Wednesday, 2 September 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
                 জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
   দার্শনিক আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল।



(০৩.৯.১৮৬৪ - ০৩.১২.১৯৩৮)
============!!!!!!!!!!!==============
           Doinik Sabder Methopath
            Vol -119. Dt - 03.09.2020
            ১৭ ভাদ্র,১৪২৭. বৃহস্পতিবার
£££££££££££££££££££££££££££££££
 " স্বামী বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্র বসু বজেন্দ্র নাথ এঁরা সকলেই ভারতবাসীর ইউরোপ বিজয়ের প্রথম সেনাপতি।"
 (অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার )।
                  ১৮৬৪ সালের ৩ রা সেপ্টেম্বর উত্তর কলকাতার রামমোহন সাহা লেনের বাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতা মহেন্দ্রনাথ শীল এবং মাতা রাধারানী দেবী। মাত্র ৭ বছর বয়সে পিতামাতাকে হারিয়ে দুই ভাই ও দুই বোন মাতুলালয় বড় হতে থাকেন। বাল্যকালের পড়াশুনা - জেনারেল অ্যাসেম ব্লিজ স্কুলে, প্রাথমিক থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৭৮ সালে এফএ ফাস্ট আর্টস এবং ১৮৮৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ পরীক্ষায় পাশ করেন। এই সময় তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে নরেন্দ্র নাথ দত্তের সঙ্গে। সেই সূত্রে একদিন দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে স্মরণীয় সাক্ষাৎ ঘটে। চিনি বিদগ্ধ অধ্যক্ষ উইলিয়াম হেস্টিংয়ের আশীর্বাদ লাভ করেন। ১৮৮৪ সালে গণিত বিদ্যায় এমএ পরীক্ষা দেওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি নিলেও শেষ পর্যন্ত উইলিয়ামের পরামর্শে দর্শন শাস্ত্রে মেয়ে পরীক্ষা দেয় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে গৌরব অর্জন করেন। ওই বছরই সিটি কলেজে দর্শন ইংরেজি বিষয়ে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন তার গভীর অধ্যায়ন ও গবেষণা পরিষদ বিস্তৃত হতে থাকে সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য, অর্থনীতি, হিন্দু দর্শন, বিজ্ঞান, জাতিতত্ত্ব ,তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, গণিত, ভৌত বিজ্ঞান, রসায়ন, জীব বিদ্যা ,পৃথিবীর ইতিহাস, ভূগোল ও ইংরেজি সাহিত্যের মধ্যে। ১৮৮৫ সালে নাগপুরের মরিস মেমোরিয়াল কলেজের ইংরেজি ও দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করলেও পরে ওই কলেজের অধ্যক্ষ হন পৃষ্ঠশক্তি এবং প্রতিষ্ঠা লাভ ঘটলেও পারিবারিক কারণে তিনি আবার বাংলায় চলে আসেন। ১৮৮৭ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন আদর্শ শিক্ষা বিজ্ঞান সাধক বহুবিধ বিদ্যার পন্ডিত প্রবর এই মানুষটি আজীবন ছাত্রদল জনসমাজে সম্মানিত ও সমাদৃত। ওই সময় তাঁর ইংরেজি প্রবন্ধ "ক্রিটিক্যাল এসেজ " ধারাবাহিকভাবে ক্যালকাটা রিভিউ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে দেশ-বিদেশে বিদগ্ধজনের নজরে আসে তিনি প্রশংসিত হন। ১৮৯৬ সালে তিনি কোচবিহার মহারাজের আমন্ত্রণে কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। 
এরপর ১৯০০ প্রিয় পত্নী ইন্দুমতী দেবীর অকাল মৃত্যু। দৃঢ়তার সঙ্গে সন্তাপ জয় করে সিমলা কমিশন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির সদস্য বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন স্বদেশী আন্দোলন জাতীয় শিক্ষা পরিষদের নতুন শিক্ষা আন্দোলন ডন সোসাইটি সদস্য রবীন্দ্রনাথ বিপিনচন্দ্র অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ ভগিনী নিবেদিতা স্বামী বিবেকানন্দের ছাত্র জীবন স্মৃতিকথা লেখেন , নানান কর্মকাণ্ড ক্লান্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি স্বাস্থ্যের উন্নতি কল্পে ১৯০৬ শালী ইউরোপ ভ্রমণে যান। লন্ডনে আয়োজিত প্রথম বিশ্ব জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন উদ্বোধন জাতিতত্ত্ব বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। পৃথিবীর বহু গুণীজনের সঙ্গে তাঁর আলাপ ঘটে । পরে ফিরে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর অনুরোধে কোচবিহার কলেজ পরিত্যাগ করে নবপ্রতিষ্ঠিত দর্শন বিভাগের অধ্যাপক গ্রুপে যোগদান করেন। ১৯১৫ সালে একমাত্র কন্যার সরযূবালার সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভ্রাতা বসন্তরঞ্জন এর শুভ পরিণয় সম্পন্ন করেন। শিক্ষা সংস্কারের জন্য গঠিত কমিটির সদস্য হন। পরে তিনি মহীশূর মহারাজ এর আমন্ত্রণে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ গ্রহণ করেন। বিশ্বভারতী পরিষদ প্রতিষ্ঠা উৎসবে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সম্মাননীয় সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। ১৯২৬ সালে তাঁর অসামান্য জ্ঞান সাধনা ও কর্মযোগ এর জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে স্যার (নাইটহুড) উপাধি প্রদান করেন.
আদর্শ চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের জন্য তাঁকে ‘আচার্য’ বলে সম্বোধন করা হত। তিনি পাশ্চাত্য জগতে হিন্দুদর্শন ও ভারতবাণী প্রচার করেন, হেগেল ও স্পেন্সারের মতবাদে দুর্বলতা প্রদর্শন করেন। তাঁর জ্ঞানচর্চা ও গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, ম্যাক্স মূলার, মাইকেল স্যাডলার প্রমুখ বিশ্বমানবতার প্রবক্তারা গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁর কলেজ-সহপাঠী।


রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে ব্রজেন্দ্রনাথ ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া তিনি মহীশূর, মাদ্রাজ, বোম্বে, ত্রিবান্দ্রমসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন ভাষণ দেন। এসব ভাষণে তিনি উপমহাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন দিক নির্দেশনা দান করেন।
              দীর্ঘ কর্মকাণ্ডের ফলে বয়সের ভারে শরীর আর সুস্থ ছিল না স্বাস্থ্য ভঙ্গের কারণে মহীশুরের সরকারি সকল কাজ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন জীবনের শেষ ভাগে প্রথমে বোম্বাইতে জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে এবং পরে কলকাতায় অবস্থান করেন। শেষে প্রায় অন্ধ অবস্থায় জ্ঞান চর্চার জন্য শ্রুতিলিখন এ এক ছাত্রকে নিয়োগ করা হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এর জন্ম শতবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ধর্ম মহাসভায় তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সুচিন্তিত লিখিত ভাষণ প্রদান করেন। অবশেষে ১৯৩৮ সালের ৩ রা ডিসেম্বর কলকাতার 
ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতেই অসুস্থ অবস্থায় পরলোকগমন করেন। তিন পুত্র ও এক কন্যা যথোচিত মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। দেশ-বিদেশের বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হয়।

রচনা কর্ম :

ব্রজেন্দ্রনাথ দশটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। অজস্র বই রচনা করেছে ধর্ম, দর্শনতত্ব, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, বিজ্ঞান নিয়ে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 
A Memoir on the Co-efficient of Numbers: A Chapter on the Theory of Numbers (1891); 
Neo-Romantic Movement in Bengali Literature (1890-91); 
A Comparative Study of Christianity and Vaishnavism (1899); 
New Essays in Criticism (1903); Introduction to Hindu Chemistry (1911); Positive Sciences of the Ancient Hindus (1915); 
Race-Origin (1911); 
Syllabus of Indian Philosophy (1924); Rammohan Roy: The Universal Man (1933); 
The Quest Eternal (1936)
Etc.

তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধসমূহ 
Calcutta Review, Modern Review, New India, Dawn, Bulletin of Mathematical Society, Indian Culture, Hindustan Standard, British Medical Journal,  
প্রবাসী, সবুজপত্র, বিশ্বভারতী প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

ব্রজেন্দ্রনাথ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ডিএসসি (১৯১৫), নাইট (Knight, ১৯২৬) এবং মহীশূরের রাজরত্নপ্রদীপ (১৯৩০) উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৩৫ সালে তিনি ৭২ বছর বয়সে পদার্পণ করলে ভারতীয় দর্শন কংগ্রেস এক সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করে। এ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ‘আচার্য শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ শীল সুহূদ্বরেষু’ শীর্ষক এক প্রশস্তিবাণী প্রেরণ করেন।

সম্মাননা :
অসামান্য মেধা ও পান্ডিত্যের অধিকারী ব্রজেন্দ্রনাথ আদর্শ চরিত্রের জন্য আচার্য্য উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তাকে চলমান বিশ্ববিদ্যালয় বলে অভিহিত করা হতো। ডিএসসি ও নাইট উপাধি পান তিনি। মহীশুর রাজ্যের রাজরত্নপ্রবীন উপাধি পান তিনি। ইংরেজ পণ্ডিতরা গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের সঙ্গে, ভারতের নাগার্জুনের সঙ্গে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের তুলনা করেছেন। তার মৃত্যুতে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, ‘সক্রেটিসের পরিবারের শেষ প্রদীপ নিভে গেল!’

  জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা :

৮ মার্চ শনিবার বিকেল চারটেয় কোচবিহার আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজ সেমিনার হলে ‘উত্তর প্রসঙ্গ’ পত্রিকার আয়োজনে সার্ধশতবর্ষের আলোকে ‘আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল’ আলোচনা চক্র অনুষ্ঠিত হল। স্বাগত ভাষণ দেন উত্তর প্রসঙ্গ পত্রিকার সম্পাদক দেবব্রত চাকী। তিনি আক্ষেপ করেন — আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল জন্ম সার্ধশতবর্ষ উদযাপনে বাংলার বিদ্বজনদের আগ্রহ চোখে পড়ল না। এদিক ওদিক এক-দুটো প্রবন্ধ বের হলেও সেখানে শ্রী শীলের ১৭ বছরের ভিক্টোরিয়া কলেজ-এর জীবনের উল্লেখ নেই। সেটা কি ভিক্টোরিয়া কলেজ কোচবিহারের মফস্বল কলেজ বলে?
বিভিন্ন বক্তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. অনল সরকার জানান, আচার্য্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ৩৩-৫০ বছর বয়স অবধি, অর্থাৎ জীবনের সব থেকে কর্মোদ্যম সময় কোচবিহারে কাটান। ভিক্টোরিয়া কলেজকে কেন্দ্র করে কোচবিহার রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্ম দেন। কিছু দিনের মধ্যেই ভিক্টোরিয়া কলেজ উত্তর-পূর্ব ভারতের ছাত্র সমাজের তীর্থস্থান হিসেবে পরিগণিত হয়। অধ্যাপক গৌরাঙ্গ বিশ্বাস বলেন, ভারতীয় দর্শনকে শ্রী শীল বিশ্বের দরবারে শ্রদ্ধেয় করে তোলেন।


অধ্যাপক উষাকান্ত দত্ত দুঃখ করে বলেন, আচার্য ব্রজেন্দ্র নাথ শীল যত আলোচনা করে গেছেন, তত লিখে যাননি। আজকের প্রজন্ম শ্রী শীলের মেধা, জ্ঞানের ফসল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যতটা লেখা আছে, ইংরেজিতে আছে, সে সব বাংলায় অনুবাদের প্রস্তাব দেন ‘উত্তর প্রসঙ্গ’ গোষ্ঠীকে। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আনন্দ গোপাল ঘোষের মতে, স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠের জন্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের জন্য নিজেদের অমর করতে পেরেছেন। সাথে তাঁদের রচনাবলীও আছে। কিন্তু আচার্য ব্রজেন্দ্র নাথ শীল এসব ব্যাপারে মনোযোগী ছিলেন না। তাই আধুনিক প্রজন্ম আচার্যকে ভুলতে বসেছে।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆





No comments: