দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
" আত্মার সুঘ্রাণ "
গ্রন্থালোচনা
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
Doinik Sabder Methopath
Vol - 80. Dt - 26.7.2020
++++++++++++++++++++++++++++++++++
" ভোগবাদের ছোবলে গত সাত - আট দশকে গ্রাম জীবনের, সমাজ জীবনের বহু কিছু হারিয়ে গেছে। আমাদের বাল্য কৈশোর যৌবনের নানা ঘটনা এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়।" ( ভূমিকাংশ, আত্মার সুঘ্রাণ) । পৃথিবীর আদি ও প্রাচীন গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতাকে আজ ধীরে ধীরে গ্রাসে করে চলেছে অতি সুখ, অতি আরামপ্রিয় নগর সভ্যতা। সময়ের অভিঘাতে তাই হারিয়ে যাচ্ছে নানান গ্রামীণ সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপাদান । যাকে ঘিরে গ্রাম জীবনে নির্মল আনন্দ ও সুখ অনুভবের পরিমণ্ডল গড়ে উঠতো। গ্রামীণ সহজ-সরল জীবন কেন্দ্রিক নানান উপাচার - উপকরণ আজ আর দেখতে পাওয়া যায় না। বিলুপ্তির পথে । আগামী প্রজন্ম সেইসব উপাদানের স্মৃতিটুকু পাবে হয়তো , ঘ্রাণ কখনো পাবে না। এই সরল বিশ্বাস নিয়ে ড. প্রবালকান্তি হাজরা মহোদয় লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র না হয়েও শুধুমাত্র হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্যের সন্ধানে আগ্রহী হয়ে - বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ " গ্রামীণ সংস্কৃতির ঝাঁপি।"
১কে রমানাথ মল্লিক লেন
কলকাতা - ১২.
প্রকাশকাল - ২৫ শে বৈশাখ ১৪১৬.
ISBN : 81- 86966-46-3. মূল্য - ১৫০.
পৃষ্ঠা- ১৯২. বোর্ড বাইন্ডিং রঙিন কভারসহ।
উৎসর্গ -
"আমার মা স্বর্গত কমলা হাজরা
ও
বাবা স্বর্গত প্রফুল্ল কুমার হাজরা 'কে
বিষয় বিন্যাসে অতীব বৈচিত্র্য লক্ষনীয়। কৃষিভিত্তিক এই ভারতবর্ষে অন্যতম প্রধান ফসল ধান। ধান থেকে চাল করার অন্যতম যন্ত্র ঢেঁকি । কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। দুপুরে খাওয়ার পর বাড়ির মেয়েরা
ধান থেকে চাল বানাত আর মুখে ছড়া গাইত -
" তাল নাই গলা নাই বহু ধান খায়
লেজের মধ্যে পাড়া দিলে আশমানেতে ধায়। "
ধান ভানার ঢেঁকি আজ আর নেই। এই ঢেঁকি নিয়ে অনেক আঞ্চলিক গান রচিত হয়েছে। যা লোকসংস্কৃতির সম্পদ। সংরক্ষণের অভাবে সেই গানগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে পালকির কথা। তৎকালীন যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছিল পালকি। জোয়ান বেহারা পালকি নিয়ে দুলে দুলে চলত আর গান গাইতো। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পালকির গান কবিতায় বলেছেন -
" পালকি চলে পালকি চলে
গগন তলে আগুন জ্বলে
স্তব্ধ গাঁয়ে আদুল গায়ে
যাচ্ছে কারা রৌদ সারা।"
এই গান আজ আর শোনা যায় না। পালকি ও আর দেখা যায় না। এমনিভাবে তিনি আলোচনা করেছেন গরুর গাড়ি , হুঁকো কলকে, পানের বাটা, লাঙল, কালির দোয়াত, বাংলার তাঁত, লাঠি, সাঁকো, গ্রামীণ হাট, গ্রামীণ ফেরিওয়ালা ও তার গান, প্রচলিত ধর্মাচার লোকাচার ও সংস্কার, গ্রামীন পালা, ধান কেন্দ্রিক উৎসব লোকাচার ও সংস্কার, কাক নিয়ে নানান সংস্কার , লোকজ উৎসব রন্ধন অরন্ধন, এমনকি লোকশিক্ষায় গ্রামীণ শেয়ালের ভূমিকা এবং আত্ম উন্মোচনের হারানো ঐতিহ্য - - চিঠি লেখার প্রসঙ্গ। গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতি, এইসব বিষয়গুলি নতুন করে জানার অন্যতম উপায় হিসেবে গ্রন্থটিকে আদরণীয় করে তুলবে আমার বিশ্বাস।
দ্বিতীয় আলোচিত গ্রন্থ -
প্রকাশক : প্রভা প্রকাশনী
১ কে রমানাথ মল্লিক লেন
কলকাতা - ১২
প্রকাশকাল - জন্মাষ্টমী, ১৪১৬.
