Friday, 14 June 2024

শুভ প্রকাশ। বর্ণপরিচয় (দ্বিতীয় ভাগ). ১৮৫৫ সালের১৪ ই জুন । আর ১৩ই এপ্রিল বর্ণপরিচয় (প্রথম ভাগ) প্রকাশ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রণীত গ্রন্থ দুটিতে প্রথম শিশু মনে মাতৃভাষা বাংলা'র বর্ণ সংক্রান্ত পরিচয় গড়ে ওঠে। DT - 14.06.2024. Vol -908. The blogger post in literary e magazine



বর্ণপরিচয়” 
দ্বিতীয় ভাগ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত
১৮৫৫ সালে ১৪ ই জুন ( ১লা আষাঢ়)


বাংলা গদ্যের জনক' বিদ্যাসাগর যে চেতনা নিয়ে সমাজের মর্মমূলে নাড়া দিয়েছিলেন তিনিই বুঝতে পেরেছিলেন একটা জাতির সুস্থ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আত্মপ্রকাশের প্রথম ও প্রধান মাধ্যম হল ভাষা, আর সেই সময়ে বাঙালি জাতির গঠনের জন্য বাংলা ভাষাকে সর্বতোমুখী করে তোলার সাধনায় প্রথম ব্রতী হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অবশ্য রামমোহন থেকেই সেই সাধনার গোড়াপত্তন হয়েছিল।



ভাষা হল বহতা নদী; পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে এই প্রবাহ নিরন্তর এগিয়ে যায় এটাই স্বাভাবিক।

বিদ্যাসাগরের গদ্য সেই ত্রিমুখী ধারাকে স্বীকৃতি দিয়ে রূপে রুপান্তরে আজকের গদ্যে পরিণত হয়েছে। প্রবাহমানতা ভাষাশরীরের প্রাণ ।

সম্প্রতি মাতৃভাষা বিশেষ করে বাংলা ভাষার ব্যবহার অর্থাৎ উচ্চারণ ও বানানে এমন একটা সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা আমার এবং আমার মত অনেকেরই মনের মধ্যে বিরাট সংশয় সৃষ্টি করেছে।

ভাষাকে পরিবর্তিত করা আর ভাষার উপর যথেচ্ছাচার করা ঠিক এক কথা নয়-সেটা মনে রাখা খুব দরকার। তাই ভাষা শিক্ষার একেবারে গোড়ার কথা একটু আলোচনা করা যাক। সে জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল 'বর্ণপরিচয়' অর্থাৎ শিশুকাল থেকে বলা ভালো ভাষা শিক্ষার প্রথম পদক্ষেপ থেকে বর্ণের সঙ্গে শিশুকে পরিচয় করানো এবং সেই বর্ণ সম্পর্কে শিশুকে সচেতন করা অভিভাবক এবং শিক্ষকের বড় দায়িত্ব। সেখানে ফাঁক থাকলে সব ব্যবস্থাই অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বর্ণই হল ভাষার ভিত্তি। বর্ণের সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের দূরত্ব যত বাড়বে বর্ণভিত্তিক শব্দ ও ভাষাবিভ্রাটও তত বড় হয়ে দেখা দেবে। সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় ক্রমশ আমাদের মাতৃভাষা কীভাবে বিভ্রান্তি দ্বারা গ্রস্থ হয়ে চলেছে। তাই আজ স্বঘোষণায় বলছি মাতৃভাষার বর্ণের সঙ্গে পরিচয় এর জন্য বর্ণমালার অবশ্যই প্রয়োজন আর সেই বর্ণমালার জন্য বর্ণপরিচয় অপরিহার্য একটি গ্রন্থ। যার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আজ‌ও আমাদের কাছে অনস্বীকার্য। 

 বিদ্যাসাগর মহাশয় রচিত একটি বাংলা বর্ণ শিক্ষার প্রাথমিক পুস্তিকা "বর্ণপরিচয়"। দুই ভাগে প্রকাশিত এই পুস্তিকাটির দুটি ভাগই প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৫ সালে। দুই পয়সা মূল্যের এই ক্ষীণকায় পুস্তিকার প্রকাশ বাংলার শিক্ষাজগতে ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই পুস্তিকায় বিদ্যাসাগর মহাশয় বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ভাষার অযৌক্তিক শাসন জাল থেকে মুক্ত করেন এবং যুক্তি ও বাস্তবতা বোধের প্রয়োগে এই বর্ণমালার সংস্কার-সাধনে প্রবৃত্ত হন। গ্রন্থটি যে শুধু বিদ্যাসাগরের জীবৎ কালেই সমাদৃত হয়েছিল তাই নয়, আজও এর জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় বৃহত্তম যে বই বাসরটিও (বই বিক্রয়ের শপিং মল) এই গ্রন্থটির সম্মানে বর্ণপরিচয় রাখা হয়েছে। ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের পূর্বেও ছাপার অক্ষরে এই জাতীয় কিছু কিছু পুস্তিকা বাজারে চলত।” ডক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১), স্কুল বুক সোসাইটি প্রকাশিত বর্ণমালা প্রথম ভাগ (১৮৫৩ ) ও বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ (১৯৫৪), ক্ষেত্রমোহন দত্ত কর্তৃক তিন ভাগে রচিত শিশুসেবধি (১৮৫৪), মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত শিশুশিক্ষা গ্রন্থগুলির নামকরেছেন। তবে এই সব পুস্তিকা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বাংলা বর্ণমালায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতাও এগুলির রচয়িতাদের ছিল না। ডক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,“শোনা যায়, প্যারীচরণ সরকার এবং বিদ্যাসাগর একদা সিদ্ধান্ত করেন যে, দু’জনে ইংরেজি ও বাংলায় বর্ণশিক্ষা বিষয়ক প্রাথমিক পুস্তিকা লিখবেন। তদনুসারে প্যারীচরণ First Book of Reading এবং বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ’প্রকাশ করেন।" বিহারী লাল সরকারের রচনা থেকে জানা যায় মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পালকিতে বসে পথেই বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ছিলেন বিদ্যাসাগর।১৮৫৫ সালের ১৩ই এপ্রিলে প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ এবং ওই বছরেই ১৪ই জুন প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ। বিহারী লাল আরও লিখেছেন, “প্রথম প্রকাশে বর্ণপরিচয়ের আদর হয় নাই। ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিরাশ হন; কিন্তু ক্রমে ইহার আদর বাড়িতে থাকে।” প্যারী চরণের ইংরেজি গ্রন্থখানিও বাঙালী সমাজে দীর্ঘকালের আদরের বস্তু ছিল। তবে আজকের বিশ্বায়নের যুগে এই গ্রন্থটির শিক্ষামূল্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। অথচ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গ্রন্থটি আজও বাঙালী সমাজে শিশুদের বাংলা শিক্ষার প্রথম সহায়ক হয়ে রয়ে গেছে।




বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে সংযুক্ত বর্ণ শেখানো হয়েছে। এরপর ছোট-বড় অনুচ্ছেদে সেগুলোর প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। পুস্তকের দ্বিতীয় ভাগের ভূমিকা (বিজ্ঞাপন) অংশে বিদ্যাসাগর লিখেছেন :

বালকদিগের সংযুক্তবর্ণপরিচয় এই পুস্তকের উদ্দেশ্য। সংযুক্তবর্ণে উদাহরণস্থলে যে সকল শব্দ আছে, শিক্ষক মহাশয়েরা বালকদিগকে উহাদের বর্ণবিভাগ মাত্র শিখাইবেন, অর্থ শিখাইবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইবেন না। বর্ণবিভাগের সঙ্গে অর্থ শিখাইতে গেলে, গুরু শিষ্য উভয় পক্ষেরই বিলক্ষণ কষ্ট হইবেক, এবং শিক্ষাবিষয়েও আনুষঙ্গিক অনেক দোষ ঘটিবেক। 

এটি শুরু থেকেই লক্ষ করা গিয়েছে, দ্রুত পড়তে শেখানো বিদ্যাসাগরের প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলা বর্ণগুলো কার বা ফলার আকার যখন পায়, তখন সেগুলো চেহারা পালটিয়ে ফেলে। ফলে, বেশি বেশি শব্দে এগুলোর প্রয়োগ দেখিয়েছেন তিনি। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগে অসংযুক্ত বর্ণ চেনানো হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিক পাঠেও কোনো সংযুক্ত বর্ণ নেই। বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগে প্রচুর সংযুক্ত বর্ণ এবং সেই অনুযায়ী পাঠ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। 

দ্বিতীয় ভাগে বিদ্যাসাগর একে একে য-ফলা, র-ফলা, ল-ফলা, ব-ফলা, ণ-ফলা, ন-ফলা, ম-ফলা শিখিয়েছেন। প্রয়োজন মতো তিনি পাঠও তৈরি করে দিয়েছেন। এর পিছনে তাঁর যুক্তি : ‘ক্রমাগত শব্দের উচ্চারণ ও বর্ণবিভাগ শিক্ষা করিতে গেলে, অতিশয় নীরস বোধ হইবেক ও বিরক্তি জন্মিবেক, এজন্য মধ্যে মধ্যে এক একটি পাঠ দেওয়া গিয়াছে।’ ফলাচিহ্নের আকৃতি ও উচ্চারণগত বৈচিত্র্য ঠিকভাবে শেখানোর জন্য বিদ্যাসাগরীয় পদ্ধতি এখনো পর্যন্ত বাংলা ভাষায় সবচেয়ে কার্যকর উপায়। ফলাচিহ্নের পাঠ শেষ করে ‘র’ বর্ণের আরেকটি চেহারা রেফ-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।  




এরপর দুই বর্ণের সংযোগে তৈরি হওয়া ৫৭টি যুক্তাক্ষরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন; যেমন : ক ক ক্ক – চিক্কণ, ধিক্কার, কুক্কুট; জ ঞ জ্ঞ – বিজ্ঞ, আজ্ঞা, অজ্ঞান, অজ্ঞেয়; শ চ শ্চ – নিশ্চয়, পশ্চাৎ, পশ্চিম ইত্যাদি। দুই বর্ণের যুক্তাক্ষর শেষ হলে তিন বর্ণের সংযোগে তৈরি ১৯টি যুক্তাক্ষর চিনিয়েছেন; যেমন: ক ষ ম ক্ষ্ম – সূক্ষ্ম, যক্ষ্মা, লক্ষ্মী; ষ ট র ষ্ট্র – উষ্ট্র, রাষ্ট্র ইত্যাদি। বাংলা যুক্তাক্ষরের সংখ্যা চারশোর বেশি; কিন্তু বিদ্যাসাগর অধিক ব্যবহৃত যুক্তাক্ষরকে এনেছেন।

বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে মোট দশটি গদ্য পাঠ রয়েছে। প্রথম দুটি পাঠে বিভিন্ন নীতিবাক্য শিক্ষা দিয়েছেন। দুটি পাঠেই নম্বর-সংযুক্ত ছয়টি করে অনুচ্ছেদ আছে। একেকটি অনুচ্ছেদ তিন বা চার বাক্যের; প্রতিটি অনুচ্ছেদে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। বক্তব্য বিষয় এরকম :

প্রথম পাঠ :

১. কখনও কাউকে কুবাক্য না বলা।

২. বাল্যকালে মন দিয়ে লেখাপড়া করা।

৩. সদা সত্য কথা বলা।

৪. দিনের পড়া দিনে শেষ করা।

৫. পিতামাতার অবাধ্য না হওয়া।

৬. সুখে থাকতে চাইলে লেখাপড়া শেখা।

দ্বিতীয় পাঠ :

১. শ্রম না করলে লেখাপড়া হয় না।

২. যে চুরি করে, তাকে সবাই ঘৃণা করে।

৩. লেখাপড়া শিখলে সবার প্রিয় হওয়া যায়।

৪. কখনও কারও সাথে কলহ না করা।

৫. গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করা।

৬. অভদ্র বালকের সঙ্গে না মেশা। 

দেখা যাচ্ছে, বারোটি বিষয়ের মধ্যে লেখাপড়া সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ আছে ছয়টি। আর দ্বিতীয় পাঠের শেষ অনুচ্ছেদে অভদ্র বালকের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে : ‘যে চুরি করে, মিথ্যা কথা কয়, ঝগড়া করে, গালাগালি দেয়, মারামারি করে, তাহাকে অভদ্র বলে।’ পড়ালেখার পাশাপাশি সদাচরণও আয়ত্ত করতে বলেছেন পুস্তকপ্রণেতা।

তৃতীয় পাঠের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সুশীল বালক’। আদর্শ বালকের কোন কোন গুণ থাকা দরকার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই পাঠে তা তুলে ধরেছেন। সুশীল বালকের পরিচয় আছে ১০টি অনুচ্ছেদে :

