১০০!!!১০০!!!১০০!!!১০০!!!১০০!!!১০০!!!১০০!!!
শত বর্ষের আলোকে
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
( ০২.৯.১৯২০ - ১১. ৭.১৯৮৫)
নিবেদিত সংকলন
" অফুরন্ত জীবনের মিছিল "
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆ ১০০ ∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
Doinik Sabder Methopath
Vol - 118. Dt - 02.09.2020
১৬ ভাদ্র, ১৪২৭. বুধবার
============!!!!! ১০০ !!!!!============
=================================
সম্পাদকীয় -
"ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধরে
একটি বীজ মাটিতে পুততাম।"
' দৈনিক শব্দের মেঠোপথ' পত্রিকা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদান রেখেছেন এমন মানুষদের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে আসছে, আজ ২রা সেপ্টেম্বর , ২০২০। শতবর্ষের আলোকে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ নিবেদিত সংকলন " অফুরন্ত জীবনের মিছিল" (ই ম্যাগাজিন) প্রকাশ করতে পেরে আমরা গর্বিত। রবীন্দ্র উত্তর চল্লিশের অন্যতম শক্তিমান কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রতিবাদী - বিপ্লবী সত্ত্বা ও আগুন হাতে প্রেমের কবি হয়ে, স্বদেশ, মানুষ ও মনুষ্যত্ব - নিয়ে গড়ে তুলেছেন আপন সৃষ্টিসম্ভার। মানুষের কান্নার প্রতি সজাগ এমন কবি, বিনিদ্র রাত জেগে জন্মভূমির বর্ণপরিচয় গড়েন। সারা জীবন যার পায়ের তলায় মাটি নেই, পেটে খিদা, সংসারের অভাব অনটন তবুও কর্তব্যকর্মে ,প্রতিবাদে , প্রতিরোধে জীবনকে শাণিত করেন, রক্তাক্ত হোন বারে বারে।সময় সচেতন ও ব্যক্তি মানুষের কবি সর্বদা বিবেকের ভূমিকায় সজাগ থেকে মাটি ও মানুষের অস্তিত্বকে কান পেতে শুনেছেন।
আজ কবির জন্মদিন। আমাদের প্রতিবাদে অনুপ্রাণিত করে। এ সময়ের কবি- লেখকরা কবির জীবন ও দর্শন নিয়ে যা ভাবছেন , সেই অভিমুখের আলো এই সংকলন । আশা করি সকলের ভালো লাগলে আমরা ধন্য হব।।
একবার মাটির দিকে তাকাও
একবার মানুষের দিকে।
ড. বিষ্ণুপদ জানা
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গবেষক।
০২.০৯.২০২০
******************( ১০০ )**************
আমার বাবা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
--মিত্রা চট্টোপাধ্যায়।
বাবার জন্ম ১৯২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর বেঁজগাও গ্রামে, তখনকার ভারতবর্ষের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। তিনি হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও সুরবালা দেবীর পুত্র। বাবা তাঁদের পঞ্চম সন্তান, দ্বিতীয় পুত্র। বাবারা ছিলেন নয় ভাই আর আট বোন। শচীন্দ্র, ধীরেন্দ্র, জীতেন্দ্র, দ্বিজেন্দ্র, বীরেন্দ্র (ডাকনাম তুরতুরি),সত্যেন্দ্র, রমেন্দ্র, রবীন্দ্র এবং রথীন্দ্র। বোনেরা হলেন মনতোষিনী, বিমলা, লাবণ্য, সুজলা, কমলা, সুফলা, রমলা এবং মৃদুলা। আজ কোলকাতায় বর্তমান আছেন তাঁর ছোটো দুই বোন রমলা গাঙ্গুলী ও মৃদুলা মুখার্জী, কানাডাতে এক ভাই রবীন চ্যাটার্জী এবং মৃদুলা মুখার্জীর স্বামী অমিয়াংশু মুখার্জী, রবিন চ্যাট্টার্জীর স্ত্রী উটা চ্যাট্টার্জী। আমাদের ঠাকুমা সুরবালাদেব্যা খুব কাছের মানুষ হাসিখুশি, দরদী- মনে হয় নব্বই বছরেরর কাছাকাছি সক্ষমভাবে বেঁচে ছিলেন । নিজের রান্না নিজেই করতেন আর ঠাকুর ঘরে ছিল তাঁর নারায়ণ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মা ষষ্ঠির পুজো। বাবা ঠাকুর দেবতা পুজো একেবারেই মানতেন না। তবে, কোনোদিন বাড়ির পুরোহিত না এলে আমাদের ছোটো কাকা রতনকাকা ( রথীন্দ্রনাথ) অথবা বাবাকে পুজো করে দিতে হয়েছে। মা পুজো না করে খাবেন না বলে। বাবা নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের ভক্তি ও বিশ্বাসকেও মর্যাদা দিতেন।