রঙিন কভারসহ বোর্ড বাইন্ডিং।
পৃষ্ঠা - ২০৮. মূল্য - ১৫০/- টাকা
উৎসর্গ -
"আমার তিন কন্যা
রিঙ্কু, পুপু, কাঁকন" কে.
বিষয় বিন্যাসে লেখক গ্রামীণ সাহিত্য - সংস্কৃতির নানান দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মূলত হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ বিশ্বাস ও সংস্কারের দিকগুলো । যেমন প্রকৃতিকে নির্মল করতে গাছ লাগানো প্রয়োজন। সবুজ পৃথিবী উপহার। এই বিষয়ে অন্যতম উৎসব গাছের বিবাহ। সেই প্রসঙ্গে তিনি গুণমুগ্ধ আলোচনা করেছেন। শরীরকে ঠান্ডা রাখতে অবশ্যই খাদ্য সামগ্রীর দৈনন্দিন যে প্রয়োজন সেই প্রয়োজনের অন্যতম খাদ্য কাঁজি পানি। গ্রামীণ কৃষি শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে ধান রাখার মড়াই, বাড়ির সামনে মাটির তুলসী মঞ্চ আজ আর দেখা যায় না, মাটির গড়া লক্ষীর ভান্ডারে আর পয়সা জমে না , গ্রামীণ ক্রীড়ায় আর অংশ নেয় না পাড়ার ছেলে মেয়েরা, তালপাতার বাঁশি, ঘুড়ি ওড়ানো, মাটির পুতুল বানানো, বনভোজন, বাড়ির উঠোনে পূজো পার্বণ , কাগজের নৌকো, সূচি শিল্প , মেলা, পড়ুয়া পূজা, কার্তিক পুজো , কাকতাড়ুয়া, নবান্ন উৎসব, কলুর ঘানি, পাদুকা খড়ম , পিঠেপুলির উপাদান - কতকিছু এখন আর সেভাবে দেখা যায় না বা গ্রামের মানুষেরা পালন করেন না। পাড়ার চায়ের দোকানে আনন্দ মজলিস জমে ওঠে না, প্রচণ্ড গরমেও তালপাতার পাখা জোটে না, শীতল পাটি কে আর বানাবে? নেই বাড়িতে বাড়িতে লবণ তৈরি সরঞ্জাম, সন্ধ্যাবেলায় তুলসী তলায় মাটির প্রদীপ হারিয়ে গেছে। মাঠে মাঠে রাখালেরা গরু চরায় না, বাঁশি বাজায় না , উৎসব অনুষ্ঠানে ম্যাজিক শো নেই। রথের দিনে রথ মিষ্টি , চুরি-ডাকাতি হলে বা কোন কিছু হারিয়ে গেলে মুদা দেওয়া কুসংস্কার মনে হয় - এমনই নানান অনুষঙ্গ নিয়ে গ্রন্থটি লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির বিষয় গুরুত্বকে আলোক দান করেছে। আমার বিশ্বাস গ্রন্থটি পাঠকসমাজে গুরুত্ব ও আদরণীয় হয়ে উঠবে।
১ কে রমানাথ মল্লিক লেন
কলকাতা -১২।
প্রকাশকাল - ডিসেম্বর, ২০১৬ সাল।
প্রচ্ছদ শিল্পী - রামকুমার মান্না।
পৃষ্ঠা -১৯৯. মূল্য -২০০/-
রঙিন কভার সহ বোর্ড বাইন্ডিং।
ISBN : 978-93-83659-20-3.
উৎসর্গ -
" আমাদের অতি আদরের নাতি-নাতনি
মুনু, তিনি, রিমি, ঋজু ,শুভ, রুপসা
ও
তাতাই " কে
জর্জ স্যান্ড বলেছিলেন " স্মৃতি আত্মার সুঘ্রাণ " । কথায় আছে "স্মৃতি সতত সুখের"। সব স্মৃতি যে সুখের হয় জীবনে এমন নয় দুঃখের স্মৃতি ও আজীবন বহন করে নিয়ে চলতে হয়। ভুলবো বললেও ভোলা যায় না। তবে সুখের স্মৃতি যেমন জীবনকে সুখ ও আনন্দ এনে দেয় তেমনি দুঃখের স্মৃতি ও জীবনকে সঠিক পথ দেখায়। লেখক আলোচনার মধ্যে জীবনের সুখ- স্মৃতি গুলোকে আলোকিত করেছেন । জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত । দীর্ঘ যাপন চিত্রে আঁকা ধারাপাতের ছবিতে - জীবনে রঙ মিশিয়ে। এই সময়ে বাল্যশিক্ষা আদর্শ শিক্ষক ড. অজিত কুমার ঘোষ এর প্রসঙ্গ যেমন শ্রদ্ধার সঙ্গে এসেছে তেমনি প্রবাস জীবনে সঙ্গী শ্রদ্ধেয় ধ্রুব চরণ মন্ডল, তারাপদদা, জগন্নাথ মাইতি ,প্রভাত কুমার দাস, হরিপদ মাইতি, প্রদ্যুৎ কুমার মাইতি , নরোত্তম হালদার, রণজিৎ কুমার নায়েক প্রমূখ ব্যক্তিবর্গের সুখ স্মৃতি কথা। প্রতিদিনের জীবন থেকে উঠে এসেছে দ্বিতীয় পর্বে লেখা। লেখক - গঙ্গাসাগরের মেলা, গ্রামীণ শৈশবের কথা, বাড়িতে সাবেকি রান্নার গুরুত্ব, মাছ ধরার উপকরণ , যোগাযোগ ব্যবস্থা, গ্রামীণ মেয়েদের আড্ডা, কিষ্ট যাত্রা , বুড়ো শিবের মন্দিরে গাজন, জলপথে যাতাযাত কালে নানান লোকগানের প্রসঙ্গ - এক কথায় দীর্ঘ জীবন পথের পথিক এই মানুষটি- পথের দুপশে যা কিছু উপাদান দেখেছেন তা যেমন সংগ্রহ করেছেন , তেমনি তাকে নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন । তাই এই গ্রন্থ যেন তাঁর আত্মার আত্মজ । লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির গ্রামীণ নানান প্রসঙ্গ যেন তাঁর রচনায় ঘুরে ফিরে জায়গা করে নিয়েছে - হারিয়ে যাওয়া নানান অনুষঙ্গ নতুন মাত্রা নিয়ে আলোকিত হয়েছে। ব্যবহারিক জীবনবোধ, ভালো-মন্দ কে সঙ্গী করে। তাই মিশন আদর্শে যে মানুষটি বেড়ে উঠেছেন, নীতি ধর্ম , মানবধর্ম ও সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়ে সেই মানুষটি উপলব্ধ অভিজ্ঞতার অনুভূতি দিয়ে গড়ে তুললেন - তাঁর সমগ্র রচনা কর্ম। আগামী প্রজন্মের কাছে যা প্রেরণা । লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষকদের কাছে আকর গ্রন্থ।
++++++++++++++++++++++++++++++++++
ড. প্রবালকান্তি হাজরা ।
------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment