Sunday, 26 July 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥
অপরিণত ব্যক্তি বৈভবে কালিদাস
(সংস্কৃত সাহিত্য)
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆Doinik Sabder Methopath
Vol - 81.  Dt - 27.7.2020
¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥
*****************************************
" হে মোর চিত্ত ,পূণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে-
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে
হেথায় দাঁড়ায়ে দু'বাহু বাড়ায়ে 
নমি- নরদেবতারে 
উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্দন করি তাঁরে।।"
                        ( ভারততীর্থ ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

" ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম। আমরা রয়েছি সেই সূর্যের দেশে।" পূতপবিত্র ভারত পূর্ণ্যভূমিতে  যুগে যুগে মহান মানবাত্মার জন্ম হয়েছে। যারা  গৌরবের সঙ্গে আপন কীর্তিকে স্বাক্ষরিত করেছেন মহানুভবতার সঙ্গে। সাহিত্য-সংস্কৃতি ন্যায়-নীতি - কাব্য- দর্শন -ব্যাকরণ বিবিধ ধারায়। আর প্রত্যেক জাতির সভ্যতা প্রকাশ পেয়েছে সাহিত্যের ধারায়। যে জাতির সাহিত্য যত প্রাচীন,  তার সভ্যতা ততদিনের। য়ুরোপীয় জাতি যখন ওক বৃক্ষের বল্কল পরিধান করে পর্বতে কান্তারে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে , তখন ভারতবর্ষ , যে প্রাচীন সভ্যতার শীর্ষদেশে আরূহ হয়ে নিজ গৌরব  বিস্তার করে চলেছে ; একথা অবিসংবাদিত সত্য । আবার একথাও সত্য যে রাষ্ট্রে সুদীর্ঘকাল শান্তি প্রতিষ্ঠা না থাকলে সাহিত্য সৃষ্টি,  কবি-সাহিত্যিকদের আবির্ভাব কখনো সম্ভব নয় । প্রাচীন গুপ্ত বংশের রাজা বিক্রমাদিত্যের বিদ্বৎ পরিষদ নবরত্ন খচিত মনিমুক্তায় বিভূষিত, তার প্রমান।  সেই নবরত্নের অন্যতম রত্ন ভারত গৌরব মহাকবি কালিদাস।

ধ্রুপদী সাহিত্য,  সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব বাল্মীকি ও ব্যাসের পরে তিনি যে শ্রেষ্ঠ ভারতীয় কবি ও নাট্যকার , এ বিষয়ে প্রায় সকলেই নিঃসংশয়। যার আবির্ভাবের কাল বা সময় পর্ব এবং জন্মস্থান নিয়ে পন্ডিত মহলে বিতর্কর ঝড় এখনো রয়েছে । কিন্তু কিভাবে , কোনো মহাকবি - লোককবিতে রূপান্তরিত হয়ে ওঠেন !  কি অনন্য পারম্পর্য্য ! তাঁকে নিয়ে গড়ে ওঠে  শত সহস্র কিংবদন্তি কালিদাস অথবা       " কালিদাস মিথ"  তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখন  জেনে নিতে হবে ব্যক্তি কালিদাস , কেমন ছিলেন । আমরা প্রায় সকলেই জানি,  ভারত গৌরব কালিদাস বিদূষিণী রাজকন্যা কাছে প্রত্যাখ্যাত,  অপমানিত হওয়ার পর পরিণত ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। কারণ তিনি রাজকন্যাকে অন্তর থেকে  ভালোবেসে ছিলেন। অন্তঃকরণে সেই অপমান শুধু মর্মস্পর্শী নয় , হৃদয়বিদারক ও।
  আজকের আলোচনা ঠিক তার পূর্বের ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা। যা   তাঁর ব্যক্তিত্বের অপরিণত রূপ বলে মনে হয়। আলোচনার নামকরণ সেই দিক থেকে প্রদত্ত ।

জন্ম : 
কালিদাসের জন্মের সময়কাল সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে মতভেদ আছে। একদল বলছেন - আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক । কারণ তাঁর অন্যতম রচিত নাটক "মালবিকাগ্নিমিত্রম্ " এর নায়ক অগ্নিমিত্র ছিলেন পুষ্যমিত্র শৃঙ্গের পুত্র।
 শৃঙ্গবংশীয় রাজাবংশের রাজত্বকাল ছিল , খ্রিস্টপূর্ব - ১৮৪ - ১৪৯  অব্দ। রাজা অগ্নিমিত্রের সম্মানার্থে নাটকটি রচিত।আবার একদল বলেন- খ্রিষ্টীয় ৪র্থ শতক থেকে ৬ ষ্ঠ শতকের মধ্যে তাঁর জন্ম। কারণ তাঁর রচিত অন্যতম নাটক "বিক্রমোর্বশীয়" এর নায়ক বিক্রমাদিত্য, উজ্জয়িনীর গুপ্তবংশের রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তথা বিক্রমাদিত্য। ঐ রাজসভায় নবরত্নের মধ্যে কালিদাস অন্যতম ছিলেন।  সেই বংশের রাজত্বকাল -  খ্রিষ্টীয় ৩৭৬- ৪১৪ অব্দ । এইসব বিতর্কের মীমাংসায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য‌ই প্রণিধানযোগ্য - 
"হায়রে,  কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল , পণ্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ সাল।"
( সেকাল,  ক্ষণিকা)
নানান বর্ণিত তথ্যের ভিত্তিতে আনুমানিক  খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক থেকে  খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের কোনো এক সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ব্যক্তি পরিচয় :
পিতা সদাশিব মিশ্র। ভৃগুগোত্রসম্ভূত বংশজাত। প্রাচীন উজ্জয়িনীর নিকটবর্তী পৌণ্ড্রগ্রামে তাঁর  জন্ম ( এ নিয়ে ও মতভেদ আছে )। পিতা পণ্ডিত প্রবর সাত্মিক মানুষ ছিলেন। প্রত্যহ কূলদেবী  মা সরস্বতীর পূজাহ্নিক সেরে জল গ্রহণ করতেন।  এমন পণ্ডিতবংশের ছেলে স্বভাব চরিত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন।
বাল্যকাল :
" নাই তাই খাচ্ছো,থাকলে কোথা পেতে 
কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে। "
বহুল প্রচলিত এই একটি ছড়া,  প্রাচীনকাল থেকে লোক মুখে মুখে উচ্চারিত। কিন্তু কবি কালিদাস এমন করে পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন কেন ? এর উত্তর সকলের বোধগম্য নয় বা না থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা যদি তাঁর বাল্যকালের দিকে তাকাই , তাহলে দেখতে পাব জীবনের কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত তিনি পথে পথেই দিন কাটিয়েছেন। তাঁর আচার - ব্যবহারে  ও অত্যাচারে  ভদ্রাদ্র সকল লোকই অতিষ্ঠ ছিলেন। যেমন - গ্রামের কারোর গাছে অসময়ে আমের মুকুল নষ্ট করা,  ক্ষেতের পাকা শস্যাদিসহ ফসল গরুতে খাইয়ে দেওয়া, দুগ্ধবতী গাই গরুর দুধ বাছুরকে পান করিয়ে দেওয়া, পাকা পেঁপের গাছকে কেটে ফেলা প্রভৃতি নানাবিধ নষ্ট , ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে নিজেকে সারাদিন ব্যপ্ত রাখা  যেন তাঁর খুব আনন্দ এবং উৎসাহের বিষয় ছিল। এই সমস্ত কর্ম যে তিনি একা  সম্পাদন করতেন তা নয় , রীতিমত একটি দল ছিল সেই দলে তিনি নেতৃত্ব দিতেন। গ্রামবাসীরা অতিষ্ঠ হয়ে পিতার কাছে নালিশ করতেন পিতা কিছুতেই পুত্রক  এ বিষয় থেকে নিবৃত্ত করতে পারতেন না।
কালিদাস যথাসময়ে পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিল কিন্তু সেখানে কখনো তাকে দেখতে পাওয়া যায়নি যদি কোনদিন দেখা যেত সেদিন গুরুমহাশয় " তদ্দিনং দুর্দ্দিনং মন্যে " মনে করে ইস্ট দেবতকে স্মরণ করতেন
 কারণ সেদিন পাঠশালায় অপর ছাত্ররা পড়াতো করত না , অধিকন্তু অনেক ছাত্র প্রহৃত হতো, তার হাতে। গুরুমহাশয় ভয় তাকে বিশেষ কিছুু বলতেেন না কারণ কালিদাসের পিতা এই পাঠশালার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আবার যেদিন গুরুমহাশয় অতিষ্ঠ হয়ে তাকে প্রহার দিতেন সেই দিন এমন চিৎকার করতেন যে লোকে মনে করত বিশেষ কিছু  ঘটেছে। পুত্রের এই দুর্দান্ত আচরণে পিতা মনে মনে রাগ করলে ও 
মিষ্টি কথায় , পরে তিরস্কারে আরো পরে প্রহার করে লেখাপড়ায় মন সংযোগ করতে বাধ্য করতেন। কিন্তু শেষ চেষ্টা করেও কোনমতে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করাতে ব্যর্থ হতেন। একমাত্রর ভরসা হিসেবে - কূলদেবী মা সরস্বতী মায়ের কাছে আকূল প্রার্থনা করতেন। " মা! এ বংশ তোমার কৃপা আশ্রিত । এই বংশে - আমার কোন অপরাধে - এমন মূর্খ পুত্র জন্মগ্রহণ করিল ! কৃপা করো মা,  কৃপা করো। আমার মুখ রক্ষা করো। আমার পূর্বপুরুষের গৌরব অক্ষুন্ন রাখো। " ১৪ বছর বয়সে কালিদাস পিতৃহারা হলেন।  কিছুদিনের জন্য স্থির হলেন। ৮  বছর বয়সে যথাবিহিত নিয়ম মেনে তাঁর উপনয়ন কর্ম সম্পন্ন হয়েছে। ফলে গ্রামীণ সমস্ত যজমান ও জমিদার তাকে বললেন  " এতদিন যা যা করেছ,  তা শোভা পেয়েছে,  এখন কর্তা স্বর্গীয় হয়েছেন। তোমাকেই সংসার চালাতে হবে। গ্রামের সকলেই তোমার যজমান। এক বছর কালাশৌচ এর সময় তুমি ক্রিয়াকর্ম সব কণ্ঠস্থ করো,  তাহা হলে তোমার সংসার সচ্ছন্দে চলে যাবে  । " কিন্তু এসব কথাতে ও কোন কাজ হয়নি।
কালিদাস অতিশয় মাতৃভক্ত ছিলেন। মায়ের আদর যত্নে বড় হয়ে অনেক কথাই শুনতেন। আবার অবাধ্য‌ও হতেন। মায়ের কথায় কিছুটা সময় স্থির হলেও পরক্ষণে আবার আগের মতই নানান উপদ্রব শুরু করতেন। মায়ের কথার উত্তরে কালিদাস এটুকুই বলতেন - " আজ হইতে পাঠশালায় যাইয়া লেখাপড়াই করিব কিন্তু পথে বাহির হইয়া আর সে কথা মনে থাকিত না , পাঠশালাগামী সতীর্থকে ভুলাইয়া লইয়া ভাঙা শিবমন্দিরে বা নির্জন জলাশয় তীরে খেলায় মত্ত হইতাম ।" এদিকে সংসার আর চলে না। আয়ের উপায় নেই। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এর ঘরে সঞ্চয় বলে কিছু নেই। চেয়ে চিনতে দুবেলা শাকান্ন সংস্থান করতেন মা। ঘরে অন্ন নেই, চালে খড় নেই তাতে কালিদাসের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তিনি যেমন ছিলেন তেমনই। 
