Monday, 30 November 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

                 জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য

                   কবিগণেশ বসু

============✓✓✓✓===============

     Doinik Sabder Methopath

    Vol -207. Dt -01/12/2020

     ১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭. মঙ্গলবার।

÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷®®®®÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

সমাজ সচেতন কবি গণেশ বসু ষাটের দশকের উল্লেখযোগ্য শক্তিমান ব্যক্তিত্ব। প্রেমের কবিতায় সমাজ রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক বাস্তব প্রেক্ষাপট নিয়ে কবিতা রচনায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ‌ পেশায় অধ্যাপক তিনি সাংবাদিকতায় সংগঠনে মিছিলে হাঁটায় অনন্য স্বাক্ষর রেখেছেন।

                কবি গণেশ বসু ১৯৪০ সালে ১ লা ডিসেম্বর জন্মগ্রহন করেন অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলার দেহেরগতি গ্রামে, মামার বাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বরিশালেরই চাঁদশি গ্রাম। গণেশ বসুর ঠাকুরদা অন্নদাচরণ বসু মজুমদার ছিলেন জমিদার। তাঁর পঞ্চম পুত্র সুমন্তনাথ বসু মজুমদার হলেন কবির পিতা। মাতার নাম পারুলদেবী। দেশভাগের পর সুমন্তনাথ বসু মজুমদার সপরিবারে ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। শরণার্থী হিসেবে দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে তাঁদের দিন কাটে। পরিবারের কিছুটা আর্থিক সুরাহা করতে কবিও ছেলেবেলা থেকেই কাজে নেমে পড়েন। প্রথমদিকে ঠোঙা বানিয়ে দোকানে বিক্রি করতেন, তারপর টিউশন পড়ানো শুরু করেন।

শিক্ষা ও কর্মজীবন :

গণেশবসুর পড়াশোনা শুরু হয় দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনে। তারপর চারুচন্দ্র কলেজে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাস করেন। তিনি কিছুকাল 'অমৃত' সাপ্তাহিকে কাজ করেছেন। পরে ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন।

মতাদর্শ ও সাহিত্যাদর্শ

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও হয়েছিলেন। কবিতায় তাঁর এই মতাদর্শের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। খাদ্য আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা 'সমুদ্রমহিষ' কবিতাটি তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। 

" ছুটে চলে, কেউ খোঁজে কঙ্কালের কঠিন বিবর

বিমিশ্র হৃদয়ে শুধু অসহায় আর্তনাদ, আর 

ঊর্ণাজাল উত্তর-দক্ষিণে -

এখন রক্তের মধ্যে শ্বাস ফেলে দুরন্ত মহিষ."

           এই কবিতাটি পড়ে স্বয়ং বিষ্ণু দে একটি আস্ত কবিতা লিখে কবিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

" মাঝে মাঝে ক্ষেপে ওঠে শিরাস্ফীত সমুদ্রমহিষ

  তোমার কবিতা উঠে জ্বলে জ্বলে ফসফরাস রাশি 

রক্তে টান প্রবণতা, বিস্ফোরণ ঘটে যায় যেন ..."

                   কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত 'স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় কবিতা'(১৯৭৩) শীর্ষক কাব্য সংকলনে কবিতাটি স্থান পেয়েছিল। এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠক্রমেও এটি ছিল একসময়।

সাহিত্যকর্ম :

গণেশ বসুর মোট কাব্যগ্রন্থ ১২টি।

  • বনানীকে কবিতাগুচ্ছ (প্রথম কাব্যগ্রন্থ: ১৯৬৪)
  • নিজের মুখোমুখি (১৯৬৭)
  • রক্তের ভিতরে রৌদ্র (১৯৬৯)
  • অধিকার রক্তের কবিতার (১৯৭০)
  • অমৃত আস্বাদে মৃত্যু বাংলাদেশ (১৯৭১)
  • বাঘের থাবার নিচে (১৯৮২)
  • নীরব সন্ত্রাস (১৯৯৯)
  • অন্ন অশ্রু ভায়োলিন (২০০৫)
  • ভাসান দরিয়া (২০০৮)
  • ভাঙা বইঠার গান (২০১১)
  • বর্ণময় পৃথিবী (২০১৩)
  • বলগা হরিণের শিং (২০১৫)
  • নরকরোটিতে প্রজাপতি (প্রবন্ধগ্রন্থ, ২০১১


  • পুরস্কার ও সম্মাননা :

  • গণেশ বসু ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গলাচরণ স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন।                           - কবির সামগ্রিক মূল্যায়নে কবি তরুণ সান্যাল লিখেছেন  " সব কবিতাই যেহেতু প্রেমের আর্তিতে মুখর, বলা যেতে পারে এই তরুণ কবি নতুন কবিতার গড্ডল ধারায় হারিয়ে যাননি। অন্য বহু তরুণ যখন রমণীর প্রতারণাকে মুখ্য করে পৃথিবীর দিকে তাকান,  তখন গণেশ বসু পৃথিবী ও সমাজের ম্লনতার জন্যই প্রেমের পরাজয় দেখেন। কবি প্রেম ও শিল্পীকে এক কেন্দ্রে আনতে চেয়েছেন। শিল্প ই প্রেম  এবং প্রেম‌ই শিল্প।"
  • আবার আলোচক পবিত্র মুখোপাধ্যায় বলেছেন " গণেশ বসুর কবিতার প্রাণশক্তি এইখানে বিশ্বাস ও আচরণে তিনি সৎ নিজের সঙ্গে তার বোঝাপড়া এতই বিবেক সংগত  সেই মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য লড়াই করতে তিনি পিছপা নন এই বিশ্বাস তাঁর কবিতার অন্তর শক্তি, সৃষ্টির ও সমৃদ্ধির অন্তর্গত প্রেরণা এবং প্রাণশক্তি।"।    আজীবন প্রশ্ন রেখে যান, সহৃদয় পাঠকের কাছে -।                                                       "এভাবে কি বাঁচা যায় ? একে কি জীবন বলো তুমি ? নীরব সন্ত্রাস চলে চরাচরে , মাথার ভিতরে দ্রোহ জ্বালা                 গুঢ়তর অভিমান পায়ে পায়ে শিকলের শব্দ জাগে ,                                              পরতে পরতে ভালোবাসা ভেঙে ভেঙে মেঘের বিষাদ বাজে।                            কাঁদে একা একা হাহাকার দিনগুলি      বান্ধব বিহীন। "।                                           বোধে - বিশ্বাসে ,অন্তর শক্তিতে, সমৃদ্ধিতে অধ্যাপক কবি সম্পাদক সংগঠক আজও জীবন সংগ্রামে বেঁচে আছেন. লেলিনের যুগে প্রথম শতবর্ষে কাজ করেছেন পূর্ণেন্দু পত্রীর সঙ্গে. প্রখ্যাত দিয়া প্রকাশনী তাঁর সাহিত্যকর্ম সুন্দরভাবে মুদ্রণ করেছেন। বহু ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এই কবি বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান অনন্য প্রতিভা। আজীবন সংগ্রামের পথে চলেছেন।
  • ∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Sunday, 29 November 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু
কবি সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু
=================================
Doinik Sabder Methopath
Vol -207. Dt -30.11.2020
১৪ অগ্রহায়ণ,১৪২৭. সোমবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

লবার্ট আইনস্টাইন ” বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু ” সম্পর্কে নিজেই বলেছেন :“জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত ”


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ” বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ” সম্পর্কে বলেছেন:“ ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ ”



জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহে [ ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের ময়মনসিংহে] জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু গিরিডিতে মারা যান। তাঁর পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত বিক্রমপুর পরগণার রাঢ়িখাল গ্রামে। তাঁর বাবা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন তৎকালীন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। এখানকার শিক্ষা সমাপ্ত করে সেন্টজেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। তার পিতা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এর পূর্বে তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভগবান চন্দ্রই এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তিতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন।

ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। তখনকার বা এখনকার দিনেও সন্তানকে ইংরেজি স্কুলে পড়ানো ছিল উচ্চ সামাজিক মান-মর্যাদার বিষয়। তাই ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে জগদীশ চন্দ্র বসু যে ইংরেজি স্কুলে যাবেন, এটা তো জানা কথা। কিন্তু ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ, তিনি চাইতেন ইংরেজি শেখার আগে উনার সন্তান ভালো করে মাতৃভাষা শিখুক আর সন্তানের মধ্যে অল্পবয়সেই দেশপ্রেম গড়ে উঠুক। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তার প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো পড়লে সহজেই বোঝা যায়। তাঁর পিতার এই চেষ্টা যে বিফলে যায়নি তার প্রমাণ জগদীশ চন্দ্র বসুর পরবর্তী জীবনের নানান ঘটনাবলী। মায়ের হাতেই শিশু জগদীশের হাতেখড়ি হয়েছিল।

গ্রামের বিদ্যালয়ে সব স্তরের ছেলের সাথে মিলে-মিশে ছোট্ট জগদীশ বড় হতে লাগলেন। ভাবুক এই ছেলে প্রতিদিন বিকালে নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির হতো আর আপনমনে গাছদের দেখত, আর চিন্তা করত বসে বসে।

বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব যুক্তি ছিল। তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ত করা উচিত। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করেছে। এর প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো। ভাষার প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ ছাড়াও ভগবান চন্দ্র চেয়েছিলেন তার পুত্র দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে মিলেমিশে মানুষ হোক এবং তার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক। জগদীশ চন্দ্রের পরবর্তী জীবনে তাঁর প্রথম বাংলা স্কুলের অধ্যয় গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছিল।

গ্রামের স্কুলে পড়ার পাট চুকিয়ে জগদীশ কলকাতায় গেলেন উচ্চ শিক্ষার জন্য। সেখানে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে  বিএ পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াকালীন ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক তাকে খুব স্নেহ করতেন, তার কারণেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর জগদীশের আগ্রহ সৃষ্টি হয় জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজী হননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র একজন বিদ্বান হোন।

বাবার ইচ্ছা ও তার আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান, কিন্তু অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসুর আনুকুল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন। কেম্ব্রিজে জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস মেটল্যান্ড বালফুর, সিডনি ভাইনসের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানসাধকেরা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জগদীশ চন্দ্র ভারতে ফিরে আসেন। তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল জর্জ রবিনসন, প্রথম মার্কুইস অব রিপন অনুরোধে স্যার অ্যালফ্রেড ক্রফট বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি এই নিয়োগের বিপক্ষে ছিলেন। শুধু যে তাঁকে গবেষণার জন্য কোন রকম সুবিধা দেওয়া হত না তাই নয়, তিনি ইউরোপীয় অধ্যাপকদের অর্ধেক বেতনেরও কম অর্থ লাভ করতেন। এর প্রতিবাদে বস্য বেতন নেওয়া বন্ধ করে দেন এবং তিন বছর অবৈতনিক ভাবেই অধ্যাপনা চালিয়ে যান। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রতিবাদের ফলে তাঁর বেতন ইউরোপীয়দের সমতুল্য করা হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণার কোন রকম উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় ২৪-বর্গফুট (২.২ মি২) একটি ছোট ঘরে তাঁকে গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে হত। পদে পদে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁর বিজ্ঞান সাধনার ও গবেষণার একজন দিকপাল হিসেবে উঠে আসেন।


প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ যে সকল গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে। এই গবেষণাগুলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিচার করতে হবে। প্রতিদিন নিয়মিত ৪ ঘণ্টা শিক্ষকতার পর যেটুকু সময় পেতেন তখন তিনি এই গবেষণার কাজ করতেন। তার উপর প্রেসিডেন্সি কলেজে কোন উন্নতমানের গবেষণাগার ছিলনা, অর্থ সংকটও ছিল প্রকট। সীমিত ব্যয়ে স্থানীয় মিস্ত্রীদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে তিনি পরীক্ষণের জন্য উপকরণ প্রস্তুত করতেন। তার এই গবেষণা কর্মগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি বহু স্থান থেকে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ পান। এর মধ্যে ছিল রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। সফল বক্তৃতা শেষে ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সস্ত্রীক দেশে ফিরে এসেছিলেন।

বিবাহ ও বাক্তিগত জীবন : ১৮৮৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে অবলাদেবীর বিয়ে হয়। অবলা দেবী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা। বিয়ের আগে অবলা বসু কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চাইলেও তাকে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি, কারণ সেখানে তখন মেয়েদের পড়ানো নিষেধ ছিল। ১৮৮২ সালে বঙ্গ সরকারের বৃত্তি নিয়ে অবলা মাদ্রাজে যান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে আবার ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাদের বিয়ের সময় জগদীশচন্দ্র বসু আর্থিক কষ্টের মধ্যে ছিলেন। এর মধ্যে আবার তিনি তখন কলেজ থেকে বেতন নিতেন না। এছাড়া জগদীশের বাবার কিছু ঋণ ছিল যার কারণে তার পরিবারকে পথে বসতে হয়। এর মধ্য থেকে অবলা দেবী ও জগদীশ চন্দ্র বসু অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসেন এবং সব ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হন। সব ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কিছুদিন মাত্র বসুর পিতা-মাতা জীবিত ছিলেন।

গবেষণা : জগদীশের আঠারো মাসের সেই গবেষণার মধ্যে মুখ্য ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোন তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞনী হের্‌ৎস প্রতক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এ নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন যদিও শেষ করার আগেই তিনি মারা যান। জগদীশচন্দ্র তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাউক্রোওয়েভ। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্‌স”। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা পরীক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত করে। অশীতিপর বৃদ্ধ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বক্তৃতা শোনার পর লাঠিতে ভর দিয়ে এসে জগদীশের স্ত্রী অবলা বসুকে তার স্বামীর সফলতার জন্য অভিবাদন জানান। জগদীশ এবং অবলা দু’জনকেই তিনি তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এই বিষয়ের উপর বিখ্যাত সাময়িকী “টাইম্‌স”-এ একটি রিপোর্ট ছাপা হয় যাতে বলা হয়, “এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, কেমব্রিজের এম.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অফ সাইন্স এই বিজ্ঞানী বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন সম্পর্কে যে মৌলিক গবেষণা করেছেন, তার প্রতি ইউরোপীয় বিজ্ঞানী মহলে আগ্রহ জন্মেছে। রয়্যাল সোসাইটি বিদ্যুৎরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়ের গবেষণাপত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।”

লিভারপুলে বক্তৃতার পর তার আরও সাফল্য আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে সান্ধ্য বক্তৃতা দেয়ার নিমন্ত্রণ। এই বক্তৃতাটি আনুষ্ঠানিকভাবে “ফ্রাইডে ইভনিং ডিসকোর্স” নামে সুপরিচিত ছিল। এই ডিসকোর্সগুলোতে আমন্ত্রিত হতেন একেবারে প্রথম সারির কোন আবিষ্কারক। সে হিসেবে এটি জগদীশচন্দ্রের জন্য একটি দুর্লভ সম্মাননা ছিল। ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি ১৯ তারিখে প্রদত্ত তার এই বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস” তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন। এই বক্তৃতার সফলতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বায়ুতে উপস্থিত বেশ কিছু বিরল গ্যাসের আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র‌্যালে তার বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে এতোটাই বিস্মিত হয়েছিলেন তার কাছে সবকিছু অলৌকিক মনে হয়েছিল। তিনি এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি- এ যেন মায়াজাল”। এই বক্তৃতার সূত্র ধরেই বিজ্ঞানী জেমস ডিউয়ার-এর সাথে জগদীশচন্দ্রের বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। ডিউয়ার গ্যাসের তরলীকরণের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত। এই বক্তৃতা সম্বন্ধে “স্পেক্টেটর” পত্রিকায় লিখা হয়েছিল, “একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন- এ দৃশ্য অভিনব।”

এই বক্তৃতার পর ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে আমন্ত্রণ আসে এবং তিনি সেখানে কয়েকটি বক্তৃতা দেন। সবখানেই বিশেষ প্রশংসিত হন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হয়ে যায় এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতি Société de Physique [ Professional society of French physicists & it was founded in 1873 by “Charles Joseph d’Almeida”. ] -এর সদস্য মনোনীত হন।

তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :


রেসপন্সেস ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন-লিভিং (১৯০২), [Responses in the Living and Non-living (১৯০২) ]


মহাবিজ্ঞানী , আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু


প্লান্ট রেসপন্সেস এজ এ মিনস অব ফিজিওলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশনস (১৯০৬), [Plant Responses as a Means of Physiological Investigations (১৯০৬)]

কম্পারেটিভ ইলেকট্রফিজিওলজি (১৯০৭), [Comparative Electrophysiology (১৯০৭)]

ফিজিওলজি অফ দ্য আসেন্ট অফ সএপ (১৯২৩),[ Physiology of the Asent of Sap (১৯২৩)]

ফিজিওলজি অফ ফটোস্যাথেসিস (১৯২৪), [Physiology of Photosynthesis (১৯২৪)]

নার্ভাস মেকানিজম অব প্লান্টস (১৯২৫), [Nervous Mechanism of Plants (১৯২৫)]

কালেক্টেট ফিজিক্যাল পেপার্স (১৯২৭),[Collected Physical Papers (১৯২৭)]

মটর মেকানিজম অব প্লান্টস (১৯২৮) , [Motor Mechanism of Plants (১৯২৮)]

গ্রোথ এন্ড ট্রপিক মুভমেন্ট ইন প্লান্টস (১৯২৯), [Growth and Tropic Movement in Plants (১৯২৯)]

others

নাইটহুড, ১৯১৬

রয়্যাল সোসাইটির ফেলো, ১৯২০

ভিয়েনা অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স-এর সদস্য, ১৯২৮

ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর ১৪তম অধিবেশনের সভাপতি, ১৯২৭

লিগ অফ নেশনস কমিটি ফর ইন্টেলেকচুয়াল কোঅপারেশনের সদস্য

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ফেলো। এর বর্তমান নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি।

  মৃত্যু : নভেম্বর ২৩, ১৯৩৭।

এক জন বাঙালি পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ ও জীববিজ্ঞানী এবং প্রথম দিকের এক জন কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা। তাঁর গবেষণা উদ্ভিদবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা করে। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে রেডিও বিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করে।


======={{============{{{===========


বুদ্ধদেব বসু

জন্ম ১৯০৮-এর ৩০শে নভেম্বর কুমিল্লায়- আজকের বাংলাদেশে। আদিনিবাস ছিলো ঢাকা জেলার মালখানগরে। ছোটো থেকেই অসম্ভব মেধাবী। ১৯২৫-এ ঢাকা বোর্ডের ম‍্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগের পঞ্চম স্হান দখল করেন। কিন্তু বিস্ময়ের এই যে, তার একবছর আগেই প্রকাশিত হয়েছে নিজস্ব প্রথম কাব‍্যগ্রন্হ ‘মর্মবাণী‘। এরপর ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। সেখানে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্হান অধিকার করে পান মাসিক কুড়িটাকা বৃত্তি।


