∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆২০০∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
ই- ম্যাগাজিন দ্বিশত সংখ্যা প্রকাশ
-----------------------------------------------
জগৎজননী জগদ্ধাত্রী
------------------------------------------------
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
১) নীরদ চন্দ্র চৌধুরী
২) নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
==============২০০=================
"অনুনাটক" বিশেষ সংখ্যা
==============২০০================
সম্পাদকীয় -
হেমন্তের হিমেল হাওয়ার পরশে দেহ মন অসাড় হলেও সোনা রোদের গান সাড়া জাগায় প্রকৃতির অঙ্গনে। গৃহবন্দি জীবনের একান্ত পারিবারিক ঘরানায় মিলেমিশে থাকতে গিয়ে সম্পৃক্তবোধ উচ্চাসন অধিকার করেছে। সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থেকেও নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেনি। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলত বাড়িতে বসে সেই ধারা নিজস্ব গতিবেগ নিয়ে এগিয়ে চলেছে, ই-ম্যাগাজিন , ই- পত্রপত্রিকা, ই -লাইব্রেরি সহ নানান মাধ্যমকে আশ্রয় করে। দৈনিক শব্দের মেঠোপথ এ রকমই একটি মৌলিক নিজস্ব ঘরানার ই-ম্যাগাজিন। নানান ভাবে চলতে চলতে ২০০তম সংখ্যা প্রকাশ করল আজ,
আপনাদের সকলের সহযোগিতায়। পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে দৈনিক শব্দের মেঠোপথ পত্রিকার পরিবার প্রীতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জ্ঞাপন করে। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে যথার্থ পরামর্শদাতা শুভানুধ্যায়ী লেখক কবি সাহিত্যিক নাট্যকারদের। যাদের সুনিপুণ মৌলিক রচনায় এই পত্রিকার অবয়ব ও গুণগত মন একটি জায়গা করে নিয়েছে । বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি - সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়াকে। প্রতিদিনের সাহস নিয়ে এগিয়ে চলার মন্ত্রে দীক্ষিত যে পরিবার। সেই পরিবারের সঙ্গে আপনারা সশরীরে আছেন জেনে গর্বিত ও আনন্দিত। সবাই ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন ।নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন।
২৩.১১.২০২০. দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
পরিবার।
------------------///------২০০-------///--------
স্তব মন্ত্র :
ওঁ আধারভূতে চাধেয়ে ধৃতিরূপে ধুরন্ধরে।
ধ্রূবে ধ্রূবপদে ধীরে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
শবাকারে শক্তিরূপে শক্তিস্থে শক্তিবিগ্রহে।
শাক্তাচার প্রিয়ে দেবি জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ “জগৎ+ধাত্রী। জগতের (ত্রিভুবনের) ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা)।”[২] ব্যাপ্ত অর্থে দুর্গা, কালী সহ অন্যান্য শক্তিদেবীগণও জগদ্ধাত্রী। তবে শাস্ত্রনির্দিষ্ট জগদ্ধাত্রী রূপের নামকরণের পশ্চাতে রয়েছে সূক্ষ্মতর ধর্মীয় দর্শন। স্বামী প্রমেয়ানন্দের মতে,
“ ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি জগদ্ধাত্রী।
সগুণ ব্রহ্মের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশরূপ তিনগুণের যুগপৎ প্রকাশ যেমন কালীরূপের বৈশিষ্ট্য, তাঁর ধারণী ও পোষণী গুণের যুগপৎ প্রকাশও জগদ্ধাত্রীরূপের বৈশিষ্ট্য।... ধা ধাতুর অর্থ ধারণ বা পোষণ। ভগবতী নিখিল বিশ্বকে বক্ষে ধারণ করে পরিপালন করেন বলে মুনিগণ কর্তৃক তিনি ত্রৈলোক্যজননী নামে অভিহিত।..."
" বারোইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু – ঘোড়ায় চড়া হাইল্যান্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মূর্তি – সিঙ্গির গায়ে রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া। ঠাকরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আদল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে জোড়হাত ক’রে স্তব কচ্চেন। প্রতিমের উপরে ছোট ছোট বিলাতী পরীরা ভেঁপু বাজাচ্চে – হাতে বাদশাই নিশেন ও মাঝে খোড়াসিঙ্গিওয়ালা কুইনের ইউনিফরম ও ফ্রেষ্ট!... বেলা আটটার সময় যাত্রা ভাঙলো, একজন বাবু মাতাল, পাত্র টেনে বিলক্ষণ পেকে যাত্রা শুনছিলেন, যাত্রা ভেঙে যাওয়াতে গলায় কাপড় দিয়ে প্রতিমে প্রণাম কত্তে গেলেন, (প্রতিমে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত জগদ্ধাত্রী-মূর্তি)। কিন্তু প্রতিমার সিঙ্গি হাতীকে কাম্ড়াচ্চে দেখে, বাবু মহাত্মার বড়ই রাগ হলো, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাবু করুণার সুরে – তারিণী গো মা কেন হাতীর উপর এত আড়ি।মানুষ মেলে টের্টা পেতে তোমায় বেতে হতো হরিণবাড়ী।সুর্কি কুটে সারা হোতো, তোমার মুকুট যেত গড়াগড়ি।।পুলিসের বিচারে শেষে সঁপতো তোমায় গ্র্যান্বুড়ি।সিঙ্গি মামা টের্টা পেতেন ছুট্তে হতো উকীলবাড়ী।।
গান গেয়ে, প্রণাম ক’রে চলে গেলেন।"
কালীপ্রসন্ন সিংহ
হুতোমপ্যাঁচার নক্সা (১৮৬৪)
জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও, দুর্গা বা কালীপূজার তুলনায় এই পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ঘটে। অষ্টাদশ শতকে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তার রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। [১১] যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। শূলপাণি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ করেন। পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত। [১২] কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয়। তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রে পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। কেবল কিছু ব্রাহ্মণগৃহে দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হত। [১২]
কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজা :
কৃষ্ণনগর রাজবাটীর জগদ্ধাত্রী পূজা
নদিয়া জেলার সদর কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। কিংবদন্তী অনুসারে নবাব আলিবর্দির রাজত্বকালে মহাবদজঙ্গ রাজার নিকট থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন। নজরানা দিতে অপারগ হলে তিনি রাজাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে (মতান্তরে মুঙ্গেরে) নিয়ে যান। মুক্তির পর নদীপথে কৃষ্ণনগরে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘাটে বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে তিনি বুঝতে পারেন সেই বছর দুর্গাপূজার কাল উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপূজার আয়োজন করতে না পেরে রাজা অত্যন্ত দুঃখিত হন। সেই রাতে দুর্গা জগদ্ধাত্রীর রূপে রাজাকে পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী দুর্গার পূজা করার আদেশ দেন।অন্য এক মতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা ১৭৬৬ সালে।[১৩] কেউ কেউ আবার কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্রকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক মনে করেন।[১২] কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দরজা জগদ্ধাত্রী পূজার সময় আজও খোলা থাকে। পূজা পুরনো প্রথা মেনে হয় শুধুমাত্র নবমী তিথিতে।
১৭৭২ সালে রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন। বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত এই পূজা শুরু হয়েছিল ঘটে ও পটে। প্রথম দিকে স্থানীয় গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে এই পূজার আয়োজন করতেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘটপটের পরিবর্তে প্রতিমায় জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল প্রায় সাড়ে সাতশো ভরি সোনায় গয়নায় দেবীপ্রতিমার অলংকারসজ্জা। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দাদের মতে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা; তার নিকট সকল মনোষ্কামনাই পূর্ণ হয়।[১৩]
এছাড়া কৃষ্ণনগরের উল্লেখযোগ্য বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি হল প্রীতিসম্মেলনী, বালকেশ্বরী, মালোপাড়া, হাতারপাড়া, উকিলপাড়া, ষষ্ঠীতলা, বউবাজার, নেদেরপাড়া, বাঘাডাঙা, পাত্রমার্কেট, কৃষ্ণনগর স্টেশন চত্বর, বেজিখালি, চকেরপাড়া, বাগদিপাড়া, মাঝেরপাড়া, ঘূর্ণি, হরিজনপল্লি, তাঁতিপাড়া, কালীনগর ইত্যাদি।বর্তমানে কৃষ্ণনগরে বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজা হয় দুই শতেরও বেশি।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা :
পালপাড়া সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজা, চন্দননগর
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। জানা যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ইন্দ্রনারায়ণ ছিলেন চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান। প্রায় আড়াইশো বছর আগে, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। লক্ষ্মীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এই পূজার সূচনা। এই পূজা চন্দননগরে আদি পূজা নামে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে পূজার সংকল্প হয়। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি। শোনা যায়, বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লেই শুশুক বা সাপের দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা। লক্ষ্মীগঞ্জ কাপড়েপট্টির জগদ্ধাত্রী পূজা চন্দননগরে দ্বিতীয় প্রাচীনতম পূজা। ১৭৬৮ সালে চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় (মতান্তরে শশধর) রীতিমতো চাঁদা তুলে এই পূজা প্রবর্তন করেন। এই অঞ্চলের অপর দুটি পূজা হল লক্ষ্মীগঞ্জ চৌমাথা (স্থাপিত ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ) ও লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের (স্থাপিত ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) পূজা। উত্তর চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি, কাপড়েপট্টি, চৌমাথা ও বাজার – এই চার পূজাতেই সিংহের রং সাদা। উত্তর চন্দননগরের অন্যান্য বড়ো জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি হল চন্দননগর বাগবাজার (স্থাপিত ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ), খলিসানী কলপুকুরধার, বউবাজার শীতলাতলা, খলিসানী বউবাজার, বাগবাজার চৌমাথা, বিদ্যালঙ্কার, পালপাড়া, বিবিরহাট উত্তরাঞ্চল, বিবিরহাট চড়কতলা তেমাথা, হরিদ্রাডাঙা, হেলাপুকুরধার, নাড়ুয়া, কাঁটাপুকুর, কাঁটাপুকুর চৌমাথা, বোড়ো কালীতলা, বোড়ো পঞ্চাননতলা, বোড়ো চাঁপাতলা, বোড়ো দিঘির ধার, বোড়ো তালডাঙা ইত্যাদি।
দক্ষিণ চন্দননগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পূজাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানকুণ্ডু সার্বজনীন, মানকুণ্ডু নতুনপাড়া, নিয়োগী বাগান, সার্কাস মাঠ, তেমাথা, অম্বিকা অ্যাথলেটিক ক্লাব, মরান রোড, গোন্দলপাড়া মনসাতলা, সাতঘাটা, গোন্দলপাড়া চারমন্দিরতলা, বেশোহাটা, লিচুতলা হাজিনগর, হাটখোলা দৈবকপাড়া, মনসাতলা, ভুবনেশ্বরীতলা, নোনাটোলা, বড়বাজার, পাদ্রিপাড়া, লালবাগান, ড্যুপ্লেক্সপট্টি, শ্রমিকপল্লি, সুভাষ জাগরণ সংঘ তেমাথা, অরবিন্দ সংঘ, বারাসত দক্ষিণ, বারাসত গেট। দক্ষিণ চন্দননগরের হালদারপাড়ার আদিপুজো অশ্বত্থতলার বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত। এই পূজা লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি ও কাপড়েপট্টির পূজার সমসাময়িক বলে মনে করা হয়।
চন্দননগর কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পূজা কমিটির অনুমোদিত তিনশের অধিক পূজা হয় ।
চন্দননগরের আলোকসজ্জা , দেবীমূর্তি ও শোভাযাত্রা বিশ্বখ্যাত।
প্রতি বছর লটারির মাধ্যমে শোভাযাত্রার জন্য 75-80টি পূজা কমিটিকে বেছে নেওয়া হয়।
জয়রামবাটীর জগদ্ধাত্রী পূজা :
বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সহধর্মিণী সারদা দেবীর জন্মভিটা র জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। পূজা উপলক্ষে জয়রামবাটীতে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। সারদা দেবীর পৈতৃক বাড়িতে এই পূজার আয়োজন করে রামকৃষ্ণ মিশন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে (১২৮৪ বঙ্গাব্দ)[১৪] সারদা দেবীর পিতৃগৃহে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেছিলেন তার জননী শ্যামাসুন্দরী দেবী। কিংবদন্তি অনুসারে, প্রতি বছর শ্যামাসুন্দরী দেবী প্রতিবেশী নব মুখুয্যের বাড়ির কালীপূজা উপলক্ষে নৈবেদ্যের চাল পাঠাতেন। ওইবছর কোনো বিবাদের কারণে নব মুখুজ্যে চাল নিতে অস্বীকার করেন। নৈবেদ্যদানে অসমর্থ হয়ে শ্যামাসুন্দরী দেবী অত্যন্ত মর্মাহত হন। সেই রাতেই তিনি দেবী জগদ্ধাত্রীকে স্বপ্নে দেখেন এবং তার স্বপ্নাদেশে ওই চালে জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন। প্রথম বছর বিসর্জনের দিন বৃহস্পতিবার ছিল। তাই সারদা দেবী লক্ষ্মীবারে বিসর্জনে আপত্তি করেছিলেন। পরদিন সংক্রান্তি ও তার পরদিন মাস পয়লা থাকায় ওই দুই দিনও বিসর্জন দেওয়া যায়নি। বিসর্জন হয় চতুর্থ দিনে। আরও কথিত আছে যে, পরের বছর সারদা দেবী জগদ্ধাত্রী পূজা বন্ধ করে দিতে চাইলে দেবী জগদ্ধাত্রী তাকে স্বপ্নাদেশে পূজা বন্ধ করা থেকে নিরস্ত করেন। এরপর প্রথম চার বছর পূজা হয়েছিল শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে; দ্বিতীয় চার বছর সারদা দেবীর নামে এবং তৃতীয় চার বছর তার কাকা নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নামে। বারো বছর পর সারদা দেবী পুনরায় পূজা বন্ধ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শোনা যায়, এই বারও জগদ্ধাত্রীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি নিরস্ত হন।
জীবদ্দশায় প্রতি বছরই জগদ্ধাত্রী পূজায় উপস্থিত থাকতেন সারদা দেবী। পূজা পরিচালনার জন্য তিনি সাড়ে দশ বিঘার কিছু বেশি জমি দেবোত্তর সম্পত্তিরূপে দিয়ে যান। ১৯১৯ সালে সারদা দেবী এই পূজায় শেষবার উপস্থিত ছিলেন। পরের বছর তিনি প্রয়াত হন।
প্রথম পূজার ঐতিহ্য অনুযায়ী আজও শুক্লা নবমীতে মূল পূজার পরও দুই দিন প্রতিমা রেখে দিয়ে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার মতোই পূজার সঙ্কল্প হয় সারদা দেবীর নামে। জগদ্ধাত্রীর প্রতিমার পাশে জয়া-বিজয়া ও নারদ মুনির প্রতিমা থাকে। নবমীতে ষোড়শোপচারে পূজা, তিন বার চণ্ডীপাঠ ও মাতৃমন্দিরে দরিদ্রনারায়ণ সেবা হয়। দশমীর দিন দশোপচারে পূজা হয়। এই দিন সন্ধ্যারতির পর যাত্রাগানের আসর বসে। একাদশীর দিনও দশোপচারে পূজা ও বিসর্জনকৃত্য সম্পন্ন হয়। এই দিন ধুনুচি নৃত্য, কর্পূরারতি, কনকাঞ্জলি প্রদান প্রভৃতিও অনুষ্ঠিত হয়। ধুনুচি নাচের পর বাদ্যঘণ্টা ও শোভাযাত্রা সহকারে মায়ের দিঘিতে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনে আশ্রমবাসী, অতিথি এবং গ্রামবাসী সকলে অংশ নেন। পূজা উপলক্ষে আশ্রমপ্রাঙ্গনে মেলাও বসে।
কেন উপনিষদ :
কেন উপনিষদে, দেবী ভাগবত পুরাণ ও অন্যান্য পুরান মতে উল্লিখিত একটি উপাখ্যান অনুসারে : একবার দেবাসুর সংগ্রামে দেবগণ অসুরদের পরাস্ত করলেন। কিন্তু তারা বিস্মৃত হলেন যে নিজ শক্তিতে নয়, বরং ব্রহ্মের বলে বলীয়ান হয়েই তাদের এই বিজয়। ফলত তারা হয়ে উঠলেন অহংকার-প্রমত্ত। তখন দেবী পার্বতী এক কুমারী বালিকার বেশ ধারণ করে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। তিনি একটি তৃণখণ্ড দেবতাদের সম্মুখে পরীক্ষার নিমিত্ত রাখলেন। অগ্নি ও বায়ু তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেই তৃণখণ্ডটিকে দগ্ধ বা বিধৌত করতে পারলেন না। তখন দেবগণ ইন্দ্রকে বালিকার পরিচয় জানবার নিমিত্ত প্রেরণ করলেন। ইন্দ্র অহংকার-প্রমত্ত হয়ে বালিকার কাছে আসেননি, এসেছিলেন জিজ্ঞাসু হয়ে। তাই ব্রহ্মরূপী দেবী পার্বতী তার সম্মুখ হতে তিরোহিত হলেন। বরং তার সম্মুখের আকাশে দিব্য স্ত্রীমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন হৈমবতী উমা পার্বতী। উমা ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে ইন্দ্রের জ্ঞানপিপাসা নিবৃত্ত করলেন।
কাত্যায়নী তন্ত্র :
উপনিষদে উমার রূপবর্ণনা নেই। কেবলমাত্র তাকে হৈমবতী পার্বতী অর্থাৎ স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা বলা হয়েছে। তবে এই হৈমবতী উমাই যে দেবী জগদ্ধাত্রী সে প্রত্যয় জন্মে কাত্যায়ণী তন্ত্রের ৭৬ পটলে (অধ্যায়) উল্লিখিত একটি কাহিনি থেকে। এই কাহিনি অনুসারে : একদা ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র – এই চার দেবতা অহংকার-প্রমত্ত হয়ে নিজেদের ঈশ্বর মনে করতে শুরু করলেন। তারা বিস্মৃত হলেন যে দেবতা হলেও তাদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই – মহাশক্তি পার্বতীর শক্তিতেই তারা বলীয়ান। দেবগণের এই ভ্রান্তি অপনয়নের জন্য দেবী জগদ্ধাত্রী ( পার্বতী) কোটি সূর্যের তেজ ও কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। এর পরের কাহিনি কেন উপনিষদে বর্ণিত তৃণখণ্ডের কাহিনির অনুরূপ। দেবী প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করে তৃণখণ্ড রাখলেন; কিন্তু চার দেবতার কেউই তাকে স্থানচ্যুত বা ভষ্মীভূত করতে অসমর্থ হলেন। দেবগণ নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলেন। তখন দেবী তার তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন। এই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী ও দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এক মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তি। সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে দেবী দেবগণকে এই মূর্তি দেখালেন; দেবগণও তার স্তবে প্রবুদ্ধ হলেন।
করীন্দ্রসুর :
ধ্যান বা স্তবমন্ত্রে উল্লেখ না থাকলেও জগদ্ধাত্রী প্রতিমায় বাহন সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড থেকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, জগদ্ধাত্রী দেবী করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ মহাহস্তীরূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কারণে দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী নামে পরিচিত। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায়, “মন করীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।... সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতীকে জব্দ করে রেখেছে।” স্বামী নির্মলানন্দের মতে, “যে-কোনো সাধনায় মনকে সংযত করে বশে আনা সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। আমাদের মন মত্ত করী, মন-করীকে বশ করতে পারলে সাধনায় সিদ্ধিলাভ অবশ্যম্ভাবী।... মত্ত মন-করীকে বশ করে সাধক-হৃদয়ে জগদ্ধাত্রীর প্রতিষ্ঠায়ই জগদ্ধাত্রী-সাধনার সার্থকতা, পূজার পরিসমাপ্তি।”[৮] করীন্দ্রাসুর এর বর্ণনা ওই নামে না থাকলেও চণ্ডীতে উল্লেখ আছে মহিষাসুর এক মহাহস্তি রুপে দেবীকে আক্রমণ করে এবং দেবী তার মুণ্ড চ্ছেদ করেন...... তখন সে এক পুরুশ রুপে অবতীর্ণ হয়ে দেবীকে যুদ্ধে আওভান করলে ......... মা তাকে তিরে বিদ্ধ করেন......... এই তির ধনুক দেবির এই মূর্তিতে বর্তমান।।
