∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু
কবি সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু
=================================
Doinik Sabder Methopath
Vol -207. Dt -30.11.2020
১৪ অগ্রহায়ণ,১৪২৭. সোমবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
লবার্ট আইনস্টাইন ” বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু ” সম্পর্কে নিজেই বলেছেন :“জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত ”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ” বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ” সম্পর্কে বলেছেন:“ ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ ”
জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহে [ ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের ময়মনসিংহে] জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু গিরিডিতে মারা যান। তাঁর পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত বিক্রমপুর পরগণার রাঢ়িখাল গ্রামে। তাঁর বাবা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন তৎকালীন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। এখানকার শিক্ষা সমাপ্ত করে সেন্টজেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। তার পিতা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এর পূর্বে তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভগবান চন্দ্রই এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তিতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। তখনকার বা এখনকার দিনেও সন্তানকে ইংরেজি স্কুলে পড়ানো ছিল উচ্চ সামাজিক মান-মর্যাদার বিষয়। তাই ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে জগদীশ চন্দ্র বসু যে ইংরেজি স্কুলে যাবেন, এটা তো জানা কথা। কিন্তু ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ, তিনি চাইতেন ইংরেজি শেখার আগে উনার সন্তান ভালো করে মাতৃভাষা শিখুক আর সন্তানের মধ্যে অল্পবয়সেই দেশপ্রেম গড়ে উঠুক। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তার প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো পড়লে সহজেই বোঝা যায়। তাঁর পিতার এই চেষ্টা যে বিফলে যায়নি তার প্রমাণ জগদীশ চন্দ্র বসুর পরবর্তী জীবনের নানান ঘটনাবলী। মায়ের হাতেই শিশু জগদীশের হাতেখড়ি হয়েছিল।
গ্রামের বিদ্যালয়ে সব স্তরের ছেলের সাথে মিলে-মিশে ছোট্ট জগদীশ বড় হতে লাগলেন। ভাবুক এই ছেলে প্রতিদিন বিকালে নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির হতো আর আপনমনে গাছদের দেখত, আর চিন্তা করত বসে বসে।
বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব যুক্তি ছিল। তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ত করা উচিত। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করেছে। এর প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো। ভাষার প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ ছাড়াও ভগবান চন্দ্র চেয়েছিলেন তার পুত্র দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে মিলেমিশে মানুষ হোক এবং তার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক। জগদীশ চন্দ্রের পরবর্তী জীবনে তাঁর প্রথম বাংলা স্কুলের অধ্যয় গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছিল।
গ্রামের স্কুলে পড়ার পাট চুকিয়ে জগদীশ কলকাতায় গেলেন উচ্চ শিক্ষার জন্য। সেখানে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াকালীন ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক তাকে খুব স্নেহ করতেন, তার কারণেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর জগদীশের আগ্রহ সৃষ্টি হয় জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজী হননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র একজন বিদ্বান হোন।
বাবার ইচ্ছা ও তার আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান, কিন্তু অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসুর আনুকুল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন। কেম্ব্রিজে জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস মেটল্যান্ড বালফুর, সিডনি ভাইনসের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানসাধকেরা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জগদীশ চন্দ্র ভারতে ফিরে আসেন। তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল জর্জ রবিনসন, প্রথম মার্কুইস অব রিপন অনুরোধে স্যার অ্যালফ্রেড ক্রফট বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি এই নিয়োগের বিপক্ষে ছিলেন। শুধু যে তাঁকে গবেষণার জন্য কোন রকম সুবিধা দেওয়া হত না তাই নয়, তিনি ইউরোপীয় অধ্যাপকদের অর্ধেক বেতনেরও কম অর্থ লাভ করতেন। এর প্রতিবাদে বস্য বেতন নেওয়া বন্ধ করে দেন এবং তিন বছর অবৈতনিক ভাবেই অধ্যাপনা চালিয়ে যান। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রতিবাদের ফলে তাঁর বেতন ইউরোপীয়দের সমতুল্য করা হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণার কোন রকম উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় ২৪-বর্গফুট (২.২ মি২) একটি ছোট ঘরে তাঁকে গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে হত। পদে পদে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁর বিজ্ঞান সাধনার ও গবেষণার একজন দিকপাল হিসেবে উঠে আসেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ যে সকল গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে। এই গবেষণাগুলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিচার করতে হবে। প্রতিদিন নিয়মিত ৪ ঘণ্টা শিক্ষকতার পর যেটুকু সময় পেতেন তখন তিনি এই গবেষণার কাজ করতেন। তার উপর প্রেসিডেন্সি কলেজে কোন উন্নতমানের গবেষণাগার ছিলনা, অর্থ সংকটও ছিল প্রকট। সীমিত ব্যয়ে স্থানীয় মিস্ত্রীদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে তিনি পরীক্ষণের জন্য উপকরণ প্রস্তুত করতেন। তার এই গবেষণা কর্মগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি বহু স্থান থেকে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ পান। এর মধ্যে ছিল রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। সফল বক্তৃতা শেষে ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সস্ত্রীক দেশে ফিরে এসেছিলেন।
বিবাহ ও বাক্তিগত জীবন : ১৮৮৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে অবলাদেবীর বিয়ে হয়। অবলা দেবী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা। বিয়ের আগে অবলা বসু কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চাইলেও তাকে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি, কারণ সেখানে তখন মেয়েদের পড়ানো নিষেধ ছিল। ১৮৮২ সালে বঙ্গ সরকারের বৃত্তি নিয়ে অবলা মাদ্রাজে যান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে আবার ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাদের বিয়ের সময় জগদীশচন্দ্র বসু আর্থিক কষ্টের মধ্যে ছিলেন। এর মধ্যে আবার তিনি তখন কলেজ থেকে বেতন নিতেন না। এছাড়া জগদীশের বাবার কিছু ঋণ ছিল যার কারণে তার পরিবারকে পথে বসতে হয়। এর মধ্য থেকে অবলা দেবী ও জগদীশ চন্দ্র বসু অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসেন এবং সব ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হন। সব ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কিছুদিন মাত্র বসুর পিতা-মাতা জীবিত ছিলেন।
গবেষণা : জগদীশের আঠারো মাসের সেই গবেষণার মধ্যে মুখ্য ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোন তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞনী হের্ৎস প্রতক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এ নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন যদিও শেষ করার আগেই তিনি মারা যান। জগদীশচন্দ্র তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাউক্রোওয়েভ। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্স”। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা পরীক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত করে। অশীতিপর বৃদ্ধ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বক্তৃতা শোনার পর লাঠিতে ভর দিয়ে এসে জগদীশের স্ত্রী অবলা বসুকে তার স্বামীর সফলতার জন্য অভিবাদন জানান। জগদীশ এবং অবলা দু’জনকেই তিনি তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এই বিষয়ের উপর বিখ্যাত সাময়িকী “টাইম্স”-এ একটি রিপোর্ট ছাপা হয় যাতে বলা হয়, “এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, কেমব্রিজের এম.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অফ সাইন্স এই বিজ্ঞানী বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন সম্পর্কে যে মৌলিক গবেষণা করেছেন, তার প্রতি ইউরোপীয় বিজ্ঞানী মহলে আগ্রহ জন্মেছে। রয়্যাল সোসাইটি বিদ্যুৎরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়ের গবেষণাপত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।”