   বুদ্ধদেব পরে লিখেছেন, ‘মাসিক কুড়ি টাকা মানে মাসিক কুড়ি টাকাই। বন্ধুরা মিলে স্হির করা গেলো, হস্তলিপি পত্রিকা আর নয়, এবারে একটি মুদ্রাযন্ত্র-নিঃসৃত দস্তুরমাফিক মাসিকপত্র চাই।‘ এই উল্লাসের ফলশ্রুতিতেই ‘প্রগতি‘ মাসিকপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । যার সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্ত-র ।


   বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ঢাকার পুরনো পল্টন রমনার গাছপালা-রাস্তাঘাট, প্রকৃতি বারেবারেই উঠে এসেছে, শুধু তাঁর স্মৃতিচারণায় নয়, তাঁর গল্প-উপন্যাসের বিভিন্ন পৃষ্ঠাতেও। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন- প্রচুর ছাত্র, কয়েকজন মাত্র ছাত্রী- অধ্যাপকদের পেছন পেছন সারিবদ্ধভাবে তাঁদের লেডিস কমনরুম থেকে আসা আবার ক্লাস শেষে ঐভাবেই ফেরত যাওয়া- এই ছবিটিও বেশ প্রভাব ফেলেছিল ওই তরুণ মনে।


   ‘প্রগতি‘ প্রকাশের অনেক আগে থেকেই বুদ্ধদেব ‘কল্লোল‘-এর নিয়মিত লেখক। সদ‍্যকৈশোর উত্তীর্ণ ভাববিলাস,তারুণ্যের চাঞ্চল্য, বিদ্রোহ ও স্বপ্নদর্শন-প্রবণতার দিক দিয়ে তিনিও তখন অপরাপর কল্লোলীয়ের সহধর্মী । রবীন্দ্রনাথকে আদ‍্যোপান্ত পড়ে ফেলার চেষ্টা ও তারপর সাহিত্যে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগ আনার চেষ্টাকে যদি রবীন্দ্র-বিরোধিতা বলা যায় তবে এই তরুণদল সেই পথেরও অভিসারী । সহযোগী অচিন্ত্যকুমারের ভাষায়- ‘কল্লোলের সে যুগটাই সাহসের যুগ, সে সাহসে রোমান্টিসিজমের মোহ মাখানো‘ ।


   পরবর্তীতে এই কল্লোল যুগের উন্মাদনা নিয়েই বুদ্ধদেব লিখবেন- ‘An Acre of Green Grass’ (1948), আর আরও অনেক প্রবন্ধ। এরমধ্যেই থাকবে সেই সময়কার রবীন্দ্র-অনুসারী কবিদের প্রতি সেই অমোঘ মূল‍্যায়ন- ‘তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ, এবং অসম্ভব ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ‘।


   অথবা কে ভুলতে পারেন বুদ্ধদেবের সেই স্পর্ধিত উচ্চারণ, যা প্রকাশিত হয়েছিল ওই পত্রিকাতেই ১৯২৭সালে- ‘আমরা মোটের ওপর অনেক বেশি rational হয়েছি, অন্ধভক্তির উপর আমাদের আর আস্হা নেই; আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি বিজ্ঞানকে। ভগবান, ভূত ও ভালবাসা- এই তিনটি জিনিসের উপর আমাদের প্রাক্তন বিশ্বাস আমরা হারিয়েছি ।‘


   এরসঙ্গেই এই গোষ্ঠীর ওপর পড়েছিল ফ্রয়েড ও তাঁর অনুসারী অ্যাডলার, ইয়ুং বা হ‍্যাভলক এলিসের মনোবিকলন তত্ত্বের প্রভাব যা তাঁদের সাহিত্যকে পূর্ববর্তীদের চেয়ে করে তুলেছিল অনেক বেশি বাস্তবানুগ এবং ইন্দ্রিয়-নির্ভর । ‘প্রথমা‘ কাব‍্যের ‘মানে‘ কবিতায় প্রেমেন্দ্র মিত্র যখন ‘গোটা মানুষের মানে‘ খুঁজছেন ‘রক্তমাংস হাড় মেদ মজ্জা/ ক্ষুধা তৃষ্ণা লোভ কাম হিংসা সমেত‘; তখন বুদ্ধদেব একে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে লিখলেন, ‘মোরে দিয়ে বিধাতার এই শুধু ছিল প্রয়োজন / স্রষ্টা শুধু চাহে, এ বীভৎস ইন্দ্রিয় মিলন-/ নির্বিচারে প্রাণী সৃষ্টি করে থাকে যেমন পশুরা।‘ অনেকেই একে অশ্লীল বলেছেন।কিন্তু তবুও বুদ্ধদেব ‘সৃষ্টির অন্ধ প্রেরণাকে‘- ‘জন্ম-জন্মান্তরের প্রেম-সম্পর্ক‘ নাম দিয়ে পাঠকদের প্রতারিত করতে চাননি । বরং তিনি বললেন, ‘আমি যে রচিব কাব‍্য এ উদ্দেশ্য ছিলো না স্রষ্টার/তবু কাব্য রচিলাম এই গর্ব, বিদ্রোহ আমার‘।


   বুদ্ধদেব ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর এবং শেলি, কিটস, বায়রন বা সুইনবার্নের মতো কবিদের কবিতা চিরদিনই ছিল তাঁর খুব ভালোলাগার জায়গায়। কিন্তু কোনো বিশেষ কবির কবিতা যদি তাঁকে খুব বেশি আলোড়িত করে থাকে, তবে তাঁরা দুজন হলেন ফরাসি কবি বোদলেয়ার আর জার্মান কবি রিলকে – দুজনেই ইউরোপীয় কিন্তু কেউই ইংরেজি সাহিত্যের নন ।


   রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয়াকে দেখেছেন অদেহী রূপে- প্রকৃতির বিচিত্র মহিমায় তাঁর প্রিয়া মানসবাসিনী, স্বপনচারিণী। তুলনায় বুদ্ধদেবের নায়িকা রক্তমাংসের নারী । তাই তাঁদের নামকরণ-ও করেছেন অপর্ণা, মৈত্রেয়ী, অমিতা, রমা ও কঙ্কাবতী হিসেবে-


‘মাঝরাতে আজ বাতাস জেগেছে শুনতে পাও / কঙ্কাবতী !


এলো এলোমেলো ব‍্যাকুল বাউল উতল বাও / কঙ্কাবতী !


হাহাকার করে বেহায়া হাওয়ার বেহালাখানি / কঙ্কাবতী !‘


  দীপ্তি ত্রিপাঠীর মতে , ‘প্রকরণের দিক থেকে বলা যায়, জীবনানন্দের কবিতা যদি হয় চিত্রধর্মী এবং সুধীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণু দের কাব্য ভাবধর্মী, তবে বুদ্ধদেবের কাব‍্য কঙ্কাবতী হলো সঙ্গীতধর্মী।’


  আসলে প্রেমের যে দুটি পর্যায় আবেগের জন্ম দেয়- পূর্বরাগ ও মিলন, বুদ্ধদেব তার কবি।


তাঁর পরবর্তী কাব‍্যগ্রন্হগুলির মধ্যে ‘শীতের প্রার্থনা ও বসন্তের উত্তর‘ জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অনেকেই মনে করেন, ‘যে আঁধার আলোর অধিক‘ কে মনে করেন বুদ্ধদেবের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ‘। রিলকে যেমন ভেবেছিলেন যে, দেবোপম অর্ফিয়ুসের পক্ষেই সম্ভব চিরন্তনের সঙ্গে যোগসাধনা, দ্বিখণ্ডিত চেতনার অধিকারী সাধারণ মানুষের পক্ষে নয়, বুদ্ধদেব সেই অর্ফিয়ুসকে প্রত‍্যক্ষ করলেন আরেক দেবতার মধ্যে- তিনি বাঙালির কাছের দেবতা– রবীন্দ্রনাথ। অপর্যাপ্ত, চেষ্টাহীন, ভাস্বর রবীন্দ্রনাথ।


…‘তবু ছিলে প্রতিযোগিতা/পরপারে, বিশ্রামের শুভ্রতাময়, যেন তুমি কখনো করোনি / চেষ্টা, কিংবা যেন কলস গিয়েছে ভেসে, তুমি শুধু জল।/ যা পেয়েছি দু-দন্ড তোমার কাছে, নিঃশব্দে কেবল ‘।


এইভাবে প্রথমকাব‍্য থেকেই অজস্রবার রবীন্দ্র-অনুষঙ্গ ব‍্যবহার করেও কবি বুদ্ধদেব শামিল হয়েছিলেন যে রবীন্দ্র-অতিক্রমণের সাধনায়, শেষপর্যন্ত আবার এই প্রতীকের কাছে ফেরার মাধ‍্যমেই যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর রবীন্দ্রায়ণ।


   প্রেম যে নিন্দনীয় নয়, কিংবা ইন্দ্রিয়বিলাস দ্বারা যে তা আবিল নয়, কিংবা মরমীদের মতো যে সে শুধু ঈশ্বরের পথে সোপানের কাজ করছে না- এই কথাটি বুদ্ধদেব রোমান্টিকদের মতোই উপলব্ধি করেছেন। তাই লোকেরা যাকে ‘কাম‘ নাম দিয়ে নিন্দে করে থাকে, তারই প্রভাবে দুজন মানুষ, দুটি নর-নারী কেমন করে পুণ‍্যের পথে নিষ্ক্রান্ত হবে- শুদ্ধশীল এই উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা বুদ্ধদেবের- হয়তো রোমান্টিকদের- ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী‘, সেই অমৃতলাভের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।


   বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘কবিতায় আমি আত্মহারা হতুম, গল্প অনেকটা খেলার মতো ছিলো। হঠাৎ একদিন সে খেলা মারাত্মক হয়ে উঠল, যখন কল্লোলে আমার একটা গল্প বেরুল, যার নাম ‘রজনী হল উতলা‘। বুদ্ধদেবের বয়েস তখনও আঠারো হয়নি। সবচেয়ে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন মহিলারা। একজন বলেছিলেন, আঁতুড়ঘরে এই ছেলেকে নুন দিয়ে মেরে ফেলা হয়নি কেন? পরে বুদ্ধদেব নিজেই জানিয়েছেন, নবযৌবনে আদিরস একটু উগ্র হয়েই প্রকাশ পায়- এ গল্পেও তাই হয়েছিল। হয়তো সেই উল্লেখ আজকের দিনে আর ততোখানি অশ্লীল বলে মনে হবে না। যাইহোক, এই নিন্দা লেখককে দমিয়ে না দিয়ে সত্যিকারের আগ্রহ এনে দিল গল্প লেখায়।


   কিন্তু বিতর্ক ছাড়াল কই? ১৯৩২-এর ডিসেম্বরে ‘এরা আর ওরা এবং আরো অনেক‘ গল্পগ্রন্থ-এর জন‍্যেও আদালতে অভিযোগ উঠেছিল। আবার জীবনের উপান্তে এসে বেশ কয়েকদিন আদালতে যেতে হয়েছিল ‘রাত ভ‘রে বৃষ্টি‘ উপন্যাসের জন্য।


১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার নর্থব্রুক হলে বুদ্ধদেবের উপন্যাস ‘যেদিন ফুটল কমল‘- এর নাট‍্যরূপ মঞ্চস্হ হয় । যিনি নাট‍্যরূপ দিয়েছিলেন তাঁর নাম প্রতিভা সোম বা রানু। ঠিক পরের বছর এই রানুর সঙ্গেই বুদ্ধদেবের বিয়ে হবিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই পরিণয়-পর্বের দীর্ঘ বিবরণ আছে প্রতিভা বসুর আত্মজীবনী ‘সেদিনের আলোছায়া‘-তে। সঙ্গীত ও সাহিত্য উভয়ক্ষেত্রেই প্রতিভা ছিলেন অসামান‍্যা।পরবর্তীকালের পাঠক এই সাক্ষ্য-ই দেবেন।


   এর আগে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দেই বন্ধ হয়ে যায় ‘প্রগতি‘। ‘কল্লোল‘ও বন্ধ হয়ে যায় ওই সময়েই।বুদ্ধদেব ঢাকা ছাড়েন ১৯৩১-এ এবং ১৯৩৪-এই কলকাতার রিপন কলেজে ( আজকের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) অধ‍্যাপনায় যোগ দেন । এর ঠিক পরের বছর কবির সেই সময়কার বাসভবন- ভবানীপুরের ১২, যোগেশ মিত্র রোডের বাড়ি থেকেই প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ‘কবিতা‘ পত্রিকা। যার সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র, সহ-সম্পাদক সমর সেন। ১৯৪০ থেকে অবশ্য সম্পাদক হিসেবে শুধু বুদ্ধদেবের নাম-ই মুদ্রিত হতে দেখা যায়। ‘কবিতা‘ পত্রিকা বাংলাদেশে হয়ে ওঠে কবিদের আশ্রয়স্হল।


১৯২২ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত এই অর্ধশতাব্দী জুড়ে প্রচুর ছোটোগল্পের রচয়িতা বুদ্ধদেব। জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতি আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা- এই গল্পগুলোতে তীব্রভাবে উপস্থিত। অনেক গল্পে আবার প্রাধান্য পেয়েছে নস্টালজিক ভাবনা, কখনও তা মধুর , কখনও বেদনামিশ্রিত, কখনও বা একটু মন কেমন করা। নাগরিকতা বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, যেমন চিত্তের ঔদার্য ও প্রসার, ভাবলোকের স্বচ্ছন্দ বিহার বা শিল্পলোকের উদার আমন্ত্রণ– এইসবই তার ছোটোগল্পে লক্ষ্য করা যায় । আর একটা বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর গল্পের অনেক চরিত্রের-ই প্রিয় বিষয় সাহিত্য।অনেক চরিত্রের মধ্যে লেখকের আত্মজৈবনিক উপাদান খুঁজে পেতে পাঠকের অসুবিধা হয় না ।


   বুদ্ধদেবের উপন্যাসেও প্রেমেরই প্রাধান্য। ‘একদা তুমি প্রিয়ে‘, ‘তুমি কি সুন্দর‘ বা বিখ্যাত ‘তিথিডোর‘ উপন্যাস প্রেম-ই এখানে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে। মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনি অবলম্বনে তিনি বেশ কিছু কাব‍্যনাটকও রচনা করেছিলেন ‘কালসন্ধ‍্যা‘ , ‘অনাম্নী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থ‘ প্রমুখ । এছাড়াও ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী‘ , ‘পুনর্মিলন‘, ‘ইক্কাকু সেন্নিন‘ নাটকের রচয়িতাও তিনিই ।


   কিন্তু নাট‍্যরচনার চেয়েও বাংলাসাহিত‍্য বুদ্ধদেবকে মনে রাখবে প্রাবন্ধিক হিসেবে।আত্মজৈবনিক বেশ কিছু রচনাও তিনি লিখেছেন, যেমন লিখেছেন সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে। বস্তুত, তিরিশের দশকের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আজও মানুষ হাতে তুলে নেন ‘কালের পুতুল‘, ‘An Acre of Green Grass’প্রমুখ গ্রন্থ। আর লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। ‘রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য‘ বা ‘সঙ্গ ,নি:সঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ‘ গ্রন্থ দুটোই শুধু নয়, ‘রবীন্দ্রনাথ ও প্রতীচী‘,’রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক‘, ‘রবীন্দ্রনাথের গানে গদ‍্য ও পদ‍্য‘ প্রমুখ প্রবন্ধ আজও পাঠকের মনে উৎসাহের সঞ্চার করে। এর কয়েকটি প্রবন্ধ ‘সাহিত‍্যচর্চা‘ গ্রন্থেও স্হান পেয়েছে। আর জীবনের একেবারে শেষতম বছরে প্রকাশিত হওয়া ‘মহাভারতের কথা‘ আজও পাঠককে নতুন দৃষ্টিতে মহাভারতের কাহিনিকে অনুধাবন করতে শেখায়।


   প্রথমে দুবছরের কিছু বেশি সময়ের ‘প্রগতি‘, তারপর দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ধরে প্রকাশ করেছেন ‘কবিতা‘ পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই পত্রিকার শুভাকাঙ্ক্ষী, যতদিন জীবিত ছিলেন কবিতাও পাঠিয়েছেন মাঝে-মধ্যেই। অনেকের মতে, কবি জীবনানন্দ আবিষ্কৃত হয়েছিলেন সম্পাদক বুদ্ধদেবের চোখেই। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে পাঠকের সামনে হাজির করান তিনিই। ‘পদাতিক‘ প্রকাশিত হয় ‘কবিতা-ভবন‘ থেকেই । এছাড়াও সমর সেন শুধুমাত্র ‘কবিতা‘ পত্রিকাতেই কবিতা লিখেছেন। সমসাময়িক বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী-র অনেক কবিতাই এখানেই আগে প্রকাশিত হয়েছে। প্রচুর বিদেশি কবিতার অনুবাদ-প্রকাশও ছিল এই পত্রিকার একটা উল্লেখযোগ্য দিক।


   পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে অত্যন্ত ব‍্যস্ত হয়ে পড়েন বুদ্ধদেব। বিভাগের বিভিন্ন কাজকর্ম আর ঘনঘন বিদেশযাত্রার ফলে অবশেষে ক্ষীণ হয়ে আসে পত্রিকার জন্য সময়।


   বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে পাঠকমহলে একটি পরিচিত অভিযোগ যে, তিনি কলাকৈবল‍্যবাদী। সমসাময়িক প্রেমেন্দ্র মিত্র বা অচিন্ত্যকুমার যখন সামাজিক মানুষের সংকট দেখে আকুল হয়েছেন, বুদ্ধদেব তখনও ব‍্যক্তিগত শিল্পচর্চায় বিশ্বাসী গবাক্ষহীন ঘরে। যদিও ফ‍্যাসিস্টবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘ-র একসময় সদস্য হয়েছিলেন তিনি, বক্তৃতাও করেছেন, লিখেছেন ‘স্বাজাতিকতা, দেশপ্রেম, বিশ্বমানবিকতা‘ বা ‘সভ‍্যতা ও ফ‍্যাসিজম‘ নামের প্রবন্ধ-ও । নোয়াখালি দাঙ্গার পর গান্ধীজির সেখানে প্রাসঙ্গিকতা স্মরণ করে লিখেছেন ‘নোয়াখালি‘ নামের প্রবন্ধ- তবুও কবিতা, গল্পে, উপন্যাসে তিনি ছিলেন আত্মতার-ই সন্ধানী।


   দীপ্তি ত্রিপাঠীর ভাষায়, ‘বুদ্ধদেব ব‍্যক্তিজীবনে বিশ্বাসী। বিষ্ণু দে-র মতো বিরাট সামাজিক জীবন তাঁর মনকে আকৃষ্ট করেনি। যে দীর্ঘ তিরিশ বছর তিনি কবিতা রচনা করেছেন সে তিরিশ বছর বাংলা তথা ভারতবর্ষের পটভূমিকা বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে মুহুর্মুহু কম্পিত হয়েছে। তবুও তিনি রাজনৈতিক প্রসঙ্গে নীরব ছিলেন, এমনকী সুধীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের মতো অনাস্থাও প্রকাশ করেননি।‘


   অনেক সমালোচক যদিও একথা বলেছেন যে, সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টির ওপর একের পর এক প্রবন্ধ রচনা করে যেভাবে তিনি উৎসাহ প্রদান করেছিলেন, বিপরীতক্রমে বুদ্ধদেবের রচনা সম্পর্কে কলম ধরতে কিন্তু সমকালীন লেখকদের ততখানি সোচ্চার হতে দেখা যায় না। তবুও নিজের লক্ষ্যে বুদ্ধদেব ছিলেন অবিচল।


   কিন্তু পরবর্তীকালের কবিরা প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন এই পূর্বজ সাহিত্যিককে। ‘ছন্দের বারান্দা‘ গ্রন্থে শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘তাঁর চরিত্রে আছে সুরের প্রতি আরোধ‍্য আকর্ষণ, তাঁর কবিতা বানিয়ে তোলে আসক্তি, ছড়িয়ে দেয় তীব্র মত্ত আত্মহারা ভালোবাসা।‘ সেই গান সেই মত্ততা ছড়িয়ে যায় শিরায় শিরায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতায় লিখেছেন, ‘তোমার নিকটে এসে বৃক্ষের ভরসা পেত কবি, ছায়া পেত, সচ্ছলতা পেত সুন্দর।‘। আর শামসুর রহমান ‘বুদ্ধদেব বসুর প্রতি‘ কবিতায় লেখেন ‘শব্দেই আমরা বাঁচি এবং শব্দের মৃগয়ায়/আপনি শিখিয়েছেন পরিশ্রমী হতে অবিরাম।/ …আপনার ঋণ / যেন জন্মদাগ, কিছুতেই মুছবে না কোনোদিন ।‘

কবিতা:

মর্মবাণী (১৯২৫),বন্দীর বন্দনা (১৯৩০),পৃথিবীর পথে (১৯৩৩),কঙ্কাবতী (১৯৩৭),দময়ন্তী (১৯৪৩),দ্রৌপদীর শাড়ি (১৯৪৮),শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩),শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর (১৯৫৫),যে-আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮),দময়ন্তী: দ্রৌপদীর শাড়ি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৬৩),মরচেপড়া পেরেকের গান (১৯৬৬),একদিন: চিরদিন (১৯৭১),স্বাগত বিদায় (১৯৭১)

উপন্যাস :

সাড়া (১৯৩০),সানন্দা (১৯৩৩),লাল মেঘ (১৯৩৪),বাসরঘর (১৯৩৫)পরিক্রমা (১৯৩৮),কালো হাওয়া (১৯৪২),তিথিডোর (১৯৪৯),নির্জন স্বাক্ষর (১৯৫১),মৌলিনাথ (১৯৫২),নীলাঞ্জনের খাতা (১৯৬০),পাতাল থেকে আলাপ (১৯৬৭),রাত ভ'রে বৃষ্টি (১৯৬৭),গোলাপ কেন কালো (১৯৬৮),বিপন্ন বিস্ময় (১৯৬৯),রুক্‌মি"" (১৯৭২)

গল্প :

রজনী হ'ল উতলা(১৯২৬),অভিনয়,অভিনয় নয় (১৯৩০),রেখাচিত্র (১৯৩১),হাওয়া বদল (১৯৪৩),শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৫৯),একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু (১৯৬০),হৃদয়ের জাগরণ (১৩৬৮),ভাসো আমার ভেলা (১৯৬৩),প্রেমপত্র (১৯৭২)

প্রবন্ধ :

হঠাৎ-আলোর ঝলকানি (১৯৩৫),কালের পুতুল (১৯৪৬),সাহিত্যচর্চা (১৩৬১),রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য (১৯৫৫),স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭),সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৩),প্রবন্ধ-সংকলন (১৯৬৬),কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)সমুদ্রতীর (১৯৩৭),আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩),আমার যৌবন (১৯৭৩)আমি চঞ্চল হে (১৯৩৭)সব পেয়েছির দেশে (১৯৪১)উত্তর তিরিশ (১৯৪৫)জাপানি জার্নাল (১৯৬২)দেশান্তর (১৯৬৬)কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)মহাভারতের কথা (১৯৭৪)কবিতার শত্রু ও মিত্র (১৯৭৪)

নাটক

মায়া-মালঞ্চ (১৯৪৪),তপস্বী ও তরঙ্গিণী (১৯৬৬

কলকাতার ইলেক্ট্রা ওসত্যসন্ধ (১৯৬৮)

অনুবাদ :

কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭),গহীন বালুচর (১৯৫৮),বোদলেয়ার: তার কবিতা (১৯৭০),লল্ডালিনের কবিতা (১৯৬৭),রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা (১৯৭০)

'ভ্রমণ কাহিনী 

সব-পেয়েছির দেশে (১৯৪১),জাপানি জার্নাল (১৯৬২),শান্তর (১৯৬৬),

স্মৃতিকথা 

আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩),আমার যৌবন (১৯৭৬)

সম্পাদনা 

আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৬৩)

সম্মাননা

১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন।

১৯৬৭ সালে তপস্বী ও তরঙ্গিণী কাব্যনাট্যের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৭৪ সালে স্বাগত বিদায় গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।

মৃত্যু

বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।


=================================




Saturday, 28 November 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

##############@@@#############
              রাস পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে
               বিশেষ কবিতার সংখ্যা

                           " সম্পর্ক "
¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶§¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶§¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶
        Doinik Sabder Methopath
         Vol -206. Dt -29.11.2020
             ১৩ অগ্রহায়ণ ,১৪২৭. রবিবার
$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$

=================================
কবিতা ' বিশেষ সংখ্যা
++++++++++++++++±+++++++++++++++++
১.
সম্পর্ক
দুর্গাদাস মিদ্যা 

সম্পর্কের শীতলতায় জল জমে বরফ হয়
সুনিবিড় ছায়া ছুঁয়ে থাকে গাছ যেভাবে
সেভাবে ঘোরতর সংসারী হতে চাই আমি 
তোমাকে ছুঁয়ে।
এইযে ঘরে ঘরে ভালোবাসার তোরণ তৈরী হয়
 সে তো আর এমনি এমনি নয়
চারপাশ ঘিরে থাকে ভালো সম্পর্কের 
নিবিড় আশ্রয়। তাই মান্যতা পায় সামাজিক
পরিচয়। নতুবা সব খেলাঘর
বাসর ভাঙে গোপন সম্পর্ক-হীনতায়।

=============///==========
২.
পোশাক বদল 
 জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

মুক্তো কুড়িয়ে নিলে দুই খোল ডিঙি
ভেসে যায় কান্না ধোয়া নীলের তারল্য।
আলোর গতি মহাকাশ ছোঁয়
ছায়াপথ পায়না স্টেশন।
হয়তো স্বপ্নের গাড়ি স্বর্গের কাছাকাছি
পারিজাত ব্লটিংয়ে আটপৌরে ঘাম
অজানা দানব চোষে স্বপ্নময় বীজ।
দৃশ্য সুন্দর হলে কোমলতা পায়?
তাহলে অদৃশ্য কেন কাঁটাদের দাঁত!
ধুসর ফুলের মধু জমে জমে ক্ষীর
নীলকণ্ঠ খুঁজে ফেরে বিজাতি পতঙ্গ।
ভোগপদ গেয়ে গেয়ে পোশাক বদল
মহাকাশে পাতা যাক ভোজের টেবিল.....

গোলমালে সুর দিলে সবই শাবাশ।

==========////=========
৩.
তৈমুর খান
হাসপাতালের দিকে 


কিছু নীরবতা আমাকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায় 
যদিও কোনও তৃষ্ণার কথা বলিনি কখনও 
যদিও গুচ্ছ গুচ্ছ কোঁকড়া চুলের রমণীদের কথা গোপন রেখেছি 
মসৃণ ত্বকের কিছু উপমা খুঁজতে খুঁজতে 
আমি শুশ্রূষার অভিমুখে দাঁড়াই 
আমাকে ভাসিয়ে দিক সময় 
আজ কোনও নৌকার কাছে যাব নাকো আমি 

ক্রমাগত একটা দ্বীপ, দ্বীপের অরণ্য 
আর নীরব ভাষার সংলাপ…

==================////======
৪.
পাপেট শো 
অশোককুমার লাটুয়া 

জীবন মানেই সম্পর্ক। 
সম্পর্ক মানেই পাপেট শো। 
বিশ্বাস, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা 
শরীর হৃদয় পিপাসা 
উপকরণ। 
গাছ, বাতাস, পাখি, মৌমাছি 
নদী, মাটি, আকাশ 
আবেগ, অনুভূতি, 
স্বপ্ন, প্রেম, স্মৃতি 
প্রেক্ষাপট। 
বৃষ্টি, গোলাপ, আলো 
মনভালো, মনখারাপ 
নক্ষত্র, জোনাকি, গল্প কিংবা কবিতা 
সবমিলিয়ে জীবন মানেই সম্পর্ক 
গোপন-খোলা চিঠি। 
সম্পর্ক মানেই পাপেট শো 
আক্ষেপ অনুরাগ অভিমান 
দিনরাত্রি। 

================////=============
৫.
হারাণজেঠু
অমিত কাশ‍্যপ

শহর কখন গড়িয়ে গড়িয়ে গ্রামের পথে 
এখন গ্রামে আর মাটির পথ নেই 
মোরামের পর মসৃণ পিচরাস্তা
মাটির বাড়ি অবলুপ্তির পথ, অট্টালিকার শোভা নজর কাড়ে
গ্রাম-শহরের মেলবন্ধন, এরই নাম সম্পর্ক

গ্রামের প্রবীণ মানুষ হারাণজেঠু, স্বাধীনতা দেখেছেন 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি তাও ম্লান নয়
নবীন প্রজন্মের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বলেন 
এরই নাম সম্পর্ক, বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় আলোময় আজ গ্রাম
গ্রাম ভরে যাচ্ছে শহুরে গন্ধে আর শোভনতায়


============/////===========
৬.
আগামীর কাছে 
বিমল মণ্ডল


বিকেলের শেষে কুয়াশা মাখা সন্ধ্যা
ধূসর নীরব আবছা আলোয় 
একটু পরে উদাসীন জোছনা;স্বপ্নের ভেতর
আকাশের গায়ে জল ঢেউ খেলে

টুপটাপ শব্দ মৃদু আলো ঘিরে 
সমান বৃত্তাকারে স্মিতহাস্য আলিঙ্গন
যেন অন্ধকার আরও অন্ধকারে 
অপেক্ষায় আগামী 

হঠাৎ কুয়াশা চিরে আলোর উচ্ছ্বাস
রাত্রির সন্ধান অনন্য অক্ষরেখা
এক, দুই... চার, পাঁচ তারাদের আলাপন

মন্থর রাত্রি শেষে 
সমস্ত জোছনার অনুভবে  
উজ্জ্বল তখনও সেই তারার হাসি
জেগে ওঠে আগামীর কাছে।

=============////========
৭.
সমস্ত দিনের সম্পর্ক
সুবীর ঘোষ

 সমস্ত দিন বসে থাকব
গাছের কাছে পাতার নীচে
আমায় তারা পাহারা দেয়
বিপদ আসতে দেয় না কাছে ।
হাত সেঁকব পা সেঁকব
প্রায় নিভন্ত চুলোর আঁচে
এখান থেকে পালিয়ে যাবার
প্রশ্ন জোলো বেবাক মিছে ।

 সমস্ত দিন বসে থাকব
গাছের কাছে রোদের ভেতর
সন্ধে হলে চাঁদের সঙ্গে
অল্প আলো অন্ধকারে
মনের গামছা নিংড়ে চিপে
করব কত জলের কদর
গাছ বলবে—“আবার এসো” ।
গাছ ঝুঁকে যায় চাঁদের ভারে ।
=============///=========
৮.
রেখাচিত্র
খুকু ভূঞ্যা

অনেক ভালোবাসার কোনো নাম হয়না
রঙ গন্ধ নির্যাস 
চোখ বুক শরীর কিছুই থাকে না
অথচ প্রশ্বাস নেয়
কথা বলে নৈঃশব্দের সঙ্গে একা একা
অশ্রুপাত করে না কিন্তু এক পাহাড় যন্ত্রনা রক্তের ভেতর লালন পালন করতে করতে
বুঝে নেয় ভালোবাসা এক অপূর্ব মৃত্যু
কেবল নীরবতা স্বীকার করে

ভাবি চোখের ওপর একটা ঘর হোক তোমার
দেখব তোমার ফুল ফোটানো
অবাক তাকিয়ে থাকা আকাশের দিকে
অথবা গভীর নীরবতার মাঝে রাত জেগে-
কী কথা হয় চাঁদ নক্ষত্রের সঙ্গে

ছায়ার কোনো বসন্ত নেই
হাড় ভাঙা ঝড় বুকে নিয়ে
চেয়ে থাকি অদৃশ্য ভালোবাসার দিকে
যদি একটা পরিচয় পাই---
অতসী শালুক আকন্দ অথবা---

=========/////=≠==========
৯.
সম্পর্ক
লোপামুদ্রা ভট্টাচার্য

আমার তখন সতেরোয় পা, তুইও ছিলি তাই..
একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে প্রথম শব্দ হাই !
খোলা জানলায় অবাক দৃষ্টি! কী এত খুঁজতিস?
বোর্ডে তখন ক্যালকুলাস,সে হদিস কি পেতিস ?
কেমিস্ট্রি ল্যাবে প্রথম যেই দুজনের হাতে হাত
শুরুটা সেই, তারপর তো হেঁটেছি কতটা পথ !
লাইব্রেরি রুমে প্রথম চুমু আড়াল খুঁজে খুঁজে
জাপটে ধরে আরাম নিলি চোখ ছিল তোর বুজে।
বছর ঘুরে বসন্ত এলো, এলো শীত ও শ্রাবণ
ক্লাসের পড়ায় ফাঁকিবাজি কবিতাই কাড়ে মন ।
স্কুল পেরিয়ে কলেজও শেষ কাজের খোঁজে আমি
পরের ঘরে পা বাড়ালি মানুষ পেয়ে নামীদামি।
কেমন করে হাত রাখলি নতুন বরের হাতে
যে হাত ছিল আমার বুকে ফাগুন- চাঁদনি রাতে।
পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতিস কোন সে অলীক দেশে
সে পথ আজ ভুলেই গেলি নবীন বধূর বেশে ।
আমি আজ সখী ভোলামন এক নিঃস্ব পথহারা
খুঁজে ফিরি আজ সে সংযোগ বিহ্বল দিশাহারা।
তুই সুখে থাক চিরটাকাল এই আমার আশা
চোখের জলে হৃদয় মাঝে গাঁথা থাক ভালোবাসা।।

===============/////============
১০.
সেলাইজন্ম।
শুভ্রাশ্রী মাইতি।

ছোটবেলা থেকেই সেলাই বড় ভালোবাসতো মা।
পেখমতোলা ময়ূর, শিং তোলা হরিণ, পাপড়ি মেলা গোলাপ
ফ্রেমবন্দী হয়ে নতুন করে সেলাইজন্ম পেত মার হাতে।
শ্বশুর বাড়ীর বারো ঘর এক উঠোনের মাঝে জমে ওঠা
রাশি রাশি কথা-অকথার সুতোগুলো অকারণ জট পাকালে
তাদের ছাড়িয়ে নিজের মতো করে নকশা বুনত মা সংসারের গোল ফ্রেমে।
ভাঙা সম্পর্কের নকশাগুলো চিকন,বোতাম,বখেয়া স্টিচের আলোয় 
ভরাট হয়ে হেসে উঠত খিলখিলিয়ে যখন তখন।
গ্রীষ্মের দুপুরে বা বর্ষার বিকেলে মার সেলাই মেশিন থেকে বেরিয়ে আসত
বড় জেঠিমার লেস বসানো ব্লাউজ, মেজো জ্যাঠার ফুলতোলা রুমাল
বা ন-কাকিমার পাতা আঁকা শাড়ী।
সেলাই মেশিনের ঘরঘর শব্দে মার চোখ চুঁইয়ে নামত সম্পর্ক সুতোর অমল আলো
আদরের সূঁচ নকশা তুলতো রাতদিন ভালোবাসার।

অব্যবহৃত সেলাই মেশিনটার গায়ে এখন সময়ের বিবর্ণ জং।
মার মতো সেলাই আমরা কেউই শিখতে পারিনি বলে
সম্পর্কগুলোর মাঝে এখন সময়ের ছেঁড়া-ফাটা খাদের ক্ষত।
কাঁচা হাতের রিফুতে সৌন্দর্য আর ভালোবাসা ভরাট হয় না বলে
খাদ বাড়ে, বাড়তেই থাকে জীবনে...

==============//=≠==========
১১.
শুভ সকাল 
কোয়েলী বসু

      প্রতিটি সকাল 
টেবিলে চায়ের কাপ, 
খবরের কাগজ,  
খোলা জানলা,নরম রোদ্দুর
     আর একটি চেয়ার।

উল্টোদিকের জানলায় তারা 
      বোধহয় ওদের নাম......
হতে পারে কিছু,
    কিন্তু প্রেমিকা টি  
কী নামে যেন ডাকল তাকে।

     ওরা প্রতিদিন আসে
শরীর দুলিয়ে পরস্পরকে
    জানায় সুপ্রভাত ।

একের মুখে থাকে খড়কুটো ,
      অন্যের চোখে থাকে 
                 রঙিন স্বপ্ন ।
 চায়ের কাপ খালি হয়,
 খবরের কাগজের অক্ষরেরা,
  মাঝে মাঝেই ওদের 
         বকম বকম সুরে 
               নেচে ওঠে।

মনে হয় কোনো সুসংবাদ।
দুধ সাদা কপোতীও
       কেমন উঠল নেচে।
বাসা বাঁধা হয়ে যায় কপোতের,
     প্রগাঢ় চুম্বন,
ওরা টের পায় কার আগমন।

কপোত- কপোতীর ,
              ভালোবাসার ঘ্রাণ আবেশ ছড়ায় ।
     আমি বুঝি ,
                  শুভ সকাল ।

==============/////=============
১২.
সম্পর্ক
 গোবিন্দ মোদক 

কতোদিন পর দেখা হলে
সম্পর্কটাকে অগোছালোভাবে 
               ঝালিয়ে নেওয়া যায়, 
তার কোনও সর্বজনগ্রাহ্য হিসাব হয় না।
তবুও অনন্ত দ্রাঘিমারেখা জুড়ে
               যখন ভেসে যায় মনের পালক,
আর ফুলেল ভোর নিয়ে আসে সকালের চিঠি,
তখন পারিজাত সম্পর্ক খুঁজে পায় সহজাত সুর, 
বাঁধা তানে হৃদয়-তন্ত্রী ছুঁয়ে নূপুর বাজে ....
আর নরম একটা রোদের অপেক্ষায় 
          বুক জুড়ে বেজে ওঠে নবান্নের গান ; 
গাঢ় স্বরে বলি -- "ভালো আছো তো ?"
কথা শুনে আকাশ তার বুকে 
          ভাসিয়ে দেয় মেঘের ভেলা
                  ঝরে পড়বার সুতীব্র আবেগে

==============////===========
১৩.
ফসলিয়া প্রেম
  অনিমেষ মন্ডল

ধানের শিষ বেয়ে ভেসে আসে ফসলিয়া প্রেম
শূণ্য খামার;
মরমি হাওয়ায় শোক ওড়ে, শুদ্ধ হয়।

রাইকিশোরী, তোমার নূপুরে সুর তোলে
মথুরা সংলাপ;
বিকেলের রোদ ছুঁয়ে ছুটে যাব আলপথ ধরে।

মুঠো ধান হাতে নিয়ে আঁচল ভারাবো
গরবিনী প্রেমে;
তোমার চোখের কাজলে ছায়া পড়ে, উপোসি উঠোন।

রাইকিশোরী, তোমার প্রেমে মাটির ঋণ সোঁপে দেবো
আমাদের আগামী;
পুরনো মানতের মতো লক্ষ্মীর আসনে তুলে রেখো।

দূরের বোষ্টমী সাধ করে গেয়ে যায় সহজিয়া গান
সুজন আলাপ;
কুঁচো ভরে চাল দিও,জল দিও।

রাইকিশোরী, তোমার হৃদয়ে বারোমাস্যা গাথা
উদরের ছায়া ভুলে;
ঝিরঝিরে রোদে ফসলিয়া গেও।

==≠===≠=========///============
১৪.
সম্পর্ক
দেবাশিস চক্রবর্ত্তী

জীবন বাবুর তিনটি ছেলে
একটি মাত্র মেয়ে,
জীবন বাবুর জীবন চলে
নাম - কীর্তন গেয়ে ।

পঁচিশ বছর কাটলো , করে
রোজের ঝগড়া - তর্ক,
রাতে কিন্তু রাখতো জীবন
মধূময় সম্পর্ক ।

জীবন বাবুর গিন্নি সেদিন
হঠাৎ ভোরের দিকে,
কোথায় যেন পালিয়ে গেলো
একটা চিঠি লিখে !