---------------------২০০------------------------------
নীরদ চন্দ্র চৌধুরী
উপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ও সুশীলা সুন্দরী চৌধুরানীর ৮ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় নীরদ চৌধুরী তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশের) কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদীতে ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ এবং কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন। এফএ পরীক্ষা পাশ করে তিনি কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) অন্যতম বাঙালি লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে একত্রে ভর্তি হন। এরপর নীরদ কলকাতার অন্যতম খ্যাতিমান স্কটিশ চার্চ কলেজে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্কটিস চার্চ কলেজের ছাত্র হিসেবে তিনি ইতিহাসে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং মেধা তালিকায় নিজের স্থান করে নেন। স্কটিশ চার্চ কলেজের সেমিনারে ভারতবর্ষের অতিপরিচিত ব্যক্তিত্ব ও ইতিহাসবেত্তা প্রফেসর কালিদাস নাগের সাথে অংশগ্রহণ করেন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও ১৯২০-এর অনুষ্ঠিত এম. এ. পরীক্ষায় অংশ না নেয়ায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন নি। এখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি। ইতোমধ্যে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে Objective Methods in History শিরোনামে একটি তাত্ত্বিক প্রবন্ধ রচনা করেন|
নীরদ চৌধুরীর কর্মজীবনের সূত্রপাত হয় ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিসাবরক্ষণ অধিদপ্তরে একজন কেরাণী হিসেবে। চাকুরির পাশাপাশি একই সময়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ রচনা করতে থাকেন। জনপ্রিয় সাময়িকীগুলোতে নিবন্ধ পাঠানোর মাধ্যমে লেখার জগতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। তার প্রথম নিবন্ধটি ছিল অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত বাঙালি কবি ভারত চন্দ্রের উপর। এই নিবন্ধটি ঐ সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ইংরেজি সাময়িকী "মডার্ন রিভিউ"-তে স্থান পায়। ইতোমধ্যে ১৯২৪ সালে তার মাতা সুশীলা সুন্দররানী চৌধুরানী পরলোকগমন করেন।
নীরদ চৌধুরী হিসাবরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে অল্প কিছুদিন পরই চাকুরি ত্যাগ করেন এবং সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন। ঐ সময়ে কলকাতা কলেজ স্কয়ারের কাছাকাছি মির্জাপুর স্ট্রিটে অন্যতম লেখক - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সাথে একত্রে বোর্ডার হিসেবে ছিলেন। তিনি তখনকার সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় ইংরেজি ও বাংলা সাময়িকী হিসেবে মডার্ন রিভিউ, প্রবাসী এবং শনিবারের চিঠিতে সম্পাদনা কর্মে সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়াও, তিনি দুইটি ক্ষণস্থায়ী অথচ উচ্চস্তরের সাময়িকী - সমসাময়িক এবং নতুন পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্য মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় রমানন্দ চ্যাটার্জির অধীনে সহকারী সম্পাদকের চাকুরি গ্রহণ করেন। ১৯২৭-এ বাংলা সাময়িকী শনিবারের চিঠি সম্পাদক পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ বছরই রবীন্দ্রনাথের সাথে তার সৌজন্য সাক্ষাৎ ঘটে।
নীরদ চৌধুরী ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে লেখিকা অমিয়া ধরের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে তিনটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তার মধ্যম পুত্র কীর্তি নারায়ণ চৌধুরী খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। জ্যেষ্ঠ পুত্র ধ্রুব নারায়ণ পিতার অনেক অপ্রকাশিত লেখা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। পৃথ্বী তাদের কনিষ্ঠ সন্তান।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদ শরৎ চন্দ্র বসুর একান্ত সচিব হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে তিনি খ্যাতিমান মহাপুরুষ যেমন: মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু-সহ অনেক খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শ পান। ভারতীয় রাজনীতির অভ্যন্তরে কাজ করার দরুন ও রাজনীতির সাথে নিবীড় ঘনিষ্ঠতা থাকায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি সম্বন্ধে সন্দিহান হন। নীরদ চন্দ্র চৌধুরী স্বাধীনতা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এ পর্যায়ে তিনি বাংলা ভাষায় লেখালিখি ছেড়ে দেন।
সচিব হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি নীরদচন্দ্র চৌধুরী বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক, সাময়িকীগুলোতে প্রবন্ধ রচনা প্রকাশ করতে থাকেন। এছাড়াও, তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও'র (এআইআর) কলকাতা শাখার রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে নীরদ চৌধুরী অল ইন্ডিয়া রেডিও'র দিল্লী শাখায় কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, প্রখ্যাত সম্পাদক, ঐতিহাসিক এবং ঔপন্যাসিক খুশবন্ত সিং নীরদচন্দ্র চৌধুরী'র বন্ধু ছিলেন। The Autobiography of an Unknown Indian প্রকাশ করেন ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৫৫-তে প্রথমবারের মতো বিদেশযাত্রা; এ দফায় তিনি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি ভ্রমণ করেন। A Passage to England প্রকাশ করেন ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে এবং The Continent of Circe খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘The Continent of Circe: An Essay on the Peoples of India’ বইটির জন্য "Duff Cooper Memorial" পুরস্কার লাভ করেন। The Intellectual in India প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে।