পুরানো ঢাকুরিয়ার ১৪ নম্বর স্টেশন রোড-এ মস্ত বড় এলাকা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল আমাদের ঠাকুরদা হরেন্দ্রনাথের তৈরি করানো বিশাল বাড়ি। তিন-তলা হলেও আসলে ঘরগুলো অনেক উঁচু উঁচু আর রাজস্থানের প্রাসাদের অনুকরণে বাড়িটার পূর্ব দিকে, প্রত্যেক তলায় বিভিন্ন মাপের ছাদ। ঠাকুরদা হরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঢাকায় ও কলকাতায় বানিয়েছিলেন মেয়েদের স্কুল। বাড়ির কাছাকাছি আমাদের পরিবারের প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের রামচন্দ্র স্কুল আর মেয়েদের বিনোদিনী গার্লস স্কুল। আমাদের ছোটবেলায় বাড়ির ছেলেরা রামচন্দ্র-য় আর ছোটো দুই পিসি আর আমরা অনেকেই বিনোদিনী স্কুলে পড়েছি।
বাবা আর মার বিয়ে হয় ১৯৪৪ সালে, কোলকাতায়। বাবার তখন চব্বিশ। মা’র সতের- আঠের, স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিলেন তখন। ১৯৪৪ সালে আমাদের ঠাকুরদাদা হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। হরেন্দ্রনাথের ইচ্ছেয় খুব তাড়াতাড়ি, ভবানিপুরে অবস্থিত আলীপুর জজ কোর্টের মুহুরি মধুসুদন বাড়রির দ্বিতীয় কন্যা রানী ভবানী-রানু কে দেখে আসার দশ দিনের মধ্যেই বিয়ে ঠিক হয়। তাঁর পরের ভাই সত্যেন্দ্র-র ও বিয়ে হয় ওই সময়ে।
ঠাকুরদা প্রয়াত হন তার পরের বছরেই, ১৯৪৫ সালে। মায়েরা ছিলেন সাত বোন। মাকে খুব ভালোবাসতেন বাবা। অনেকেই বলতেন, তার রানু ডাকের মধ্যেই ভালোবাসার উত্তাপ আর গভীরতা ছিল; কবিতা ও সংসার-যাপনে, জীবনযুদ্ধে, স্ত্রীকে বন্ধু আর সহযোদ্ধা করে নিয়েছিলেন। স্ত্রী এবং কমরেড। তাঁর কবিতা সিক্ত হয়েছে, অন্য মাত্রা পেয়েছে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার শক্তি আর রসায়নে। কবির এই আদর আর স্বীকৃতি তার স্ত্রী রানী চট্টোপাধ্যায়ের বেশ খানিকটা প্রাপ্য।
বাবা পড়াশোনা করেছিলেন জগবন্ধু ইন্সটিটিউশন এবং রিপন কলেজিয়েট স্কুলে। কলেজ করেছেন রিপন কলেজে। কর্মজীবন শুরু হয়েছিল জ্যাঠামশাই দ্বিজেন্দ্রনাথের ঢাকুরিয়া ব্যাঙ্কিং কর্পরেশনে। বেকার অবস্থা, কখনো প্রুফ রিডিং এ কেটেছে, আবার জগদবন্ধু এবং বাঘাযতীন স্কুলে শিক্ষকতাও করেছিলেন। পরবর্তি কাজ ১৯৫৬ থেকে তঁর মামার টিপারা ( ত্রিপুরা) টি কর্পোরেশনে, যে চা বাগানের মালিক ছিলেন আমাদের ঠাকুরদা হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু বেশ কয়েক বছর কাজ করে, চাকরির টানাপোড়েন থেকে নিজেকে মুক্ত করেন, কবিতাই ছিল তাঁর প্যাশন, পেশা এবং সম্পূর্ণ জগত। কেন কবিতা লেখেন, এ প্রশ্নের সহজ উত্তর আসত এক বাক্যেই- ‘কবিতা লেখা ছাড়া আর কিছু পারি না বলে’। তার সারা জীবন ছিল সংগ্রামের – অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, মানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম। ভালোবাসার পৃথিবী তাঁর স্বপ্ন, তাই অ-ভালোবাসা, অন্যায়, বিভেদ-হিংসার বিরুদ্ধে সজাগ, মুখর থাকত কবির কলম। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। তাঁর কবিতার একটি পংক্তি উচ্চারণ করিঃ
‘একটা পৃথিবী চাই, মায়ের আঁচলের মত। আর যেন সেই আঁচল জুড়ে গান থাকে যখন শিশুদের ঘুম পায়’।
আলিপুরে ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে যখন লাইব্রেরিয়ানের পাঠক্রম শেষ করেন, অবসর পেলে প্রায়ই ঘুরে আসতেন চিড়িয়াখানায়। প্রাণিজগৎ নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ, পড়াশোনা, জ্ঞান ছিল তাঁর। চিড়িয়াখানায় ঘুরতে ঘুরতে আমরাও তার কাছে শিখতাম, চাক্ষুষ জেনে যেতাম কতকিছু। পরিযায়ী পাখি কোনগুলো, কোথা থেকে কখন আসে চিড়িয়াখানায়, কোথায় যায় ওরা, শুনতাম বাবার কাছে। দু-তিনটে গন্ডার ছিল তখন; তার মধ্যে একটা নাকি বাবার বন্ধু। আমরা সত্যি বলেই ভাবতাম, দৌড়ে যেতাম সেই গন্ডারটার কাছাকাছি। বাড়িতেও অনেক সচিত্র বইপত্র পড়িয়ে আমাদের খুব ছোটোবেলা থেকেই শিখিয়েছিলেন পৃথিবী আর