হন্যে হয়ে খুঁজতে গিয়ে
ক্লান্ত জীবন ঘোষ,
ঠ্যাং ছড়িয়ে বুক চাপড়ে
করছিল আফশোস ।

মায়াময় এই দুনিয়ায়
কখন কে - যে কার !
এক লহমায় কাটতে পারে
সম্পর্কের তার ।

==============///=========≠========
১৫.
সম্পর্ক 
  নবকুমার মাইতি 

চলমান সময়ের অস্থির স্রোতে সম্পর্ক গুলো ভেঙে খাণখাণ হয়ে যাচ্ছে
চারিদিকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম,সীমান্তে রণভেরী 
মিলিটারী ট্রাকের আনাগোনা,লাশকাটা ঘর 
ভয়ঙ্কর মারণ ভাইরাস,পৃথিবীর কাল যেন শেষ হয় !

দেশপ্রেমের নামাবলী গায়ে এক শ্রেণীর মানুষ 
বিকিয়ে দিচ্ছে দেশের সাম্য,স্বাধীনতা,সৌভ্রাতৃত্ব
বিনিময়ে মুনাফার পাহাড়ে বসে বাজায় ঔদাসিন্যের বাঁশি
সাম্প্রদায়িক বিভেদগামী শক্তির আস্ফালন,আর্থিক মন্দা 
নরপিশাচের লালসার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত নারীর সম্ভ্রম 

স্থিতধী মানুষ আজ অচল আয়তন,ক্রমাগত কোণ-ঠাসা  
তাদের অমূল্য অভিমত । সম্পর্কের সুতোয় টান
একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে খানখান
সম্প্রীতি,মানবতা,ভালবাসা,প্রেম,সুকোমল প্রবৃত্তি 
শতাব্দীর সঞ্চিত নিরন্ধ্র অন্ধকারে আমাদের চোখে বেদনাশ্রু

অধীর অপেক্ষায় বিনিদ্র দিনের যাপন চিত্র 
খুঁজে ফিরি অভেদসুন্দরের ধ্যানে নিমগ্ন পৃথিবী 
যেখানে উচ্চ নীচ, নারী পুরুষ, রাম রহিম
ভূবন বাউল, ইয়াসিন মিঞ্যা আমরা সকলে ভাই ভাই 
সম্পর্ক একটাই—বিশ্বপিতার সন্তান । 

==============///================
          









                 




Friday, 27 November 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
          আলোচনা পর্ব

শ্রেণী-সংগ্রামের গান ও চাঁদ-কাস্তের কবিতা

================!!!!!!!!!============

Doinik Sabder Methopath

Vol - 205. Dt - 28.11.2020

 ১২ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭. শনিবার

÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

কাস্তে-হাতুড়ির সমন্বিত প্রতীকে মার্কস-এঙ্গেলসের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শনের লক্ষ্য ছিল শ্রেণিশোষণ ও শ্রেণিবৈষম্যের অবসান ঘটাতে শ্রেণিসংগ্রামী বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষক-জনতার মুক্তি, সেইসঙ্গে সমাজবদল, সংস্কৃতির চরিত্রবদল ঘটানো। উনিশ শতক (১৮৪৮) থেকে এ-আহ্বান বিশ্ব-সাহিত্য-সংস্কৃতির বুদ্ধিজীবী সমাজে বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগায়। ইউরোপ থেকে এশিয়ায়, এবং বিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিম-লে। তিরিশের দশকে প্রগতি সাহিত্যের সূচনায় মার্কসবাদী দর্শনের নান্দনিক প্রতীকগুলো ক্রমান্বয়ে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের চেতনা স্পর্শ করে, তাদের কারো সৃজনশীলতায় প্রভাব রাখে।
রাখে বিশেষ করে কবিতায়। কাস্তে-হাতুড়ি কৃষক-শ্রমিকের সংগ্রামী সত্তার প্রতীক। কৃষিপ্রধান দেশ বঙ্গে কাস্তেরই প্রতীকী-প্রাধান্য নানা প্রতীকী উপমায়, কখনো চাঁদের সঙ্গে, যে-চাঁদ সাধারণত রোমান্টিক প্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবেও কবিতায়-গানে ব্যবহৃত। তিরিশের দশকের বাঙালি কবিদের দু-একজন চাঁদ ও কাস্তের উপমায় নান্দনিক প্রসাদ সৃষ্টি করে পাঠককুলকে চমকে দিয়েছিলেন।
সেখানে বিপ্লব নয়, ছিল প্রগতিচেতনার কাব্য-নান্দনিকতার সংগ্রামী প্রকাশ চাঁদকে কাস্তের প্রতীকে তুলে ধরে। যেমন তিরিশের শেষার্ধের কবি দিনেশ দাস। কবিতাটির নাম ‘কাস্তে’। কিন্তু বিদেশি শাসনে সাহিত্য-সংস্কৃতি ভুবনে সামাজিক পিছুটানের কারণে কবিতাটির প্রকাশ বিলম্বিত হয়। সময়টা ছিল প্রগতিচেতনার পাশাপাশি বাংলা কাব্যে-শিল্পসর্বস্বতার (‘আর্ট ফর আর্টস সেক’-এর) প্রাধান্য।
যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বা প্রথম পর্বের বিষ্ণু দে। অন্যদিক থেকে ভিন্ন গোত্রের অমিয় চক্রবর্তী কিংবা বুদ্ধদেব বসু। দিনেশ দাস বাংলা কাব্যভুবনে শ্রেণিগত উচ্চতায় অধিষ্ঠিত না হলেও ‘কাস্তে’র মতো একাধিক কবিতা লিখে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন, সন্দেহ নেই। দুর্বোধ্য কারণে, হয়তোবা শিরোনামের কারণে, বা তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থানের কারণে লেখার পর কবিতাটির প্রকাশ বছরখানেক বিলম্বিত হয়।
অবশেষে প্রগতিবাদী কবি অরুণ মিত্রের কল্যাণে দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’ কবিতাটি শারদীয় দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং কবি ও কবিতাপাঠকদের মধ্যে যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বিশেষ করে এর পঙ্ক্তিবিশেষ।
বেয়নেট হ’ক যত ধারালো
কাস্তেটা শান দিও বন্ধু,
এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে।
তিরিশের রোমান্টিকতা বর্জন করে বিপ্লবীচেতনার নান্দনিক প্রকাশ ঘটায় কবিতাটি। চাঁদ নিয়ে উচ্ছ্বাস বিসর্জনের খাতায় নাম লেখায়। কবিতাটি প্রগতিচেতনায় তৎপর সাংস্কৃতিককর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে। অন্যদিকে কবিতাটির পঙ্ক্তিবিশেষ তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত কবিদের কারো কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষ করে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে প্রমুখের।
সুধীন্দ্রনাথ কলাকৈবল্যবাদী, ফরাসি শব্দবাদী কবি মালার্মের অনুসারী। লিখেছেন : মালার্মের কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্ট। ‘উৎকৃষ্ট কবিতার’ শৈল্পিক সমঝদার নান্দনিক কবি সুধীন্দ্রনাথ কাস্তের অনুষঙ্গে কবিতা লেখেন তাঁর শিল্পবোধের সমান্তরালবর্তিতায়। কবিতাটি ছাপা হয় বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায়।
অবিশ্বাস্যই ঠেকে ‘এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে’ পঙ্ক্তিটি নিয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নান্দনিক মাত্রায় কাব্যতৎপরতা। বিষ্ণু দে-ও কাস্তের সংগ্রামী কাব্যধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন কিছুটা দেরিতে, ‘সন্দ্বীপের চর’-এ পৌঁছে। ‘মৌভোগ’ কৃষক সম্মেলনের কথা স্মরণে রেখে ওই শিরোনামের কবিতাটি সংগ্রামী ধারায় রচিত, যদিও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা-বিরোধিতা যেখানে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, সেখানে তিনি ‘লাল নিশান’ উড়িয়ে লেখেন :
তাদের কথা হাওয়ায়, কৃষাণ কাস্তে বানায় ইস্পাতে
কামারশালে মজুর ধরে গান।
মনে রাখতে হবে, তিরিশের দশকে ভারতীয় রাজনীতি, বিশেষভাবে বঙ্গীয় রাজনীতি বিপ্লবী ধারায় একটি রক্তাক্ত সংগ্রাম এবং আত্মদানের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল। সূর্য সেন, প্রীতিলতা, যতীন দাস থেকে বিপ্লববাদীরা বক্সা-হিজলি ক্যাম্পে বন্দিদশায়, গুলি-মৃত্যুর ঘটনাবলি, যা রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করে, যা তাঁর কবিতায়ও প্রকাশ পায়।
কাস্তের প্রতীকে রোমান্টিক চাঁদকে সংগ্রামী ভুবনে টেনে এনে লেখা একটি কবিতা তিরিশের দুই বিপরীত ধারার কবিকে এতটাই স্পর্শ করে যে, তার প্রকাশ ঘটে তাঁদের সচেতন কাব্যপঙ্ক্তিতে। অবশ্য দুজনকে দুই তাৎপর্যে। বিষ্ণু দে এর প্রকাশ ঘটান কৃষক-শ্রমিকের শ্রেণিসংগ্রামের ধারায় নান্দনিকতা অক্ষুণœ রেখে। সেটা অবশ্য চল্লিশে পৌঁছে, গোত্রান্তর পর্যায়ে, যা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত।

দুই
আবার কখনো হালকা চালে প্রথম দিকের কবিতায় দিনেশ দাসের পঙ্ক্তির মতো করেই সামাজিক অনাচারী চরিত্রের চিত্র আঁকেন বিষ্ণু দে এমন পঙ্ক্তি রচনায় :
আকাশে উঠল ওকি কাস্তে না চাঁদ
এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে!
জুঁইবেলে ঢেকে দাও ঘন অবসাদ,
চলো সখি আলো করো ভাঙা নেড়া ছাদ।
এ-জাতীয় হালকা চটুলতার পাশাপাশি একই কবিতায় একই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতার পরিচয়ও রাখেন বিষ্ণু দে এই বলে :
ঠগেরা বেনেরা পাতে চশমের ফাঁদ।
স্বার্থ-ছিটায় মুখে মৃত্যুর স্বাদ,
চাঁদের উপমা তাই কাস্তে। …
হৃদয়ে হাতুড়ি ঠোকে প্রেম, ওঠে চাঁদ
এ যুগের চাঁদ বাঁকা কাস্তে ॥
পর্বান্তরে ভিন্ন এক বিষ্ণু দে জনজোয়ারের টানে তেভাগার কাব্যচর্চায় এবং কৃষক-আন্দোলনের পটভূমিতে কাস্তের সংগ্রামী ভূমিকাকে কাব্যপঙ্ক্তির নান্দনিকতায় প্রকাশ করেছেন। এবং তা নানা অনুষঙ্গে। তাতে প্রকাশ পেয়েছে কাস্তের শৈল্পিক ব্যবহার :
তোমার বাউলে মিলাই বন্ধু কাস্তের মেঠো স্বর
মানব না বাধা কেউ
ঘৃণা আর প্রেমে ক্রান্তিতে চাই জীবিকার অবসর
জীবনের তটে জোয়ারভাটার ঢেউ।
এসব কাব্যপঙ্ক্তি বিষ্ণু দে-সুলভ ভিন্ন এক শিল্পচরিত্রের প্রকাশ ঘটায় – যা দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’ থেকে অনেকটাই দূরে।
যেমন সুধীন্দ্রনাথের কাব্যপঙ্ক্তি – সেখানটায় অবশ্য বিষ্ণু দে থেকেও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কাব্যবোধের প্রকাশ, যদিও বিষয়বস্তু চাঁদ ও কাস্তে। এতে সংগ্রামীচেতনা নয়, শৈল্পিকচেতনারই প্রাধান্য। তবু কলাকৈবল্যবাদী কবি এ-উপলক্ষে অশান্ত বিশ্বপরিস্থিতির উন্মাদনাকে শিল্পের ধোঁয়াশায় ঢেকে ভিন্ন এক উপলব্ধির প্রকাশ ঘটান, যাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলা চলে না। সুধীন্দ্রনাথের ‘কাস্তে’ একেবারেই ভিন্ন চরিত্রের। এর শুরুটা এরকম :
আকাশে উঠেছে কাস্তের মতো চাঁদ
এ-যুগের চাঁদ কাস্তে।
ছায়াপথে কোন্ অশরীরী উন্মাদ
লুকাল আসতে আসতে।
গোটা ছোটখাটো কবিতাটিকে সুধীন্দ্রনাথ-সুলভ কাব্যশব্দবন্ধের জটিলতায় গতি করে উপসংহারে মানবিক চেতনার পক্ষে সংগ্রামী আভাস রেখেছেন শেষ কয়েকটি চরণে। সেখানে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে নৈতিক সংগ্রামে কাস্তের ইতিবাচক ভূমিকার প্রশ্নবোধক প্রকাশ রেখেছেন পৌরাণিক সূত্রের অনুষঙ্গে। উল্লেখ্য, অশুভ শক্তির প্রবলতার প্রসঙ্গে শুভশক্তির আভাস :
শুষ্ক ক্ষীরোদ সাগরে মগ্ন বিষ্ণু
নরপিশাচেরা পৃথিবীতে আজ জিষ্ণু। …
খ-াবে কবে অমৃতের অপরাধ
কালপুরুষের কাস্তে।
কবিতাটির সমাপ্তি অবশ্য ইতিবাচক প্রত্যাশায় সময়ের ওপর চোখ রেখে, তবু সংশয়ের প্রশ্নটি থেকেই যায়। অমৃতের অপরাধ তো শ্রেণিগত চরিত্রের। যতদিন প্রতীকী সুরাসুরের দ্বন্দ্বে সুরের চাতুর্য ও শক্তি লড়াইয়ের মাধ্যমে পরাজিত না হবে, ততদিন নিম্নবর্গীয়দের অমৃতের ন্যায্য অধিকার অর্জিত হবে না। এভাবেই কবি সুধীন্দ্রনাথের প্রতীকে ঢাকা প্রগতিশীলতা শৈল্পিক প্রাধান্যকে অতিক্রম করে মাঝেমধ্যে বিরল কাব্যপঙ্ক্তিতে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। সেখানে তিনি যথার্থ বাস্তববাদী শিল্পী।
যেমন দেখা যায় ‘উটপাখি’ কবিতাটিতে, গোটা বক্তব্যবিষয় অতিক্রম করে একটি অসাধারণ নৈতিক সত্যের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটে একটি মাত্র পঙ্ক্তিতে, যা নানামাত্রিক অভিধায় ঋদ্ধ :
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
তিরিশের দশকের ‘চাঁদ-কাস্তে’র কাব্যবিচারে তাই বলতে হয়, তৎকালীন বিবেচনায়, দিনেশ দাসের কাস্তে স্পষ্টতায় বেয়নেটের চেয়েও ধারালো। এবং তা শ্রেণিসংগ্রামের প্রত্যয় আদর্শগত চেতনায় ধারণ করে। দিনেশ দাসের কাস্তে যথারীতি সুধীন্দ্রনাথের কাব্য-পৌরাণিক উপমায় কালপুরুষের তরবারি রূপ ধারণ করেছে, যদিও তিনি সেটিকে ‘কাস্তে’ নামেই অভিহিত করেছেন।
তিরিশের দশকের কবিতার দোলাচলবৃত্তির মধ্যে কবি দিনেশ দাস কাস্তেকে চাঁদের উপমায় যুক্ত করে কবিতাকে সংগ্রামের ধারক-বাহক করে তোলেন। সেটা ছিল শ্রেণিসংগ্রামের শৈল্পিক প্রকাশ। চাঁদের প্রেমিক রোমান্টিকতাকে তিনি নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। যদিও সেখানে শৈল্পিক নান্দনিক রূপের প্রকাশে ঘাটতি ছিল না। চল্লিশের দশকের কবিরা এই ধারাবাহিকতায় কাস্তেকে নানা ভাষ্যে কবিতার উপজীব্য করে তোলেন।

