Wednesday, 26 August 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

বিজ্ঞাপন  ∆∆∆∆  বিজ্ঞাপন  ∆∆∆∆ বিজ্ঞাপন 
                 বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ
          ( বিজ্ঞাপনে মডেল রবীন্দ্রনাথ)
###############################
              Doinik Sabder Methopath
            Vol -112. Dt - 27.8.2020
               ১০ ভাদ্র, ১৪২৭. বৃহস্পতিবার
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
 
           ভাবি নি সম্ভব হবে কোনদিন’

                     ঊনবিংশ শতাব্দীতেই নানা পণ্য ও সেবার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন কবিগুরু। নতুন বই থেকে শুরু করে কুকার, তেল, মিষ্টির বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে তাঁকে। এসব বিজ্ঞাপনে কখনো তাঁর স্বাক্ষরসহ আশীর্বাদ বাণী কখনো অটোগ্রাফ বা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। তখনকার সংবাদপত্রে তাঁর ছবি ও লেখাসহ বেরিয়েছে গোদরেজ সাবানের বিজ্ঞাপন। প্রায় ১০টির মতো প্রসাধনসহ কুন্তলীন চুলের তেল ও পারফিউমের বিজ্ঞাপনে মডেল ছিলেন।


 মিষ্টি খেয়ে তার গুণগান লিখে দিয়েছেন, সেই লেখাই বিজ্ঞাপন আকারে বেরিয়ে গেছে পত্রিকার পাতায়! শ্রীঘৃত, ক্যাডব্যারির বোর্নভিটা, কাজল কালি,



 সুগন্ধী ক্রিম, দার্জিলিং চা, লিপটন চা, ফিলিপস রেডিও, মার্টিন বান, রেল দপ্তর ছিল এ তালিকার বিজ্ঞাপন। আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথি ওষুধের বিজ্ঞাপনেও অংশ নিয়েছেন। বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রশস্তি লিখেছেন। সেটাই বিজ্ঞাপনে তুলে ধরেছে কম্পানি। রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞাপনের তালিকায় আরো ছিল সিনেমা, গ্রামোফোন রেকর্ড।




পণ্যসভ্যতার যে জাগরণ আমরা একবিংশ শতাব্দীতে দেখছি তার সূচনা হয়েছিল ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে। বাংলা সাহিত্যের এই সম্রাট অবদান রেখেছেন বিজ্ঞাপন নির্মাণেও। কখনও ব্যক্তিগত অনুরোধ, কখনও বা অর্থের জন্য হরেক রকম পণ্য এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য বিজ্ঞাপন লিখেছেন রবি ঠাকুর। কখনও বা অনুমতি দিয়েছেন বিজ্ঞাপনে তার নাম ব্যবহার করার। এসব বিজ্ঞাপনে কখনও বা রবীন্দ্রনাথের উক্তি ব্যবহৃত হয়েছে বিজ্ঞাপন হিসেবে।
*
সরকারি রেল কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা:

‘রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনদিন’

*
হিন্দুস্থান কো-অপারেটিভ ইন্সুরেন্স নামক কোম্পানির একটি বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ!
*
রবীন্দ্রনাথের লেখা সবচেয়ে রসোদ্দীপক বিজ্ঞাপন বোধহয় এটিই! এস সি রায় অ্যান্ড কোং কলকাতার ১৬৭/৩ কর্নওয়ালিশ রোডে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে তৈরি করত পাগলের ওষুধ। সেই ওষুধের বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয়ন পত্রের সন্ধান জুড়েছেন তারা! ডাক্তার উমেশচন্দ্র রায়ের জগদ্বিখ্যাত ‘পাগলের মহৌষধ’ শিরোনামের সেই বিজ্ঞাপনটি এমন-
'৭০ বৎসরের ঊর্ধ্বকাল যাবৎ লক্ষ লক্ষ দুর্দ্দান্ত পাগল ও সর্ব্বপ্রকার বায়ুগ্রস্ত রোগীর আরোগ্য করিয়াছে। মূর্চ্ছা, মৃগী, অনিদ্রা, হিষ্টিরিয়া, অক্ষুধা, স্নায়বিক দুর্ব্বলতা প্রভৃতি রোগেও ইহা আশুফলপ্রদ। প্রতি শিশি মূল্য ৫ টাকা।
বিবরণী-পুস্তিকা বিনামূল্যে পাঠাই ।
“আমি ইহার উপকারিতা বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছি”—রবীন্দ্রনাথ।
(রবীন্দ্রনাথ পাগলের ওষুধের উপকার সম্পর্কে বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছেন!)
অনেকে আবার নিজের প্রতিষ্ঠানে প্রত্যয়নপত্রে ঝুলিয়ে রাখতেন এমন কিছু পোস্টার। যেমন : নেপিয়ার পেন্ট (পেইন্ট!)
*
বন্ধুস্থানীয় হেমেন্দ্র মোহন বোসের পিড়াপীড়িতে কবি লিখেছিলেন সুলেখা কালির বিজ্ঞাপন--
‘সুলেখা কালি... এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’