লিভারপুলে বক্তৃতার পর তার আরও সাফল্য আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে সান্ধ্য বক্তৃতা দেয়ার নিমন্ত্রণ। এই বক্তৃতাটি আনুষ্ঠানিকভাবে “ফ্রাইডে ইভনিং ডিসকোর্স” নামে সুপরিচিত ছিল। এই ডিসকোর্সগুলোতে আমন্ত্রিত হতেন একেবারে প্রথম সারির কোন আবিষ্কারক। সে হিসেবে এটি জগদীশচন্দ্রের জন্য একটি দুর্লভ সম্মাননা ছিল। ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি ১৯ তারিখে প্রদত্ত তার এই বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস” তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন। এই বক্তৃতার সফলতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বায়ুতে উপস্থিত বেশ কিছু বিরল গ্যাসের আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে তার বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে এতোটাই বিস্মিত হয়েছিলেন তার কাছে সবকিছু অলৌকিক মনে হয়েছিল। তিনি এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি- এ যেন মায়াজাল”। এই বক্তৃতার সূত্র ধরেই বিজ্ঞানী জেমস ডিউয়ার-এর সাথে জগদীশচন্দ্রের বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। ডিউয়ার গ্যাসের তরলীকরণের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত। এই বক্তৃতা সম্বন্ধে “স্পেক্টেটর” পত্রিকায় লিখা হয়েছিল, “একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন- এ দৃশ্য অভিনব।”
এই বক্তৃতার পর ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে আমন্ত্রণ আসে এবং তিনি সেখানে কয়েকটি বক্তৃতা দেন। সবখানেই বিশেষ প্রশংসিত হন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হয়ে যায় এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতি Société de Physique [ Professional society of French physicists & it was founded in 1873 by “Charles Joseph d’Almeida”. ] -এর সদস্য মনোনীত হন।
তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :
রেসপন্সেস ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন-লিভিং (১৯০২), [Responses in the Living and Non-living (১৯০২) ]
মহাবিজ্ঞানী , আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু
প্লান্ট রেসপন্সেস এজ এ মিনস অব ফিজিওলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশনস (১৯০৬), [Plant Responses as a Means of Physiological Investigations (১৯০৬)]
কম্পারেটিভ ইলেকট্রফিজিওলজি (১৯০৭), [Comparative Electrophysiology (১৯০৭)]
ফিজিওলজি অফ দ্য আসেন্ট অফ সএপ (১৯২৩),[ Physiology of the Asent of Sap (১৯২৩)]
ফিজিওলজি অফ ফটোস্যাথেসিস (১৯২৪), [Physiology of Photosynthesis (১৯২৪)]
নার্ভাস মেকানিজম অব প্লান্টস (১৯২৫), [Nervous Mechanism of Plants (১৯২৫)]
কালেক্টেট ফিজিক্যাল পেপার্স (১৯২৭),[Collected Physical Papers (১৯২৭)]
মটর মেকানিজম অব প্লান্টস (১৯২৮) , [Motor Mechanism of Plants (১৯২৮)]
গ্রোথ এন্ড ট্রপিক মুভমেন্ট ইন প্লান্টস (১৯২৯), [Growth and Tropic Movement in Plants (১৯২৯)]
others
নাইটহুড, ১৯১৬
রয়্যাল সোসাইটির ফেলো, ১৯২০
ভিয়েনা অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স-এর সদস্য, ১৯২৮
ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর ১৪তম অধিবেশনের সভাপতি, ১৯২৭
লিগ অফ নেশনস কমিটি ফর ইন্টেলেকচুয়াল কোঅপারেশনের সদস্য
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ফেলো। এর বর্তমান নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি।
মৃত্যু : নভেম্বর ২৩, ১৯৩৭।
এক জন বাঙালি পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ ও জীববিজ্ঞানী এবং প্রথম দিকের এক জন কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা। তাঁর গবেষণা উদ্ভিদবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা করে। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে রেডিও বিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করে।
======={{============{{{===========
বুদ্ধদেব বসু
জন্ম ১৯০৮-এর ৩০শে নভেম্বর কুমিল্লায়- আজকের বাংলাদেশে। আদিনিবাস ছিলো ঢাকা জেলার মালখানগরে। ছোটো থেকেই অসম্ভব মেধাবী। ১৯২৫-এ ঢাকা বোর্ডের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগের পঞ্চম স্হান দখল করেন। কিন্তু বিস্ময়ের এই যে, তার একবছর আগেই প্রকাশিত হয়েছে নিজস্ব প্রথম কাব্যগ্রন্হ ‘মর্মবাণী‘। এরপর ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। সেখানে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্হান অধিকার করে পান মাসিক কুড়িটাকা বৃত্তি।
বুদ্ধদেব পরে লিখেছেন, ‘মাসিক কুড়ি টাকা মানে মাসিক কুড়ি টাকাই। বন্ধুরা মিলে স্হির করা গেলো, হস্তলিপি পত্রিকা আর নয়, এবারে একটি মুদ্রাযন্ত্র-নিঃসৃত দস্তুরমাফিক মাসিকপত্র চাই।‘ এই উল্লাসের ফলশ্রুতিতেই ‘প্রগতি‘ মাসিকপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । যার সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্ত-র ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ঢাকার পুরনো পল্টন রমনার গাছপালা-রাস্তাঘাট, প্রকৃতি বারেবারেই উঠে এসেছে, শুধু তাঁর স্মৃতিচারণায় নয়, তাঁর গল্প-উপন্যাসের বিভিন্ন পৃষ্ঠাতেও। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন- প্রচুর ছাত্র, কয়েকজন মাত্র ছাত্রী- অধ্যাপকদের পেছন পেছন সারিবদ্ধভাবে তাঁদের লেডিস কমনরুম থেকে আসা আবার ক্লাস শেষে ঐভাবেই ফেরত যাওয়া- এই ছবিটিও বেশ প্রভাব ফেলেছিল ওই তরুণ মনে।
‘প্রগতি‘ প্রকাশের অনেক আগে থেকেই বুদ্ধদেব ‘কল্লোল‘-এর নিয়মিত লেখক। সদ্যকৈশোর উত্তীর্ণ ভাববিলাস,তারুণ্যের চাঞ্চল্য, বিদ্রোহ ও স্বপ্নদর্শন-প্রবণতার দিক দিয়ে তিনিও তখন অপরাপর কল্লোলীয়ের সহধর্মী । রবীন্দ্রনাথকে আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলার চেষ্টা ও তারপর সাহিত্যে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগ আনার চেষ্টাকে যদি রবীন্দ্র-বিরোধিতা বলা যায় তবে এই তরুণদল সেই পথেরও অভিসারী । সহযোগী অচিন্ত্যকুমারের ভাষায়- ‘কল্লোলের সে যুগটাই সাহসের যুগ, সে সাহসে রোমান্টিসিজমের মোহ মাখানো‘ ।
পরবর্তীতে এই কল্লোল যুগের উন্মাদনা নিয়েই বুদ্ধদেব লিখবেন- ‘An Acre of Green Grass’ (1948), আর আরও অনেক প্রবন্ধ। এরমধ্যেই থাকবে সেই সময়কার রবীন্দ্র-অনুসারী কবিদের প্রতি সেই অমোঘ মূল্যায়ন- ‘তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ, এবং অসম্ভব ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ‘।
অথবা কে ভুলতে পারেন বুদ্ধদেবের সেই স্পর্ধিত উচ্চারণ, যা প্রকাশিত হয়েছিল ওই পত্রিকাতেই ১৯২৭সালে- ‘আমরা মোটের ওপর অনেক বেশি rational হয়েছি, অন্ধভক্তির উপর আমাদের আর আস্হা নেই; আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি বিজ্ঞানকে। ভগবান, ভূত ও ভালবাসা- এই তিনটি জিনিসের উপর আমাদের প্রাক্তন বিশ্বাস আমরা হারিয়েছি ।‘
এরসঙ্গেই এই গোষ্ঠীর ওপর পড়েছিল ফ্রয়েড ও তাঁর অনুসারী অ্যাডলার, ইয়ুং বা হ্যাভলক এলিসের মনোবিকলন তত্ত্বের প্রভাব যা তাঁদের সাহিত্যকে পূর্ববর্তীদের চেয়ে করে তুলেছিল অনেক বেশি বাস্তবানুগ এবং ইন্দ্রিয়-নির্ভর । ‘প্রথমা‘ কাব্যের ‘মানে‘ কবিতায় প্রেমেন্দ্র মিত্র যখন ‘গোটা মানুষের মানে‘ খুঁজছেন ‘রক্তমাংস হাড় মেদ মজ্জা/ ক্ষুধা তৃষ্ণা লোভ কাম হিংসা সমেত‘; তখন বুদ্ধদেব একে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে লিখলেন, ‘মোরে দিয়ে বিধাতার এই শুধু ছিল প্রয়োজন / স্রষ্টা শুধু চাহে, এ বীভৎস ইন্দ্রিয় মিলন-/ নির্বিচারে প্রাণী সৃষ্টি করে থাকে যেমন পশুরা।‘ অনেকেই একে অশ্লীল বলেছেন।কিন্তু তবুও বুদ্ধদেব ‘সৃষ্টির অন্ধ প্রেরণাকে‘- ‘জন্ম-জন্মান্তরের প্রেম-সম্পর্ক‘ নাম দিয়ে পাঠকদের প্রতারিত করতে চাননি । বরং তিনি বললেন, ‘আমি যে রচিব কাব্য এ উদ্দেশ্য ছিলো না স্রষ্টার/তবু কাব্য রচিলাম এই গর্ব, বিদ্রোহ আমার‘।
বুদ্ধদেব ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর এবং শেলি, কিটস, বায়রন বা সুইনবার্নের মতো কবিদের কবিতা চিরদিনই ছিল তাঁর খুব ভালোলাগার জায়গায়। কিন্তু কোনো বিশেষ কবির কবিতা যদি তাঁকে খুব বেশি আলোড়িত করে থাকে, তবে তাঁরা দুজন হলেন ফরাসি কবি বোদলেয়ার আর জার্মান কবি রিলকে – দুজনেই ইউরোপীয় কিন্তু কেউই ইংরেজি সাহিত্যের নন ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয়াকে দেখেছেন অদেহী রূপে- প্রকৃতির বিচিত্র মহিমায় তাঁর প্রিয়া মানসবাসিনী, স্বপনচারিণী। তুলনায় বুদ্ধদেবের নায়িকা রক্তমাংসের নারী । তাই তাঁদের নামকরণ-ও করেছেন অপর্ণা, মৈত্রেয়ী, অমিতা, রমা ও কঙ্কাবতী হিসেবে-
‘মাঝরাতে আজ বাতাস জেগেছে শুনতে পাও / কঙ্কাবতী !
এলো এলোমেলো ব্যাকুল বাউল উতল বাও / কঙ্কাবতী !
হাহাকার করে বেহায়া হাওয়ার বেহালাখানি / কঙ্কাবতী !‘
দীপ্তি ত্রিপাঠীর মতে , ‘প্রকরণের দিক থেকে বলা যায়, জীবনানন্দের কবিতা যদি হয় চিত্রধর্মী এবং সুধীন্দ্রনাথ ও বিষ্ণু দের কাব্য ভাবধর্মী, তবে বুদ্ধদেবের কাব্য কঙ্কাবতী হলো সঙ্গীতধর্মী।’
আসলে প্রেমের যে দুটি পর্যায় আবেগের জন্ম দেয়- পূর্বরাগ ও মিলন, বুদ্ধদেব তার কবি।
তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্হগুলির মধ্যে ‘শীতের প্রার্থনা ও বসন্তের উত্তর‘ জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অনেকেই মনে করেন, ‘যে আঁধার আলোর অধিক‘ কে মনে করেন বুদ্ধদেবের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ‘। রিলকে যেমন ভেবেছিলেন যে, দেবোপম অর্ফিয়ুসের পক্ষেই সম্ভব চিরন্তনের সঙ্গে যোগসাধনা, দ্বিখণ্ডিত চেতনার অধিকারী সাধারণ মানুষের পক্ষে নয়, বুদ্ধদেব সেই অর্ফিয়ুসকে প্রত্যক্ষ করলেন আরেক দেবতার মধ্যে- তিনি বাঙালির কাছের দেবতা– রবীন্দ্রনাথ। অপর্যাপ্ত, চেষ্টাহীন, ভাস্বর রবীন্দ্রনাথ।
…‘তবু ছিলে প্রতিযোগিতা/পরপারে, বিশ্রামের শুভ্রতাময়, যেন তুমি কখনো করোনি / চেষ্টা, কিংবা যেন কলস গিয়েছে ভেসে, তুমি শুধু জল।/ যা পেয়েছি দু-দন্ড তোমার কাছে, নিঃশব্দে কেবল ‘।
এইভাবে প্রথমকাব্য থেকেই অজস্রবার রবীন্দ্র-অনুষঙ্গ ব্যবহার করেও কবি বুদ্ধদেব শামিল হয়েছিলেন যে রবীন্দ্র-অতিক্রমণের সাধনায়, শেষপর্যন্ত আবার এই প্রতীকের কাছে ফেরার মাধ্যমেই যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর রবীন্দ্রায়ণ।
প্রেম যে নিন্দনীয় নয়, কিংবা ইন্দ্রিয়বিলাস দ্বারা যে তা আবিল নয়, কিংবা মরমীদের মতো যে সে শুধু ঈশ্বরের পথে সোপানের কাজ করছে না- এই কথাটি বুদ্ধদেব রোমান্টিকদের মতোই উপলব্ধি করেছেন। তাই লোকেরা যাকে ‘কাম‘ নাম দিয়ে নিন্দে করে থাকে, তারই প্রভাবে দুজন মানুষ, দুটি নর-নারী কেমন করে পুণ্যের পথে নিষ্ক্রান্ত হবে- শুদ্ধশীল এই উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা বুদ্ধদেবের- হয়তো রোমান্টিকদের- ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী‘, সেই অমৃতলাভের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘কবিতায় আমি আত্মহারা হতুম, গল্প অনেকটা খেলার মতো ছিলো। হঠাৎ একদিন সে খেলা মারাত্মক হয়ে উঠল, যখন কল্লোলে আমার একটা গল্প বেরুল, যার নাম ‘রজনী হল উতলা‘। বুদ্ধদেবের বয়েস তখনও আঠারো হয়নি। সবচেয়ে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন মহিলারা। একজন বলেছিলেন, আঁতুড়ঘরে এই ছেলেকে নুন দিয়ে মেরে ফেলা হয়নি কেন? পরে বুদ্ধদেব নিজেই জানিয়েছেন, নবযৌবনে আদিরস একটু উগ্র হয়েই প্রকাশ পায়- এ গল্পেও তাই হয়েছিল। হয়তো সেই উল্লেখ আজকের দিনে আর ততোখানি অশ্লীল বলে মনে হবে না। যাইহোক, এই নিন্দা লেখককে দমিয়ে না দিয়ে সত্যিকারের আগ্রহ এনে দিল গল্প লেখায়।
কিন্তু বিতর্ক ছাড়াল কই? ১৯৩২-এর ডিসেম্বরে ‘এরা আর ওরা এবং আরো অনেক‘ গল্পগ্রন্থ-এর জন্যেও আদালতে অভিযোগ উঠেছিল। আবার জীবনের উপান্তে এসে বেশ কয়েকদিন আদালতে যেতে হয়েছিল ‘রাত ভ‘রে বৃষ্টি‘ উপন্যাসের জন্য।
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার নর্থব্রুক হলে বুদ্ধদেবের উপন্যাস ‘যেদিন ফুটল কমল‘- এর নাট্যরূপ মঞ্চস্হ হয় । যিনি নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তাঁর নাম প্রতিভা সোম বা রানু। ঠিক পরের বছর এই রানুর সঙ্গেই বুদ্ধদেবের বিয়ে হবিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই পরিণয়-পর্বের দীর্ঘ বিবরণ আছে প্রতিভা বসুর আত্মজীবনী ‘সেদিনের আলোছায়া‘-তে। সঙ্গীত ও সাহিত্য উভয়ক্ষেত্রেই প্রতিভা ছিলেন অসামান্যা।পরবর্তীকালের পাঠক এই সাক্ষ্য-ই দেবেন।
এর আগে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দেই বন্ধ হয়ে যায় ‘প্রগতি‘। ‘কল্লোল‘ও বন্ধ হয়ে যায় ওই সময়েই।বুদ্ধদেব ঢাকা ছাড়েন ১৯৩১-এ এবং ১৯৩৪-এই কলকাতার রিপন কলেজে ( আজকের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) অধ্যাপনায় যোগ দেন । এর ঠিক পরের বছর কবির সেই সময়কার বাসভবন- ভবানীপুরের ১২, যোগেশ মিত্র রোডের বাড়ি থেকেই প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ‘কবিতা‘ পত্রিকা। যার সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র, সহ-সম্পাদক সমর সেন। ১৯৪০ থেকে অবশ্য সম্পাদক হিসেবে শুধু বুদ্ধদেবের নাম-ই মুদ্রিত হতে দেখা যায়। ‘কবিতা‘ পত্রিকা বাংলাদেশে হয়ে ওঠে কবিদের আশ্রয়স্হল।
১৯২২ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত এই অর্ধশতাব্দী জুড়ে প্রচুর ছোটোগল্পের রচয়িতা বুদ্ধদেব। জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতি আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা- এই গল্পগুলোতে তীব্রভাবে উপস্থিত। অনেক গল্পে আবার প্রাধান্য পেয়েছে নস্টালজিক ভাবনা, কখনও তা মধুর , কখনও বেদনামিশ্রিত, কখনও বা একটু মন কেমন করা। নাগরিকতা বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, যেমন চিত্তের ঔদার্য ও প্রসার, ভাবলোকের স্বচ্ছন্দ বিহার বা শিল্পলোকের উদার আমন্ত্রণ– এইসবই তার ছোটোগল্পে লক্ষ্য করা যায় । আর একটা বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর গল্পের অনেক চরিত্রের-ই প্রিয় বিষয় সাহিত্য।অনেক চরিত্রের মধ্যে লেখকের আত্মজৈবনিক উপাদান খুঁজে পেতে পাঠকের অসুবিধা হয় না ।
বুদ্ধদেবের উপন্যাসেও প্রেমেরই প্রাধান্য। ‘একদা তুমি প্রিয়ে‘, ‘তুমি কি সুন্দর‘ বা বিখ্যাত ‘তিথিডোর‘ উপন্যাস প্রেম-ই এখানে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে। মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনি অবলম্বনে তিনি বেশ কিছু কাব্যনাটকও রচনা করেছিলেন ‘কালসন্ধ্যা‘ , ‘অনাম্নী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থ‘ প্রমুখ । এছাড়াও ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী‘ , ‘পুনর্মিলন‘, ‘ইক্কাকু সেন্নিন‘ নাটকের রচয়িতাও তিনিই ।
কিন্তু নাট্যরচনার চেয়েও বাংলাসাহিত্য বুদ্ধদেবকে মনে রাখবে প্রাবন্ধিক হিসেবে।আত্মজৈবনিক বেশ কিছু রচনাও তিনি লিখেছেন, যেমন লিখেছেন সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে। বস্তুত, তিরিশের দশকের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আজও মানুষ হাতে তুলে নেন ‘কালের পুতুল‘, ‘An Acre of Green Grass’প্রমুখ গ্রন্থ। আর লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। ‘রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য‘ বা ‘সঙ্গ ,নি:সঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ‘ গ্রন্থ দুটোই শুধু নয়, ‘রবীন্দ্রনাথ ও প্রতীচী‘,’রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক‘, ‘রবীন্দ্রনাথের গানে গদ্য ও পদ্য‘ প্রমুখ প্রবন্ধ আজও পাঠকের মনে উৎসাহের সঞ্চার করে। এর কয়েকটি প্রবন্ধ ‘সাহিত্যচর্চা‘ গ্রন্থেও স্হান পেয়েছে। আর জীবনের একেবারে শেষতম বছরে প্রকাশিত হওয়া ‘মহাভারতের কথা‘ আজও পাঠককে নতুন দৃষ্টিতে মহাভারতের কাহিনিকে অনুধাবন করতে শেখায়।
