বিংশ শাতাব্দীর গোড়ার দিক। পতিসরে জমিদারির কাজ দেখতে এসেছেন বাবুমশাই। সেখানে আমিনের সেরেস্তায় কাজ করেন এক ঋজুদেহী ব্রাহ্মণ। তাঁর ডাক পড়ল বাবুমশাইয়ের কাছে। বাবুমশাই বললেন, ‘‘দিনে তো সেরেস্তায় কাজ করো, রাত্রিতে কী করো?
সন্ধ্যার পর কিছুক্ষণ সংস্কৃতের আলোচনা করি। কিছুক্ষণ একখানি বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে প্রেসের কপি-পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করি।’’
পাণ্ডুলিপি!
শুনে বাবুমশাই যেন চমকে উঠলেন। দেখতে চাইলেন সেই পাণ্ডুলিপি। দেখলেন। কোনও কথা না বলে ফেরতও দিলেন।
দিন কয়েক পরের ঘটনা।
আচমকা শান্তিনিকেতন থেকে একটি বার্তা এল পতিসরের ম্যানেজার শৈলেশচন্দ্র মজুমদারের কাছে।
তাতে লেখা, ‘‘শৈলেশ, তোমার সংস্কৃতজ্ঞ কর্মচারীকে এইখানে পাঠাইয়া দাও।’’
এই বাবুমশাইটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর কর্মচারী? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। হ্যাঁ, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচয়িতা সেই হরিচরণ।
বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায় এবং অবশ্যই ঠাকুর পরিবারের দিকপালদের সঙ্গে একই সারিতে রবীন্দ্রনাথ হরিচরণকে ঠাঁই দিয়েছিলেন অধ্যাপক হিসেবে।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
Haricharan Bandyopadhyay)
(২৩ জুন, ১৮৬৭ - ১৩ জানুয়ারি, ১৯৫৯ )
একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, শান্তিনিকেতনের খ্যাতিমান অধ্যাপক ও বহুল প্রচলিত ও চর্চিত "বঙ্গীয় শব্দকোষ" অভিধান প্রণেতা ছিলেন।
জন্ম পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার রামনারায়ণপুরে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুন। পিতার নাম নিবারণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। মায়ের নাম জগৎতারিণী দেবী। পৈতৃক বাড়ি যশাইকাটি গ্রামে। এই গ্রামেই তার বিদ্যারম্ভ। এখানকার বিভিন্ন স্কুলের পাঠ শেষে ভর্তি হন কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজে বর্তমানেবিদ্যাসাগর কলেজে। কিন্তু বি.এ.তৃতীয় বর্ষে স্টুডেন্ট ফান্ডের টাকা বন্ধ হওয়ায় আর পড়াশোনা করতে পারেন নি। ইতিমধ্যে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়।
অগত্যা কিছুকাল গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করার পর কলকাতায় মেদিনীপুরের নাড়াজোলের কুমার দেবেন্দ্রলাল খানের গৃহশিক্ষকতা করেন। পরে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা টাউন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে প্রধান পণ্ডিত রূপে যোগদান করেন। কিন্তু সেখানে মাসিক মাহিনা যথেষ্ট ছিল না। বাধ্য হয়ে বছর খানেক বাদে ছেড়ে দেন শিক্ষকতা। পরে তার এক অগ্রজের চেষ্টায় সুপারিনটেন্ডন্টের কাজ পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত পতিসর কাছারিতে। ইতিমধ্যে কোন একসময় রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পরিদর্শনে এসে তার সংস্কৃত জ্ঞানের পরিচয় পান এবং ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। সেসময় থেকেই তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমে সংস্কৃতের অধ্যাপকরূপে অতিবাহিত করে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে অবসর নেন। অধ্যাপনাকালে কবির অভিপ্রায় অনুসারে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' সংকলনের কাজ শুরু করেন। তার সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় দুরূহ কাজ সম্পন্ন করলেন চল্লিশ বছর পর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। এই বৎসর বিশ্বভারতী পাঁচটি খণ্ডে প্রকাশ করে তার সংকলিত "বঙ্গীয় শব্দকোষ"। তবে বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশের পূর্বে তিনি নিজের অর্থব্যয়ে ১৩৪০ বঙ্গাব্দ (১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ) থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে এই অভিধানের ধারাবাহিক প্রকাশ আরম্ভ করেন কলকাতার 'বিশ্বকোষ' প্রেস হতে। ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে ১০৫ খণ্ডে এই মুদ্রণ সমাপ্ত হয়। এর কিছুদিন পর ১০৫ খণ্ডের এই অভিধান পাঁচ ভাগে ক্রমে ক্রমে প্রচারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শব্দকোষ কে বাংলাভাষার এক সম্পদ বলে আখ্যা দেন। আর এই প্রসঙ্গে লিখেছেন -
"১৯৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য আকাদেমিও তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষ দুটি খণ্ডে প্রকাশ করে।"
বাংলা অভিধানের গুরুত্ব বিবেচনায় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান দুটিই সর্বাপেক্ষা পরিচিত। তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান শব্দার্থের গভীর ও ব্যাপকতর অর্থ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে অধিকতর উপযোগী। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষার শব্দ ছাড়াও এ অভিধানে আছে ইংরেজি, পর্তুগিজ, হিন্দি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার শব্দ। তিনি শব্দার্থ স্পষ্ট করতে বাংলা সাহিত্য থেকে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়েছেন; আবার একটি শব্দের পূর্ণ পরিচিতির জন্য সংস্কৃত থেকেও আবশ্যকীয় উদ্ধৃতির সমাবেশ ঘটিয়েছেন।
এ অভিধান প্রথমে পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত হয় (১৯৩২-১৯৫১), পরে দুখন্ডে। বঙ্গীয় শব্দকোষ ছাড়াও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের কথা, সংস্কৃত-প্রবেশ, ব্যাকরণ-কৌমুদী, Hints on Sanskrit Composition & Translation, পালিপ্রবেশ, শব্দানুশাসন, কবির কথা প্রভৃতি গ্রন্থ।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উল্লেখযোগ্য ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থগুলি হল-
'সংস্কৃত প্রবেশ'
'পালিত প্রবেশ'
'ব্যাকরণ কৌমুদী'
'Hints on Sanskrit Translation and Composition'
'কবির কথা'
'রবীন্দ্রনাথের কথা'
এছাড়া তিনি ম্যাথু আর্নল্ডের'শোরাব রোস্তম' এবং বশিষ্ট বিশ্বামিত্র','কবিকথা মঞ্জুষা' প্রভৃতি গ্রন্থ অমিত্রাক্ষর ছন্দে অনুবাদ করেছিলেন ।
বাংলা ভাষায় অসামান্য কাজের স্বরূপ স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন।
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক ।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে শিশিরকুমার স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ডি.লিট. এবং সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দেশিকোত্তম উপাধি দ্বারা সম্মানিত করে।
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ই জানুয়ারি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হন ।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার টাকা নেই। বেতন দেওয়ার টাকা নেই। এই ছিল হরিচরণের ইস্কুলবেলা। আর সেখানেও জড়িয়ে আছে রবীন্দ্র-স্মৃতি।
মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে বেতন তখন তিন টাকা। কিশোর হরিচরণ পড়ল মহা ফাঁপরে।
কোথা থেকে টাকা জোগাড় হবে! এক বন্ধু জানাল পটলডাঙার মল্লিকবাবুরা কয়েক জন ছাত্রের বেতন দেন।
শোনামাত্র দরখাস্ত করে দিল স্কুলের সভাপতিকে। সেই পদে তখন ‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এর সম্পাদক জাঁদরেল নরেন্দ্রনাথ সেন। দরখাস্তের সঙ্গে দু’টি সুপারিশ পত্রও জুড়ে দিল হরিচরণ।
প্রথমটি সেকালের বিখ্যাত চিকিৎসক চন্দ্রমোহন ঘোষের। তাঁর সুপারিশ দেখামাত্র ‘আমি ইহাকে চিনি না’ বলে পাত্তাই দিলেন না নরেন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর চোখ বিস্ফারিত দ্বিতীয় সুপারিশপত্রটি পেয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! এর পর দরখাস্তকারীকে আর কী করে অবজ্ঞা করেন?
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হরিচরণের যোগসূত্রটা অবশ্য বাঁধা হয়েছিল অন্য একটি সূত্রে। তাঁর মূলে ছিলেন যদুনাথ চট্টোপাধ্যায়। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর বেশ যোগাযোগ। হরিচরণের বয়েস তখন পনেরো কী ষোলো। যদুনাথ খবর আনলেন বাবুদের বাড়িতে নাটক হবে। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। অভিনয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
শুনে আর যেন স্থির থাকতে পারল না কিশোর হরিচরণ। এ পালা তাকে দেখতেই হবে। দেখেওছিলেন শেষ পর্যন্ত। বৃদ্ধ বয়েস পর্যন্ত হরিচরণের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে বেঁচে ছিল দস্যুবেশী রবীন্দ্রনাথের সেই ছবিটা। বেশ লেগেছিল দস্যু সর্দারের চরিত্রে অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর অভিনয়ও।
বয়েস যত বেড়েছে কবি-সান্নিধ্য প্রবল হয়েছে হরিচরণের! দাদা যদুনাথ এটা টের পেয়েছিলেন। পতিসরের চাকরিটা জোটে মূলত এই যদুনাথেরই উদ্যোগে।
শান্তিনিকেতনে তখন প্রায় বছর তিনেক শিক্ষকতা করা হয়ে গিয়েছে হরিচরণের। এমন সময় এক দিন রবীন্দ্রনাথ হরিচরণের কাছে একটা ইচ্ছা প্রকাশ করে বসলেন।
কী রকম?
রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘আমাদের বাংলা ভাষায় কোনও অভিধান নেই, তোমাকে একখানি অভিধান লিখতে হবে।’’
গুরুদেবের নির্দেশ। অমান্য করবেন কোন সাহসে! বরং প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হরিচরণ।
দিনরাত এক করে চলল শব্দ আর তার অর্থের সন্ধান। তাঁর উদ্যোগ দেখে খুশি হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিপাঠীকে লিখলেন, ‘‘এ গ্রন্থখানি রচিত ও প্রকাশিত হইলে দেশের একটি মহৎ অভাব দূর হইবে।’’ মাঝে একবার শুধু ছেদ পড়ল কাজে। খুব আর্থিক অনটন সে বার শান্তিনিকেতনে। বাধ্য হয়েই কাজ ছাড়লেন হরিচরণ।
সেন্ট্রাল কলেজের ক্ষুদিরাম বসুর সাহায্যে মিলল অন্য একটা চাকরি। ওই কলেজেই সংস্কৃত পড়ানোর।
পড়াতে লাগলেন ঠিকই। কিন্তু মন তাঁর পড়ে থাকে আশ্রমে! এ দিকে আবার অভিধানের কাজটিও এগোচ্ছে না— সব মিলিয়ে প্রচণ্ড মানসিক পীড়ায় ভুগতে লাগলেন হরিচরণ।
ফের দরবার রবীন্দ্রনাথের কাছে। গেলেন জোড়াসাঁকোয়। সবটা শুনলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নিয়ে গেলেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর কাছে। আশা, যদি কিছু একটা হিল্লে হয়।
মহারাজা মাসিক পঞ্চাশ টাকা বৃত্তি দিলেন হরিচরণকে। সেটা হরিচরণ পেয়েছিলেন প্রায় আট বছর। পরের চার বছরে মিলেছিল ষাট টাকা করে বৃত্তি। আবেগে আপ্লুত হরিচরণ কাঁদতে কাঁদতে পা জড়িয়ে ধরেছিলেন গুরুদেবের।
রবীন্দ্রনাথের ছিল মৃদু প্রতিক্রিয়া— ‘‘স্থির হও, আমার কর্তব্যই করেছি।’’
বৃত্তি পেয়ে সেই যে কলকাতার পাততাড়ি গুটোলেন হরিচরণ, আর কোনও দিন অন্য দিকে ফিরেও চাননি।
======{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}======
No comments:
Post a Comment