গাছপালা, পশু-পাখির কথা। মুখে মুখে অঙ্ক কষা, অঙ্কের সহজ নিয়ম, বাঙলা ইংরেজি ভূগোল ছাড়িয়ে বিজ্ঞানও সহজভাবে শিখিয়ে দিতেন, অনেক বই কিনে দিতেন প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানকে বোঝা,পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য। নিজের সন্তান, বিশাল একান্নবর্তি পরিবারের আর পাড়ার যত খুদে কিশোর তরুনদল, সকলের সঙ্গেই বেশ ভাব তাঁর। গল্পের বই, নাটক, খেলাধুলো, নাচ-গান, ব্যায়াম- যা কিছু শিশুদের শারীরিক আর মানসিক বিকাশের জন্য দরকার; আমাদের মননে, শারীরিক চর্চায় বাবাই সেই বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন; নিত্য জলহাওয়া দিয়ে সস্নেহে বড়ো করতেন একএকটি চারাগাছ। যখন আমি ছোটো, ঠাকুমা, জ্যাঠা-কাকা, আমাদের জেনারেশনের ভাই-বোনদের নিয়ে বাড়ি পরিপূর্ণ। পিসিরা আসছেন তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে, সমস্ত ছুটিছাটায় । দোতলার ‘বড় ঘরে’ থাকতেন ঠাকুমা, সুরবালা দেব্যা। একটা মস্ত বড়, চার দিকে রেলিং দেওয়া খাটে তিনি ঘুমাতেন, বাকী সময়ে ঐ খাট ছিল আমাদের দখলে। নাটকের রিহার্সাল-ও দিয়েছি ঐ খাটের ওপর। কয়েকটা সিড়ি বেয়ে ওই খাটটায় উঠতে হতো। পুজোর ছুটিতে বা অন্য সময়ে দূর থেকে পিসীরা বা বিদেশ থেকে কাকারা এলে, ঐ খাটের ওপর ছোটরা কতজন মিলে গা-ঘেষে বসে ঠাকুমা, মা, কমলা পিসী বা ছোট কাকীমার কাছে গল্প শুনতাম। বাবাও আমাদের গল্প বলতেন তার মধ্যে একটা গল্পের চরিত্র ছিলেন বীরেন চাটুর্জে বলে এক ভবঘুরে লোক।
আমরা ছোটো তিনজন, বিল্টুদা, কেয়া আর আমি, সন্ধ্যা বেলা মাঠ থেকে ধুলো মাখা পায়ে বাড়ি ফিরলে, বাবা আমাদের পা ধুইয়ে মুছিয়ে দিতেন।আমাদের জ্বর বা যে কোনো আসুস্থতায় অনেক যত্ন শুশ্রূষা করতেন। মুখে মুখে ছড়া আর অঙ্ক।বাবা আমাদের ইংরেজি, বাংলা ছড়া পাঠ করে শোনাতেন। গল্প বলতেন তার মধ্যে একটা গল্পের চরিত্র ছিলেন বীরেন চাটুর্জে বলে এক ভবঘুরে লোক। আমার পড়তে শেখারও আগে শুরু হয়েছিল বাবার পড়ে শোনানো ঠাকুরমার ঝুলি, দাদামশায়ের থলে, সুকুমার রায়ের আবোলতাবোল, হ য ব র ল। নিজের পড়াও শুরু বাবার এনে দেওয়া বই থেকে। উপেন্দ্র কিশোর সমগ্র, বিদেশী রুপকথার অনুবাদ মোটা মোটা বই, হ্যান্স অ্যান্ডারসন, লীলা মজুমদারের হলদে পাখির পালক, টং লিং, খেরোর খাতা, ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের যূথপতি আর চিত্রগ্রীব, সন্দেশ পত্রিকা থেকে গৌরী ধর্মপাল, আরও যত বই ছিল, বাবা এনে দিলে আমরা এক একজন করে পড়ে ফেলতাম। তাঁর এনে দেওয়া বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী আর চাঁদের পাহাড়, শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়েরর সদাশিব ও
ব্যোমকেশ বক্সী, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত আমার খুব প্রিয় তখন। বিদেশী ক্লাসিক্যাল বই-এর অনুবাদ পড়াটা নেশার মত ছিল, শেষ না করে থামতে পারতাম না। বাবার এনে দিলেন ব্যোমকেশ বক্সি, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মামাবাবু, জাপানী গোয়েন্দা হুকাকাশি-র বই, নলিনী রায়ের গোয়েন্দাগন্ডালু, হেমেন্দ্র কুমার রায়ের বিমল-কুমার আর বিদেশী গোয়েন্দা গল্পের অনুবাদ- শার্লক হোমস, ফাদার ব্রাউন, আগাথা ক্রিস্টির হারকুল পয়রো, মিস মার্পেল, পার্কার পাইন – কিছু বই সরাসরি ইংরেজিতেই পড়েছি। টিনটিনের সংগে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি- বড় বড় হার্ডবাইন্ড বইগুলো একের পর এক কিনে আনতেন। গ্র্যাফিক্স বই-এর মধ্যে ম্যানড্রেক, অরণ্যদেব, পুরনো হাঁদা ভোঁদা লরেল-হার্ডি প্রচুর পড়তাম- বাবাও আমার থেকে নিয়ে পড়তেন অরণ্যদেব। তাঁর কাছে গল্প শোনার সময় একসঙ্গে নাটকও করতাম গল্পের চরিত্র ভাগ করে নিয়ে - বিশেষ করে পাগলা দাশু। এক প্রজন্ম পরে, আমার মেয়ে ঝুমরি ( পৌলোমি) আর দিদির মেয়ে তিতিন ( মধুমিতা) -এর সঙ্গেও নাটকের এই খেলা ছিল বাবার, তখনকার গল্পগুলো অন্য- গোপাল ভাড় , ডুবডুব-চমটক-কালিয়া এরকম কত কী। বাবা আমাদের খুবই উৎসাহ দিতেন লেখার। শুধু লেখা নয়, আমাদের প্রত্যেকের খেলাধুলা, এক্সারসাইজ, গান, আবৃত্তি, নাটক, নাচ, গান, কী নয়? খেতে আর খাওয়াতে, দুটোতেই বাবার আনন্দ। সিঙাড়া জিলাপি আর অমৃতি খুব প্রিয়। আমাদের প্রত্যেকের জন্মদিনে ঘুম থেকে উঠেই সিঙ্গাড়া আর জিলাপি নিয়ে আসতেন। আম পুড়িয়ে শরবৎ, আচার বানাতেন- লেবু, বড়বড় লঙ্কা, আম, পাকা কুল এইসব দিয়ে। প্রয়োজন মতো হাত লাগিয়ে লুচি, নিমকি ভাজাতে বেজায় উত্সাহ ছিল। বাবার ঝোঁক ছিল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, এ ব্যাপারে অনেক পড়াশনা আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। যৌবনকালে তিনি অনুশীলন সমিতির সঙ্গে রাজনৈতিল ভাবে যুক্ত ছিলেন। চারের দশকে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে কিছুদিন প্রাথমিক সদস্য ছিলেন। তাঁর কবিতায় প্রতিবাদী রূপটি তীব্র হয় ভারতে ১৯৬৯ সালে খাদ্য আন্দলন, ১৯৬১-র নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল বিরোধী আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ১৯৬৬ র খাদ্য আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ, ৭০-এ ইন্দিরা সরকারের এমারজেন্সী, প্রতিটি সংকটকালে। ১৯৬২ সালে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় প্রথমে চিন বিরোধী ভূমিকা নিলেও পরে নিজেই তাঁর সেই রাজনৈতিক অবস্থান কে ভুল বলে স্বীকার করেছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে আইন অমান্য করার অপরাধে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্যদের সঙ্গে কারা বরণ করেন। এমারজেন্সী এবং বন্দীমুক্তি আন্দলনের সময় তিনি ছিলেন সম্মুখ ফ্রন্টে। স্বাক্ষর সংগ্রহ, ইস্তেহার, অজস্র পোস্টারধর্মী কবিতা লিখে সমস্ত পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতেন। দেশ ও মানুষের দুর্দিনে কবিতাই ছিল তাঁর যুদ্ধাস্ত্র। সাতের দশকে নকশাল তরুনতরুনীদের ওপরে পুলিসী নির্যাতন চরমে পৌঁছলে তিনি শুধু প্রতিবাদ জানাবার জন্য শতাধিক কবিতা লিখেছিলেন। ডাক্তারদের ওপর বামফ্রন্টের পুলিশ ও পার্টিকর্মীদের হামলার প্রতিবাদ সভাতে তিনি অসুস্থ শরীরে উপস্থিত ছিলেন এবং সম্ভবত সেইটিই তাঁর জীবনের শেষ প্রতিবাদ সভা।
ফুসফুসের ক্যান্সারের সঙ্গে দশ মাস যুদ্ধ করে আমাদের ১৪ ষ্টেশন রোড ঢাকুরিয়ার বাড়িতে, ১৯৮৫ সালের ১১ জুলাই সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাবা , যখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র পঁয়ষট্টি, মা রানী ভবানি-র বয়স সাতান্ন। কবি ও মেডিকাল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিও থোরাসিক সার্জন ভূমেন্দ্র গুহ রায় তাঁর ক্যান্সার রোগ শনাক্ত করেন, ১৯৮৪ সালে অক্টোবর মাসে
বাবা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ভূমেন্দ্র গুহ রায় তাঁর অপারেশন, কেমোথেরাপি এবং পরবর্তী চিকিৎসা করেন। এর পরে ভর্তি হন ঠাকুরপুকুরে ডাক্তার সরোজ গুপ্তের ক্যান্সার হাসপাতালে, রেডিএশন কোর্স ও সেরে ওঠার জন্য। সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে এলেও জীবনের দীপ একটু একটু করে নিবে আসছিল তাঁর। হোমিওপ্যাথ ডাক্টার ভোলানাথ চক্রবর্তী এসে যেদিন দেখলেন, ১০ জুলাই, সে দিনই জানিয়ে গেলেন অন্তিম সময় উপস্থিত। কিন্তু তার কয়েক দিন আগেও লিখছিলেন কবিতা। অফুরন্ত জীবনের মিছিল, এই বইটি তে ওই সময়ের, জীবন মরণের সীমানায় দাঁড়িয়ে লেখা অসম্ভব ভালো ভালো কবিতা আছে।
তাঁর কবিতা উদ্ধৃত করে অশেষ কথার সংক্ষিপ্ত অংশটি শেষ করি।
তুই
তোর কি কোন তুলনা হয়,
তুই
চোখ বুজলে হীম সাগর
চোখ মেললেই অনন্ত নীল আকাশ
**********************************
আমাদের আপনজন
অরবিন্দ সরকার
বীরেন্দ্র এক সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব
কবিতায় তিনি নিবিড় উদ্ভাস
নির্ভীক অকপট এক অগ্নি স্ফু লিংগ ।
আকাশ আলিঙ্গনে উদাসী বাউল
স্পষ্টাবাদিতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার ।
কাব্যিক সুষমায় তিনি অমোঘ
নিবিড় বোধে অতুলনীয়
শিল্পীত রসে মঞ্জ রিত
মানুষের পাশে থেকে আদরে
ভালোবাসায় একান্ত আত্মজন।
****************************
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
দুর্গাদাস মির্দ্দা
বাংলা সাহিত্যে কাব্য জগতে যাঁরা তাঁদের উপস্থিতির শতবর্ষ অতিক্রম করতে পারলেন তাঁরা সকলেই স্বনামধন্য এবং উল্লেখযোগ্য।
সেই কবি শতবর্ষের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেন যাঁর কবিতার মধ্যে মানব জীবনের সাধনা পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতিপ্রেম সেও তো কবিতার বিষয়বস্তু হতেই পারে, হতেই পারে প্রেমের নিরলস সাধনা সাধনা কিন্তু মানবপ্রেম যখন কোন কবির সৃষ্ট কাব্য চেতনায় মুখ্য উপজীব্য হয়ে ওঠে তখন তাঁকে মানুষের কবি বলে গণ্য করতে কুন্ঠা থাকার কথা নয়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই ঘরাণার কবি যিনি কবিতা চর্চা করতে গিয়ে শুধুমাত্র আবেগতাড়িত না হয়ে বাস্তবের কঠোরতায় বিচরণ করে সৃষ্টিশীল মারগে পৌঁছেছেন। সমাজ-মানসের এই কবির কবিতায় ভাষিত হয়েছে সমগ্র দুনিয়ার প্রতারিত বিপন্ন মানুষের বেদনা, মানবতাবিরোধী ঘটনার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ ছিল বা আছে বলেই আজও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায় স্মরণীয় কবি। বারাব্বাস- শিশুমনের জিজ্ঞাসা কবিতাটি পড়তে পড়তে গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে কারণ এই কবিতায় অবৈধ শিশুর যন্ত্রণার কথা এমন করে বলা হয়েছে যা যেকোনো যা যেকোনো পরিতক্ত শিশুর জীবন কাহিনী যা অবশ্যই মানবতাবিরোধী অপরাধ তিনি ক্ষমা করতে পারেননি বলেই তিনি আজও স্মরণীয়
এবং বরণীয়।
***************************
কবি প্রণাম
অমিত কাশ্যপ
'আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে/ কারা যেন আজো ভাত রাঁধে/ ভাত বাড়ে, ভাত খায়'--কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটা আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাই দেখা যায় তাঁর কবিতায় সেই ধ্বনি, সেই নিরন্ন- বুভুক্ষু মানুষের তীব্র হাহাকার, হতাশা। কবি কত সহজে, কত সহজ ভাষায় ব্যক্ত করেন তাঁর অভিমত 'ফ্যান দাও বলে যাঁরা কাঁদে রাস্তায়/ ঘরে নেই ভাত। মাগো, তুই কাছে আয়। আজ জন্মশতবর্ষের মুহূর্তে জানাই প্রণাম।
*************************
প্রাণ প্রদীপ
রাজীব ঘাঁটী
প্রাণে জ্বেলেছো আলোর প্রদীপ,
আকাশতলে আজ আলোকিত কবিতা
স্বপ্নরা আমাদের রোজ ডাক দিয়ে যায়
তোমার পদচিহ্ন ধরে আমাদের অন্বেষণ।
এভাবেই অক্ষরের ভালোবাসারা রোজ ডাকে
রোজই বলে সময়কে আপন করো ,আপনার ।
রোজই বদলাতে চায় আমাদের জীবনধারা
এভাবে ও ভালোবাসা জেগে থাকে কবিতা হয়ে আমাদের জীবন ধারায়। তোমার আলোয় আলোকিত হয়ে বদলাবো অক্ষরের সংজ্ঞা।
************************
রাস্তা
ফটিক চৌধুরী
স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে শিখিয়েছিলে তুমি
সে রাস্তা সরল হোক কিংবা বাঁকা, তোমাকে
জামা পাল্টানোর যুগে দরকার ছিল খুব
নির্ভীক প্রতিবাদে ছিলে,স্বপ্নে দিতে না ডুব।
কবিতার চেয়ে গাছ লাগানোর কথা বলেছিলে
কত সত্যি ছিল আজ,বলেছিলে মানুষের কথা
বিশ্বাসে অবিচল, ছিল না কোন ভয়।
বলেছিলে: রাস্তা কারো একার নয়।
**************************
গরম ভাতের কবি
শুভঙ্কর দাস
স্বপ্নের ভেতর সাদাপাতা ওড়ে
একবার স্পর্শ করলে অমরত্ব এসে দাঁড়াবে দরজায়..
অথচ কবি তা চায় না
ভুখামিছিলে কবি বসে আছেন
দিনরাত
একটা মাত্র কবিতা লিখতে
দুমুঠো গরম ভাত!
