∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
=============∆∆∆================
Doinik Sabder Methopath
Vol -202. Dt -25.11.2020
৯ অগ্রহায়ণ,১৪২৭. বুধবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷✓✓✓÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।
এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?
যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
একাকী যাবো না অসময়ে।।
অথবা
অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’
আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ?’
১৯৪৮ সালে শক্তি কলকাতার বাগবাজারে আসেন এবং মহারাজা কাশিম বাজার পলিটেকনিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন।সেখানে তিনি বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক দ্বারা মার্কসবাদের পরিচিতি লাভ করেন।১৯৪৯ সালে তিনি প্রগতি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন এবং "প্রগতি" নামে একটি হাতে-লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন, যা খুব শীঘ্রই পরবর্তীতে মুদ্রিত রূপ নেয় এবং পুনরায় নাম বদনিয়ে "বহ্নিশিখা" রাখা হয়।
১৯৫১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সিটি কলেজে ভর্তি হন তার এক মামার কাছে, যিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং তার তখনকার অভিভাবক, যিনি শক্তির হিসাবরক্ষকের চাকরি পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। একই বছর তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) সদস্য হন। ১৯৫৩ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক বাণিজ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, যদিও তিনি বাণিজ্য অধ্যয়ন ছেড়ে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক অধ্যয়নের জন্যে প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা) ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষায় উপস্থিত হননি।
১৯৫৬ সালে, শক্তিকে তার মামার বাড়ি ছেড়ে আসতে হয়েছিল এবং তিনি তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে আল্টাডাঙ্গায় একটি বস্তিতে চলে যান। সে সময়ে তিনি সম্পূর্ণরূপে তার ভাইয়ের স্বল্প আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। দারিদ্রের কারণে শক্তি স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ত্যাগ করেন এবং সাহিত্যকে জীবিকা করার উদ্দেশ্যে উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন।
কর্মজীবন
শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও কোনো পেশায় দীর্ঘস্থায়ী ছিলেন না। একসময় তিনি দোকানের সহকারী হিসেবে সাক্সবি ফার্মা লিমিটেডে কাজ করেছেনন এবং পরে ভবানীপুর টিউটোরিয়াল হোমে (হ্যারিসন রোড শাখায়) শিক্ষকতা করেন। ব্যবসা করার চেষ্টাও করেছিলেন। এবং ব্যর্থ হওয়ার পর একটি মোটর কোম্পানিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়কে বিয়ে করেছিলেন, যিনি একজন ভারতীয় লেখক। ১৯৬৫ সালে আড্ডার মধ্য দিয়ে তাদের প্রথম সাক্ষাত ঘটে।তাদের মেয়ে তিতি চট্টোপাধ্যায়।
সাহিত্যকর্ম
প্রারম্ভিক রচনা (১৯৫০-এর দশক-) সম্পাদনা
মার্চ ১৯৫৬ সালে, শক্তির কবিতা "যম" বুদ্ধদেব বসু প্রকাশিত কবিতা সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি কৃত্তিবাস এবং অন্যান্য পত্রিকার জন্য লিখতে শুরু করেন। বুদ্ধদেব বসুও তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য কোর্সে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। শক্তি কোর্সে যোগদান করলেও সম্পূর্ণ করেন নি। ১৯৫৮ সালে শক্তি সিপিআইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক বন্ধ করে দেন।
প্রথম উপন্যাস লেখেন কুয়োতলা। কিন্তু কলেজ - জীবনের বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে তার বনাঞ্চল - কুটির চাইবাসায় আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একজন সফল লিরিকাল কবিতে পরিণত হন। একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলার অভ্যাস গড়ে ফেলেন তিনি। শক্তি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। ভারবি প্রকাশনায় কাজ করার সূত্রে তার শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজ বের হয়। পঞ্চাশের দশকে কবিদের মুখপত্র কৃত্তিবাস পত্রিকার অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার উপন্যাস অবনী বাড়ি আছো? দাঁড়াবার জায়গা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। রূপচাঁদ পক্ষী ছদ্মনামে অনেক ফিচার লিখেছেন।
১৯৬০-এর দশক
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম, হে নৈশব্দ' ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় দেবকুমার বসুর চেষ্টায়।
হাংরি আন্দোলন
মূল নিবন্ধ: হাংরি আন্দোলন
১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলন - এর জনক মনে করা হয় তাদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম । অন্য তিনজন হলেন সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় এবং মলয় রায়চৌধুরী। শেষোক্ত তিনজনের সঙ্গে সাহিত্যিক মতান্তরের জন্য ১৯৬৩ সালে তিনি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যোগ দেন । তিনি প্রায় ৫০টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে কৃত্তিবাসের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম সাহিত্যিক মহলে একত্রে উচ্চারিত হতো, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলন এর ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং কৃত্তিবাস পত্রিকায় ১৯৬৬ সালে সেই মনোভাব প্রকাশ করে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন।
উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পাদনা
"অবনী বাড়ি আছো" - কবিতা, কাব্যগ্রন্থ:
ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৫)
পুরস্কার
১৯৭৫ তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন।১৯৮৩ সালে, তার যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো (১৯৮২) কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি একাধিক পুরস্কারে পেয়েছেন।
মৃত্যু: মার্চ ২৩, ১৯৯৫।
কবির চোখে কবি -
লেখক শক্তির এক কবিতা লেখার দুপুরে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার বাইরের কোনো এক মফস্বল শহরে। এ বিষয়ে লেখকের বর্ণনা, 'একদিন এক দুপুরে চারপাঁচটি কবিতা লিখল শক্তি। তার মধ্যে একটি হল 'অবনী, বাড়ি আছো?' আর একটি 'আমি স্বেচ্ছাচারী'। ঘরের মধ্যে আমি আর শক্তি, বাইরে দাউদাউ করা দ্বিপ্রহর। মনে আছে লেখা শেষ করে এক হাতে গেলাসে মহুয়া, চিত্রাপাথর থেকে ভোরবেলা সংগ্রহ করে আনা, আর হাতে সদ্যরচিত পাণ্ডুলিপি, উন্মত্ত দরবেশের মতোই শক্তি পদদাপ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে—ঈষৎ স্খলিত কণ্ঠে সেই টাটকা কবিতা পড়তে পড়তে।' শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিকে ওই 'উন্মত্ত দরবেশে'র ভূমিকায় সদ্যরচিত কবিতাপাঠরত অবস্থায় দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য লেখকের ঘটেছিল তা জীবন জুড়ে উদ্যাপিত হওয়ার মতোই। আর, ভাবা যায়, ভোরবেলার প্রথম কাজ ছিল বাস্তবের দৈনন্দিনের অমৃত সংগ্রহ করা!
শক্তিসান্নিধ্যে লেখকের রামকিঙ্করের আস্তানায় রাত্রিযাপনের রোমহর্ষক বর্ণনাটি কোনো পাঠকই কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। (লেখাটির ভাস্বতী ঘোষ-কৃত ইংরেজি অনুবাদ 'পরবাস'-এ পাওয়া যাবে—সম্পাদক।) প্রচুর দেশি অমৃত তথা গরল পানের পর বেঁহুশ অবস্থা থেকে শেষরাত্রে সহসা চোখ মেলে লেখক দেখেছিলেন নগ্ন রামকিঙ্কর তাঁর এক অর্ধসমাপ্ত ভাস্কর্যের দিকে লণ্ঠনের আলোতে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছেন। লেখকের ভাষায়, 'ডান হাতের মুঠোয় ভাতের গ্রাসের আকারের একটা মাটির তাল। টুলে বসে, স্তব্ধ হয়ে কাজটির দিকে তাকিয়ে আছেন রামকিঙ্কর, স্থির। লক্ষ লক্ষ মশা ছেঁকে ধরেছে, তিনি টের পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তাঁর চোখে একটা অদ্ভুত ভাবলেশহীন দৃষ্টি, রামকৃষ্ণদেব যাকে বলেছিলেন যোগীর দৃষ্টি।' ঘুরতে ঘুরতে নবীনদাস বাউলের আখড়াতে গিয়ে পড়তেন শক্তি, কখনো কেঁদুলির পথে, কখনো অকারণেও। বোঝা যায়, এইসব সহজিয়া সাধক-স্রষ্টাদের মধ্যে শক্তি তাঁর স্বাভাবিক স্থান খুঁজে পেতেন তাঁর অধীত নাগরিক প্রজ্ঞা ও পঠনপাঠন সত্ত্বেও। গীতা মেঘদূত কুমারসম্ভব বা রিল্কের অনুবাদক বাউলমেলায় শুয়ে রাত কাটাচ্ছেন, এমনটা হওয়াতেই যেন জীবনের এক সামগ্রিকতায় পৌঁছনো! শক্তি পেরেছিলেন এই সামগ্রিকতার পথে এগিয়ে যেতে বহু দূর, যে-যাত্রার মূল্য হয়তো অকালমৃত্যু। বিরাট জীবনীশক্তি ছিল বলেই শক্তি হয়তো তাঁর অকালমৃত্যু অনেকটা পেছিয়ে দিতে পেরেছিলেন—১৯৩৩-এর জাতক হয়ে ১৯৯৫ পর্যন্ত—৬২ বছর ৪ মাস বয়স পর্যন্ত। তাঁর ছিল এক অতিজীবিতের বাঁচা, যে বাঁচায় কোনো সাবধানতার বা সংযমের স্থান নেই।
কালীকৃষ্ণ গুহ।
"মনে মনে বহুদূর চলে গেছি – যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু – প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোড়েন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে"।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment