(২৩ জুলাই, ১৮৯৮−সেপ্টেম্বর ১৪, ১৯৭১)
বিংশ শতাব্দীর এক বিশিষ্ট বাঙালি
কথাসাহিত্যিক। তিনি ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি ছোটোগল্প-সংকলন, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ-সংকলন, ৪টি স্মৃতিকথা, ২টি ভ্রমণকাহিনি, একটি কাব্যগ্রন্থ এবং একটি প্রহসন রচনা করেন।
শরৎস্মৃতি পুরস্কার (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
জগত্তারিণী স্মৃতিপদক (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসের জন্য তারাশঙ্কর ১৯৫৫ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার ও ১৯৫৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং ১৯৬৭ সালে গণদেবতা উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া ১৯৬২ সালে তিনি পদ্মশ্রী এবং ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ সম্মান অর্জন করেন. ।
১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের সমস্যা ও লাভপুর-সন্নিহিত অঞ্চলের সাধারণ জনজীবন পরবর্তীকালে তারাশঙ্করের আঞ্চলিক উপন্যাস গুলির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল। তাঁর পিতার নাম ছিল হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ছিল প্রভাবতী দেবী। তারাশঙ্করের পিতৃ বিয়োগ হয় ১৩১৩ সালের আশ্বিন মাসে নবমীর দিন। হিসাব মতো সেটি ছিল ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ, তারাশঙ্করের বয়স তখন আট বছর। তারাশঙ্কর ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯১৬ সালে। আগের বছর পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারেননি, ১৯১৬ সালে দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। ১৯১৬ সালে লাভপুরের যাদবলাল এইচ. ই. স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতায় আসেন এবং প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ও পরে সাউথ সাবআর্বান কলেজে (অধুনা আশুতোষ কলেজ) ভর্তি হন। কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্য ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে তিনি লেখাপড়া সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
১৯১৬ সালেই উমাশশী দেবীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন তারাশঙ্কর। তাঁদের দুই পুত্র সনৎকুমার ও সরিৎকুমারের জন্ম যথাক্রমে ১৯১৮ ও ১৯২২ সালে এবং তিন কন্যা গঙ্গা, বুলু ও বাণীর জন্ম যথাক্রমে ১৯২৪, ১৯২৬ ও ১৯৩২ সালে। মধ্যম কন্যা বুলু ১৯৩২ সালেই মারা যায়।[২]তারাশঙ্কর কোনও দিনই বিধানসভার সদস্য হননি। ১৯৫২ সালে বিধান পরিষদের মনোনীত সদস্য হয়েছিলেন, ১৯৬০ সালে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হওয়ার আগে পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। নোবেল পুরস্কারের জন্যে তিনি মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু মৃত্যু হওয়াতেই তিনি তা পাননি। যতদূর জানা যায় চূড়ান্ত মনোনয়নের আগে বাছাইপর্বে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর নামও বিবেচিত হয়েছিল, সে সময়েই তাঁর মৃত্যু হওয়ায় সে নাম আর চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছায়নি।
সম্প্রতি নোবেল কমিটি জানিয়েছেন যে ১৯৭০ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু সঠিক অনুবাদের অভাব এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণে সেই নোবেল আর পাওয়া হয়নি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সে বছরে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন চিলির পাবলো নেরুদা।