নীরদ চৌধুরী ভারত ত্যাগ করে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে পাড়ি জমান ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে। এসময় Scholar Extraordinary বইটি লেখার কাজে হাত দেন। বইটি Scholar Extraordinary. The Life of Professor the Right Honourable Friedrich Max Muller, P.C. প্রচ্ছদনামে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ইতোমধ্যে ভারতীয় জীবনযাত্রার এক অতি সুন্দর প্রতিচ্ছবি সম্বলিত গ্রন্থ To Live or Not to Live প্রকাশিত হয় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৭৫, ১৯৭৬ এবং ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে যথাক্রমে প্রকাশ করেন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বই: Clive of India. A Political and Psychological Essay, Culture in the Vanity Bag. Clothing and Adornment in Passing and Abiding India এবং Hinduism. A Religion to Live By।
নীরদ চৌধুরীর মহান কীতি Thy Hand! Great Anarch! India: 1921—১৯৫২ নামীয় গ্রন্থটি। এই গ্রন্থটি ১৯৮৭ তে প্রকাশিত হয়। তখন তার বয়স নব্বুই। এ বয়সে তার দৈহিক এবং মানসিক কর্মক্ষমতা অটুট ছিল। পাণ্ডিত্য ও মণীষার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। ১৯৯২-এ ইংল্যান্ডের রাণী তাকে কমান্ডার অব দি অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার (সিবিই) উপাধি অর্পণ করেন।
১৯৯৪: দুঃখের বৎসর, অমিয়া চৌধুরানীর দেহত্যাগ।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রাক্কালে - ১০১ বৎসর বয়সে - নীরদচন্দ্র চৌধুরী অক্সফোর্ডে নিজ বাসগৃহে মৃত্যুবরণ করেন।
উল্লেখযোগ্য কর্ম
২০ লাইব্রেরি রোডে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর প্রাক্তন বাসবভন
নীরদচন্দ্র চৌধুরী'র প্রধান সাহিত্যকর্ম দি অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান (আইএসবিএন ০-২০১-১৫৫৭৬-১) ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এর ফলে তিনি সেরা ভারতীয় ইংরেজি লেখকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। নতুন ও স্বাধীন দেশ হিসেবে ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে কটাক্ষ করে বইটি উৎসর্গ করেন তিনি।
প্রকৃতপক্ষে বইয়ের উৎসর্গ অংশে বলা হয়েছে - অনেক ক্ষুদ্ধ ভারতীয়দের অভিমত: রাজনৈতিক এবং আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নব্য সাম্রাজ্যবাদের অনুকরণমাত্র।
নীরদ চৌধুরী সরকারি চাকুরি থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন, ফলে অবসর ভাতা থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। কালো তালিকাভুক্ত লেখক হিসেবে চিহ্নিত হন এবং জোরপূর্বক নতুন জীবনে গমন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি ভারত সরকার নিয়ন্ত্রিত অল ইন্ডিয়া রেডিও'র রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে আইনের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন যা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল।
নীরদ চৌধুরী পরবর্তীতে অবশ্য বলেছিলেন যে তিনি বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। তার বন্ধু, সম্পাদক, ঐতিহাসিক এবং ঔপন্যাসিক খুশবন্ত সিংয়ের মতে, "বইয়ের উৎসর্গটির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর প্রতি নিন্দাজ্ঞাপন করা যা আমাদেরকে সাম্যের দিকে ধাবিত করতে পারেনি।" - গ্রান্তা নিবন্ধে চৌধুরীর ভাষ্য। "প্রতিকল্প হিসেবে প্রর্দশনস্বরূপ তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, প্রাচীন রোমের সাথে সমান্তরাল পথে পা রাখছে ভারত।"
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং বিবিসি যৌথভাবে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীকে ৮ সপ্তাহের জন্য ইংল্যান্ড ভ্রমনের আয়োজন করে। তিনি বিবিসিতে বক্তৃতা পাঠ করতে সম্মত হন। ব্রিটিশ জীবনধারার উপর নীরদ চৌধুরী আটটি বক্তৃতামালা প্রদান করেন। পরবর্তীতে ঐ বক্তৃতাগুলোই একত্রিত করে প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড বইয়ে প্রকাশ করা হয়। ই.এম.ফরস্টার এ বিষয়ের সমালোচনা-ভাষ্য ও তার দৃষ্টিভংগী দ্য টাইমস্ লিটারেরী সাপ্লিমেন্টে প্রকাশ করেন।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত দ্য কন্টিনেন্ট অব সার্স গ্রন্থটি ১ম এবং একমাত্র ভারতীয় হিসেবে ডাফ কুপার প্রাইজ অর্জনে সহায়তা করে।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে মার্চেন্ট আইভরী প্রোডাকশনের ব্যানারে এডভেঞ্চার অব এ ব্রাউন ম্যান ইন সার্চ অব সিভিলাইজেশন শীর্ষক ডকুমেন্টারী ফিল্ম বা প্রামাণ্য চিত্রে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীকে উপজীব্য করে তৈরী করা হয়।
নীরদ চৌধুরী ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে দাই হ্যান্ড, গ্রেট আনার্ক শীর্ষক নিজের জীবনের শেষভাগ নিয়ে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। ১৯৯২ সালে তিনি ব্রিটেনের রাণী ২য় এলিজাবেথ কর্তৃক সম্মানিত হন এবং অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার উপাধীতে ভূষিত হন। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে নিজের শতবর্ষে সর্বশেষ বই হিসেবে থ্রী হর্সম্যান অব দ্য নিউ এপোক্যালিপস প্রকাশ করেন।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং লেখার ধরন সম্পাদনা
নীরদচন্দ্র চৌধুরী স্বাধীনতা-পূর্ব কংগ্রেস পার্টি প্রতিষ্ঠায় যতটুকু না সমালোচিত হয়েছিলেন, তারচেয়েও তার বেশি সহানুভূতি ছিল ডান-পন্থী ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলনে। তিনি অযোধ্যার বাবরী মসজিদ ধ্বংস সম্বন্ধে সমালোচনা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।[৩]
এছাড়াও তিনি গভীরভাবে বাংলার সমাজজীবনকে কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। বাঙালি সমাজজীবনে ভণ্ডামি, কপটতার পাশাপাশি সামাজিক স্তর ও শ্রেণিবিভাজন দেখে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী'র প্রবন্ধগুলোয় সংস্কৃত ভাষা এবং বাংলা ভাষার পুরনো সংস্করণ সাধুভাষার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তিনি কথ্য ভাষা হিসেবে চলতিভাষা যৎকিঞ্চিৎ ব্যবহার করেছেন।
আধুনিক বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত আরবি, উর্দু এবং ফার্সি ভাষা প্রয়োগ করা থেকে তিনি যথাসম্ভব নিজেকে বিরত রেখেছেন।
সম্মাননা ও পুরস্কার সম্পাদনা
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্য কন্টিনেন্ট অব সার্স (১৯৬৫) রচনার জন্য ডাফ কুপার মেমোরিয়াল পুরস্কার লাভ।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার প্রদত্ত সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার লাভের পূর্বে আনন্দ পুরস্কার পান।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট বা ডক্টর অব লিটারেচার ডিগ্রী অর্জন।[৪]
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক কমান্ডার অব দি অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (সিবিই) উপাধি লাভ।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ব-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ডিগ্রী হিসেবে দেশিকোত্তম - যার অর্থ "ধরিত্রীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ" পুরস্কার প্রদান করে।
রচিত পুস্তকাদি :
মূল নিবন্ধ: নীরদচন্দ্র চৌধুরীর গ্রন্থাবলি
তিনি ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায়ই লিখেছেন। ইংরেজিতে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১; বাংলায় ৫। এছাড়া বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। উপরোল্লিখিত গ্রন্থগুলো ছাড়াও তার কিছু অপ্রকাশিত, বিশেষ করে অগ্রন্থিত রচনা রয়ে গেছে। এগুলো ১৯৩০-৫০ কালপর্বে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও অদ্যাবধি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। তার গ্রন্থগুলোর প্রথম সংস্করণ বেশিরভাগ লন্ডন ও ভারত থেকে প্রকাশিত। কেবল ফয়জুল লতিফ চৌধুরী সংকলিত নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাংলা প্রবন্ধ গ্রন্থটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত।
দেহাবসান :
নীরদ সি. চৌধুরী মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একজন সৃষ্টিশীল এবং স্বাধীনচেতা লেখক হিসেবেই পরিগণিত ছিলেন। ৯৯ বছর বয়সে তার শেষ বই প্রকাশিত হয়। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তার স্ত্রী অমীয়া চৌধুরী অক্সফোর্ডে মারা যান। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডেই নিজের ১০২তম জন্মদিনের দু'মাস পূর্বে পরলোকগমন করেন ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ নীরদ চন্দ্র চৌধুরী।
---------------------//---------------
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
জন্ম: ২৩ নভেম্বর, ১৯৫০ সালে। অধুনা বাংলাদেশের পাবনায়। মেধাবী ছাত্র, সারা জীবনই স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা। অনার্স পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে গঙ্গামণি দেবী পদক এবং জাতীয় মেধাবৃত্তি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত নিয়ে এম-এ পাশ করার পর নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যাপনা নিয়ে কর্মজীবনের শুরু। ১৯৮১ থেকে কলকাতা গুরুদাস কলেজে। ১৯৮৭ সালে সংস্কৃত সাহিত্যে ডক্টরেট, বিষয়-কৃষ্ণ-সংক্রান্ত নাটক। দেশী-বিদেশী নানা পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে নানান গবেষনামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত। প্রিয় বিষয়-বৈষ্ণবদর্শন এবং সাহিত্য। রবিবাসরীয় আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকারও নিয়মিত লেখক। বাল্যকাল কেটেছে ধর্মীয় সংকীর্ণতার গন্ডিতে, পরবর্তী জীবনে সংস্কৃত সাহিত্যই উম্মোচিত করেছেন মুক্তচিন্তার পথ। ইনি রিসার্চ করেছেন শ্রদ্ধেয়া সুকুমারী ভট্টাচার্যের তত্বাবধানে।
তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন :
" আমি নিজে সম্পূর্ণ সাধু এবং সজ্জন ব্যক্তি নই বলেই এটা বুঝতে পারি যে, জীবন্ত এক চলমান সমাজ কখনো সম্পূর্ণ সাধু এবং সৎ হতে পারে না। ঠিক এই কারণেই নীতি-বস্তুটা আমার কাছে পাথরে লেখা কোনো কঠিন সীমাবদ্ধ ভাবনা নয়। মহাভারত যেহেতু প্রাচীনকালের এক চলমান সমাজের কথা বলে এবং সেখানে যখন এই কথাটা পেলাম যে, ধর্মও কখনো অধর্মের রূপ ধারণ করে, আবার অধমও কখনো ধর্মের রূপ ধারণ করে, কখনো আবার ধর্ম বস্তুটাকে ধর্মের মতোই দেখা যায়, কিন্তু এই যে বিচার, সেটা শেষ জায়গায় এসে বুদ্ধি দিয়েই করতে হয় - বিদ্বাংস স্তং সংপ্রপশ্যন্তি বুদ্ধ্যা। ফলত বুদ্ধি দিয়েই আমি বিচার করে বুঝেছি যে, মহাভারত যে ধর্মনীতির কথা বলে, সেখানে সকালে উঠে সন্ধ্যা-আহ্নিক না করলেই ‘প্রত্যবায়' বা দোষ হয় না, সেখানেও দেশ, কাল, পাত্র কিংবা সিচুয়েশনের বিচারটুকু জরুরী হয়ে পড়ে, অর্থাৎ কিনা সকালের সন্ধ্যা-আহ্নিকটা কেন করতে পারল না, সে বিচারটাও চাই।
নৈতিকতার ব্যাপারে শুধু এই সাধারণ স্মৃতি-শাস্ত্রীয় নিয়ম-কানুনই নয়, জীবনের আরো অনন্ত গভীর ব্যাপার আছে, অনন্ত ভাব-বিকার আছে ঘৃণা, জুগুপ্সা, প্রেম, ভালবাসা এবং যুদ্ধ - এখানে অনন্ত ঘটনা-পরম্পরা আছে, যার ওপরে নির্ভর করে সত্য, সততা এবং ধর্মের বিচার হবে। খুব ভাল একটা কথা বলেছিলেন বৈয়াকরণ পতঞ্জলি। বলেছিলেন - যে কোনো ক্রিয়াই কিন্তু একটা ক্রিয়ামাত্র নয়। যে কোনো ক্রিয়াই অনেকগুলি ক্রিয়ার সমষ্টি – পূর্বাপরীভূত : ব্যাপার কলাপঃ। অর্থাৎ কিনা ভাত রান্না করছি - এই রান্না করার মধ্যে চাল ধোয়া থেকে আরম্ভ করে হাঁড়িতে চাল চাপানো, চাল উল্টানো, তাকে সামাল দেওয়া, সিদ্ধ হয়ে গেলে হাঁড়ি নামানো, মাড় গালার পর হাঁড়ি সুস্থিত করে রাখা পর্যন্ত সমস্ত কাজগুলি নিয়ে তবে ভাত রান্না হয়। নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রগুলিও কিন্তু একই রকম। একটি বাচ্চা ছেলে যখন লোভের খাবার চুরি করে খায়, তখন তাকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করার আগে দশবার ভেবে দেখা উচিত তার বয়স এবং তার পূর্বতন ব্যবহার, তার সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক অবস্থা।
মহাভারতে অনীমান্ডব্যের কাছে স্বয়ং ধর্মকেও অভিশাপ লাভ করতে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছিল - একটি নির্দিষ্ট বয়সের আগে একটি বালককে কখনোই তার অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা যাবে না। অনুরূপভাবে দেবযানীর সঙ্গে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও সেই সম্পর্কের মধ্যে প্রায় জোর করে ঢুকে পড়েই শর্মিষ্ঠা যখন তার যৌবনের প্রাপ্য আদায় করে নেন তখন এমনই মহান উদারতায় তার বিচার করেছেন মহাভারতের কবি যে, বৈবাহিক শাস্ত্রীয়তার চেয়েও ভালবাসা এখানে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে- এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, কালিদাসের মৃত্যুঞ্জয়ী নাটক অভিজ্ঞানশকুন্তলে কথ-মুনি শকুন্তলাকে আশীর্বাদ করে বলেন- মহারাজ যযাতির কাছে শর্মিষ্ঠা যে গৌরব লাভ করেছিলেন, তুমিও তেমনই গৌরব লাভ করো দুষ্যন্তের কাছে।