*************************
শতবর্ষে কবি বীরেন্দ্রনাথ
গৌর চাঁদ পাত্র
শতবর্ষ আগে মুক্তিপাগল দিনে পথচলা শুরু।
চলতে চলতে মাটির আগুন- লাভাতে সেঁকা
কবিতার চাবুকে ভাষা।
সব্যসাচীর একহাতে প্রেম অন্যহাতে লড়াই উদ্যত কলম।
নেতা নয়, শুধু মানুষের কাছে মাথানত।
বুকে নিয়ে রাজার মুখোশ ভাঙার প্রত্যয়ী শপথ।
তাই আজ শতবর্ষ পরিক্রমা শেষে-
শোষন-অসাম্যহীন সমাজের স্বপ্নদেখা
বীরশ্রেষ্ঠ কবির যাত্রা পথে হোক উড্ডীন
নতুন মুক্ত সকাল আনার অঙ্গীকার-নিশান।
*****************************
সংগীতময় চা
বিমল মন্ডল
একটা কাপের রূপ আগুনের সুসম্পর্ক থেকে
জন্ম দিয়েছেন সত্যিকারের
বেঁচে থাকার আপন মন্ত্র
কবিতার আধার ধরে আছে উষ্ণ তরল
যা কিছু স্পষ্ট মানুষের কাছে
'মহাপৃথিবীর রাস্তা'য় জ্বলছে , জ্বলে যায় প্রতিবাদী আগুন
দুরন্ত পিপাসা আগুন পোড়ার আগে সেই কাপ হাতে ধরে
প্রেমের কথা বলতে বলতে
যা আজ জন্ম নিয়ে
ধীরে ধীরে কবিতার পুণ্যময় বাতাসে
ছড়িয়ে দিলেন
গভীর সংগীতময় চা।
**********************
শতবর্ষে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রে মে শ প ন্ডা
মাটি আর মানুষ- খাদ্য প্রান আর বুভুক্ষু মানুষের হয়ে গনআন্দোলনে
যিনি কবিতার বিপ্লব এনেছিলেন-,
সেই অসহায় নিপীড়িত উপেক্ষিত উৎপীড়িতের হয়ে কথা বলা কবি বীরেন চেট্টাপাধ্যায়।
মানবতার দরবারে মানবের আর্তি,
কাতর আর্তি , জাগতিক জীবনে মানুষকে বাঁচার জন্য এর কবিতার
পুক্তি-।
গ্রহচ্যুত, রানুর জন্য লখিন্দর , মানুষের মুখ-ভিসা অফিসের সামনে,
মহাদেবের দুয়ারে , ভিয়েতনাম, ভারতবর্ষ তার কাব্য গ্রন্থগুলিতে
মানব প্রেম উদ্ভাসিত ।
মানুষের হাসি মুখ, ভরা পেট মানুষের জীবন তাঁর অন্তরের ঐকান্তিক চাওয়া। সাম্যের গানে , সমানাধিকারের প্রশ্নে তিনি অবিচল।
শাসকের শোষন, গুলি বুলেটের আস্ফালন ,রক্তচক্ষু, অসহায় মানুষের অধিকারের জন্য তিনি কবিতাকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন
জনমানসে। কারাবরনেও পিছপা হননি তিনি। নির্ভীক কবি আজ ও
প্রাসঙ্গিক ।
তিনি আবার ফিরে আসুন-,শাষক কি সবার? এ প্রশ্ন আছো জীবিত। গরিবের দেশ ,চাষার দেশ , অনাহারে
থাকা , নিরন্ন, খোলাছাদের মানুষের
সুদিন এখনো আসেনি।
ভর্তুকিতে ভরে গেছে দেশ। মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়করানোর কোন জায়গা নেই। অথচ দেশ, তার সরকার প্রতিশ্রুতির কল্পতরু। মানুষের নৈতিকতা ক্রমহ্রাসমান, বিত্তশালীদের
দাপট, ক্ষমতার আস্ফালনের কাছে সাধারন মানুষ আজ ও ভীত সন্ত্রস্ত ।
**************************
মাটির কবি।
শুভ্রাশ্রী মাইতি।
শুধু দেশকে চিনবে বলে
একটা খোলা খাতা ফুটিফাটা মাটির কাছে চেয়েছিল আগুনের তাপ।
শুধু বৃষ্টি নামার মন্ত্র শেখাবে বলে
একটা জলজ হৃদয় কাদা-মাটি-জলে বুনেছিল অক্ষরের সোনালী ধান।
শুধু মানুষের মুখ আঁকবে বলে
একটা শাণিত কলম টেনে ছিঁড়েছিল অবিচারের অন্ধকার মুখোশ।
খোলা খাতার হৃদয়ে কলমের ফলায় অক্ষরের ফসল ফললেই
সিগারেটের প্যাকেট বা বাসের টিকিটও কবিতার আকাশ হয়ে ওঠে অক্লেশে।
যে আকাশে প্রতিবাদের উনুন জ্বেলে একজন কবি ভাত ফোটান প্রেমের আগুনে
আধপেটা মানুষের দেশে মাটির সোঁদা গন্ধে আশ্চর্য ভাতের গন্ধ মিশিয়ে দেবেন বলে।
*******************************
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
শ্রাবণী বসু
অভাবচুম্বন করেছেন-কবিতার জন্য,
এভাবে হেঁটে পথ দেখিয়েছেন -
কবি-বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
মানবতার জন্য বারবার ঘেমেছে
তাঁর শক্তিশালী কলম।
কবিতা যখন জীবনীশক্তি বাড়িয়ে দেয়,
কবিতা যখন মন্ত্রের মত অমোঘ,
মানুষ তাকে হৃদয়ে ধারণ করে।
বুকের কুলুঙ্গিতে প্রদীপ জ্বলছে
দীপশিখায় কবির নামটি স্পষ্ট দেখছি।
*********************************
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ড. বাপ্পাদিত্য মাইতি
আধুনিক কবিদের অনেকে দুর্বোধ্য অবোধ্য --এ রকম অনেক অভিযোগ আছে।কিন্তু বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে তা গ্রহণীয় নয়। গত শতকের এই সাম্যবাদী কবি শোষণ বঞ্চনা নিয়ে যেমন সোচ্চার তেমনি কাব্যকথায় জটিলতা মুক্ত। তিনি কত অনায়াসেই না লেখেন --
রাত্রি ভোর হয়।
পদ্মের পাতায় জল । মন্ত্রগুলো
অবাক ভোরের পাখি
আর
আগুনের রঙে রাঙা মানুষের শোক জন্মভূমি তোর পায়ে মাথা রাখতে সাধ হয়।
মার্ক্সবাদী এই কবি আবার লোক কথাকেও কবিতায় চমৎকার ভাবে তুলে আনেন ।
ইমেজের ব্যবহার করেন সাবলীল দক্ষতায় --
স্নানের জলের মতো সে শরীর থেকে আলোর মদ গড়িয়ে পড়ছে।
কবি সাম্প্রদায়িকতা কে তীব্র ভাবে আক্রমণ করেন। শ্রমজীবী মানুষের কথাকে মূলত কাব্য ভাবনায় ঠাঁই দিয়াছেন। এই রাজনৈতিক মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু সীমাবদ্ধতাও তৈরি করে। তবে শোষণ মুক্ত সমাজের যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন তাকেই স্থির বিশ্বাসের কাব্য রূপ দিয়েছেন।
*****************************
আলো আগুনের কবি
মঞ্জির বাগ
কালো বস্তির কালো আঁধার কাটিয়ে আলোর গান যে লিখেছিলে কবি সেই গানে তোমাকেই স্মরণ করি কবি মধুপুরের পাহাড়িয়া সুরে যে মোহনিয়া গানটি গানটি মিশে আছে
সেই প্রেমের আগুনে ডুবে যে ভালোবাসার গান লিখেছিলে কবি সে তুমি শতবর্ষের আলো আঁধারে ভেসে যেতে যেতে বাঙালির মন তোমাকেই মনে করে
রাস্তা যে কারোর একার নয়
এই সাহসের তর্জনী ওঠাবার সাহস শুধু তোমারই আছে আর আছে বলেই এ অসময়ে তোমাকেই স্মরণ করি কবি বীরেন্দ্র।
*********************************
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে
কলমে - শ্রীলিম
হে বীরেন্দ্র, সাধারণ মানুষের জন্য কেঁদেছে তোমার কবিতাগুচ্ছ!
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের পথে অগ্রসর হয়ে,
ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত অথচ পরিশ্রমী শ্রমজীবী মানুষের জয়গান গেয়ে,
পৃথিবীর বার্ধক্যে দিন যত এগিয়েছে তোমার দৃষ্টি হয়েছে স্বচ্ছ।
আজকের ভারত তথা বাংলার করুণ দশা রাজনীতির টানাপোড়েনে,
এসেছিল দেশ তথা দেশবাসীর সেবা করার বুলি আউড়ে,
আজকে তারা পথভ্রষ্ট, একে অপরকে কাদা ছুঁড়তেই ব্যস্ত,
ডুবছে সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবীদের খেটে খেয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
হে বীরেন্দ্র, ভারত তথা বাংলার চারিদিকে ঘিরেছে ঘন অমাবস্যায়,
মানুষখেকো বাঘেরা আজ সত্যিই বড় খুব লাফায়!
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
তোমার স্বপ্ন
সোনালী মিত্র
তোমার কলমে লাঙ্গলের ইতিহাস
তোমার হৃদয়ে মানুষের বসবাস।
মাটির ফসলের ভালবাসার অজস্র স্বপ্নের
ভীড় আলবেয়ে ঘুরতো।
একবার শুধু হাতে হাত রেখে জাগরণের সুর
চেয়েছিলে সূর্যর কাছে বস্তির কালো ঘরে।
দুমুঠো ভাতের স্বপ্ন দিনের খাতায় স্বরলিপি হয়ে কলমে তোমার বাজতো।
এখনও সময় থমকে আছে বাতাসে লাশের গন্ধ
হামাগুড়ি দিয়ে মৃত্যু এখন মিছিলে ভর করে।
*******************************
আত্মপক্ষ সমর্থন
র জ ত দা স
ভাতের সঙ্গে দেখা হয় প্রকাশ্য
আমার স্বদেশ স্বপ্নের কথা বলে !
বাঁচার লালটুকটুকে নম্র শপথ
মূক অন্ধকার মূর্খের মুখোমুখি।
রাজকীয় পোশাক আর ঝলসানো রুটি
পাথরে পাথর ঠুকে শিখেছি খুঁটিনাটি।
""""""""""""""""""""""""""""""""""""
শীর্ষে চাষিভাই
নবীন মণ্ডল
আদিম হতে সভ্য প্রমাণ বিবর্তনই
চাষাবাদ রক্তে মেশা মোদের জীবন ;
মাটির কাছে থাকি,মন্দ নয়কো,গণি---
বাঁচায় সদা আগুন শক্তি পেট-ভাতাতেই কুলীন।
চাকরির বল অর্থে প্রকট মনের সান্ত্বনা
অর্থ ভরা থালায় ভরে নাকো পেট!
বাড়ায় সকল জীবন চলার দুঃখ যন্ত্রণা,
চাষি লক্ষ পুষি বাড়ে কৃষক ভাই-এর রেট।
উচ্চ শিরে মাথা থাকে সবাই হাতটি পাতি
নাইকো মোক্ষ অর্থ মোহে নিছক মাতামাতি।।
****************************
অ-নামের ছবি
জয়দেব মাইতি
কখনো কি অন্ধকারের পথে হেঁটেছ সখা? কিংবা আলোর বিপরীতে!
ভেবেছ কি! যে পথে আমি একা হাঁটি- বাকিরা সেখানে প্রাণ হাতে বেঁচে থাকে!