তারাশঙ্কর যে সব পুরস্কার পেয়েছিলেন তা সবই কলকাতা বসবাসের সময়ে। স্বাভাবিক ভাবেই পুরস্কারের সবগুলি স্মারকও তাঁর টালা পার্কের বাড়িতে রক্ষিত ছিল। তারাশঙ্করের সমস্ত পুরস্কার ও অন্য স্মৃতিচিহ্নগুলি বর্তমানে টালার বাসভবনে (এখন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এক্তিয়ারভুক্ত), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে এবং কলকাতা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অল্প কিছু জিনিস আছে লাভপুরের ধাত্রীদেবতায়, সেগুলি পাওয়া গিয়েছে তারাশঙ্করের বংশধরদের সৌজন্যে।
১৯৩০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান করে তারাশঙ্কর গ্রেফতার হয়েছিলেন; সেই বছর ডিসেম্বর মাসে কারাগার থেকে মুক্তি লাভও করেন। ১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় তাঁর। সেই বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস চৈতালী ঘূর্ণি।[২]
১৯৩৫ ও ১৯৩৭ সালে লাভপুরের অধিবাসীরা তারাশঙ্করকে দুই বার সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় ধাত্রী দেবতা উপন্যাসটি। ১৯৪০ সালে তিনি কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে একটি বাড়ি ভাড়া করে নিজের পরিবারবর্গকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। ১৯৪১ সালে তিনি সপরিবারে চলে যান কলকাতার উত্তর শহরতলি অঞ্চলের বরানগরে। ১৯৪২ সালে তিনি বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনের পৌরোহিত্য করেন। সেই বছরই তিনি ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কানপুর প্রবাসী সাহিত্য সম্মেলনে পৌরহিত্য করেন। এই সময়কালের মধ্যেই একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস কালিন্দী (১৯৪০), গণ দেবতা (১৯৪৩), মন্বন্তর (১৯৪৩), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪), কবি (১৯৪৪), সন্দীপন পাঠশালা (১৯৪৬) ও অভিযান (১৯৪৬)। ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতায় আয়োজিত প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন। সেই বছরই তিনি বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত সুবর্ণ জয়ন্তী প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৭ সালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তারাশঙ্করকে শরৎ স্মৃতি পদক প্রদান করে। সেই বছর জুলাই মাসে জীবনের পঞ্চাশ-বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা তাঁকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতার টালা পার্ক অঞ্চলে নতুন বাড়ি তৈরি করে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তারাশঙ্কর।
১৯৫১ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের একটি আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৫২ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন।
১৯৫৪ সালে তিনি মায়ের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসের জন্য তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯৫৬ সালে চীনা লেখক লু-শুনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভারত সরকার তাঁকে চীনে প্রেরণ করে; কিন্তু পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি রেঙ্গুন থেকেই ফিরে আসেন। সেই বছরই তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে চীন সরকারের আমন্ত্রণে তিনি চীন সফরে যান। ১৯৫৮ সালে তিনি আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক সমিতিতে যোগ দিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। সেই বছরই আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনের ভারতীয় লেখকদের নেতা হিসেবে তিনি গিয়েছিলেন তাসখন্দে।