আসলে এই গ্রন্থসূত্রে আমরা জানতে চাই যে, নীতি-নৈতিকতা এবং ধর্মের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের মতো উদার দেশ খুব কমই আছে। বিশেষত পরিস্থিতির প্রয়োজনে ‘পূর্বাপরীভূত ব্যাপারগুলির বিচার বিবেচনা করে নীতির কাঠিন্যের জায়গাটুকু পরিহার করাটা আপাতদৃষ্টিতে ধর্ম-বিগর্হিত মনে হতে পারে, কিন্তু সমাজ, ব্যক্তি এবং ব্যক্তিজীবনের বৃহত্তর প্রয়োজনে কাঠিন্যের আবরণভঙ্গটুকুও যে ধারণাত্মক ধর্মের প্রয়োজন, সেই প্রয়োজন থেকেই বকল্পিক ধর্মের সৃষ্টি হয়, সেখানেই ভারতবর্ষের জীবন-দেবতার আবাস।
* পাঠকগণ, এই লেখকের আরো একটি বইয়ের পিডিএফ সংগ্রহ করতে পারেন -
> মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ
আমি দুটি ঘটনার উল্লেখ করবো এখানে। আমার পিতাঠাকুর খুব কড়া ধাতের নৈতিক মানুষ ছিলেন। আমার অতিবাল্যে পৈতের সময় সারা দিন স্মার্ত ক্রিয়াকর্মের পর সন্ধে গড়িয়ে যেতেই রাত্রির ভাত খাওয়া বন্ধ হল। তেমন খাওয়া নাকি নিয়ম নয়। ভাগ্যবশত আমাদের কুলপুরোহিত মহামান্য পণ্ডিত ছিলেন এবং ছিলেন পরম উদার। তিনি শুধু এক বালকের উপনয়নের অর্থ না বোঝ বুভুক্ষা দেখেও কোনো তিরস্কার করলেন না। আমার পিতার নাম ধরে ডেকে তিনি বললেন – একটা বিকল্প আছে শোনো। আট রকমের পরিস্থিতি কোনো ব্ৰত নষ্ট করে না - অষ্টৈতদ্ অব্ৰতঘ্নানি। জল, মূলজাতীয় বস্তু শাকালু ইত্যাদি, ফল, দুধ এবং ঘি – এগুলোর উপবাসের অনুকল্প, এগুলো খাওয়ায় দোয হয় না। দোষ হয় না শরীর খারাপের জন্য ওষুধ খেলে, এমনকী ব্রতবিরোধী পথ্য খেলেও। এই ছয়ের সঙ্গে আর দুটি বিকল্পের উচ্চারণ ছিল চরম মানবিক। কোনো নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ যদি ইচ্ছে করেন, কিংবা আদেশ দেন গুরু, তাহলেও ব্রতের অন্যথা করা যায়, ব্রতভঙ্গও করা যায় - হবিব্রাহ্মণকাম্যা চ গুরোর্বচনম্ ঔষধম্। আমি সেদিন ব্রাহ্মণের কামনায়, কুলগুরুর আদেশে রাত্রিবেলায় সুন্দর রাত্রিভোজন করেছিলাম, সেটা যদিও হবিষ্যান্ন ছিল। কিন্তু তার স্বাদ এবং ব্রতভঙ্গের তথাকথিত অনৈতিক স্বাদ একত্রে বড়ো মধুর ছিল।
আর একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর চিতায় চিরশায়িত ছিলেন এক পিতা, পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তার নয় বছরের পুত্র, শশাকাহত, নিস্পন্দ। আত্মীয়-স্বজন শাস্ত্রীয় বিশুদ্ধতায় ওই ছেলেটির হাতে পাটকাঠি ধরিয়ে দিল প্রিয় পিতার মুখাগ্নি করার জন্য। সেই অবস্থায় শ্মশান-পুরোহিত, যিনি মৃত্যু দেখে-দেখে, মৃতদেহ দেখে-দেখে সাধারণত ভাবলেশহীন থাকেন তিনি বললেন - ওঁর নিকট-আত্মীয় কেউ মুখাগ্নি করুন, ছেলেটিকে এই বীভৎস কষ্টের মধ্যে রাখবেন না, ওকে বাড়ি নিয়ে যান কেউ। আমার ভারী ভাল লেগেছিল শ্মশান পুরোহিতের এই তথাকথিত অশাস্ত্রীয় অনুশাসন।
আমি শুধু বোঝাতে চাই, নীতির এই শাস্ত্রীয় অতিক্রম মানুষের জীবনের ক্ষেত্রেও এইরকম দেশ-কাল-পাত্র এবং পরিস্থিতি-নির্ভর। বস্তুত সেই সব অতিক্রমের মধ্যে যদি বৃহত্তরের শ্রেয়োসাধন ঘটে, যদি দলিত-বঞ্চিতের আত্মপ্রতিষ্ঠা ঘটে, ন্যায়-রূপী অন্যায়ের প্রতিবিধান ঘটে, তবে সেই অতিক্রমও কিন্তু মানুষের জীবন-নীতির প্রসন্নতা লাভ করে। অথচ সেই নীতি শাস্ত্রীয় শব্দপাঠের প্রমাণে প্রতিষ্ঠা করা যায় না; সেই নীতির প্রতিষ্ঠা হয় মহাকাব্যিক চেতনায়, মহত্তরের অনৃশংস বৃত্তিতে। এই গ্রন্থ সেই মহাভারতীয় নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিত-মাত্র।"
- নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
---------------------------//-------------
অনু নাটক সংখ্যা
=================================
১.
বিশ্বময়ী মা
সুবীর ঘোষ
মা রাখীদেবী-- তোরা আয় খেয়ে নে, দুধ যে ঠান্ডা হয়ে গেল।
তপুন--মা শহীদুরকে দেবে না তো। ও আমাকে জলদি আউট করে দিয়েছে।
মা--ও আবার কী কথা। তুমি বল সামলাতে পারনি তাই আউট হয়ে গেছ।
তপুন--না মা, ও আমাদের বাড়িতে খাবে না।
মা-- তাই হয় না কী? ওর মা বাড়ি নেই । আমার কাছে ওকে রেখে গেছে। ওকে খেতে দেব না?
( এরপর শহীদুর এসে বলে ) --মাসি ওকে তুমি খেতে দিয়ে দাও। আমি না-হয় পরে খাব। নইলে ও আমাকে মারবে।
মা--মারুক তো দেখি। আমি আছি না?
( ওরা খেয়ে বেরিয়ে গেলে রাখীদেবী বেরোলেন। রাস্তায় বীথির সঙ্গে দেখা। )
রাখী--কী রে বীথি যাচ্ছিস কোথায়?
বীথি--আমি যাচ্ছি নাপিতবউকে খবর দিতে। মা আজ আলতা পরবে। বৌদি তুমি কোথায় চললে?
রাখী-----বামুনপাড়ার তিনুদিকে আজ দুপুরে খেতে বলেছি । ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব ।
বীথি--চল না বৌদি মাঝের পাড়ার জগদ্ধাত্রী ঠাকুরটা দেখে যাই। শুনলাম না কী খুব ভালো হয়েছে।
( এরপর ওরা প্যাণ্ডেলে গিয়ে ঠাকুর দেখল। প্রণাম করার সময় রাখীদেবী মনে মনে বললেন ) --
মা মা গো, জগন্ময়ী মা। ঘরে ঘরে সব মা-ই যেন জগন্মাতা হয়ে ওঠে । আমিও যেন শুধু আমার সন্তানের নয়, সবার মা হয়ে উঠতে পারি।
-------------------//---------------
২.
মায়ের মমতা
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
(কুশীলব- রতন, রতনের মা সবিতা, বন্ধু রামচরণ)
'মা, তাড়াতাড়ি ভাত দাও গো ' - হাঁক পাড়ে রতন।
' চলে আয়! ' সবিতা আলুপোস্ত ভাত দেয়।
রোজকার মত ৮ টায় বেরিয়ে পড়ে রতন। কারখানায় হাড় ভাঙা খাটুনি। এই কাজটা জুটিয়ে দিয়েছে পঞ্চায়েত অরুণ বটব্যাল।
আজ কারখানায় বিকেলে হঠাৎ হইচই। মাইনে দেবার কথা থাকলেও মালিক আসেনি। কাজেই উত্তেজনা, বিক্ষোভ। শেষে লকআউট। সব শ্রমিকদের মাথায় হাত!
রতনের সাথে এক শিফ্টে আরো তিনজন কাজ করে প্রসেসিং ইউনিটে। তারমধ্যে রামচরণের সাথেই রতনের বেশি সখ্যতা। দু'জনে বসে ভাবতে থাকে।
' আমার তো রাতের খাবারই নেই ঘরে! তারমধ্যে মেসভাড়া বাকি '। রামচরণের গলায় চিন্তার সুর!
' সব ঠিক হয়ে যাবে ' রতন আশ্বস্ত করে।
শেষে অনেক ব'লে রাজি করে রামচরণকে বাড়ি নিয়ে আসে রতন।
' মা, ও আমার বন্ধু! ক'দিন এখানেই থাকবে।'
সবিতার চিন্তা বাড়লেও বুঝতে দেয় না।
' এসো বাবা, এসো । '
কোনক্রমে দিন চলছে- দু'দিন, তিনদিন, হপ্তা.....
কারখানা এখনো খুলছে না!
গতমাসে রতন বহু শখ করে মা'কে একটা রুপার হার দিয়েছিল। আসলে বাবার মৃত্যুশয্যায় চিকিৎসায় মায়ের সব বেচতে হয়েছিল।
সবিতা সেটা বিক্রি করে ৬০০ টাকা পেয়েছিল। তা দিয়েই কোনমতে তিনজনের খাবারটা এ ক'দিন চলছে!
সবিতা ভাবতে থাকে.....। একটা উপায় বের
করতেই হবে।
---------------------//--------------------
৩.
, সবার মা
গোবিন্দ মোদক
(কুশীলব: গোপাল ও ইন্দ্র। দুই বন্ধু)
গোপাল- কিরে ইন্দ্র, শুনলাম তোদের পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট নাকি একজন মহামেডান !
ইন্দ্র- হ্যাঁ, একদম ঠিক শুনেছিস। তো ?
গোপাল- বলিস কিরে ! মনসা পুজো ! দুর্গাপুজো ! কালীপুজো ! জগদ্ধাত্রী পুজো ! এতোগুলো দেবী মায়ের নিষ্ঠা-সহকারে পুজো ! অথচ তাতে থাকবে মুসলিমদের ছোঁয়া ! ছিঃ ! ছিঃ !
ইন্দ্র- আমাকে অবাক করলি তুই ! এ যুগের একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও তুই জাত-পাত-সংস্কার নিয়ে বসে আছিস ! ওরে, মা কালী, মা দুর্গা শুধু হিন্দুদের মা-ই নয়, সবার মা !
গোপাল- এই তোদের মতো অপগণ্ডদের জন্যই আজ আমাদের ধর্মের এই অবস্থা !
ইন্দ্র- তোর কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না ! কোন ধর্মে লেখা আছে যে একজন মানুষ দেবী-পূজায় অংশ নিতে পারবে না ?
গোপাল- রাখ তোর তত্ত্বকথা !
ইন্দ্র- তুই-ও তত্ত্ব না জেনে আমাকে তত্ত্বকথা বোঝাতে আসিস না ! শুনে রাখ -- তোদের বাড়ির তুলসি-মন্দিরটাও হয়তো একজন মুসলিম রাজমিস্ত্রি-ভাইয়ের হাতেই গড়া। এই যে এতো বড়ো বড়ো মন্দির, সেগুলো তৈরিতে কিন্তু কম মুসলিম বা খ্রিস্টান কর্মী কাজ করেনি ! তাছাড়া, এই যে ঠাকুর গড়ার জন্য মাটি আনা হয়েছে গঙ্গার পাড় থেকে, হতেই পারে তা হয়তো কেটে এনেছেন একজন মুসলিম ভাই ! তাহলে বুঝি সেই ঠাকুরটা অপবিত্র হয়ে যান !
গোপাল- তুই ব্যাটা নাস্তিক !! (চলে যেতে উদ্যত হয়)।
ইন্দ্র- আরে পালাচ্ছিস কোথায় ! একজন মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দেওয়ার সময় তুই কি দেখিস সেটা হিন্দুর রক্ত, না মুসলিমের রক্ত ! ওরে, শুনে রাখ --- আমাদের সবার রক্তই যেমন লাল, তেমন আমাদের মা-ও সবারই মা !!
--------------------//------------------
৪.
মা তুমি কার
কলমে - দেবাশিস চক্রবর্ত্তী ।
( চরিত্র - ভোলানাথ দত্ত, কেতকী )
ভোলানাথ :- মা - মাগো, জগৎ জননী ,মুখ রাখিস মা।
কোনোভাবে পার্টিটা যেন হড়কে না যায়। জয় মা -
কেতকী :- এই ভরসন্ধ্যাবেলা আবার চললে কোথা ?
ভোলানাথ :- প্রেম করতে ।
কেতকী :- আঃ - আদিখ্যেতা !
বুড়ো বয়সে ভীমরতি ! দেখলে গা জ্বলে যায় ।
ভোলানাথ :- জল ঢালো,
জ্বলুনি কমে যাবে ।
কেতকী :- কতার কি ছিরি !
ভোলানাথ :- কি ছিরি ?
কেতকী :- বিচ্ছিরি ।
ভোলানাথ :- তা তো হবেই। তিরিশ বছর কি একভাবে এ ছিরি থাকে ? প্রথম পনের থাকে এ ছিরি, পরের পনের বি ছিরি তারপর -
কেতকী :- থাক , ঢের হয়েছে । যে চুলোয় যাচ্ছো যাও । জিঞ্জেস করে আমার ঘাট হয়েছে ।
ভোলানাথ :- তোমার তো শুধু ঘাট হয়েছে , আমার পুরু জীবনটাই একটা পুকুর হয়ে গেছে ।
কেতকী :- কি বললে ? আজ জগদ্ধাত্রী পূজোর নবমীর দিনে তুমি আমাকে এতো বড়ো কতা বললে ? মা মাগো, তুমি দ্যাখো মা, এ কি মালের গলায় আমাকে ঝুলিয়ে দিয়েছো ।
ভোলানাথ :- মা কি তোর একার রে পাগলি ?
কেতকী :- কি বললে ?
ভোলানাথ :- জয় মা ।
কেতকী :- থাক, পাপ মুখে আর মায়ের নাম কোরোনা ।
ভোলানাথ :- কি - পাপ মুখ ! বেশ, নিচের তলায় ভাড়াটে আসছে , সেলামীর একলাখ টাকা হাতে পাই,তারপর আমি বিবাগী হবো ।
কেতকী :- কি বললে গো তুমি ! এক লাখ ? মা কি তবে এবার মুখ তুলে চাইলো ?
ভোলানাথ :- চাইলো । তবে তোমার দিকে নয়, আমার
পাপ মুখের দিকেই মা চাইলো ।
কেতকী:- উমঃ - আগে টাকাটা হাতে আসুক , তারপর তুমি মাকে জিজ্ঞেস কোরো
*মা তুমি কার* ?
ভোলানাথ :- এ্যাঁ - !
-----------------///----------------------------------------------
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ পরিবার :
শ্রী অঞ্জন কুমার দাস - সভাপতি
শ্রী বিভাস জানা ও বিনীতা জানা
যুগ্ম সম্পাদক।
ড. বিষ্ণুপদ জানা। পরিকল্পনা ও প্রকাশক।
শ্রীমতি নীলিমা জানা - কৃতজ্ঞতা স্বীকার।
বিশেষ সংখ্যার সম্পাদনা - ড. বিষ্ণুপদ জানা।
ঠিকানা ও যোগাযোগ -
কৃষ্ণনগর :খেজুরী :পূর্ব মেদিনীপুর.৭২১৪৩২
মোবাইল সহ হোয়াটসঅ্যাপ -
৯৬৭৯৪৫৯২৪৫/ ৯০৬৪৩৩৪৯৮৯
ই মেইল - janabishnupada99@gmail.com
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment