মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই সৃষ্টিশীল। পিকাসো বলে গিয়েছেন, ‘এভরি চাইল্ড ইজ় অ্যান আর্টিস্ট’।
নীরদ মজুমদার
( ১১ মে, ১৯১৭ - ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮২)
ইউরোপীয় ছবির আঙ্গিকে ভারতীয় শৈলীর অপূর্ব সংমিশ্রণ করে নিজস্ব আঙ্গিকে শিল্প সৃষ্টি করেছিলেন।
জন্ম : পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মে।
পিতা - প্রফুল্লকুমার মজুমদার
মাতা - রেণুকাময়ী দেবী।
সাত সন্তানের একজন। বাবা প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন পুলিশ অফিসার। মা ছিলেন বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের এক নিবেদিত প্রাণ। ছোটবেলাটা নীরদের সেই সাংস্কৃতিক পারিবারিক আবহাওয়াতেই কেটেছে। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ ছিল তার।ঠাকুমা যোগমায়া দেবীর স্নেহের ধন ছিলেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই ছোটোবেলায় বাড়ির ধর্মীয় পরিবেশ নীরদকে অনেকটা প্রভাবিত করে।সেই প্রভাব তিনি সমগ্র জীবন বয়ে বেরিয়েছেন। নীরদ মজুমদারের মা রেণুকা দেবীও ছিলেন বাড়ির সেই পরিমণ্ডলের আর এক নিবেদিত প্রাণ। বাবা প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন পুলিশ অফিসার। ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক নীরদের শৈশবকাল থেকেই ছিল। শিল্পচর্চায় বাড়ি থেকে বাধা পাননি এতটুকু। তিনি যখন ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট-এ ভর্তি হন তখন তাঁর বয়স মাত্র তেরো। সোসাইটিতে ছবি আঁকায় তিনি এতটাই কৃতিত্ব দেখান যে কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘নরম্যান ব্লান্ট স্মৃতি পদক’ পুরস্কার দেন। ছাত্রাবস্থায় নীরদের আদর্শ ছিলেন অননীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্ত শহর টাকিতে। তবে তাঁদের কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে একটা ভাড়াবাড়ি ছিল। বছর ছয়েক বয়সে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বিষ্ণুপুরের ‘বিষ্ণুপুর শিক্ষা সংঘ’ স্কুলে নীরদ ও তাঁর বড় ভাই কমলকুমারের সাথে একই শ্রেণিতে ভর্তি হন। কয়েক বছর পর সেখান থেকে কলকাতার ক্যাথিড্রাল মিশনারি স্কুলে। এখানেও বেশি দিন তাঁর মন টেকেনি। সংস্কৃত ভাষা শিখতে ভর্তি হলেন ভবানীপুরের এক সংস্কৃত টোলে।
নীরদ মজুমদার ছিলেন প্রখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদারের (১৯১৪ - ১৯৭৯) কনিষ্ঠ ভ্রাতা।তাঁদের কনিষ্ঠা ভগিনী শানু লাহিড়ী (১৯২৮-২০১৩) ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রকর ও চিত্রকলার প্রশিক্ষক।
তিনি শিল্পকলার প্রথম পাঠ নেন কলকাতার ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টে। তার প্রথম শিক্ষক ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র চিত্রশিল্পী ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার। শৈপ্লিক দক্ষতার জন্য পাঠ শেষে ‘নরম্যান ব্লান্ট স্মৃতি পদক’ লাভ করেন।
প্রদোষ দাশগুপ্ত, রথীন মৈত্র এবং পরিতোষ সেন প্রমুখ এক ঝাঁক নবীন প্রজন্মের আধুনিকতাবাদীদের নিয়ে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নীরদ মজুমদার গড়ে তোলেন ক্যালকাটা গ্রুপ। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা গ্রুপে তার একক প্রদর্শনী হয়। ইতিমধ্যে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সরকারের বৃত্তি পেয়ে নীরদ প্যারিসে যান সেখানে তার শিক্ষাকেন্দ্র ছিল আঁদ্রে লেৎ-এর অ্যাকাডেমি। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে এক প্রদর্শনীতে অংশ নেন এবং কিছুদিন সেখানে আর্ট গ্যালারিতে কিউরেটার হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে নীরদ প্যারিসে ফিরে আসেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে ‘গ্যালরী বারবিজ’ -এ তার একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপে তিনি দশ বৎসর বসবাস করেন এবং সেখানে অবস্থানকালে কনস্ট্যান্টিন ব্রানসুয়েসি, জর্জেস ব্রাক এবং জিন জেনেটের প্রমুখ অনেক লেখক এবং শিল্পীর সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে নীরদ মজুমদার কলকাতায় ফিরে আসেন। তিনি বড় আকারের ক্যানভাসে আঁকতে থাকেন এবং, ধীরে ধীরে তার শিল্প কাজে তন্ত্র আর্টের পুনরজাগরণ ঘটতে লাগল। ছবির বিষয় রইল ভারতীয় তথা একান্ত বাংলার, কিন্তু রীতিতে কিছুটা আধুনিক ইউরোপীয়। তিনি কিউবিজম্-এর পথ ছেড়ে ভারতীয় দর্শন, বেদ এবং উপনিষদের পবিত্রবাক্যের চিত্ররূপায়ণে আত্মনিয়োগ করেন। ভারতীয় মন্ত্র-তন্ত্র শাস্ত্রোক্ত বিষয়গুলি যথা কালী, দুর্গা, মঙ্গল কাব্যের বিষয়বস্তু হয়ে উঠল।
তাঁর শিল্পকল্প কেবল একটি রচনায় সম্পূর্ণ ছিল না। সব সময় গুটিকয়েক ক্যানভাস মিলে একেকটি বিষয়ের উপস্থাপনা হয়েছে। ওই রকম সিরিজ:
ইমাজএক্লোজ
উইং অফ নো এন্ড
ষোড়শী কলা
নিত্যকলা ষডচক্র
বৈতরণী
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যুগ্মকাব্যগ্রন্থ “সুন্দর রহস্যময়”-এর জন্য তিনি একাধিক ছবি এঁকেছেন। এটা নিছক অলঙ্করণ নয়, বরং শিল্পকর্মই।
রচনা :
সাহিত্যের প্রতি নীরদ মজুমদারের একটা আকর্ষণ ছিল। বড় দাদা কমলকুমার মজুমদারের পরোক্ষ প্রভাব ছিল। তিনি একসময় তার স্ত্রীর সাথে যৌথভাবে ভক্তকবি রামপ্রসাদের গানের ফরাসি অনুবাদ করেছিলেন।
নীরদ মজুমদার তাঁর প্রয়াণের চার বছর আগে দেশ সাহিত্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখেন আত্মজীবনীমূলক রচনা পুনশ্চ প্যারী। এটি তাঁর মৃত্যুর পর আনন্দ পাবলিশার্স কলকাতা কর্তৃক ১৯৮২-এ পুস্তকাকারে প্রকাশিত।
পরিবার:
মার্গেরাইট মজুমদার - স্ত্রী।
অদিতি গ্যালিন মজুমদার - কন্যা
চিত্রভানু মজুমদার - পুত্র।
মৃত্যু - ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ সাল। মাত্র ৬৬ বছর বয়সে।
নীরদ মজুমদারের ছবির জগৎ তত্ত্বময়। তাঁর মতে পৃথিবীর সমস্ত বিষয়বস্তুই মহাজাগতিক ক্রিয়াকলাপের অন্তর্গত। নীরদের ছবির বিষয় ভারতীয়, কিন্তু রীতিতে কিছুটা ফরাসি। তাঁর রেখার তীক্ষ্ণতা, কৌণিকতা, বর্ণলেপন ইত্যাদি মন দিয়ে লক্ষ্য করলে সেটা বোঝা যায়। অনেকে বলেন তাঁর ছবিতে একটা টানাপোড়েনের সংকট লুকিয়ে আছে। সেই টানাপোড়েনটি হল ইওরোপীয় শরীরের সঙ্গে ভারতীয় আত্মার দ্বন্দ্ব। তবে নীরদের ছবির ড্রয়িং বরাবরই অসম্ভব জমজমাট। সেজন্যই বোধহয় দশমহাবিদ্যা, বেহুলা-লখীন্দরের কাহিনি, কথাসরিৎসাগর, চন্দ্রকলাবিদ্যা, তন্ত্রের তত্ত্ব নিয়ে ছবি আঁকলেও তা কখনও প্রচলিত ভারতীয় চরিত্রের ছবির মতো হয়নি। তাঁর ছবির ফিগারেরা সর্বদা ঋজু ও টানটান। তারা কখনও সৌন্দর্যসর্বস্ব নয়, লাবণ্যের ভারে তারা লুটিয়ে পড়ে না নব্যবঙ্গীয় চিত্ররীতির মতো। মহাজাগতিক চিন্তা ও চেতনার জন্যই হয়তো নীরদের ছবির জ্যামিতি এত সুসংবদ্ধ। কারণ মহাজগতের বিন্যাস তো আসলে একটি অন্তহীন নিখুঁত জ্যামিতি। তাঁর ছবিতে অনেক প্রতীকি ব্যাপারও আছে। আছে রং সম্পর্কে আশ্চর্য সংযম ও পৌনঃপুনিকতা।
সাহিত্যের প্রতি নীরদ মজুমদারের একটা টান ছিল। দাদা কমলকুমার মজুমদারের পরোক্ষ প্রভাবও কাজ করতো নিশ্চয়ই। নীরদ একসময়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে ভক্তকবি রামপ্রসাদের গানের ফরাসি অনুবাদ করেছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যুগ্মকাব্যগ্রন্থ সুন্দর রহস্যময়-এর জন্যও নীরদ একাধিক ছবি এঁকেছিলেন। যেগুলিকে নিছক অলঙ্করণ বলা যাবে না কোনোভাবেই। মৃত্যুর চারবছর আগে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তিনি লিখেছিলেন আত্মজীবনীমূলক রচনা পুনশ্চ পারী । ১৯৮২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর আনন্দ পাবলিশার্স থেকে সেটি বই আকারে প্রকাশিত হলেও বহুদিন ধরেই বইটি আর পাওয়া যায় না ।
###############################
No comments:
Post a Comment