Sunday, 31 July 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। বাংলা সাহিত্যের কবি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। Vol -814. Dt -01.08.2022. ১৫ শ্রাবণ ১৪২৯. সোমবার।

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

" যুগটা বড় বেশি মুখর। অনেক কাগজ অনেক পাঠক অনেক মতবাদের সামনে আপনাকে অহরহ দাঁড়াতে হচ্ছে। …একই সময়ে নিন্দা প্রশংসার ঝড়ের সামনে আপনাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। …শিল্পীর জীবনে এ এক অভিশাপ। আবার পরীক্ষাও। আমি তাই মনে করি। পরীক্ষা হচ্ছে শিল্পী তাঁর নিজের সৃষ্টিক্ষমতার উপরে অকাট্য বিশ্বাস রেখে তাঁর পরবর্তী রচনায় হাত দিচ্ছেন কিনা। …প্রত্যয়ের হাত শক্ত করে ধরে হাজার রকম মতামতের ঢেউয়ের উপর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া শিল্পীর আর কিছু করার আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।’


 মৃত্যু - ১ আগস্ট ১৯৮২ একজন বাঙালী স্বীকৃত সাহিত্যিক।

১৯১২ সালে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ২০ আগষ্ট। । তাঁর ডাকনাম ছিল ধনু। পিতা অপূর্বচন্দ্র নন্দী ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন, তাঁর মায়ের নাম চারুবালা দেবী। একই জেলায় আরেক প্রবাদপুরুষ সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ জন্মেছিলেন। মল্লবর্মণের মতো নন্দীরও দারিদ্র্য আর অভাব নিয়ে জন্ম। তাঁর ডাকনাম ছিল ধনু। পিতা অপূর্বচন্দ্র নন্দী ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন, তাঁর মায়ের নাম চারুবালা দেবী। অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৩০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন তিনি। ১৯৩২-এ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ওই কলেজেই স্নাতক স্তরে ভর্তি হন। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র ১৯৩৫ সালে প্রাইভেটে বিএ পাশ করেন। ১৯৩৬ সালে কাজের নিমিত্ত কলকাতা যান। তিনি প্রথম চাকরি পান বেঙ্গল ইমিউনিটিতে। তারপর টাটা এয়ারক্রাফ্ট, জে ওয়ালটার থমসন-এর পাশাপাশি কাজ করেন যুগান্তর সংবাদপত্রের সাব এডিটর হিসেবে এবং দৈনিক আজাদ পত্রিকায়ও ছিলেন। এছাড়াও তার কর্মক্ষেত্রে ছিল ইন্ডিয়ান জুটমিলস অ্যাসোসিয়েশনের ইংরেজি ও বাংলা ভাষার মুখপত্র মজদুর ও জনসেবক পত্রিকায়। ছোটবেলা থেকে তিনি সাহিত্যচর্চ্চা করতেন। স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৯৩১ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এক বছর গৃহবন্দী থাকাকালীন তার সাহিত্যচর্চার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জ্যোৎস্না রায় ছদ্মনামে।

এখানে বলে রাখা ভাল, কলকাতায় এসে তিনি সাগরময় ঘোষের সান্নিধ্যে আসেন। ও দেশ পত্রিকায় ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ছোটগল্প ‘রাইচরণের বাবরি’। মাতৃভূমি, ভারতবর্ষ, চতুরঙ্গ, পরিচয় পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের নজরে আসে জ্যোতিরিন্দ্রর লেখা। তাঁর লেখা ছোটগল্প ‘ভাত ও গাছ’, ‘ট্যাক্সিওয়ালা’, ‘নীল পেয়ালা’, ‘সিঁদেল’, ‘একঝাঁক দেবশিশু’ ও ‘নীলফুল এবং বলদ’ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৪৮ সালে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস সূর্যমুখী প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে তিনি সাহিত্যচর্চাকেই জীবনের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর উপন্যাসগুলো হল সূর্যমুখী, মীরার দুপুর, গ্রীষ্ম বাসর, নিশ্চিন্তপুরের মানুষ, হৃদয়ের রং, প্রেমের চেয়ে বড়, সর্পিল, তিন পরী ছয় প্রেমিক, নীল রাত্রি, বনানীর প্রেম।

১৯৩৬ সালে মাত্র চবিবশ বছর বয়সে তাঁর লেখা ছোটগল্প ‘নদী ও নারী’ পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশের পরপরই গল্পকার হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়ে। এখানে বলে রাখা ভাল, কবিতা লিখে শব্দ-সহবাস শুরু হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্রের। কিন্তু কোথাও কিছুর একটা অভাব বোধ করছিলেন তিনি। কী যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। ‘গদ্য চাই। গদ্য খুঁজছি।’ তাই আতিপাতি করে বই খোঁজা শুরু হল। বাড়িতে কারও সাহিত্যচর্চা ছিল না সে ভাবে। ফলে বই খুঁজে পেতে প্রথমে একটু হোঁচটই খেতে হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবার টেবিলের উপরে আইনের বইয়ের পাশেই মিলল সেই অমূল্য ধন! তিনটি উপন্যাস। তখন বয়স মাত্র এগারো থেকে বারো। রুদ্ধশ্বাসে পড়া হয়ে গেল রমেশচন্দ্র দত্তের লেখা সে তিন উপন্যাস। তার মধ্য দিয়েই যেন সাবালক হল সাহিত্যপাঠ। ধনু আর এখন পুকুরঘাটে যাওয়ার রাস্তার পাশের পুঁইমাচার সামনে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে না। উপন্যাস-গল্পের বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে চরিত্রেরা তখন তার সঙ্গে যেন কথা বলে, গল্প করে। কিন্তু তাতে বিপদ হল এক দিন। বাবার বন্ধু বাড়িতে এসেছেন। তখন ধনু বসে উপন্যাস পড়ছে। সামনে আরও দু’-চারটে উপন্যাস-গল্পের বই ছড়ানো। বাবার বন্ধু তো দেখে অবাক। এগারো-বারো বছরের ছেলে এ রকম উপন্যাস পড়ছে! ‘‘এত অল্প বয়সের ছেলেকে এ সব উপন্যাস-টুপন্যাস পড়তে দেবেন না,’’ বলে তিনি চলে গেলেন। ‘অবাক হলাম বাবাকে দেখে। তিনি কিন্তু একবারও আমাকে বললেন না যে এখনও তোমার উপন্যাস পড়ার সময় হয়নি’, নিজের বাবা সম্পর্কে লিখছেন জ্যোতিরিন্দ্র।
অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৩০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন তিনি। ১৯৩২-এ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ওই কলেজেই স্নাতক স্তরে ভর্তি হলেন জ্যোতিরিন্দ্র এবং ১৯৩৫ সালে প্রাইভেটে বিএ পাশ করেন তিনি। ১৯৩৬ সালে কর্মসূত্রে কলকাতা আসেন তিনি ও প্রথম চাকরি পান বেঙ্গল ইমিউনিটিতে। তারপর টাটা এয়ারক্রাফ্ট, জে ওয়ালটার থমসন-এর পাশাপাশি কাজ করেছেন যুগান্তর সংবাদপত্রের সাব এডিটর হিসেবে এবং মৌলানা আজাদ খান সম্পাদিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। তার কর্মক্ষেত্রে ছিল ইন্ডিয়ান জুটমিলস অ্যাসোসিয়েশনের ইংরেজি ও বাংলা ভাষার মুখপত্র মজদুর ও জনসেবক পত্রিকা।
আবার তাঁর (জ্যোতিরিন্দ্র) পুত্র তীর্থঙ্করবাবু বলছেন, ‘‘বাবার সঙ্গে লেখা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেছি। তিনি কথা শুনেছেন মন দিয়ে। মনঃপূত না হলে তখন নিজের মতটা বলেছেন।’’ আসলে নিজের বাবার কাছ থেকে মুক্তমনা সংস্কৃতির যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, তা থেকে বিচ্যুত হননি জ্যোতিরিন্দ্র। কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও ক্রমশ গদ্যই সঙ্গী হয়ে গেল তাঁর। প্রথমে অমুক সমিতি, তমুক ক্লাব, এ পাড়া, ও পাড়ার হাতে লেখা কাগজে গল্প পাঠানো চলছিল নিয়মিত। ছোট হলেও একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছিল গল্পকারের পরিচয়। এই করতে করতে স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে গেল। কলেজে পড়াকালীন মঁপাসার একটা গল্প অনুবাদ করে ঢাকার এক পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন তিনি। সেটি ছাপা হল। ছাপার হরফে সেই প্রথম নিজের নাম দেখলেন জ্যোতিরিন্দ্র। সে কী আনন্দ! তার এক মাস পরেই ওখানে একটি মৌলিক গল্প পাঠালেন। ছাপা হল সেটিও। এর মধ্যেই ঘটল সেই ঘটনা। স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করার জন্য তাঁকে সন্ত্রাসবাদী অ্যাখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়! জ্যোতিরিন্দ্র লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। চার মাস জেলে আটক করার পর আমাকে স্বগৃহে অন্তরীন করা হয়।’ শুধু অন্তরিন করে রাখাই নয়, চাপলো সরকারি নিষেধাজ্ঞাও—কোনও পত্রপত্রিকায় লেখা যাবে না। কিন্তু মাথার মধ্যে শব্দেরা যে ভর করছে, ভনভন করছে তারা। অতঃপর ‘জ্যোৎস্না রায়’-এর আগমন ধরণীতে! ‘জ্যোৎস্না রায়’ ছদ্মনামেই চলল সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। কিন্তু সে সব লেখার কিছুই নিজের কাছে রাখা গেল না। দেশভাগ হল। ও পার বাংলার আলমারিতেই পড়ে রইলেন ‘জ্যোৎস্না রায়’!
-সময় মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে ওঠে। ভাত-কাপড়-বাসস্থানের অভাবের সঙ্গে আরো কিছু প্রয়োজনীয় অভাব দেখা দেয়। বাঁচার মতো বাঁচার জন্য বিনোদন-সংস্কৃতি চায়। এ-সময়ে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ থেকে গজিয়ে ওঠেন একঝাঁক সাহিত্যিক। মূলত যাঁরা সাহিত্য-সংস্কৃতির নেতৃত্বে আসীন হন, তাঁদের পদচারণে এ-সময় বাংলাসাহিত্যের ভূমি উর্বর হয়। নতুন অভিনব জীবনের কথাকাররা বেরিয়ে আসেন তিক্ত-অভিজ্ঞতায় বলিষ্ঠ হয়ে। কাজী নজরুল ইসলাম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদার, সন্তোষকুমার ঘোষ, মনোজ বসু, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখ। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্প বা উপন্যাসে ব্যক্তিক ও পারিবারিক অস্তিত্বের সংকট নিয়ে যে-কাহিনি গড়ে তুলেছেন তা এককথায় মর্মস্পর্শী বা হৃদয়স্পর্শী বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর রচনার বিষয়ে প্রবলভাবে অপবাদ দেওয়া হয় যে, তিনি কবিতা দ্বারা আক্রান্ত-অধিকৃত। কথাটা হয়তো পুরোপুরি সত্য। এও তো চিরসত্য, তাঁর লেখা বাস্তবতা থেকে কখনো বিচ্যুত হয়নি।

তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দের মতোই জ্যোতিরিন্দ্র চিত্রময়তাকে আশ্রয় করে এগিয়ে যান, যার কারণে চিত্রকল্প-চিত্রকলা উপমা-রূপক প্রতীক ইত্যাদি কবিতার অলংকার গদ্যে অবিরল ধারায় বহুল ব্যবহার করেছেন। তাতে অবশ্যই রচনার মান উতড়ে গেছে। জ্যোতিরিন্দ্রের সাহিত্যের প্রধান বিষয় যদিও মানুষ এবং প্রকৃতি। তাঁর গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলো দারিদ্র্যর সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। কিন্তু তিনি কখনো শ্রেণিসংগ্রামের কথা ভাবেননি। তার প্রকৃতি বাস্তবিকই নিজের অর্থাৎ স্বতন্ত্র, রবীন্দ্রনাথ বা বিভূতির প্রকৃতির মতো এক নয়। তাই তো দেখা যায় মানুষ এবং প্রকৃতিকে তিনি একটা সামান্তরালে এনে দাঁড় করিয়েছেন। এও সত্য, তাঁর রচনা যৌনতায় ভরপুর; অনেকটা যৌনতাই উপজীব্য যেন। তারপরও তাঁর মানুষ, তাঁর প্রকৃতি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ বা প্রকৃতিকে নিজের মতো করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমানভাবে তাঁর গল্প-উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন। শুধুমাত্র পটভূমিকায় বিরাজিত নয়, প্রকৃতি কখনো নিষ্ঠুর, শুধুই পেলব নয়, মানুষের অন্তঃপ্রকৃতি যেমন, বিমুগ্ধতা তাকে বিবরে অথবা কোটরে প্রবেশ করিয়েছে, চরিত্র হয়েছে সজীব-সাবলীল। তাই তাঁর গল্প-উপন্যাস আকাশপ্রমাণ সাফল্য বয়ে এনেছে। সত্তর বছরের আয়ুষ্কালে দরিদ্রতা-স্বেচ্ছাবৃত-নিঃসঙ্গতায় কেটেছে। মন্বন্তর-মহামারি-দাঙ্গা-দেশভাগের কারণে জন্মভূমির মায়া ত্যাগ।

তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। আবার কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলো এসেছে নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের বিচিত্র এলাকা থেকে। কখনো মনে হয়েছে তারই মতো ভেসে এসেছে কুলহারা-স্বজনহারা সব, ১৯৩৪ সালে জীবিকার সন্ধানে কলিকাতায় (কলকাতা) চলে যান, কলকাতা গিয়েও প্রথম জীবনে দীর্ঘসময় টিউশনিই ছিল তাঁর পেশা, যদিও অনেক পরে সাংবাদিকতার পেশাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন। নির্লিপ্ত আর নির্জনতাপ্রিয় মানুষটি জীবনের অনেকগুলো বছর ক্ষুদ্র পরিসরের মেসবাড়ির জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং সেখানকার কত বাস্তব জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন; কত সমস্যা কত কাহিনির জন্ম তিনি দেখেছেন এখানে। মানুষ এবং মানুষের বিচিত্র ঘটনা-উপঘটনা এবং তাদের সংগ্রামমুখর পথচলা সবই তার হৃদয়কে স্পর্শ করে গেছে। তাদের পেশা-বয়স-মানসিকতা সবই ভিন্ন, বারো ঘর এক উঠোন (১৯৫৫) উপন্যাসে বস্তিজীবনের কাহিনি বিধৃত। অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী উপন্যাসে তৎকালীন বাংলাদেশের রূপক নির্মাণ। নির্মম ও দুঃসাহসিকতায় এবং সে-নিরাসক্তি প্রায় নিষ্ঠুরতার শামিল। তাকে তিনি প্রজ্বালিত অগ্নিগিরির মতো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন উপন্যাসে।

১৯৫৩ সালে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মীরার দুপুর’। এই উপন্যাস সম্বন্ধে কেউ তাঁকে বলেন ‘সুন্দরের কারিগর’, কেউ বলেন, ‘শব্দের জাদুকর’— তিনি বাংলা সাহিত্যের এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। বিংশ শতকের ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে বাংলা সাহিত্যের জন্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটা যুগ। গল্প-উপন্যাসের যে-জন্মবেদনা এবং সাহিত্যিকদের উঠে আসার সময়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯২৪-২৮) শুরু এবং শেষের সীমা নির্দিষ্ট ছিল পাশ্চাত্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯, যার শেষ হয় ১৯৪৫ আনুষ্ঠানিকভাবে। ১৯৪৩-এর প্রথম দিকে প্রাকৃতিক ঝড়, দুর্যোগ এবং মন্বন্তর, ১৯৪৬-এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বাস্ত্তহারাদের সহায়-সম্বল হারানোর তীব্র বুকভাঙা যন্ত্রণা, ১৯৪৭-এ দেশভাগ, দুটো স্বাধীন দেশের মানচিত্র অর্থাৎ ধর্ম এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বিভাজিত দেশের উদ্বাস্ত্ত সমস্যা – সেই গভীর সমস্যা থেকেঅবক্ষয়-অনন্বয়-অস্তিত্বের সংকট, উদ্ভব ঘটে নতুন ধনিকশ্রেণির, প্রান্তিক মানুষকে চুষে খাওয়ার সেই রক্তচোষার দলেরা ঐক্যবদ্ধ হয়। মুখোশ খুলে সামনে আসে পুঁজিবাদি-কালোবাজারি-মুনাফাখোর-মজুতদার-দাদন ব্যবসায়ী – ১৯৫০ অবধি এদের দৌরাত্ম্যের কাছে হার মানে রাষ্ট্র, ক্রমে ক্রমে তা আবার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
ছোটবেলা থেকে তিনি সাহিত্যচর্চ্চা করতেন। স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৯৩১ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এক বছর গৃহবন্দী থাকাকালীন তার সাহিত্যচর্চার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জ্যোৎস্না রায় ছদ্মনামে সোনার বাংলা ও ঢাকার থেকে প্রচারিত বাংলার বাণী পত্রিকায় তাঁর লেখা কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। কলকাতায় এসে তিনি সাগরময় ঘোষের সান্নিধ্যে আসেন ও দেশ পত্রিকায় ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ছোটগল্প রাইচরণের বাবরি। মাতৃভূমি, ভারতবর্ষ, চতুরঙ্গ, পরিচয় পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের নজরে আসে জ্যোতিরিন্দ্রর লেখা। তাঁর লেখা ছোটগল্প ভাত ও গাছ, ট্যাক্সিওয়ালা, নীল পেয়ালা, সিঁদেল, একঝাঁক দেবশিশু ও নীলফুল এবং বলদ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৪৮ সালে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস সূর্যমুখী প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে তিনি সাহিত্যচর্চাকেই জীবিকা হিসাবে বেছে নেন। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ১৯৬৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সুরেশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ও ১৯৬৬ সালে আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হন। তাকে কল্লোল যূগের অন্যতম শ্রেষ্ট ছোটগল্পকার বলে মনে করা হয়। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ২০টি ও গল্পগ্রন্থ আছে তিপান্নটি।

আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন লেখকই হবেন। শুধু মাত্র লেখার প্রয়োজনে বস্তিতে থাকতে পর্যন্ত কার্পণ্য করেননি। তিনি বাস্তব অভিজাতার আলোকে সব কিছু উপলব্ধি করেন তা আমরা তাঁর লেখা থেকে পাই।

ছোটবেলার ধনু, বড় হয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী নামে লিখলেন, ‘আজ আমি বুঝি তখনও আমার ভাল লাগার বোধ জন্মায়নি। …কোন‌্ দৃশ্য, কোন‌্ শব্দ— কিসের গন্ধ আমাকে আনন্দ দেবার জন্য অপেক্ষা করছিল তখনও জানতে পারিনি, বুঝতে পারিনি।’ আর সেই না বোঝাকেই আজীবন বুঝতে চেয়েছিলেন লেখক জ্যোতিরিন্দ্র, একের পর এক লেখায়। কখনও তাঁকে বলা হয়েছে যে তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখেন, কখনও বলা হয়েছে লেখার মাধ্যমে আদর্শ প্রচার করছেন। কিন্তু সে সব কিছুকে প্রবল ভাবে অস্বীকার করেছেন জ্যোতিরিন্দ্র। শুধু বিশ্বাস করেছেন, ‘মনে হয়, কোনো রচনাই ‘নিখুঁত’ হল না ‘সর্বাঙ্গীণ সুন্দর’ হল না— আরও ভাল করে লেখা উচিত ছিল।’

প্রাতঃভ্রমণের নেশা ছিল ঠার্কুদার। ঠার্কুদার হাত ধরে রেললাইন পার হয়ে একদম শহরের শেষ সীমায় এক খালের কাছে সে দিন চলে গিয়েছিল ধনু। তারপর সেখান থেকে খালের ধারে হেলিডি সাহেবের বাংলোর কাছে এক ফুলবাগানে। বুড়ো দারোয়ান ঠার্কুদাকে খুব ভালবাসতেন। দারোয়ান গেট খুলে দিলেন। কিন্তু বাগানে ঢুকেই চমকে উঠল ধনু। এই, এই বুঝি সেই অবিশ্বাস্য! ধনুর মাথার সামনে একটা গাছের দুটো ডালে দুটো সদ্য ফোটা গোলাপ। একটু একটু শিশির লেগে রয়েছে পাপড়ির গায়ে। সূর্য উঠছে সবে। তার রক্তাভ আলো এসে পড়েছে পাপড়িতে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি নীল প্রজাপতি একটা কলির বোঁটায় এসে বসল। পলক পড়ছে না ধনুর। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ভিতরটা কী রকম করছে যেন।

জ্যোতিরিন্দ্র লিখছেন, ‘ভাললাগা কাকে বলে, ভাল দৃশ্য কী সেদিন প্রথম টের পেলাম। আর গন্ধ। নির্জন ঊষার সেই বাগানে গোলাপের মৃদু কোমল গন্ধে আমার বুকের ভিতর ছেয়ে গেল। সেই গন্ধ বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। যেন একটা আশ্চর্য সম্পদ আহরণ করে বাড়ি ফিরলাম।’

বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে আসা প্রকৃতির গন্ধের সঙ্গে সেই যে সম্পর্কের শুরু, তা আজীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি। আমৃত্যু। আসলে এক এক জনের স্মৃতি এক এক জিনিসের অনুরণন নিজের মতো করে ধরে রাখে। কখনও কোনও দৃশ্য, কখনও গন্ধ, কখনও আবার রং, এক এক জনের ক্ষেত্রে স্মৃতির অনুষঙ্গের বিষয়গুলি এক এক রকম। জ্যোতিরিন্দ্রের কাছে তা ছিল গন্ধ। তিনি প্রয়োজন মতো সেই সব স্মৃতির অনুষঙ্গে ডুব দিয়েছেন। ডুব দিয়ে কখনও ‘ভাদ্র মাসে জলে ডোবানো পাটের পচা গন্ধ থেকে বা অঘ্রাণের পাকা ধানের গন্ধ থেকে বা কখন আবার পুঁটি, মৌরলা মাছের আঁশটে গন্ধ’ থেকে সৃজনের প্রয়োজনীয় উপকরণটুকু নিয়ে উঠে এসেছেন। সকলের চোখের আড়ালে গিয়ে বসে পড়েছেন নিজের লেখার খাতার সামনে। তার পর পাতা জুড়ে জন্ম নিয়েছে একের পর এক দৃশ্যাবলি। ‘বুটকি-ছুটকি’, ‘গিরগিটি’, ‘বনের রাজা’-সহ অনেক গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে ছোটবেলার নানা রকম গন্ধের স্মৃতি। জ্যোতিরিন্দ্রের নিজের কথায়, ‘সব ক’টা ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সেই শৈশব থেকে আমার নাকটা অতিমাত্রায় সজাগ সচেতন।

পরবর্তী জীবনে সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে এই গন্ধ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’ তিনি নিজের বিয়ের মেয়ে দেখতে গিয়ে তাও চমকপ্রদ।বিলাসিতা নেই, বন্ধুবান্ধব নেই, আড্ডা নেই, অহেতুক সময় নষ্ট নেই। অন্তর্মুখী অথচ স্পষ্টবক্তা, গভীর অথচ সূক্ষ্ম রসবোধ রয়েছে, যাঁরা জ্যোতিরিন্দ্রকে কাছ থেকে চিনতেন, তাঁদের কাছে এমন ভাবেই ধরা দিতেন তিনি। যেমন বিয়ের জন্য পাত্রী (পারুল নন্দী) দেখতে গিয়েছেন। পাত্রী দেখা শেষের মুখে। হঠাৎ কোনও রকম ভনিতা ছাড়াই পাত্রীর দাদাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘‘আমি কত মাইনে পাই জানতে চাইলেন না তো!’’ পাত্রীর দাদা একটু বিব্রত। কিন্তু তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নিজেই বলে দিলেন, ‘‘আমি মাইনে পাই একশো তিরিশ টাকা।’’ মেয়ের বাড়ির সকলে একটু অবাকই হয়েছিলেন। কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দেননি জ্যোতিরিন্দ্র। সাদামাটা মানুষ তিনি। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, বিয়ে করতে গিয়েছেন তিনি। একরাশ ঝাঁকড়া চুল, সাজগোজের মধ্যে শুধু লন্ড্রি থেকে কাচানো নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি। ব্যস, ওইটুকুই। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনিই বর!বিবাহ ও কর্মজীবনতখন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী কলকাতার জে ওয়ালটার থমসন-এ কর্মরত। কামিনীকুমার ধরচৌধুরী ও ক্ষীরোদাদেবীর মধ্যম কন্যা পারুলের সঙ্গে ১৯৪৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর বিয়ে হয়। ইংরেজ আমলের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছিলেন পারুল, ভাল বাঁশি ও সেতার বাজাতে পারতেন।

বিয়ের আগে পারুলদেবীকে দেখতে গেলেন গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। সঙ্গে নিয়ে গেলেন বন্ধু গণেশ দত্তকে। গণেশবাবুর গায়ের রং ছিল মিশমিশে কালো। বিয়ের পরে তিনি পারুলদেবীকে বলেছিলেন— ও পাশে থাকলে আমায় একটু দেখতে ভাল লাগবে, তাই নিয়ে গিয়েছিলাম গণেশকে।

লেখার সময় আধশোওয়া হয়ে বসতেন আরাম কেদারায়। সামনের দক্ষিণ দিক পুরো খোলা। সেখান থেকে প্রচুর আলো এসে পড়ছে ছিপছিপে একহারা চেহারায়। তিনি ভাবছেন আর লিখছেন। হঠাৎ করেই হয়তো মেয়ে বা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘অমুক চরিত্রের কী নাম দেওয়া যায় বলো তো?’’ তাঁরা হয়তো নাম বলতেন দু’-একটা। কিন্তু কোনওটাই মনঃপূত হতো না তাঁর। স্ত্রী হয়তো জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ওই গল্পটার নাম কী দিলে?’’ নিরাসক্ত গলায় উত্তর আসত, ‘‘সে পরে দেখবে’খন।’’ আসলে নিজের লেখা নিয়ে আগাম কিছু বলাটা মোটেই পছন্দ করতেন না তিনি। 
===={{={{{{{{{========{{{{{{{{{====={{{===






Saturday, 30 July 2022

মহাপ্রয়াণ দিবস। জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী মোহাম্মদ রফি। Vol -813. Dt -31.07.2022. ১৪ শ্রাবণ,১৪২৯. রবিবার। The blogger in literature e-magazine

মোহাম্মদ রফি

৩১ জুলাই, ১৯৮০ইং তারিখ বৃহস্পতিবার রাত ১০:৫০ ঘটিকায় উপমহাদেশের অমর সঙ্গীতকার মোহাম্মদ রফি'র মহাপ্রয়াণ ঘটে। আকস্মিকভাবে মাইওকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হৃদজনিত সমস্যায় ভুগে যখন রফি'র মৃত্যু ঘটে, তখন তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। তাঁর শেষ গানটি ছিল আস পাস ছবির শ্যাম ফির কিউ উদাস হ্যায় দোস্ত। লক্ষ্মীকান্ত-পিয়ারেলালের রচনায় এ গানটি রেকর্ড করার কয়েক ঘণ্টা পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রফি। মৃত্যু পরবর্তী সময়ে মোহাম্মদ রফি'কে জুহু মুসলিম গোরস্থানে কবর দেওয়া হয়।


প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে মুম্বাইয়ের সর্ববৃহৎ শবযাত্রা হিসেবে রফি'র শবযাত্রায় দশ সহস্রাধিক ব্যক্তি অংশ নিয়েছিলেন। ২০১০ সালে তার কবরস্থানটি ভেঙে ফেলা হয় নতুন মৃতদেহ সমাধি দেয়ার জন্য। মূল সমাধি ভেঙে ফেলার দরুন এর সন্নিকটে একটি নির্দিষ্ট নারিকেল গাছকে তার প্রতীকী সমাধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

মৃত্যু পরবর্তীকালে তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একসময় সুরকার হিসেবে নিসার বাজমী (পরবর্তীতে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হন) বলেন, "যখন রফিকে তিনি তাঁর দেনা পরিশোধ করতে পারেননি, তখন রফি এক রূপির বিনিময়ে তার জন্য একটি সঙ্গীত গান ও তাঁকে দায়মুক্ত করেন। এছাড়াও তিনি প্রযোজকদের বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।"

লক্ষ্মীকান্ত-পিয়ারেলাল জুটির অন্যতম লক্ষ্মীকান্ত তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন যে, "রফি সর্বদাই অর্থ সাহায্য করেছেন অনেককেই; কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি অর্থ ফেরতের আশা করেননি।"

শাস্ত্রীয় ও আধুনিক গানের অন্যতম জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মান্না দে তার সমসাময়িক মোহাম্মদ রফি সম্পর্কে বলেন যে, "তিনি সকলের চেয়ে সেরা গায়ক ছিলেন। রফি এবং আমি সকল স্তরের গানই গেতে পারি এবং তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন ভদ্রলোক। তিনি আমার চেয়েও সেরা গায়ক ছিলেন এবং আমি অবশ্যই বলবো যে, কেউই তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি যখনই যা চেয়েছেন, তা-ই করতে পেরেছেন। আমরা সকলেই একবাক্যে ও কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্বীকার করি।"

প্রবীণ অভিনেতা শাম্মী কাপুর তার সম্পর্কে বলেন, "আমি রফিকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমি যখনই গান রেকর্ড করতে যাই, তখনই মোহাম্মদ রফি'কে খুঁজে পাই। এছাড়াও পর্দায় গানকে কিভাবে উপস্থাপন করতে হবে এ বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে পরামর্শ নিতাম। ফলে, তিনিও গানে আমার অংশগ্রহণকে বেশ পছন্দ করতেন।

ভারতের পাঞ্জাব এলাকার অমৃতসর গ্রামের কাছাকাছি কোটলা সুলতান সিংয়ের অধিবাসী হাজী আলী মোহাম্মদের ৬ষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ রফি ২৪ ডিসেম্বর১৯২৪ ।সঙ্গীত শিল্পী মোহাম্মদ রফি'র ডাক নাম ছিল ফিকো। তার নিজ গ্রামে এক ফকিরের ভজন গানকে অনুকরণ করে গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। জীবিকার সন্ধানে তার বাবা হাজী আলী মোহাম্মদ ১৯২০ সালে লাহোরে চলে যান এবং ভাট্টি গেটের নূর মহল্লায় একটি স্যালুনের মালিক হন।

তার বড় ভাই মোহাম্মদ দ্বীনের বন্ধু আবদুল হামিদ লাহোরে অবস্থানকালীন সময়ে রফি'র সঙ্গীত প্রতিভা দেখে তাকে গান গেতে সাহস জুগিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি রফি'র শ্যালক হয়েছিলেন। আবদুল হামিদ পরবর্তী সময়ে তার পরিবারের বড়দের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করে তাকে মুম্বাই পাঠান। ১৯৪৪ সালে মোহাম্মদ রফি বোম্বেতে গেলে সঙ্গী হিসেবে তার সাথে আবদুল হামিদও গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, উস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খান, পণ্ডিত জীবনলাল মত্তো এবং ফিরোজ নিজামী'র মতো প্রথিতযশা শিল্পীদের কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন।

১৩ বছর বয়সে রফি লাহোরের প্রথিতযশা শিল্পী কে. এল. সাইগলের সাথে জীবনের প্রথম দর্শক-শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়ে কনসার্টে গান পরিবেশন করেন।১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের নির্দেশনায় লাহোরে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নিজেকে অভিষেক ঘটান। পাঞ্জাবী ভাষায় নির্মিত গুল বালুচ (১৯৪৪ সালে মুক্তি পায়) চলচ্চিত্রে জিনাত বেগমের সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীত "সোনিয়ে নি, হেরিয়ে নি" গানটি গান।একই বছরে মোহাম্মদ রফি অল ইন্ডিয়া রেডিও'র লাহোর সম্প্রচার কেন্দ্রে গান পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ পান।

১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের পরিচালনায় গুল বালোচ ছবির মাধ্যমে সঙ্গীতে পেশাগতভাবে অভিষেক ঘটান রফি। পরের বছর বোম্বের চলচ্চিত্র গাও কি গৌরী ছবিতে নৈপথ্য গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটান। এছাড়াও রফি লায়লা-মজনু (১৯৪৫) এবং জুগনু চলচ্চিত্রে সংক্ষিপ্তভাবে, অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। লায়লা-মজনু চলচ্চিত্রে 'তেরা জ্বালা' কোরাস গানে তাকে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে গাইতে দেখা যায়।

১৯৪৪ সালে মোহাম্মদ রফি বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) চলে আসেন। তার শ্যালক সেখানে তাকে ভেন্দী বাজারের মতো ব্যস্ততম এলাকায় দশ ফুট বাই দশ ফুট কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে তানভীর নাকভী নামীয় একজন কবি - আবদুর রশীদ কারদার, মেহবুব খান এবং অভিনেতা-পরিচালক নাজিরের মতো চলচ্চিত্র পরিচালকের সাথে রফিকে পরিচয় করে দেন। শ্যাম সুন্দর তখন মুম্বাইয়ে অবস্থান করছিলেন। তিনি রফিকে আবারো জিএম দুররানী'র সাথে দ্বৈত সঙ্গীতে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। শ্যাম সুন্দরের গাঁও কি গোরী চলচ্চিত্রের আজি দিল হো কাবু মে তো দিলদার কি এ্যায়সী তাঈসী গানের মাধ্যমে মোহাম্মদ রফি হিন্দী চলচ্চিত্রে প্রথম গান রেকর্ড করেন।

১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধী নিহত হবার পর হুসনলাল ভগতরাম-রাজেন্দ্র কৃষাণ-রফি ত্রয়ী একরাত্রিতেই কালজয়ী শুনো শুনো এই দুনিয়াওয়ালো, বাপুজী কি অমর কাহিনী গান রচনা করে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।[১৩] এরপর তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহ্‌রু'র আমন্ত্রণে গানটি পুনরায় পরিবেশন করে উপস্থিত সকলকে শোনান। ১৯৪৮ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নেহরু'র কাছ থেকে রৌপ্য পদক গ্রহণ করেন মোহাম্মদ রফি।

১৯৪৯ সালে নওশাদ (চাদনী রাত, দিল্লাগী, দুলারী); শ্যাম সুন্দর (বাজার); হুসনলাল ভগতরামের (মীনা বাজার) প্রমূখ সঙ্গীত পরিচালকদের নির্দেশনায় একক সঙ্গীতে অংশ নেন। নওশাদের নির্দেশনায় শ্যাম কুমার, আলাউদ্দীন এবং অন্যান্যদের সঙ্গে রফি'র প্রথম গান ছিল ১৯৪৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পেহলে আপ ছবির হিন্দুস্তান কি হাম হ্যায় গানটি। এভাবেই তিনি হিন্দি ভাষায় তার প্রথম গান রেকর্ড করেন। এছাড়াও রফি দু'টি হিন্দী ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৪৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত লায়লা মজনু চলচ্চিত্রের তেরা জ্বালা জিস নে দেখা গানের দৃশ্যে অতিথি শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

তিনি নওশাদের সহযোগিতায় অনেকগুলো গান গেয়েছেন। ১৯৪৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শাহজাহান চলচ্চিত্রে কুন্দন লাল সায়গলের সাথে মেরে স্বপ্ন কি রানি, রুহী রুহী নামের কোরাসে অংশ নেন। মেহবুব খানের আনমল ঘড়ি (১৯৪৬)-তে তেরা খিলোনা তোতা বালক এবং জুগনু (১৯৪৭) চলচ্চিত্রে ইয়াহান বাদলা ওয়াফা কা গানে নূর জাহানের সাথে দ্বৈত সঙ্গীতে কণ্ঠ দেন।

ভারত বিভাজনের সময় মোহাম্মদ রফি ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তার পরিবারও বোম্বেতে চলে আসে। কিন্তু ঐসময়কার অন্যতম জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী নূরজাহান পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হবার সিদ্ধান্ত নেন। নূরজাহান সেখানে আহমেদ রুশদী'র সাথে নতুন করে সঙ্গীত জুটি বাঁধেন।
রফি ঐ সময়ের জনপ্রিয় সঙ্গীতকার হিসেবে কুন্দন লাল সায়গল, তালাত মেহমুদের গানগুলো গভীরভাবে অনুসরণ করেন। তবে সবচেয়ে বেশি অনুরক্ত ও প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন জি. এম. দূররাণী'র প্রতি, যার গানগুলোকে নিজের গানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি তার আদর্শকে ধারণ করতে গিয়ে ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হাম সব চোর হ্যায় ছবিতে হামকো হাসতে দেখ জামানা জ্বলতা হ্যায় এবং ১৯৫০ সালে বেকসুর ছবিতে খবর কিসি কো নাহিন, ও কিধার দেখতে-এর মতো গানে প্রভাব ফেলেছিলেন।


রফি এবং আব্দুল হামিদ বোম্বেতে অবস্থানকালীন চল্লিশের দশকে দুই বোনকে বিয়ে করেন। রফি পূর্বে তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু অভিবাসন আইনের দরুন তাকে ভারতে আনতে পারেননি। দেশ বিভক্তির ফলে তার স্ত্রী পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থান করেন। প্রথম সংসারে তার একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। বোম্বেতে অবস্থানকালীন তিনি বিলকিস নাম্নী এক রমণীকে ২য় বারের মতো বিয়ে করেন। তাদের ২য় সংসারে ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা আছে। তিনি মদপান করতেন না। একজন ধার্মিক ও বিনয়ী ব্যক্তি হিসেবে সর্বত্র সকলের কাছে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

তিনি পরিবারের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন বলে জানা যায়। রেকর্ডিং রুম থেকে বাড়ীতে এবং বাড়ি থেকে রেকর্ডিং রুমে আসা-যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তার জীবন। চলচ্চিত্রের যে-কোন ধরনের জলসায় তাকে কখনো অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এছাড়াও, ধূমপান কিংবা মদপান করতেন না রফি। তিনি ভোর ৩টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ও একাধারে সঙ্গীতের রেওয়াজ বা সঙ্গীত চর্চা করতেন। প্রধানত ক্যারম, ব্যাডমিন্টন এবং ঘুড়ি উড়াতেই তার আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।

রফি'র ছোট ভাই মোহাম্মদ সাদ্দিকী এখনও বেঁচে আছেন এবং পরিবার নিয়ে পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থান করছেন।

সঙ্গীত জীবন

মোহাম্মদ রফি তার সুদীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে অনেক নামকরা সঙ্গীত পরিচালকের দিক-নির্দেশনায় বিভিন্ন ধরনের গান গেয়েছেন। তন্মধ্যে অমর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নওশাদের পরিচালনায়ই গান গেয়েছেন বেশি। এছাড়াও, ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে মোহাম্মদ রফি ও.পি. নায়ার, শঙ্কর জয়কিষাণ এবং এস.ডি.বর্মনের সুরেও অনেক গান গেয়েছেন।

নওশাদের সাহচর্য্যে

নওশাদের পিতার কাছ থেকে একটি সুপারিশ পত্র এনে মোহাম্মদ রফি তাকে দেখান। ১৯৪৪ সালে পেহলে আপ ছবিতে নওশাদের নির্দেশনায় রফি তার প্রথম গান হিসেবে "হিন্দুস্তান কে হাম হে" গান। ১৯৪৬ সালে দ্বৈত সঙ্গীতরূপে আনমল ঘড়িতে গান রেকর্ড করেন। মোহাম্মদ রফি'র পূর্বে নওশাদের প্রিয় কণ্ঠশিল্পী ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদ। একদিন রেকর্ডিং চলাকালীন সময়ে তালাত মাহমুদকে ধুমপানরত অবস্থায় দেখতে পান নওশাদ। এতে তিনি তার প্রতি ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হন ও রাগ করেন। ফলে বৈজু বাওরা ছবির সকল গানেই মোহাম্মদ রফিকে অন্তর্ভুক্ত করেন নওশাদ।] নওশাদের সাহচর্য্যে রফি নিজেকে হিন্দী সিনেমার ভুবনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও কিংবদন্তি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বৈজু বাওরা (১৯৫২) ছবির গান হিসেবে - ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে এবং মন তারপাত হরি দর্শন কো আজ রফি'র কণ্ঠকে অবিসংবাদিত তারকা খ্যাতি এনে দেয়।[১০] নওশাদের দিক-নির্দেশনায় সর্বমোট ১৪৯টি সঙ্গীত পরিবেশন করেন রফি। তন্মধ্যে তার সলো বা একক সঙ্গীত ছিল ৮১টি।

শচীন দেব বর্মণের সাহচর্য্যে

শচীন দেব বর্মণ বিখ্যাত অভিনেতা দেব আনন্দ এবং গুরু দত্তের মাধ্যমে রফিকে তার নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। রফি বর্মণের সঙ্গীত পরিচালনায় পিয়াসা (১৯৫৭), কাগজ কে ফুল (১৯৫৯), তেরে ঘর কে সামনে (১৯৬২), গাইড (১৯৬৫), আরাধনা (১৯৬৯) এবং অভিমান (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এস. ডি. বর্মণ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সঙ্গীত পরিচালক যিনি নওশাদের পাশাপাশি মোহাম্মদ রফিকেও তার সুরারোপিত অধিকাংশ গানে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন।

সঙ্গীত পরিচালক রবি'র সাথে

রফি তার প্রথম ফিল্মফেয়ার পদক পান চৌদভীন কা চাঁদ (১৯৬০) ছবির সঙ্গীত পরিচালক ও গীতিকার রবি কর্তৃক লিখিত সূচনা সঙ্গীতের জন্য। ১৯৬৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নীল কমল ছবিতে "বাবুল কি দোয়ায়েন লেটি জা" গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। মোহাম্মদ রফি যখন গানটি রেকর্ডিং করেন তখন সেসময় তিনি বেশ আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা বিবিসিতে সাক্ষাৎকারের সময় এ বিষয়ে প্রসঙ্গান্তরে কথাটি তুলে ধরেছিলেন। রবি এবং রফি'র গীত ও সুরে অন্যান্য অনেক গান রয়েছে - চায়না টাউন (১৯৬২), কাজল (১৯৬৫) এবং দো বদন (১৯৬৬) চলচ্চিত্রসমূহে।

সঙ্গীত পরিচালক জয় কিষাণের সাথে

হিন্দী চলচ্চিত্র শিল্পে মোহাম্মদ রফি এবং সঙ্গীত পরিচালক শঙ্কর জয়কিষাণের মধ্যে চমৎকার ও গভীর সু-সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। জয়কিষাণের সঙ্গীত পরিচালনা ও নির্দেশনায় রফি বেশ কিছু ছবির গানে কণ্ঠ দেন যা শাম্মী কাপুর এবং রাজেন্দ্র কুমারের ঠোঁটে দেখা যায়। রফি'র ৬টি ফিল্মফেয়ার পদক প্রাপ্তির মধ্যে ৩টিই ছিল শঙ্কর জয়কিষাণের সঙ্গীত নির্দেশনা ও পরিচালনায়। তেরি পিয়ারী পিয়ারী সুরত কো, বাহারো ফুল বর্ষাও এবং দিল কি ঝরোখে মে'র মতো অবিস্মরণীয় গানগুলো তাকে ঐ পদকগুলো প্রাপ্তিতে সহায়তা করেছিল।

ইয়াহু! চাহে কোই মুঝে জাংলী কাহে গানটি ছিল একমাত্র গান যাতে দ্রুতলয়ের অর্কেষ্ট্রা ঘরাণার গান করেছেন রফি। কিশোর কুমারের পরিবর্তে রফিকে সারারাত ছবিতে আজব হ্যায় দাস্তান তেরী ইয়ে জিন্দেগী গানে অন্তর্ভুক্ত করেন শঙ্কর জয়কিষাণ। মোহাম্মদ রফি তার সঙ্গীত নির্দেশনা ও পরিচালনায় সর্বমোট ৩৪১টি গান গেয়েছিলেন। তন্মধ্যে ২১৬টি গানই ছিল একক সঙ্গীতের।[১৭]বসন্ত বাহার, প্রফেসর, জাংলী, সুরজ, ব্রহ্মচারী, এ্যান ইভ্‌নিং ইন প্যারিস, দিল তেরা দিওয়ানা, ইয়াকিন, প্রিন্স, লাভ ইন টোকিও, বেটি বেটে, দিল এক মন্দির, দিল আপনা আউর প্রীত পারাই, গবন এবং জব পেয়ার কিসি সে হোতা হে ছবিগুলোতে তার গান রয়েছে।

ও. পি. নায়ারের সঙ্গে

রফি এবং ও. পি. নায়ার জুটি কর্তৃক যৌথভাবে সৃষ্ট ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকের সঙ্গীতগুলো শ্রোতা-দর্শকদের মনে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। নায়ার একবার রফি'র সম্বন্ধে বলেছিলেন, "যেখানে মোহাম্মদ রফি নেই, সেখানে ও. পি, নায়ারও নেই"। নায়ার এবং রফি উভয়ের সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্ট অনেকগুলো গান জনপ্রিয় হয়েছিল। তন্মধ্যে ইয়ে হ্যায় বোম্বে মেরি জান অন্যতম। তিনি রফিকে দিয়ে গায়ক-অভিনেতা হিসেবে কিশোর কুমারের জন্য মন মরা বাওয়ারা গানটি রাগীনি ছবিতে গাইয়েছেন। পরবর্তীতে রফি কিশোর কুমারের অন্যান্য চলচ্চিত্র হিসেবে বাঘী, শেহজাদা এবং সারারাত ছবিতেও গান গেয়েছেন।

নায়ার তার চলচ্চিত্রের জন্য অধিকাংশ গানেই আশা ভোঁসলে এবং মোহাম্মদ রফিকে অংশগ্রহণ করিয়েছেন। নয়া দৌঁড় (১৯৫৭), তুমসা নাহিন দেখা (১৯৫৭) এবং কাশ্মীর কি কালী (১৯৬৪) চলচ্চিত্রে নায়ার-রফি দু'জনের সঙ্গীতে অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। নায়ারের সঙ্গীত পরিচালনায় রফি সর্বমোট ১৯৭টি গান করেছেন। তন্মধ্যে ৫৬টি গান ছিল একক সঙ্গীতের। ১৯৫৭ সালে নয়া দৌড় চলচ্চিত্রে তিনি আশা ভোঁসলের সাথে জুটি বেধে "উড়ে জাব জাব জুলফে তেরি","মাংগকে সাথ তুমহারা" ও "সাথি হাত বাড়ানা" গানগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। রফি'র কণ্ঠে তুমসা নাহিন দেখা চলচ্চিত্রে জাওয়ানিয়ান ইয়ে মাস্ত মাস্ত এবং সূচনা সঙ্গীত হিসেবে ইউ তো হামনে লাখ হাসি দেখে হ্যায় গানটিও অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এছাড়াও, কাশ্মীর কি কালী ছবিতে তারিফ করুন কিয়া উসকি জিসনে তুমহে বানায়া গানটিও সমধিক জনপ্রিয় ছিল।

লক্ষ্মীকান্ত-পিয়ারেলাল জুটির সঙ্গে

অত্যন্ত জনপ্রিয় দুই গীতিকার লক্ষ্মীকান্ত-পিয়ারেলাল জুটিও মোহাম্মদ রফিকে তাদের সৃষ্ট গানে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিলেন। এ জুটির সঙ্গীত পরিচালনায় প্রথম ছবি হিসেবে ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পরশমণি চলচ্চিত্রের গানে মোহাম্মদ রফি অংশ নেন। রফি এবং লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল জুটি যৌথভাবে ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দোস্তি চলচ্চিত্রের চাহুঙ্গা মে তুঝে সাঁঝ সাভেরে গানের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এ জুটির সাথে ৩৬৯টি গানে অংশগ্রহণ করেছেন মোহাম্মদ রফি। তন্মধ্যে ১৮৬টি গানই ছিল একক সঙ্গীতের।

১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বলিউডে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য গায়কদের তুলনায় রফিকেই দেখা গিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও, হিন্দী ছবিতে তিনি অনেক খ্যাতনামা চলচ্চিত্র তারকার জন্যে গান গেয়েছেন। ১৯৬৫ সালে সঙ্গীত কলায় অসামান্য অবদান রাখায় ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত করে। ১৯৬০ এর দশকে মৌরিতাস ভ্রমণের সময় তিনি ক্রিয়োল ভাষায় একটি গান গেয়েছিলেন। এছাড়াও, রফি দু'টি ইংরেজি এ্যালবামের গানে অংশ নেন। তাদের মধ্যে একটি হলো পপ হিটস্‌।



জীবনের শেষের বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড সংক্রান্ত বিষয়ে মোহাম্মদ রফি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তিনি লতা মঙ্গেশকরের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করেন। ১১ জুন, ১৯৭৭ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃপক্ষকে লিখিত একটি চিঠিতে তিনি জানান যে, লতাজী সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করেছেন সত্য; কিন্তু তা গিনেস কর্তৃপক্ষের ভাষ্য মোতাবেক ২৫,০০০ গানের কম নয়। গিনেস থেকে পত্র প্রাপ্তির প্রত্যুত্তরে রফি ২০ নভেম্বর, ১৯৭৯ সালে চিঠিতে লিখেন যে: আমি খুবই মর্মাহত যে আমার অনুরোধ পুনর্বিবেচনা করা হয়নি। এমনকি আমার নাম অন্তর্ভুক্তির বিপরীতে মিস মঙ্গেশকরের দাবিকৃত বিশ্বরেকর্ডটি অপসারণও করা হয়নি।

১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ রফি দাবি করেন যে, তিনি ঐ সময় পর্যন্ত ২৫ থেকে ২৬ হাজারের মতো গান গেয়েছেন।

রফি'র মৃত্যুর পর গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের ১৯৮৪ সালের সংস্করণে লেখা হয় যে, 'লতা মঙ্গেশকর সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করেছেন। তবে মোহাম্মদ রফিও দাবি করেছেন যে, তিনি ১১টি ভারতীয় ভাষায় ১৯৪৪ সাল থেকে এপ্রিল, ১৯৮০ সালের মধ্যে ২৮,০০০ এর মতো গান গেয়েছেন।'

প্রাপ্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান মোতাবেক ১৯৪৫ থেকে ১৯৮০ সময়কালের মধ্যে মোহাম্মদ রফি ৪,৫১৬টি হিন্দি ছবির গান, ১১২টি অন্যান্য চলচ্চিত্রের গান এবং ৩২৮টি অন্যান্য গান রেকর্ড করেছেন।[২৮]

অবশ্য পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে মোহাম্মদ রফি এবং লতা মঙ্গেশকর - উভয় কণ্ঠশিল্পীর নামই গিনেস বুক থেকে অপসারণ করা হয়।

ভারত সরকার মোহাম্মদ রফি'র মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করে ও তার প্রতি সম্মান জানিয়ে দুই দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিল।[৪৬]
১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র গুমনাম ছবির জান পেহচান হো গানটি ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ঘোস্ট ওয়ার্ল্ড ছবির সাউণ্ডট্রাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছবিটির শুরুতে মোহাম্মদ রফি'র শয়নকক্ষে গুমনাম শিরোনামের ভিডিওতে নাচের দৃশ্যের অবতারণা করা হয়।
২০০১ সালের চলচ্চিত্র হিসেবে মনসুন ওয়েডিং চলচ্চিত্রে আজ মৌসুম বড় বেঈমান হ্যায় শিরোনামের গানটি পুনরায় ধারণ করা হয়।
রফি'র জীবনকে ঘিরে একটি প্রামাণ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারী ভারতের চলচ্চিত্র বিভাগের নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে।
মুম্বাইয়ের বন্দ্রা এবং পুনেতে মোহাম্মদ রফি অবিস্মরণীয় করে রাখতে "পদ্মশ্রী মোহাম্মদ রফি চক" নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।[৫০]
জুন, ২০১০ সালের জুন মাসে আউটলুক ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে ভোটের মাধ্যমে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে মোহাম্মদ রফিকেও সবচেয়ে জনপ্রিয় নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে মনোনীত করা হয়।[৫১] একইভাবে ঐ ম্যাগাজিনের ভোটে ১৯৬৪ সালের চিত্রলেখা ছবির মন রে তু কাহে না ধীর ধরে গানের জন্য রফি ১ম স্থান অর্জন করেন।[৫২] তিনটি গান যৌথভাবে ২য় স্থানের জন্য মনোনীত হয়। তন্মধ্যে দু'টি গানই ছিল মোহাম্মদ রফি'র কণ্ঠে। ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গাইড ছবির গানগুলো হলো - তেরে মেরে স্বপ্নে আব এক রং হে এবং দিন ধাল জায়ে, হ্যায় রাত না জায়ে।
আউটলুক ম্যাগাজিন কর্তৃক পরিচালিত এই ভোট পর্বটিতে ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পের গণ্যমান্য অনেক শিল্পী বিচারকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা হলেন - অভিজিৎ, আদেশ শ্রীবাস্তব, আলিশা চিন্নাই, আনু মালিক, এহসান, গুলজার, হরিহরণ, হিমেশ রেশমিয়া, যতীন, জাভেদ আখতার, কৈলেশ খের, কবিতা কৃষ্ণমূর্ত্তি, খৈয়াম, কুমার শানু, ললিত, লয়, মহালক্ষ্মী আয়ার, মহেন্দ্র কাপুর, মান্না দে, প্রসূন যোশী, রাজেশ রোশান, সাধনা সরগম, সমীর, সন্দেশ শানদিলিয়া, শান, শঙ্কর, সান্তনু মৈত্র, শ্রেয়া ঘোষাল, সনু নিগম এবং তালাত আজিজ।

সঙ্গীত পরিচালক রাজেশ রোশানের গীত রচনান্তে বেশ কয়েকটি গানে কণ্ঠ দেন রফি। রফি'র মৃত্যুতে তিনি বলেন যে, "রফি ছিলেন একজন উষ্ণ হৃদয়ের অধিকারী সহজ-সরল মানুষ যার মনের মধ্যে কোন হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না"।

সঙ্গীতপ্রেমীরা রফিকে মরণোত্তর ভারত রত্ন পুরস্কার (যা ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান) প্রদানের মাধ্যমে যথাযথভাবে সম্মান জানানোর জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
১৯৪৮: প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু'র কাছ থেকে ভারতের ১ম স্বাধীনতা দিবসে রৌপ্য পদক গ্রহণ করেন।[১১]
১৯৬৭: ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ।
১৯৭৪: তেরী গালিও ম্যা না রাখেঙ্গে কদম আজ কে বাদ গানের জন্য ফিল্ম ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে সেরা গায়কের পুরস্কার লাভ।
২০০১: হিরো হোণ্ডা-স্টারডাস্ট ম্যাগাজিনের যৌথ উদ্যোগে ৭ জানুয়ারি, ২০০১ তারিখে অংশগ্রহণকারী পাঠকদের ৭০ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি শতাব্দীর সেরা গায়ক হিসেবে পুরস্কৃত হন।

জাতীয় চলচ্চিত্র পদক

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
বছর গান চলচ্চিত্র সঙ্গীত পরিচালক সুরকার ফলাফল
১৯৭৭ "ক্যায়া হুয়া তেরা ওয়াদা" হাম কিসি সে কাম নাহি রাহুল দেব বর্মন মাজরুহ সুলতানপুরী।

সঙ্গীত কলায় অসামান্য অবদান রাখায় শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় পদক এবং ৬-বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মোহাম্মদ রফি। এছাড়াও, ১৯৬৭ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মশ্রী সম্মানেও অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি।[২] প্রায় চল্লিশ বছর সময়কাল ধরে সঙ্গীত জগতে থাকাকালীন ছাব্বিশ হাজারেরও অধিক চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্য গায়ক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন মোহাম্মদ রফি।[৩] তিনি বহুবিধ গানে অংশ নেয়ার বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তন্মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, বিরহ-বিচ্ছেদ, উচ্চ মার্গের প্রেম-ভালবাসা, কাওয়ালী, ভজন, গজল-সহ বিভিন্ন গোত্রের গানে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন সমানভাবে। বিশেষ করে হিন্দি এবং উর্দু ভাষায় সমান দক্ষতা থাকায় তার গানগুলোতে বৈচিত্র্য এসেছে সমধিক।
হিন্দিসহ কোনকানি, উর্দু, ভোজপুরী, উড়িয়া, পাঞ্জাবী, বাংলা, মারাঠী, সিন্ধী, কানাড়া, গুজরাতি, তেলুগু, মাঘী, মৈথিলী, অহমীয়া ইত্যাদি ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন। এছাড়াও আরও গান গেয়েছেন - ইংরেজি, ফার্সী, স্প্যানিশ এবং ডাচ ভাষায়।।




Friday, 29 July 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। বাংলা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। Vol -812. Dt -30.07.2022. ১৩ শ্রাবণ,১৪২৯. শনিবার। The blogger in literature e-magazine


বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

সাম্মানিক ডি লিট, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম

  মৃত্যু - ৩০ জুলাই ১৯৮৭ সালে। 

মিথিলায় তাঁর জন্ম, মৃত্যুও সেখানেই। ১৯৮৭ সালে দারভাঙায় প্রয়াত হন বিভূতিভূষণ। বাংলার দিকে তাকিয়ে, বাংলাকে মনে রেখে, দূরে-দূরেই চলে গেলেন ‘পরবাসী’ এক বাঙালি সাহিত্যিক। 


বিভূতিভূষণের সব ভাল লাগার মধ্যেও বাংলা নিয়ে যে অভিযোগ ছিল, আজকের বাঙালির কাছে তা প্রণিধানযোগ্য। তাঁর আত্মকথায় সে কালের কলকাতা পায়ে হেঁটে ঘোরার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তিনি বলতেন নেশা— ‘শিবপুর থেকে নিয়ে সর্বত্রই বাঙ্গালী টুকরা টাকরা কুড়িয়ে বেড়ানো’। শিবপুর ফেরিঘাটে গঙ্গা পেরিয়ে হেঁটে কলেজ, সেই পথের পরিধিই ক্রমশ বাড়ে। কিন্তু বদলে যাওয়া শহর দেখে পরিতাপ ঝরে পড়েছে তাঁর গলায়— “আমরা বলি বাঙ্গালী আমরা মূলত কবির জাত, শিল্পীর জাত, গৌণত আর কিছু।... ইডেন গেছে, ডালহৌসী গেছে, আরও কত গেছে এই রকম।” বাংলার সঙ্গে তাঁর দু’বার আলাপ, প্রথম বার চাতরায় তাকে ‘দেখা’, দ্বিতীয় বার শিবপুরে তাকে ‘পাওয়া’। দুই আলাপেই যে ‘ফ্রেশ্‌নেস্’ ছিল, চার পাশের ক্লিন্নতায় দিনে-দিনে কি তা ক্ষুণ্ণও হয়েছিল।‌

তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের রচয়িতা। রসরচনায়ও রয়েছে তার অসামান্য দক্ষতা। তিনি অনেক কৌতুক ও রঙ্গরসের গল্পও লিখেছেন।




১৮৯৪ সালের ২৪ অক্টোবর বিহারের দ্বারভাঙ্গা 

জেলার পান্ডুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বিপিন বিহারী মুখোপাধ্যায়। তার আদি নিবাস হুগলী জেলার চাতরা হলেও তার তিন পুরুষের বাস বিহারের দ্বারভাঙ্গায় ছিল। বিভূতিভূষণ দ্বারভাঙ্গা পীতাম্বরী বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। দ্বারভাঙ্গা রাজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং রিপন কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. পাশ করেন।



প্রবাসে জন্ম, আমৃত্যু বাস পরবাসেই। তবু জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে একান্ত ভাবে বাঙালিয়ানার সাধনা করেছেন, সাহিত্যসাধনার অনুপ্রেরণাও তা থেকেই। এমনকি, অভাবে-অপমানেও কখনও নিজের অভীষ্ট থেকে বিচ্যুত হননি বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়।


২৯ মার্চ, ১৯৭২। দারভাঙা থেকে দিন কয়েকের জন্য নিউ আলিপুরে এসেছেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। সন্ধের আড্ডায় এক বন্ধু নিভৃতে জানালেন, “যাওয়ার আগে একটা ভাল খবরই দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে একটু খুঁৎ থেকে যাচ্ছে।” ব্যাপার হল, সে বারের রবীন্দ্র পুরস্কার বিভূতিভূষণেরই পাওয়ার কথা, কিন্তু শেষ কালে এক ‘ইনফ্লুয়েনসিয়াল্’ সাংবাদিক বাদ সেধেছেন। কাষ্ঠ হেসে লেখকের প্রত্যুত্তর, “আপনি তো জানেন, আমার নিজের এ বিষয়ে কোন চেষ্টা থাকেনা। বইও এগিয়ে দিই না। এ অবস্থায় পেলে মুফুতে পাওয়া যায়। না পেলে দুঃখ থাকবার কথা নয়। তবু যে বৈরাগ্যই আছে, এ কথা কি ক’রে বলব? যেমন হয় জানাবেন।” ১২ এপ্রিল রেডিয়োয় ঘোষণা হল, “আর কোন বই না পাওয়ায় বিভূতি মুখোপাধ্যায়ের ‘এবার প্রিয়ংবদা’র ওপর দেওয়া হোল পুরস্কার।” এ বার ব্যাপারটা সত্যিই ভাবিয়ে তুলল বিভূতিভূষণকে। হয়তো কমিটিতে তাঁর নাম আটকানো যায়নি বলে রেডিয়োয় বিকৃত প্রচার! কিন্তু রাজ্য সরকারের সঙ্গে পত্রাচার কি রুচিসম্মত হবে? কলকাতায় দু’-এক জনকে চিঠি লিখলেন। জানা গেল, তাঁর নাম সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হলেও কোনও বইয়ের হদিশ পাওয়া যাচ্ছিল না, অতঃপর এক সদস্য ‘প্রকাশ ভবন’ আর ‘এম. সি. সরকার’ ঘুরে ‘এবার প্রিয়ংবদা’ জোগাড় করতে সমর্থ হন, অগত্যা সেই নামই ঘোষণা। এক দিন সরকারি চিঠিও এল, যথাযথ বিধিবদ্ধ। শেষাবধি আর পুরস্কারখানা প্রত্যাখ্যান করলেন না বিভূতিভূষণ।

ঘটনাটা এমনিতেই অসম্মানজনক, বিশেষত প্রাপকের পক্ষে, কিন্তু বিভূতিভূষণকে তা অন্য ভাবে ভাবিয়েছিল। নিজের জীবনে— শুধু সাহিত্যজীবন নয়, সমগ্র জীবনে— যদি কোনও কিছুর সন্ধান তিনি করে থাকেন, তা নিখাদ বাঙালিত্বের। জীবনের অধিকাংশ কেটেছে প্রবাসে— পণ্ডৌল (মিথিলা), দারভাঙা, পটনা। বঙ্গদেশের চাতরা (হুগলি), শিবপুর, নিউ আলিপুরে অল্প কালই থাকার সুযোগ হয়েছে। এমন প্রতিকূল প্রতিবেশে যিনি আজীবন বাংলা সাহিত্যসাধনা করে গিয়েছেন, তাঁর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেরা সাহিত্যসম্মান, যা নাকি রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত, তা নিয়ে এমন গরমিল লজ্জার চেয়ে অনেক বেশি বেদনার। বিভূতিভূষণ সেই ছেলেবেলা থেকেই বাংলাকে দেখতে চেয়েছেন, পেতে চেয়েছেন, এ ভূখণ্ডে পা রাখতেই তাঁর মনে বাড়তি পুলক জেগে উঠত। পরবাসে বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে স্থানীয় স্বজাতিদের নিয়ে নিয়মিত সভা-সমিতি করে গিয়েছেন, যত দিন পেরেছেন। অমলিন ভালবাসায় এই দাগটুকু না পড়লেই হত।

১৮৯৬ সালে পণ্ডৌল নামে যে উত্তর বিহারের অঞ্চলে বিভূতিভূষণের জন্ম তা শহর নয়, আবার গণ্ডগ্রামও নয়। এক প্রান্তে নীলকুঠি, নতুন যুগের অভিজ্ঞান ওটুকুই। গায়ে-লাগা দু’ঘর বাঙালি, মেটে বাড়ি, সে কালের বাবুদের কোয়ার্টার। গঞ্জজীবন এমনিই নিস্তরঙ্গ, তায় সমাজবিচ্ছিন্ন বাঙালি পরিবারে কালেভদ্রের তরঙ্গাঘাতও পৌঁছত না, শিশুমনও তাই অচঞ্চল। কিন্তু যে বিপন্নতায় দিনযাপন, তা বড় হয়ে বুঝেছেন বিভূতিভূষণ। পরবাসে দুই প্রজন্মে বাংলা ভাষা ও কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা বড় কঠিন। বড়কি ভৌজি (বড় বৌদি), ছোটকি ভৌজি (ছোট বৌদি), কটোরা (বাটি), বৈগন (বেগুন) ঘরে চালু হয়ে গিয়েছে, বাংলাতেও মৈথিলি টান। পরে তিনি লিখেছেন, বিকৃতির হাত থেকে বাঁচতে বাংলা পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর বাবা, আর ‘একে তার গুরুগম্ভীর ভাষা, তার ওপর বাবার অনুস্বার, বিসর্গ আর যুক্তাক্ষরাদির শুদ্ধতা বজায় রেখে পড়া’, দুইয়ে মিলে বিদ্যাসাগরের ‘আখ্যানমঞ্জরী’ যে ঝঙ্কার সৃষ্টি করত, তা এখনও কানে লেগে। শিশুমনকে বাঙালি ধাঁচে গড়েপিটে নিতে শেষাবধি ছেলেদের চাতরা-শ্রীরামপুরের আদিবাড়িতে পাঠানোর সিদ্ধান্তই নিলেন বাবা। সেই মতো রেলযাত্রা।

সেই রেলগাড়িতেই বছর সাত-আটের বিভূতি ঘুম ভেঙে দেখল, যাঁরা জিনিস বেচছেন, তাঁরা ছাড়া সবাই ‘আমাদের মতোই কথা বলছে’! তার জিজ্ঞাসা: “এরা কারা বাবা?”

“এরা বাঙ্গালী।”

“আমরাও তো তাই।”

“হ্যাঁ, তাছাড়া কি হব?”

“তা এত কোথা থেকে এল বাবা?”

দাদা বলল, “এটা যে বাংলাদেশ রে। কী বোকা বিভূতিটা, বাবা।”

“এবার তোকে বাংলাদেশের একটা মিষ্টি খাওয়াব। কখনও ভুলতে পারবি না।”

বাল্যাবস্থায় বর্ধমানের সীতাভোগের যে স্বাদ সে পেয়েছিল, তা নাকি জিভে লেগে আছে।

তার কর্মক্ষত্র ছিল বৈচিত্রময়। কর্মজীবনের প্রথম দিকে তিনি ইন্ডিয়ান নেশন পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষের পদে আসীন ছিলেন। পরে বিহারের দ্বারভাঙ্গায় মহারাজের সচিব হিসাবেও কাজ করেন। আবার পরবর্তি কালে কিছুকাল শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯১৬ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত কর্মজীবনে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা, ধনী পরিবারে গৃহ-শিক্ষকতা করেছিলেন। শিক্ষকতা চলাকালীন তিনি নিজেকে লেখার কাজে নিয়োজিত করেন। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের তিনি রচয়িতা। তার জনপ্রিয়তম উপন্যাসটি হলো নীলাঙ্গুরিয়। এছাড়াও তিনি অনেক কৌতুক ও রঙ্গরসের গল্পও লিখেছেন।

ইন্টারমিডিয়েট-ইন-আর্টস পড়তে দু’বছরের জন্য শিবপুরে পাঠানো হল বিভূতিভূষণকে— ১৯১২ সালে রিপন কলেজে। রাজস্কুলে চল্লিশটা ছেলের মধ্যে যে ছিল পুরোভাগে, কলকাতার কলেজে বৃত্তি পাওয়া স্কলারদের ভিড়ে সুদূর বিহার থেকে আসা সেই ছাত্রের হারিয়ে যাওয়ারই কথা, অনেকটা তাঁর ‘বরযাত্রী’ গল্পের কে গুপ্ত-র মতোই। শুধু নিজের যোগ্যতা আর আগ্রহেই ভেসে রইল সে ছেলে।


এর পরের আরও কিছু খুচরো আসা-যাওয়া মিলিয়ে শিবপুরে মেরেকেটে তিন বছর কাটিয়েছেন বিভূতিভূষণ। অথচ তিনি বলেন, এই তিনটে বছর তাঁর দীর্ঘ জীবনের যেন অর্ধেকটা জুড়েই আছে। জীবনের মাপকাঠি সময় নয়, উপলব্ধির গাঢ়ত্বে-গভীরতা-বৈচিত্রে। বাংলার প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছতে পেরে তাঁর মনে হয়েছিল, “আমার বাঙালীত্ব-বোধ একটা সার্থকতা পেল।” একে প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতা বা গণ্ডিবদ্ধ স্বজাতীয়তা মনে হতেই পারে, বিভূতিভূষণ তাই বারবার তাঁর পূর্ণ ভারতীয়ত্বে বিশ্বাসের কথা জোর দিয়ে বলতেন। তিনি এমন ভারতের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে প্রদেশের সীমারেখা মুছে গিয়ে জগতের সামনে দাঁড়ায় এক দেশ। তবু তাঁর কাছে, বাঙালিত্ব আলাদা বস্তু— ‘একটা পাড়ার মধ্যে একটা বাড়ীর যে নিজস্বতা’। ছেলেবেলায় চাতরাকে বিভুঁই মনে হয়েছিল, পণ্ডৌল তখনও জীবনের ধ্রুবতারা, দারভাঙার পরিবেশে নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিল। বাঙালিরও তখন স্বর্ণযুগ। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, আশুতোষ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, সুরেন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ— “এমন একটা যুগ যে, অবাঙ্গালীও বাঙ্গালীত্বে গৌরববোধ করবেন।”


শিবপুরের জীবন তাঁকে একটা বাঙালি সমাজও দিয়েছিল। বিবাহ, শ্রাদ্ধ, উপনয়ন, ব্রত, অন্নপ্রাশন— ভোজই কি সামাজিক আদানপ্রদানের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান? সবচেয়ে আনন্দের তো বটেই। বিভূতিভূষণ নিজেও কৌতুক করেন, ‘সবটুকু পরস্মৈপদী, রসনা-তৃপ্তির সঙ্গে, সে-তৃপ্তির আহরণের যে-উদ্বেগ আর ব্যয়ভার তার কোন সম্বন্ধ থাকেনা’। আলাপ-আলোচনার সুযোগ এক আকর্ষণ। পঙ্‌ক্তির অপেক্ষা আর পঙ্‌ক্তিতে বসার মধ্যেই হয়ে যায় কত গল্পগাছা, সমালোচনা, পরনিন্দা, পরচর্চা— যাকে বলে মজলিশ। বিভূতিভূষণের লেখালিখির প্রেরণার আট আনাও এই শিবপুর থেকেই। দারভাঙায় অঙ্কুরিত সাহিত্যরচনার বাসনা পল্লবিত হয় শিবপুরে। কলকাতার বিপুল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের যে সান্নিধ্য তখন পেলেন, নবীন সাহিত্যিকের পক্ষে তা এক কল্পনাতীত পরিবেশ।


আইএ পাশ করে বিহারে ফিরতে হল, পটনা বি এন কলেজে বিএ পড়তে ভর্তিও হলেন, কিন্তু মাত্র জনা ছয়েক বাঙালি ছাত্রের সম্পর্ক হল খুবই নিবিড়, থেমে থাকল না বিভূতিভূষণের কলমও। ১৯১৫ সালে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হল ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়, তৎকালীন ভারতের অগ্রণী পত্রিকা। পরিচয়ের সঙ্গে এল আত্মবিশ্বাস।

প্রথম পাতাকলকাতাপশ্চিমবঙ্গদেশখেলাআষাঢ়ের গল্পবিদেশসম্পাদকের পাতাবিনোদনজীবন+ধারাজীবনরেখাব্যবসাভিডিয়োঅন্যান্যপাত্রপাত্রী

নিরন্তর খাঁটি বাঙালিয়ানার সন্ধান

৮৯৬ সালে পণ্ডৌল নামে যে উত্তর বিহারের অঞ্চলে বিভূতিভূষণের জন্ম তা শহর নয়, আবার গণ্ডগ্রামও নয়।


আবাহন দত্ত

১৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৭:২৩


ছবি: পরিমল গোস্বামী

এই বিজ্ঞাপনের পরে আরও খবর


প্রবাসে জন্ম, আমৃত্যু বাস পরবাসেই। তবু জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে একান্ত ভাবে বাঙালিয়ানার সাধনা করেছেন, সাহিত্যসাধনার অনুপ্রেরণাও তা থেকেই। এমনকি, অভাবে-অপমানেও কখনও নিজের অভীষ্ট থেকে বিচ্যুত হননি বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়।



২৯ মার্চ, ১৯৭২। দারভাঙা থেকে দিন কয়েকের জন্য নিউ আলিপুরে এসেছেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। সন্ধের আড্ডায় এক বন্ধু নিভৃতে জানালেন, “যাওয়ার আগে একটা ভাল খবরই দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে একটু খুঁৎ থেকে যাচ্ছে।” ব্যাপার হল, সে বারের রবীন্দ্র পুরস্কার বিভূতিভূষণেরই পাওয়ার কথা, কিন্তু শেষ কালে এক ‘ইনফ্লুয়েনসিয়াল্’ সাংবাদিক বাদ সেধেছেন। কাষ্ঠ হেসে লেখকের প্রত্যুত্তর, “আপনি তো জানেন, আমার নিজের এ বিষয়ে কোন চেষ্টা থাকেনা। বইও এগিয়ে দিই না। এ অবস্থায় পেলে মুফুতে পাওয়া যায়। না পেলে দুঃখ থাকবার কথা নয়। তবু যে বৈরাগ্যই আছে, এ কথা কি ক’রে বলব? যেমন হয় জানাবেন।” ১২ এপ্রিল রেডিয়োয় ঘোষণা হল, “আর কোন বই না পাওয়ায় বিভূতি মুখোপাধ্যায়ের ‘এবার প্রিয়ংবদা’র ওপর দেওয়া হোল পুরস্কার।” এ বার ব্যাপারটা সত্যিই ভাবিয়ে তুলল বিভূতিভূষণকে। হয়তো কমিটিতে তাঁর নাম আটকানো যায়নি বলে রেডিয়োয় বিকৃত প্রচার! কিন্তু রাজ্য সরকারের সঙ্গে পত্রাচার কি রুচিসম্মত হবে? কলকাতায় দু’-এক জনকে চিঠি লিখলেন। জানা গেল, তাঁর নাম সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হলেও কোনও বইয়ের হদিশ পাওয়া যাচ্ছিল না, অতঃপর এক সদস্য ‘প্রকাশ ভবন’ আর ‘এম. সি. সরকার’ ঘুরে ‘এবার প্রিয়ংবদা’ জোগাড় করতে সমর্থ হন, অগত্যা সেই নামই ঘোষণা। এক দিন সরকারি চিঠিও এল, যথাযথ বিধিবদ্ধ। শেষাবধি আর পুরস্কারখানা প্রত্যাখ্যান করলেন না বিভূতিভূষণ।


Advertisement


ঘটনাটা এমনিতেই অসম্মানজনক, বিশেষত প্রাপকের পক্ষে, কিন্তু বিভূতিভূষণকে তা অন্য ভাবে ভাবিয়েছিল। নিজের জীবনে— শুধু সাহিত্যজীবন নয়, সমগ্র জীবনে— যদি কোনও কিছুর সন্ধান তিনি করে থাকেন, তা নিখাদ বাঙালিত্বের। জীবনের অধিকাংশ কেটেছে প্রবাসে— পণ্ডৌল (মিথিলা), দারভাঙা, পটনা। বঙ্গদেশের চাতরা (হুগলি), শিবপুর, নিউ আলিপুরে অল্প কালই থাকার সুযোগ হয়েছে। এমন প্রতিকূল প্রতিবেশে যিনি আজীবন বাংলা সাহিত্যসাধনা করে গিয়েছেন, তাঁর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেরা সাহিত্যসম্মান, যা নাকি রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত, তা নিয়ে এমন গরমিল লজ্জার চেয়ে অনেক বেশি বেদনার। বিভূতিভূষণ সেই ছেলেবেলা থেকেই বাংলাকে দেখতে চেয়েছেন, পেতে চেয়েছেন, এ ভূখণ্ডে পা রাখতেই তাঁর মনে বাড়তি পুলক জেগে উঠত। পরবাসে বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে স্থানীয় স্বজাতিদের নিয়ে নিয়মিত সভা-সমিতি করে গিয়েছেন, যত দিন পেরেছেন। অমলিন ভালবাসায় এই দাগটুকু না পড়লেই হত।


অ-প্রবাসী


Advertisement


১৮৯৬ সালে পণ্ডৌল নামে যে উত্তর বিহারের অঞ্চলে বিভূতিভূষণের জন্ম তা শহর নয়, আবার গণ্ডগ্রামও নয়। এক প্রান্তে নীলকুঠি, নতুন যুগের অভিজ্ঞান ওটুকুই। গায়ে-লাগা দু’ঘর বাঙালি, মেটে বাড়ি, সে কালের বাবুদের কোয়ার্টার। গঞ্জজীবন এমনিই নিস্তরঙ্গ, তায় সমাজবিচ্ছিন্ন বাঙালি পরিবারে কালেভদ্রের তরঙ্গাঘাতও পৌঁছত না, শিশুমনও তাই অচঞ্চল। কিন্তু যে বিপন্নতায় দিনযাপন, তা বড় হয়ে বুঝেছেন বিভূতিভূষণ। পরবাসে দুই প্রজন্মে বাংলা ভাষা ও কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা বড় কঠিন। বড়কি ভৌজি (বড় বৌদি), ছোটকি ভৌজি (ছোট বৌদি), কটোরা (বাটি), বৈগন (বেগুন) ঘরে চালু হয়ে গিয়েছে, বাংলাতেও মৈথিলি টান। পরে তিনি লিখেছেন, বিকৃতির হাত থেকে বাঁচতে বাংলা পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর বাবা, আর ‘একে তার গুরুগম্ভীর ভাষা, তার ওপর বাবার অনুস্বার, বিসর্গ আর যুক্তাক্ষরাদির শুদ্ধতা বজায় রেখে পড়া’, দুইয়ে মিলে বিদ্যাসাগরের ‘আখ্যানমঞ্জরী’ যে ঝঙ্কার সৃষ্টি করত, তা এখনও কানে লেগে। শিশুমনকে বাঙালি ধাঁচে গড়েপিটে নিতে শেষাবধি ছেলেদের চাতরা-শ্রীরামপুরের আদিবাড়িতে পাঠানোর সিদ্ধান্তই নিলেন বাবা। সেই মতো রেলযাত্রা।


সেই রেলগাড়িতেই বছর সাত-আটের বিভূতি ঘুম ভেঙে দেখল, যাঁরা জিনিস বেচছেন, তাঁরা ছাড়া সবাই ‘আমাদের মতোই কথা বলছে’! তার জিজ্ঞাসা: “এরা কারা বাবা?”


“এরা বাঙ্গালী।”


“আমরাও তো তাই।”


“হ্যাঁ, তাছাড়া কি হব?”


“তা এত কোথা থেকে এল বাবা?”


দাদা বলল, “এটা যে বাংলাদেশ রে। কী বোকা বিভূতিটা, বাবা।”


“এবার তোকে বাংলাদেশের একটা মিষ্টি খাওয়াব। কখনও ভুলতে পারবি না।”


বাল্যাবস্থায় বর্ধমানের সীতাভোগের যে স্বাদ সে পেয়েছিল, তা নাকি জিভে লেগে আছে।


পাঁচ বছর বয়সে সরস্বতী পুজোর দিনে হাতেখড়ির পর আড়াই-তিন বছরে দ্বিতীয় ভাগ আর ধারাপাতের কিছুটা আয়ত্ত হয়েছিল। তার জোরেই চাতরার মহাদেব মাস্টারের বাংলা পাঠশালায় ভর্তি হওয়া গেল। বাঙালি শিক্ষকসমীপে পুত্রদের সমর্পণ করে পশ্চিম-প্রবাসে ফিরে গেলেন বাবা।


এ সময়ই বালকের মাথায় চেপে বসল ভবঘুরেবৃত্তি বা বাউন্ডুলেপনার ভূত। যদিও তা ভূত না পরী, না কি ‘গার্জেন-এঞ্জেল’, তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না, উত্তরজীবনে যা পেয়েছেন, তা তো ওর কৃপাতেই। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির গোড়ায় ছিল ঘোরার এই নেশা— লেখকের ভাষায় ‘ব্যসন’। প্রবাসী বালক বাংলাভূমিকে আপন করে নিতে না পারলে, এই সাহিত্যিকের কি জন্ম হত? বৃদ্ধ বয়সে আত্মকথায় হিসাব কষেন, বাল্য-কৈশোর-যৌবনে বাংলাকে পেয়েছেন দু’বার, দু’-তিন বছরের দু’টি সংক্ষিপ্ত প্রবাসে, চাতরায় আড়াই-তিন বছর, অল্প ক’দিন শিবপুরে। এই ক’দিনের কথাও ‘নীলাঙ্গুরীয়’ উপন্যাসের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে, আছে ‘বর্ষায়’ গ্রন্থের দু’খানা ছোটগল্পে। তিনি বলেন, “‘বর্ষায়’ গল্পের নয়নতারার দ্বিপ্রাহরিক তাসের মজলিশে যে গেছি, তাও প্রায় নিরুদ্দেশভাবেই ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক সময় মনে পড়ে গিয়ে।... চাতরার জীবনধারার ভাষা থেকে নিয়ে সর্বাঙ্গীণ বাঙালীত্বের বিস্ময় অনেকদিনই গেছে মিটে।”


ফের যখন পণ্ডৌলে ফেরা গেল, তখন নীলকুঠির উঁচু পদে অরবিন্দ নামে এক বাঙালি ভদ্রলোক, বিভূতির চোখে ‘যেন কলকাতারই এক টুকরো’। কাজ সেরে সন্ধেয় ভরাট গলায়, অপূর্ব ঢঙে, সুর করে নবীন সেনের ‘রৈবতিক’ কাব্য পড়তেন তিনি, নিশুতি গঞ্জের আকাশ নাকি ভরাট করে রাখত শুধু সেই আবেগ-উত্তেজনার স্বরই। তার পর মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, রমেশ দত্তদের নিয়েও কথা হত। এক লহমায় বদলে গেল পণ্ডৌলের জীবন, বিভূতির লেখালিখির অনুপ্রেরণা তৈরি হল।


এর পর দারভাঙার বাংলা স্কুল। দারভাঙার বাঙালিদের ছেলেদের বাংলা পড়ানোর সুবিধার জন্য এর পত্তন। প্রতিষ্ঠাতা রাজশেখর বসুর বাবা চন্দ্রশেখর। তাঁর পুত্র ছাড়াও স্কুলের দুই প্রখ্যাত ছাত্র যতীন্দ্রনাথ সেন ও নন্দলাল বসু। ১৯০৩ সালের ৩ জুলাই এইট্‌থ ক্লাসে ভর্তি হল বিভূতি। বাংলা স্কুলের বাড়ি পরিবেশ ছাত্র শিক্ষক, সব একেবারে বেঁধে ফেলল যৌবনের সাড়ে চারখানা বছর। সে-ও মহা খুশি— পণ্ডৌলের ‘দেহাতী’, ‘গেঁয়ো-গেঁয়ো’ গন্ধটা গা থেকে মুছে যেতে লাগল। ১৯০৮ সালে পরীক্ষা দিয়ে রাজস্কুল। চৌবাচ্চার তেলাপিয়া যেন মহাসাগরে— তিনটে ঘর, তিন শিক্ষকের বিদ্যালয় থেকে কত ঘর, মাস্টার, ছাত্র! চোদ্দো থেকে আঠারো জীবন গঠনের সময়, তখনকার মঞ্চেই ভবিষ্যৎ রচনার সূচনা। এই চার বছর সম্পর্কে তিনিও বলেন, “কত জল্পনা-কল্পনা, তার মধ্যে আমি মাত্র একটি টায়েটোয়ে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে আসতে পেরেছি গল্প-উপন্যাস লেখার বাসনা।”


স্বর্গাদপি গরীয়সী


ইন্টারমিডিয়েট-ইন-আর্টস পড়তে দু’বছরের জন্য শিবপুরে পাঠানো হল বিভূতিভূষণকে— ১৯১২ সালে রিপন কলেজে। রাজস্কুলে চল্লিশটা ছেলের মধ্যে যে ছিল পুরোভাগে, কলকাতার কলেজে বৃত্তি পাওয়া স্কলারদের ভিড়ে সুদূর বিহার থেকে আসা সেই ছাত্রের হারিয়ে যাওয়ারই কথা, অনেকটা তাঁর ‘বরযাত্রী’ গল্পের কে গুপ্ত-র মতোই। শুধু নিজের যোগ্যতা আর আগ্রহেই ভেসে রইল সে ছেলে।


এর পরের আরও কিছু খুচরো আসা-যাওয়া মিলিয়ে শিবপুরে মেরেকেটে তিন বছর কাটিয়েছেন বিভূতিভূষণ। অথচ তিনি বলেন, এই তিনটে বছর তাঁর দীর্ঘ জীবনের যেন অর্ধেকটা জুড়েই আছে। জীবনের মাপকাঠি সময় নয়, উপলব্ধির গাঢ়ত্বে-গভীরতা-বৈচিত্রে। বাংলার প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছতে পেরে তাঁর মনে হয়েছিল, “আমার বাঙালীত্ব-বোধ একটা সার্থকতা পেল।” একে প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতা বা গণ্ডিবদ্ধ স্বজাতীয়তা মনে হতেই পারে, বিভূতিভূষণ তাই বারবার তাঁর পূর্ণ ভারতীয়ত্বে বিশ্বাসের কথা জোর দিয়ে বলতেন। তিনি এমন ভারতের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে প্রদেশের সীমারেখা মুছে গিয়ে জগতের সামনে দাঁড়ায় এক দেশ। তবু তাঁর কাছে, বাঙালিত্ব আলাদা বস্তু— ‘একটা পাড়ার মধ্যে একটা বাড়ীর যে নিজস্বতা’। ছেলেবেলায় চাতরাকে বিভুঁই মনে হয়েছিল, পণ্ডৌল তখনও জীবনের ধ্রুবতারা, দারভাঙার পরিবেশে নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিল। বাঙালিরও তখন স্বর্ণযুগ। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, আশুতোষ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, সুরেন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ— “এমন একটা যুগ যে, অবাঙ্গালীও বাঙ্গালীত্বে গৌরববোধ করবেন।”


শিবপুরের জীবন তাঁকে একটা বাঙালি সমাজও দিয়েছিল। বিবাহ, শ্রাদ্ধ, উপনয়ন, ব্রত, অন্নপ্রাশন— ভোজই কি সামাজিক আদানপ্রদানের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান? সবচেয়ে আনন্দের তো বটেই। বিভূতিভূষণ নিজেও কৌতুক করেন, ‘সবটুকু পরস্মৈপদী, রসনা-তৃপ্তির সঙ্গে, সে-তৃপ্তির আহরণের যে-উদ্বেগ আর ব্যয়ভার তার কোন সম্বন্ধ থাকেনা’। আলাপ-আলোচনার সুযোগ এক আকর্ষণ। পঙ্‌ক্তির অপেক্ষা আর পঙ্‌ক্তিতে বসার মধ্যেই হয়ে যায় কত গল্পগাছা, সমালোচনা, পরনিন্দা, পরচর্চা— যাকে বলে মজলিশ। বিভূতিভূষণের লেখালিখির প্রেরণার আট আনাও এই শিবপুর থেকেই। দারভাঙায় অঙ্কুরিত সাহিত্যরচনার বাসনা পল্লবিত হয় শিবপুরে। কলকাতার বিপুল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের যে সান্নিধ্য তখন পেলেন, নবীন সাহিত্যিকের পক্ষে তা এক কল্পনাতীত পরিবেশ।


আইএ পাশ করে বিহারে ফিরতে হল, পটনা বি এন কলেজে বিএ পড়তে ভর্তিও হলেন, কিন্তু মাত্র জনা ছয়েক বাঙালি ছাত্রের সম্পর্ক হল খুবই নিবিড়, থেমে থাকল না বিভূতিভূষণের কলমও। ১৯১৫ সালে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হল ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়, তৎকালীন ভারতের অগ্রণী পত্রিকা। পরিচয়ের সঙ্গে এল আত্মবিশ্বাস।


ময়দানের গ্রন্থমেলায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে।

ময়দানের গ্রন্থমেলায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে।

জীবন-তীর্থ


১৯১৬ সালে কলেজ পাশের পর ১৯৪২-এ অবসর পর্যন্ত হরেক চাকরি করেছেন বিভূতিভূষণ। অনেক স্কুল, এবং দারভাঙা-রাজের বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর। আট-ন’বার চাকরি ছেড়েছেন। মিশতে হয়েছে বহু মানুষের সঙ্গে। সব জায়গাতেই খুঁজে বেরিয়েছেন বাংলাকে। বিহারে তখনও বাঙালিদের ভাল দাপট। উকিলমহলের পুরোধারা সব বাঙালি; বড় অফিসার, জজ ম্যাজিস্ট্রেট, কর্মচারীরা বাঙালি, কিছু কেরানিও। ডাক্তারদের মধ্যেও অনেক। কিন্তু বুদ্ধিজীবী অংশের যে অভাব দারভাঙা বা অন্যত্র ছিল, তা পূরণ হয়েছিল মুজফ্‌ফরপুরে। সেখানে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে বিভূতিভূষণ তাই নতুন বিশ্বাস ও শক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এই বাঙালি সমাজ ‘পরিপূর্ণ’। ঐতিহ্যশালী শহরে গিয়ে বছর তিনেকের জন্য থেমে যাওয়া লেখনী ফের সচল হয়েছিল, তাঁর মতে ‘পুনরভিষেক’। এক সাহিত্যবাসরে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের উদ্যোগ হয়, কেন্দ্রে অনুরূপা দেবী, মুজফ্‌ফরপুরে যে জনপ্রিয় সাহিত্যিকের উপস্থিতি বাঙালিদের প্রেরণা জোগাত। রীতিমতো শামিয়ানা টাঙিয়ে আবৃত্তি-প্রবন্ধপাঠ-মূকাভিনয়ে পালিত হয় জয়ন্তী। পটনায় যখন থাকতেন, সক্রিয় ভাবে যোগ দিতেন প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে। নিয়ে আসা হত বনফুল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশদের। হাঙ্গামার ঘটনাও দেখেছেন। এক বার ‘শনিবারের চিঠি’ গোষ্ঠী তাতিয়ে দিল সভাপতি মোহিতলাল মজুমদারকে, তাঁর অভ্যর্থনা নাকি যথাযোগ্য হয়নি! পর দিন আর স্টেজেই উঠলেন না ক্রুদ্ধ সাহিত্যিক। আবার রাঘোপুরে থাকতে বাবু রঘুনন্দন সিংহের সপ্তম মাসের মাতৃশ্রাদ্ধে যখন সারা দেশ থেকে নামকরা পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানানো হল, বাংলার কদর হল বেশি, সেখানেই ‘মহামহোপাধ্যায়’-এর সংখ্যাধিক্য। সশিষ্য যে ২৫-২৬ জন এসেছিলেন, তার মধ্যে বিভূতিভূষণের জিম্মায় ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ডা. বিনয়তোষ।


বিভূতিভূষণ আত্মকথায় লিখেছেন, “কয়েদখানার দাপটেও বাঙ্গালীর সাহিত্য-প্রীতিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনা, মেডিকেলের ডিসেক্‌শন রুম বা অপারেশন টেবিলে পারবে কেন?” গোটা বিহারে মেডিক্যাল কলেজ তখন মাত্র দুটো, সেখানকার বাঙালি ছেলেরা মিলেই ‘সন্ধ্যা-মজলিস’ সাহিত্যবাসর বসিয়ে ফেলেছিল, বছরশেষে বৈঠকও হত। সভাপতি বিভূতিভূষণ, কলকাতা থেকে প্রধান অতিথি জোগাড়ের ভার তাঁর। পরে আর্টস-সায়েন্সের ছাত্রদেরও সে মৌতাত জমে উঠল। বিভূতিভূষণের উপরি পাওনা— কলকাতার সাহিত্যিকেরা তাঁর কাছে রাত কাটান। কে আসেননি? গজেন্দ্রনাথ মিত্র, প্রবোধকুমার সান্যাল, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুশীলকুমার দে, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, জগদীশ ভট্টাচার্য, গৌরকিশোর ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সবাইকেই একটা দিন বেশি ধরে রাখার চেষ্টা করতেন, কলেজের হাঙ্গামা মিটে গেলে মন খুলে সাহিত্য-আলাপ। এক বার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এসেছিলেন, বিহারেও তাঁর খ্যাতি দেখার মতো, বিশেষ করে মৈথিলীদের মধ্যে! তাঁরা বাংলা কিছু বোঝেন, বীরেনবাবুর কৌতুক-চিত্র শোনেন, আর চণ্ডীপাঠের বিশুদ্ধ উচ্চারণ বা আবেগময় কণ্ঠস্বর তো তাঁদের বিহ্বল করে দিয়েছিল।


স্বাধীনতার পরে দেশ ব্রিটিশমুক্ত হলেও বিহারে সংখ্যালঘু বাঙালির হাল ফেরেনি। বাঙালিদের নিয়ে ব্রিটিশ কোনও কালেই সন্তুষ্ট নয়, বাগে আনতে না পেরে দমনের চেষ্টা করত, ঔপনিবেশিক যুগে বিহারে তেমনই এক কানুন ‘ডোমিসাইল রুল’। বাঙালিকে বিহারে চাকরি পেতে গেলে দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে ভূমিপুত্রের প্রমাণ দিতে হত, চাকরিজীবনে সার্টিফিকেটের জন্য ঘুরতে হয়েছে বিভূতিভূষণকেও। স্বাধীন দেশে সে দানব তো বেঁচেবর্তে রইলই, ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ ভাগ হওয়ায় রাষ্ট্র রুজির সঙ্গে ভাষার দাবিও তারা করল। প্রতিবাদী হল বাঙালি। এগারো বছর পর ‘বেঙ্গলী এসোসিয়েশন’কে পুনরুজ্জীবিত করলেন পটনার বিশিষ্টরা। ছোট-বড় শহরে সহায়ক সমিতি গঠনকল্পে বার্ষিক সর্ববিহার সম্মেলনের উদ্যোগ হল, জন্ম নিল পাক্ষিক পত্রিকা ‘সঞ্চিতা’। বাঙালিদের ইংরেজি শতবর্ষী সাপ্তাহিক ‘বিহার হেরাল্ড’ নবজীবন পেল। পটনা, ভাগলপুর হয়ে তৃতীয় বছরের সম্মেলন দারভাঙায়। স্মারক পত্রিকা ‘অ-প্রবাসী’। বিভূতিভূষণরা মনে করতেন, আসমুদ্র হিমাচল ভারতের যিনি বাসিন্দা, তিনি নিজভূমেই। 

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কৌতুক গল্পের বই বরযাত্রী'র ছয় বন্ধু গণশা, ঘোঁতনা, ত্রিলোচন, গোরাচাঁদ, রাজেন আর কে. গুপ্ত বাংলা রসসাহিত্যের পরিচিত চরিত্র। অল্প দু চার কথায় জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টি করা বা একটা সমাজকে এরকম সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরতেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। কৌতুক রসের এরকম বই হিসেবে বরযাত্রী সিরিজ বাংলা সাহিত্যে অনন্য। কৌতুক রসের তার আরেকটি বিখ্যাত সৃষ্টি রানু সিরিজের গল্পগুলি। কিন্তু বিভূতিভূষণের প্রতিভা ছিল বহুমুখী। ছোটদের জন্য পুজোসংখ্যায় তিনি নিয়মিত লিখেছেন, পোনুর চিঠি ও অন্যান্য নানান গল্প - যা পরিণত মনস্ক পাঠকেরাও পরম উৎসাহে পড়েছেন।

রচনা কর্ম 

বরযাত্রী
রানু সিরিজের গল্প গুলি
সর্গাদপীগরীয়সী
দুয়ার হতে অদূরে
কুশীপ্রাঙ্গনের চিঠি
একই পথের দুই প্রান্ত্রে
অযাত্রার জয়যাত্রা
পনুর চিঠি
কৈলাশের পাঠরানী
দুষ্টুলক্ষিদের গল্প
জীবন তীর্থ ( আত্মজীবনী)
কাঞ্চনমূল্য (শরৎস্মৃতি পুরস্কার পান)
এবার প্রিয়ংবদা ( রবীন্দ্র পুরস্কার পান)

পুরস্কার

বর্ধমান বিশবিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক 'ডি. লিট' উপাধি প্রদান করেন। তিনি

আনন্দ পুরস্কার;
শরৎস্মৃতি পুরস্কার;
রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন।


====={{{{{{{=°°°°^÷={{{{{{{{={============

Thursday, 28 July 2022

মহাপ্রয়াণ দিবস। বাংলা গদ্যের জনক ও আধুনিক মানব ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। Vol -812. Dt -29.07.2022. ১২ শ্রাবণ, ১৪২৯. শুক্রবার। The blogger in literature e-magazine


ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর।


২৯ শা জুলাই,১৮৯১ সালে ৭০ বছর বয়সে কলকাতায় পরলোকগমন করেন। 


১৮৭৫ সালের ৩১ মে নিজের উইল প্রস্তুত করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। পরের বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ডের ট্রাস্টি পদ থেকে ইস্তফা দেন। এপ্রিল মাসে কাশীতে পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। এই সময় কলকাতার বাদুড়বাগানে বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এই বাড়ি সংলগ্ন রাস্তাটি বিদ্যাসাগর স্ট্রিট ও সমগ্র বিধানসভা কেন্দ্রটি বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত। ১-২ আগস্ট আদালতে উপস্থিত থেকে চকদিঘির জমিদার সারদাপ্রসাদ রায়ের উইল মামলায় উইল প্রকৃত নয় বলে জমিদার পত্নী রাজেশ্বরী দেবীর স্বপক্ষে সাক্ষী দেন। ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে বাদুড়বাগানে বাস করতে থাকেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এ বছর বাংলার গভর্নর কর্তৃক সন্মাননা লিপি প্রদান করা হয় তাকে। এপ্রিল মাসে গোপাললাল ঠাকুরের বাড়িতে উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ছাত্রদের বেতন হয় মাসিক ৫০ টাকা। ১৮৭৯ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ [কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়] কর্তৃক দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত হয়।

১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় সিআইই উপাধি পান। ১৮৮১ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ থেকে প্রথম বিএ পরীক্ষার্থী পাঠানো হয়। ১৮৮২ সালের ৫ আগস্ট রামকৃষ্ণ পরমহংস তার বাদুড়বাগানের বাড়িতে আসেন। দুজনের মধ্যে ঐতিহাসিক এক আলাপ ঘটে। এই বছর মেট্রোপলিটান কলেজে চালু হয় আইন পাঠ্যক্রম। ১৮৮৩ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন। মার্চে বাণভট্টের হর্ষচরিতম্ তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৮৮৪ সালের নভেম্বরে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে ব্রজবিলাস গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়াও প্রকাশিত হয় ‘কস্যচিৎ তত্ত্বান্বেষিণঃ’ ছদ্মনামে বিধবা বিবাহ ও যশোহর হিন্দুধর্মরক্ষিণীসভা পুস্তক। দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি এর নামকরণ করেন বিনয় পত্রিকা। এই নভেম্বরেই কানপুরে বেড়াতে যান এবং সেখানে দিনকতক থাকেন।

১৮৮৫ সালে মেট্রোপলিটান কলেজের বউবাজার শাখা স্থাপিত হয়। ১৮৮৬ সালের অগস্টে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোসহচরস্য’ ছদ্মনামে রত্নপরীক্ষা পুস্তক প্রকাশ করেন। ১৮৮৭ সালের জানুয়ারিতে শঙ্কর ঘোষ লেনের নতুন ভবনে মেট্রোপলিটান কলেজ স্থানান্তরিত হয়। ১৮৮৮ সালের এপ্রিলে নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস, জুনে আখ্যান মঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ), জুলাইতে পদ্যসংগ্রহ নামক সংকলন গ্রন্থের প্রথম ভাগ প্রকাশ করেন। ১৩ আগস্ট পত্নী দীনময়ী দেবীর মৃত্যু হয়। ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশ করেন সংস্কৃত রচনা। ১৮৯০ সালের ১৪ এপ্রিল বীরসিংহ গ্রামে মায়ের নামে স্থাপন করেন ভগবতী বিদ্যালয়। মে মাসে নির্বাচিত উদ্ভট শ্লোকসংগ্রহ শ্লোকমঞ্জরী প্রকাশিত হয়।

বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই, বাংলা ১২৯৮ সনের ১৩ শ্রাবণ, রাত্রি দুটো আঠারো মিনিটে তার কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর ১০ মাস ৪ দিন। মৃত্যুর কারণ, ডাক্তারের মতে, লিভারের ক্যানসার।

মৃত্যুর পর ১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বরে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিদ্যাসাগর চরিত প্রকাশ করেন পুত্র নারায়ণচন্দ্র বিদ্যারত্ন। ১৮৯২ সালের এপ্রিলে ৪০৮টি শ্লোকবিশিষ্ট ভূগোল খগোল বর্ণনম্ গ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়। পশ্চিম ভারতের এক সিভিলিয়ন জন লিয়রের প্রস্তাবে বিদ্যাসাগর পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও ইউরোপীয় মত অনুসারে এই ভূগোল গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। বিবিসি জরিপকৃত(২০০৪) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তার স্থান অষ্টম।


শিক্ষামূলক গ্রন্থ

বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ ; ১৮৫৫)
ঋজুপাঠ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ ; ১৮৫১-৫২)
সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১)
ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩)

অনুবাদ গ্রন্থ

হিন্দি থেকে বাংলা
বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭ ; লল্লুলাল কৃত বেতাল পচ্চীসী অবলম্বনে)
সংস্কৃত থেকে বাংলা
শকুন্তলা (ডিসেম্বর, ১৮৫৪ ; কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে)
সীতার বনবাস (১৮৬০) - ভবভূতির উত্তররামচরিতম্‌ নাটকের আখ্যানবস্তু।[২০]
মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০ ; ব্যাসদেব মূল মহাভারত-এর উপক্রমণিকা অংশ অবলম্বনে)
বামনাখ্যানম্ (১৮৭৩ ; মধুসূদন তর্কপঞ্চানন রচিত ১১৭টি শ্লোকের অনুবাদ)
ইংরেজি থেকে বাংলা
বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮ ; মার্শম্যান কৃত হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচিত)
জীবনচরিত (১৮৪৯ ; চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ অবলম্বনে রচিত)
নীতিবোধ (প্রথম সাতটি প্রস্তাব – ১৮৫১ ; রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক অবলম্বনে রচিত)
বোধোদয় (১৮৫১ ; চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত)
কথামালা (১৮৫৬ ; ঈশপস ফেবলস অবলম্বনে রচিত)
চরিতাবলী (১৮৫৭ ; বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা অবলম্বনে রচিত)
ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯ ; শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস অবলম্বনে রচিত)


ইংরেজি গ্রন্থ

পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্
সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ
সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার
| style="width: 50%;text-align: left; vertical-align: top; " |

মৌলিক গ্রন্থ

সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩)
বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)
বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (প্রথম খন্ড ১৮৭১, ২য় খন্ড ১৮৭৩)
অতি অল্প হইল এবং ”আবার অতি অল্প হইল দুখানা পুস্তক (১৮৭৩, বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের উত্তরে 'কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য' ছদ্মনামে।)
ব্রজবিলাস, যৎকিঞ্চিৎ অপূর্ব্ব মহাকাব্য (নভেম্বর, ১৮৮৪) - "কবিকুলতিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য" ছদ্মনামে রচিত। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের রচনার প্রত্যুত্তরে লিখিত হয়।[২১]
রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬)
প্রভাবতী সম্ভাষণ (সম্ভবত ১৮৬৩)
জীবন-চরিত (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)
শব্দমঞ্জরী (১৮৬৪)
নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (১৮৮৮)
ভূগোল খগোল বর্ণনম্ (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)
সম্পাদিত গ্রন্থ


অন্নদামঙ্গল (১৮৪৭)
কিরাতার্জ্জুনীয়ম্ (১৮৫৩)
সর্বদর্শনসংগ্রহ (১৮৫৩-৫৮)
শিশুপালবধ (১৮৫৩)
কুমারসম্ভবম্ (১৮৬২)
কাদম্বরী (১৮৬২)
বাল্মীকি রামায়ণ (১৮৬২)
রঘুবংশম্ (১৮৫৩)
মেঘদূতম্ (১৮৬৯)
উত্তরচরিতম্ (১৮৭২)
অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ (১৮৭১)
হর্ষচরিতম্ (১৮৮৩)
পদ্যসংগ্রহ প্রথম ভাগ (১৮৮৮ ; কৃত্তিবাসি রামায়ণ থেকে সংকলিত)
পদ্যসংগ্রহ দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯০ ; রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল থেকে সংকলিত)


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার মনে করা হয়। যদিও তত্ত্বগত ভাবে বাংলা গদ্যের জনক তিনি নন। কারণ বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তার আগমনের বহুপূর্বেই গদ্যরচনার সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু সেইসব গদ্য ছিল শিল্পগুণবিবর্জিত নীরস এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্ন বাক্যসমষ্টি। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা সাধু গদ্যের একটি মান্য ধ্রুবক নির্দেশনা করেন। প্রয়োজনবোধে সেই গদ্যে চলিত ভাষার গতিশীলতাও যুক্ত করেন। কল্পনা ও স্বকীয় পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে যে গদ্যভাষার জন্ম তিনি দেন, তা ছিল সরস, সুমধুর, সুশ্রাব্য, ছন্দোময় ও গতিশীল। এই অর্থে তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের নব জন্মদাতা। তিনি বাংলা আধুনিক গদ‍্যের জনক।

মান্য সাধু বাংলা গদ্যের শিল্পরূপটি ঠিক কিরকম হতে পারে, তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনূদিত বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনাগুলিতে। ১৮৫৪ সালে শকুন্তলা ও ১৮৬০ সালে সীতার বনবাস গ্রন্থে তার সেই বিশিষ্ট গদ্যশৈলীর পরিচয় পাওয়া যাবে :

“ শকুন্তলার অধরে নবপল্লবশোভার সম্পূর্ণ আবির্ভাব ; বাহুযুগল কোমল বিটপের বিচিত্র শোভায় বিভূষিত ; আর, নব যৌবন, বিকশিত কুসুমরাশির ন্যায়, সর্বাঙ্গ ব্যাপীয়া রহিয়াছে। (শকুন্তলা, প্রথম পরিচ্ছেদ) ”
“ লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্য! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত ; অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয় ; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে। (সীতার বনবাস, প্রথম পরিচ্ছেদ, আলেখ্যদর্শন) ”
এই চিত্ররূপময়, কাব্যিক ও অলংকার বহুল গদ্যভাষার পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে বিদ্যাসাগরকে লৌকিক ভাষার আদর্শে দ্রুতগামী ও শ্লেষাত্মক গদ্যরচনা করতেও দেখা যায়। জীবনের শেষ পর্বে রচিত ব্রজবিলাস তার একটি উদাহরণ:

“ এই কয় প্রশ্নের উত্তর পাইলেই, বিদ্যারত্ন ও কপিরত্ন, উভয় খুড় মহাশয়ের সঙ্গে, নানা রঙ্গে, হুড়হুড়ি ও গুঁতোগুঁতি আরম্ভ করিব। প্রশ্নের উত্তর পাইলে, হাঙ্গাম ও ফেসাৎ উপস্থিত করিবেক, এমন স্থলে উত্তর না দেওয়াই ভাল, এই ভাবিয়া, চালাকি করিয়া, লেজ গুটাইয়া, বসিয়া থাকিলে আমি ছাড়িব না। (ব্রজবিলাস) ”
এই ভাষা আলালি ভাষার মতো ফারসি শব্দবহুল নয়, আবার হুতোমি ভাষার অশ্লীলতা দোষ থেকেও মুক্ত। বরং স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর্যবান অথচ সরস বাংলা চলিত গদ্যের সূত্রপাত করেছিলেন, তারই পূর্বসূরী।
সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিদ্যাসাগরের অসামান্য দখল ছিল। আবার নিজ চেষ্টায় ইংরেজি শিখে সেই ভাষার সাহিত্যের সঙ্গেও সম্যক পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত শব্দ ও পদবিন্যাসের শ্রুতিমাধুর্য ও গাম্ভীর্যকেই তিনি স্থান দিয়েছিলেন বাংলা গদ্যে; দুর্বোধ্যতা বা দুরুহতাকে নয়। অন্যদিকে কাব্যিক ছন্দোময়তায় গদ্যকে দিয়েছিলেন এক ললিত সুডৌল রূপ। গ্রহণ-বর্জনের যে অসামান্য ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল, তার মাধ্যমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক গদ্যের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারিক গদ্য ও সমকালীন সংবাদপত্রগুলির নিকৃষ্ট গদ্যনমুনা সব থেকেই ছেঁকে নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় সাহিত্যগুণ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের আদর্শে যতিচিহ্নের ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যে কালান্তর সূচনা করতেও পিছপা হননি তিনি। নিছক ব্যবহারিক বাংলা গদ্যকে তিনি উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক গদ্যে বিবর্তিত করতে তার প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, “বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন।”



১৮৩৯ সালে জ্ঞানচর্চায় তিনি 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ছাত্র জীবনে প্রতি বছরই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃৃত কলেজ ত্যাগ করে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান শিক্ষকের পদ লাভ করেন। ১৮৪৬ সালে সংস্কৃৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ওই কলেজের শিক্ষকদের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি সংস্কৃৃত কলেজের কাজে ইস্তফা দেন। ১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের 'হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল' অবলম্বনে রচনা করেন 'বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ' গ্রন্থখানি। ওই বছরই ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন। বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপনা করেন 'সব শুভকরী সভা'। ১৮৫০ সালে তিনি সংস্কৃৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৩৫ সংবৎ (১৮৭৪) প্রকাশিত 'বর্ণপরিচয়' গ্রন্থের ৫৩তম সংস্করণ। বাংলা বর্ণশিক্ষার জগতে ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত বইটি সার্ধশত বছর পরে আজও সমান জনপ্রিয়। ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় 'সব শুভকরী' পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর প্রথম সংখ্যায় 'বাল্যবিবাহের দোষ' নামে একটি বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৩ সালে জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হলে তার সদস্য মনোনীত হন বিদ্যাসাগর।
সংস্কৃত শাস্ত্রের বিরাট পণ্ডিত হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে দ্বিধা করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল তাকে। এই বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সর্বস্ব পণ করে সংগ্রাম করেছেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন, যে লোকাচার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত, আসলে তা ধর্মবহির্ভূত স্থবিরতার আচারমাত্র। তার আন্দোলন সফল হয়েছিল। ১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন।[১৫][১৬] তবে শুধু আইন প্রণয়নেই ক্ষান্ত থাকেননি বিদ্যাসাগর মহাশয়। তার উদ্যোগে একাধিক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। তার পুত্রও( নারায়ণচন্দ্র) এক ভাগ্যহীনা বিধবাকে বিবাহ করেন। এজন্য সেযুগের রক্ষণশীল সমাজ ও সমাজপতিদের কঠোর বিদ্রুপ ও অপমানও সহ্য করতে হয় তাকে। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বহুবিবাহের মতো একটি কুপ্রথাকে নির্মূল করতেও আজীবন সংগ্রাম করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। প্রচার করেন বাল্যবিবাহ রোধের সপক্ষেও। এর সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রচারেও যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। শুধু কলকাতায় নয়, নারীমুক্তির বার্তা বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে, বিভিন্ন জেলাতেও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারীশিক্ষার সপক্ষে জোর প্রচার চালান তিনি। যদিও তার এই উদ্যোগও সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা নিন্দিত হয়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পর্যন্ত অত্যন্ত হীন বাক্যবাণে নারীমুক্তি আন্দোলনের ব্যঙ্গ করেন। তবু তার জীবদ্দশাতেই নারীশিক্ষা আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।[
বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যসাগসর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তিনি সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করে সরকার এই স্কুলগুলোর কিছু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি। এরপর কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত) এবং নিজের মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।।


" বীরসিংহগ্রামে আমার জন্ম হইয়াছে; কিন্তু, এই গ্রাম আমার পিতৃপক্ষীয় অথবা মাতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বাসস্থান নহে। জাহানাবাদের (অধুনা আরামবাগ) ঈশান কোণে, তথা হইতে প্রায় তিন ক্রোশ উত্তরে, বনমালীপুর নামে যে গ্রাম আছে, উহাই আমার পিতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বহুকালের বাসস্থান। "

১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর (১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার) ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শর্মা জন্মগ্রহণ করেন।[১৩] এই গ্রামটি অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত হলেও, সেই যুগে ছিল হুগলি জেলার অন্তর্ভুক্ত।[১৪] ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার নাম ছিল ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ছিল ভগবতী দেবী। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা হুগলি জেলার বনমালীপুর গ্রাম।[৭] ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত ব্যক্তি। তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন। সেই কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব বীরসিংহেই তার মা ও ঠাকুরমার সঙ্গে অতিবাহিত হয়।



চার বছর নয় মাস বয়সে ঠাকুরদাস বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। কিন্তু সনাতন বিশ্বাস বিদ্যাদানের চেয়ে শাস্তিদানেই অধিক আনন্দ পেতেন। সেই কারণে রামজয় তর্কভূষণের উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক উৎসাহী যুবক বীরসিংহ গ্রামে একটি নতুন পাঠশালা স্থাপন করেন। আট বছর বয়সে এই পাঠশালায় ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। তার চোখে কালীকান্ত ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। কালীকান্তের পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। তাদের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন কালীকান্ত ও চাকর আনন্দরাম গুটিও। কথিত আছে, পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে তিনি সেগুলি অল্প আয়াসেই আয়ত্ত করেছিলেন। কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে তারা আশ্রয় নেন। এই পরিবারের কর্তা তখন জগদ্দুর্লভ সিংহ। ১৮২৯ সালের ১ জুন সোমবার কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ( যা বর্তমানে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত) ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮২৪ সালে; অর্থাৎ, ঈশ্বরচন্দ্রের এই কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর আগে। তার বয়স তখন নয় বছর। এই কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বিদ্যাসাগরের আত্মকথা থেকে জানা যায়, মোট সাড়ে তিন বছর তিনি ওই শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন।ব্যাকরণ পড়ার সময় ১৮৩০ সালে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণিতেও ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান। সংস্কৃত কলেজে মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের ‘পে স্টুডেন্ট’ ও অন্য ছাত্রদের ‘আউট স্টুডেন্ট’ বলা হত। অন্যদিকে তিন বছর ব্যাকরণ শ্রেণিতে পঠনপাঠনের পর বারো বছর বয়সে প্রবেশ করেন কাব্য শ্রেণিতে। সে যুগে এই শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। ১৮৩৩ সালে ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র ২ টাকা পেয়েছিলেন। ১৮৩৪ সালে ইংরেজি ষষ্ঠশ্রেণির ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক পারিতোষিক হিসেবে পান। এই বছরই ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

১৮৩৫ সালে ইংরেজি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রূপে পলিটিক্যাল রিডার নং ৩ ও ইংলিশ রিডার নং ২ পারিতোষিক পান। এই বছরই নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরেজি শ্রেণি উঠিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বর্ষে সাহিত্য পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে পনেরো বছর বয়সে প্রবেশ করেন অলংকার শ্রেণিতে। অলংকার শাস্ত্র একটি অত্যন্ত কঠিন বিষয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ ও রসগঙ্গাধর প্রভৃতি অলংকার গ্রন্থে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

১৮৩৬ সালে অলংকার পাঠ শেষ করেন। বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে রঘুবংশম্, সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রত্নাবলী, মালতী মাধব, উত্তর রামচরিত, মুদ্রারাক্ষস, বিক্রমোর্বশী ও মৃচ্ছকটিক গ্রন্থ পারিতোষিক পান। ১৮৩৭ সালের মে মাসে তার ও মদনমোহনের মাসিক বৃত্তি বেড়ে হয় আট টাকা।

