Thursday, 1 August 2024

। শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।‌ মহেন্দ্রনাথ দত্ত ।‌ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এক ভক্ত, গৃহী সন্ন্যাসী ও লেখক। তিনি ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং সমাজ সংস্কারক স্বামী বিবেকানন্দর অনুজ। DT - 01.08.2024. Vol - 940. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.




মহেন্দ্রনাথ দত্ত 
(১ আগস্ট ১৮৬৮ — ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬)


মহেন্দ্রনাথ অবশ্যই আমাদের কালের অনন্য এক দার্শনিক, দুঃসাহসী, গবেষক, চিন্তানায়ক, ইতিহাসবিদ, পরিব্রাজক এবং উদাসী এক সাধক। শুনেছি, লেখক মহেন্দ্রনাথের কলম ধরার অভ্যেস ছিল না, কিন্তু এই স্মৃতিধর পুরুষটি ভক্তজনকে ডিক্টেশন দিতেন—যেমনটা দিতেন ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্য নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। আরও শুনেছি, বই লিখে অর্থ উপার্জনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন মহেন্দ্রনাথ। তাঁর নামাঙ্কিত বইগুলি ছাড়া এ দেশের রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলনকে পুরোপুরি বোঝা প্রায় অসম্ভব। যদিও কেউ কেউ এখন দুঃখ করেন, লেখক মহেন্দ্রনাথ তাঁর প্রাপ্য সম্মান আজও পাননি। নিজের নামাঙ্কিত ছোট ছোট বইগুলি ছাড়াও আরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েক ডজন কথোপকথন। সব রচনা বোধ হয় আজও গ্রন্থিত হয়নি, কিন্তু ভক্তজন ও অনুরাগীদের এই সব স্মৃতিসঞ্চয়ে বিবেকানন্দ অ্যান্ড ফ্যামিলির যে সব খবরাখবর ছড়িয়ে আছে, তা বিস্ময়কর। আমাকে সবচেয়ে যা বিস্মিত করে, তা হল তাঁর অনন্য স্মৃতিশক্তি, সেই সঙ্গে রসবোধ ও সত্যনিষ্ঠা। মহেন্দ্রনাথ যখন লেখক, তখন আমরা এক আশ্চর্য বিবেকানন্দকে বারে বারে খুঁজে পাই। ঘটনামালার গভীরে ঢুকে খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে সেই বিবেকানন্দকে, যিনি আজও তুলনাহীন!

 শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এক ভক্ত, গৃহী সন্ন্যাসী ও লেখক। তিনি ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং সমাজ সংস্কারক  স্বামী বিবেকানন্দর অনুজ।

জন্ম ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা আগস্ট (১২৭৫ বঙ্গাব্দের ২৯ শে শ্রাবণ) বৃটিশ ভারতের কলকাতার ৩নং গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটের মহেন্দ্র তপক্ষেত্রে। পিতা অ্যাটর্নী বিশ্বনাথ দত্ত এবং মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। তিনি নরেন্দ্রনাথ বা স্বামী বিবেকানন্দর মধ্যম ভ্রাতা। পিতার মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন বিদ্যালয়ের নিচু ক্লাসের ছাত্র। মহেন্দ্রনাথ কলকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউট থেকে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স এবং ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করেন। স্কুল জীবনে কেশবচন্দ্র সেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রমুখের প্রভাবে ব্রাহ্ম সমাজের সংস্পর্শে এলেও ছোটবেলা থেকেই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও তার অনুরাগী স্বামী অভেদানন্দ, স্বামী সারদানন্দ, গিরিশ ঘোষ প্রমুখের সাথে থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন শাস্ত্রের অধ্যয়ন ও আলোচনা করতেন। এফ.এ পাশের পর ঈশ্বরনিষ্ঠ তপশ্চর্যাকে আয়ত্ত করার জন্য হরিদ্বার হৃষিকেশ প্রভৃতি তীর্থভূমি ঘুরে বেড়ান। 
মহেন্দ্রনাথের স্নাতকে ভাল ফল হয় নি। স্বামী সারদানন্দ ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জাহাজে ইংল্যান্ড গমন করিলে, তার এক সপ্তাহ পর মহেন্দ্রনাথও খেতড়ির মহারাজের কাছ থেকে এক পিঠের জাহাজভাড়া নিয়ে মহেন্দ্রনাথ লন্ডনে আইন শিক্ষার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড যান। মহেন্দ্রনাথের ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ বিশেষ চিন্তিত ছিলেন। তিনি চাইতেন না যে, সে তার পিতার মত উকিল না হয়ে যেন একজন ইলেকট্রিসিয়ান হন এবং তাঁকে সারদানন্দ ও গুডউইনের সাথে এক সঙ্গে আমেরিকা পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে মহেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণায় লিপ্ত থাকেন। মূলত আর্থিক অনটনের জন্য বিবেকানন্দ মহিমের ইংল্যান্ডে আগমনে খুশি হননি। মহেন্দ্রনাথ দেড়-দু'বছর থাকার পর খানিকটা অভিমান করে আর হাতে বেশি অর্থ না থাকার কারণে পদব্রজে ইউরোপের নানা দেশের ভেতর দিয়ে উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া, গ্রীস, ইরান, সিরিয়া, রাশিয়া বুলগেরিয়া হয়ে... পাঁচ বৎসর ধরে পর্যটন করে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরে আসেন।


তার পরিক্রমার বিবরণী প্রক্ষিপ্ত আভাসে মহেন্দ্র পাবলিশিং কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ন্যাশনাল ওয়েলথ্, ফেডারেটেড এশিয়া, প্রাচীন ভারতের সংশ্লিষ্ট কাহিনী প্রভৃতি বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। সে সময়ে তার অনুগামীদের পুলিশি জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করতে তার লেখা বহু পাণ্ডুলিপি তিনি নিজে নষ্ট করে ফেলেছেন। মহেন্দ্রনাথ পৃথিবীর বহু ভাষা জানতেন এবং ভাষাতত্ত্বে তার গভীর জ্ঞান ছিল। সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান, কাব্য, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, অর্থনীতি, স্থাপত্য, সমাজ-বিজ্ঞান, জীববিদ্যা, দর্শন, পুরাতত্ত্ব, নীতিবিজ্ঞান, নন্দনতত্ত্ব, বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত তাপ, আলোক,শব্দ, স্পন্দন ও মহাজাগতিক ক্রমবিবর্তন, শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদদের জীবনী, ইতিহাস ও অনুধ্যান প্রভৃতি বহু বিষয়ে প্রায় নব্বই খানি পুস্তকের রচয়িতা তিনি।

রচনাসম্ভার
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল —

শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী (৩ খণ্ড)
লণ্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ (৩ খণ্ড)
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের অনুধ্যান
গিরিশচন্দ্রের মন ও শিল্প
পশুজাতির মনোবৃত্তি
পাশুপত অস্ত্রলাভ (কাব্য)
শিল্প প্রসঙ্গ
নৃত্যকলা
প্রাচীন জাতির দেবতা ও বাহনবাদ
ডিসারটেশন অন পেন্টিং
প্রিন্সিপল্স অব আর্কিটেকচার
মাইন্ড
রাইটস্ অফ ম্যানকাইন্ড প্রভৃতি।

  মহেন্দ্রনাথের বিভিন্ন বিষয়ের উপর যেমন ছিল প্রশংসনীয় দখল, তেমনই তার ছিল সর্বধর্মের প্রতি এক গভীর উদারতা। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। তিনি সব কিছুকে এক আধ্যাত্মিক চিন্তায় রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রায়ই তিনি তার অনুরাগীদের বলতেন-

“ভিন্নবোধ বলতে কিছু নেই। এক শক্তি থেকেই ভিন্ন রকমের অভিন্ন যুক্তিবোধের সৃষ্টি হয়।”

মহেন্দ্রনাথ গৈরিক বস্ত্র ধারণ না করলেও সন্ন্যাসজীবন যাপন করতেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের মহাষ্টমীর দিনে তিনি সমাধিস্থ হলেন। অবশেষে বিজয়া দশমীর দিন ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই অক্টোবর (১৩৬৩ বঙ্গাব্দের ২৮ আশ্বিন, রবিবার, পুণ্য বিজয়া দশমী । তিনি পার্থিব শরীর পরিত্যাগ করেন। 

পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তের ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে ওকালতির খবররাখবর আমরা যতটুকু পাই, তা মহেন্দ্রনাথের জন্যই। আইনবিদ বিশ্বনাথ দত্তের কোনও চিত্র বা আলোকচিত্র আজও উদ্ধার হয়নি। কিন্তু মহেন্দ্রনাথ আমাদের জানিয়েছেন, সে বার লাহৌরে বিশেষ বরফ পড়ায় বিশ্বনাথ কানে কালা হয়ে যান। পসার ছেড়ে তিনি প্রথমে রাজপুতানা, পরে ইনদওর ও শেষে মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে চলে যান। রান্নাবান্না এবং খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে নরেন্দ্রনাথের বিশেষ আগ্রহ যে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া, তা মহেন্দ্রনাথই আমাদের জানিয়েছেন। পোলাও ও মাংস রান্নায় তাঁর পিতৃদেব ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সেই দক্ষতা যে বিবেকানন্দ সন্ন্যাসজীবনেও ত্যাগ করেননি। আরও একটি মজার খবর— নরেন্দ্রনাথ অল্প বয়সে কিছুতেই ইংরেজি পড়তে চাইতেন না। শেষ পর্যন্ত জননী ভুবনেশ্বরীই নরেনকে বাংলা এবং ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব নেন।

দাদা সম্বন্ধে মহেন্দ্রনাথ যা লিখছেন তার আকার তেমন দীর্ঘ নয়, কিন্তু তথ্যের উৎস হিসেবে এগুলিকে সোনার খনি বলাটা অত্যুক্তি হবে না। এ ছাড়াও অনেক খবর ছড়িয়েছিটিয়ে আছে নানা জনের সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের শেষ বয়সের সংলাপে। যেমন তাঁর ছোটবেলার খাদ্যবিলাস। স্কুল থেকে ফিরে দু’ভাই পাঁঠার মুড়ি দিয়ে কড়াইশুঁটির তরকারি প্রাণভরে খেতেন। এঁরা যে মিতাহারী ছিলেন, এমন ভাবার সুযোগ নেই! তাঁর বইতে আরও খবর আছে, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন তৈরির অনেক আগে নরেন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ‘গ্রিভি ক্লাব’ সংগঠন করেছিলেন এবং ভুনি খিচুড়ি তৈরিতে সবিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। আর একটি খবর আমার খুব ভাল লেগেছিল—বেদ বেদান্ত উপনিষদ বোঝার অনেক আগেই তিনি ফরাসি রান্নার দামি বই কিস্তিতে কিনেছিলেন। নিলামে কিনেছিলেন চায়ের কেটলি। চায়ের নেশা এতই প্রবল ছিল যে, ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের রাত্রে কাশীপুরে বাড়ির দরজায় আগুন ধরিয়ে, তাতেই সবাই মিলে চা পান করেছিলেন।

১৮৯৮ থেকে টানা পাঁচ বছর নিঃসম্বল অবস্থায় পর্যটন, মহেন্দ্রনাথের জীবনে এক চাঞ্চল্যকর অধ্যায়। এর সম্বন্ধে সামান্য কিছু লেখা হলেও তা যথেষ্ট নয়। ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ায় মহেন্দ্রনাথের দুঃসাহসিক ভ্রমণ সম্বন্ধে যৎসামান্য যা লিপিবদ্ধ হয়েছে। তা যথেষ্ট নয়।

পরবর্তী কালে তাঁর ভক্তদের এক জন যে সংক্ষিপ্তসার দিয়েছেন তা নির্ভরযোগ্য মনে হয়। বর্ণনাটি মোটামুটি এই রকম:

‘ইংলণ্ড ত্যাগ করিয়া জাহাজে ফরাসি দেশ। সেখান হইতে জাহাজে জিব্রাল্টার পার হইয়া হাঁটাপথে মরাক্কা মাল্টাদ্বীপ, আলেকজান্দ্রিয়া, কায়রো।... কায়রো হইতে জেরুসালেম... আড়াই মাস অবস্থান করেন দামাস্কাসে। ত্রিপোলীতে দু’এক মাস, কনস্টানটিনোপল, সোফিয়া, বুলগেরিয়া, বানকাল পাহাড় অতিক্রম ও নানা পথ ভ্রমণ করিয়া পুনরায় কনস্টানটিনোপলে।... সে স্থান হইতে আরমেনিয়া, সেখান হইতে ককেশাস পাহাড় পার হইয়া বাকু শহরে অবস্থান। সেখান হইতে কাসপিয়ান সাগর পার... তেহরান-খোরসান-ইসপাহান-মেসোপটেমিয়া-বাগদাদ, বসরা-করাচি-কাশ্মীর।’

দাদার আকস্মিক দেহত্যাগের কয়েক দিন পর মহেন্দ্রনাথের কলকাতায় ফেরা।

সুদীর্ঘ জীবনে মহেন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন অনুধ্যান ছাড়াও অসংখ্য ভক্তজনের কাছে যে সব কথা বলেছেন, তার বেশ কিছু আমাদের হাতে রয়েছে। এই সব সংলাপ বিশ্লেষণ করে, তার থেকে মণিমুক্তো সংগ্রহ করা আজও হয়নি। তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধেও আমরা সমস্ত খবরাখবর সাজিয়ে নিতে পারিনি। কিছু কিছু খবর অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে, যেমন ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তনকালে (১৯০২) মহেন্দ্রনাথ কিছুকাল করাচিতে সাংবাদিকতা করেছিলেন। কলকাতায় ফিরে মহেন্দ্র কখনও উপার্জনের তেমন চেষ্টা করেননি। বই থেকে উপার্জনের চেষ্টা সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব মতামত, ‘‘বই বেচার পয়সা থেকে এক পয়সার পান কিনে যদি আমায় খাওয়াও তা হলে আমি পতিত হব, আর তোমরা যদি খাও তা হলে তোমাদেরও বিশেষ অকল্যাণ হবে।’’














{======{{{{{{{======{{{{===}}}}====}









No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় । একজন বিশিষ্ট দরদী মনের মরমী যাত্রা পালাকার। তিনি যাত্রাপালার প্রযোজক-নির্দেশক, গীতিকার ও সুরকারও ছিলেন।

ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়  ( ২৫ নভেম্বর,  ১৯৩৪ -  ২৮ ডিসেম্বর,  ১৯৯৮) বাংলা ও বাঙালির কালচারের সঙ্গে যাত্রা শিল্প রক্তের সঙ্গে মিশে রয়েছে। এখন সেই ...