প্রথমে দুবছরের কিছু বেশি সময়ের ‘প্রগতি‘, তারপর দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ধরে প্রকাশ করেছেন ‘কবিতা‘ পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই পত্রিকার শুভাকাঙ্ক্ষী, যতদিন জীবিত ছিলেন কবিতাও পাঠিয়েছেন মাঝে-মধ্যেই। অনেকের মতে, কবি জীবনানন্দ আবিষ্কৃত হয়েছিলেন সম্পাদক বুদ্ধদেবের চোখেই। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে পাঠকের সামনে হাজির করান তিনিই। ‘পদাতিক‘ প্রকাশিত হয় ‘কবিতা-ভবন‘ থেকেই । এছাড়াও সমর সেন শুধুমাত্র ‘কবিতা‘ পত্রিকাতেই কবিতা লিখেছেন। সমসাময়িক বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী-র অনেক কবিতাই এখানেই আগে প্রকাশিত হয়েছে। প্রচুর বিদেশি কবিতার অনুবাদ-প্রকাশও ছিল এই পত্রিকার একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েন বুদ্ধদেব। বিভাগের বিভিন্ন কাজকর্ম আর ঘনঘন বিদেশযাত্রার ফলে অবশেষে ক্ষীণ হয়ে আসে পত্রিকার জন্য সময়।
বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে পাঠকমহলে একটি পরিচিত অভিযোগ যে, তিনি কলাকৈবল্যবাদী। সমসাময়িক প্রেমেন্দ্র মিত্র বা অচিন্ত্যকুমার যখন সামাজিক মানুষের সংকট দেখে আকুল হয়েছেন, বুদ্ধদেব তখনও ব্যক্তিগত শিল্পচর্চায় বিশ্বাসী গবাক্ষহীন ঘরে। যদিও ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘ-র একসময় সদস্য হয়েছিলেন তিনি, বক্তৃতাও করেছেন, লিখেছেন ‘স্বাজাতিকতা, দেশপ্রেম, বিশ্বমানবিকতা‘ বা ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম‘ নামের প্রবন্ধ-ও । নোয়াখালি দাঙ্গার পর গান্ধীজির সেখানে প্রাসঙ্গিকতা স্মরণ করে লিখেছেন ‘নোয়াখালি‘ নামের প্রবন্ধ- তবুও কবিতা, গল্পে, উপন্যাসে তিনি ছিলেন আত্মতার-ই সন্ধানী।
দীপ্তি ত্রিপাঠীর ভাষায়, ‘বুদ্ধদেব ব্যক্তিজীবনে বিশ্বাসী। বিষ্ণু দে-র মতো বিরাট সামাজিক জীবন তাঁর মনকে আকৃষ্ট করেনি। যে দীর্ঘ তিরিশ বছর তিনি কবিতা রচনা করেছেন সে তিরিশ বছর বাংলা তথা ভারতবর্ষের পটভূমিকা বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে মুহুর্মুহু কম্পিত হয়েছে। তবুও তিনি রাজনৈতিক প্রসঙ্গে নীরব ছিলেন, এমনকী সুধীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের মতো অনাস্থাও প্রকাশ করেননি।‘
অনেক সমালোচক যদিও একথা বলেছেন যে, সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টির ওপর একের পর এক প্রবন্ধ রচনা করে যেভাবে তিনি উৎসাহ প্রদান করেছিলেন, বিপরীতক্রমে বুদ্ধদেবের রচনা সম্পর্কে কলম ধরতে কিন্তু সমকালীন লেখকদের ততখানি সোচ্চার হতে দেখা যায় না। তবুও নিজের লক্ষ্যে বুদ্ধদেব ছিলেন অবিচল।
কিন্তু পরবর্তীকালের কবিরা প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন এই পূর্বজ সাহিত্যিককে। ‘ছন্দের বারান্দা‘ গ্রন্থে শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘তাঁর চরিত্রে আছে সুরের প্রতি আরোধ্য আকর্ষণ, তাঁর কবিতা বানিয়ে তোলে আসক্তি, ছড়িয়ে দেয় তীব্র মত্ত আত্মহারা ভালোবাসা।‘ সেই গান সেই মত্ততা ছড়িয়ে যায় শিরায় শিরায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতায় লিখেছেন, ‘তোমার নিকটে এসে বৃক্ষের ভরসা পেত কবি, ছায়া পেত, সচ্ছলতা পেত সুন্দর।‘। আর শামসুর রহমান ‘বুদ্ধদেব বসুর প্রতি‘ কবিতায় লেখেন ‘শব্দেই আমরা বাঁচি এবং শব্দের মৃগয়ায়/আপনি শিখিয়েছেন পরিশ্রমী হতে অবিরাম।/ …আপনার ঋণ / যেন জন্মদাগ, কিছুতেই মুছবে না কোনোদিন ।‘