১৯৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তারাশঙ্করকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক প্রদান করে। সেই বছরই মাদ্রাজে আয়োজিত সর্বভারতীয় লেখক সম্মেলনে পৌরোহিত্য করেন তিনি। ১৯৬০ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদের সদস্য মনোনীত হন। এই উপলক্ষ্যে হাওড়া জেলার বাঁটরার অধিবাসীবৃন্দ তাঁকে গণসম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেছিল। একই বছর লাভপুরের অধিবাসীরাও তাঁকে তৃতীয়বার সম্বর্ধিত করেন। ১৯৬২ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মান লাভ করেন। এই বছরই তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু ঘটলে ভগ্নহৃদয় তারাশঙ্কর অন্যদিকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ছবি আঁকা ও কাঠের পুতুল তৈরিতে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি শিশিরকুমার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সংসদের সদস্যপদ থেকে অবসর নেন। ১৯৬৬ সালে তিনি নাগপুর বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে পৌরোহিত্য করেন। ১৯৬৭ সালে গণদেবতা উপন্যাসের জন্য তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। এই উপলক্ষ্যে কলকাতা পৌরসংস্থা তাঁকে গণসম্বর্ধনা দিয়েছিল।
সত্তর বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরা মহাজাতি সদনে তাঁকে আরেকটি সম্বর্ধনা দিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে তিনি পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। সেই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট. প্রদান করে। ১৯৬৯ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। সেই বছরই তাঁর মা প্রভাবতী দেবী প্রয়াত হন এবং তারাশঙ্কর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি এবং ত্রৈমাসিক পত্রিকা শতরূপা-র সম্পাদকীয় পর্ষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি লাভপুরে চতুর্থ সম্বর্ধনা লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে তিনি নৃপেন্দ্রচন্দ্র স্মৃতি বক্তৃতা প্রদান করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় স্মৃতি বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
উপন্যাস
চৈতালি ঘূর্ণি (১৯৩২), পাষাণপুরী (১৯৩৩), নীলকণ্ঠ (১৯৩৩), রাইকমল (১৯৩৫), প্রেম ও প্রয়োজন (১৯৩৬), আগুন (১৯৩৮), ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪৩), মন্বন্তর (১৯৪৪), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪), কবি (১৯৪৪), সন্দীপন পাঠশালা (১৯৪৬), ঝড় ও ঝরাপাতা (১৯৪৬), অভিযান (১৯৪৬), সন্দীপন পাঠশালা (কিশোরপাঠ্য সংস্করণ, ১৯৪৮), পদচিহ্ন (১৯৫০), উত্তরায়ণ (১৯৫০), হাঁসুলীবাঁকের উপকথা (১৯৫১), তামস তপস্যা (১৯৫২), নাগিনী কন্যার কাহিনী (১৯৫২), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩), চাঁপাডাঙার বৌ (১৯৫৪), পঞ্চপুত্তলি (১৯৫৬), বিচারক (১৯৫৭), সপ্তপদী (১৯৫৮), বিপাশা (১৯৫৯), রাধা (১৯৫৯), মানুষের মন (১৯৫৯), ডাকহরকরা (১৯৫৯), মহাশ্বেতা (১৯৬১), যোগভ্রষ্ট (১৯৬১), না (১৯৬১), নাগরিক (১৯৬১), নিশিপদ্ম (১৯৬২), যতিভঙ্গ (১৯৬২), কান্না (১৯৬২), কালবৈশাখী (১৯৬৩), একটি চড়–ইপাখি ও কালো মেয়ে (১৯৬৩), জঙ্গলগড় (১৯৬৪), মঞ্জরী অপেরা (১৯৬৪), সংকেত (১৯৬৪), ভুবনপুরের হাট (১৯৬৪), বসন্তরাগ (১৯৬৪), স্বর্গমর্ত্য (১৯৬৫), বিচিত্রা (১৯৬৫), গন্না বেগম (১৯৬৫), অরণ্যবহ্নি (১৯৬৬), হীরাপান্না (১৯৬৬), মহানগরী (১৯৬৬), গুরুদক্ষিণা (১৯৬৬), শুকসারী কথা (১৯৬৭), শক্করবাঈ (১৯৬৭), মণিবৌদি (১৯৬৯), ছায়াপথ (১৯৬৯), কালরাত্রি (১৯৭০), রূপসী বিহঙ্গিনী (১৯৭০), অভিনেত্রী (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), শতাব্দীর মৃত্যু (১৯৭১), কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড (কিশোর উপন্যাস, ১৯৭২)।
ছোটোগল্প
ছলনাময়ী (১৯৩৭), জলসাঘর (১৯৩৮), রসকলি (১৯৩৯), তিন শূন্য (১৯৪২), প্রতিধ্বনি (১৯৪৩), বেদেনী (১৯৪৩), দিল্লী কা লাড্ডু (১৯৪৩), যাদুকরী (১৯৪৪), স্থলপদ্ম (১৯৪৪), তেরশো পঞ্চাশ (১৯৪৪), প্রসাদমালা (১৯৪৫), হারানো সুর (১৯৪৫), ইমারত (১৯৪৭), রামধনু (১৯৪৭), শ্রীপঞ্চমী, কামধেনু (১৯৪৯), মাটি (১৯৫০), শিলাস্থান (১৯৫২), বিস্ফোরণ (১৯৫৫), কালান্তর (১৯৫৬), বিষপাথর (১৯৫৭), রবিবারের আসর (১৯৫৯), পৌষলক্ষ্মী (১৯৬১), আলোকাভিসার, চিরন্তনী (১৯৬২), অ্যাক্সিডেন্ট (১৯৬২), তমসা (১৯৬৩), আয়না (১৯৬৩), চিন্ময়ী (১৯৬৪), একটি প্রেমের গল্প (১৯৬৫), তপোভঙ্গ, দীপার প্রেম (১৯৬৬), নারী রহস্যময়ী (১৯৬৭), পঞ্চকন্যা (১৯৬৭), শিবানীর অদৃষ্ট (১৯৬৭), গোবিন সিংয়ের ঘোড়া (১৯৬৮), জয়া (১৯৬৮), এক পশলা বৃষ্টি (১৯৬৯), মিছিল (১৯৬৯), উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)।
নাটক
কালিন্দী (১৯৪২), দুইপুরুষ (১৯৪৩), পথের ডাক (১৯৪৩), বিংশ শতাব্দী (১৯৪৫), দ্বীপান্তর (১৯৪৫), যুগবিপ্লব (১৯৫১), কবি (১৯৫৭), কালরাত্রি (১৯৫৭), সংঘাত (১৯৬২), আরোগ্য নিকেতন (১৯৬৮)
প্রবন্ধ সংকলন
সাহিত্যের সত্য (১৯৬১), ভারতবর্ষ ও চীন (১৯৬৩), রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী (১৯৭১)। স্মৃতিকথা: আমার কালের কথা (১৯৫১), বিচিত্র স্মৃতিকাহিনী (১৯৫৩), আমার সাহিত্য জীবন, প্রথম খণ্ড (১৯৫৩), কৈশোর স্মৃতি (১৯৫৬), আমার সাহিত্য জীবন, দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৬২)
রচনা-সংকলন
তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৪৭), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় গল্প (১৯৫৩), স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৫৪), গল্প-সঞ্চয়ন (১৯৫৫), ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫৬), রচনাসমগ- প্রথম খণ্ড (১৯৫৯), প্রেমের গল্প (১৯৬১), ছোটদের ভালো ভালো গল্প (১৯৬২), গল্প-পঞ্চাশৎ (১৯৬৩), কিশোর সঞ্চয়ন (১৯৬৬), ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৬৯)
প্রহসন
চকমকি (১৯৪৫)
ভ্রমণসাহিত্য
মস্কোতে কয়েক দিন (১৯৫৯)
কাব্যগ্রন্থ
ত্রিপত্র (১৯২৬)
প্রথম পর্ব: চৈতালী ঘূর্ণি থেকে আগুন
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস চৈতালী ঘূর্ণি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। তাঁর প্রথম পর্বের অন্যান্য উপন্যাসগুলি হল পাষাণ পুরী (১৯৩৩), নীলকণ্ঠ (১৯৩৩), রাইকমল (১৯৩৫), প্রেম ও প্রয়োজন (১৯৩৬) ও আগুন (১৯৩৮)। তারাশঙ্করের প্রথম উপন্যাস চৈতালী ঘূর্ণি সম্পর্কে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন, "তারাশঙ্কর সাহিত্য জীবনে রাঢ়ের গ্রামাঞ্চল নিয়ে বহু সার্থক ও সুবৃহৎ উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু সে সমস্ত উপন্যাসের প্রায় তাবৎ উপাদানই বীজাকারে যেন তুলনায় নিতান্ত ক্ষুদ্রাকার ‘চৈতালী ঘূর্ণি’র মধ্যেই সঞ্চিত।পাষাণপুরী উপন্যাসে নায়ক কালী কর্মকারের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক বন্ধন মুক্তির আকুলতা এবং রাইকমল উপন্যাসে বৈষ্ণবী নায়িকার মুক্তি সন্ধানের সুর ধ্বনিত হলেও, ড. মুখোপাধ্যায়ের মতে এই দুই উপন্যাস ছিল অপরিণত] মহাশ্বেতা দেবী রাইকমল উপন্যাস প্রসঙ্গে ড. মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত না হলেও, পাষাণ পুরী ও নীলকণ্ঠ উপন্যাস দু’টিকে বলেছেন আখ্যান সর্বস্ব ও যেনতেনভাবে রচিত।
দ্বিতীয় পর্ব: ধাত্রীদেবতা থেকে ঝড় ও ঝরাপাতা
তারাশঙ্করের উপন্যাস রচনার দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত উপন্যাসগুলি হল: ধাত্রী দেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪৩), মন্বন্তর (১৯৪৩), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪), কবি (১৯৪৪), সন্দীপন পাঠশালা (১৯৪৬), অভিযান (১৯৪৬) ও ঝড় ও ঝরাপাতা (১৯৪৬)। এই উপন্যাসগুলির বিষয়বস্তু রাজনৈতিক বন্ধন মুক্তি ও মানুষের সনাতন জীবন-মুক্তির সাধনা, সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনযাত্রা ও নানাপ্রকার অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাই এই উপন্যাসগুলি আদর্শবাদের চড়া সুরে বাঁধা। ধাত্রী দেবতা-র নায়ক শিবনাথ স্বদেশ চেতনা, মাতৃভক্তি ও জনকল্যাণের ত্রিবেণী সঙ্গমে উপনীত হয়েছে। যুগ্ম উপন্যাস গণদেবতা-পঞ্চগ্রাম-এর নায়ক দেবু ঘোষ শোষণ ও বঞ্চনাবিহীন এক ভারতের স্বপ্ন দেখেছে, যেখানে কর্মের পথে নারী হবে পুরুষের সহপথিক। সন্দীপন পাঠশালা-র নায়ক সীতারাম পণ্ডিতও অনুরূপভাবে ভারতের এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। অপর দিকে কবি উপন্যাসের নায়ক নিতাইয়ের পারিবারিক জাত ব্যবসা চুরি ছেড়ে কবিয়ালের বৃত্তি গ্রহণ করে উপলব্ধি করে জীবনের পরম সত্য।
তৃতীয় পর্ব: হাঁসুলী বাঁকের উপকথা থেকে ডাকহরকরা
তৃতীয় পর্বে এসে তারাশঙ্করের উপন্যাসগুলি এক নতুন মোড় নিয়েছে। এই পর্বের উপন্যাসগুলি হল: পদচিহ্ন (১৯৫০), উত্তরায়ণ (১৯৫০), হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১), তামস তপস্যা (১৯৫২), নাগিনী কন্যার কাহিনী (১৯৫২), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩), চাঁপাডাঙার বৌ (১৯৫৪), পঞ্চপুত্তলি (১৯৫৬), বিচারক (১৯৫৭), সপ্তপদী (১৯৫৮), বিপাশা (১৯৫৯), রাধা (১৯৫৯), মানুষের মন (১৯৫৯) ও ডাকহরকরা (১৯৫৯)। ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, "আঞ্চলিক উপন্যাসের সার্থক রূপ এখানে দেখি। তার চেয়ে বড় কথা এখানে লেখক হয়ে উঠেছেন কালের রূপকার ‘ক্রনিক্লার’।… বোধ করি এই পর্বটি তারাশংকরের উপন্যাসের সমৃদ্ধতম পর্ব।"[৬] হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, তামস তপস্যা, পঞ্চপুত্তলি ও নাগিনী কন্যার কাহিনী-তে পিছিয়ে পড়া জনসমাজের কথা, আরোগ্য নিকেতন, বিচারক ও সপ্তপদী উপন্যাসে আধুনিক শহুরে শিক্ষিত মানুষের কথা, আবার রাধা উপন্যাসে অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের প্রেক্ষাপটে বীরভূমের বৈষ্ণব সমাজে মা-মেয়ের জীবনের জটিল রহস্যের কথা ফুটে উঠেছে। অন্যভাবে দেখলে আরোগ্য উপন্যাস ও হাঁসুলী বাঁকের উপকথা-য় রয়েছে অতীত ও বর্তমানের দ্বন্দ্ব, বিচারক-এ চিত্রিত হয়েছে আধুনিক মানুষের বিবেকের ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত, আবার রাধা উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর জীবন ধর্ম ও প্রেমের তীব্র টানাপোড়েন।
চতুর্থ পর্ব: মহাশ্বেতা থেকে কীর্তিহাটের কড়চা