জীবনের একটি সময় এলো যখন কালিদাস অতিশয় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বিবাহের জন্য। কিন্তু এরূপ মূর্খ,  দুর্দান্ত গন্ডগোলে কাজকর্মহীন ছেলেকে কন্যা সম্প্রদান করবে কে ! মায়ের ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। মা দেখলেনেএই সুযোগ , বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে ছেলেকে সংসারমুখী করতে হবে। তাই বললেন " কালিদাস , তুইতো বিবাহের জন্য ব্যস্ত হয়েছিস, কিন্তু সংসারের অভাবের দিকে তো কোন রূপ দৃষ্টি নাই। তুই যদি সংসারের কাজে মনোনিবেশ করিস তাহলে আমি তোর বিবাহের চেষ্টা করিতে পারি।" কালিদাস মায়ের কথায় সাগ্রহে বললেন " তুমি যা বলিবে আমি তাই করিব।" মা বললেন - " তুই যদি কাঠ  আনিতে যাস, তাহা হইলে তোর বিবাহ নিশ্চিত।" কালিদাস মায়ের কথামতো কুঠার হাতে সেই প্রথম সংসারের কাজে কাঠ সংগ্রহ করতে নিকটবর্তী অরণ্যে গেলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক বড় গাছে শুকনো কাঠ দেখে কাটার জন্য গাছে উঠলেন ,যে ডাল কাটবেন সেই ডালের আগার বসেছেন।  এতোটাই মূর্খ তিনি। আসলে এই জাতীয় কাজ তিনি কখনো করেননি , অভিজ্ঞতাও জীবনে সঞ্চয় করেননি । বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে যা হয়। পরের ঘটনা স্বাভাবিক, আমাদের সকলের জানা। গৌড়ের দুর্দান্ত প্রতাপশালী রাজা মাণিকেশ্বর সিংহ। রাজার একমাত্র কন্যা বিদ্যানুরাগী। তাই তাঁর নাম বিদ্যাবতী কমলা। বাল্যকাল থেকে একমাত্র কন্যার ইচ্ছা অনুসারে তিনি সবকিছু সম্পন্ন করেছেন। কন্যাকে বিবাহ প্রস্তাবে রাজি করেছেন। বিদ্যাপতি কমলা পিতাকে শর্ত দিয়েছেন - " যে ব্যক্তি আমাকে বিচারে পরাজিত করিতে পারিবে আমি তাহাকেই বরমাল্য প্রদান করিব।শুধু মৌখিক বিচার কেন , যদি কেহ মৌণ বিচারে বা আকার ইঙ্গিত দ্বারা বিচার করিতে প্রবৃত্ত হন । তাহলে আমি তাহাতে প্রস্তুত আছি। " রাজ্যের অতিশয় পণ্ডিতেরা 
যখন রাজকন্যা বিদ্যাবতীর দ্বারা অপমানিত পরাজিত - তখন উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিরোধী দল গঠন করেন এবং মনে মনে সংকল্প করেন, কোন মহামূর্খের সঙ্গে রাজকন্যাকে বিবাহ দেবেন। পণ্ডিতেরা চারিদিকে সেই খোঁজ করছিলেন। বনে কালিদাসের সঙ্গে দেখা হয় - 
তাদের বিবেচনায় রাজকন্যার যথার্থ পাত্র হিসেবে, কালিদাসেই যোগ্য।  সেইমতো কালিদাস কে গাছ থেকে নামিয়ে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছে না তখন একজন প্রস্তাব দিলেন - রাঙা বউ দেব,  বিয়ে করবে? কালিদাসের ভাব বিপর্যয় ঘটলো সঙ্গে সঙ্গে সব কথায় রাজি হয় পণ্ডিতদের সঙ্গে বাসায় গেলেন। পণ্ডিতদের বিস্তর আলোচনা পর,  সিদ্ধান্ত হলো - কালিদাস মৌনভাবে রাজকন্যার সঙ্গে বিচারে যাবেন। রাজসভায় প্রবেশ মাত্র অপরাপর পণ্ডিতেরা দাঁড়িয়ে সম্মান জানাবেন। পূর্ব কল্পিত সমস্ত পরিকল্পনার রুপায়ন হলো। কালিদাস কে রাজসভায় পণ্ডিতবেশে নিয়ে যাওয়া হল। রাজা সহ পণ্ডিতেরা দাঁড়িয়ে সম্মান শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেন। রাজকন্যা তো অবাক। মনে মনে ভাবলেন  - বড় পন্ডিত মানুষ হবেন। আর কালিদাস প্রথম দর্শনে রাজকন্যাকে ভালোবেসে ফেললেন। ঘোষণা হল এই মহা পন্ডিত মৌন বিচারে প্রস্তুত আছেন। রাজকন্যা ও রাজি। কালিদাস উদ্ভিন্নযৌবনা নববসন্ত সমাগত প্রফুল্ল সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে দুই হাতের দুই তর্জনী উত্তোলন করে রাজকন্যার দুটি কর্ণভূষণকে নির্দেশিত করলেন। রাজকন্যা মনে করলেন ইনি দ্বৈতবাদ এর কথা বলছেন। তৎক্ষণাৎ তিনি একটি আঙ্গুল উদ্যত করে অদ্বৈতবাদ এর কথা বোঝালেন।  অমনি পন্ডিত মন্ডলী বিদ্রুপ করে উঠলেন । রাজকন্যা অপ্রতিভ হলেন। রাজকন্যার পরাজয়। শর্ত মেনে কালিদাসের সঙ্গে বিবাহ সম্পন্ন হল। পণ্ডিতেরা সাগ্রহে দেখতে চাইলেন,  উভয়ের প্রথম সাক্ষাৎ। বিবাহিত কালিদাসের ফুলশয্যা। রাজবাড়ী বিচিত্র পুষ্প সমাহারে সজ্জিত পুষ্পের সুরভি সৌরভে আমোদিত ফুলশয্যার 