তিন
তিরিশের দশকের আরেক ভিন্নমাত্রার স্বনামখ্যাত, বিরলপ্রজ কবি সমর সেন। একটিমাত্র মাঝারি আয়তনের বইয়ে তাঁর কাব্যসমগ্রের প্রকাশ, আর আত্মজৈবনিক ধারালো বিশ্লেষণে রচিত ‘বাবু বৃত্তান্ত’ – এত অল্প লিখেও বাংলা কাব্যসাহিত্যে তাঁর স্থানটি ঈর্ষণীয়। মূলত তাঁর তীব্র তীক্ষè মধ্যবিত্ত সমাজ, মূলত নাগরিক সমাজকে স্যাটায়ারি নির্মমতায় বিশ্লেষণ ও তাঁর তির্যক কাব্যিক পরিবেশনের কারণে।
তাঁর সম্পর্কে কবি ও বোদ্ধা পাঠকের অভিযোগ ছিল – এত অল্প লিখে কাব্যভুবন থেকে বিদায় নিলেন কেন? বিশ থেকে তিরিশের দশকে রাজধানী কলকাতার নাগরিক সমাজের অনাচারী, যৌনতাপ্রবণ ও দুর্নীতিপরায়ণ সমাজ সমর সেনের তীক্ষè আক্রমণের লক্ষ্য। মূল্যবোধের অবক্ষয়ে জীর্ণ, কারো বিচারে পচাগলা সমাজদর্শনের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন মেধাবী বা প্রতিভাবান তরুণদের প্রতিক্রিয়া ছিল আত্মঘাতী; নান্দনিক বিচারেও একই কথা বলা চলে।
এদের প্রাথমিক পর্বের সৃষ্টি – কবিতা বা কথাসাহিত্য যতটা আত্মসমালোচনার, তারচেয়ে অনেক বেশি সমাজবীক্ষণ ও সমাজ-ব্যবচ্ছেদের। সে-ব্যবচ্ছেদ সমর সেনের কবিতায় সর্বাধিক দৃষ্ট, কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। আমাদের আলোচ্য বিষয় যেহেতু কবিতা, বিশেষ করে সীমাবদ্ধ বৃত্তে দিনেশ দাসের কবিতায় চাঁদ ও কাস্তের প্রতীকী রূপ নিয়ে, তাই বক্তব্য ওই ছোট্ট বৃত্তে সীমাবদ্ধ।
সমর সেনের কবিতার সূচনা যেহেতু ১৯৩৪-৩৭ পর্বে, তাই পূর্বোক্ত প্রতীকী রূপের কাব্যিক প্রকাশ সমকালীন কবি সমর সেনের সৃজনশীলতায় প্রভাব ফেলেছে কি না তা বিবেচ্য, বিশেষ করে তিনি যখন পরবর্তী পর্যায়ে প্রগতিশীলতার ভুবনে পা রেখেছেন অবক্ষয়-বৃত্ত থেকে মুক্ত হয়ে। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা, তৎকালীন কবিদের বৃহত্তর সংখ্যা ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র এবং বিশ্বসাহিত্যের নিষ্ঠাবান পাঠক।
ব্যতিক্রম নন দুই অগ্রজ কবি, এবং কিছুটা হলেও ইংরেজ কবি টিএস এলিয়ট, অংশত ইয়েটস, এবং ফরাসি শিল্পসর্বস্ববাদী কবিদের প্রভাব সমর সেনের কাব্যচেতনায় লক্ষণীয়, তবে তা সুধীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণু দে-র চেয়ে অনেক কম। সামাজিক অবক্ষয়ের রূপচিত্রণের কারণে সমর সেনের কবিতা প্রথম পর্বে উগ্র প্রগতি মতাদর্শে যথেষ্ট সমালোচিত, আবার বিপরীত ধারার সমালোচনাও কম নয়।
এমন এক পরিস্থিতিতে চাঁদ-কাস্তে বিষয়ক দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’ কবিতার প্রতিক্রিয়া সমকালে লেখা সমর সেনের কবিতায় লক্ষ করা যাবে এমন সম্ভাবনা একেবারেই ভুল প্রমাণিত করে সমর সেনের কবিতা। অসুস্থ সমাজ, দূষিত সমাজ, বিকৃত মূল্যবোধে ও অবক্ষয়ে জীর্ণ নাগরিক সমাজের বিশ্লেষণে সমর সেন সমাজজীবনের চেয়ে ব্যক্তিক আচরণের জীবন বিশ্লেষণকেই প্রাধান্য দেন মূলত প্রেমকে ভিত্তি করে।
সেখানে তারুণ্যে, যৌবনে ব্যক্তিক আকাক্সক্ষার প্রতিফলন প্রাধান্য পায়, সামাজিক পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় অশান্ত চেতনার অস্থিরতায়। সেখানে ‘অন্ধকার’ ও ‘হাহাকার’ শব্দ-দুটোর প্রাধান্য এবং ধারালো ছুরির তীক্ষè-তির্যক মন্তব্য, উপমা ও চিত্ররূপের প্রাধান্য। চাঁদ অবশ্য সেখানে মাঝেমধ্যে এসেছে, তবে কাস্তে নয়, এটা অবিশ্বাস্যই ঠেকে।
সূচনা-কবিতাটিতে পুনরুক্তি : ‘আকাশে চাঁদ নেই’ (‘নিঃশব্দতার ছন্দ’)। শহরের অবাঞ্ছিত চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে রাত্রিকে মনে হয় ‘নিঃসঙ্গ পশুর মতো আকাশের মরুভূমিতে’। আকাশের কোনো রোমান্টিক রূপ নেই, আকর্ষণও নেই। বরং ‘রাত্রে চাঁদের আলোয় শূন্য মরুভূমি জ্বলে/ বাঘের চোখের মতো’ – এ-উদ্ভট উপমার উপলব্ধিই প্রধান হয়ে ওঠে।
দিনেশ দাস থেকে শুরু করে সুধীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণু দে যেখানে চাঁদকে দেখেন শাণিত কাস্তের মতো, সমর সেনের চোখে তার ভিন্নরূপ। তাঁর ভাষায় :
আজো জ্বলন্ত খড়্গের মতো আকাশে
চাঁদ ওঠে,
আজো সামনে
মৃত্যুর মতো মন্থর জীবন।
যে-খড়্গে কোনো রোমান্টিক উপলব্ধির অবকাশ নেই, নেই কোনো সংগ্রামেরও। আছে খড়্গাঘাতে নাগরিক জীবনে অনিবার্য মৃত্যুর উপলব্ধি। পরবর্তী জীবনে রক্তাক্ত শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাসী ফ্রন্টিয়ার সম্পাদক সমর সেন তাঁর কবিজীবনের প্রথম পর্বে চাঁদকে কাস্তের প্রতীকে দেখেননি। দেখেছেন ব্যক্তিজীবনে, সমাজজীবনে ‘জ্বলন্ত খড়্গের’ প্রতীক রূপে, যে খড়্গের কাজ হলো জীবনকে কেটে ছিন্নভিন্ন করা।

চার
তিরিশের দশকে চাঁদ-কাস্তে বা শুধুমাত্র কাস্তে নিয়ে কবিতার আদর্শিক সংগ্রাম চালানো বা রূপচিত্র আঁকার চেষ্টা করেননি দিনেশ দাস বাদে কোনো কবি। এ-চর্চাটা চলেছে চল্লিশের দশকে। সুভাষ-সুকান্ত থেকে বিষ্ণু দে প্রমুখের হাতে। আর গণসংগীতে বিশেষভাবে স্বনামখ্যাত সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ গুণীজন। শেষোক্তদের প্রভাব পঞ্চাশের দশকেও পূর্ববঙ্গের তরুণ-রাজনীতিমনস্ক সমাজে ব্যাপক পরিসরে দেখা গেছে।
চল্লিশের দশকে মূলত সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য কাস্তেকে কৃষকজীবনের রূপচিত্রণে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে শ্রেণিসংগ্রামের শৈল্পিক তাৎপর্যে ব্যবহার করেছেন। সেই সঙ্গে সেই দশকের উল্লেখযোগ্য কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ একই পথে পা বাড়িয়েছেন। সেখানে চাঁদের রোমান্টিক প্রতীক বা আবহ প্রায়শ অনুপস্থিত।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘ কাব্যজীবনের প্রথমদিকের পদাতিক-চিরকুট-অগ্নিকোণ পর্বে যেমন প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য বুদ্ধদেব বসুসহ একাধিক স্বনামখ্যাত কবি ও শিল্পমনস্ক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তেমনি তাতে পরিস্ফুট রাজনৈতিক প্রগতিবাদী চরিত্র, কখনো উগ্রতা রাজনৈতিক অঙ্গনের পাঠকদের মধ্যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল।
শ্রেণিশাসন-শোষণ এবং এর বিপরীতে শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রেণিশত্রু খতমের আহ্বান ছিল সুভাষের কবিতার একটি পার্শ্বমুখ। কৃষক-আন্দোলন, তেভাগা ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষের কবিতায় কাস্তে নানা মাত্রায়, নানা ভাষ্যে বারবার এসেছে, ক্বচিৎ শিল্পের নম্রমাধুর্যে। গ্রামীণ পরিবেশের চিত্রণে এক পর্যায়ে সুভাষ এঁকেছেন একটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দশিল্পরূপ :
ধানের জমিরা পাশাপাশি শুয়ে
দিগি¦দিকে –
খাড়া করে কান কাস্তের শান
শুনছে নাকি
কামারশালে?
পদাতিকের কবি যেখানে কাস্তের শান শুনছেন, চিরকুটের বিপ্লবী কবি সেখানে প্রশ্ন তুলছেন দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ নিয়ে :
শানানো কাস্তে-হাতুড়ির মুখে
সোজা জিজ্ঞাসা –
দুশো বছরের রক্ত শুষেও
মেটেনি পিপাসা?
একই বিশ্বাসে বিপ্লবশেষে সম্ভাব্য সফলতার ঘোষণা চিরকুটের কবিতায় :
দিন আসে ভাই –
কাস্তের মুখে নতুন ফসল তুলবার।
এমন বহু উদাহরণ তুলে ধরা যাবে কাস্তের সংগ্রামী ভূমিকা নিয়ে, নানা প্রতীকে, নানা চিত্ররূপে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে। চল্লিশের দশকের চরিত্রমাফিক, আদর্শমাফিক কাস্তে-প্রাকরণিক কাব্যপঙ্ক্তির তিরিশের দশক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যে – সরাসরি বিপ্লবী সংগ্রামী ধারায়।
একইভাবে অনুরূপ যুগোপযোগী কবিতাপঙ্ক্তির সন্ধান মেলে সুকান্তর রচনায়। সুভাষের কবিতায় যেখানে প্রাকরণিক উদ্ভাস আপন বৈশিষ্ট্যে, সুকান্তে সেখানে স্পষ্টতা, ঋজুতা, সরল-জটিলতাহীন শব্দবিন্যাস। সম্ভবত এ-কারণেই সমকালে সুকান্তর কবিতা অনেক বেশি পাঠকমন জয় করেছিল – এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল সুভাষ-সুকান্তকে নিয়ে জনপ্রিয়তার তুলাদ-ে।
সুকান্তের ‘ফসলের ডাক : ১৩৫১’ কবিতাটি শুরুই হয়েছে এভাবে সহজ-সরল শব্দভাষ্যে :
কাস্তে দাও আমার এ হাতে –
সোনালী সমুদ্র সামনে, ঝাঁপ দেব তাতে। …
আমার পুরনো কাস্তে পুড়ে গেছে ক্ষুধার আগুনে
তাই দাও দীপ্ত কাস্তে-চৈতন্য-প্রখর –
যে কাস্তে ঝলসাবে নিত্য উগ্র দেশপ্রেমে,
যে কাস্তে শত্রুর কাছে দেখা দেবে অত্যন্ত ধারালো।
এমন কিছু কাস্তেবিষয়ক কাব্য-উল্লেখের উদাহরণ মিলবে সুকান্ত ভট্টাচার্যের একাধিক কবিতায়। যেমন – ‘এরই মধ্যে হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর/ কঠিন কাস্তেতে দেয় সুর’ ইত্যাদি।
তবে তিরিশ আর চল্লিশে বড় একটি পার্থক্য হলো কবি দিনেশ দাস চাঁদকে কাস্তের রূপ দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন অভিজাত কবিমহলে, অন্যদিকে সুভাষ-সুকান্ত প্রমুখ বিপ্লবী কবিরা কাস্তেকে শ্রেণিসংগ্রামের নানা ভাষ্যে হাজির করেছিলেন। তাই সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের উপমা টেনে বলতে পেরেছিলেন : ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ – যে-কাব্যপঙ্ক্তি একসময় পাঠকের মুখে মুখে ফিরতো।

পাঁচ
কাস্তে কৃষকসমাজে ফসল কাটার অতি প্রয়োজনীয় একটি হাতিয়ার। অন্যদিকে সমাজবদলের আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী অস্ত্র, যেমন শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের প্রতীক হাতুড়ি। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গন তার সর্বোচ্চ সংগ্রামী সচেতনতার কালে (যেমন বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে) কাস্তে-হাতুড়িকে নান্দনিক সৃজনশীলতায় ব্যাপক হারে ব্যবহার করেছিল, ইতিহাস তা ধরে রেখেছে যেমন কবিতায়, তেমনি গণসংগীতে।
সে-পর্যায়ে গণসংগীতে কাস্তের সাংস্কৃতিক ব্যবহার ছিল অনেক বেশি ধারালো, যে-ধারা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হয়ে পূর্ববঙ্গে ষাটের দশক পর্যন্ত বিস্তৃতিলাভ করে একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে। কাস্তে তখন শ্রেণিসংগ্রামের প্রতীক, শ্রেণিশত্রু খতমের হাতিয়ার – যেমন কৃষক-আন্দোলনের উগ্রতায়, তেমনি তেভাগার অনুরূপ আন্দোলনে, মূলত উত্তরবঙ্গে।
ধানকাটা-ফসলকাটার হাতিয়ারকে মূলত তেভাগা তথা উত্তাল কৃষক-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গণসংগীতে কাস্তেতে শান দেওয়ার আহ্বানে গণসংগীতকারদের মধ্যে সলিল চৌধুরী ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস ঐতিহাসিক মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। সমাজসচেতন সাংস্কৃতিক মহলে তাঁদের জনপ্রিয়তা ছিল অপরিসীম। কবি দিনেশ দাস যার সূচনা ঘটিয়েছিলেন একাধিক কবিতায়, বিশেষ করে ‘কাস্তে’ শীর্ষক কবিতায়, তাতে কবিতায় সুভাষ-সুকান্ত প্রমুখ এবং গণসংগীতে পূর্বোক্ত দুজন বৈপ্লবিক সংগ্রামী আবহ তৈরি করেন।
সেই ঐতিহাসিক সৃজনশীলতার দু-একটি চরণের উদাহরণ আমাদের সেই ঐতিহাসিক যুগটিকে স্মরণ করিয়ে দেবে – সমাজ-সচেতন রাজনীতি-সচেতন তরুণদের মুখে মুখে এবং মাঠে-ময়দানে ক্ষেতে-খামারে সেসব গণসংগীত প্রবল আবেগ সৃষ্টি করেছে। যেমন সলিল চৌধুরীর গান – ‘হেই সামালো, হেই সামালো ধান হো/ কাস্তেটা দাও শান হো/ আর দেব না ধান মোদের প্রাণ হো’ ইত্যাদি অবিস্মরণীয় গানের চরণ। তেমনি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বহু গানের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় কাস্তের গান – ‘তোমার কাস্তেটা দিও জোরে শান,/ ও কিষাণ ভাইরে।’
শীর্ণকায় বাঁকা চাঁদ এবং কাস্তে, বিশেষভাবে কাস্তের প্রতীকে এক সময় বাংলা কবিতা ও গান সাহিত্য-সংস্কৃতির আসর মাতিয়েছিল, এখন তা বিস্মৃত ইতিহাস। সময়ের অনেক চরিত্রবদল ঘটে গেছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, এমনকি কাজে, সংগীতে।‌

সংগৃহীত



Thursday, 26 November 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

    জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য


যতীন্দ্রমোহন বাগচী
=============¶¶¶¶¶¶¶¶¶=====≠==≠===
          Doinik sabder methopath
  Vol -204. Dt- 27.11.2020
অগ্রহায়ণ, ১৪২৭. শুক্রবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷$$$$$$$÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

"বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই
মাগো, আমার শোলকবলা কাজলা দিদি কই?’’ 

কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত যমশেরপুর ভূপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়।  কবির জন্মভিটে, নাটমন্দির, আস্তাবল, হাতিশালা, সিংহদুয়ার, নাচমহল, কবির হাতির (কালীর) সমাধি, আমবাগান, পদ্মপুকুর, চন্দনাদিঘি, নতুন বাড়ি, পুরাতন বাড়ি আজ‌ও মনের মধ্যে গুনগুন করে গেয়ে ওঠে—
 ‘‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই— মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?’’ কখনও কখনও মনের অজান্তেই বলে উঠে— 
"ওই যে গাঁটি যাচ্ছে দেখা ‘আইরি’ খেতের আড়ে...।  

কবির অমর সৃষ্টি কবিতা ‘কাজলা দিদি’ (দিদিহারা) যা পরে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে প্রতিমা বন্ধ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একটি অতি জনপ্রিয় গান হয়ে বাঙালির মনের মণিকোঠায় চির উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গিয়েছে। তাঁর আরও দু’টি গান এক সময়ে খুবই খ্যাতি লাভ করেছিল। শচীন দেব বর্মনের কণ্ঠে— ‘ঝুলন ঝুলিছে শ্যামরাই’ আর ‘বাইবো না আর উজান ঘরে’। তবে ‘কাজলাদিদি’ এবং ‘জন্মভূমি’ কবিতা দু’টি কবিকে বাঙালির হৃদয়ে চিরভাস্বর করে রেখেছে।      


 ইংরেজি ১৬২৪ -১৭১১ সালে সৃষ্টিধর বাগচী অবিভক্ত নদিয়ার যমশেরপুর গ্রামে কাঁচা ঘরের পরিবর্তন ঘটিয়ে যে পাকা গৃহের পত্তন করেন সেই বাড়িটিই ‘পুরাতন বাগচী বাড়ি’ বলে পরিচিতি লাভ করেছিল। কালক্রমে এই বাড়িটিই রাজপ্রাসাদের আকার ধারণ করে। সৃষ্টিধরের পরবর্তী বংশধর রামনৃসিংহ বাগচী (বাংলা ১১৬৮- ১২৩২), ইনিই যমশেরপুরের আধুনিক বর্ধনশীল বাগচী বংশের আদি পুরুষ বলে পরিচিত। এর পরবর্তীতে বাংলার ১২৪৪ সালে হরিমোহন বাগচী পুরাতন বাগচী বাড়ির অনতিদূরে পত্তন করেন আর এক সুবিশাল রাজপ্রাসাদ, যেটিকে নতুন বাড়ি বল হয়।

 উচ্চবিত্তসম্পন্ন জমিদার বাগচী পরিবারে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী ২৭ নভেম্বর ১৮৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হরিমোহন বাগচী, মাতা গিরিশমোহিনী দেবী।বিগত বাংলা ১২৪০ থেকে ১২৫০ সাল পর্যন্ত রামগঙ্গা বাগচী নসিপুরের মহারাজা কীর্তিচাঁদের আমলে দেওয়ানির রাজ করতেন। এর পর তিনি যুগিনদা, টেকা, মজলিশপুর, বিদাড়া, পরাশপুর, কুপিলা ও যমশেরপুরের জমিদারির পত্তনী নেন। ক্রমে ক্রমে ধনে-মানে-প্রতিপত্তিতে এই বাগচী জমিদারদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। পুরাতন বাড়ির মালিক জমিদার নারায়ণ বাগচীর অকালপ্রয়াত কনিষ্ঠ পুত্র ভূপেন্দ্রনারায়ণের জমিদারির অংশ যমশেরপুর উচ্চ ইংরেজি স্কুলকে দান করেন। এবং স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ স্কুলটির নাম রাখেন ‘যমশেরপুর ভূপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়’। অপর দিকে, রামগঙ্গা বাগচীর প্রথম পুত্র কৃষ্ণনারায়ণের স্ত্রী ভবসুন্দরী দেবীর নামে স্কুল সংলগ্ন ‘ভবসুন্দরী হিন্দু হোস্টেল’ প্রতিষ্ঠা করেন। 

 বাগচী পরিবার যমশেরপুর গ্রামকে আদর্শপল্লিতে উন্নীত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এই উদ্দেশ্যে উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, হরিমোহন দাতব্য চিকিৎসালয়, বড় ডাকঘর, ইট-বিছানো সদর রাস্তা, একাধিক পুকুর, পানীয় জলের জন্য বড় বড় কুয়ো, শিশুদের খেলাধুলো করার জন্য গ্রামের মধ্যে হিতসাধনী মাঠ ইত্যাদি স্থাপন করেন। বিগত ১৮৩২/৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই বাগচী পরিবারের পুরাতন বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করে সমগ্র গ্রামখানিকে আনন্দ-উচ্ছল, কোলাহলমুখর করে তুলেছিলেন। এখনও দুর্গাপুজো হয়। তবে সে প্রাণ আর নেই।    
কিন্তু হায়! কালের করাল গ্রাসে এই স্বর্গপুরী বাগচী বাড়ি আজ শুধুই কঙ্কালসর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবির বংশের উত্তরাধিকাররা দেশ-বিদেশে ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন। জৌলুস হারিয়ে বড় অবহেলায় পড়ে আছে কবির জন্মভিটে। এখন পড়ে আছে জরাজীর্ণ, নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত, ধূলো-ধূসরিত প্রায় ভগ্নস্তূপ অট্টালিকা। এখন ভেঙে পড়ছে খিলান-সিংহদুয়ার। দুর্গাদালানে নোংরা ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে তিনশো বছরের পুরনো পালকিটি। সময় কবেই তার চলাচল থামিয়ে দিয়েছে। বাড়ির চারপাশে জমে উঠেছে আগাছা জঙ্গল। দিনের বেলাতেও সাপখোপ, বাদুড়, চামচিকে, পেঁচা, পায়রা, মাকড়সার জালে চারপাশ পরিপূর্ণ। বিশাল স্তম্ভের সুন্দর কারুকার্য খসে খসে পড়ছে, দেওয়ালের ফোকর দিয়ে বট-পাকুড় জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠেছে। কবি যতীন বাগচীর সাধের লাইব্রেরি কক্ষটির দীন দশা আজ অন্তিম পর্যায়ে। দর্শনার্থীরা কবির বাড়ি দেখতে এসে শুধুই হা-হুতাশ করেন। তাঁরা আর কী-ই বা করবেন? 

