∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆ আলোচনা পর্ব -১০
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷!!!!!!!!!!¡!!!!¡!÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷ Doinik Sabder Methopath
Vol -155.Dt -09.10.20
২২ আশ্বিন,১৪২৭.শুক্রবার
===========!!!!!!!!!!!!!!!!==============
জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড
শিবাংশু দে
বাংলায় একটা শব্দ আছে, 'ট্র্যাডিশনাল', অর্থাৎ শিল্পের আদিরূপের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রবণতা। আমার কিন্তু মনে হয় 'ঐতিহ্য' ব্যাপারটি নদীর মতো বহমান। তার প্রতিটি ঘাটের নিজস্ব ট্র্যাডিশন রয়েছে এবং সেটা সময় নিরপেক্ষ। তার প্রাসঙ্গিকতা শুধু মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারার প্রয়াস থেকেই বিচার্য হওয়া উচিত। গঙ্গোত্রীর ঐতিহ্য বা গঙ্গাসাগরের ঐতিহ্য, দুয়েরই নিজস্ব গরিমা রয়েছে। তাদের সার্থকতা মানুষের তৃষ্ণাকে নিবারণ করতে পারার ক্ষমতা থেকেই নির্ধারিত হয়। এই কথাগুলি এই জন্য মনে এলো যে এই পাঁচজন শিল্পী নিঃসন্দেহে এই অর্থে ট্র্যাডিশনাল এবং তাঁদের রসসৃজনের ক্ষমতা ও মানুষের শিল্পতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করতে পারার জাদু, বহু যুগ পেরিয়ে এসে, আজও সমঝদার শ্রোতার কাছে সমান প্রাসঙ্গিক। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে এই সব শিল্পীদের বৃহত্তর শ্রোতাদের সামনে গান শোনাবার সুযোগ হয়নি। মুষ্টিমেয় কিছু রসগ্রাহী শ্রোতা এবং ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত আগ্রহী রসিকবর্গ ব্যতিরেকে এঁদের গান শোনার অবসর ইতর সাধারণের ঘটেনি। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে উপাসনামন্দির বা অভিজাতবর্গের বৈঠকখানা থেকে সর্বশ্রেণীর শ্রোতাদের নাগালে নিয়ে আসার কাজটি করেছিলেন অন্য কেউ।
'... কোন রাতের পাখি গায় একাকী, সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে'
পৃথিবীর যেকোন বনেদি ভাষায় শব্দ উচ্চারণ থেকে বক্তা'র শ্রেণী নির্ধারণ করা হয়। সংস্কৃতে 'অশুদ্ধ' অর্থাৎ যথেষ্ট আর্ষ নয়, এমন উচ্চারণকে শূদ্রের স্তর দেওয়া হতো। এমনটিই ছিলো লাতিনে বা ফার্সিতে। পরবর্তী ঔপনিবেশিক কালে এই প্রবণতাটি ইংরিজি ও ফরাসি ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যেও দেখতে পাই। লোকে বলে, শেক্সপিয়রের সময় ইংরিজি উচ্চারণ নিয়ে তত মাথাব্যথা ছিলোনা, যেমন দেখা যায় মহারানী ভিক্টোরিয়ার সময়কালে। ফরাসি বিপ্লবের সময়ও মৌখিক শব্দের উচ্চারণ দিয়ে 'শোষক' ও 'শোষিতে'র ফারাক করার প্রয়াস হতো। অর্থাৎ চিরকালীন অভিজাত আর ইতরজাত'র বিভেদ। এই ধরণের স্বীকৃতির কাঠিণ্য ভাষাগুলির বানানপদ্ধতির ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। এই কাঠিণ্য বস্তুতঃ শাসকের (পড়ুন অভিজাতর) জেদ। যে জাতি যতো বেশি প্রাকৃত সম্পদ লুটতে পারে, তার তত অধিক বলের অভিমান। ঔপনিবেশিক অভিজাতর বানান, উচ্চারণ, উপস্থাপনার প্রতি ইতরজাত সদা সন্দিগ্ধ ও বিপ্রতীপ। কাব্যের মর্মবাণী যেহেতু শব্দ আশ্রিত এবং শব্দের আত্মা যেহেতু উচ্চারণে, তাই কোনও শ্রাব্য কাব্যসৃষ্টিই মূলশব্দের স্বীকৃত উচ্চারণ ভঙ্গিকে অস্বীকার করে ধরা দেবেনা। অন্যপক্ষে দৃশ্যশব্দের কাব্যপাঠে স্বীকৃত বানানশৈলীর গুরুত্ব অপরিসীম। উভয় নিরিখেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের 'শুদ্ধতা' স্বীকৃত উচ্চারণ ও বানান শৈলির প্রতি দায়বদ্ধ। যেকোনও ভাষার মতো বাংলাতেও উচ্চারণ ও বানান পরস্পর নির্ভরশীল।
এখন প্রশ্নটি হচ্ছে কোনও শব্দের বানান উচ্চারণভিত্তিক হবে না তার আনুগত্য উৎস শিকড়ের প্রতি অধিক থাকবে। এই অনুপাতের কার্যকারণ সম্পর্কের উপরেই শব্দের ও উচ্চারণের শরীর নির্ভর করে। জোড়াসাঁকো দ্বীপের বাইরের কোলকাতায় যে বাংলা ব্যবহৃত হতো, জোড়াসাঁকোর লোকজন তা সযত্নে পরিহার করে চলতেন। যার পরিচয় কালী সিংহি থেকে নরেন দত্ত, সবার লেখাতেই পাওয়া যায়। কারণ 'জোড়াসাঁকো', 'রাঁড়ি-বাড়ি-জুড়িগাড়ি'র কোলকাতায় এক টুকরো য়ুরোপীয় উপনিবেশ। সেখানে উপনিষদও চর্চা হতো য়ুরোপীয় পণ্ডিতদের 'বৈজ্ঞানিক' নিষ্ঠায়। তাই আজ যে ভাষাকে 'বাংলা' বলা হয় তার সৃজক দুজন বঙ্গভাষী য়ুরোপীয়। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। আমি সচেতনভাবে এ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের নাম নিচ্ছিনা, কারন তিনি ছিলেন গঙ্গোত্রীর উৎস, নদী হতে পারেননি। ঠাকুরবাড়ির 'বাংলা' উচ্চারন তাই শিমলা-গরানহাটা- ঠনঠনের উচ্চারন থেকে ভিন্ন। এর পিছনে ব্রাহ্মসমাজি শ্রেণীসচেতনতাও কাজ করেছে। বরিশালের ব্রাহ্মরাও 'জোড়াসাঁকো'র বাংলায় কথা বলতে প্রয়াস পেতেন। বাংলাভাষাকে একটি আধুনিক অগ্রসর মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপীয়, মূলত ইংরিজি, structured ব্যবস্থাটির শরণ নেন। এটি মূল সংস্কৃত বানান ও ব্যাকরণ পদ্ধতির থেকে পৃথক। এই কারণে হিন্দি বানান ও উচ্চারণ অনেক বেশি সমগোত্র, কিন্তু বাংলা বানান ও উচ্চারণ ইংরিজির মতো বহুরূপী। রবীন্দ্রসংগীতের উচ্চারণ প্রকরণে এই সব নানা কার্যকারণ কাজ করেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথমযুগের স্বরলিপি যাঁরা করেছেন, জ্যোতিরিন্দ্র, ইন্দিরা বা দিনু ঠাকুর, তাঁরা তো ঐ পারিবারিক ব্যবস্থারই অঙ্গ।
পরবর্তীকালে শৈলজারঞ্জনের শিক্ষাও তো ইন্দিরাদেবীরই পথানুসারী। তাই স্বরবিতানে অ-কার ও ও-কারের যে দিশানির্দেশ আছে তার উৎসও এই নিয়মেরই অন্তর্গত। সম্প্রতি একজন প্রতিষ্ঠিত সুগায়িকা বন্ধুর (যাঁর শিক্ষা কোলকাতায় অনেক গুণীজনের কাছে) সঙ্গে 'বিজনঘরে' প্রসঙ্গে অনেক আলোচনা হলো। সেখানে সব সম্ভাব্যতা, যেমন বিজন (হসন্ত), বিজন(অ) বা বিজনো, নিয়েই কথা হলো। তাতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হলো যে উচ্চারনটা বিজন(অ) হওয়াটাই সমীচীন, তবে ঘাতটা তীব্র হবেনা, মৃদু হওয়াই কাম্য। কিন্তু কিছু সেরা শিল্পীরা ব্যতিক্রমও তো আছেন।
আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত মানে নিজের সঙ্গে কথা বলা। তাই সততা ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনও অঙ্গকেই ঠিক আত্মস্থ করা যায়না। এই বিষয়টি কথা, উচ্চারণ, সুর বা গায়ন, সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতোগুলি সূক্ষ্ম লক্ষণকে সঠিক মাত্রায় আয়ত্ব করে রস উপভোগ করার জন্য যে প্রস্তুতি লাগে, তা বৃহত্তর শ্রোতামণ্ডলীর নাগালের বাইরে। আমজনতার কাছে শোনার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। 'কানে' শুনে 'ভালো' না লাগলে তাঁদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বিজড়িত থাকার কোনও গরজ নেই। শব্দঝংকারের ক্ষেত্রে , দৈনন্দিন পথেঘাটে শোনা উচ্চারণধ্বনির সঙ্গে কোনও ব্যতিক্রম হয়ে গেলেই, তাঁরা বিযুক্ত হয়ে যা'ন। এ ভাবেই কয়েকজন প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের ক্ষেত্রেও অভিযোগ আসে, তাঁরা 'চিবিয়ে' শব্দ উচ্চারণ করেন। এটা যতোটা ব্যক্তিস্তরের অরুচি, তা'র থেকে অনেক বেশি ইতরজাত'র আপত্তি। একালে কণিকা বা নীলিমার বা অন্য কোনও সিদ্ধ শিল্পীর প্রতিও এই অভিযোগ শোনা যায়। আবার জর্জদা'র গানে আকাশ 'ভওরা' উচ্চারণ বিতর্কটি মনে পড়ছে সুভাষ চৌধুরী মশাইয়ের বক্তব্য ছিলো, যেটা এক্ষণের ( পরে আজকাল কাগজেও) জন্য রায়মশাইয়ের সাক্ষাৎকার নেবার সময় তিনি উল্লেখ করেছিলেন।
সুচিত্রার উচ্চারণের প্রতি বৃহত্তর শ্রোতৃকূল অতি প্রসন্ন, আবার অনেক 'সমঝদার' তাঁর উচ্চারণে অকারণ অতিরিক্ত শ্বাসাঘাত প্রয়োগে কখনো অস্বস্তি বোধ করেন। তবে শ্রোতা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঠিক কোন ধরনের উচ্চারণে আশ্বস্ত বোধ করবেন? এর কোনও প্রশ্নাতীত সমাধান নেই। তবে স্পষ্ট ও প্রযুক্ত শব্দগুলির গভীরতর ইঙ্গিতের প্রতি যথোচিত সম্মান জানিয়ে যে উচ্চারণ, তার আবেদন সচরাচর ব্যর্থ হয়না। কিন্তু কণিকা তো সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন, তবু এক শ্রেণীর শ্রোতার কেন এই অনুযোগ? একজন বলেছিলেন, কণিকার গায়নভঙ্গি মাত্রাতিরিক্ত 'কোমল', একটু আদুরে, ললিত সমর্পণে অতি নিবেদিত। রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একটু বেমানান। আমি ঠিক নিশ্চিত ন'ই এটাই যথার্থ কারণ কি না।
সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ''..... সকলের উচ্চারণ শুনে নিশ্চয়ই আমার ভাল মনে হয়না। স্পষ্ট উচ্চারণই অনেকে করেনা। কয়েকজন - সুচিত্রা-টুচিত্রা আছে, যারা ভাল গাইয়ে - তাদের মধ্যে উচ্চারণটা বোধ হয়..... সুচিত্রার উচ্চারণ খুব পরিষ্কার। '' তখন প্রশ্ন ওঠে সুচিত্রা 'সন্ধ্যা' শব্দটি 'স(অ)ন্ধ্যা' উচ্চারণ করেন, কিন্তু ব্যাকরণের নির্দেশ অনুযায়ী তা 'সোন্ধ্যা' হওয়া উচিৎ ছিলো। তখন সত্যজিৎ বলেন 'স(অ)ন্ধ্যা' উচ্চারণটি 'খুবই খারাপ'। আরও বলেন,''.....In general, বাচনভঙ্গিটা খারাপ হয়ে গেছে।.... বাংলা উচ্চারণের সেই awarenessটা অনেকটা চলে গেছে।....উচ্চারণটি সেখানে অঙ্গ ছিলো শিক্ষার। এখন সে পরিমাণে মোটেই নেই। যে জন্য সেটা গানেও reflected হচ্ছে।''
'চিবিয়ে' অর্থাৎ শব্দগুলিকে ঈষৎ চেপে বঙ্কিমভঙ্গিমায় উচ্চারণ করার প্রবণতা, যা তৎকালীন অন্যান্য বাংলাগানের গায়কির অঙ্গ ছিলো, আমরা রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে প্রথমদিকের কিছু প্রধান শিল্পীদের গানের মধ্যে পাই। পথিকৃৎ হিসেবে এঁরা নমস্য, কিন্তু এখন আমরা এ ব্যাপারটি হয়তো পছন্দ করিনা। রুচি তো বদলাতে থাকে। এঁদের মধ্যে কনক দাসও ছিলেন, কিন্তু কণিকার গায়নশৈলি ও শব্দোচ্চারণ ছিলো একান্ত নিজস্ব, নিবেদিত ও তল্লীন।
============≠====!!!!!!!!!!!!!÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
No comments:
Post a Comment