কক্ষ। বিধাতার কি বিচিত্র লীলা ! একদিকে মহামূর্খ কালিদাস অপরদিকে রাজকন্যা দীর্ঘসময় মৌনব্রত। ধৈর্যের সীমা পরিসীমা উভয়ের যেন আর সয় না। রাজকন্যা ভাবছেন - উনি কথা বলছেন না কেন,!  উনার তো মৌনব্রত শেষ হয়েছে। কালিদাস ভাবছেন-  কথা বলতে গিয়ে যদি তাঁর সব কিছু ধরা পড়ে যায়। অবশেষে বিধাতা যেন উপায় করে দিলেন ! অদূরে একটি উষ্ট্র ডেকে ওঠায়,  রাজকন্যা ভয় পেলেন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কালিদাস কে জিজ্ঞাসা করলেন- ওটা কি ডাকিতেছে? কালিদাস  নীরব। পুনরায় রাজকন্যা বিস্মিত হয়ে বললেন। তবুও নীরব। অবশেষে নিরুপায় কালিদাস প্রথম কথা বললেন - উট্র। বিস্ময় ব্যাকুল চিত্তে রাজকন্যা আবার জিজ্ঞাসা করলেন । উত্তর এল - উষ্ট। রাজকন্যা সব বুঝতে পেরে নিজের প্রতি নিজের আক্রোশে নীরব হলেন।
" উষ্ট্রে লুম্পতি রং বা  জং বা 
তস্মৈ  দত্তা নিবিড়নিতম্বা !! "
পাশে থেকে বিদ্রুপ বিকট হাসি। পরক্ষণে সমস্ত নীরব। রাজকন্যা বুঝতে পারলেন হীন প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তিনি। কালিদাসের সবকিছু সত্য পরিচয় জেনে রাজকন্যা নিজেকে ক্ষমা করতে পারলেন না। উদ্ধত কণ্ঠে বললেন- " তুমি দূর হও ".
রাজকন্যা গভীর অনুতাপে কাঁদতে লাগলেন পাশাপাশি কালিদাস‌ও বিস্তর কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আর বললেন - আমি তোমায় বড় ভালোবাসি। আমি মূর্খ। তুমি আমাকে শিক্ষা দিয়া তোমার উপযুক্ত করিয়া লও। তুমি দয়া করো।" উত্তরে রাজকন্যা বললেন " তুমি যাও সরস্বতী দেবীর আরাধনা করো। যদি তাহার প্রসাদ লাভ করিতে পারো। তবেই ইহজন্মে তোমায় আমায় মিলন সম্ভব হইবে। নচেৎ নয়।" পিতা বলতেন - সরস্বতীর আরাধনা করো , একমাত্র ভালোবাসার পাত্রী রাজকন্যা ও বললেন - সরস্বতীর মায়ের আরাধনা করো। কালিদাসের মনে বিষয়টি গুরুত্ব পেল। মনে মনে ভাবলেন রাজকন্যার চোখের জল ,  রাজকন্যার জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া - এসবের জন্য তাঁর কৃতকর্ম দায়ী। তীব্র অপমানে অপমানিত কালিদাস বিস্মিত,  হতবাক হয়ে অপরিণত মনোভাব থেকে পরিণত মনোভাবের সূচনা বিন্দুতে এলেন। এভাবেই জীবনে কোন গভীরতর আঘাত‌ই পারে জীবনের মোড় পাল্টে দিতে, জীবনে সম্মান স্বীকৃতি এনে দিতে। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত -  মহাকবি কালিদাস। 
                ড. বিষ্ণু পদ জানা।

তথ্যঋণ - ১) সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস, 
                        ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।  
২) মহাকবি কালিদাসের ইতিহাস - সতীপতি ভট্টাচার্য, সম্পাদনায় - বারিদবরণ ঘোষ।৩) উইকিপিডিয়া।
################################

No comments: