Sunday, 31 July 2022
স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। বাংলা সাহিত্যের কবি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। Vol -814. Dt -01.08.2022. ১৫ শ্রাবণ ১৪২৯. সোমবার।
Saturday, 30 July 2022
মহাপ্রয়াণ দিবস। জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী মোহাম্মদ রফি। Vol -813. Dt -31.07.2022. ১৪ শ্রাবণ,১৪২৯. রবিবার। The blogger in literature e-magazine
Friday, 29 July 2022
স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। বাংলা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। Vol -812. Dt -30.07.2022. ১৩ শ্রাবণ,১৪২৯. শনিবার। The blogger in literature e-magazine
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
সাম্মানিক ডি লিট, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম
মৃত্যু - ৩০ জুলাই ১৯৮৭ সালে।
মিথিলায় তাঁর জন্ম, মৃত্যুও সেখানেই। ১৯৮৭ সালে দারভাঙায় প্রয়াত হন বিভূতিভূষণ। বাংলার দিকে তাকিয়ে, বাংলাকে মনে রেখে, দূরে-দূরেই চলে গেলেন ‘পরবাসী’ এক বাঙালি সাহিত্যিক।
বিভূতিভূষণের সব ভাল লাগার মধ্যেও বাংলা নিয়ে যে অভিযোগ ছিল, আজকের বাঙালির কাছে তা প্রণিধানযোগ্য। তাঁর আত্মকথায় সে কালের কলকাতা পায়ে হেঁটে ঘোরার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তিনি বলতেন নেশা— ‘শিবপুর থেকে নিয়ে সর্বত্রই বাঙ্গালী টুকরা টাকরা কুড়িয়ে বেড়ানো’। শিবপুর ফেরিঘাটে গঙ্গা পেরিয়ে হেঁটে কলেজ, সেই পথের পরিধিই ক্রমশ বাড়ে। কিন্তু বদলে যাওয়া শহর দেখে পরিতাপ ঝরে পড়েছে তাঁর গলায়— “আমরা বলি বাঙ্গালী আমরা মূলত কবির জাত, শিল্পীর জাত, গৌণত আর কিছু।... ইডেন গেছে, ডালহৌসী গেছে, আরও কত গেছে এই রকম।” বাংলার সঙ্গে তাঁর দু’বার আলাপ, প্রথম বার চাতরায় তাকে ‘দেখা’, দ্বিতীয় বার শিবপুরে তাকে ‘পাওয়া’। দুই আলাপেই যে ‘ফ্রেশ্নেস্’ ছিল, চার পাশের ক্লিন্নতায় দিনে-দিনে কি তা ক্ষুণ্ণও হয়েছিল।
তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের রচয়িতা। রসরচনায়ও রয়েছে তার অসামান্য দক্ষতা। তিনি অনেক কৌতুক ও রঙ্গরসের গল্পও লিখেছেন।
১৮৯৪ সালের ২৪ অক্টোবর বিহারের দ্বারভাঙ্গা
জেলার পান্ডুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বিপিন বিহারী মুখোপাধ্যায়। তার আদি নিবাস হুগলী জেলার চাতরা হলেও তার তিন পুরুষের বাস বিহারের দ্বারভাঙ্গায় ছিল। বিভূতিভূষণ দ্বারভাঙ্গা পীতাম্বরী বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। দ্বারভাঙ্গা রাজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং রিপন কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. পাশ করেন।
তার কর্মক্ষত্র ছিল বৈচিত্রময়। কর্মজীবনের প্রথম দিকে তিনি ইন্ডিয়ান নেশন পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষের পদে আসীন ছিলেন। পরে বিহারের দ্বারভাঙ্গায় মহারাজের সচিব হিসাবেও কাজ করেন। আবার পরবর্তি কালে কিছুকাল শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯১৬ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত কর্মজীবনে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা, ধনী পরিবারে গৃহ-শিক্ষকতা করেছিলেন। শিক্ষকতা চলাকালীন তিনি নিজেকে লেখার কাজে নিয়োজিত করেন। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের তিনি রচয়িতা। তার জনপ্রিয়তম উপন্যাসটি হলো নীলাঙ্গুরিয়। এছাড়াও তিনি অনেক কৌতুক ও রঙ্গরসের গল্পও লিখেছেন।
ইন্টারমিডিয়েট-ইন-আর্টস পড়তে দু’বছরের জন্য শিবপুরে পাঠানো হল বিভূতিভূষণকে— ১৯১২ সালে রিপন কলেজে। রাজস্কুলে চল্লিশটা ছেলের মধ্যে যে ছিল পুরোভাগে, কলকাতার কলেজে বৃত্তি পাওয়া স্কলারদের ভিড়ে সুদূর বিহার থেকে আসা সেই ছাত্রের হারিয়ে যাওয়ারই কথা, অনেকটা তাঁর ‘বরযাত্রী’ গল্পের কে গুপ্ত-র মতোই। শুধু নিজের যোগ্যতা আর আগ্রহেই ভেসে রইল সে ছেলে।
এর পরের আরও কিছু খুচরো আসা-যাওয়া মিলিয়ে শিবপুরে মেরেকেটে তিন বছর কাটিয়েছেন বিভূতিভূষণ। অথচ তিনি বলেন, এই তিনটে বছর তাঁর দীর্ঘ জীবনের যেন অর্ধেকটা জুড়েই আছে। জীবনের মাপকাঠি সময় নয়, উপলব্ধির গাঢ়ত্বে-গভীরতা-বৈচিত্রে। বাংলার প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছতে পেরে তাঁর মনে হয়েছিল, “আমার বাঙালীত্ব-বোধ একটা সার্থকতা পেল।” একে প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতা বা গণ্ডিবদ্ধ স্বজাতীয়তা মনে হতেই পারে, বিভূতিভূষণ তাই বারবার তাঁর পূর্ণ ভারতীয়ত্বে বিশ্বাসের কথা জোর দিয়ে বলতেন। তিনি এমন ভারতের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে প্রদেশের সীমারেখা মুছে গিয়ে জগতের সামনে দাঁড়ায় এক দেশ। তবু তাঁর কাছে, বাঙালিত্ব আলাদা বস্তু— ‘একটা পাড়ার মধ্যে একটা বাড়ীর যে নিজস্বতা’। ছেলেবেলায় চাতরাকে বিভুঁই মনে হয়েছিল, পণ্ডৌল তখনও জীবনের ধ্রুবতারা, দারভাঙার পরিবেশে নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিল। বাঙালিরও তখন স্বর্ণযুগ। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, আশুতোষ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, সুরেন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ— “এমন একটা যুগ যে, অবাঙ্গালীও বাঙ্গালীত্বে গৌরববোধ করবেন।”
শিবপুরের জীবন তাঁকে একটা বাঙালি সমাজও দিয়েছিল। বিবাহ, শ্রাদ্ধ, উপনয়ন, ব্রত, অন্নপ্রাশন— ভোজই কি সামাজিক আদানপ্রদানের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান? সবচেয়ে আনন্দের তো বটেই। বিভূতিভূষণ নিজেও কৌতুক করেন, ‘সবটুকু পরস্মৈপদী, রসনা-তৃপ্তির সঙ্গে, সে-তৃপ্তির আহরণের যে-উদ্বেগ আর ব্যয়ভার তার কোন সম্বন্ধ থাকেনা’। আলাপ-আলোচনার সুযোগ এক আকর্ষণ। পঙ্ক্তির অপেক্ষা আর পঙ্ক্তিতে বসার মধ্যেই হয়ে যায় কত গল্পগাছা, সমালোচনা, পরনিন্দা, পরচর্চা— যাকে বলে মজলিশ। বিভূতিভূষণের লেখালিখির প্রেরণার আট আনাও এই শিবপুর থেকেই। দারভাঙায় অঙ্কুরিত সাহিত্যরচনার বাসনা পল্লবিত হয় শিবপুরে। কলকাতার বিপুল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের যে সান্নিধ্য তখন পেলেন, নবীন সাহিত্যিকের পক্ষে তা এক কল্পনাতীত পরিবেশ।
আইএ পাশ করে বিহারে ফিরতে হল, পটনা বি এন কলেজে বিএ পড়তে ভর্তিও হলেন, কিন্তু মাত্র জনা ছয়েক বাঙালি ছাত্রের সম্পর্ক হল খুবই নিবিড়, থেমে থাকল না বিভূতিভূষণের কলমও। ১৯১৫ সালে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হল ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়, তৎকালীন ভারতের অগ্রণী পত্রিকা। পরিচয়ের সঙ্গে এল আত্মবিশ্বাস।
প্রথম পাতাকলকাতাপশ্চিমবঙ্গদেশখেলাআষাঢ়ের গল্পবিদেশসম্পাদকের পাতাবিনোদনজীবন+ধারাজীবনরেখাব্যবসাভিডিয়োঅন্যান্যপাত্রপাত্রী
নিরন্তর খাঁটি বাঙালিয়ানার সন্ধান
৮৯৬ সালে পণ্ডৌল নামে যে উত্তর বিহারের অঞ্চলে বিভূতিভূষণের জন্ম তা শহর নয়, আবার গণ্ডগ্রামও নয়।
আবাহন দত্ত
১৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৭:২৩
ছবি: পরিমল গোস্বামী
এই বিজ্ঞাপনের পরে আরও খবর
প্রবাসে জন্ম, আমৃত্যু বাস পরবাসেই। তবু জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে একান্ত ভাবে বাঙালিয়ানার সাধনা করেছেন, সাহিত্যসাধনার অনুপ্রেরণাও তা থেকেই। এমনকি, অভাবে-অপমানেও কখনও নিজের অভীষ্ট থেকে বিচ্যুত হননি বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়।
২৯ মার্চ, ১৯৭২। দারভাঙা থেকে দিন কয়েকের জন্য নিউ আলিপুরে এসেছেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। সন্ধের আড্ডায় এক বন্ধু নিভৃতে জানালেন, “যাওয়ার আগে একটা ভাল খবরই দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে একটু খুঁৎ থেকে যাচ্ছে।” ব্যাপার হল, সে বারের রবীন্দ্র পুরস্কার বিভূতিভূষণেরই পাওয়ার কথা, কিন্তু শেষ কালে এক ‘ইনফ্লুয়েনসিয়াল্’ সাংবাদিক বাদ সেধেছেন। কাষ্ঠ হেসে লেখকের প্রত্যুত্তর, “আপনি তো জানেন, আমার নিজের এ বিষয়ে কোন চেষ্টা থাকেনা। বইও এগিয়ে দিই না। এ অবস্থায় পেলে মুফুতে পাওয়া যায়। না পেলে দুঃখ থাকবার কথা নয়। তবু যে বৈরাগ্যই আছে, এ কথা কি ক’রে বলব? যেমন হয় জানাবেন।” ১২ এপ্রিল রেডিয়োয় ঘোষণা হল, “আর কোন বই না পাওয়ায় বিভূতি মুখোপাধ্যায়ের ‘এবার প্রিয়ংবদা’র ওপর দেওয়া হোল পুরস্কার।” এ বার ব্যাপারটা সত্যিই ভাবিয়ে তুলল বিভূতিভূষণকে। হয়তো কমিটিতে তাঁর নাম আটকানো যায়নি বলে রেডিয়োয় বিকৃত প্রচার! কিন্তু রাজ্য সরকারের সঙ্গে পত্রাচার কি রুচিসম্মত হবে? কলকাতায় দু’-এক জনকে চিঠি লিখলেন। জানা গেল, তাঁর নাম সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হলেও কোনও বইয়ের হদিশ পাওয়া যাচ্ছিল না, অতঃপর এক সদস্য ‘প্রকাশ ভবন’ আর ‘এম. সি. সরকার’ ঘুরে ‘এবার প্রিয়ংবদা’ জোগাড় করতে সমর্থ হন, অগত্যা সেই নামই ঘোষণা। এক দিন সরকারি চিঠিও এল, যথাযথ বিধিবদ্ধ। শেষাবধি আর পুরস্কারখানা প্রত্যাখ্যান করলেন না বিভূতিভূষণ।
Advertisement
ঘটনাটা এমনিতেই অসম্মানজনক, বিশেষত প্রাপকের পক্ষে, কিন্তু বিভূতিভূষণকে তা অন্য ভাবে ভাবিয়েছিল। নিজের জীবনে— শুধু সাহিত্যজীবন নয়, সমগ্র জীবনে— যদি কোনও কিছুর সন্ধান তিনি করে থাকেন, তা নিখাদ বাঙালিত্বের। জীবনের অধিকাংশ কেটেছে প্রবাসে— পণ্ডৌল (মিথিলা), দারভাঙা, পটনা। বঙ্গদেশের চাতরা (হুগলি), শিবপুর, নিউ আলিপুরে অল্প কালই থাকার সুযোগ হয়েছে। এমন প্রতিকূল প্রতিবেশে যিনি আজীবন বাংলা সাহিত্যসাধনা করে গিয়েছেন, তাঁর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেরা সাহিত্যসম্মান, যা নাকি রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত, তা নিয়ে এমন গরমিল লজ্জার চেয়ে অনেক বেশি বেদনার। বিভূতিভূষণ সেই ছেলেবেলা থেকেই বাংলাকে দেখতে চেয়েছেন, পেতে চেয়েছেন, এ ভূখণ্ডে পা রাখতেই তাঁর মনে বাড়তি পুলক জেগে উঠত। পরবাসে বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে স্থানীয় স্বজাতিদের নিয়ে নিয়মিত সভা-সমিতি করে গিয়েছেন, যত দিন পেরেছেন। অমলিন ভালবাসায় এই দাগটুকু না পড়লেই হত।
অ-প্রবাসী
Advertisement
১৮৯৬ সালে পণ্ডৌল নামে যে উত্তর বিহারের অঞ্চলে বিভূতিভূষণের জন্ম তা শহর নয়, আবার গণ্ডগ্রামও নয়। এক প্রান্তে নীলকুঠি, নতুন যুগের অভিজ্ঞান ওটুকুই। গায়ে-লাগা দু’ঘর বাঙালি, মেটে বাড়ি, সে কালের বাবুদের কোয়ার্টার। গঞ্জজীবন এমনিই নিস্তরঙ্গ, তায় সমাজবিচ্ছিন্ন বাঙালি পরিবারে কালেভদ্রের তরঙ্গাঘাতও পৌঁছত না, শিশুমনও তাই অচঞ্চল। কিন্তু যে বিপন্নতায় দিনযাপন, তা বড় হয়ে বুঝেছেন বিভূতিভূষণ। পরবাসে দুই প্রজন্মে বাংলা ভাষা ও কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা বড় কঠিন। বড়কি ভৌজি (বড় বৌদি), ছোটকি ভৌজি (ছোট বৌদি), কটোরা (বাটি), বৈগন (বেগুন) ঘরে চালু হয়ে গিয়েছে, বাংলাতেও মৈথিলি টান। পরে তিনি লিখেছেন, বিকৃতির হাত থেকে বাঁচতে বাংলা পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর বাবা, আর ‘একে তার গুরুগম্ভীর ভাষা, তার ওপর বাবার অনুস্বার, বিসর্গ আর যুক্তাক্ষরাদির শুদ্ধতা বজায় রেখে পড়া’, দুইয়ে মিলে বিদ্যাসাগরের ‘আখ্যানমঞ্জরী’ যে ঝঙ্কার সৃষ্টি করত, তা এখনও কানে লেগে। শিশুমনকে বাঙালি ধাঁচে গড়েপিটে নিতে শেষাবধি ছেলেদের চাতরা-শ্রীরামপুরের আদিবাড়িতে পাঠানোর সিদ্ধান্তই নিলেন বাবা। সেই মতো রেলযাত্রা।
সেই রেলগাড়িতেই বছর সাত-আটের বিভূতি ঘুম ভেঙে দেখল, যাঁরা জিনিস বেচছেন, তাঁরা ছাড়া সবাই ‘আমাদের মতোই কথা বলছে’! তার জিজ্ঞাসা: “এরা কারা বাবা?”
“এরা বাঙ্গালী।”
“আমরাও তো তাই।”
“হ্যাঁ, তাছাড়া কি হব?”
“তা এত কোথা থেকে এল বাবা?”
দাদা বলল, “এটা যে বাংলাদেশ রে। কী বোকা বিভূতিটা, বাবা।”
“এবার তোকে বাংলাদেশের একটা মিষ্টি খাওয়াব। কখনও ভুলতে পারবি না।”
বাল্যাবস্থায় বর্ধমানের সীতাভোগের যে স্বাদ সে পেয়েছিল, তা নাকি জিভে লেগে আছে।
পাঁচ বছর বয়সে সরস্বতী পুজোর দিনে হাতেখড়ির পর আড়াই-তিন বছরে দ্বিতীয় ভাগ আর ধারাপাতের কিছুটা আয়ত্ত হয়েছিল। তার জোরেই চাতরার মহাদেব মাস্টারের বাংলা পাঠশালায় ভর্তি হওয়া গেল। বাঙালি শিক্ষকসমীপে পুত্রদের সমর্পণ করে পশ্চিম-প্রবাসে ফিরে গেলেন বাবা।
এ সময়ই বালকের মাথায় চেপে বসল ভবঘুরেবৃত্তি বা বাউন্ডুলেপনার ভূত। যদিও তা ভূত না পরী, না কি ‘গার্জেন-এঞ্জেল’, তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না, উত্তরজীবনে যা পেয়েছেন, তা তো ওর কৃপাতেই। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির গোড়ায় ছিল ঘোরার এই নেশা— লেখকের ভাষায় ‘ব্যসন’। প্রবাসী বালক বাংলাভূমিকে আপন করে নিতে না পারলে, এই সাহিত্যিকের কি জন্ম হত? বৃদ্ধ বয়সে আত্মকথায় হিসাব কষেন, বাল্য-কৈশোর-যৌবনে বাংলাকে পেয়েছেন দু’বার, দু’-তিন বছরের দু’টি সংক্ষিপ্ত প্রবাসে, চাতরায় আড়াই-তিন বছর, অল্প ক’দিন শিবপুরে। এই ক’দিনের কথাও ‘নীলাঙ্গুরীয়’ উপন্যাসের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে, আছে ‘বর্ষায়’ গ্রন্থের দু’খানা ছোটগল্পে। তিনি বলেন, “‘বর্ষায়’ গল্পের নয়নতারার দ্বিপ্রাহরিক তাসের মজলিশে যে গেছি, তাও প্রায় নিরুদ্দেশভাবেই ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক সময় মনে পড়ে গিয়ে।... চাতরার জীবনধারার ভাষা থেকে নিয়ে সর্বাঙ্গীণ বাঙালীত্বের বিস্ময় অনেকদিনই গেছে মিটে।”
ফের যখন পণ্ডৌলে ফেরা গেল, তখন নীলকুঠির উঁচু পদে অরবিন্দ নামে এক বাঙালি ভদ্রলোক, বিভূতির চোখে ‘যেন কলকাতারই এক টুকরো’। কাজ সেরে সন্ধেয় ভরাট গলায়, অপূর্ব ঢঙে, সুর করে নবীন সেনের ‘রৈবতিক’ কাব্য পড়তেন তিনি, নিশুতি গঞ্জের আকাশ নাকি ভরাট করে রাখত শুধু সেই আবেগ-উত্তেজনার স্বরই। তার পর মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, রমেশ দত্তদের নিয়েও কথা হত। এক লহমায় বদলে গেল পণ্ডৌলের জীবন, বিভূতির লেখালিখির অনুপ্রেরণা তৈরি হল।
এর পর দারভাঙার বাংলা স্কুল। দারভাঙার বাঙালিদের ছেলেদের বাংলা পড়ানোর সুবিধার জন্য এর পত্তন। প্রতিষ্ঠাতা রাজশেখর বসুর বাবা চন্দ্রশেখর। তাঁর পুত্র ছাড়াও স্কুলের দুই প্রখ্যাত ছাত্র যতীন্দ্রনাথ সেন ও নন্দলাল বসু। ১৯০৩ সালের ৩ জুলাই এইট্থ ক্লাসে ভর্তি হল বিভূতি। বাংলা স্কুলের বাড়ি পরিবেশ ছাত্র শিক্ষক, সব একেবারে বেঁধে ফেলল যৌবনের সাড়ে চারখানা বছর। সে-ও মহা খুশি— পণ্ডৌলের ‘দেহাতী’, ‘গেঁয়ো-গেঁয়ো’ গন্ধটা গা থেকে মুছে যেতে লাগল। ১৯০৮ সালে পরীক্ষা দিয়ে রাজস্কুল। চৌবাচ্চার তেলাপিয়া যেন মহাসাগরে— তিনটে ঘর, তিন শিক্ষকের বিদ্যালয় থেকে কত ঘর, মাস্টার, ছাত্র! চোদ্দো থেকে আঠারো জীবন গঠনের সময়, তখনকার মঞ্চেই ভবিষ্যৎ রচনার সূচনা। এই চার বছর সম্পর্কে তিনিও বলেন, “কত জল্পনা-কল্পনা, তার মধ্যে আমি মাত্র একটি টায়েটোয়ে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে আসতে পেরেছি গল্প-উপন্যাস লেখার বাসনা।”
স্বর্গাদপি গরীয়সী
ইন্টারমিডিয়েট-ইন-আর্টস পড়তে দু’বছরের জন্য শিবপুরে পাঠানো হল বিভূতিভূষণকে— ১৯১২ সালে রিপন কলেজে। রাজস্কুলে চল্লিশটা ছেলের মধ্যে যে ছিল পুরোভাগে, কলকাতার কলেজে বৃত্তি পাওয়া স্কলারদের ভিড়ে সুদূর বিহার থেকে আসা সেই ছাত্রের হারিয়ে যাওয়ারই কথা, অনেকটা তাঁর ‘বরযাত্রী’ গল্পের কে গুপ্ত-র মতোই। শুধু নিজের যোগ্যতা আর আগ্রহেই ভেসে রইল সে ছেলে।
এর পরের আরও কিছু খুচরো আসা-যাওয়া মিলিয়ে শিবপুরে মেরেকেটে তিন বছর কাটিয়েছেন বিভূতিভূষণ। অথচ তিনি বলেন, এই তিনটে বছর তাঁর দীর্ঘ জীবনের যেন অর্ধেকটা জুড়েই আছে। জীবনের মাপকাঠি সময় নয়, উপলব্ধির গাঢ়ত্বে-গভীরতা-বৈচিত্রে। বাংলার প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছতে পেরে তাঁর মনে হয়েছিল, “আমার বাঙালীত্ব-বোধ একটা সার্থকতা পেল।” একে প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতা বা গণ্ডিবদ্ধ স্বজাতীয়তা মনে হতেই পারে, বিভূতিভূষণ তাই বারবার তাঁর পূর্ণ ভারতীয়ত্বে বিশ্বাসের কথা জোর দিয়ে বলতেন। তিনি এমন ভারতের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে প্রদেশের সীমারেখা মুছে গিয়ে জগতের সামনে দাঁড়ায় এক দেশ। তবু তাঁর কাছে, বাঙালিত্ব আলাদা বস্তু— ‘একটা পাড়ার মধ্যে একটা বাড়ীর যে নিজস্বতা’। ছেলেবেলায় চাতরাকে বিভুঁই মনে হয়েছিল, পণ্ডৌল তখনও জীবনের ধ্রুবতারা, দারভাঙার পরিবেশে নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিল। বাঙালিরও তখন স্বর্ণযুগ। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, আশুতোষ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, সুরেন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ— “এমন একটা যুগ যে, অবাঙ্গালীও বাঙ্গালীত্বে গৌরববোধ করবেন।”
শিবপুরের জীবন তাঁকে একটা বাঙালি সমাজও দিয়েছিল। বিবাহ, শ্রাদ্ধ, উপনয়ন, ব্রত, অন্নপ্রাশন— ভোজই কি সামাজিক আদানপ্রদানের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান? সবচেয়ে আনন্দের তো বটেই। বিভূতিভূষণ নিজেও কৌতুক করেন, ‘সবটুকু পরস্মৈপদী, রসনা-তৃপ্তির সঙ্গে, সে-তৃপ্তির আহরণের যে-উদ্বেগ আর ব্যয়ভার তার কোন সম্বন্ধ থাকেনা’। আলাপ-আলোচনার সুযোগ এক আকর্ষণ। পঙ্ক্তির অপেক্ষা আর পঙ্ক্তিতে বসার মধ্যেই হয়ে যায় কত গল্পগাছা, সমালোচনা, পরনিন্দা, পরচর্চা— যাকে বলে মজলিশ। বিভূতিভূষণের লেখালিখির প্রেরণার আট আনাও এই শিবপুর থেকেই। দারভাঙায় অঙ্কুরিত সাহিত্যরচনার বাসনা পল্লবিত হয় শিবপুরে। কলকাতার বিপুল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের যে সান্নিধ্য তখন পেলেন, নবীন সাহিত্যিকের পক্ষে তা এক কল্পনাতীত পরিবেশ।
আইএ পাশ করে বিহারে ফিরতে হল, পটনা বি এন কলেজে বিএ পড়তে ভর্তিও হলেন, কিন্তু মাত্র জনা ছয়েক বাঙালি ছাত্রের সম্পর্ক হল খুবই নিবিড়, থেমে থাকল না বিভূতিভূষণের কলমও। ১৯১৫ সালে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হল ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়, তৎকালীন ভারতের অগ্রণী পত্রিকা। পরিচয়ের সঙ্গে এল আত্মবিশ্বাস।
ময়দানের গ্রন্থমেলায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে।
ময়দানের গ্রন্থমেলায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে।
জীবন-তীর্থ
১৯১৬ সালে কলেজ পাশের পর ১৯৪২-এ অবসর পর্যন্ত হরেক চাকরি করেছেন বিভূতিভূষণ। অনেক স্কুল, এবং দারভাঙা-রাজের বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর। আট-ন’বার চাকরি ছেড়েছেন। মিশতে হয়েছে বহু মানুষের সঙ্গে। সব জায়গাতেই খুঁজে বেরিয়েছেন বাংলাকে। বিহারে তখনও বাঙালিদের ভাল দাপট। উকিলমহলের পুরোধারা সব বাঙালি; বড় অফিসার, জজ ম্যাজিস্ট্রেট, কর্মচারীরা বাঙালি, কিছু কেরানিও। ডাক্তারদের মধ্যেও অনেক। কিন্তু বুদ্ধিজীবী অংশের যে অভাব দারভাঙা বা অন্যত্র ছিল, তা পূরণ হয়েছিল মুজফ্ফরপুরে। সেখানে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে বিভূতিভূষণ তাই নতুন বিশ্বাস ও শক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এই বাঙালি সমাজ ‘পরিপূর্ণ’। ঐতিহ্যশালী শহরে গিয়ে বছর তিনেকের জন্য থেমে যাওয়া লেখনী ফের সচল হয়েছিল, তাঁর মতে ‘পুনরভিষেক’। এক সাহিত্যবাসরে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের উদ্যোগ হয়, কেন্দ্রে অনুরূপা দেবী, মুজফ্ফরপুরে যে জনপ্রিয় সাহিত্যিকের উপস্থিতি বাঙালিদের প্রেরণা জোগাত। রীতিমতো শামিয়ানা টাঙিয়ে আবৃত্তি-প্রবন্ধপাঠ-মূকাভিনয়ে পালিত হয় জয়ন্তী। পটনায় যখন থাকতেন, সক্রিয় ভাবে যোগ দিতেন প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে। নিয়ে আসা হত বনফুল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশদের। হাঙ্গামার ঘটনাও দেখেছেন। এক বার ‘শনিবারের চিঠি’ গোষ্ঠী তাতিয়ে দিল সভাপতি মোহিতলাল মজুমদারকে, তাঁর অভ্যর্থনা নাকি যথাযোগ্য হয়নি! পর দিন আর স্টেজেই উঠলেন না ক্রুদ্ধ সাহিত্যিক। আবার রাঘোপুরে থাকতে বাবু রঘুনন্দন সিংহের সপ্তম মাসের মাতৃশ্রাদ্ধে যখন সারা দেশ থেকে নামকরা পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানানো হল, বাংলার কদর হল বেশি, সেখানেই ‘মহামহোপাধ্যায়’-এর সংখ্যাধিক্য। সশিষ্য যে ২৫-২৬ জন এসেছিলেন, তার মধ্যে বিভূতিভূষণের জিম্মায় ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ডা. বিনয়তোষ।
বিভূতিভূষণ আত্মকথায় লিখেছেন, “কয়েদখানার দাপটেও বাঙ্গালীর সাহিত্য-প্রীতিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনা, মেডিকেলের ডিসেক্শন রুম বা অপারেশন টেবিলে পারবে কেন?” গোটা বিহারে মেডিক্যাল কলেজ তখন মাত্র দুটো, সেখানকার বাঙালি ছেলেরা মিলেই ‘সন্ধ্যা-মজলিস’ সাহিত্যবাসর বসিয়ে ফেলেছিল, বছরশেষে বৈঠকও হত। সভাপতি বিভূতিভূষণ, কলকাতা থেকে প্রধান অতিথি জোগাড়ের ভার তাঁর। পরে আর্টস-সায়েন্সের ছাত্রদেরও সে মৌতাত জমে উঠল। বিভূতিভূষণের উপরি পাওনা— কলকাতার সাহিত্যিকেরা তাঁর কাছে রাত কাটান। কে আসেননি? গজেন্দ্রনাথ মিত্র, প্রবোধকুমার সান্যাল, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুশীলকুমার দে, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, জগদীশ ভট্টাচার্য, গৌরকিশোর ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সবাইকেই একটা দিন বেশি ধরে রাখার চেষ্টা করতেন, কলেজের হাঙ্গামা মিটে গেলে মন খুলে সাহিত্য-আলাপ। এক বার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এসেছিলেন, বিহারেও তাঁর খ্যাতি দেখার মতো, বিশেষ করে মৈথিলীদের মধ্যে! তাঁরা বাংলা কিছু বোঝেন, বীরেনবাবুর কৌতুক-চিত্র শোনেন, আর চণ্ডীপাঠের বিশুদ্ধ উচ্চারণ বা আবেগময় কণ্ঠস্বর তো তাঁদের বিহ্বল করে দিয়েছিল।
স্বাধীনতার পরে দেশ ব্রিটিশমুক্ত হলেও বিহারে সংখ্যালঘু বাঙালির হাল ফেরেনি। বাঙালিদের নিয়ে ব্রিটিশ কোনও কালেই সন্তুষ্ট নয়, বাগে আনতে না পেরে দমনের চেষ্টা করত, ঔপনিবেশিক যুগে বিহারে তেমনই এক কানুন ‘ডোমিসাইল রুল’। বাঙালিকে বিহারে চাকরি পেতে গেলে দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে ভূমিপুত্রের প্রমাণ দিতে হত, চাকরিজীবনে সার্টিফিকেটের জন্য ঘুরতে হয়েছে বিভূতিভূষণকেও। স্বাধীন দেশে সে দানব তো বেঁচেবর্তে রইলই, ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ ভাগ হওয়ায় রাষ্ট্র রুজির সঙ্গে ভাষার দাবিও তারা করল। প্রতিবাদী হল বাঙালি। এগারো বছর পর ‘বেঙ্গলী এসোসিয়েশন’কে পুনরুজ্জীবিত করলেন পটনার বিশিষ্টরা। ছোট-বড় শহরে সহায়ক সমিতি গঠনকল্পে বার্ষিক সর্ববিহার সম্মেলনের উদ্যোগ হল, জন্ম নিল পাক্ষিক পত্রিকা ‘সঞ্চিতা’। বাঙালিদের ইংরেজি শতবর্ষী সাপ্তাহিক ‘বিহার হেরাল্ড’ নবজীবন পেল। পটনা, ভাগলপুর হয়ে তৃতীয় বছরের সম্মেলন দারভাঙায়। স্মারক পত্রিকা ‘অ-প্রবাসী’। বিভূতিভূষণরা মনে করতেন, আসমুদ্র হিমাচল ভারতের যিনি বাসিন্দা, তিনি নিজভূমেই।
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কৌতুক গল্পের বই বরযাত্রী'র ছয় বন্ধু গণশা, ঘোঁতনা, ত্রিলোচন, গোরাচাঁদ, রাজেন আর কে. গুপ্ত বাংলা রসসাহিত্যের পরিচিত চরিত্র। অল্প দু চার কথায় জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টি করা বা একটা সমাজকে এরকম সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরতেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। কৌতুক রসের এরকম বই হিসেবে বরযাত্রী সিরিজ বাংলা সাহিত্যে অনন্য। কৌতুক রসের তার আরেকটি বিখ্যাত সৃষ্টি রানু সিরিজের গল্পগুলি। কিন্তু বিভূতিভূষণের প্রতিভা ছিল বহুমুখী। ছোটদের জন্য পুজোসংখ্যায় তিনি নিয়মিত লিখেছেন, পোনুর চিঠি ও অন্যান্য নানান গল্প - যা পরিণত মনস্ক পাঠকেরাও পরম উৎসাহে পড়েছেন।
রচনা কর্ম
Thursday, 28 July 2022
মহাপ্রয়াণ দিবস। বাংলা গদ্যের জনক ও আধুনিক মানব ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। Vol -812. Dt -29.07.2022. ১২ শ্রাবণ, ১৪২৯. শুক্রবার। The blogger in literature e-magazine
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। ২৯ শা জুলাই,১৮৯১ সালে ৭০ বছর বয়সে কলকাতায় পরলোকগমন করেন। ১৮৭৫ সালের ৩১ মে নিজের উইল প্রস্তুত করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। পরের বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ডের ট্রাস্টি পদ থেকে ইস্তফা দেন। এপ্রিল মাসে কাশীতে পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। এই সময় কলকাতার বাদুড়বাগানে বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এই বাড়ি সংলগ্ন রাস্তাটি বিদ্যাসাগর স্ট্রিট ও সমগ্র বিধানসভা কেন্দ্রটি বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত। ১-২ আগস্ট আদালতে উপস্থিত থেকে চকদিঘির জমিদার সারদাপ্রসাদ রায়ের উইল মামলায় উইল প্রকৃত নয় বলে জমিদার পত্নী রাজেশ্বরী দেবীর স্বপক্ষে সাক্ষী দেন। ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে বাদুড়বাগানে বাস করতে থাকেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এ বছর বাংলার গভর্নর কর্তৃক সন্মাননা লিপি প্রদান করা হয় তাকে। এপ্রিল মাসে গোপাললাল ঠাকুরের বাড়িতে উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ছাত্রদের বেতন হয় মাসিক ৫০ টাকা। ১৮৭৯ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ [কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়] কর্তৃক দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত হয়। ১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় সিআইই উপাধি পান। ১৮৮১ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ থেকে প্রথম বিএ পরীক্ষার্থী পাঠানো হয়। ১৮৮২ সালের ৫ আগস্ট রামকৃষ্ণ পরমহংস তার বাদুড়বাগানের বাড়িতে আসেন। দুজনের মধ্যে ঐতিহাসিক এক আলাপ ঘটে। এই বছর মেট্রোপলিটান কলেজে চালু হয় আইন পাঠ্যক্রম। ১৮৮৩ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন। মার্চে বাণভট্টের হর্ষচরিতম্ তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৮৮৪ সালের নভেম্বরে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে ব্রজবিলাস গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়াও প্রকাশিত হয় ‘কস্যচিৎ তত্ত্বান্বেষিণঃ’ ছদ্মনামে বিধবা বিবাহ ও যশোহর হিন্দুধর্মরক্ষিণীসভা পুস্তক। দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি এর নামকরণ করেন বিনয় পত্রিকা। এই নভেম্বরেই কানপুরে বেড়াতে যান এবং সেখানে দিনকতক থাকেন। ১৮৮৫ সালে মেট্রোপলিটান কলেজের বউবাজার শাখা স্থাপিত হয়। ১৮৮৬ সালের অগস্টে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোসহচরস্য’ ছদ্মনামে রত্নপরীক্ষা পুস্তক প্রকাশ করেন। ১৮৮৭ সালের জানুয়ারিতে শঙ্কর ঘোষ লেনের নতুন ভবনে মেট্রোপলিটান কলেজ স্থানান্তরিত হয়। ১৮৮৮ সালের এপ্রিলে নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস, জুনে আখ্যান মঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ), জুলাইতে পদ্যসংগ্রহ নামক সংকলন গ্রন্থের প্রথম ভাগ প্রকাশ করেন। ১৩ আগস্ট পত্নী দীনময়ী দেবীর মৃত্যু হয়। ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশ করেন সংস্কৃত রচনা। ১৮৯০ সালের ১৪ এপ্রিল বীরসিংহ গ্রামে মায়ের নামে স্থাপন করেন ভগবতী বিদ্যালয়। মে মাসে নির্বাচিত উদ্ভট শ্লোকসংগ্রহ শ্লোকমঞ্জরী প্রকাশিত হয়। বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই, বাংলা ১২৯৮ সনের ১৩ শ্রাবণ, রাত্রি দুটো আঠারো মিনিটে তার কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর ১০ মাস ৪ দিন। মৃত্যুর কারণ, ডাক্তারের মতে, লিভারের ক্যানসার। মৃত্যুর পর ১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বরে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিদ্যাসাগর চরিত প্রকাশ করেন পুত্র নারায়ণচন্দ্র বিদ্যারত্ন। ১৮৯২ সালের এপ্রিলে ৪০৮টি শ্লোকবিশিষ্ট ভূগোল খগোল বর্ণনম্ গ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়। পশ্চিম ভারতের এক সিভিলিয়ন জন লিয়রের প্রস্তাবে বিদ্যাসাগর পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও ইউরোপীয় মত অনুসারে এই ভূগোল গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। বিবিসি জরিপকৃত(২০০৪) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তার স্থান অষ্টম। শিক্ষামূলক গ্রন্থ বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ ; ১৮৫৫) ঋজুপাঠ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ ; ১৮৫১-৫২) সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১) ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩) অনুবাদ গ্রন্থ হিন্দি থেকে বাংলা বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭ ; লল্লুলাল কৃত বেতাল পচ্চীসী অবলম্বনে) সংস্কৃত থেকে বাংলা শকুন্তলা (ডিসেম্বর, ১৮৫৪ ; কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে) সীতার বনবাস (১৮৬০) - ভবভূতির উত্তররামচরিতম্ নাটকের আখ্যানবস্তু।[২০] মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০ ; ব্যাসদেব মূল মহাভারত-এর উপক্রমণিকা অংশ অবলম্বনে) বামনাখ্যানম্ (১৮৭৩ ; মধুসূদন তর্কপঞ্চানন রচিত ১১৭টি শ্লোকের অনুবাদ) ইংরেজি থেকে বাংলা বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮ ; মার্শম্যান কৃত হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচিত) জীবনচরিত (১৮৪৯ ; চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ অবলম্বনে রচিত) নীতিবোধ (প্রথম সাতটি প্রস্তাব – ১৮৫১ ; রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক অবলম্বনে রচিত) বোধোদয় (১৮৫১ ; চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত) কথামালা (১৮৫৬ ; ঈশপস ফেবলস অবলম্বনে রচিত) চরিতাবলী (১৮৫৭ ; বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা অবলম্বনে রচিত) ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯ ; শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস অবলম্বনে রচিত) ইংরেজি গ্রন্থ পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্ সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার | style="width: 50%;text-align: left; vertical-align: top; " | মৌলিক গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩) বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫) বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (প্রথম খন্ড ১৮৭১, ২য় খন্ড ১৮৭৩) অতি অল্প হইল এবং ”আবার অতি অল্প হইল দুখানা পুস্তক (১৮৭৩, বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের উত্তরে 'কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য' ছদ্মনামে।) ব্রজবিলাস, যৎকিঞ্চিৎ অপূর্ব্ব মহাকাব্য (নভেম্বর, ১৮৮৪) - "কবিকুলতিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য" ছদ্মনামে রচিত। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের রচনার প্রত্যুত্তরে লিখিত হয়।[২১] রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬) প্রভাবতী সম্ভাষণ (সম্ভবত ১৮৬৩) জীবন-চরিত (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত) শব্দমঞ্জরী (১৮৬৪) নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (১৮৮৮) ভূগোল খগোল বর্ণনম্ (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত) সম্পাদিত গ্রন্থ অন্নদামঙ্গল (১৮৪৭) কিরাতার্জ্জুনীয়ম্ (১৮৫৩) সর্বদর্শনসংগ্রহ (১৮৫৩-৫৮) শিশুপালবধ (১৮৫৩) কুমারসম্ভবম্ (১৮৬২) কাদম্বরী (১৮৬২) বাল্মীকি রামায়ণ (১৮৬২) রঘুবংশম্ (১৮৫৩) মেঘদূতম্ (১৮৬৯) উত্তরচরিতম্ (১৮৭২) অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ (১৮৭১) হর্ষচরিতম্ (১৮৮৩) পদ্যসংগ্রহ প্রথম ভাগ (১৮৮৮ ; কৃত্তিবাসি রামায়ণ থেকে সংকলিত) পদ্যসংগ্রহ দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯০ ; রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল থেকে সংকলিত) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার মনে করা হয়। যদিও তত্ত্বগত ভাবে বাংলা গদ্যের জনক তিনি নন। কারণ বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তার আগমনের বহুপূর্বেই গদ্যরচনার সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু সেইসব গদ্য ছিল শিল্পগুণবিবর্জিত নীরস এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্ন বাক্যসমষ্টি। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা সাধু গদ্যের একটি মান্য ধ্রুবক নির্দেশনা করেন। প্রয়োজনবোধে সেই গদ্যে চলিত ভাষার গতিশীলতাও যুক্ত করেন। কল্পনা ও স্বকীয় পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে যে গদ্যভাষার জন্ম তিনি দেন, তা ছিল সরস, সুমধুর, সুশ্রাব্য, ছন্দোময় ও গতিশীল। এই অর্থে তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের নব জন্মদাতা। তিনি বাংলা আধুনিক গদ্যের জনক। মান্য সাধু বাংলা গদ্যের শিল্পরূপটি ঠিক কিরকম হতে পারে, তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনূদিত বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনাগুলিতে। ১৮৫৪ সালে শকুন্তলা ও ১৮৬০ সালে সীতার বনবাস গ্রন্থে তার সেই বিশিষ্ট গদ্যশৈলীর পরিচয় পাওয়া যাবে : “ শকুন্তলার অধরে নবপল্লবশোভার সম্পূর্ণ আবির্ভাব ; বাহুযুগল কোমল বিটপের বিচিত্র শোভায় বিভূষিত ; আর, নব যৌবন, বিকশিত কুসুমরাশির ন্যায়, সর্বাঙ্গ ব্যাপীয়া রহিয়াছে। (শকুন্তলা, প্রথম পরিচ্ছেদ) ” “ লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্য! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত ; অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয় ; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে। (সীতার বনবাস, প্রথম পরিচ্ছেদ, আলেখ্যদর্শন) ” এই চিত্ররূপময়, কাব্যিক ও অলংকার বহুল গদ্যভাষার পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে বিদ্যাসাগরকে লৌকিক ভাষার আদর্শে দ্রুতগামী ও শ্লেষাত্মক গদ্যরচনা করতেও দেখা যায়। জীবনের শেষ পর্বে রচিত ব্রজবিলাস তার একটি উদাহরণ: “ এই কয় প্রশ্নের উত্তর পাইলেই, বিদ্যারত্ন ও কপিরত্ন, উভয় খুড় মহাশয়ের সঙ্গে, নানা রঙ্গে, হুড়হুড়ি ও গুঁতোগুঁতি আরম্ভ করিব। প্রশ্নের উত্তর পাইলে, হাঙ্গাম ও ফেসাৎ উপস্থিত করিবেক, এমন স্থলে উত্তর না দেওয়াই ভাল, এই ভাবিয়া, চালাকি করিয়া, লেজ গুটাইয়া, বসিয়া থাকিলে আমি ছাড়িব না। (ব্রজবিলাস) ” এই ভাষা আলালি ভাষার মতো ফারসি শব্দবহুল নয়, আবার হুতোমি ভাষার অশ্লীলতা দোষ থেকেও মুক্ত। বরং স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর্যবান অথচ সরস বাংলা চলিত গদ্যের সূত্রপাত করেছিলেন, তারই পূর্বসূরী। সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিদ্যাসাগরের অসামান্য দখল ছিল। আবার নিজ চেষ্টায় ইংরেজি শিখে সেই ভাষার সাহিত্যের সঙ্গেও সম্যক পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত শব্দ ও পদবিন্যাসের শ্রুতিমাধুর্য ও গাম্ভীর্যকেই তিনি স্থান দিয়েছিলেন বাংলা গদ্যে; দুর্বোধ্যতা বা দুরুহতাকে নয়। অন্যদিকে কাব্যিক ছন্দোময়তায় গদ্যকে দিয়েছিলেন এক ললিত সুডৌল রূপ। গ্রহণ-বর্জনের যে অসামান্য ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল, তার মাধ্যমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক গদ্যের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারিক গদ্য ও সমকালীন সংবাদপত্রগুলির নিকৃষ্ট গদ্যনমুনা সব থেকেই ছেঁকে নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় সাহিত্যগুণ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের আদর্শে যতিচিহ্নের ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যে কালান্তর সূচনা করতেও পিছপা হননি তিনি। নিছক ব্যবহারিক বাংলা গদ্যকে তিনি উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক গদ্যে বিবর্তিত করতে তার প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, “বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন।” ১৮৩৯ সালে জ্ঞানচর্চায় তিনি 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ছাত্র জীবনে প্রতি বছরই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃৃত কলেজ ত্যাগ করে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান শিক্ষকের পদ লাভ করেন। ১৮৪৬ সালে সংস্কৃৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ওই কলেজের শিক্ষকদের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি সংস্কৃৃত কলেজের কাজে ইস্তফা দেন। ১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের 'হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল' অবলম্বনে রচনা করেন 'বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ' গ্রন্থখানি। ওই বছরই ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন। বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপনা করেন 'সব শুভকরী সভা'। ১৮৫০ সালে তিনি সংস্কৃৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৩৫ সংবৎ (১৮৭৪) প্রকাশিত 'বর্ণপরিচয়' গ্রন্থের ৫৩তম সংস্করণ। বাংলা বর্ণশিক্ষার জগতে ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত বইটি সার্ধশত বছর পরে আজও সমান জনপ্রিয়। ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় 'সব শুভকরী' পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর প্রথম সংখ্যায় 'বাল্যবিবাহের দোষ' নামে একটি বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৩ সালে জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হলে তার সদস্য মনোনীত হন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত শাস্ত্রের বিরাট পণ্ডিত হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে দ্বিধা করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল তাকে। এই বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সর্বস্ব পণ করে সংগ্রাম করেছেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন, যে লোকাচার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত, আসলে তা ধর্মবহির্ভূত স্থবিরতার আচারমাত্র। তার আন্দোলন সফল হয়েছিল। ১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন।[১৫][১৬] তবে শুধু আইন প্রণয়নেই ক্ষান্ত থাকেননি বিদ্যাসাগর মহাশয়। তার উদ্যোগে একাধিক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। তার পুত্রও( নারায়ণচন্দ্র) এক ভাগ্যহীনা বিধবাকে বিবাহ করেন। এজন্য সেযুগের রক্ষণশীল সমাজ ও সমাজপতিদের কঠোর বিদ্রুপ ও অপমানও সহ্য করতে হয় তাকে। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বহুবিবাহের মতো একটি কুপ্রথাকে নির্মূল করতেও আজীবন সংগ্রাম করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। প্রচার করেন বাল্যবিবাহ রোধের সপক্ষেও। এর সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রচারেও যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। শুধু কলকাতায় নয়, নারীমুক্তির বার্তা বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে, বিভিন্ন জেলাতেও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারীশিক্ষার সপক্ষে জোর প্রচার চালান তিনি। যদিও তার এই উদ্যোগও সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা নিন্দিত হয়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পর্যন্ত অত্যন্ত হীন বাক্যবাণে নারীমুক্তি আন্দোলনের ব্যঙ্গ করেন। তবু তার জীবদ্দশাতেই নারীশিক্ষা আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।[ বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যসাগসর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তিনি সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করে সরকার এই স্কুলগুলোর কিছু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি। এরপর কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত) এবং নিজের মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।। " বীরসিংহগ্রামে আমার জন্ম হইয়াছে; কিন্তু, এই গ্রাম আমার পিতৃপক্ষীয় অথবা মাতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বাসস্থান নহে। জাহানাবাদের (অধুনা আরামবাগ) ঈশান কোণে, তথা হইতে প্রায় তিন ক্রোশ উত্তরে, বনমালীপুর নামে যে গ্রাম আছে, উহাই আমার পিতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বহুকালের বাসস্থান। " ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর (১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার) ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শর্মা জন্মগ্রহণ করেন।[১৩] এই গ্রামটি অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত হলেও, সেই যুগে ছিল হুগলি জেলার অন্তর্ভুক্ত।[১৪] ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার নাম ছিল ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ছিল ভগবতী দেবী। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা হুগলি জেলার বনমালীপুর গ্রাম।[৭] ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত ব্যক্তি। তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন। সেই কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব বীরসিংহেই তার মা ও ঠাকুরমার সঙ্গে অতিবাহিত হয়। চার বছর নয় মাস বয়সে ঠাকুরদাস বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। কিন্তু সনাতন বিশ্বাস বিদ্যাদানের চেয়ে শাস্তিদানেই অধিক আনন্দ পেতেন। সেই কারণে রামজয় তর্কভূষণের উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক উৎসাহী যুবক বীরসিংহ গ্রামে একটি নতুন পাঠশালা স্থাপন করেন। আট বছর বয়সে এই পাঠশালায় ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। তার চোখে কালীকান্ত ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। কালীকান্তের পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। তাদের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন কালীকান্ত ও চাকর আনন্দরাম গুটিও। কথিত আছে, পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে তিনি সেগুলি অল্প আয়াসেই আয়ত্ত করেছিলেন। কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে তারা আশ্রয় নেন। এই পরিবারের কর্তা তখন জগদ্দুর্লভ সিংহ। ১৮২৯ সালের ১ জুন সোমবার কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ( যা বর্তমানে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত) ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮২৪ সালে; অর্থাৎ, ঈশ্বরচন্দ্রের এই কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর আগে। তার বয়স তখন নয় বছর। এই কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বিদ্যাসাগরের আত্মকথা থেকে জানা যায়, মোট সাড়ে তিন বছর তিনি ওই শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন।ব্যাকরণ পড়ার সময় ১৮৩০ সালে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণিতেও ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান। সংস্কৃত কলেজে মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের ‘পে স্টুডেন্ট’ ও অন্য ছাত্রদের ‘আউট স্টুডেন্ট’ বলা হত। অন্যদিকে তিন বছর ব্যাকরণ শ্রেণিতে পঠনপাঠনের পর বারো বছর বয়সে প্রবেশ করেন কাব্য শ্রেণিতে। সে যুগে এই শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। ১৮৩৩ সালে ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র ২ টাকা পেয়েছিলেন। ১৮৩৪ সালে ইংরেজি ষষ্ঠশ্রেণির ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক পারিতোষিক হিসেবে পান। এই বছরই ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। ১৮৩৫ সালে ইংরেজি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রূপে পলিটিক্যাল রিডার নং ৩ ও ইংলিশ রিডার নং ২ পারিতোষিক পান। এই বছরই নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরেজি শ্রেণি উঠিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বর্ষে সাহিত্য পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে পনেরো বছর বয়সে প্রবেশ করেন অলংকার শ্রেণিতে। অলংকার শাস্ত্র একটি অত্যন্ত কঠিন বিষয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ ও রসগঙ্গাধর প্রভৃতি অলংকার গ্রন্থে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৮৩৬ সালে অলংকার পাঠ শেষ করেন। বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে রঘুবংশম্, সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রত্নাবলী, মালতী মাধব, উত্তর রামচরিত, মুদ্রারাক্ষস, বিক্রমোর্বশী ও মৃচ্ছকটিক গ্রন্থ পারিতোষিক পান। ১৮৩৭ সালের মে মাসে তার ও মদনমোহনের মাসিক বৃত্তি বেড়ে হয় আট টাকা। এই বছরই ঈশ্বরচন্দ্র স্মৃতি শ্রেণিতে ভর্তি হন (এই অংশের সমতুল্য আজকের সংস্কৃত কলেজ-র পঠন)। সেই যুগে স্মৃতি পড়তে হলে আগে বেদান্ত ও ন্যায়দর্শন পড়তে হত। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের মেধায় সন্তুষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে সরাসরি স্মৃতি শ্রেণিতে ভর্তি নেন। এই পরীক্ষাতেও তিনি অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ত্রিপুরায় জেলা জজ পণ্ডিতের পদ পেয়েও পিতার অনুরোধে তা প্রত্যাখ্যান করে ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণিতে। শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি সেই সময় বেদান্তের অধ্যাপক। ১৮৩৮ সালে সমাপ্ত করেন বেদান্ত পাঠ। এই পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং মনুসংহিতা, প্রবোধ চন্দ্রোদয়, অষ্টবিংশতত্ত্ব, দত্তক চন্দ্রিকা ও দত্তক মীমাংসা গ্রন্থ পারিতোষিক পান। সংস্কৃতে শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা পুরস্কারও পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৪০-৪১ সালে ন্যায় শ্রেণিতে পঠনপাঠন করেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই শ্রেণিতে দ্বিতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে তিনি পারিতোষিক পান। ন্যায় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ১০০ টাকা, পদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা, দেবনাগরী হস্তাক্ষরের জন্য ৮ টাকা ও বাংলায় কোম্পানির রেগুলেশন বিষয়ক পরীক্ষায় ২৫ টাকা-সর্বসাকুল্যে ২৩৩ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর 'ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা' নামে স্বাক্ষর করতেন৷ জন্মগ্রহণ কালে তার পিতামহ তার বংশানু্যায়ী নাম রেখেছিলেন "ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়"। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। এই প্রশংসাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ : HINDOO LAW COMMITTEE OF EXAMINATION We hereby certify that at an Examination held at the Presidency of Fort William on the 22nd Twenty-second April 1839 by the Committee appointed under the provisions of Regulation XI 1826 Issur Chandra Vidyasagar was found and declared to be qualified by his eminent knowledge of the Hindoo Law to hold the office of Hindoo Law officer in any of the Established Courts of Judicature. H.T. Prinsep President Member of the Committee of Examination This Certificate has been granted to the said Issur Chandra Vidyasagar under the seal of the committee. This 16th Sixteenth day of May in the year 1839 Corresponding with the 3rd Third Joistha 1761 Shukavda. J.C.C. Sutherland Secy To the Committee (পুরনো বানান অপরিবর্তিত) সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর তিনি এই কলেজ থেকে অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত দেবনাগরী হরফে লিখিত এই সংস্কৃত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে 'বিদ্যাসাগর' নামে অভিহিত করেন। প্রশংসাপত্রটি নিম্নরূপ: অস্মাভিঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরায় প্রশংসাপত্রং দীয়তে। অসৌ কলকাতায়াং শ্রীযুত কোম্পানী সংস্থাপিত বিদ্যামন্দিরে ১২ দ্বাদশ বৎসরান্ ৫ পঞ্চমাসাংশ্চোপস্থায়াধোলিখিত শাস্ত্রাণ্য ধীতবান্ ব্যাকরণম্... শ্রীগঙ্গাধর শর্ম্মভিঃ কাম্যশাস্ত্রম্... শ্রীজয়গোপাল শর্ম্মভিঃ অলঙ্কারশাস্ত্রম্... শ্রীপ্রেমচন্দ্র শর্ম্মভিঃ বেদান্তশাস্ত্রম্... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ ন্যায়শাস্ত্রম্... শ্রীজয়নারায়ণ শর্ম্মভিঃ জ্যোতিঃশাস্ত্রম্... শ্রীযোগধ্যান শর্ম্মভিঃ ধর্মশাস্ত্রম্... শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ সুশীলতয়োপস্থিতস্বৈত স্বৈতেষু শাস্ত্রেষু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ট। ১৭৬৩ এতচ্ছকাব্দীয় সৌরমার্গশীর্ষস্য বিংশতি দিবসীয়ম্। রসময় দত্ত, সচিব। ১০ ডিসেম্বর ১৮৪১। ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত হবার পর সেই বছরই ২৯ ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিতের পদে আবৃত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বেতন ছিল মাসে ৫০ টাকা। ১৮৪৬ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এই পদের দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৪৬ সালের ৬ এপ্রিল একই বেতন হারে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের ভার গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স পঁচিশ বছর। ১৮৪৭ সালে স্থাপন করেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামে একটি বইয়ের দোকান। এই বছরই এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় হিন্দি বেতাল পচ্চিসী অবiলম্বনে রচিত তার প্রথম গ্রন্থ বেতাল পঞ্চবিংশতি। প্রথম বিরাম চিহ্নের সফল ব্যবহার করা হয় এ গ্রন্থে। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সম অংশীদারত্বে সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানাও স্থাপন করেন তিনি। অন্নদামঙ্গল কাব্যের পান্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য এই বছরই নদিয়ার কৃষ্ণনগরে আসেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে সংরক্ষিত মূল গ্রন্থের পাঠ অনুসারে পরিশোধিত আকারে দুই খণ্ডে অন্নদামঙ্গল সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। এই বইটিই সংস্কৃত যন্ত্র প্রেসের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। ১৮৪৭ সালের ১৬ জুলাই কলেজ পরিচালনার ব্যাপারে সেক্রেটারি রসময় দত্ত এর সঙ্গে মতান্তর দেখা দেওয়ায় সংস্কৃত কলেজের সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচনা করেন বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থখানি। এই বছরেই ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে আবৃত হন। বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপনা করেন সর্ব্বশুভকরী সভা। সেপ্টেম্বরে উইলিয়াম ও রবার্ট চেম্বার্স রচিত খ্যাতিমান ইংরেজ মনীষীদের জীবনী অবলম্বনে তার লেখা জীবনচরিত গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়। ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর প্রথম সংখ্যায় বাল্যবিবাহের দোষ নামে একটি বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ৪ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াের কাজে ইস্তফা দিয়ে ৫ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন। ১৮৫১ সালের ৫ জানুয়ারি সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ ছাড়াও কলেজের অস্থায়ী সেক্রেটারির কার্যভারও গ্রহণ করেন। ২২ জানুয়ারি ১৫০ টাকা বেতনে কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই সংস্কৃত কলেজে সেক্রেটারির পদটি বিলুপ্ত হয়। এপ্রিল মাসে রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে তার রচিত বোধোদয় পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার নিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। ৯ জুলাই পূর্বতন রীতি বদলে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থদের সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। ২৬ জুলাই প্রবর্তিত হয় রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটির প্রথা। এর আগে প্রতি অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে ছুটি থাকত। ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজের দ্বার সকল বর্ণের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। নিয়ম হয়, যে কোনও সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তান সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ পাবে। ১৮৫২ সালের এপ্রিলে ২৬ অনুচ্ছেদ সংবলিত নোটস অন দ্য সংস্কৃত কলেজ প্রস্তুত হয়। ২৮ আগস্ট থেকে কলেজে প্রবেশার্থী ছাত্রদের ২ টাকা দক্ষিণা দেওয়ার প্রথা চালু হয়। ১৮৫৩ সালে জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। জুন মাসে কালিদাসের রঘুবংশম্ ও ভারবির কিরাতার্জ্জুনীয়ম্ প্রকাশিত হয় তার সম্পাদনায়। সেপ্টেম্বর মাসে বারাণসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ জেমস আর ব্যালানটাইন সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শন করে যে রিপোর্ট দেন, তার মতামত সমালোচনা করে শিক্ষা সংসদে একটি রিপোর্ট দেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বাংলার শিক্ষার ইতিহাসে এই রিপোর্ট এক যুগান্তকারী দলিল। এই বছরেই তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ব্যাকরণ কৌমুদী প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হলে তার সদস্য মনোনীত হন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ছাত্রদের থেকে মাসিক ১ টাকা বেতন নেওয়ার প্রথা চালু হয়। এই বছরেই ব্যাকরণ কৌমুদী তৃতীয় ভাগ ও কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে তার রচিত শকুন্তলা প্রকাশিত হয়। এছাড়া তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা শীর্ষক একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – প্রথম পুস্তক প্রকাশিত। এই বছরের এপ্রিল মাসে বাংলা নববর্ষের দিন (১লা বৈশাখ,সংবৎ ১৯১২ অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল ১৮৫৫) যুগান্তকারী বাংলা শিশুপাঠ্য বর্ণমালা শিক্ষাগ্রন্থ বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়। কথিত আছে, মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পাল্কিতে বসে তিনি বর্ণপরিচয়-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। ১ মে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ছাড়াও মাসিক অতিরিক্ত ২০০ টাকা বেতনে দক্ষিণবঙ্গে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে নিযুক্ত হন। জুন মাসে (১৪ জুন অর্থাৎ ১লা আষাঢ় সংবৎ ১৯১২) বর্ণপরিচয় গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। ১৭ জুলাই বাংলা শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সংস্কৃত কলেজের অধীনে ওই কলেজের প্রাতঃকালীন বিভাগে নর্ম্যাল স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন তার বন্ধু এবং বিশিষ্ট বাঙালি যুক্তিবাদী ও গ্রন্থকার অক্ষয়কুমার দত্ত। এই বছরেই দক্ষিণবঙ্গের চার জেলায় একাধিক মডেল স্কুল বা বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নদিয়ায় পাঁচটি, আগস্ট-অক্টোবরে বর্ধমানে পাঁচটি, আগস্ট-সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে হুগলিতে পাঁচটি এবং অক্টোবর-ডিসেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় চারটি বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। অক্টোবর মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করার পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণ সহ বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশ করেন। বিধবা বিবাহ আইনসম্মত করতে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সরকারের নিকট বহুসাক্ষর সংবলিত এক আবেদনপত্রও পাঠান। ২৭ ডিসেম্বর আরেকটি আবেদনপত্র পাঠান বহু বিবাহ নিবারণ বিধির জন্য। ১৮৫৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মেদিনীপুরে পঞ্চম বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ঈশপের কাহিনি অবলম্বনে রচিত কথামালা প্রকাশিত হয়। ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইনসম্মত হয়। এই দিনই প্রকাশিত হয় তার স্বরচিত গ্রন্থ চরিতাবলী। এই বছর ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রথম বিধবা বিবাহ আয়োজিত হয় ১২, সুকিয়া স্ট্রিটে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পাত্র ছিলেন প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশের কণিষ্ঠ পুত্র তথা সংস্কৃত কলেজের কৃতি ছাত্র ও অধ্যাপক, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী ছিলেন বর্ধমান জেলার পলাশডাঙা গ্রামের অধিবাসী ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দ্বাদশ বর্ষীয়া বিধবা কন্যা কালীমতী। ১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি স্থাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য তথা ফেলো মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। উল্লেখ্য এই সমিতির ৩৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ছয় জন ছিলেন ভারতীয়। এই বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে হুগলি জেলায় সাতটি ও বর্ধমান জেলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরের বছর জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে হুগলিতে আরও তেরোটি, বর্ধমানে দশটি, মেদিনীপুরে তিনটি ও নদিয়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। মোট ১৩০০ ছাত্রীসংবলিত এই বিদ্যালয়গুলির জন্য তার খরচ হত মাসে ৮৪৫ টাকা। এই ১৮৫৮ সালের ৩ নভেম্বর শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তার সঙ্গে মতবিরোধ হলে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করেন। প্রায় ৩৯ বছর বয়সে সরকারের সঙ্গে তার সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়। যদিও নিজের কাজের জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনও রূপ স্বীকৃতি বা পেনসন তিনি পান নি। ১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনার নেপথ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যথেষ্ট অবদান ছিল। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম পত্রিকা যাতে রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৫৯ সালের ১ এপ্রিল পাইকপাড়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় [লা স্কুল। কিছুকাল এই প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন তিনি। ২০ এপ্রিল মেট্রোপলিটান থিয়েটারে উমেশচন্দ্র মিত্র রচিত নাটক বিধবা বিবাহ প্রথম অভিনীত হয়। ২৩ এপ্রিল রামগোপাল মল্লিকের সিঁদুরিয়াপট্টির বাসভবনে সেই নাটকের অভিনয় দেখেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মিশে গেলে উক্ত সভার সভাপতির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর গণশিক্ষার প্রসারে সরকারি অনুদানের জন্য বাংলার গভর্নরের নিকট আবেদন করেন। ১৮৬০ সালে বোর্ড অফ একজামিনার্সের পদ থেকেও ইস্তফা দেন তিনি। এই বছরই ১২ এপ্রিল ভবভূতির উত্তর রামচরিত অবলম্বনে তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ সীতার বনবাস প্রকাশিত হয়। কথিত আছে বইখানি তিনি রচনা করেছিলেন মাত্র চারদিনে। ১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছর ডিসেম্বর মাসে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে গ্রহণ করেন তার সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার পরিচালনভার। ১৮৬২ সালে কৃষ্ণদাস পালকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন তিনি। এই বছর তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাণভট্টের কাদম্বরী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাকে উৎসর্গ করেন স্বরচিত বীরাঙ্গনা কাব্য। ১৮৬৩ সালে সরকার তাকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য, ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী নাবালক জমিদারদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৮৫৬ সালে এই ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক গদ্যরচনা 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' এ বছর রচিত হয়। ১৮৬৪ সালে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের নাম পরিবর্তন করে কলিকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন রাখা হয়। ৪ জুলাই ইংল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে সাম্মানিক সদস্য নির্বাচিত করে। খুব কম ভারতীয়ই এই বিরল সম্মানের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। ২ আগস্ট ফ্রান্সে ঋণগ্রস্ত মাইকেল মধুসূদনের সাহায্যার্থে ১৫০০ টাকা প্রেরণ করেন তিনি। ১৮৬৫ সালের ১১ জানুয়ারি ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর মহাশয় তার প্রথম রিপোর্টটি পেশ করেন। ১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার নিকট আবেদনপত্র পাঠান বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছরই প্রকাশিত হয় তার পরিমার্জিত আখ্যান মঞ্জরী পুস্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। ১৮৬৭ সালের জুলাই মাসে জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতার সঙ্গে গোপালচন্দ্র সমাজপতির বিবাহ হয়। এবছর অনাসৃষ্টির কারণে বাংলায় তীব্র অন্নসংকট দেখা দিলে তিনি বীরসিংহ গ্রামে নিজ ব্যয়ে একটি অন্নসত্র স্থাপন করেন। ছয় মাস দৈনিক চার-পাঁচশো নরনারী ও শিশু এই অন্নসত্র থেকে অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। ১৮৬৮ সালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামগোপাল ঘোষ প্রয়াত হন। ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারির পদ ত্যাগ করেন। এপ্রিল মাসে তার সম্পাদনায় কালিদাসের মেঘদূতম্ প্রকাশিত হয়। ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচিত কমেডি অফ এররস্ অবলম্বনে রচিত বাংলা গ্রন্থ ভ্রান্তিবিলাস। উল্লেখ্য, শোভাবাজার রাজবাড়িতে আনন্দকৃষ্ণ বসুর কাছে তিনি শেকসপিয়রের পাঠ নেন। কথিত আছে, মাত্র পনেরো দিনে তিনি কমেডি অফ এবর-এর এই ভাবানুবাদটি রচনা করেছিলেন। এবছরই বীরসিংহ গ্রামে তার পৈতৃক বাসভবনটি ভস্মীভূত হয়। চিরতরে জন্মগ্রাম বীরসিংহ ত্যাগ করেন ‘বীরসিংহের সিংহশিশু’। ১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। ২০ ফেব্রুয়ারি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, দুর্গাচরণ ছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা। ১১ আগস্ট বাইশ বছর বয়সী পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগর নিবাসী শম্ভুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্দশবর্ষীয়া বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল কাশীতে মা ভগবতী দেবী প্রয়াত হন। ১৮৭১-৭২ সাল নাগাদ তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। জলহাওয়া পরিবর্তনের জন্য এই সময় তিনি কার্মাটারে (বর্তমানে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত) একটি বাগানবাড়ি কেনেন। সেখানে একটি স্কুলও স্থাপন করেন। ১৮৭২ সালের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। স্বল্প আয়ের সাধারণ বাঙালির মৃত্যুর পর তার স্ত্রী-পুত্র পরিবারবর্গ যাতে চরম অর্থকষ্টে না পড়েন, তার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা। বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন এর অন্যতম ট্রাস্টি। ১৮৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে স্থাপিত হয় মেট্রোপলিটান কলেজ। সেযুগের এই বেসরকারি কলেজটিই বর্তমানে কলকাতার বিখ্যাত বিদ্যাসাগর কলেজ নামে অভিহিত। এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (দ্বিতীয় পুস্তক)। এই সময়েই মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউটের শ্যামপুকুর শাখাটির প্রতিষ্ঠা। মে মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের উত্তরে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামের আড়ালে রচনা করেন অতি অল্প হইল এবং আবার অতি অল্প হইল নামে দু-খানি পুস্তক। ১৬ আগস্ট মাইকেল মধুসূদনের নাটক শর্মিষ্ঠা অভিনয়ের মাধ্যমে উদ্বোধিত হল বেঙ্গল থিয়েটার। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই থিয়েটারের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৮৭৪ সালে মাত্র এক বছরেই ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান কলেজ গুণানুসারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। {{{{{{{[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[ |
শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। কালীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের খ্যাতনামা অভিনেতা।পরিচিতিকলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন তিনি। পিতা মনীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী। প্রথমে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সিনেমা জগতে তিনি কালী ব্যানার্জী নামে সমধিক পরিচিত। dt -২০.১১.২০২৪. Vol -১০৫৬. Wednesday। The blogger post in literary e magazine.
কালীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ( ২০ নভেম্বর, ১৯২০ — ৫ জুলাই, ১৯৯৩ ) বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের খ্যাতনামা অভিনেতা। কলকাতার কালীঘাট অঞ্...
-
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মজয়ন্তীতে দৈনিক শব্দের মেঠোপথ পত্রিকার উদ্যোগে পরিবারের সঙ্গে ৮ম মাসিক সাহিত্য বিকেলের আড্ডা ও বর্ণ...
-
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৮ সালে বাংলাদেশের সিলেটে। তুলনামূলক সাহিত্য, ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব, ললিতকলার ইতিহাস নিয়ে তিনি পড়াশোন...
-
‘ কী গাব আমি কী শোনাব" গানটির সুর এখনো কানে ভেসে আসে , শিল্পী বেঁচে নেই কিন্তু তার সৃষ্টি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অলিতে গলিতে এখনো সুরেলা ...