অনুচ্ছেদ ১ : যে পিতামাতার আদেশ ঠিকমতো পালন করে।

অনুচ্ছেদ ২ : যে মন দিয়ে লেখাপড়া করে।

অনুচ্ছেদ ৩ : যে সহোদর ভাইবোনের প্রতি সহমর্মী।

অনুচ্ছেদ ৪ : যে মিথ্যা কথা বলে না।

অনুচ্ছেদ ৫ : যে অন্যায় কাজ করে না।

অনুচ্ছেদ ৬ : যে কখনও কটুবাক্য বলে না।

অনুচ্ছেদ ৭ : যে কখনও চুরি করে না।

অনুচ্ছেদ ৮ : যে অলসতায় দিন কাটায় না।

অনুচ্ছেদ ৯ : যে খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মেশে না।

অনুচ্ছেদ ১০ : যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকের আদেশ পালন করে।

চতুর্থ পাঠের শিরোনাম ‘যাদব’। এই দুরন্ত বালকটিকে উপস্থাপনের ভঙ্গি শিশু-পাঠ্যের উপযোগী হয়নি। যাদবের বয়স আট বছর। তার বাবা তাকে প্রতিদিন স্কুলে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু যাদব স্কুলে না গিয়ে ওই সময়টুকুতে পথে পথে খেলা করে বেড়াত। একদিন ভুবন নামে একটি ছেলেকে স্কুলে যেতে দেখে যাদব বলে, ‘ভুবন! আজ তুমি পাঠশালায় যাইও না। এস দুজনে মিলিয়া খেলা করি। পাঠশালার ছুটি হইলে, যখন সকলে বাড়ি যাইবে, আমরাও সেই সময়ে বাড়ি যাইব।’ যাদবের প্রলোভনে না ভুলে ভুবন স্কুলে চলে যায়। আরেকদিন অভয় নামে আরেকটি ছেলেকে স্কুলে যেতে দেখে যাদব একই রকম কথা বলে। অভয় রাজি না হওয়ায় তার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে যাদব। এরপর স্কুলে গিয়ে অভয় গুরু মহাশয়কে যাদবের কথা বলে দেয়। গুরু মহাশয় তাঁর ‘যথোচিত কর্তব্য’ মতো যাদবের পিতার কাছে অভিযোগ পাঠান। শেষ অনুচ্ছেদে বিদ্যাসাগর লিখেছেন : ‘যাদবের পিতা শুনিয়া অতিশয় ক্রোধ করিলেন, তাহাকে অনেক ধমকাইলেন, বই কাগজ কলম যা কিছু দিয়াছিলেন, সব কাড়িয়া লইলেন। সেই অবধি, তিনি যাদবকে ভালবাসিতেন না, কাছে আসিতে দিতেন না, সম্মুখে আসিলে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন।’ সমাজের আদরবঞ্চিত এই দুরন্ত বালকের ভবিষ্যৎ কী হয়েছিল, জানার উপায় নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে সে ভয়ংকর উদাহরণ হয়ে থাকবে।

পঞ্চম পাঠের শিরোনাম ‘নবীন’। নবীনের বয়স নয় বছর; সেও যাদবের মতো দুরন্ত। নবীন সারাদিন পথে পথে খেলা করে বেড়ায়, লেখাপড়ায় মন নেই। গুরু মহাশয় তাকে ধমকাতেন; ধমকের ভয়ে সে স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দেয়। বিদ্যাসাগর দেখিয়েছেন তিনজন বালককে নবীন পভ্রষ্ট করতে চেয়েছে। তবে কেউ নবীনের প্রলোভনে পা দেয়নি; বরং তারা যুক্তি দেখিয়েছে হেলায় খেলায় সময় নষ্ট করলে এর পরিণাম ভালো হয় না। একসময় নবীন তার ভুল বুঝতে পারে :

এইরূপে, ক্রমে ক্রমে তিন জনের কথা শুনিয়া, নবীন মনে মনে ভাবিতে লাগিল সকলেই কাজের সময় কাজ করে। এক জনও, কাজে অবহেলা করিয়া, সারাদিন খেলিয়া বেড়ায় না। কেবল আমিই সারাদিন খেলা করিয়া বেড়াই। সকলেই বলিল, কাজের সময় কাজ না করিয়া, খেলিয়া বেড়াইলে, চিরকাল দুঃখ পাইতে হয়। এজন্য, তারা সারাদিন খেলা করিয়া বেড়ায় না। আমি যদি, লেখাপড়ার সময়, লেখাপড়া না করিয়া, কেবল খেলিয়া বেড়াই, তা হলে, আমি চিরকাল দুঃখ পাইব। বাবা জানিতে পারিলে, আর আমায় ভালবাসিবেন না, মারিবেন, গালাগালি দিবেন, কখন কিছু চাহিলে, দিবেন না। আমি আর লেখাপড়ায় অবহেলা করিব না। আজ অবধি, লেখাপড়ার সময় লেখাপড়া করিব।

শেষ অনুচ্ছেদে পুস্তকপ্রণেতা জানাচ্ছেন, নবীনের পরিবর্তনের ফলে সবাই তার প্রশংসা করত। আর লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়াতে ক্রমে ক্রমে সে অনেক বিদ্যা অর্জন করতে পেরেছিল।

আত্ম-উন্নয়নের শিক্ষা শিশুরা পেতে পারে নবীনের কাছ থেকে। তবে, এ বিদ্যাসাগরের পুস্তক প্রণয়নের দেড়শো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের শিশুরা খেলার মাঠ হারিয়েছে, আর পড়াশোনার জন্য পেয়েছে সীমাহীন জায়গা – স্কুলঘর, নিজের বাড়ি আর কোচিং সেন্টার! 

ষষ্ঠ পাঠে আছে ‘মাধবে’র কথা। মাধবের বয়স দশ। চতুর্থ পাঠের যাদবের মতো মাধবকেও খারাপ ছেলে হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যাদবের পরিণতি কী হয়েছিল, লেখা নেই। কিন্তু মাধবের করুণ পরিণতির বর্ণনা আছে এই পাঠের শেষ অনুচ্ছেদে। মাধবের দোষ ছিল – সে স্কুলে গিয়ে অন্য বালকদের কলম, কাগজ ইত্যাদি চুরি করত। কয়েকবার ধরা পড়েছে সে; অন্য স্কুলে বদলিও করা হয়েছে তাকে; কিন্তু চুরির অভ্যাস থেকে সে বের হতে পারেনি। মাধব একধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিল। কারণ, ধরা পড়ার পর সে বলেছিল, ‘আমি চুরি করি নাই, ভুলিয়া লইয়াছিলাম।’ ধরা যাক, শিক্ষকের শাস্তির ভয়ে সে মিথ্যা বলেছে। কিন্তু ‘আমি আর কখনও চুরি করিব না’ এই জাতীয় বাক্য বারংবার বলা সত্ত্বেও সে নিজেকে শোধরাতে পারেনি। তার জীবনে ট্র্যাজেডি নেমে আসে যখন তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। মাধবের কাহিনিকার জানাচ্ছেন, বাল্যকাল থেকে চুরির অভ্যাস করে মাধব আর ওই অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি। খেতে না পেয়ে, পেটের জ্বালায় ব্যাকুল হয়ে সে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াত। তবু তার জন্য কারো মায়া হতো না।

সপ্তম পাঠের শিরোনাম ‘রাম’। রামের মধ্যে আবার কোনো ধরনের খারাপ দোষ নেই। সে পিতামাতার বাধ্য ছেলে, ভাইবোনদের প্রতি আন্তরিক, সমবয়সীদের প্রিয়ভাজন, লেখাপড়ায় যত্নশীল, মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকে এবং কারো মনে কষ্ট দেয় না। একজন বালকের এত বেশি সুবোধ বা সুশীল হওয়াও স্বাভাবিক নয়!

অষ্টম পাঠের শিরোনাম ‘পিতা মাতা’। পিতামাতার গুরুত্ব ও মর্যাদা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এই পাঠে। আর খুবই সাধারণভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, ‘তোমরা কদাচ পিতা মাতার অবাধ্য হইবে না।’

নবম পাঠ ‘সুরেন্দ্র’কে নিয়ে। এই পাঠের শুরু কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই :

সুরেন্দ্র! আমার কাছে এস। তোমায় কিছু জিজ্ঞাসা করিব। এই কথা শুনিয়া, সুরেন্দ্র তৎক্ষণাৎ শিক্ষকের নিকট উপস্থিত হইল। তিনি বলিলেন, আমি শুনিলাম …

সুরেন্দ্রর দোষ – সে পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে একটি পাখিকে লক্ষ করে ঢিল ছুড়ছিল। সেই ঢিল যদি পাখির গায়ে লাগত, তবে পাখি কষ্ট পেত – শিক্ষক এমনটাই বোঝাতে চেষ্টা করেন। তবে কাহিনির শুরুর মতো মধ্য অংশও বেশ নাটকীয়। সুরেন্দ্রর ছোড়া ঢিল কোনো পাখির গায়ে না লাগলেও লেগেছে নিকটে দাঁড়ানো একটি বালকের গায়ে। এমনকি সেই ঢিল বালকের মাথায় লেগে রক্তপাত হয়েছে। শিক্ষক বলেন, চোখে লাগলে ছেলেটি এ জন্মের মতো অন্ধ হয়ে যেত। সব শুনে সুরেন্দ্র তার ভুল বুঝতে পারে এবং ভবিষ্যতে আর এরকম না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। 

দশম পাঠের শিরোনাম ‘চুরি করা কদাচ উচিত নয়’। এখানে যে-কাহিনি দেওয়া হয়েছে, আজকের দিনের পুস্তকপ্রণেতাগণ তা পড়লে শিউরে উঠবেন। এই পাঠের প্রধান চরিত্র ভুবন। শৈশবে সে পিতামাতাকে হারায়। এরপর মাসির কাছে বড় হতে থাকে। স্কুল থেকে একবার ভুবন একজনের বই চুরি করে নিয়ে আসে। কিন্তু মাসি কোনো শাসন করেনি; ফলে ভুবনের সাহস দিনে দিনে বাড়তে থাকে। গল্পের পরিণতিতে আছে, বড় হয়ে ভুবন বড় চোরে পরিণত হয়। বিচারক তাকে ফাঁসির আদেশ দেন। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভুবন তার মাসির সঙ্গে দেখা করানোর অনুরোধ করে। ভুবনের মাসিকে ফাঁসির মঞ্চের কাছে আনা হলে মাসি ভুবনকে দেখে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে থাকে। ভুবন মাসিকে বলে, ‘এখন আর কাঁদিলে কি হইবে।’ এরপর মাসির কানে কানে একটি কথা বলার জন্য কাছে ডাক দেয়। মাসি কাছে গেলে ভুবন মাসির কান কামড়ে কেটে নেয়। আর ভর্ৎসনা করে বলে, মাসি যদি আগে থেকেই তাকে সাবধান করত, তাহলে তার জীবনে এই পরিণতি হতো না।


পাঠগুলোর বিষয় থেকে সমকালীন সমস্যাও উপলব্ধি করা যায়। চুরির ব্যাপারটিকে একাধিক পাঠে আনা হয়েছে। পাঠগুলোয় লেখাপড়ার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। বালকদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য পুস্তকপ্রণেতার আন্তরিক চেষ্টা আছে। তবে বিদ্যাসাগর কোনো পাঠে মেয়ে বা নারী চরিত্রের উদাহরণ টানেননি; অথচ তিনি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে উদ্যোগী ছিলেন। 

তিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগে যতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন ব্যবহার করেছেন; দ্বিতীয় ভাগে এগুলোর পাশাপাশি আশ্চর্যচিহ্নও আছে; কিন্তু কোনো ভাগেই তিনি জিজ্ঞাসাচিহ্ন ব্যবহার করেননি। ভাষা-শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় আরোহী পদ্ধতিকে তিনি উপযুক্ত মনে করেছেন – বর্ণ থেকে শব্দের পর্যায়ে গিয়েছেন; এরপর পাঠে শব্দগুচ্ছ বা বর্গ, ছোট বাক্য, বড় বাক্য এবং অনুচ্ছেদ এনেছেন; শেষে একাধিক অনুচ্ছেদ সহযোগে দীর্ঘ পাঠ তৈরি করেছেন। বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের সব শব্দই যুক্তাক্ষরবিহীন; অন্যদিকে দ্বিতীয় ভাগের মূল লক্ষ্য যুক্তাক্ষরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বাংলাভাষী শিশুর মাতৃভাষা শেখার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হিসেবে বিদ্যাসাগরীয় পদ্ধতিকে মেনে নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য দুই পদ্ধতির মিশ্র রূপ ব্যবহার করেছেন সহজপাঠে। সহজপাঠ ও বর্ণপরিচয় দুটি পুস্তকেরই উদ্দেশ্য ভাষা-শিক্ষণ; তবে রবীন্দ্রনাথের পুস্তকে ছন্দের দোলা প্রধান সহায়ক উপাদান হয়েছে, আর বিদ্যাসাগরে নীতিশিক্ষাকে ভাষা-শিক্ষণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। 



=======∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆=======



















No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...