Wednesday, 11 November 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆¶¶¶¶¶¶¶∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
            আলোচনা পর্ব -১৮

নিহিত আর ক্ষতচিহ্নময় শঙ্খ ঘোষের কবিতা
                            
$$$$$$$$$$$$$\\\\\\\\\$$$$$$$$$$$$
        Doinik sabder methopath
          Vol -189  Dt -12.11.2020
           ২৬ কার্তিক,১৪২৭. বৃহস্পতিবার
®®®®®®®®®®®®®®®®®®®®®®®®

আমাদের সংস্কৃতির শিরোধার্য ব্যক্তিত্ব শঙ্খ ঘোষ জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন। আনন্দের খবর নিশ্চয়ই। কিন্তু আমাদের জীবনযাপনে, আমাদের চর্চায় শঙ্খ ঘোষের লালন যেভাবে জড়ানো, কোনও পুরস্কারই তাকে অতিরিক্ত আলো দিতে পারবে না। শুধু তো দুটি কবিতা-গদ্য লেখা নয়, নিজের লেখা, পড়াশোনার পাশাপাশি বিদ্যাচর্চার বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতটি তিনি সবসময় নজরে রাখেন। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি যে-কোন শুভ উদ্যোগ সফল করতে তিনি যে কতটা পরিশ্রম করেন, তা যাঁরা ভেতর থেকে না দেখেছেন তাঁরা বুঝতেই পারবেন না। নিজেকে উহ্য রেখে কাজ করে চলার যে-নির্মম নজির তিনি প্রতিনিয়ত তৈরি করে চলেছেন তা আমাদের এই আগ্রাসী আত্মসর্বস্বতার বাজারে অবিশ্বাস্য মনে হয়।

২০০৯ সালে বারাসতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনাপর্বে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ শুরু করার অনুরোধ জানিয়ে শঙ্খ ঘোষ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের উপাচার্যকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। অসামান্য সেই চিঠি। শঙ্খ ঘোষের গদ্যভাষার নিজস্ব মন্দ্রতার সঙ্গে সেই চিঠিতে মিশে ছিল তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়টির প্রতি তার আবেগ, সমর্থন আর উৎসাহ। তুলনামূলক সাহিত্যের ধারণা ছাড়া যে এই মুহূর্তে সাহিত্যপাঠ অসম্ভব, সে-কথা সংযত কিছু যুক্তি আর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন তিনি। লিখেছিলেন : ‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি যদি ভরসা করে এমন একটি বিভাগের প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে পড়াশোনার জগতে একটা বড় কাজ হতে পারে বলে মনে হয়। মনে হয় অনেক বিচ্ছিন্নতাবোধেরও প্রতিষেধক হতে পারে সেটা’। চিঠিটি স্যার আমার হাতেই দিয়েছিলেন, উপাচার্যকে দেবার জন্য। সেই চিঠির সূত্রেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা করি। ঘটনাটি উল্লেখের একটি মৃদু কারণ, আমাকে তিনি গত দু-দশক ধরে কতটা প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তা আরেকবার মনে করা। ওই চিঠিটি শুধু আমার পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতেই কতটা গুরুত্বপূর্ণ, পাঠক তা নিশ্চয়-ই বুঝতে পারছেন। আমাকে বার্তাবাহক করে স্যার সেই গুরুত্বের সঙ্গে আমাকে স্থায়ীভাবে যুক্ত করে দিলেন।


 
শঙ্খ ঘোষের কবিতার সবচেয়ে স্বাভাবিক অবলম্বন হলো সময়। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের চারপাশের সব প্রকাশ্য টানাপোড়েন আমরা ছুঁয়ে ফেলতে পারি। যা-কিছু আমাদের জীবনকে বাইরের দিকে যুক্ত করছে, সমবেত মহাপৃথিবীর অংশ হয়ে উঠছে আমাদের বেঁচে-থাকা যে-সমারোহময় মুহূর্তে, সেইসব মুহুর্তের সব উত্তেজনা শঙ্খ ঘোষ কবিতার ধরে রাখতে পারেন। তাঁর কবিতা আলাদা এক মননভঙ্গির গভীরতা নিয়ে কথা বলে। এমনকি যখন কৌতুক বা ব্যঙ্গের ধরন রাখেন তিনি কবিতায়, তখনও ভাষা তার স্বাভাবিক মন্দ্রতা হারায় না। তাঁর ‘শ্লোগান’ কবিতাটি মনে করুন :

এমনিভাবে থাকতে গেলে শেষ নেই শঙ্কার
মারের জবাব মার

বুকের ভিতর অন্ধকারে চমকে ওঠে হাড়
মারের জবাব মার

বাপের চোখে ঘুম ছিল না ঘুম ছিল না মার
মারের জবাব মার

কিন্তু তারও ভিতরে দাও ছন্দের ঝংকার
মারের জবাব মার

লক্ষণীয়, দেয়াললিখন প্রসঙ্গে কবির সপ্রশ্ন অস্বস্তি রয়েছে। কবিতাটিতে এই অস্বস্তি রূপ নিয়েছে সব্যঙ্গ অথচ নিঃশব্দ প্রত্যাখ্যানের। শ্রেণি-ঘৃণার এই স্লোগান (‘মারের জবাব মার’) একসময় বাংলাপ্লাবিত ছিল। এই প্লাবন এবং তার জোয়ারে ভেসে-যাওয়া সময়ের নানা চিহ্ন ‘স্লোগান’ কবিতাতেও ধরা পড়েছে। সেন্ট্রাল জেল কিংবা কার্জন পার্কে ঝরে যাওয়া সোনার ছেলেদের স্মৃতিকণা ঝলক দেয় ‘বুকের ভিতর অন্ধকারে চমকে ওঠে হাড়’-এর কথায়। স্মৃতির লালন আর নির্মম মৃত্যুকে একই সঙ্গে ধরে রেখেছে ‘হাড়’ শব্দটি। আর তারপরেই ‘মারের জবাব মার’ অসহায় বৈপরীত্যে চলকে ওঠে।
একমাত্রিক সুন্দরের দিকে হাত জোড় করে বসে থাকা শঙ্খ ঘোষের স্বভাব নয়। যে-কোনও দৃশ্যের সাধারণ স্তর থেকে তিনি স্তরান্তরে চলে যেতে পারেন। কারণ তিনি দেখেছেন ‘ভাঙা ডানা পড়ে থাকে রাজপথে, গুহামুখে, চরে’। সম্ভাবনার সমুদ্র থেকে কোনও আসক্ত হাওয়া উঠে আসছে না, তবু, এই ‘নাগিনীপিচ্ছিল অন্ধকারে’ও তিনি বলতে পারেন : ‘তারও মাঝখানে আমি স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন দেখি/দেখি ওরা হেঁটে যায় পৃথিবী সুন্দরতর করে’। তিনি জানেন ‘চম্পকনগরে আজ কানীর চক্রান্ত চারিদিকে’, তাই, ‘আমি শুধু এইখানে প্রহরীর মতো জেগে দেখি/যেন না ওদের গায়ে কোনো নাগিনির শ্বাস লাগে’।
একটা সময় ছিল, ঐ আশির দশকে, যখন শঙ্খ ঘোষ আমাদের অধিকার করে নিচ্ছেন ক্রমশ, আর, আমরা সেই টানের স্বরূপ বুঝে নিতে চাইছিলাম নানা কায়দায়। টের পাচ্ছিলাম, সময় তার সব রহস্য আর সম্ভাবনা নিয়ে নানা গমকে তাঁর কবিতায় উঠে আসতে চাইছে। এই গমকটা খুব বড়ো ব্যাপার। কে কীভাবে কথা বলবেন কবিতায়, তার মাত্রা বা বহরের ওপর নির্ভর করে তাঁর কবিতা কাকে, কতটা, কতদিন ছুঁতে পারবে। শঙ্খ ঘোষ বারবার এই ধরনটা পালটে পালটে নিজের ভাষাটাকে সক্ষম করে রাখতে চেয়েছেন। বারবার।

শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে প্রতি রবিবার একটি দরাজ আড্ডা বসে। আমি দু-দশক ধরে সেই আড্ডার নির্ভুল সদস্য। স্যারের বাড়ির আড্ডার বৈশিষ্ট্য হলো যে-কেউ যে-কোন বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারেন। সার্থক আড্ডার ধরন-ই তো তাই। আর আমাদের দুর্লভ কিন্তু নিঃশব্দ প্রাপ্তি হয় যখন স্যার আমাদের কথায় তাঁর কথা মেশান। ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই ঘটে চলে, আড্ডার নিজস্ব নিয়মেই সেটা হয়, কিন্তু এই স্বাভাবিকতার যে-অতিরিক্ত ঐশ্বর্য, তা আমরা প্রত্যেকেই আমাদের জীবনের ভাঁড়ারে গোপনে তুলে নিতে থাকি।
আলোচক 
সুমন গুণ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆√√√√√∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
           (সংগৃহীত )


No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...