এই পর্বের উপন্যাসগুলি হল: মহাশ্বেতা (১৯৬১), যোগভ্রষ্ট (১৯৬১), না (১৯৬১), নাগরিক (১৯৬১), নিশিপদ্ম (১৯৬২), যতিভঙ্গ (১৯৬২), কান্না (১৯৬২), কালবৈশাখী (১৯৬৩), একটি চড়ুই পাখি ও কালো মেয়ে (১৯৬৩), জঙ্গলগড় (১৯৬৪), মঞ্জরী অপেরা (১৯৬৪), সংকেত (১৯৬৪), ভুবনপুরের হাট (১৯৬৪), বসন্তরাগ (১৯৬৪), স্বর্গমর্ত্য (১৯৬৫), বিচিত্রা (১৯৬৫), গন্না বেগম (১৯৬৫), অরণ্যবহ্নি (১৯৬৬), হীরাপান্না (১৯৬৬), মহানগরী (১৯৬৬), গুরুদক্ষিণা (১৯৬৬), শুকসারি কথা (১৯৬৭), কীর্তিহাটের কড়চা (১৯৬৭) ও শক্করীবাঈ (১৯৬৭)। এই পর্বের উপন্যাসে তারাশঙ্কর জনজীবনের চিত্রন ছেড়ে আকৃষ্ট হয়েছেন নিয়তির খেলা ও অধ্যাত্মবাদের প্রতি। এই পর্বের প্রথম উপন্যাস মহাশ্বেতা-য় তারাশঙ্কর এঁকেছেন এক ভাগ্যবিড়ম্বিতা নারীর ছবি। এই পর্বেই তারাশঙ্কর লিখেছেন নিশিপদ্ম ও যতিভঙ্গ-এর মতো অন্য ধরনের উপন্যাস, মঞ্জরী অপেরা-র মতো বিচিত্র স্বাদের ঘটনাবহুল উপন্যাস, সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস অরণ্যবহ্নি, আবার কীর্তিহাটের কড়চা-র মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস, যার বিস্তার ১৭৯৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সাত পুরুষের কাহিনিতে। তৃতীয় পর্বের আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসে তারাশঙ্কর জীবনের প্রতি যে গভীর ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা আরেকবার দিয়েছেন চতুর্থ পর্বের সপ্তপদী উপন্যাসে এসে। আবার যোগভ্রষ্ট উপন্যাসে "মানবতাবাদ নয়, গান্ধীবাদ বা সাম্যবাদ নয়, এক রহস্যময় অধ্যাত্মবাদের রূপায়ণ" দেখা যায়।
পঞ্চম পর্ব: মণিবৌদি থেকে নবদিগন্ত
তারাশঙ্করের উপন্যাস রচনার সর্বশেষ এই পর্বের উপন্যাসগুলি হল: মণিবৌদি (১৯৬৯), ছায়াপথ (১৯৬৯), কালরাত্রি (১৯৬৯), রূপসী বিহঙ্গিনী (১৯৭০), অভিনেত্রী (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), সুতপার তপস্যা (১৯৭১) ও একটি কালো মেয়ের কথা (১৯৭১), নবদিগন্ত (১৯৭৩)। এই পর্বে তারাশঙ্কর উপন্যাস রচনার প্রচলিত রীতিটিকে ভেঙেছেন। মণিবৌদি, অভিনেত্রী, ফরিয়াদ, একটি কালো মেয়ে ও সুতপার তপস্যা উপন্যাসে ঘটনার বিন্যাসে কথকতার পারম্পর্য রক্ষিত হয়নি। লেখকের বক্তব্য ও চরিত্রের কথা সমান্তরালভাবে এসেছে এবং তার সঙ্গে মিশে গেছে আখ্যানভাগ। ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, "এ-গুলিতে আছে দুটি করে কাহিনী-ধারা – একটি মূল কাহিনীর ধারা, অপরটি শাখা-কাহিনীর ধারা। কিন্তু শেষোক্তর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই প্রথমোক্তের অবসান। অনেকটা স্মৃতিচারণের ঢঙে লেখা, তবে তা জনান্তিকে নয়।"এই উপন্যাসগুলির প্রেক্ষাপট ১৯১০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ষাট বছরের বাংলা। ড. মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, এই বিক্ষুব্ধ সময়ে "মানুষের আমূল পরিবর্তনের পিছনে যে তপস্যা, লেখক তারই রূপ ও কারণ সন্ধান করেছেন শেষ পর্বের উপন্যাসে।"
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি শরীরে সাইনাস-জাতীয় ব্যথা অনুভব করেন। ১৩ অগস্ট তিনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান; কিন্তু বিকেলের মধ্যেই আবার সুস্থ হয়ে ওঠেন। ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাঁর শরীর মোটামুটি ঠিকই ছিল। তারপরই আরেক বার তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৪ সেপ্টেম্বর ভোরে তাঁর মৃত্যু ঘটে। জ্যেষ্ঠপুত্র সনৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তর কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন।
===={{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}}======
No comments:
Post a Comment