জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
=============//////////==============
Doinik sabder methopath
Vol -184. Dt -06.11.2020
২০ কার্তিক,১৪২৭. শুক্রবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷//////////÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ৬ নভেম্বর,১৯৩৪ বাংলাদেশের ঢাকা জেলার আড়াই হাজার থানার রাইনাদি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম অভিমন্যু বন্দ্যোপাধ্যায় আর মাতার নাম লাবণ্যপ্রভা দেবী।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালে অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায়। প্রথম যৌবন থেকেই পেশার তাগিদে তিনি পৃথিবী ভ্রমণ করেছে, সেই অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর চারটি বিখ্যাত উপন্যাস, নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে, মানুষের ঘরবাড়ি, অলৌকিক জলযান ও ঈশ্বরের বাগান-এ।
নীলকন্ঠ পাখির খোঁজের ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার ভাষা পায় তাঁর লেখনীর হাত ধরে। জীবন প্রবাহে আলো আঁধারে অনন্ত মানুষের মুখ তাঁর ভাষায় বাঙ্ময়। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে বাংলা সাহিত্য বার বার ঘুরে ফিরে আসে মানুষের বাঁচার আর্তি।।
"মাথার উপরে অজস্র তারের ঠাসবুনট জাল ফুঁড়ে অঘ্রানের একখানি ফ্যালফ্যালে হলুদ চাঁদ। ঈষৎ ময়লা ধুতি, হালকা পাঞ্জাবি, আকাশের দিকে আঙুল তুলে অঘ্রানের চাঁদ দেখাচ্ছেন— ‘‘তোমার কিছু মনে হচ্ছে, কোনও পুরনো কিছু!’’
থমথম করে সেই গলা।
"সরু রাস্তাটা তস্য সরু হয়ে গিয়েছে দোকানের দাপটে। দু’দণ্ড থমকে গেলে পিছন থেকে অজস্র রিকশা-অটোর নির্দয় ধমক। কলকাতার পূর্ব শহরতলী, কেষ্টপুরের সেই ঢালু রাস্তাটায় খানিক গড়িয়ে গিয়েই সে দিন থমকে পড়েছিলেন তিনি— ‘‘চাঁদটা দেখেছ!’’
মাথার উপরে অজস্র তারের ঠাসবুনট জাল ফুঁড়ে অঘ্রানের একখানি ফ্যালফ্যালে হলুদ চাঁদ। ঈষৎ ময়লা ধুতি, হালকা পাঞ্জাবি, আকাশের দিকে আঙুল তুলে অঘ্রানের চাঁদ দেখাচ্ছেন— ‘‘তোমার কিছু মনে হচ্ছে, কোনও পুরনো কিছু!’’ থমথম করে সেই গলা।
শেষ বাসে বাড়ি ফিরছি, সে রাতে মনে হয়েছিল, একটা অলৌকিক জলযান বুঝি আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে সবুজ খেতের কচ্ছপ-চড়া ধানি মাঠের মাঝ বরাবর। অফুরন্ত এক বানভাসি সমুদ্রে ভেসে চলা সেই রাত, পায়ের তলায় টলমল করা জলের তরঙ্গ, ভিজে উঠেছে শরীর...পুরনো কিছু মনে পড়ছে না তোমার...মনে মনে নিজেকে বলি গ্যাৎচোরেৎশালা!
অন্তরীক্ষের যে আঁধারে হাজারো নীলকণ্ঠ উড়িয়ে, হাততালিতে অন্ধকার ভেঙে দিয়েছিলেন সোনার জেঠামশাই, যে পাখিরা ফিরব ফিরব করেও, কোনও দিন আর ফিরে আসেনি, তারা বুঝি চলে গিয়েও আকাশের নির্জনতায় রয়ে গিয়েছে আজও। কেষ্টপুরের সেই ক্ষীণ গলির বাড়ি ছেড়ে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের শায়িত দেহটা টলমল করে ফিরে যাওয়ার সময়েও সে দিন মনে হল, কোনও এক অলৌকিক জলযান তাঁকে ঈশ্বরের বাগানে নিয়ে চললেন।
প্রথম আলাপটা অবশ্য কিঞ্চিৎ তপ্ত। ভোটের সময়, ইভিএম নয়। তখনও ব্যালট গুনে ভোট। মুহুর্মুহু গুলির মতো ফল আসছে। ফোনটা এল তখনই।
—‘ফল কী দাড়াল ভাই?’
আমার গলায় বিরক্তি ছিল বেশ, ‘‘কে বলছেন?’’
সংক্ষিপ্ত জবাব এল
— ‘অতীন।’
এ পাশ থেকেও ছোট্ট জবাব ফিরে গেল, ‘পরে করুন।’
—কেন? ফল জানতে চাইছি...বলা বারণ নাকি!
খুব ঠান্ডা গলায় বলি, ‘কাগজে এই সময়ে ঠিক কতটা নাকে-মুখে অবস্থায় থাকি, জানেন? এখন যা শুনবেন, ফলটা কাল সকালের গরম কাগজে একই থাকবে, কথা দিলাম পরিবর্তন হবে না!’
ঝগড়াটা, আরও কিছু চোখা শব্দের অনুষঙ্গে গড়িয়ে চলার মাঝে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম ফোনের ওপারের মানুষটি নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ করছেন! ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই বললেন,
—বেশ কথা বলেন তো ভাই, নাম কী?
বাইশ বছর আগের, এক নির্বাচনী রাতে যে আলাপটা জমাট বেঁধেছিল এ ভাবে, শেষ কয়েক বছরে, তা ক্ষীণ হলেও ‘একটি জলের রেখা’ হয়ে থেকে গিয়েছিল বুঝি। দেখা হলে ধরিয়ে দিতেন, ‘‘সেই রাতের ঝগড়াটা মনে আছে তো!’’
মনে আছে অতীনদা। মনে আছে ধানি জমিতে স্বল্প জলে উঠে আসা সেই সব জলজ কচ্ছপের কথা, মনে আছে এখনও অবিরল সমুদ্রে বুনো ফুলের গন্ধ। আর মনে আছে বলেই রাতের অন্ধকারে শীতের মাঠে হয়ত অনাবিল কোনও পাপই অন্বেষণ করে বেড়াই আমি। তার পরে হেরে গিয়ে, নিজেকে বলি— গ্যাৎচোরেৎশালা!
গ্রন্থ তালিকা :
নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে
অলৌকিক জলযান
ঈশ্বরের বাগান
পঞ্চযোগিনী
মানুষের ঘর বাড়ি
দেবীমহিমা
শেষ দৃশ্য
দ্বিতীয় পুরুষ
সুন্দর অপমান
দুঃস্বপ্ন
উপেক্ষা
মানুষের হাহাকার
সবুজ শ্যাওলার নিচে
সমুদ্র মানুষ
সাগরে মহাসাগরে
ঋতুসংহার
একটি জলের রেখা
নগ্ন ঈশ্বর
পুতুল
বিদেশিনী
রোদ্দুরে জ্যোৎস্নায়
নীল তিমি
ধ্বনি প্রতিধ্বনি
ফোটা পদ্মের গভীরে
গম্বুজে হাতের স্পর্শ
একালের বাংলা গল্প
সুখী রাজপুত্র
রাজা যায় বনবাসে
একজন দৈত্য একটি লাল গোলাপ
অন্নভোগ
কাপাশি
ঝিনুকের নৌকা
তুষার কুমারী
দুই ভারতবর্ষ
নদীর সঙ্গে দেখা
নারী ও পুরুষ
মধ্যযামিনী
উড়ন্ত তরবারি
গিনি রহস্য
বিন্নির খই লাল বাতাসা
নারী এবং নদীর পারে বাড়ী
একটি জলের রেখা ও ওরা তিনজন
অমৃতা
অপহরণ
অরণ্য
উত্তাপ
আবাদ
জীবন মহিমা
মৃন্ময়ী
পুরস্কার তালিকা :
ধ্বনি প্রতিধ্বনিনীলকন্ঠ পাখির খোঁজের ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার ভাষা পায় তাঁর লেখনীর হাত ধরে। জীবন প্রবাহে আলো আঁধারে অনন্ত মানুষের মুখ তাঁর ভাষায় বাঙ্ময়। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে বাংলা সাহিত্য বার বার ঘুরে ফিরে আসে মানুষের বাঁচার আর্তি।
মানিক স্মৃতি পুরস্কার - ১৯৫৮ সালে 'সমুদ্র মানুষ' এর জন্য।
বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার - ১৯৯১ সালে।
ভুয়াল্কা পুরস্কার - ১৯৯৩ সালে পঞ্চযোগিনী এর জন্য।
বঙ্কিম পুরস্কার - ১৯৯৮ সালে দুই ভারতবর্ষ এর জন্য।
মতিলাল পুরস্কার
তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও সুধা পুরস্কার - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার - ২০০১ সালে পঞ্চাশটি গল্প-এর জন্য
শরৎ পুরস্কার- ২০০৫ সালে
সুরমা চৌধুরী আন্তর্জাতিক স্মৃতি পুরস্কার (আই.আই.পি.এম প্রবর্তিত) - ২০০৮ সালে
সাম্মানিক মূল্য দশ লক্ষ টাকা 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে'-র জন্য
প্রয়াত বিখ্যাত সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। সম্প্রতি বাথরুমে পড়ে গিয়ে মস্তিস্কে গুরুতর চোট পান তিনি। পোর্ট ট্রাস্টের কাছে সেন্টিনারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। তাঁর চিকিৎসক ছেলের তত্ত্বাবধানেই তিনি ভর্তি ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। শনিবার দুপুর ৩.৪০ নাগাদ মৃত্যু হয় তাঁর।
===============================
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন,
অনন্তে উড়ে গেল নীলকন্ঠ পাখিটি
- মানস চক্রবর্তী
বাংলার সংস্কৃতি জগতে মহীরুহ পতন চলছেই। নীরেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন, মৃণাল, দিব্যেন্দুর পর এবার বিদায় নিলেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। বয়স হয়েছিল তিরাশি। তবে বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। শেষ দিকে স্মৃতি অনেকটাই লোপ পেয়েছিল। কেষ্টপুরের বাড়িতেই থাকতেন। খুব একটা বেরোতেন না। সঙ্গী বলতে স্ত্রী এবং সর্ব ক্ষণের কাজের ছেলে। দুই ছেলে থাকেন তাদের নিজের আবাসে। খানিকটা অগোচরেই চলে গেলেন তিনি।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন প্রচুর। কিন্তু তিনি বাংলা সাহিত্যেই শুধু নন, ভারতীয় সাহিত্যেই অমর হয়ে থাকবেন নীলকন্ঠ পাখির খোঁজের জন্য। বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী থেকে বাংলা উপন্যাসের যে রাজপথের শুরু, তার একটা বড় জংশনের নাম নীলকন্ঠ। দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে লেখা এই উপন্যাসের আরও তিনটি সিক্যুয়েল আছে। অলৌকিক জলযান, মানুষের ঘরবাড়ি এবং ঈশ্বরের বাগান। সে গুলোও সৃষ্টি হিসেবে মহৎ এবং অবশ্যই জনপ্রিয়। তবে কোনওটাই নীলকন্ঠ নয়। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে একবার কথা হয়েছিল। ড্রয়িং রুমে চা খেতে খেতে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। কিন্তু বাকিগুলোকে তুমি ফেলে দিতে পারবে না।“
নানারকম পেশায় নিযুক্ত ছিলেন অতীনদা। জাহাজের খালাসি হয়ে চলে গেছেন বিশ্বের কত না কত শহরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন…। সেই সব অভিজ্ঞতা ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়। আবার রঙের কারখানায় ম্যানেজারি করেছেন। স্কুল মাস্টারি করেছেন। এই স্কুল মাস্টারি করার জন্য বি টি পড়তে হয়েছে। এবং সেখানেই আলাপ ও পরিণয় বৌদির সঙ্গে। বিয়ের আগে চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৭ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কারের জন্য উপন্যাস পাঠিয়ে প্রথম হয়েছিলেন মতি নন্দী, দ্বিতীয় অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃতীয় পূর্নেন্দু পত্রী। কেউ কাউকে চিনতেন না। পরে অতীন এবং মতি বেশ বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। অতীন-মমতার বিয়েতে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে সাক্ষী হিসেবে সই করেছিলেন মতি ও নিতি নন্দী।
তার পর মতি যোগ দিলেন আনন্দবাজারে। অতীন গেলেন যুগান্তরে। যুগান্তরে থাকাকালীন অতীন চুটিয়ে সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি দুহাতে লিখেছেন। তাঁদেরই সমসাময়িক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ মনে করতেন, অতীনের লেখার মধ্যে গ্রিক ট্রাজেডির ছাপ আছে। আর নীলকন্ঠকে তিনি বলতেন বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালির সমতুল্য। প্রথম উপন্যাসেই যিনি বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণ সিংহাসনে বসে গিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন অনেক পরে। ২০০১ সালে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পঞ্চাশটি গল্প গ্রন্থটির জন্য। অতীনের সেরা পঁচিশটি বইয়ের মধ্যে এটা পড়ে না। কিন্তু এটাই ভারতবর্ষ। এখানে গুণী মানুষদের কদর করতে অনেক সময় দেরি হয়ে যায়।
তবে পুরস্কার পান বা না পান বা কম পান, যতদিন বাঙালি সাহিত্য চর্চা করবে, তত দিনই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো সাহিত্যলোকে বিরাজ করবেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। নীলকন্ঠ তাঁকে অমরত্ব দিয়ে গেছে। শনিবার সেই পাখিটা চলে গেল অনন্ত আকাশে।
====================
তথ্য ঋণ
১) উইকিপিডিয়া
২) বাংলা পিডিয়া
৩) আনন্দবাজার পত্রিকা
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment