"ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল– আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় এবং সেইটেই তার সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য"। ( সত্যজিৎ রায় )

ঋত্বিক কতটা তীব্রভাবে বাঙালি ছিলেন, ঋত্বিক কতখানি নিবিড়ভাবে বাংলার মানুষের ছিলেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সত্যজিৎ রায়ের এই অকপট সাক্ষ্য।

বহু প্রেম আর বহু জন্মের নির্বাক সাক্ষী পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনে জন্ম হয় যমজ ভাই-বোন, ঋত্বিক-প্রতীতির। তাঁদের ডাকনাম ছিল ভবা আর ভবী। ঋত্বিকের পুরো নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক।

তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) রাজশাহী শহরের মিয়াঁপাড়ায় । তার মায়ের নাম ইন্দুবালা দেবী এবং বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক। তিনি বাবা-মায়ের ১১তম এবং কনিষ্ঠতম সন্তান। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে পূর্ববঙ্গের প্রচুর লোক কলকাতায় আশ্রয় নেয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়। শরণার্থীদের অস্তিত্বের সংকট তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে এবং পরবর্তী জীবনে তার চলচ্চিত্রে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯৪৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম.এ কোর্স শেষ করেও পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি।

তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং তিনি কবিতা ও নাটক লিখতেন। তার বড় ভাই ঐ সময়ের খ্যাতিমান এবং ব্যতিক্রমী লেখক মনীশ ঘটক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী। আইপিটিএ থিয়েটার মুভমেন্ট এবং তেভাগা আন্দোলনে মনীশ ঘটক জড়িত ছিলেন। মনীশ ঘটকের মেয়ে বিখ্যাত লেখিকা ও সমাজকর্মী মহাশ্বেতা দেবী। ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ঘটক ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা।

ছোটবেলা থেকেই ঋত্বিক অন্য ধাঁচের মানুষ ছিলেন। আর দশজন লোকের মতো তো ছিলেনই না, আর দশজন বিখ্যাত লোকের মতোও তিনি ছিলেন না। ছেলেবেলা থেকে আমৃত্যু জীবনকে তিনি নিজের মতো করে গড়েছেন, ভেঙেছেন, তারপর আবার নতুন করে গড়েছেন। ঋত্বিক রাজনীতি করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। গণনাট্যের কর্মী ছিলেন। নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। ঋত্বিক সাহিত্যিক ছিলেন– গল্প লিখেছেন, ছাত্রাবস্থায় ‘অভিধারা’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে ভাইস-প্রিন্সিপালও হন। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সিনেমাওয়ালা, বাংলা এবং বাঙালির সিনেমাওয়ালা।

১৯৪৮ সালে। কলকাতার হাজরা রোডের উপর আট বাই বারো ফিটের মতো একটা চায়ের দোকান – নাম প্যারাডাইস ক্যাফে। প্যারাডাইসের নোংরা চেয়ার-টেবিলে বসে আড্ডা দিতেন একদল তরুণ। এঁদের কয়েকজনের নাম মৃণাল সেন, তাপস সেন, সলীল চৌধুরী আর ঋত্বিক ঘটক। কখনো কখনো আসতেন বিজন ভট্টাচার্য। এইখানেই আড্ডা হতো, তর্ক হতো। মধ্যমণি ঋত্বিক। ঋত্বিকের রাজনীতি আর সিনেমার সূতিকাগার নোংরা চেয়ার-টেবিলে ঠাসা প্যারাডাইস ক্যাফে। এই তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া ছিলেন ঋত্বিক।

চলচ্চিত্রে আসার কথা ছিল না। তাঁর স্বপ্নের সমস্তটা জুড়ে ছিল নাটক। ঋত্বিক সিনেমাতে এসেছেন, কারণ সিনেমা একসাথে বহু মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। মেজদা সুধীশ ছিলেন সিনেমার লোক। দাদার বহু সিনেমার সাথে সরাসরিভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। দাদা সুধীশ ঘটকের সূত্রেই সিনেমার বহু লোকের সঙ্গে পরিচিতও হলেন। নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ সিনেমার কাজ করতে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় সত্যজিৎ রায়ের সাথে। বেশ কিছু সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পর অবশেষে নিজের সিনেমার ঝুলি খুললেন ঋত্বিক ঘটক।

https://assets.roar.media/assets/TP7zBfP9WrZWUFOL_ritwik_ghatak.jpg
চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটক; Image Source: ঋত্বিক চলচ্চিত্র কথা

‘নাগরিক’ তাঁর প্রথম সিনেমা হলেও প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নয়। ‘নাগরিক’ বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের টানাপোড়নের গল্প। যে গল্প, যে জীবনবোধ, যে তিক্ততা ঋত্বিক দেখেছেন, কোনো ভণিতা না করেই তা বলে গেছেন নাগরিকে। পুরো সিনেমার কাজ শেষ করেও পরে অর্থাভাবে সিনেমাটি আর মুক্তি পায় না (১৯৫২ সালে)। সাতাশ বছরের ঋত্বিকের প্রথম সিনেমা ‘নাগরিক’ মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পরে, ১৯৭৭ সালে।

১৯৫৫ সালে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা নিয়ে ডকুমেন্টারি ছবি করলেন ‘ওঁরাও’।

১৯৫৮ সালে প্রথম সিনেমা ‘অযান্ত্রিক’ মুক্তি পায়। এর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন ঋত্বিক। কেবল ছয় থেকে সাতবার স্ক্রিপ্টই বদলেছেন। তাঁর এত এত পরিশ্রম বৃথা যায়নি। বাংলা সিনেমার জগতে এটি এখনো এক অনবদ্য সিনেমা।

https://assets.roar.media/assets/TP7zBfP9WrZWUFOL_ritwik_ghatak.jpg
অযান্ত্রিক;

 ‘অযান্ত্রিক’ এক অন্যরকম গল্পের নাম। মানুষ এবং যন্ত্রের ভালোবাসার গল্প এটি। বিমল এবং তার ট্যাক্সি ‘জগদ্দল’ সিনেমার নায়ক-নায়িকা। বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি বললেন এক পরাবাস্তব গল্প। ঋত্বিক বাঙালিকে এক নতুন ঘরানার সিনেমা উপহার দিলেন। নাগরিকের ব্যর্থতার পর মুষড়ে যাওয়া ঋত্বিককে খ্যাতি এনে দিল অযান্ত্রিক। অযান্ত্রিকের বিষয়বস্তু নির্ধারণে তিনি দেখিয়েছেন অতুলনীয় সাহস। জগদ্দলকে অনুভূতিপ্রবণ এক সত্তা হিসেবে কল্পনা করে, তার মধ্যে মানুষিক প্রতিক্রিয়া আরোপ করে সে যুগের দর্শকের কাছে উপস্থাপনের সাহস দেখিয়েছেন ঋত্বিক।

১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। বাড়ি থেকে পালানো এক ছেলের চোখে শহরকে দেখার গল্প। নাকি ঋত্বিকের গল্পই এটি? তিনি নিজেও তো কয়েকবার পালিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। সে যাই হোক, এটি তাঁর গল্প না হলেও নিজের বাড়ি থেকে পালানোর অভিজ্ঞতার যথার্থ ব্যবহার করেছেন এই সিনেমায়।

এরপর একে একে মুক্তি পায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এগুলোর প্রথম তিনটি সিনেমাকে ত্রয়ী বলা হয়। দেশভাগের ফলে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে যে শরণার্থী সমস্যা তৈরি হয় তাই-ই ছিল ত্রয়ীর মূল বিষয়বস্তু। ঋত্বিক দেখিয়েছেন দেশভাগ কি করে কোটি কোটি পরিবারকে উদ্বাস্তু করেছে।

ঋত্বিকের সবগুলো সিনেমার চেয়ে শেষের দুটি একেবারে আলাদা। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের উপর নির্মিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমাটি এক মালোপাড়ার জীবনপ্রবাহের প্রতিচ্ছবি। এ গল্প কেবল একটি মালোপাড়ার নয়, এ গল্প তিতাস নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা শত শত মালোপাড়ার গল্প।  ছেলেবেলায় ব্রহ্মপুত্র দেখেছেন ঋত্বিক, বাবার চাকরি তখন ময়মনসিংহে। আরো বড় হয়ে চষে বেড়িয়েছেন পদ্মার পাড় । নদীর পাড়ের জীবন তিনি দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। সেজন্যই বোধহয় এত স্পষ্ট প্রতিবিম্বে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন নদীপাড়ের গল্প। আবার তিতাসপাড়ের অনন্তের মতো তাঁকেও চলে যেতে হয়েছে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে; সবকিছু ছেড়ে দূরে, বহুদূরে । এ সিনেমার শুটিং হয় বাংলাদেশে।

https://assets.roar.media/assets/TP7zBfP9WrZWUFOL_ritwik_ghatak.jpg
তিতাস একটি নদীর নাম; 

‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ অনন্য সিনেমা। সোজা কথায় ঋত্বিক ঘটকের ‘সেলফ পোর্ট্রেট’ এই সিনেমা। মূল চরিত্র নীলকণ্ঠ, কমিউনিজমে বিশ্বাসী-পাঁড় মাতাল-বুদ্ধিজীবি, এ ঋত্বিক ছাড়া আর কেউ নয়। এই সিনেমা নির্মাণের সময় ব্যক্তিজীবনে প্রচণ্ড অসুখী ছিলেন ঋত্বিক । একদিকে মদ্যপান যেমন অত্যধিক হারে বেড়ে গেছিলো, তেমনি অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতাও জেঁকে বসেছিলো দেহে। দেহের উপর ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলেন তিনি। তবু এই সিনেমায় কি ভীষণ নৈপুণ্যে নিজেকে বিশ্লেষণ করলেন, ধরে ধরে নিজেকে নিয়ে নির্মোহ আলাপ করলেন। নিজের ছায়ায় এক বুদ্ধিজীবির হারিয়ে যাওয়ার গল্প শোনালেন আমাদের। আরো বললেন , “ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।”

https://assets.roar.media/assets/TP7zBfP9WrZWUFOL_ritwik_ghatak.jpg
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো; 

ঋত্বিক সিনেমায় তাঁর বলতে না পারা কথা বলেছেন, তাঁর প্রতিবাদ, তাঁর চিন্তা কিংবা তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছেন। ঋত্বিক গল্প ছেড়ে নাটক করেছিলেন লোকে গল্প পড়ার চেয়ে নাটকটা বেশি দেখে বলে,  আর নাটক ছেড়ে সিনেমায় এসেছিলেন আরো অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য। তিনি এও বলেছিলেন যে আরো বেশি অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছানোর অন্য কোন মাধ্যম যদি তিনি পেতেন তবে তিনি সিনেমাকে লাথি মেরে সে মাধ্যমটাকেই বেছে নিতেন। সিনেমাকে ভালোবেসে তিনি আসেননি, নিজের সৃষ্টিকে বাঁধতে চেয়েছেন স্থায়ী শিল্পদৃশ্যে। ঋত্বিক যা বলেছেন, তাই-ই করেছেন। তাঁর ভাবনাগুলো নিয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন অগণিত মানুষের কাছে। নাটক আর সিনেমা দুই ক্ষেত্রেই অভিনয় করেছেন ঋত্বিক। যুক্তি তক্কো আর গপ্পোতে তো কেন্দ্রীয় নীলকণ্ঠতে অভিনয় করেছেন। তিতাস একটি নদীর নামেও অভিনয় করেছেন।

https://assets.roar.media/assets/TP7zBfP9WrZWUFOL_ritwik_ghatak.jpg
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো সিনেমার একটি দৃশ্যে ঋত্বিক; 