*
ব্রিটিশরা তখন 'চা' নামক এক নতুন ধরণের পানীয় বাঙালিদের কাছে বেচার খুব চেষ্টা করছে। জায়গায় জায়গায় খোলা হয়েছে চায়ের দোকান, লাগানো হয়েছে চায়ের বিজ্ঞাপনী পোস্টার! রবীন্দ্রনাথের কাছে সেসময় ধরনা দিয়েছিল অন্যতম বিশ্বসেরা চা কোম্পানি লিপটন। ওদের জন্যও পদ্য ফেঁদেছিলেন নোবেল লরিয়েট। এইখানে দেখা মেলে কবিগুরুর ইংরেজিকে আত্মীকৃত করার সেই ট্রেডমার্ক টেকনিক। অফিসকে আপিস বলার মতো রবীন্দ্রনাথ এখানে কেটলিকে বলছেন কাতলি—
'চা-স্পৃহ চঞ্চল
চাতকদল চল
কাতলি-জল তল
কলকল হে…'




*
স্বদেশীদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত ‘গডরেজ’ সাবানের এই বিজ্ঞাপনটি প্রথম প্রকাশিত হয় ইংরেজি দৈনিক দ্য অ্যাডভান্স- এ। বিজ্ঞাপনের ভাষাটি ছিলো--
 Godrej’s is Toilet Soaps/ High Class Swadeshi Soaps/
“The best in the World’ Poet Rabindranath Tagore speaks ‘highly of our soaps’.
(সূত্র: দ্য অ্যাডভান্স, জানুয়ারি ৭, ১৯৩৭, পৃষ্ঠা: ১৩)
পরে বিজ্ঞাপনটি আনন্দবাজারেও প্রকাশিত হয়েছিলো। সেখানকার ভাষ্য--
"কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘গডরেজ সাবানের অপেক্ষা ভালো কোনো সাবান আমার জানা নাই। আমি ভবিষ্যতে শুধু এই সাবানই ব্যবহার করিব স্থির করিয়াছি।"
 

আজকের ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন "সুপার মডেল"। মডেল হিসাবে তাঁর যুগে রবীন্দ্রনাথের চাহিদা আজকের বিরাট কোহলি বা বিগ বি-দের থেকে কম ছিল না, জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশছোঁয়া।

আর একটা কথা, একদিক থেকে কবিগুরু অনেক যোজন এগিয়ে ছিলেন হালের সুপার মডেলদের থেকে। রবীন্দ্রনাথ যেসব পণ্যের বিজ্ঞাপন করেছেন, তাঁর বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট ছিল তাঁরই লেখা। এই দক্ষতা অন্য কোন মডেলের আছে বা ছিল, তা গবেষণার বিষয়।

রবীন্দ্রনাথ যে পণ্যের বিজ্ঞাপন করতেন তার কাটতিও নাকি বেড়ে যেত হু হু করে। এ কথাটা অবশ্যই তর্কযোগ্য। তবুও মেনে নিন, এ তথ্য সবটাই স্বরচিত নয়। এ সংক্রান্ত গবেষণায় জানা গিয়েছে, অন্তত ১৩৫ পণ্যের বিজ্ঞাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সবগুলিই পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের পাতায়।



পণ্যের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছেন কলকাতার মাসিক 'পুরশ্রী' পত্রিকার প্রাক্তণ সম্পাদক অরুণ কুমার রায়। তার তথ্য অনুযায়ী, ১৮৮৯  থেকে মৃত্যুর বছর পর্যন্ত অর্থাত্‍ ১৯৪১ পর্যন্ত ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ অংশ নিয়েছেন। ঘি থেকে ত্বকের ক্রিম, মিষ্টি থেকে হারমোনিয়াম- কোনোকিছুই বাদ ছিলোনা। তবে মডেলরা যেভাবে দেহভঙ্গি দিয়ে, মনমাতানো হাসির ঝিলিক দিয়ে মাত করার চেষ্টা করেন, রবি ঠাকুরের বিজ্ঞাপন নিশ্চয়ই তেমন ছিলোনা। বিজ্ঞাপনে থাকত তাঁর সেই বিখ্যাত গোঁফ-দাড়িওয়ালা পরিচিত ছবি আর ওই পণ্য সম্পর্কে কিছু কথা। তলায় থাকতো নিজের সই।
বিজ্ঞাপনের জন্য লিখে দেওয়া বাণীতে তিনি যে স্রেফ সেসব পণ্যের গুণকীর্তন করেছেন, তা কিন্তু নয়। ওইসব স্ক্রিপ্ট বা বাণীর মধ্যে ছিল রস, বুদ্ধিমত্তা, ছন্দ, শ্রুতিমধুরতা, দেশপ্রেম আর থাকত একটা দৃশ্য বা সমাজের কোনো একটি দিকের প্রতি ইঙ্গিত। স্বদেশি শিল্পাদ্যোগকে উত্‍সাহ দিতে এবং তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি দেশীয় পণ্যের জন্যও বিশেষ কিছু কথা লিখে গিয়েছেন। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি এসব 'বিশেষ কথা' বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করতেন।



তাই যে কোনও দিক থেকেই চলচ্চিত্র কিংবা খেলুড়ে তারকাদের বিজ্ঞাপনের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞাপনের ফারাক অনেকটাই। অসম্ভব জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য তিনি কোটি টাকা বা একশ বছর আগে তার সমপরিমাণ অর্থও নেননি। নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে দেশীয় পণ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি জাতীয়ভাবে তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
ওইসব বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্টে ব্যবহার করা শব্দ এবং ভাষায় রবীন্দ্রনাথের ভাষাশৈলীর ক্ষমতারই প্রকাশ পাওয়া যায়। তার বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল সংহত, সাজানো-গোছানো। সংক্ষেপে সারকথাটুকুই বলতে পারতেন খুব সহজে।

দেশীয় পণ্য হিসেবে রেডিয়াম ক্রিম এবং শ্রীঘৃতের জন্যও তিনি বিজ্ঞাপন করেছেন। এখন শ্রীঘৃত পাওয়া গেলেও রেডিয়াম ক্রিম আর পাওয়া যায় না।


শ্রীঘৃত সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, "বাংলায় ঘিয়ের ভেজাল বাঙালির অন্ত্রের ভেজালকেও অনিবার্য করে তুলেছে। আমি আশা করি শ্রীঘৃত বাঙালির এই ভেজাল রোগের প্রতিকার করবে"।


রেডিয়াম ক্রিম সম্পর্কে তিনি লেখেন, "রূপচর্চার জন্য স্নো ও ক্রিমজাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার করেন, তারা রেডিয়াম ফ্যাক্টরির তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।"


রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব, তিনিই প্রথম বাংলায় বিজ্ঞাপনের ভাষা তৈরি করেছিলেন। আর বিজ্ঞাপনের ভাষা কতটা সংক্ষিপ্ত আর অর্থবহ হতে হয় তিনিই তা শিখিয়েছিলেন বাঙালিদের। আজও সেই ধারা অব্যাহত আছে। আধুনিক বিজ্ঞাপনেও আমরা দেখি, যে বিজ্ঞাপনের যত অল্প সময় আর অল্প কথায় বেশি বোঝানোর ক্ষমতা আছে, সেই বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি পণ্যও হয়ে ওঠে জনপ্রিয়।
সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি, ভোলানাথ দত্ত এন্ড সন'স লিমিটেডের কাগজ এবং ডরকিনস হারমোনিয়াম কোম্পানির জন্যও বিজ্ঞাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।



সাহিত্যক্ষেত্রে অসাধারণ জনপ্রিয়তার কারণে তার সময়ে পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য তিনিই ছিলেন সবার প্রথম পছন্দ। সেই সময় পণ্যের বিজ্ঞাপনে তার নাম ব্যবহার করা মানে তা ছিল চরম অভিজাত একটি ঘটনা।

তবে এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ একাই নন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুও বিজ্ঞাপন জগতে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁরাও বেশকিছু বিজ্ঞাপন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি এই বিজ্ঞাপন সেই সময়ের বিখ্যাত ম্যাগাজিন এবং পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বারবার। প্রবাসী, বসুমতী, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল গেজেট, ভাণ্ডার, শনিবারের চিঠি, সাধনা, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, দ্য স্টেটসম্যান ও অ্যাডভান্সে প্রকাশিত।







  বিজ্ঞাপন ®®®® বিজ্ঞাপন ®®®® বিজ্ঞাপন

                                                    সংগৃহীত -

==============!!!!!!!!!==============






No comments: