Monday, 7 December 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
                  বিশেষ আলোচনা পর্ব

                হারিয়ে গেছে বিয়ের 
            নিমন্ত্রণপত্রে পদ্য /ছড়া লেখা

ছন্দিত: নিমন্ত্রণপত্রের প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথের কবিতাংশ। ডান দিকে, ‘কাকুলীর বিয়েতে’ পদ্য
===========!!!!!!!!!!!!================
          Doinik sabder methopath
           Vol -215. Dt -08.12.2020
            ২২ অগ্রহায়ণ,১৪২৭. মঙ্গলবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷$$$$$$÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

উনিশ শতকের শেষের দিকে জনপ্রিয় রেওয়াজ ছিল বিয়েতে পদ্য ছাপানোর। প্রথম বিয়ের পদ্য নাকি রাজা সুবোধ মল্লিকের বিয়েতে ছাপা হয়েছিল বাংলা ১৩০৪ সালে। সেই সব পদ্যের রচয়িতাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ পদ্য-লিখিয়ে নিজের নাম রাখতেন না, বর বা কনের মা-বাবা, দাদু-দিদিমা, ভাগ্নি-ভাইপো, এমনকী পড়শির নাম দিয়ে ছাপতেন।  
বিয়ের পদ্যগুলি ছিল ‘প্রীতি উপহার’। পদ্য ছাপিয়ে সমস্ত নিমন্ত্রিতের কাছে হাতে হাতে বিলি করার প্রচলন ছিল। সব জায়গায় যে ‘প্রীতি উপহার’ লেখা হত, তা নয়। কোনও পদ্যে বর-কনের নাম লিখে নীচে লেখা হত ‘প্রীতির ডালা’ বা ‘প্রীতি নিবেদন’। ‘আশিস’, ‘স্নেহাশিস’, ‘শ্রদ্ধার্ঘ্য’, ‘মেয়েদের দুটি কথা’, ‘খোশ রোজ’, এ সবও লেখা থাকত। তার তলায় থাকত দীর্ঘ কবিতা। ছোটদের নামে ছাপা হলে ‘ভালোবাসা’, বড়দের নামে হলে লেখা থাকত ‘আশীর্বাদ’। বর-কনের প্রশংসা ও শুভ কামনাই ছিল সে সব পদ্যের মূল বিষয়।
বিয়ের পদ্য ছাপানো উপহারপত্র সে কালে অনুষ্ঠানবাড়ির সাংস্কৃতিক অবস্থানেরও সূচক ছিল। কাব্যপ্রতিভাধারী আত্মীয় বা বন্ধু নিজেরাই লিখতেন অভিনব সব কবিতা। অন্যরা স্মরণ নিতেন ছাপাখানার। সে কালে সব ছাপাখানাতেই বিয়ের পদ্য ছাপা হত। এমনকী শুধু বিয়ের পদ্য ছাপিয়েই ব্যবসা চলত অনেক ছোটখাটো ছাপাখানার। মালা হাতে পরি, ফুল-লতাপাতার নকশা করা কাগজ তৈরি থাকত, ফরমায়েশ মাফিক নাম বদলে দিলেই হল। এর ফলে প্রায়ই যা হত— শ্রাবণ মাসে কোকিল ডেকে উঠত পদ্যে, ঘোর অমাবস্যার বিবাহলগ্নও ভেসে যেত ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়। সকলের তো আর কবি-বন্ধু বা সাহিত্য-ঘেঁষা আত্মীয় থাকত না। অথচ বিয়ের মরশুমে পদ্য চাই-ই চাই। তাই সাধারণের জন্য এই বাজারি ব্যবস্থাই সই। জাতি, ধর্ম, সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে বিয়ের পদ্য ছাপাতেন সবাই। 
বর বড় না কনে, বিয়ের আসরের সেই প্রতিযোগিতারও অঙ্গ ছিল বিয়ের পদ্য। বরের বাড়ি থেকে ক’টা পদ্য ছাপা হল? কনের বাড়ি থেকেই বা কেমন পদ্য দিল? মজার গল্প শুনিয়েছেন পদ্মশ্রী যতীন্দ্রমোহন দত্ত। তাঁর বোনের বিয়ে উপলক্ষে কনেবাড়ি থেকে চারটে পদ্য ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল। বিয়ে ঠিক হয়েছিল বর্ধমানে চান্ডু-র জমিদারবাড়িতে, পাত্র সেই আমলের মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। তাদের ঘরে হাতি ছিল, ষোলো বেহারার পালকিও। অথচ বরের বাড়ি থেকে বিয়েতে একটিও পদ্য ছাপা হয়নি। সেই নিয়ে বাসরঘরে খুব পিছনে লাগা হল জামাইয়ের। কেউ বলল ‘রেঢ়ো’, কেউ আবার ছড়া কাটল: ‘কোঁচা লম্বা, কাছায় টান— তবে জানবে বর্ধমান!’

কাব্যিক: বিয়ের পদ্যে ঠাঁই হত প্যারডিরও। ‘ছোট মামার বিয়েতে’ ‘নীল নবঘনে’র ছায়া

‘বিয়ের মন্তর’ নামে একটি পদ্যের সঙ্কলনই প্রকাশ করে ফেলেছিলেন সত্যচরণ মিত্র। ১৩২০ সালের বৈশাখে, ছেলের বিয়ে উপলক্ষে প্রকাশিত সেই সংকলনে পদ্যের সংখ্যা মোট তিরিশটি। একটি পদ্যে লেখা:

আজকাল

পদ্যহীন বিয়ে— ভাবলে গা কেঁপে ওঠে

আরে ছি ছি লাজে মরে যাই,

বর কনে থাক বা না থাক,—

পুরুত আসুক আর নাই আসুক

(অন্ততঃ) একটা পদ্য চাইই চাই।

লাল নীল কাগজেতে যা’তা লেখা

লোকের হাতে দিলেই তাই

তার বদলে একটা ‘‘থ্যাংকস’’

পেলে এক্কেবারে বর্ত্তে যাই।

বরের কোষ্ঠী ও বংশপরিচয় নিয়েও লেখা হত পদ্য। সেগুলি মূলত ছাপা হত বন্ধুদের নামে। শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে পাওয়া ‘কাকুলীর বিয়েতে’ পদ্য লিখেছে ছোট একটি মেয়ে: ‘ও কাকুলী সত্যি বুঝি তোমার নাকি বিয়ে/ তুমি নাকি বউ আনবে টোপর মাথায় দিয়ে...’ নববধূর কাছে পদ্য-শেষে তার আবদার: ‘যত পাবে সাজার জিনিষ ভাগ যেন তার পাই।’ আবার ভরা বর্ষায় ‘ছোট মামার বিয়েতে’ পদ্য লেখা হচ্ছে রবিঠাকুরের ‘আষাঢ়’ কবিতার ছাঁদে: ‘শ্রাবণের মাঝে মামার বাড়ীতে তিল ঠাঁই আর নাহিরে।/ ওরে তোরা আজ যাস্‌নে আজিকে যাস্‌নে বাড়ীর বাহিরে।’ হাসি-মশকরাও ছিল— অবশ্যই সে কালের মূল্যবোধের নিরিখে। দাদামশায়ের চতুর্থ পক্ষের বিয়ে উপলক্ষে পাওয়া যাচ্ছে নাতিদের ছাপানো, চারিদিকে কালো বর্ডার দেওয়া পদ্য, বিষয়— নবপরিণীতার সম্ভাব্য একাদশীর ব্যবস্থা!

গ্রামেও জনপ্রিয় ছিল এই প্রথা। হাতে হাতে বিলি হত বিয়ের পদ্য। সেই সব পদ্যের কাগজ নিয়ে ছোটদের উৎসাহ ছিল অপরিসীম। এই বিষয় নিয়ে একটু খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, কলকাতার বাঙালি মুসলমান পরিবারেও এই রেওয়াজ ছিল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বণিক–বার্তা’ পত্রিকার একটা পুরনো সংস্করণে ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বিয়ের পদ্য থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় বসতি স্থাপন করা আবুল হাসানের স্মৃতি উদ্ধৃত করে তাঁর পুত্র ইফতিখার হাসনাত জানিয়েছেন, হাসান সাহেবের বিয়ে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, ১৯৪২ সালে। সেই বিয়ের কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন কবি সিকান্দার আবু জাফর। হাসান সাহেব ছিলেন ব্যায়ামবীর এবং প্রথম মুসলমান ‘মিস্টার বেঙ্গল’। রাবীন্দ্রিক শৈলীতে রচিত বিয়ের পদ্যে সেই বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।

মধু বসন্ত জাগিল কি শেষে

মরমের তরুশাখে!

‘পেশীর দানব’ চঞ্চল হোল

‘রাঙা কুসুমের’ ডাকে?

অশান্ত আশা অন্তরে রাখি

পথে পথে যারে ফিরেছিলে ডাকি,

পেয়েছো কি আজ সন্ধান তার

বসন্ত ঝংকারে?

মনে রেখ ভাই এ ‘ফুল’ তোমার

ডাম্বেল, রিং নয়,

কুস্তিতে জেতা চলিবেনা হেথা

শুধু মানা পরাজয়।...

যুদ্ধের বাজার বলে বিয়ে থেমে থাকেনি। থেমে থাকেনি বিয়ের পদ্য ছাপাও। কবিতায় ছায়া পড়েছে যুদ্ধের, বাঙালি তার মধ্যেও অননুকরণীয় রসবোধে মশকরা করে গিয়েছে। নেমন্তন্ন খাওয়ার সময় যদি সাইরেন বেজে ওঠে? শুভদৃষ্টির মুহূর্তে যদি ব্ল্যাক আউট হয়ে যায়? এই সব সম্ভাবনাও উঠে এসেছে পদ্যে। 

পদ্য নিয়ে আলোচনায় ঠাকুরবাড়ির প্রসঙ্গ না ছুঁয়ে গেলে হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের আশীর্বাদ বা উপহার হিসাবে প্রচুর লিখেছেন। তবে বিয়ে উপলক্ষে কোনও কবিতা নয়, প্রথম লিখেছিলেন দু’টি গান। ১৮৮১ সালে। গানদু’টির প্রথম লাইন— ‘দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি’ আর ‘মহাগুরু দুটি ছাত্র এসেছে তোমার’। দ্বিতীয় গানটি পরে পরিবর্তন করে করেছিলেন ‘শুভদিনে এসেছে দোঁহে’। গান দু’টি রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লীলাবতীর সঙ্গে কৃষ্ণকুমার মিত্রের বিয়ে উপলক্ষে লেখা।

এই গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও একটা ইতিহাস। লীলাবতীর বিয়েতে গানদু’টি গাইতে হবে বলে গায়কদের নিজেই তালিম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই গায়কদের দলে এক জনের নাম— ‘শ্রী নরেন্দ্রনাথ দত্ত’। ভবিষ্যতের স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় গানের মধ্যে ছিল ‘দুই হৃদয়ের যদি’— যা তাঁর সম্পাদনায় ‘সঙ্গীতকল্পতরু’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।

রবি ঠাকুর কলম ধরার পর রবীন্দ্রসৃষ্টি দিয়ে বিয়ের পদ্য সঙ্কলনের প্রচ্ছদ সাজানো শুরু হল। প্রথম পাতায় রবীন্দ্র-কবিতাংশ, ভিতরের পাতায় নিজেদের লেখা বিয়ের কবিতা। সেই উদাহরণও পাওয়া যায়। যেমন শোভাবাজার রাজবাড়ির অমল কৃষ্ণ দেবের বিয়ের পদ্য সঙ্কলনের প্রচ্ছদে কবিগুরুর রচনা:

নূতন পথের যাত্রী দুটি

ছুটছে যাহার সন্ধানে

যোগ করে দাও, এক করে দাও,

হলদে সুতোর বন্ধনে।

আরও যে বিয়ের উৎসবগুলিতে কবিগুরু তাঁর লেখা উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে আছে বিহারীলাল গুপ্তের কন্যা স্নেহলতার বিয়ে, দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা নলিনীর বিয়ে, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে, লীলাদেবীর বিয়ে, দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের কন্যা ইন্দিরার বিয়ে, কবি অমিয় চক্রবর্তীর বিয়ে, লালগোলার রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের বিয়ে, কোচবিহারের রাজকন্যা ইলাদেবীর বিয়ে ইত্যাদি।

কবির আশীর্বাণী সকলেই চাইত। কাউকে বিমুখ করতেন না তিনি। এ দিকে ফরমায়েশি লেখা লিখতেও মন চাইত না। সে কথা জানিয়েছিলেন চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের মেয়ের বিয়ের জন্য কবিতা পাঠানোর সময়। এই ধরনের সৃষ্টি সব নিশ্চয়ই ছাপা হয়নি। কে জানে, হয়তো কিছু বিয়ের পদ্য এখনও লুকিয়ে আছে কোনও পারিবারিক অ্যালবামের গহনে!

বিয়ের পদ্য দেবদেবীর বিয়েতেও লেখা হয় এবং পাঠ করা হয়। বর্ধমানের সগড়াই গ্রামে ধর্মরাজ ও মনসাদেবীর বিয়ে উপলক্ষে পদ্যপাঠের রীতি আছে, ‘‘যুগে যুগে এইভাবে কাটে কতকাল।/ সগড়াইবাসীর কিবা সুখের কপাল।।/ প্রতি বর্ষে ধর্ম বিয়ে মনসা মিলন।/ দেখিতেছে গ্রামবাসী যাবজ্জীবন।।’’
বিয়ের বাসরে গান, বাজনা-সহ জলসহায় গান, ঢেঁকি মোঙলানোর গান আজও শোনা যায়। আর বিয়ে মানেই কাব্যময়। ছাদনাতলার ছড়া, নেমন্তন্ন করার ছড়ার চিঠি আর সেই সঙ্গে নাপিতের কণ্ঠে ছড়া এবং বিয়ের আসরে বর্ণাঢ্য পদ্যপাঠ। এগুলি অনেকাংশেই বর্তমানে লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছে।
কথায় আছে, ‘জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে/ তিন বিধাতা নিয়ে।’ জন্ম-মৃত্যুর মতো বিয়েটাও অধিকাংশ নরনারীর কাছে রহস্য রোমাঞ্চকর এক বিমিশ্র বিষয়। হিন্দুদের চোখে বিয়ে আবার দশবিধ সংস্কারের মধ্যে শেষ বা চরম সংস্কার। তবে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের কাছে বিবাহ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সাধারণত পিতৃকুলের গোত্র পরিত্যাগ করে তিনি স্বামীকুলের গোত্র ও পদবি গ্রহণ করেন। সুতরাং বিবাহ মানেই হিন্দুনারীর কাছে এক চরম সন্ধিক্ষণ। তাই বিয়েতে নানা ধরনের শাস্ত্রীয় ও মেয়েলি আচার অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। এই আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি, বিয়েতে থাকে তিনটি আকর্ষণীয় পর্ব—লোকখেলা, গান আর পদ্য মানে ছড়া। লোকখেলা যেমন, কড়িখেলা, পাশাখেলা, ভাঁড়কুলোখেলা ইত্যাদি। বিয়ের বাসরে গান, বাজনা-সহ জলসহায় গান, ঢেঁকি মোঙলানোর গান আজও শোনা যায়। আর বিয়ে মানেই কাব্যময়। ছাদনাতলার ছড়া, নেমন্তন্ন করার ছড়ার চিঠি আর সেই সঙ্গে নাপিতের কণ্ঠে ছড়া এবং বিয়ের আসরে বর্ণাঢ্য পদ্যপাঠ। এগুলি অনেকাংশেই বর্তমানে লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছে।

বিয়ের পদ্য নিয়ে বিস্তারিত চর্চা করা যায়। তার আগে ছড়া নিয়ে দু’চার কথা বলা যেতে পারে। বাংলার মায়েদের এক স্বভাবগত সৃষ্টি হল এই ছড়া। ছেলে-ভুলনোর ছড়া থেকে ঘুম-পাড়ানির গান, প্রবাদ প্রবচনে সর্বত্রই ছড়া সৃষ্টি করেন বাংলার বধূরা। তা-ও মুখে মুখে। বাংলার কবিয়ালেরাও আসরে বলেন, ‘‘মায়া মমতায় গড়া/ বাংলা মায়ের ছড়া।’’
সুতরাং বিয়েতেও যে নানা ধরনের ছড়া থাকবে তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে! আগে পান, সুপারি দিয়ে নেমন্তন্ন করার চল ছিল। বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করার সময়ে বাজার থেকে কয়েকটা কার্ড নিয়ে এসে লাল কালিতে রং বাহারি ছড়ায় নিমন্ত্রণ-ছড়া লেখা হত। যেমন, ‘‘বন্ধু তোমায় জানাই খবর/ হয়তো তুমি হাসবে।/ ৮ই ফাগুন আমার বিয়ে / নিশ্চয় তুমি আসবে।।’’
বিয়ের দিন ছাদনাতলায় সুন্দর করে আলপনা দেওয়ার চল আছে। বড় করে দু’টি উড়ন্ত প্রজাপতি আঁকা হত। আগেকার বিয়ের আলপনায় দেখা যায়, চারপাশে লতাপাতার অলঙ্করণ। বর, কনের বসার পিঁড়ি দু’টিও অলঙ্কৃত হত সুচিত্রিত আলপনায়। বর্গাকার ছাদনাতলায় লেখা হত ‘শ্রীশ্রীপ্রজাপতয়ে নমঃ’। তার পরেই লেখা থাকত দুই পঙ্‌ক্তির ছড়া।
কন্যা সম্প্রদানের বা মধুপর্ক দানের পরে নাপিত ছড়া কাটেন। একে সাধারণত ‘গৌরবচন’ বলা হয়। অনেক সময়ে আবার বিবাহের শুভদৃষ্টি বা মালাবদলের সময়ে এই ছড়া বলা হয়, যেমন, ‘‘শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন।/ রামসীতার বিবাহ কথা করুন গো শ্রবণ।।/ যথাধ্বনি উলুধ্বনি করুন সকলে।/ হর গৌরীর মিলন হল শুভকালে।।’’

এ বার আসি বিয়ের পদ্যের কথায়। বিয়ের পদ্য বর ও কনে দুই পক্ষেই ছাপাত। বরের বন্ধুরা আবার আলাদা করে বিয়ের পদ্য পাঠ ও তা বিলির ব্যবস্থা করতেন বিবাহসভায়। পদ্য-পাঠের সাধারণ নিয়ম ছিল, কনেকে সিঁদুর দান করার পরে অথবা বাসরঘরে যাওয়ার পূর্বে নাপিত ঘোষণা করতেন এ বার বিয়ের পদ্য পড়ার পালা। বর বা কনেপক্ষের পারিবারিক পদ্যপাঠ করার পরে ছেলের বন্ধুদের এক জন পদ্য পড়তেন। পদ্য শুনে উপস্থিত ব্যক্তিরা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাত। তবে মেয়ের বন্ধুদের কবিতা ছাপানো বা পাঠের ব্যবস্থা দেখা যেত না। বিয়ের পদ্য সাধারণত তিন ধরনের হত— ছড়াকারে লেখা, গদ্যে লেখা আর গদ্যপদ্য মিশিয়ে লেখা। পারিবারিক পদ্যগুলি ছিল ক্ষুদ্র পুস্তিকা স্বরূপ। এখানে বাবা, মা, কাকা, কাকিমা, দাদা, বৌদি, দাদু, ঠাকুমা, ভাইপো, ভাইঝি বা ভাগ্নে-ভাগ্নির বয়ানে পদ্য লেখা হত। এ ধরনের পদ্যগুলিতে আশীর্বাণী, মৃত নিকট আত্মীয়কে স্মরণ করে শোকোচ্ছ্বাস ইত্যাদির পাশাপাশি, ছোটদের বয়ানে পদ্যর শিরোনাম থাকত— ‘দিদির বিয়েতে একটু চাটনি’, ‘মামার বিয়েতে ধামাকা’ ইত্যাদি। যেমন, ‘‘তেল হলুদের বন্যায় মুড়কি মুড়ি ভেসে/ বোঁদে ব্যাটা ভিজে মরে পড়ে চিনির রসে।।’’

পদ্যর শেষে থাকত ইতি তোমার ভাই-বোনেরা, মা, বাবা ইত্যাদি শব্দমালা। পদ্য শুরু হতো ‘শ্রীশ্রীপ্রজাপতয়ে নমঃ’ বাক্য দিয়ে। দু’দিকে দু’টি প্রজাপতির ছবি। তারও উপরে ছাপা হত মালা হাতে দু’টি পরি বা বিদ্যাধর-বিদ্যাধরী। কাগজগুলি ছিল হালকা লাল, সবুজ বা হলুদ রঙের। পদ্যপাঠের পরে উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের বিলি করা হত। ৯০-এর দশকের শুরুতে গ্রামবাংলা থেকে বিয়ের পদ্যপাঠ বিলুপ্ত হতে থাকে।

একটা প্রশ্ন অনেকেই তোলেন, বিয়ের পদ্যপাঠ কবে থেকে শুরু হয়েছিল? এ কথা সত্য প্রাচীন বা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিয়ের নানা আচার অনুষ্ঠান, লোকখেলা, গানবাজনার বিবরণ থাকলেও পদ্যপাঠের কোনও প্রসঙ্গ নেই। যতীন্দ্রমোহন গুপ্ত এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, ১৩০৪ বঙ্গাব্দে কলকাতায় রাজা সুবোধ মল্লিকের বিয়ের সময় প্রথম পদ্য ছাপানো হয়েছিল। কারও কারও মতে রাজা প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের বিবাহ উপলক্ষে পিতামহ কালীকৃষ্ণ ঠাকুর তাঁর মৃত পুত্র শরদ্বিন্দুনাথকে স্মরণ করে এক শোকবিলাপ মুদ্রণ ও পাঠের ব্যবস্থা করেন। যাই হোক, বিয়ের পদ্য বিশ শতকের প্রথম দিকে যে ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয়েছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

অধিকাংশ ছাপাখানায় হরেক রকম বিয়ের পদ্যের নমুনা আগে থেকেই সংগৃহীত থাকত। যারা পদ্য ছাপাতে যেতেন তাঁরা পছন্দ করার পরে বর-কনের নাম, বিয়ের তারিখ, বিবাহবাসর এবং কারা লিখছেন তাদের নামগুলি লিখে নিতেন। অনেকেই আবার কবিযশোঃপ্রার্থী, কবিয়াল বা প্রতিষ্ঠিত কবিদের কাছে লিখিয়ে নিয়ে আসতেন বিয়ের পদ্যগুলি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের পদ্য না লিখলেও অনেক বিয়েতে তিনি আশীর্বাণী লিখে দিতেন। লীলাদেবী, দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের কন্যা ইন্দিরা, লালাগোলার রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ এবং কবি অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কোচবিহারের রাজকন্যা ইলাদেবীর বিয়েতেও তিনি সানন্দে আশীর্বাণী লিখে দিয়েছিলেন। তবে প্রথম শ্রেণির বিয়ের পদ্যকার ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। কাটোয়ার ডাকসাইটে ডেপুটি ছিলেন কবি তারকচন্দ্র রায়। তারকবাবুর শালার বিয়েতে পদ্য লিখে দিয়েছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। আচার্য হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সংগৃহীত সেই পদ্যটি লেখা হয়েছিল ১৩২২ সালের ১৮ মাঘ। পদ্যটি লেখা হয়েছিল তারকবাবুর নাতির নামে, ‘‘আজকে তোমার বইবে তুফান বুকে/ মুখেতে আর বলবো আমি কত/ দুই জনেতে থাক পরম সুখে/ একটি বোঁটায় দুটি ফুলের মতো।।’’

      তথ্যঋণ  -আনন্দবাজার পত্রিকা।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆



 


No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...