ক) প্যারীচাঁদ মিত্র
(২২.৭.১৮১৪ -২৩.১১.১৮৮৩)
" 'আলালের ঘরের দুলাল' নামক ব্যঙ্গ আখ্যান তাঁকে সমকালে ও পরবর্তী যুগে বিখ্যাত করেছে ।এই গ্রন্থকে প্রথম উপন্যাস বলা হলেও এটি আসলে বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক সামাজিক নকশা।" অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে
নাগরিক জীবনের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অধঃপতিত বাস্তব সমাজের চিত্র সৃষ্টি করে শুধু নয়, 'আলালী" ভাষা ব্যবহার করে যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি গদ্যকার প্যারীচাঁদ মিত্র।ব্যক্তিজীবন :
১৮১৪ সালের ২২ শে জুলাই , কলকাতার নিমতলার বিখ্যাত মিত্র পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মূলত বণিক পরিবার। পিতা রামনারায়ন মিত্র কাগজ ও হন্ডি ব্যবসায়ী । তিন পুরুষের এই ব্যবসায় প্রতিপত্তি ও অর্থলাভ যথেষ্ট ছিল। শৈশবে গুরু মহাশয়ের নিকট বাংলা শিক্ষা এবং মুন্সির নিকট ফারসি শিক্ষা লাভ । প্যারীচাঁদ প্রথাগত পড়াশোনায় ভর্তি হন একাদশ শ্রেণিতে হিন্দু কলেজে ১৮২৭ সালে ৭ই জুলাই। তিনি ওই কলেজে পেয়ে যান, প্রখ্যাত নব্য ইংরেজি সাহিত্যের তরুণ অধ্যাপক ডিরোজিও কে। অনুপ্রাণিত হন। মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলেন কিন্তু কখনো তিনি অনুকরণ করেননি। সঙ্গে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন রামতনু লাহিড়ী ,কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় , রাধানাথ শিকদার প্রমুখ ছাত্রদের। যারা পরবর্তীতে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। কলেজে পড়াকালীন প্রত্যক্ষ ডিরোজিওর ছাত্ররা উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণ শুরু করেন, যারা পরবর্তীতে "ইয়ং বেঙ্গল" নামে পরিচিত হন । অনেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৮৩৬ সালে প্যারীচাঁদ হিন্দু কলেজ থেকে কৃতি ছাত্র রূপে শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর কর্মসূত্রে তিনি ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি সাব লাইব্রেরিয়ান পদে যোগদান করেন, পরে লাইব্রেরিয়ান হন কিন্তু ছোটবেলা থেকে পরিবারের উত্তরাধিকার সূত্রে স্বাধীন ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন মনে যার ছিল তিনি সাগ্রহে লাইব্রেরিয়ান পদ ত্যাগ করে কালাচাঁদ শেঠ এন্ড কোম্পানিতে আমদানি-রপ্তানি কাজ করেন পরে দুই ছেলেকে নিয়ে প্যারীচাঁদ মিত্র এন্ড সন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্যবসার কাজে মনোনিবেশ করেন। এছাড়াও তিনি বহু প্রতিষ্ঠান সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যেমন- গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কোং লিঃ, পোর্ট ক্যানিং ইনভেস্টমেন্ট কং, হাওড়া ডকিং লিমিটেড , বেঙ্গলি টি কোম্পানি প্রভৃতি। তিনি একদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর ছিলেন। বেথুন সোসাইটি এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। নানান কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জীবন ঘাত প্রতিঘাতে এগিয়ে চলোও সময়ের নিষ্ঠুরতায় ২৩ শে নভেম্বর ১৮৮৩ সালে জীবন দীপ নিভে যায়।
রচনা সমূহ :
আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮), মদ খাওয়া বড় দায়, জাত যাবার কি উপায় (১৮৫৯), রামারঞ্জিকা (১৮৬০), কৃষিপাঠ (১৮৬১), যৎকিঞ্চিৎ (১৮৬৫), অভেদী (১৮৭১), আধ্যাত্মিকা (১৮৮০), বামাতোষিণী , ডেভিড হেয়ার জীবনচরিত (১৮৭৮), গীতাঙ্কুর (১৮৬১) প্রভৃতি।
সম্পাদনা :
মাসিক পত্রিকা (১৬ আগস্ট, ১৮৫৪) সহযোগী সম্পাদক ছিলেন রাধানাথ শিকদার।
ছদ্মনাম - টেক চাঁদ ঠাকুর।"আলালের ঘরের দুলাল" মূলত ব্রাহ্মসমাজের আদর্শবাদকে আলোকিত করে. বৈদ্যবাটি জমিদার রামরাম বাবুর পুত্র মতিলাল জমিদারের অতিরিক্ত আদরে এবং কুসঙ্গে মিশে অধঃপতিত হওয়া এবং পরে দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে স্বভাবের পরিবর্তন আখ্যানটির মূল উপজীব্য। নীতিকথা প্রচারক হিসেবে বরদাবাবু , রামলাল, বেনীবাবু প্রতীকী চরিত্রগুলি যেমন এসেছে তেমনি নীতিধর্মী চরিত্র হিসেবে ঠকচাচা , রামরাম বাবু, মতিলাল এবং তার সঙ্গীরা অনেক বেশি সার্থক চরিত্র হয়ে উঠেছে। গ্রন্থটি অশ্লীলতাবিহীন আধুনিক মনের পরিচয়। এর মর্মগত সুশিক্ষার বাণী ও লোকায়ত ভাষা সংযত প্রয়োগ গ্রন্থটি কে স্মরণীয় করে রেখেছে। তাাঁর রামারঞ্জিকা , অভেদী কিংবা আধ্যাত্মিকতার সাহিত্যগুণ ততটা নয় যতটা নীতি শিক্ষাই মুখ্য। অভেদী উপন্যাসের নায়ক অন্বেষণ চন্দ্র সত্যান্বেষী কিন্তু সংসারী নন ।সমকালীন ব্রাহ্মসমাাজের অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র পরিলক্ষিত। যৎকিঞ্চিৎ গ্রন্থে ঈশ্বরের অস্তিত্ব, ঈশ্বর কি রূপ, তাহার সহিত কি সম্বন্ধ , আত্মার রাজ্যের নিয়ম প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে . "বামাতোষিণী 'মূলত স্ত্রী শিক্ষা মূলক গ্রন্থ কুড়িটি পরিচ্ছেদের মধ্য প্রথম ১৬ টি হরিহর ও তার স্ত্রী পদ্মাবতী গৃৃহকথা আলোচিত শেষ ৪টি পরিচ্ছেদে জাপান দেশের স্ত্রীলোকসহ স্ত্রীদের নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিত্র রচনার মধ্য দিয়ে লেখক প্রার্থনা করেছেন। " জগদীশ্বর আমাদিগকে কৃপা করুন যে , হেয়ার সাহেবের যেরূপ শুদ্ধ প্রেম ছিল সেই রূপ শুদ্ধ প্রেমে আমরা যেন পরিপূর্ণ থাকি আর তাঁর গীতাঙ্কুর - ৩৪টি ব্রহ্মসংগীতের সংকলন গ্রন্থ।
যুগ্ম্ম-সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা সমকালীন সমাজ দর্পণের প্রতিফলন।
গদ্যরীতি :
প্যারীচাঁদের গদ্যক আলালী গদ্য বলা হয়। এই গদ্যের বৈশিষ্ট্য - বাক্যরীতি কথ্যভঙ্গি, কলকাতার নিকটবর্তী আঞ্চলিক ভাষা ও আরবি-ফারসি শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগ, দেশি-বিদেশি তৎসম শব্দের অবাধ ব্যবহার, ক্রিয়া বিভক্তি কারক ও অব্যয় এর নতুন রূপ আবিষ্কার, সময় সন্ধিযুক্ত দীর্ঘ জটিল বাক্য পরিহার এবং প্রবাদ প্রবচনের প্রয়োগ, আসলে এটি একটিি সংকর ভাষা। এই ভাষার গুনে তিনি সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন " যে ভাষায় সকলে কথোপকথন করে তিনি সেই ভাষায় আলালের ঘরের দুলাল প্রণয়ন করিলেন। সেইদিন হইতেই বাঙালা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি, সেই দিন হইতে শুষ্ক তরুর মূলে জীবন বারি নিষিক্ত হইল।"