ঋত্বিক ঘটক বাম ঘরানার রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর সিনেমাতে সে আদর্শের ছাপ স্পষ্ট। মানুষের জীবনের অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যতার চরম রূপ বার বার ধরা দিয়েছে তাঁর ক্যামেরায় । এত বিস্তৃতভাবে নীচুতলার মানুষের গল্প বাঙলা সেলুলয়েডের ফিতায় আজ অব্দি আর কেউ বলেননি। ‘তিতাস একটি নদীর নামে’ ক্ষুধার জ্বালায় চুরি করতে দেখা যায়, নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েও অভাবের তাড়নায় শেষে অনন্তকে তাড়িয়ে দেয় বাসন্তী । অযান্ত্রিকের ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে শুরু হয়ে যুক্তি তক্কো গপ্পোতে এসে অভাবের কষাঘাতে বিপর্যস্ত বুদ্ধিজীবিকে দেখতে পাই আমরা। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’তে গ্রামের ছেলে কাঞ্চন কলকাতায় এসে দেখে উঁচু-উঁচু বাড়ি আর তার ঠিক পাশেই নোংরা বস্তি। এ শহরের অর্থনৈতিক বৈষম্য এভাবেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন ঋত্বিক। সুবর্ণরেখার সীতা তার শিশুসন্তানকে বাঁচাতে বেছে নেয় অন্ধকার জগতকে।

দেশভাগের দুঃখ আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ঋত্বিককে। তাই ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ তাঁর রাজশাহীর পদ্মাপাড়ের স্মৃতিকাতরতা, তাই ‘সুবর্ণরেখা’ তাঁর আজন্ম লালিত বেদনার নাম। বাংলাদেশ থেকে, জন্মস্থান থেকে নির্বাসিত হওয়ার হাহাকার ঋত্বিকের মতো করে আর কেউ প্রকাশ করেননি। বড়ো ভালবাসতেন বাংলাদেশকে তিনি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে ভুল করেননি ঋত্বিক। মুক্তিযুদ্ধের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নির্মাণ করেন ‘দুর্বার গতি পদ্মা’।

খ্যাতির মাপকাঠিতে ঋত্বিককে যদি ‘সিনেমার জীবনানন্দ’ বলা হয় তবে অত্যুক্তি হবে না। আজ ঋত্বিকের যে খ্যাতি তাঁর জীবদ্দশায় এর প্রায় কিছুই ছিল না। ঋত্বিক বাঙালিকে সিনেমায় নতুন স্বাদ এনে দিয়েছিলেন যা এর আগে বাঙালি কখনো পায়নি। সিনেমায় নতুন ভাষা এনেছেন, নতুন ধরণ এনেছেন। অথচ মৃত্যুর আগ অব্দি প্রাপ্য সম্মান বা ভালোবাসা কিছুই পান নি। অভাবের সাথেও লড়েছেন। ‘সেই ঋত্বিক’ বইয়ে ঋত্বিককে নিয়ে লিখতে গিয়ে বোন প্রতীতি দেবী লিখেছেন, “শুনেছি পরবর্তী জীবনে (ঋত্বিককে) খেতে দেয়া হত না বা পেত না – আমার মা-বাবার সৌভাগ্য, সে দৃশ্য দেখতে হয়নি।”  তবু এই সবকিছু একপাশে সরিয়ে রেখে একজন খাঁটি শিল্পীর মতোই নিবিষ্ট মনে নির্মাণ করে গেছেন একের পর এক সিনেমা।

ঋত্বিকের সিনেমার বিষয়বস্তুর প্রধান দিক সমকালীন সংকট। মানুষের অবক্ষয় ঋত্বিককে আকর্ষণ করতো – ঋত্বিক নিজেই সেটা বলেছেন। প্রথম সিনেমার নাগরিকেই তার প্রমাণ মেলে। মানুষের অবক্ষয়ে আয়না ফেলে তিনি দেখতেন জীবনকে-গতিকে-স্বাস্থ্যকে। ঋত্বিক মানুষের অবক্ষয়কে দেখতেন, কিন্তু বিশ্বাস করতেন জীবনের প্রবহমানতায়। তাঁর চরিত্ররা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও জীবনের জয়গান গায়, জীবনের প্রতি বিশ্বাস রাখে। অযান্ত্রিক সিনেমায় তাই জগদ্দলকে বিক্রি করে দেয় বিমল, পুরোনো জঞ্জালকে দূর করে দেয়। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা বলে ওঠে, “আমি বাঁচবো দাদা।”

ঋত্বিক বাঙালির চিত্রপরিচালক ছিলেন। তাঁর ক্যামেরায় উঠে এসেছে বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বাঙালির ধর্মবিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, সর্বোপরি বাঙালির জীবনবোধ। শুধু বাঙালিরই নয়, আদিবাসীদের যাপিত জীবনের চিত্রও ফুটে উঠেছে তাঁর সিনেমায়। কেন সত্যজিৎ রায় ঋত্বিকের ‘বাঙালি’ পরিচয়কে সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ দিক’ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁর ব্যাখ্যা পাওয়া আরেক চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের জবানিতে, যা উল্লেখ না করলেই নয়। জাপানি পরিচালক কুরোসাওয়া এবং ওজুর উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন –

কুরোসাওয়া জাপানি, আবার আন্তর্জাতিকও। কিন্তু ওজু একান্তই জাপানি। ওজুকে সঠিকভাবে বুঝতে জাপানি শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। ঋত্বিক ঘটকও যেন তেমনই আমাদের একান্তই বাঙালি এক শিল্পী যাঁর বিষয়বস্তু, গল্প বলার ধরন, বাংলা ভাষার নাটকীয় প্রকাশভঙ্গি অনুযায়ী নাটকীয় সংলাপ, বাংলা মঞ্চ-নাটকের ধারায় উচ্চকিত অভিনয়রীতি... ঋত্বিকের ছবির ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সের শটগুলো স্মরণ করুন, এ সবই এক বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালকের একান্ত নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষার প্রকাশ। তাই ঋত্বিকের শিল্পউৎসকে খুঁজতে হবে পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষায় নয়, সেটা খুঁজতে হবে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও শিল্পমাধ্যমগুলির মাঝে।” [ ৩ ]

এইভাবে ঋত্বিক বাঙালির শিল্পী হয়ে উঠলেন। ঋত্বিকের সিনেমায় পৌরাণিকতা এসেছে বারবার। তবে সেটা বিশ্বাসের চোখ দিয়ে নয়, শিল্পীর চোখ দিয়ে।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ঋত্বিক কাউকেই কাছে পাননি, মৃত্যুর সময় স্ত্রী সুরমাও ছিলেন বহু দূরে। বিশৃঙ্খল আর বেপরোয়া জীবন আস্তে আস্তে তাঁকে শেষ করে দিচ্ছিলো। ঋত্বিকের শেষ সময়গুলোর সাক্ষী ছিলেন আরেক চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। তাঁর ভাষায়, “ শেষ ক-টা বছর ঋত্বিকের বেঁচে থাকাটাই একটা বিরাট অঘটন।” অসুখে ধুঁকে ধুঁকে উনিশশো ছিয়াত্তরের ছয় ফেব্রুয়ারি রাত এগারোটা  পাঁচ মিনিটে মারা যান আজন্ম ভবঘুরে ভবা। মৃণাল সেন সুরমা ঘটককে খবর পাঠালেন, ‘Ritwik Ghatak expired’।

কিন্তু... এক্সপায়ার্ড ঋত্বিক ঘটক তাঁর সৃষ্টির অমরত্বের সুযোগে এখনও বাঙালিকে ভাবার প্র্যাকটিস করাচ্ছেন। ক্রমাগত বলেই চলেছেন, “ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।”

This article is about Ritwik Ghatak. Ritwik Ghatak was a dramatist, professor, writer, actor and most importantly filmmaker & script writer.

সম্মাননা :

১৯৭০: ভারত সরকার তাকে শিল্পকলায় পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন।[৫]

১৯৫৭: মুসাফির চলচ্চিত্রের জন্য ভারতের ৫ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তৃতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য মেধার ছাড়পত্র লাভ করেন।[৯]

১৯৫৯: মধুমতী চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে ৬ষ্ঠ ফিল্মফেয়ার পুরস্কার-এ মনোনয়ন লাভ করেন।[১০]

১৯৭০: হীরের প্রজাপতি চলচ্চিত্রের জন্য ১৬তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ চলচ্চিত্র পুরস্কার (প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক) লাভ করেন।[১১]

১৯৭৪: যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৭৪: তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রের জন্য সেরা পরিচালক বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন।



∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