বাংলা বা বাঙালি কবি যতীন্দ্রমোহনকে কতটা মনে রেখেছে— এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলা যায়, নদিয়া জেলার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী যমশেরপুর গ্রামের কবিকে নিয়ে বৃহত্তর এলাকার মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং পবিত্র শ্লাঘা। তাঁর এই সারস্বত সাধনার আহ্বানে যমশেরপুর গ্রামের মাটিকে এক দিন ধন্য করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম। ১৯৭৮ সালে কবির জন্মশতবর্ষ পালিত হয় কবির জন্মভিটায়। তিন দিনের অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথনাথ ঘোষ, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সংবাদভাষ্যকার দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী প্রমুখ নক্ষত্রের উপস্থিতিতে।      
তিনি বহু সাহিত্যিক পত্রিকায় গঠনমূলক অবদান রেখেছেন। ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত মানসী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯২১ এবং ১৯২২ সালে তিনি যমুনা পত্রিকার যুগ্ন সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ পূর্বাচল পত্রিকার মালিক এবং সম্পাদক ছিলেন। তার রচনায় তার সমকালীন রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ্য করে যায়। তাঁকে রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করে হয়। বাগচি ১৯৪৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরন করেন।

পল্লী-প্রীতি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিমানসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। "পথের পাঁচালী"র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবি জীবনানন্দ দাশের মত তার কাব্যবস্তু নিসর্গ-সৌন্দর্যে চিত্ররূপময়। গ্রাম বাঙলার শ্যামল স্নিগ্ধ রূপ উন্মোচনে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন। গ্রাম জীবনের অতি সাধারণ বিষয় ও সুখ-দুঃখ তিনি সহজ সরল ভাষায় সহৃদয়তার সংগে তাৎপর্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন।

সাহিত্যকর্ম 
সংকলিত কবিতা 

 কাব্যগ্রন্থ

লেখা (১৯০৬),
রেখা (১৯১০),
অপরাজিতা (১৯১৫),
বন্ধুর দান (১৯১৮),
জাগরণী (১৯২২),
নীহারিকা (১৯২৭)
মহাভারতী (১৯৩৬)
কাব্যমালঞ্চ
নাগকেশর,
পাঞ্চজন্য,
পথের সাথী প্রভৃতি
কবিতা সম্পাদনা
কাজলাদিদি
শ্রিকল
অন্ধ বধু
হাট
উপন্যাস '
পথের সাথী

এই অঞ্চলের মানুষের অন্যতম কাব্যিক অভিজ্ঞান হলেন যতীন্দ্রমোহন। এই অঞ্চলের মানুষ যতীন্দ্রমোহনের কাব্যমালঞ্চের অপরাজিতা নাগকেশরের পরাগ মেখে এখনও কবির মহাভারতী পাঞ্চজন্যে শঙ্খধ্বনির জন্য উৎকর্ণ হয়ে থাকেন, থাকবেন। তাই যতীন্দ্রমোহন বাগচীর অনুষঙ্গে বিশ্বকবির গান যেন বুকের মধ্যে বাজে— ‘‘তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ, ও মোর ভালবাসার ধন।’’     

১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কবি ইহলোক ত্যাগ করেন। রবীন্দ্র অনুরাগী নদিয়ার সুসন্তান পল্লীকবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যপূর্ণ বাগচীবাড়ির সলিল সমাধি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কবির জন্মভিটেকে ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’ ঘোষণা করে সংরক্ষণ করা আশু প্রয়োজন। না হলে ভাবীকাল আমাদের ক্ষমা করবে না।




Wednesday, 25 November 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
             জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
===============!!!!!!!!!!!!===========
          Doinik sabder methopath
Vol -203. Dt - 26.11.2020
       অগ্রহায়ণ,১৪২৭. বৃহস্পতিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷|||||||÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৯০ সালের ২৬ নভেম্বর, হাওড়ার শিবপুরে, তাঁর মামার বাড়িতে। উত্তর ভারতের কান্যকুব্জ থেকে, একাদশ-দ্বাদশ শতকের দিকে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাঁদেরই একজন ছিলেন সুনীতিকুমারের ত্রয়োদশ পূর্বপুরুষ – বীতরাগ। বীতরাগের এক পৌত্র সুলোচনকে বল্লাল সেন পশ্চিমবঙ্গের চাউটুতি গ্রাম দান করেছিলেন। তুর্কিদের বঙ্গদেশ অধিকারের পর এই পরিবার পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে এসে বাস করতে থাকেন। সুনীতিকুমারের প্রপিতামহ ভৈরব চট্টোপাধ্যায় পিতৃভিটা ত্যাগ করে হুগলিতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। কুলীন ব্রাহ্মণদের ঐতিহ্য অনুসরণে দারপরিগ্রহণ করেই তিনি জীবিকানির্বাহ করতেন। একাধিক বিয়ে করেছিলেন, তবে থাকতেন হুগলিনিবাসী পত্নীর সঙ্গে।পিতা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজ সওদাগরি অফিসের চাকুরে। মাতা কাত্যায়নী দেবীকে হারিয়েছেন বাল্যকালেই। মাতৃহারা সুনীতিকুমার প্রতিপালিত হয়েছেন পিতার যত্নে ও তাঁর ঠাকুরমার স্নেহচ্ছায়ায়। মায়ের কাছেই অক্ষরজ্ঞান লাভ করেছিলেন শৈশবে। এরপর ঠাকুরদাদা ঈশ্বরচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে বাড়িতে পড়ালেখার প্রাথমিক পাঠ লাভ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র ফারসি ও ইংরেজি জানতেন, সংস্কৃত ভাষাও রপ্ত করেছিলেন পরে। ফারসি সাহিত্যের অনেক গল্প শোনাতেন পৌত্রদের। তাঁর কাছ থেকে শুনে শুনে গুলিস্তাঁর অনেক বয়েৎ মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল সুনীতিকুমারের। কলকাতার সুকিয়াস স্ট্রিটের একটি সাবেকি পাঠশালায় সুনীতিকুমারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। গোলপাতার একটি কুঁড়েঘরের সামনের খোলা মাঠে চলতো পাঠশালার পাঠদান। এরপর দুবছরের জন্য পড়েন আমহার্স্ট স্ট্রিটের ক্যালকাটা একাডেমিতে। ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগের মড়ক দেখা দিলে তাঁদের পরিবার শিবপুরে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। তখন বাড়িতেই পড়তেন ঠাকুরদাদার কাছে। এক বছর পর আবার কলকাতায় ফিরে এসে ভর্তি হন মতিলাল শীলের ফ্রি স্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৯০৭ সালে তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন। বিনে মাইনেতে স্কুলে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় মতিলাল শীলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সুনীতিকুমার :আমরা চার ভাই প্রত্যেকেই ৮ বা ৭ বছর ক’রে মোতীলাল শীলের দাক্ষিণ্যে তাঁর-ই স্থাপিত ইস্কুলে বিনা বেতনে প’ড়ে মানুষ হই। তাঁর কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য, কৃতজ্ঞ হৃদয়ে নতমস্তকে তাঁর পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করি।এন্ট্রান্সের নির্বাচনী পরীক্ষায় গণিতে শূন্য পেয়েছিলেন, কাজেই এই বিষয়ে পাশ করবেন কি না এই নিয়ে শঙ্কা ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষার আগের কয়েক মাস অনলস সাধনায় গণিত রপ্ত করলেন ভালোভাবেই। পরীক্ষায় ফল বেশ ভালো হলো – মেধা তালিকায় ষষ্ঠ স্থান। এফ.এ. পড়লেন জেনারেল অ্যাসেম্বলি মিশনারির কলেজে, এটি পরে ডাফের কলেজের সঙ্গে একীভূত হয়। এখন এর নাম স্কটিশ চার্চ কলেজ। এফ.এ. পরীক্ষার ফলও ভালো হলো, তৃতীয় স্থান অর্জন করলেন। উভয় পরীক্ষায় মেধা-বৃত্তি পাওয়ায় তাঁর উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ প্রশস্ত হলো। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হলেন, অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করলেন। প্রেসিডেন্সিতে এম.এ. পড়লেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রায়ই ক্লাস করতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণির পাঠদান তখন সবে শুরু হয়েছে। এম.এ.তে সুনীতিকুমার সাহিত্যের পরিবর্তে ভাষা শাখায় পরীক্ষা দিলেন; এজন্য তাঁকে অধ্যয়ন করতে হয়েছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইংরেজি ভাষা। ভাষাবিজ্ঞানও পড়েছেন অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে। এম.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেই। বঙ্গীয় সংস্কৃত পর্ষদের অধীনে অনুষ্ঠিত সংস্কৃত পরীক্ষায়ও পাশ করলেন কৃতিত্বের সঙ্গে।স্কটিশ চার্চ কলেজে তিনি বেশ কয়েকজন গুণী শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। ইতিহাসের অধ্যাপক বিপিনচন্দ্র সেন ও অধরচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন গ্রিস ও রোমের ইতিহাস অধ্যয়নের অনুপ্রেরণা। গ্রিক ও রোমান সাহিত্য অধ্যয়নের সূচনা হলো। এ ভাষাদুটি তিনি জানতেন না, শিখতে শুরু করলেন। এই দুই সভ্যতার ভাস্কর্য তাঁকে আকৃষ্ট করতে থাকে। প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক এইচ.এম. পার্সিভাল তাঁকে ইউরোপীয় জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তোলেন।সুনীতিকুমারের চাকরিজীবনের সূচনা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে। কিছুদিন পর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট নক্সের সহকারী পদে নিয়োগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়ে তিনি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। প্রাচীন-মধ্যযুগের ইংরেজি এবং টিউটনিক ভাষা সম্পর্কে এম.এ. পড়ার সময়েই কিছুটা ধারণা তাঁর হয়েছিল। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার জার্মানিক শাখা সম্পর্কে গবেষণা করার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু যোগ্য তত্ত্বাবধায়ক পেলেন না। এই সময়ের কিছু আগে-পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন ঘটে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও বসন্তরঞ্জন বিদ্বদ্বল্লভের চয্যাচর্য্যবিনিশ্চয় ও শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের পুথি আবিষ্কার, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি – এইসব ঘটনা সুনীতিকুমারকে বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধানী করে তোলে। তিন বছর ধরে গবেষণা করেন তিনি বাংলা ভাষায় ফারসি উপাদান, বাংলা ক্রিয়া ও ক্রিয়ামূল এবং চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কে। এই গবেষণা কাজের জন্য তিনি প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। বাংলার উপভাষা সম্পর্কে গবেষণার জন্য পেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবিলি পুরস্কার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষকের চাকরিও জুটে যায় ১৯১৭ সালে। ১৯১৯ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি পান ইউরোপে গিয়ে ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য।বিলেতে গিয়ে তিনি ভর্তি হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে। ১৯১৯ থেকে ১৯২২ – এই তিন বছর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের সেরা অধ্যাপকদের কাছে তিনি শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এল.ডি. বার্নেট ছিলেন তাঁর গবেষণা নির্দেশক। বার্নেটের কাছ থেকে শিখেছেন পালি। তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক এফ.এ. থমাসের কাছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী সম্পর্কে জেনেছেন। ধ্বনিবিজ্ঞানের পাঠ নিয়েছেন অধ্যাপক ড্যানিয়েল জোন্সের মতো পন্ডিতের কাছ থেকে। ড্যানিয়েল ছিলেন একই সঙ্গে তাঁর শিক্ষাগুরু ও সুহৃদ। এই সময়ে সার ই. ডেনিসন রস, অধ্যাপক আর.ডব্লিউ চেম্বারস, ই.এইচ.জি গ্রাটান ও রবিন ফ্লাওয়ারের ক্লাসে বসে শিখেছেন যথাক্রমে ফারসি, প্রাচীন ইংরেজি, গোথিক ও প্রাচীন আইরিশ। সার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের সঙ্গে এই সময়ে তাঁর যোগাযোগ ছিল। গ্রিয়ার্সন সুনীতিবাবুর কাজ সম্পর্কে বেশ আগ্রহী ও উৎসাহী ছিলেন। The Origin and Development of the Bengali Language-এর ভূমিকাও লিখেছেন গ্রিয়ার্সন।প্যারিসে তিনি অধ্যাপক অাঁতোয়েন মেইলেত ও জুল ব্লখের কাছ থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী, বিশেষত ভারতীয় আর্যভাষাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছেন। সিলভাঁ লেভি, পল পেলিওত ও জাঁ প্রিজিলুস্কির (Przylusky) সান্নিধ্যেও তিনি বেশ উপকৃত হয়েছেন।১৯২২ সালের নভেম্বরে তিনি ফিরে আসেন কলকাতায়। ততদিনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্বনিবিজ্ঞান বিভাগে খয়রা অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হয়েছে। সুনীতিকুমার এই পদে যোগ দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে তিনি পড়াতেন বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, সংস্কৃত ও তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান। পরে ফারসি, পালি, ইসলামের ইতিহাস ও ফরাসি বিষয়ে ক্লাস নেন। ধ্বনিবিজ্ঞানও পড়িয়েছেন।লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনীতিকুমার বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে গবেষণা করে ডি.লিট উপাধি অর্জন করেন ১৯২১ সালে। তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ১৯২৬ সালে এটি প্রকাশিত হয় The Origin and Development of the Bengali Language নামে। এই অভিসন্দর্ভটি সুনীতিকুমারের প্রধান কীর্তি, একটি অসাধারণ ও বড় মাপের কাজ, – Magnum Opus।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষার ঠিকুজি নির্ণয়ের একটি পরিশ্রমসাধ্য কাজ করেছেন। ১৯১৯ থেকে ১৯২১-এর মধ্যে – এই অল্পসময়ে – এই ধরনের একটি কাজ সমাপ্ত করা প্রায় অকল্পনীয়। নিজের মাতৃভাষা সম্পর্কে এরকম একটি গবেষণা করার চিন্তা তাঁর মনে এসেছিল প্রায় একযুগ আগে – এম.এ. পড়ার সময়। ইংরেজি ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আধুনিক পদ্ধতি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাংলা ভাষাও ইংরেজির মতো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই কারণে ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ করার সম্ভাবনার কথা ভেবে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন।বাংলা ভাষার ঠিকুজি অনুসন্ধান করতে গিয়ে সুনীতিকুমার একটি বিশাল পটে কাজ করেছেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিস্তীর্ণ ভূগোলের অনেক ভাষার সম্পর্ক। বঙ্গীয় ইতিহাসের পর্বান্তরের সঙ্গেও এই ভাষার বিকাশ সম্পর্কিত। বিষয়টি শুধু ভাষাতাত্ত্বিক নয়, বিদ্যানুশীলনের অন্যান্য শৃঙ্খলার সঙ্গেও এর সংযোগ আছে। এই কারণে তাঁর এই কাজ ভূগোল, ইতিহাস ও জনগোষ্ঠীগত ইতিহাসের একটি সমন্বিত অধ্যয়ন। সুনীতিকুমারের আগে জন বীমস্ ভারতীয় ভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর অনুসন্ধান-পদ্ধতির সঙ্গে সুনীতিকুমারের পার্থক্য আছে। বীমস্ ভারতের সব ভাষাকে একক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে একটির সঙ্গে অন্যটির তুলনামূলক আলোচনা করে একটি সূত্র আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। সুনীতিকুমার একটি ভাষাকে আলোচনার ভিত্তি করেছেন, নির্দিষ্ট ভাষার সার্বিক আলোচনা করে অন্যভাষার সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। এই পার্থক্যের কথা জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনও উল্লেখ করেছেন, বইটির ভূমিকায়। তিনি বীমসের পদ্ধতির প্রশংসা করেও এর সীমাবদ্ধতার দিকটি নির্দেশ করেছন :…but such an attempt, ¯ admirable though Beam’s work was, ¯ cannot be really successful till each of the different languages has been separately and minutely dissected under the strictest scientific rules. The palace of comparative grammar cannot be built without bricks, and the bricks are made up of the facts of each particular language.গ্রিয়ার্সনের A Linguistic Survey of India-র বাংলা ভাষা-সম্পর্কিত অংশের সঙ্গে একমত হতে পারেননি সুনীতিকুমার। তবু, সুনীতিকুমারের মেধা ও কাজ সম্পর্কে গ্রিয়ার্সনের ছিল অকুণ্ঠিত স্বীকৃতি।বাংলা ভাষার উদ্ভব-ক্রমবিকাশের ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য বিচার করতে গিয়ে জুল ব্লখের La Formation de la Langue Marathe-র কাঠামোকে সুনীতিকুমার অনুসরণীয় বিচেনা করেছেন। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ-রচনায় রামমোহন রায়, চিন্তামণি গাঙ্গুলি, নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ ও হৃষিকেশ শাস্ত্রীর অবদানকে উল্লেখযোগ্য মনে করলেও বৈজ্ঞানিকভাবে এই ভাষার সমস্যাগুলো আলোচনা করার পথিকৃতের কৃতিত্ব দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে।বাংলা ভাষার ইতিহাস ও প্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য তিনি প্রধানত নির্ভর করেছেন জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান ও বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ-আবিষ্কৃত শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের ওপর। চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়ের উপকরণও তাঁর আলোচনায় প্রভূত পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে।ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সবচেয়ে পূর্বপ্রান্তের ভাষা বাংলা ও অসমীয়া। অসমীয়াকে সুনীতিকুমার বাংলার সহোদরারূপে বিবেচনা করেছেন। ১৯১১ সালের জনগণনার হিসাবে ভারতে বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটিরও কম – ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯১৫ জন। বাংলাভাষীর সংখ্যা তখন ভারতে ছিল সর্বাধিক। এই প্রসঙ্গে হিন্দিভাষীর সংখ্যার প্রসঙ্গও এসে যায়। পশ্চিমী হিন্দির একটি সংস্কৃতরূপ তখন আর্যভারতের এক বিশাল ভূখন্ডের সাহিত্য, শিক্ষা, আদালত ও জনজীবনের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বিহারি, পূর্বী হিন্দি, পাঞ্জাবি, লাহন্দি, মধ্য ও পশ্চিমি পাহাড়ি এবং রাজস্থানি ভাষাভাষী অঞ্চলে এ-ভাষার প্রচলন ছিল। হিন্দি তখন এসব অঞ্চলের লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা ছিল। কিন্তু হিন্দি মাতৃভাষা ছিল সাড়ে চার কোটি মানুষের।বঙ্গদেশের বিরান্নববই শতাংশ মানুষই বাংলাভাষী ছিলেন; অসম, বিহার ও উড়িষ্যারও বেশকিছু এলাকায় বাংলা কথিত হতো। এসব অঞ্চলকে বাংলা ভাষা-ভূগোলের অন্তর্গত গণ্য করেছেন সুনীতিকুমার। ওড়িয়া, মাগহি, মৈথিলি ও অসমীয়া ভাষায়ও বাংলার প্রভাব লক্ষ করেছেন তিনি। ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম অঞ্চল থেকে আগত অভিবাসীদের কারণে বাংলায় হিন্দি ভাষার অনেক শব্দ ও বাকভঙ্গির প্রবেশ ঘটেছে। দার্জিলিং এলাকায় বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে গেছে খাসকুরা বা পর্বতীয়া ভাষার অনেক বৈশিষ্ট্য। এছাড়া বঙ্গদেশের পশ্চিম সীমান্তে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর মুন্ডা শাখার সাঁওতালি, হো ও মুন্ডারি ভাষার সংস্পর্শে এসেছে বাংলা ভাষা। মাল্টো, কুরুখ ও ওঁরাও ভাষার সঙ্গেও বাংলার মিথষ্ক্রিয়া ঘটেছে।বাংলা ভাষার সঙ্গে ভারতীয় আর্যভাষা শাখার অন্য ভাষাগুলোর সংস্পর্শ ও মিথষ্ক্রিয়া ঘটেছে নানা কারণে। এই বিবেচনায় বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে গিয়ে অন্য ভাষাগুলোর পরিচয় দিয়েছেন সুনীতিকুমার। উত্তর-পশ্চিম ভারতের দার্দিক ভাষা উল্লিখিত ভাষা-শাখার অন্তর্গত না হলেও এই ভাষার আলোচনাও করেছেন তিনি। পশ্চিম পাঞ্জাবি বা লাহন্দি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, রাজস্থানি শাখার মারওয়ারি, জয়পুরি, মেওয়াতি, পাহাড়ি বা খাশা, খাসকুরা, পশ্চিমি হিন্দি এবং এর বিভিন্ন রূপ, পূর্বীয় হিন্দি, মারাঠি, ভোজপুরিয়া, সিংহলি এবং পশ্চিম এশিয়ার জিপসিদের ভাষার পরিচয় আছে The Origin and Development of the Bengali Language-এ। ভাষাগুলোর ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ইতিহাসও তুলে ধরেছেন তিনি।ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের বিচারে ভারতীয় আর্যভাষা শাখার বিবর্তনধারাকে – ক. প্রাচীন ভারতীয়, খ. মধ্যভারতীয় ও গ. নব্যভারতীয় – এই তিনটি পর্বে বিন্যস্ত করেছেন সুনীতিকুমার। প্রতিটি পর্বেই ভারতীয় আর্য শাখার ভাষাগুলোর বিবর্তন ঘটেছে – প্রতিটি ভাষা ক্রমশ স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করেছে। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার কালনির্দেশ সুনির্দিষ্ট করা যায়নি। তবে বৈদিক শ্লোকগুলো রচিত হওয়ার সময় থেকে (খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ১৫০০ থেকে ১২০০) গৌতম বুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বপর্যন্ত তিনি এই পর্বের কালসীমা বলে বিবেচনা করেছেন। মধ্যভারতীয় আর্যভাষার কাল মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নব্যভারতীয় আর্যভাষার পর্ব শুরু হয়। এই পর্বের প্রথম কয়েক শতাব্দীকে সুনীতিকুমার নব্যভারতীয় আর্যভাষার আদি বা প্রাথমিক পর্যায় বলে উল্লেখ করেছেন। এরপর থেকে এই পর্ব ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠে, স্থানীয় ভাষাগুলোও স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এখানে আসা আর্যদের ভাষাও একরকম ছিল না। বেশ কয়েকটি উপভাষার প্রচলন ছিল তাদের মধ্যে। এর মধ্যে একটি উপভাষা বা উপভাষাগুচ্ছের নিদর্শন পাওয়া যায় বেদে। বেদবহির্ভূত বেশ কয়েকটি আর্য উপভাষাও প্রচলিত ছিল। এগুলোর মধ্য থেকেই নব্যভারতীয় আর্যভাষা স্তরের কোনো কোনো ভাষা বিবর্তিত হয়েছে বলে সুনীতিকুমার মনে করেন।ভারতীয় আর্যভাষার বিবর্তনের তিনটি স্তর নিয়েই অনেক গবেষণা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার মধ্যে বৈদিক ও সংস্কৃত অন্তর্ভুক্ত। এই দুটি ভাষা সম্পর্কে ইউরোপে গবেষণা হয়েছে প্রচুর।বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তনের ধারা অনুসন্ধানের জন্য ভারতে আর্যদের আগমন-ইতিহাসের পর্যালোচনাও তিনি প্রাসঙ্গিক মনে করেছেন। ভারতবর্ষের আর্যাবর্তে ঋগ্বেদ ধর্মীয় ও সাহিত্যিক অভিব্যক্তির প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে। আর্য জীবনধারার দুটি কেন্দ্র সেই সময়ে ভারতে বিকশিত হয় – একটি গন্ধার, অন্যটি ব্রহ্মবর্ত। আর্যভাষীদের সকলেই বৈদিক ছিলেন না। বৈদিক আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের বিরোধ তো ছিলই, অবৈদিক আর্যদের সঙ্গেও তাদের সংঘাত চলেছিল। তবে আর্য-অনার্য বিরোধ-সংঘাতের মধ্যেও অনার্য সংস্কৃতি ও ভাষা দীর্ঘদিন ধরেই রক্ষা পেয়েছিল। আর্য-অনার্যের এই দ্বন্দ্ব একসময়ে সমন্বয়ের পথে অগ্রসর হয়, উভয়ই একে অপরের জীবনদৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে। এই সমন্বয় পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল গাঙ্গেয় উপত্যকায়। এই বিরোধ-সমন্বয়ের প্রক্রিয়ায় আর্যভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল – উত্তর ভারতে, এমনকি দক্ষিণেও, একসময়ে ভাবের বাহন হয়ে উঠল আর্যভাষা।সুনীতিকুমার মনে করেন, বঙ্গদেশের জনগণ খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগেও আর্যভাষী ছিলেন না। আর্যভাষা বঙ্গদেশে আসে মগধ ও অন্যান্য অঞ্চলের সৈনিক, ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ-জৈন প্রচারক ও বণিকদের মাধ্যমে। বঙ্গদেশের আর্যায়নের সূচনা হয়, সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। মৌর্য ও গুপ্ত শাসনামল জুড়ে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। সপ্তম খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই আর্যায়ন প্রক্রিয়া মোটামুটি সম্পন্ন হয়।

সুনীতিকুমারের বিবেচনায় খ্রিষ্টীয় দশম শতকের মধ্যভাগে বাংলা ভাষা তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। চর্যাপদের আলোচনা-প্রসঙ্গে সুনীতিকুমার বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল নির্ণয় করেছেন। লুইপাকে আদি কবি ধরে নিয়ে তিনি দশম শতককে বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল বলে সাব্যস্ত করেছেন। অবশ্য তাঁর আগে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছিলেন। The Origin and Development of the Bengali Language-এ চর্যার ভাষাও বিচার করেছেন সুনীতিকুমার। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যার ভাষাকে বাংলা বলে সাব্যস্ত করেছিলেন। কয়েকজন কবির শব্দ-বিচার করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তবে বিজয়চন্দ্র মজুমদার তাঁর The History of the Bengali Language (১৯২০)-এ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় The Origin and Development of the Bengali Language-এ সুস্পষ্টভাবেই চর্যার ভাষা বাংলা এই মত ব্যক্ত করেন : The Language of the Caryâs is the genuine vernacular of Bengal at its basis. It belongs to the Early or old NIA. stage. The declension is still more like MIA. rather than NIA., although the system of post-positions has come in.চর্যার ভাষার মূল রূপটি বাংলা বলে সাব্যস্ত করলেও এর মধ্যে সুনীতিকুমার শৌরসেনী অপভ্রংশের প্রভাব লক্ষ করেছেন, সংস্কৃত ও মধ্যভারতীয় আর্যভাষা স্তরের সাহিত্যিক প্রাকৃতের বৈশিষ্ট্যও কিছুটা লক্ষ করেছেন। সুনীতিকুমারই প্রথম ভাষাতাত্ত্বিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে চর্যার ভাষা ও ব্যাকরণ পর্যালোচনা করেন। বাংলায় ক্রিয়াপদে -ইল অতীতকাল এবং -ইব ভবিষ্যৎ জ্ঞাপক। চর্যাপদে এই ধরনের প্রয়োগ লক্ষ করে এর ভাষাকে বাংলা বলে সাব্যস্ত করার অন্যতম যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অতীতকালের চিহ্ন -ইল-র প্রয়োগ তখনো সবক্ষেত্রে হয়নি, অনেক ক্ষেত্রেই -ইঅ রক্ষিত হয়েছে; চর্যাপদের ছন্দ ও টীকাভাষ্য পর্যালোচনা করে তিনি সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন যে, মূল শব্দে -ইল ছিল।চর্যার ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমারের মত অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। বিশেষত ওড়িয়া, অসমীয় ও মৈথিলি পন্ডিতগণ চর্যাপদকে তাঁদের স্ব-স্ব ভাষার রচনা বলে দাবি করেছেন। বাঙালি পন্ডিতগণও এই সম্পর্কে সকলে একমত নন। পন্ডিত বিজয়চন্দ্র মজুমদারের কথা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে, দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর History of Bengali Language and Literature-এর প্রথম সংস্করণে এই সম্পর্কে কোনো আলোচনা না করলেও এর দ্বিতীয় সংস্করণে (১৯৫৪) চর্যার ভাষা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন; এবং চর্যাপদের ভাষা বাংলা নয় বলে সাব্যস্ত করেছেন। আহমদ শরীফও চর্যার ভাষাকে বাংলা বলে মানতে চাননি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ চর্যার ভাষাকে বাংলা সাব্যস্ত করলেও একে ‘বঙ্গ-কামরূপী’ নামে অভিহিত করতে চান। সুনীতিকুমার চর্যার ভাষা মূলত পশ্চিমবঙ্গের ভাষা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই সম্পর্কেও শহীদুল্লাহ্ ভিন্নমত ব্যক্ত করেছেন :আমরা বৌদ্ধগানের ভাষাকে পশ্চিমবঙ্গের বলিয়া নির্দেশ না করিয়া প্রাচীন বাঙ্গালা কিংবা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রাচীন বঙ্গ-কামরূপী ভাষা বলাই সঙ্গত মনে করি।চর্যার কাল নির্ণয় সম্পর্কেও ভিন্নমত আছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লুইপাকে প্রাচীনতম চর্যাকার হিসেবে মেনে নেননি। তাঁর মতে, চর্যা-রচয়িতাদের মধ্যে শবরীপাই প্রাচীনতম। মৎস্যেন্দ্রনাথকে তিনি সপ্তম শতকের বলে বিবেচনা করে ওই সময়টা বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। শহীদুল্লাহ্র এই মত সম্পর্কে আলোচনা-প্রসঙ্গে সুনীতিকুমার তাঁর ‘The Tertiary Stage of Indo-Aryan’ প্রবন্ধে মৎস্যেন্দ্রনাথের কাল সম্পর্কে তারনাথ-উল্লিখিত কিংবদন্তি সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। শহীদুল্লাহ্র মত মেনে নিলে ভারতীয় আর্যভাষার তৃতীয় স্তরের উদ্ভবকাল সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হয়। সুনীতিকুমারের মতে, সপ্তম শতকের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন শব্দে হয়তো তৃতীয় স্তরের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে এই স্তরের সূচনা দশম শতকেই। সুনীতিকুমার ও শহীদুল্লাহ্র মতপার্থক্যের উল্লেখ করছি এই কারণে যে, বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল সম্পর্কে সুনীতিকুমার ও শহীদুল্লাহ্র অনুসারী পন্ডিতগণ দুই ধারায় বিভক্ত। পশ্চিমবঙ্গে সুনীতিকুমারের মত স্বীকৃত, বাংলাদেশের প্রায় সকলেই শহীদুল্লাহ্র অনুসারী।সুনীতিকুমার The Origin and Development of the Bengali Language-এ বাংলা ভাষার প্রত্ননিদর্শন প্রসঙ্গে প্রাকৃতপৈঙ্গলের কথা উল্লেখ করেছেন। বিজয়চন্দ্র মজুমদার প্রাকৃতপৈঙ্গলের কয়েকটি কবিতাকে প্রাচীন বাংলায় রচিত বলে নির্ণয় করেছিলেন। সুনীতিকুমার এই মত অনেকটাই স্বীকার করে নিয়েছেন :It is very likely that in their original form these poems were in Old Bengali, or rather in Proto-Bengali, with MIA. characteristics still present.শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের ভাষাকে তিনি চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বলে বিবেচনা করেন। এতে পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষার প্রাধান্যের কথা বলেছেন তিনি, তবে প্রাচীনতার কারণে এই ভাষার সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও অসমীয়া ভাষার সাদৃশ্যও তাঁর চোখে পড়েছে। কিছুটা ওড়িয়া প্রভাবের কথাও তিনি বলেছেন। তবে প্রাচীন অসমীয়া ভাষার উপস্থিতির কারণে পুথির কিছুটা জাল কি না, অনেকের এই সন্দেহের বিষয়টিও উল্লেখ করতে ভোলেননি।The Origin and Development of the Bengali language-এ বাংলা ভাষার বিবর্তন-ইতিহাসকে তিনি তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন। পরে, ‘বাংলা ভাষার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে এই বিভাজনকে আরেকটু বিস্তৃত করেছেন তিনি। ভাষার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগেরও একটি রূপরেখা দিয়েছেন তিনি। ভাষা ও সাহিত্যের যুগবিভাগের ক্ষেত্রে তিনি সমান্তরলতার অনুসারী। তাঁর মতে :বাংলা ভাষার ইতিহাসে যেরূপ যুগবিভাগ করিতে পারা যায় বাঙ্গালা সাহিত্যেও সেইরূপ যুগবিভাগ প্রশস্ত।সুনীতিকুমারের যুগবিন্যাসটি এই প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারে : বাংলাভাষার যুগ-বিভাগ বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ -
১. বাঙ্গালা ভাষার আদি বা ১. প্রাচীন বা মুসলমান-পূর্বপ্রাচীন যুগ : খ্রীষ্টাব্দ যুগ : ১২০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত;১২০০ পর্যন্ত; ২. যুগান্তর কাল : ১২০০ ২. তুর্কী-বিজয়ের যুগ : ১২০০হইতে ১৩০০ পর্যন্ত; হইতে ১৩০০ পর্যন্ত; ৩. আদি মধ্যযুগ, প্রাক-চৈতন্য ৩. আদি মধ্য যুগ বাবা চৈতন্য-পূর্ব যুগ : প্রাক-চৈতন্য যুগ :১৩০০ হইতে ১৫০০ পর্যন্ত; ১৩০০ হইতে ১৫০০ পর্যন্ত;৪. অন্ত্য মধ্য-যুগ : ১৫০০ ৪. অন্ত্য মধ্য-যুগ : ১৫০০হইতে ১৮০০ পর্যন্ত; হইতে ১৮০০ পর্যন্ত;ক. চৈতন্য-যুগ বা বৈষ্ণব-সাহিত্য-প্রধান যুগ :১৫০০-১৭০০খ. অষ্টাদশ শতক ( নবাবী আমল) : ১৭০০-১৮০০;৫.আধুনিক যুগ : ১৮০০ হইতে। ৫. নবীন বা আধুনিক বা ইংরেজযুগ : ১৮০০ হইতে। বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাজনের সঙ্গে বঙ্গদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সমান্তরলতা আছে। সুনীতিকুমার এই ক্ষেত্রে ভাষার বিবর্তনকে বিবেচনায় এনেছেন। এর সঙ্গেও রাজনৈতিক ইতিহাসের সাদৃশ্য আছে, তবে ভাষার সঙ্গে সাহিত্যের বিকাশকে সম্পর্কিত করার যুক্তিটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়।১৯৪৩ সালে প্রকাশিত রমেশচন্দ্র মজুমদার-সম্পাদিত History of Bengal-এর প্রথম খন্ডের দ্বাদশ অধ্যায়ে ‘Rise of Vernacular Literature’ শীর্ষক রচনায় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। আলোচনার শুরুতে তিনি বাঙালি জনগোষ্ঠীর পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর মতে, বঙ্গদেশে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর আগমন ও তাদের পারস্পরিক সংমিশ্রণের ফলে খ্রিষ্টপূর্ব বঙ্গদেশের ভাষা-পরিস্থিতি বেশ জটিল ও অনির্দিষ্ট ছিল। আর্যভাষীদের আগমনের ফলেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর গঠন সম্পন্ন হয় এবং বাংলা ভাষার বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দেয় বলে মনে করেন তিনি। এই আলোচনায় প্রাচীনযুগে রচিত বাংলা সাহিত্যকে তিনি ১. Buddhist, ২. Brahminical ও ৩. Secular – এই তিন ভাগে বিন্যস্ত করেছেন। বৌদ্ধসাহিত্য অংশে তিনি আলোচনা করেছেন চর্যাপদ সম্পর্কে। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য অংশে মানসোল্লাসের সূত্রে জ্ঞাত প্রাচীন বাংলা ও অপভ্রংশে রচিত বিষ্ণু ও কৃষ্ণ-বিষয়ক রচনার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রাক-মুসলমান পর্বে ধর্মনিরপেক্ষ প্রেম-কবিতা রচিত হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন তিনি। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলে রক্ষিত প্রাকৃতপৈঙ্গলে সংকলিত কয়েকটি কবিতা এবং সেক-শুভোদয়ায় উদ্ধৃত একটি প্রেমমূলক কবিতার কথা এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন।সুনীতিকুমার বাংলা উপভাষার শ্রেণিবিন্যাসও করেছেন The Origin and Development of the Bengali Language বইতে। এই বিন্যাসের জন্য তিনি বাংলা ভাষার আধুনিক রূপকেই বেছে নিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভাষাবিচারে উপভাষার শ্রেণিকরণ যুক্তিযুক্ত নয়, ভাষার প্রচলিত রীতিকে বিবেচনায় নিয়েই এই শ্রেণিকরণ করা বিধেয়।বাংলা উপভাষাগুলোর সঙ্গে মৈথিলির বেশ কিছু সাদৃশ্য সনাক্ত করেছেন তিনি। বঙ্গদেশের ভাগলপুর ও মিথিলার চিকাচিকি এলাকার সমন্বয়ে ‘অঙ্গ’ নামে পরিচিত এলাকায় বাংলা উপভাষাগুলোর প্রাথমিক রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর এই উপভাষা-বৈশিষ্ট্যের বিস্তার ঘটে রাঢ় এবং পুন্ড্র বা বরেন্দ্রভূমিতে। মিথিলা ও বরেন্দ্রভূমি থেকে ব্যাপক হারে অভিবাসনের ফলে অসম উপত্যকায়ও এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। রাঢ় এলাকা থেকে এই উপভাষা-বৈশিষ্ট্য বিস্তৃত হয় দক্ষিণ বঙ্গে। সুনীতিকুমার বাংলা উপভাষাকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন – রাঢ়, পুন্ড্র বা বরেন্দ্র, বঙ্গ ও কামরূপ – এই চারটি জনপদের সঙ্গে সম্পর্কিত করে এই বিন্যাস করেছেন তিনি। তবে, উপভাষার শ্রেণিকরণ খুব সহজ নয় – একথাও উল্লেখ করছেন। কাছাড়, সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি ও ত্রিপুরা অঞ্চলের পৃথক ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, সাহিত্যিক ভাষার ক্রমবর্ধমান প্রভাব, ব্যাপক অভিবাসনের ফলে ভাষার মিশ্রণ – এসব কারণে উপভাষাগুলোর বিচার বেশ জটিল।


সুনীতিকুমার মনে করেন, বাংলার উপভাষাগুলো কোনো একক আদিম উৎস থেকে উৎসারিত নয়। মাগধী অপভ্রংশের বিভিন্ন স্থানিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই সেগুলো বিকশিত হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমান্বয়ে একটি সর্ববঙ্গীয় চরিত্র – তাঁর ভাষায়, pan-Bengali – অর্জন করেছে। বাংলা সাহিত্যের ভাষাও pan-Bengali বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে বলে তিনি মনে করেন। উপভাষা-বিচারের ক্ষেত্রে তিনি ভৌগোলিক উপভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, শ্রেণি-উপভাষা সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন।সুনীতিকুমারের The Origin and Development of the Bengali Language প্রকৃত অর্থেই একটি মহাগ্রন্থ। বাংলাভাষার ইতিহাস, গঠন-বেশিষ্ট্য ও ব্যাকরণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি কার্যত বাঙালির ইতিহাস, ভূগোল ও মানস-সংস্কৃতিরও পরিচয় তুলে ধরেছেন। বাঙালি মনীষার একটি উল্লেখযোগ্য কৃতি এই অসাধারণ গ্রন্থটি।লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি.লিটের কাজ শেষ করার পর ড্যানিয়েল জোনসের তত্ত্বাবধানে বাংলাভাষার ধ্বনি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই গবেষণার ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুটি বই – A Bengali Phonetic Reader ও Bengali Self-taught। A Bengali Phonetic Reader-এর ভূমিকায় সুনীতিকুমার উল্লেখ করেছেন, বাংলা ভাষার একটি রীতির উচ্চারণকে ভিত্তি করেই তাঁর গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। কলকাতার শিক্ষিতজনের ভাষাকে প্রমিত ধরে নিয়ে তিনি এই কাজ করেছেন। উচ্চারণের ক্ষেত্রে নির্ভর করেছেন তাঁর নিজের উচ্চারণের ওপর। বাংলা ধ্বনিগুলোর পরিচয় ও সেগুলোর ধ্বনিগুণ সম্পর্কে আলোচনায় ধ্বনিমূলের ধারণাটি প্রয়োগের ব্যাপারে সুনীতিকুমারই পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলা অবিভাজ্য ধ্বনি ও শ্বাসাঘাত নিয়েও আলোচনা করেছেন তিনি। চর্চা করেছেন সংস্কৃত ধ্বনি নিয়েও। ‘The Pronunciation of Sanskrit’ শীর্ষক প্রবন্ধে পাণিনি-যুগের সংস্কৃত উচ্চারণ এবং কিছু কিছু শব্দের আধুনিক কাল পর্যন্ত বিবর্তনের রূপগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। সুনীতিকুমার যে-সময়ে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন, তখন ঐতিহাসিক-তুলনামূলক রীতির প্রাধান্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি বর্ণনামূলক পদ্ধতিরও প্রয়োগ করেছেন তাঁর ভাষাচর্চায়। ধ্বনিবিজ্ঞানে তাঁর পারদর্শিতা ছিল প্রশ্নাতীত। ধ্বনিবিজ্ঞানে পান্ডিত্যের জন্যই তিনি ১৯৬৯ সালে International Phonetic Association-এর সভাপতি নির্বাচিত হন।বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বাংলা ব্যাকরণের প্রতি তিনি মনোযোগী হয়েছিলেন। The Origin and Development of the Bengali Language-এ তিনি বাংলা ভাষার ধ্বনিবিচার করেছেন, রূপতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন, বাংলা লিপিরও পর্যালোচনা করেছেন। বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁর সামগ্রিক আগ্রহ ও গবেষণার প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার একটি ব্যাকরণ রচনায় উদ্যোগী হওয়া তাঁর জন্য প্রায় অনিবার্যই ছিল। সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুকরণে বাংলা ব্যাকরণ রচিত হওয়া উচিত নয় – এই মনোভাব তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, ১৯২৮ সালে The Origin and Development of the Bengali Language প্রকাশিত হওয়ার দু-বছরের মধ্যেই। বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে এই ধরনের চিন্তা অবশ্য আরো আগেই শুরু হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও বাংলা ভাষার জন্য সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাবমুক্ত ব্যাকরণ-রচনার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন।১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণে সুনীতিকুমার বাংলা ব্যাকরণের একটি আদর্শ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পরে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপযোগী এই ব্যাকরণের একটি সরল সংস্করণও তিনি রচনা করেছেন সরল ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ নামে। ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের আলোচনায় সুনীতিকুমারের এই ব্যাকরণ বাংলা ব্যাকরণচর্চার ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। বাংলা ব্যাকরণের আলোচনায় বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের প্রয়োগ করার ফলে এই ব্যাকরণটি ভাষা বিচার ও শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি আদর্শ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।সুনীতিকুমার বাংলা ভাষাচর্চাতেই সীমিত থাকেননি। ভাষাচর্চায় তাঁর আগ্রহ অধিকার ব্যাপক। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ধ্বনিবিচার করেছেন (‘Evolution in Speech Sounds’), ভারতীয় আর্যভাষার তৃতীয় স্তরের উদ্ভব ও এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন (‘The Tertiary Stage of Indo-Aryan’), ভারতীয় আর্যভাষায় অনার্য উপাদান শনাক্ত করেছেন (‘Non-Aryan Elements in Indo Aryan’), কলকাতার হিন্দুস্তানি ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন (‘Calcutta Hindustani’)। এখানে আমরা সুনীতিকুমারের ভাষাবিষয়ক রচনার কয়েকটির মাত্র উল্লেখ করলাম। সুনীতিকুমারের ভাষা-জ্ঞান সম্পর্কে বিখ্যাত অস্ট্রীয় পন্ডিত ও A History of Indian Literature-এর লেখক মরিজ ভিন্টারনিজের (Moriz Winternitz) মূল্যায়নটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে :He had a knowledge of linguistic factor which no European scholar could even hope to acquire.বহুভাষীর দেশ ভারতে ভাষা-সমস্যার দিকটি বহুমাত্রিক। সুনীতিকুমার এই সমস্যার নানাদিক সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, ভেবেছেনও এই নিয়ে। তাঁর মতে, ‘The original barrier of language was sometimes more potent than the barrier of sea or mountains.’। তিনি অবশ্য এটাও বলেছেন, মানবসভ্যতার সংস্কৃতিগুলোর স্বাতন্ত্র্য ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ফলে এই ব্যবধান অনেকটাই দূরীভূত হয়। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ভাষা-চয়নের সমস্যার দিকটি নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা-মাধ্যম নির্ধারণের সমস্যার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেছেন। ভারতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদেশি ভাষার জায়গায় ক্রমান্বয়ে মাতৃভাষাকে অবলম্বনের কথা বলেছেন। তবে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের জন্য বিদেশি ভাষা শেখার ব্যাপারে যাতে কোনো বাধা না থাকে সেদিকটি বিবেচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।ভারতে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় ভাষা নির্ধারণের প্রশ্নটি বিতর্কাতীত নয়। বর্তমানে হিন্দি ভাষা বেশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে, অন্তত কয়েক দশক আগের চাইতে। ১৯৭২ সালে ভারতের ভাষা-পরিস্থিতি সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে সুনীতিকুমার লিখছেন :The hope that India will be integrated into one single nation through Hindi as its National Language is now shattered; and Hindi, in so far as it is sought to be forced upon the rest of India by some unimaginative short sighted political elements, by various means, overt and covert, while bringing certain definite advantages to Hindi-speakers, and Hindi-users, with an attendant waste of millions and millions of money, is proving to be a disintegrating force. It is bringing in Linguism in other linguistic areas also.এই পর্যবেক্ষণ তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর ‘A Roman Alphabet for India’ প্রবন্ধে। ভারতীয় বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বোধগম্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ভারতীয় ভাষাগুলোর জন্য রোমান হরফ প্রচলনের কথা তিনি ভেবেছিলেন। ভারতীয় ভাষাগুলোর পার্থক্যের মতো সেগুলোর লিপিও পৃথক। সুনীতিকুমার এই রোমান লিপির চিন্তাটি অবশ্য বেশ আগেই প্রকাশ করেছিলেন, ১৯৩৫ সালে। তাঁর এই চিন্তা অবশ্য গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। ভারতীয় ভাষাগুলোর জন্য রোমান লিপি গ্রহণের কথা বললেও নাগরী লিপি চাপিয়ে দেওয়ার সমর্থক তিনি ছিলেন না। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের ভাষাগুলোর জন্য রোমান বা আরবি হরফ ব্যবহারের কথা উঠেছিল। তখন এর মধ্যে রাজনৈতিক প্রভুত্ব-প্রয়াসের আশঙ্কা করেছিলাম আমরা। কিন্তু সুনীতিকুমারের প্রস্তাবে সেইরকম ষড়যন্ত্র খোঁজার চেষ্টা করা সমীচীন হবে না। তাঁর চিন্তাটি একজন উৎকণ্ঠিত ভাষাবিজ্ঞানীর, যিনি নিজের দেশের সামগ্রিক ঐক্য চেয়েছিলেন, বৈচিত্র্যকে সমন্বিত করে।ভাষাকে সুনীতিকুমার একটি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ফসল রূপেই বিবেচনা করেছেন। এ-কারণেই, বোধকরি, ভাষা বিচার করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে উৎসাহী হয়েছেন, সেই সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন এবং তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ও পান্ডিত্যপূর্ণ মত প্রকাশ করেছেন। বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচয় আমরা The Origin and Development of the Bengali Language-এ পেয়েছি। ‘বাঙ্গালীর ইতিবৃত্ত : জাতিগঠনে’ প্রবন্ধে তিনি বাঙালির ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্তই প্রকাশ করেছেন। ইংরেজি caste, tribe, people, nation প্রভৃতি শব্দের জন্য ভারতীয় ভাষাগুলোতে জাতি শব্দটিই ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। সুনীতিকুমার এর একটি সমাধান দিযেছেন উল্লিখিত আলোচনায়। Nation অর্থে রাষ্ট্র, People – জনগণ, Tribe – উপজাতি, Caste – বর্ণ, Race – জাতি – এরকম একটি সমাধান তিনি দিয়েছেন। তাঁর এই সমাধান এখন মোটামুটি গৃহীত। Culture শব্দের জন্য যে সংস্কৃতি শব্দটি আমরা এখন ব্যবহার করি সেটিও তো বাংলায় এসেছিল সুনীতিকুমারের উদ্যোগে, রবীন্দ্রনাথের কাছে শব্দটি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল।বাঙালি জনগোষ্ঠীর উদ্ভবের সঙ্গে বাংলা ভাষার উৎপত্তিকে তিনি সম্পর্কিত করেছেন। স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে এই জনগোষ্ঠীর বাঙালি পরিচয়ও স্বীকৃত হয়নি। সিংহলবিজয়ী বিজয় সিংহকে এই কারণেই তিনি বাঙালি বলতে রাজি নন। জাতিগঠনে ভাষা প্রধান বাঁধন হলেও অন্য কতগুলো দিকও উপেক্ষণীয় নয়। এক ধরনের চিন্তা-কল্পনা, অর্থনৈতিক জীবনের সমধর্মিতা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থানের প্রকৃতি, গৃহস্থালি ও জীবিকার সরঞ্জাম – এই উপকরণগুলোও বাঙালির একক জাতিসত্তা গঠনে সহায়তা করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি উল্লেখ করেছেন :বাঙালী মুসলমানের সঙ্গে মানসিক-প্রবৃত্তিগত, প্রকৃতিগত মিল পাওয়া যাবে বাঙালী হিন্দু বা বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টানের সঙ্গে, পাঠান বা তুর্কী বা আরব মুসলমানের সঙ্গে নয়।বাঙালির জীবন-সংস্কৃতি ও সাহিত্য ভাবনা সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য’ নামে। বাঙালি বিভিন্ন জাতির জীবন-সংস্কৃতি-ভাষা ও জীবিকার পথকে কীভাবে আত্মস্থ করেছে তার একটি প্রাঞ্জল ও তথ্যবহুল বিবরণ এতে আছে। বাঙালির জীবনে Confusion of issues বা বিষয়-বিভ্রম সৃষ্টির উপাদানও কম নয়। এই সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শও তিনি দিয়েছেন।শুধু বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিই তাঁর আগ্রহ ও আলোচনার বিষয় নয়। কিরাত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও পরিচয় সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা তাঁর Kirât Janakriti। কোচ ও রাজবংশীসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর পরিচয় তুলে ধরেছেন তিনি। মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি গৌতম বুদ্ধকে খাঁটি বা মিশ্র কিরাত বলে উল্লেখ করেছেন। এই আলোচনা করতে গিয়ে তিনি অনুভব করেছেন, কোনো জনগোষ্ঠীর অধ্যয়নে অনেক বিদ্যাশৃঙ্খলার সহযোগিতা প্রয়োজন। তাঁর মতে :Closer study through the various human sciences should be carried on with greater intensity through linguistics, through sociology, through anthropology, through political history and through comparative religion.দ্রাবিড়, কোলদের জীবন-সংস্কৃতিও তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন গভীর আগ্রহের সঙ্গে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের অর্কেস্ট্রা শুনতে চেয়েছেন তিনি। সামগ্রিকভাবে ভারতীয় জীবন-ভাষা-সংস্কৃতি-চিন্তা-দর্শন-মনোজগৎ-বহির্জগতের সকল বিষয়েই ছিল তাঁর আগ্রহ। ভারতীয় জীবন সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর মত :মানুষকে সভ্য এবং মানবোচিত পদে উন্নীত করিবার জন্য পৃথিবীতে যে সমস্ত মনোভাব ও চেষ্টা কার্য্যকর হইয়াছে, ভারতের সংস্কৃতি সেগুলির মধ্যে অন্যতম।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুনীতিকুমারের সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার। সুনীতিকুমার রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ঊনত্রিশ বছরের ছোটো ছিলেন – বয়সের বিচারে এক প্রজন্মের ব্যবধান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সুনীতিবাবুর পান্ডিত্যকে সমীহ করতেন। শেষের কবিতার অমিত নির্জনতা-ভোগের জন্য শিলঙে গিয়ে ‘পাহাড়ের ঢালুতে দেওদারু গাছের ছায়ায়’ বসে পড়েছে ‘সুনীতি চাটুজ্যের বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব’। রবীন্দ্রনাথ অমিতের শব্দতত্ত্ব-চর্চার কথা বয়ান করায় সুনীতিকুমার বেশ আমোদিত হয়েছিলেন, বন্ধুদের প্রায়ই বলতেন, ‘তোমাদের রবীন্দ্রনাথ তো আমাকে বিখ্যাত করে দিলেন।’ ভাষাবিষয়ক যে-কোনো প্রশ্নের মীমাংসার জন্য রবীন্দ্রনাথের আস্থাভাজন ছিলেন সুনীতিকুমার। ১৯২৭ সালে মালয়, যবদ্বীপ ও শ্যামদেশ ভ্রমণের সময়ে রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী ছিলেন তিনি। সেই ভ্রমণের বৃত্তান্ত রচনায় সুনীতিকুমারের পর্যবেক্ষণ ও পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি। সুনীতিকুমারও রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীল মনীষাকে শ্রদ্ধা করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি সাব্যস্ত করেছেন, ‘last great expression of World literature for the present age’ হিসেবে। তাঁর বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে স্বদেশের ও বিশ্বমানবতার সম্পদ। রবীন্দ্র প্রতিভা, সৃষ্টি ও কর্মের বিচিত্রমুখী প্রয়াস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন :A cursory survey of his life would thus reveal Rabindranath to be like a diamond with many facets. There was hardly any normal venue or avocation of man ¯ excepting highly specialised military and technical and other scientific lines ¯ in which Rabindranath did not make his mark. ভাষাবিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়ের চর্চা করেও সুনীতিকুমার জীবনের রসোপভোগে নিজেকে বঞ্চিত করেননি। সংগীতে তাঁর বেশ অনুরাগ ছিল। মামার বাড়িতে সাংগীতিক পরিবেশ ছিল। সেই পরিবেশেই তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। শিবপুরে থাকার সময়ে নিকুঞ্জ দত্তের ধ্রুপদ, শ্যামা-সংগীত ও নিধুবাবুর টপ্পা শুনে শুনে তাঁর সংগীতরুচি গড়ে উঠেছিল। ভারতীয় সংগীতের বিবর্তন-ইতিহাস সম্পর্কেও তিনি বেশ অবহিত ছিলেন। চিত্রাঙ্কনেও তিনি বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাঁর লাইন-ড্রয়িংগুলো উল্লেখ করার মতো।আমরা এর আগে বলেছি, ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বাঙালির জীবন-ইতিহাসের সামগ্রিক রূপ অনুসন্ধান করেছেন, কিন্তু তাতে তৃপ্ত না হয়ে তিনি সমগ্র ভারতের জীবন ও সংস্কৃতিকে অধ্যয়ন ও আস্বাদন করেছেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তিনি বিশ্বের সকল জাতির জীবন ও সংস্কৃতির প্রতিই আগ্রহী ছিলেন। মানুষের সৃজনশীলতার সকল প্রচেষ্টাকেই তিনি উপলব্ধি ও উপভোগ করতে চেয়েছেন। নিজেকে প্রসারিত করতে চেয়েছেন বিশ্বের বিদ্বৎ-চর্চার ধারায়। পান্ডিত্যে-মনীষায়-রসোপভোগ্যতায় তাঁর তুলনা বিরল।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
সংগৃহীত