প্যারীচাঁদ ও বিদ্যাসাগর :
উভয়ই বাংলা গদ্য প্রতিষ্ঠাতার প্রাণপুরুষ কিন্তু উভয়ের গদ্যরীতি বিপরীতধর্মী। বিদ্যাসাগরের গদ্য পন্ডিতী গদ্য আর প্যারীচাঁদের গদ্য আলালী গদ্য নামে পরিচিত। প্যারীচাঁদ বিদ্যাসাগরের গদ্য উপলব্ধি করেছিলেন - বড় বেশি সংস্কৃতি ঘেঁষা ও ক্লাসিক বর্মে চর্মে আবৃত। এই ভাষার মধ্যে সহজ সরল ঘরোয়া রূপ আনতে হবে , ভাষাকে ভারবহনক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিদিনের ব্যবহারিক ভাষার রূপ দিতে হবে।
ভাষার দৃষ্টান্ত :
' ঠকচাচা চৌকির ওপর থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়িয়া বলিলেন - মোর উপর এত না টিটকারী দিয়া বাত হচ্ছে কেন ? মুই তো এ সাদি করতে বলি - একটা নামজাদা লোকের বেটি না আসলে আদমির কাছে বহু শরমের বাত ...." ।
….......................................................
...........................................................
খ) ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়।
(২২.৭. ১৮৪৭ - ০৩.১১.১৯১৯) উদ্ভট ও মজার গল্প রচয়িতা ত্রৈলোক্যনাাথ মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে যথার্থথ অবদান রেখেছে, শিশুসুলভ কৌতুহল ও কৌতুক রস পরিবেশনার মধ্য দিয়ে়় মুখ্যত তাঁর" ডমরু-চরিত " এর গল্পগুলি আজগুবি ঘটনা হলেও বিশ্বাসযোগ্যতায় অদ্ভুত।
রচনা কর্ম :
উপন্যাস -
কঙ্কাবতী (১২৯৯), সেকালের কথা (১৩০১), ফোকলা দিগম্বর ( ১৩০৭), ময়না কোথায় (১৩১১) , পাপের পরিনাম (১৩১১) ।
উপন্যাসের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ও প্রভাত কুমার যখন প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, ঠিক সেই সময়ে - ত্রৈলোক্যনাথ সম্পূর্ণ এক অন্য জগৎ উপন্যাসে বেছে নিলেন- ভুত-প্রেত রাক্ষস -খোক্ষস, শাঁখিনী ডাকিনী যোগিনী তাঁর অন্যতম চরিত্র হয়ে , অদ্ভুত রস সঞ্চারিত করলো , বাংলা সাহিত্য পাঠকদের মনে।
গল্প সংকলন -
ভূত ও মানুষ (১৮৯৭), মুক্তামালা (১৯০১), মজার গল্প ( ১৯০৪), ডমরু চরিত (১৯২৩). মোট ৩০ টি গল্পে গল্পকার আমাদের দেশে প্রচলিত গল্প গাথা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে হাস্যরসাত্মক গল্প উপহার দিয়েছেন। ভূদেব চৌধুরী যথার্থ বলেছেন - " আজগুবি গল্পের আধারে ত্রৈলোক্যনাথ অনায়াসে পরিবেশন করেছেন, নিভৃত গোপন জীবন- রস।"
নির্মল হাস্যরসের পরিবেশ রচনা করে তিনি যে অবদান রেখেছেন শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসময় আনন্দ লোকে । এই প্রসঙ্গে ড.অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় যথার্থ বলেছেন -" ত্রৈলোক্যনাথের তেমন কোন তত্ত্বদৃষ্টি ছিল না, অদ্ভুত উদ্ভট অবিশ্বাস্য শিশুসুলভ কৌতুহল ও কৌতুক অবলম্বন করে গল্প জমাবার তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল।" তাঁর জন্ম দিনে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।
বাংলা সাহিত্যে উভয়ের অবদান স্বীকার করি।
বিনীতা জানা। ২২.৭.২০২০
1 comment:
অনুগ্রহ করে আপনারা জানাবেন আপনাদের মতামত। কেমন লাগছে এই পত্রিকা। পরামর্শ দেবেন।
Post a Comment