কবিতা:
মর্মবাণী (১৯২৫),বন্দীর বন্দনা (১৯৩০),পৃথিবীর পথে (১৯৩৩),কঙ্কাবতী (১৯৩৭),দময়ন্তী (১৯৪৩),দ্রৌপদীর শাড়ি (১৯৪৮),শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩),শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর (১৯৫৫),যে-আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮),দময়ন্তী: দ্রৌপদীর শাড়ি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৬৩),মরচেপড়া পেরেকের গান (১৯৬৬),একদিন: চিরদিন (১৯৭১),স্বাগত বিদায় (১৯৭১)
উপন্যাস :
সাড়া (১৯৩০),সানন্দা (১৯৩৩),লাল মেঘ (১৯৩৪),বাসরঘর (১৯৩৫)পরিক্রমা (১৯৩৮),কালো হাওয়া (১৯৪২),তিথিডোর (১৯৪৯),নির্জন স্বাক্ষর (১৯৫১),মৌলিনাথ (১৯৫২),নীলাঞ্জনের খাতা (১৯৬০),পাতাল থেকে আলাপ (১৯৬৭),রাত ভ'রে বৃষ্টি (১৯৬৭),গোলাপ কেন কালো (১৯৬৮),বিপন্ন বিস্ময় (১৯৬৯),রুক্মি"" (১৯৭২)
গল্প :
রজনী হ'ল উতলা(১৯২৬),অভিনয়,অভিনয় নয় (১৯৩০),রেখাচিত্র (১৯৩১),হাওয়া বদল (১৯৪৩),শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৫৯),একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু (১৯৬০),হৃদয়ের জাগরণ (১৩৬৮),ভাসো আমার ভেলা (১৯৬৩),প্রেমপত্র (১৯৭২)
প্রবন্ধ :
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি (১৯৩৫),কালের পুতুল (১৯৪৬),সাহিত্যচর্চা (১৩৬১),রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য (১৯৫৫),স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭),সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৩),প্রবন্ধ-সংকলন (১৯৬৬),কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)সমুদ্রতীর (১৯৩৭),আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩),আমার যৌবন (১৯৭৩)আমি চঞ্চল হে (১৯৩৭)সব পেয়েছির দেশে (১৯৪১)উত্তর তিরিশ (১৯৪৫)জাপানি জার্নাল (১৯৬২)দেশান্তর (১৯৬৬)কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)মহাভারতের কথা (১৯৭৪)কবিতার শত্রু ও মিত্র (১৯৭৪)
নাটক
মায়া-মালঞ্চ (১৯৪৪),তপস্বী ও তরঙ্গিণী (১৯৬৬
কলকাতার ইলেক্ট্রা ওসত্যসন্ধ (১৯৬৮)
অনুবাদ :
কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭),গহীন বালুচর (১৯৫৮),বোদলেয়ার: তার কবিতা (১৯৭০),লল্ডালিনের কবিতা (১৯৬৭),রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা (১৯৭০)
'ভ্রমণ কাহিনী
সব-পেয়েছির দেশে (১৯৪১),জাপানি জার্নাল (১৯৬২),শান্তর (১৯৬৬),
স্মৃতিকথা
আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩),আমার যৌবন (১৯৭৬)
সম্পাদনা
আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৬৩)
সম্মাননা
১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন।
১৯৬৭ সালে তপস্বী ও তরঙ্গিণী কাব্যনাট্যের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭৪ সালে স্বাগত বিদায় গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
মৃত্যু
বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
=================================