এই বছরই ঈশ্বরচন্দ্র স্মৃতি শ্রেণিতে ভর্তি হন (এই অংশের সমতুল্য আজকের সংস্কৃত কলেজ-র পঠন)। সেই যুগে স্মৃতি পড়তে হলে আগে বেদান্ত ও ন্যায়দর্শন পড়তে হত। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের মেধায় সন্তুষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে সরাসরি স্মৃতি শ্রেণিতে ভর্তি নেন। এই পরীক্ষাতেও তিনি অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ত্রিপুরায় জেলা জজ পণ্ডিতের পদ পেয়েও পিতার অনুরোধে তা প্রত্যাখ্যান করে ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণিতে। শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি সেই সময় বেদান্তের অধ্যাপক। ১৮৩৮ সালে সমাপ্ত করেন বেদান্ত পাঠ। এই পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং মনুসংহিতা, প্রবোধ চন্দ্রোদয়, অষ্টবিংশতত্ত্ব, দত্তক চন্দ্রিকা ও দত্তক মীমাংসা গ্রন্থ পারিতোষিক পান। সংস্কৃতে শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা পুরস্কারও পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৪০-৪১ সালে ন্যায় শ্রেণিতে পঠনপাঠন করেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই শ্রেণিতে দ্বিতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে তিনি পারিতোষিক পান। ন্যায় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ১০০ টাকা, পদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা, দেবনাগরী হস্তাক্ষরের জন্য ৮ টাকা ও বাংলায় কোম্পানির রেগুলেশন বিষয়ক পরীক্ষায় ২৫ টাকা-সর্বসাকুল্যে ২৩৩ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর 'ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা' নামে স্বাক্ষর করতেন৷


জন্মগ্রহণ কালে তার পিতামহ তার বংশানু্যায়ী নাম রেখেছিলেন "ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়"। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। এই প্রশংসাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ :

HINDOO LAW COMMITTEE OF EXAMINATION

We hereby certify that at an Examination held at the Presidency of Fort William on the 22nd Twenty-second April 1839 by the Committee appointed under the provisions of Regulation XI 1826 Issur Chandra Vidyasagar was found and declared to be qualified by his eminent knowledge of the Hindoo Law to hold the office of Hindoo Law officer in any of the Established Courts of Judicature.
H.T. Prinsep
President






Member of the Committee of Examination

This Certificate has been granted to the said Issur Chandra Vidyasagar under the seal of the committee. This 16th Sixteenth day of May in the year 1839 Corresponding with the 3rd Third Joistha 1761 Shukavda.
J.C.C. Sutherland
Secy To the Committee (পুরনো বানান অপরিবর্তিত)

সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর তিনি এই কলেজ থেকে অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত দেবনাগরী হরফে লিখিত এই সংস্কৃত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে 'বিদ্যাসাগর' নামে অভিহিত করেন। প্রশংসাপত্রটি নিম্নরূপ:


অস্মাভিঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরায় প্রশংসাপত্রং দীয়তে। অসৌ কলকাতায়াং শ্রীযুত কোম্পানী সংস্থাপিত বিদ্যামন্দিরে ১২ দ্বাদশ বৎসরান্ ৫ পঞ্চমাসাংশ্চোপস্থায়াধোলিখিত শাস্ত্রাণ্য ধীতবান্
ব্যাকরণম্... শ্রীগঙ্গাধর শর্ম্মভিঃ


কাম্যশাস্ত্রম্... শ্রীজয়গোপাল শর্ম্মভিঃ
অলঙ্কারশাস্ত্রম্... শ্রীপ্রেমচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
বেদান্তশাস্ত্রম্... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
ন্যায়শাস্ত্রম্... শ্রীজয়নারায়ণ শর্ম্মভিঃ
জ্যোতিঃশাস্ত্রম্... শ্রীযোগধ্যান শর্ম্মভিঃ
ধর্মশাস্ত্রম্... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
সুশীলতয়োপস্থিতস্বৈত স্বৈতেষু শাস্ত্রেষু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ট।
১৭৬৩ এতচ্ছকাব্দীয় সৌরমার্গশীর্ষস্য বিংশতি দিবসীয়ম্।
রসময় দত্ত, সচিব।
১০ ডিসেম্বর ১৮৪১।

১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত হবার পর সেই বছরই ২৯ ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিতের পদে আবৃত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বেতন ছিল মাসে ৫০ টাকা। ১৮৪৬ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এই পদের দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৪৬ সালের ৬ এপ্রিল একই বেতন হারে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের ভার গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স পঁচিশ বছর। ১৮৪৭ সালে স্থাপন করেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামে একটি বইয়ের দোকান। এই বছরই এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় হিন্দি বেতাল পচ্চিসী অবiলম্বনে রচিত তার প্রথম গ্রন্থ বেতাল পঞ্চবিংশতি। প্রথম বিরাম চিহ্নের সফল ব্যবহার করা হয় এ গ্রন্থে। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সম অংশীদারত্বে সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানাও স্থাপন করেন তিনি। অন্নদামঙ্গল কাব্যের পান্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য এই বছরই নদিয়ার কৃষ্ণনগরে আসেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে সংরক্ষিত মূল গ্রন্থের পাঠ অনুসারে পরিশোধিত আকারে দুই খণ্ডে অন্নদামঙ্গল সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। এই বইটিই সংস্কৃত যন্ত্র প্রেসের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। ১৮৪৭ সালের ১৬ জুলাই কলেজ পরিচালনার ব্যাপারে সেক্রেটারি রসময় দত্ত এর সঙ্গে মতান্তর দেখা দেওয়ায় সংস্কৃত কলেজের সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচনা করেন বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থখানি। এই বছরেই ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে আবৃত হন। বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপনা করেন সর্ব্বশুভকরী সভা। সেপ্টেম্বরে উইলিয়াম ও রবার্ট চেম্বার্স রচিত খ্যাতিমান ইংরেজ মনীষীদের জীবনী অবলম্বনে তার লেখা জীবনচরিত গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়। ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর প্রথম সংখ্যায় বাল্যবিবাহের দোষ নামে একটি বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ৪ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াের কাজে ইস্তফা দিয়ে ৫ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন। ১৮৫১ সালের ৫ জানুয়ারি সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ ছাড়াও কলেজের অস্থায়ী সেক্রেটারির কার্যভারও গ্রহণ করেন। ২২ জানুয়ারি ১৫০ টাকা বেতনে কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই সংস্কৃত কলেজে সেক্রেটারির পদটি বিলুপ্ত হয়। এপ্রিল মাসে রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে তার রচিত বোধোদয় পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার নিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। ৯ জুলাই পূর্বতন রীতি বদলে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থদের সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। ২৬ জুলাই প্রবর্তিত হয় রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটির প্রথা। এর আগে প্রতি অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে ছুটি থাকত। ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজের দ্বার সকল বর্ণের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। নিয়ম হয়, যে কোনও সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তান সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ পাবে। ১৮৫২ সালের এপ্রিলে ২৬ অনুচ্ছেদ সংবলিত নোটস অন দ্য সংস্কৃত কলেজ প্রস্তুত হয়। ২৮ আগস্ট থেকে কলেজে প্রবেশার্থী ছাত্রদের ২ টাকা দক্ষিণা দেওয়ার প্রথা চালু হয়।

১৮৫৩ সালে জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। জুন মাসে কালিদাসের রঘুবংশম্ ও ভারবির কিরাতার্জ্জুনীয়ম্ প্রকাশিত হয় তার সম্পাদনায়। সেপ্টেম্বর মাসে বারাণসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ জেমস আর ব্যালানটাইন সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শন করে যে রিপোর্ট দেন, তার মতামত সমালোচনা করে শিক্ষা সংসদে একটি রিপোর্ট দেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বাংলার শিক্ষার ইতিহাসে এই রিপোর্ট এক যুগান্তকারী দলিল। এই বছরেই তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ব্যাকরণ কৌমুদী প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হলে তার সদস্য মনোনীত হন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ছাত্রদের থেকে মাসিক ১ টাকা বেতন নেওয়ার প্রথা চালু হয়। এই বছরেই ব্যাকরণ কৌমুদী তৃতীয় ভাগ ও কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে তার রচিত শকুন্তলা প্রকাশিত হয়। এছাড়া তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা শীর্ষক একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়।

১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – প্রথম পুস্তক প্রকাশিত। এই বছরের এপ্রিল মাসে বাংলা নববর্ষের দিন (১লা বৈশাখ,সংবৎ ১৯১২ অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল ১৮৫৫) যুগান্তকারী বাংলা শিশুপাঠ্য বর্ণমালা শিক্ষাগ্রন্থ বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়। কথিত আছে, মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পাল্কিতে বসে তিনি বর্ণপরিচয়-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। ১ মে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ছাড়াও মাসিক অতিরিক্ত ২০০ টাকা বেতনে দক্ষিণবঙ্গে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে নিযুক্ত হন। জুন মাসে (১৪ জুন অর্থাৎ ১লা আষাঢ় সংবৎ ১৯১২) বর্ণপরিচয় গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। ১৭ জুলাই বাংলা শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সংস্কৃত কলেজের অধীনে ওই কলেজের প্রাতঃকালীন বিভাগে নর্ম্যাল স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন তার বন্ধু এবং বিশিষ্ট বাঙালি যুক্তিবাদী ও গ্রন্থকার অক্ষয়কুমার দত্ত। এই বছরেই দক্ষিণবঙ্গের চার জেলায় একাধিক মডেল স্কুল বা বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নদিয়ায় পাঁচটি, আগস্ট-অক্টোবরে বর্ধমানে পাঁচটি, আগস্ট-সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে হুগলিতে পাঁচটি এবং অক্টোবর-ডিসেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় চারটি বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। অক্টোবর মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করার পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণ সহ বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশ করেন। বিধবা বিবাহ আইনসম্মত করতে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সরকারের নিকট বহুসাক্ষর সংবলিত এক আবেদনপত্রও পাঠান। ২৭ ডিসেম্বর আরেকটি আবেদনপত্র পাঠান বহু বিবাহ নিবারণ বিধির জন্য।
১৮৫৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মেদিনীপুরে পঞ্চম বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ঈশপের কাহিনি অবলম্বনে রচিত কথামালা প্রকাশিত হয়। ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইনসম্মত হয়। এই দিনই প্রকাশিত হয় তার স্বরচিত গ্রন্থ চরিতাবলী। এই বছর ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রথম বিধবা বিবাহ আয়োজিত হয় ১২, সুকিয়া স্ট্রিটে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পাত্র ছিলেন প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশের কণিষ্ঠ পুত্র তথা সংস্কৃত কলেজের কৃতি ছাত্র ও অধ্যাপক, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী ছিলেন বর্ধমান জেলার পলাশডাঙা গ্রামের অধিবাসী ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দ্বাদশ বর্ষীয়া বিধবা কন্যা কালীমতী।

১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি স্থাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য তথা ফেলো মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। উল্লেখ্য এই সমিতির ৩৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ছয় জন ছিলেন ভারতীয়। এই বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে হুগলি জেলায় সাতটি ও বর্ধমান জেলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরের বছর জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে হুগলিতে আরও তেরোটি, বর্ধমানে দশটি, মেদিনীপুরে তিনটি ও নদিয়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। মোট ১৩০০ ছাত্রীসংবলিত এই বিদ্যালয়গুলির জন্য তার খরচ হত মাসে ৮৪৫ টাকা। এই ১৮৫৮ সালের ৩ নভেম্বর শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তার সঙ্গে মতবিরোধ হলে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করেন। প্রায় ৩৯ বছর বয়সে সরকারের সঙ্গে তার সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়। যদিও নিজের কাজের জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনও রূপ স্বীকৃতি বা পেনসন তিনি পান নি।

১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনার নেপথ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যথেষ্ট অবদান ছিল। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম পত্রিকা যাতে রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৫৯ সালের ১ এপ্রিল পাইকপাড়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় [লা স্কুল। কিছুকাল এই প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন তিনি। ২০ এপ্রিল মেট্রোপলিটান থিয়েটারে উমেশচন্দ্র মিত্র রচিত নাটক বিধবা বিবাহ প্রথম অভিনীত হয়। ২৩ এপ্রিল রামগোপাল মল্লিকের সিঁদুরিয়াপট্টির বাসভবনে সেই নাটকের অভিনয় দেখেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মিশে গেলে উক্ত সভার সভাপতির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর গণশিক্ষার প্রসারে সরকারি অনুদানের জন্য বাংলার গভর্নরের নিকট আবেদন করেন। ১৮৬০ সালে বোর্ড অফ একজামিনার্সের পদ থেকেও ইস্তফা দেন তিনি। এই বছরই ১২ এপ্রিল ভবভূতির উত্তর রামচরিত অবলম্বনে তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ সীতার বনবাস প্রকাশিত হয়। কথিত আছে বইখানি তিনি রচনা করেছিলেন মাত্র চারদিনে।

১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছর ডিসেম্বর মাসে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে গ্রহণ করেন তার সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার পরিচালনভার। ১৮৬২ সালে কৃষ্ণদাস পালকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন তিনি। এই বছর তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাণভট্টের কাদম্বরী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাকে উৎসর্গ করেন স্বরচিত বীরাঙ্গনা কাব্য। ১৮৬৩ সালে সরকার তাকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য, ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী নাবালক জমিদারদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৮৫৬ সালে এই ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক গদ্যরচনা 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' এ বছর রচিত হয়। ১৮৬৪ সালে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের নাম পরিবর্তন করে কলিকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন রাখা হয়। ৪ জুলাই ইংল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে সাম্মানিক সদস্য নির্বাচিত করে। খুব কম ভারতীয়ই এই বিরল সম্মানের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। ২ আগস্ট ফ্রান্সে ঋণগ্রস্ত মাইকেল মধুসূদনের সাহায্যার্থে ১৫০০ টাকা প্রেরণ করেন তিনি। ১৮৬৫ সালের ১১ জানুয়ারি ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর মহাশয় তার প্রথম রিপোর্টটি পেশ করেন।

১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার নিকট আবেদনপত্র পাঠান বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছরই প্রকাশিত হয় তার পরিমার্জিত আখ্যান মঞ্জরী পুস্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। ১৮৬৭ সালের জুলাই মাসে জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতার সঙ্গে গোপালচন্দ্র সমাজপতির বিবাহ হয়। এবছর অনাসৃষ্টির কারণে বাংলায় তীব্র অন্নসংকট দেখা দিলে তিনি বীরসিংহ গ্রামে নিজ ব্যয়ে একটি অন্নসত্র স্থাপন করেন। ছয় মাস দৈনিক চার-পাঁচশো নরনারী ও শিশু এই অন্নসত্র থেকে অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। ১৮৬৮ সালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামগোপাল ঘোষ প্রয়াত হন। ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারির পদ ত্যাগ করেন। এপ্রিল মাসে তার সম্পাদনায় কালিদাসের মেঘদূতম্ প্রকাশিত হয়। ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচিত কমেডি অফ এররস্ অবলম্বনে রচিত বাংলা গ্রন্থ ভ্রান্তিবিলাস। উল্লেখ্য, শোভাবাজার রাজবাড়িতে আনন্দকৃষ্ণ বসুর কাছে তিনি শেকসপিয়রের পাঠ নেন। কথিত আছে, মাত্র পনেরো দিনে তিনি কমেডি অফ এবর-এর এই ভাবানুবাদটি রচনা করেছিলেন। এবছরই বীরসিংহ গ্রামে তার পৈতৃক বাসভবনটি ভস্মীভূত হয়। চিরতরে জন্মগ্রাম বীরসিংহ ত্যাগ করেন ‘বীরসিংহের সিংহশিশু’।
১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। ২০ ফেব্রুয়ারি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, দুর্গাচরণ ছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা। ১১ আগস্ট বাইশ বছর বয়সী পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগর নিবাসী শম্ভুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্দশবর্ষীয়া বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল কাশীতে মা ভগবতী দেবী প্রয়াত হন।

১৮৭১-৭২ সাল নাগাদ তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। জলহাওয়া পরিবর্তনের জন্য এই সময় তিনি কার্মাটারে (বর্তমানে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত) একটি বাগানবাড়ি কেনেন। সেখানে একটি স্কুলও স্থাপন করেন। ১৮৭২ সালের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। স্বল্প আয়ের সাধারণ বাঙালির মৃত্যুর পর তার স্ত্রী-পুত্র পরিবারবর্গ যাতে চরম অর্থকষ্টে না পড়েন, তার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা। বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন এর অন্যতম ট্রাস্টি। ১৮৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে স্থাপিত হয় মেট্রোপলিটান কলেজ। সেযুগের এই বেসরকারি কলেজটিই বর্তমানে কলকাতার বিখ্যাত বিদ্যাসাগর কলেজ নামে অভিহিত। এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (দ্বিতীয় পুস্তক)। এই সময়েই মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউটের শ্যামপুকুর শাখাটির প্রতিষ্ঠা। মে মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের উত্তরে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামের আড়ালে রচনা করেন অতি অল্প হইল এবং আবার অতি অল্প হইল নামে দু-খানি পুস্তক। ১৬ আগস্ট মাইকেল মধুসূদনের নাটক শর্মিষ্ঠা অভিনয়ের মাধ্যমে উদ্বোধিত হল বেঙ্গল থিয়েটার। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই থিয়েটারের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৮৭৪ সালে মাত্র এক বছরেই ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান কলেজ গুণানুসারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল।



{{{{{{{[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[