নবান্ন উৎসবে তারা কাস্তে হাতে লড়াই করে জীবন যন্ত্রণায়-
একজন তো--আজীবন সেই স্রোতের বিপরীতে নিজেকে করেছে ব্যাতিক্রমী-
মাথা স্থির রেখে এখনও হেঁটে চলেন সাধারণের মাঝে -
তিনি তো মানুষের কবি। অ -নামের মেরুদণ্ড।
**************************
হে কবি
শ্যামল রক্ষিত
পা থেকে মাথা পর্যন্ত আগনে
জ্বলছে
জ্বলুক
আমার কী
হাত থেকে কবেই নামিয়ে
রেখেছি রাইফেল
আমার কোনও যুদ্ধ নেই
ইস্তাহারও না
ধর্মগ্রন্থে এত রক্ত
এত রাষ্ট্রীয় দহন
আমি কোথায় মুখ লুকোই
হে কবি ৷
*****************************
মানবতার কবি
পার্থপ্রতীম মিশ্র
অনেকে পায়রা উড়ায়;উড়ে যাওয়া দ্যাখে।বাগানে ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে প্রজাপতি মাখে।মোহময়ী চন্দ্রালোকে মায়াময় গন্ধরাজ সাজে...
আর তুমি!মাটিতে দাঁড়িয়ে যারা মাটির ঘুম ভাঙায়,ফসল তুলে ধরে,
তাদের বসতি মাটির হিসেব চাও।
তুমি ডিজিটাল আয়না তুলে ধরো,ছুড়ে দাও প্রশ্ন বান-
যদি জন্মে আজ শিশু স্বাধীন,কেনো তবে মায়ের চোখে জল!কেনো রুক্ষ কেশ;শত ছিদ্র আঁচল!
ফুটপাথে চারপায়ে হাঁটা হাজারও উলংগ শিশু আকাশের নক্ষত্র দেখে দেখে শীতের রাতে,দুরন্ত বর্ষায় গরম ভাতের তরে,রুটির তরে ভুখা কান্না জুড়ে...
তুমি সেই কান্নার কাছে,মাটি- মানুষের পাশে রাত জাগো;জেগে থাকার গান গাও...
******************************
আলোকিত কবিতা বৃক্ষ
বীথিকা পড়ুয়া মহাপাত্র
কবি তুমি ক্রান্তদর্শী এক কবিতা বৃক্ষ!
আমাদের হৃদয়ের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়!
তোমার কবিতারা স্বচ্ছ জলের মতো
অথচ বোধে ভরা শঙ্খসম দৃঢ়,
তারা সেকাল একাল পেরিয়ে আজও প্রাসঙ্গিক!
তুমি অক্ষর প্রদীপ জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছো এখনো অসহায় মানুষের একথালা ভাতের
গন্ধের পাশে!
বেকার জীবনের পাঁচালি হাতে আজ ও হাঁ-করা জুতোর ফিতে বাঁধতে থাকে কিছু দুঃস্বপ্ন গিলে ফেলা আগুনের ফুলকি!
দুর্ভাগ্যের পথে বৃষ্টি পড়ে এখনো
বস্তির ভাঙা চালি বেয়ে!
সেই কালো রাত কাটেনি কাটেনি!
বসে আছে গভীর অমানিশা নিয়ে!
তাই তোমার কবিতারা সর্বচক্ষু এড়িয়ে যাওয়া
কালো বস্তির পাঁচালি শুনিয়ে যায়
আগামীর কানে কানে!
কান্নার মহাকাব্যরা খোঁজে রোদ্দুরের ডাঙা!
তোমার বৃষ্টি আনার মন্ত্র খোঁজে
বর্তমান কবি কলম তোমার বোনা শব্দশস্য মাঠে!
কবি তোমার তিন পাহাড়ের স্বপ্নেরা
আলোকিত ভালোবাসা খুঁজে চলে আজ ও
দুই সাঁওতাল যুবক যুবতীর মাদলের বোলে!
হাজারো প্রদীপ শিখায় আরতি নিও কবি
এ ঋনী পৃথিবীর কাছে!
হে কালজয়ী কবি লহো প্রণাম!
*****************************
কবিকে
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
প্রমোদবিলাসসুখে নয়
বিশুদ্ধ কান্নার জন্য খিদের বন্ধুত্ব ঘন
নির্ভেজাল আলোয় ধুয়ে যায় ফুটপাথ
শিশুমুখে আলো
দরদের অতিরেক নয় মুখোশ নয়
লালরক্তে লেখা ইস্তাহার ছলনাহীন
অসহায় যে কারও মুখে আলো শবযাত্রা
শ্মশানের অন্ধকার পাথর চাপা বুক
তবু কবি জাগে কবিতার তীব্র কৃপাণ।
*****************************
মানুষ কবি
বিষ্ণুপদ জানা
মানুষেরা পেটভর্তি ভাত খায়
সাদা ভাতেরভাণ্ড বাঁকা চাঁদ
মাথার উপরে
'আশ্চর্য ভাতের গন্ধ'
আকাশে বাতাসে
চাঁদ এসে চুমু খায়
ন্যাংটো ছেলের গালে
অবাক চোখে মা
জাপ্টে ধরে বুকে
রাজা আসে রাজা যায়
রাস্তা - এই দেশ
ভারত বর্ষ
ক্ষুধার জ্বালায়
মুখে রক্ত ওঠে
মাটিতে মানুষ গড়ে
মানুষেরা পেটভর্তি ভাত খায়।
*******************************
সংগৃহীত বইয়ের কিছু -
সম্পাদিত বই
বিভিন্ন সময়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কিত বক্তৃতার সংকলন বই ও স্মরণ কমিটির বই
শতবর্ষের আলোকে প্রকাশিত বই
কন্যা মিত্রা চট্টোপাধ্যায় ঘোষ ' এর বই
আলোচনা বিষয়ক বই -
১০০!!!১০০!!!১০০!!!১০০!!!১০০!!!১০০!!!১০০!!!
No comments:
Post a Comment