। যোগ্য স্বামীর পতিব্রতা সহধর্মিনী হয়ে উঠেছিলেন কাদম্বরী; তাদের গৃহে গুনীসমাগম নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। এই মহিলাকে সরণ করে স্বামীর বন্ধু কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর সাধের আসন কাব্যের নামকরণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বৌঠানকে উৎসর্গ করেছিলেন একাধিক গ্রন্থ এবং তাঁকে স্মরণে রেখে রচনা করেছেন বহু গান।
পরিতাপের বিষয়, কাদম্বরী দেবী পঁচিশ বছর বয়সে ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিলে আত্মহত্যা করেন। রবীন্দ্রনাথ এই মর্মান্তিক শোক সারা জীবন ভুলতে পারেন নি। এ বাড়িতেই তার মৃত্যু ঘটে।জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্ত্রীর মৃত্যুর পর ক্রমে নিজেকে গুটিয়ে নেন এবং মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। নিজের কোন সন্তান না থাকায় সত্যেন্দ্রনাথের সন্তানদের সান্নিধ্য তিনি উপভোগ করতেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কলকাতা ছেরে চলে যান, বিহার প্রদেশের রাঁচির মোরাবাড়ি পাহাড়ে একটি বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে থাকেন এবং নির্জনবাসে জীবন কাটিয়ে দেন।
মৃত্যু
রাঁচিতেই ৭৬ বছর বয়সে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে এই প্রতিভাদীপ্ত পুরুষ পরলোক গমন করেন ১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ।
ঐতিহাসিক নাটকগুলো
পুরবিক্রম (১৮৭৪),
সরোজিনী (১৮৭৫),
অশ্রুমতি (১৮৭৯),
স্বপ্নময়ী (১৮৮২)।
হাস্যরসাত্মক নাটকগুলো
কিঞ্চিত জলযোগ (১৮৭৩),
এমন কর্ম আর করব না (১৮৭৭),
হঠাৎ নবাব (১৮৮৪),
অলীক বাবু (১৯০০)।
অনুবাদসমূহ
কালিদাসের অভিগ্ঞান শকুন্তলম ও মালতী মাধবা,
সুদ্রকের মৃচ্যতিকা,
মার্কাস অরেলিয়াসের মেডিটেশনস,
শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার,
বাল গঙ্গাধর তিলকের গীতারহস্য।
২+++++(+++++++++((((((!!!!++((((+((+((+!!!!!
No comments:
Post a Comment