∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
================================
Doinik Sabder Methopath
Vol -256. Dt -19.01.2021
৫ মাঘ, ১৪২৭. বুধবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
অঘ্রানের সকালে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই পথের পাশে পুষ্পিত এক জারুলের সঙ্গে দেখা আর তার চোখে পড়ল গেটের ওপর খিলান তৈরি করে ফুটে আছে বোগেনভিলিয়া এবং এই নতুন শীতের ঠান্ডা হাওয়ায় একটা-দুটো করে শান্তভাবে ঝরেও পড়ছে তার মভ ফুল— এই দেখার মুহূর্তেই সে বুঝতে পারল সে আর নিজের মধ্যে নেই নিজের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সে’’
‘‘মাথার ওপর দিয়ে মেট্রোর শেষ ট্রেন এক পারকাশনের ধ্বনি ছড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল বহুদূর পর্বতমালার থেকে হাওয়ার ঘোড়সওয়ার শীত নিয়ে এসেছে এ শহরে তার প্রবাহ আমার পথকে নিস্তব্ধ জনহীন করে রেখেছে’’
বা,
‘‘যেসব নদী এই দারুণ গ্রীষ্মে খাক হয়েছে দু’-একটা দুর্বল রোগা সোঁতায় তার ইতিহাস রয়ে গেছে বালিপাথর সরিয়ে তা তুমি খুঁজে পাবে না নক্ষত্রপুঞ্জ যদি তোমার প্রবাহকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তোমার নিজস্ব যুদ্ধের কাছেই তোমাকে ফিরতে হবে বারবার’’
অথবা,
‘‘ছেলেটার এখন অনেক বয়স এত পথ পার হয়ে আসার পর যখন বার্ধক্য বেদনার মোকাবিলা করতে গিয়ে তার নিশিযাপন নিদ্রাহারা হয়ে যায় তখন সেই মায়াবী কার্বাইডের আলো কোথা থেকে জানি ফিরে এসে তার কবিতাকে নিষিক্ত করে দেয় কোনও শুশ্রূষার মতো’’
বালিপাথরকে সরিয়ে শৈশব দিনগুলো এলো।
১৯৩৫ সালে শিয়ালদহ রেলস্টেশনের কাছে মির্জাপুর স্ট্রিটের এক বাড়িতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। বাংলাদেশের শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে তাঁর পূর্বপুরুষের বাসস্থান। তবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বংশের পরবর্তী পুরুষরা সকলেই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। তাঁর পরিবারের অনেকেই কৃষ্ণনগরে বসবাস করতেন ।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠাকুরদার আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্রর পিসিমা তারা দেবীর সঙ্গে 'স্যার' আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কলকাতা হাইকোর্টের জাস্টিস রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবাও ছিলেন নামী আইনজীবী।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পড়াশোনা কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স স্কুলে। তারপর , বাবার বদলির চাকরির হাত ধরে তাঁর পড়াশোনা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর লকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ দু-বছর পড়াশোনা করেন।
পড়ুয়া সৌমিত্র কলকাতায় থাকাকালীন বহু সময়ই নাটক , সিনেমা দেখতে গিয়েছেন। ডেসিকার ফিল্ম দেখার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছেন। এমন এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুবক 'অপু'র খোঁজ করতে গিয়ে আলাপ সত্যজিৎ রায়ের। ১৯৫৯ সালে 'অপুর সংসার' এর হাত ধরে একজন এমন বাঙালি ছাপোষা অথচ উজ্জবল চেহারার অভিনেতাকে সত্যজিৎ স্ক্রিনে ধরেছিলেন , যাঁর ব্যক্তিত্বে বাঙালি বিভোর হয়েছে। ততদিনে বিভূতিভূষণের অপু সৌমিত্রের হাত ধরে যেন ঠিক পাশের বাড়ির ছেলে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অপুকে যেভাবে বাঙালি বুকে জড়িয়েছে, তেমই ৭০ এমএম পর্দার ফেলুদাকে বাঙালি সৌমিত্রর চেহারাতেই চিনতে পেরেছে। সত্যজিৎ-সৌমিত্রর হাত ধরে এসেছে হীরক রাজার দেশের মাস্টার মশাইয়ের চরিত্র, এসেছে 'শাখা প্রশাখা' ,'অরণ্যের দিনরাত্রি'র মতো ছবি।
১৯৮৪ র 'কোনি',১৯৭৩ র 'বসন্ত বিলাপ',১৯৭২ এ উত্তম কুমারকে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে 'স্ত্রী' বাঙালিকে আজও বিভোর করে। ১৯৬১ সালে একইভাবে বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় তাল মিলিয়ে সৌমিত্র অসামান্য অভিনয় উপহার দেন 'ঝিন্দের বন্দি' ছবিতে। ১৯৬৪ এর 'চারুলতা'য় মাধবী, শর্মিলার সঙ্গে ১৯৫৯, এ "অপুর সংসার',১৯৬০ এ 'দেবী', ১৯৬১ তে অপর্ণার সঙ্গে 'তিনকন্যা', যেন সৌমিত্রকে নায়কের থেকেও এক উঁচুস্তরে নিয়ে যায়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে 'তাহাদের কথা',পরবর্তীকালে ঋতুপর্ণের সঙ্গে ' অসুখ' এরপরের যুগে ' বেলা শেষে' সৌমিত্রকে যেন 'পরিচালকের অভিনেতা' করে তুলেছিল। যুগ, কাল, বয়সের উর্ধ্বে তিনি হয়েছিলেন 'অভিনেতা'।
১৯৬৩ সালে 'তাপসী' দিয়ে শুরু সৌমিত্র চট্টোাপাধ্যায়ের নাট্যজীবন। এরপর রাজকুমার, ফেরা, চন্দনপুরের চোর, টিকটিকির মতো নাটক কখনও তাঁর অভিনয়ে কখনও বা তাঁর নির্দেশনায় সমৃদ্ধ হয়েছে। স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায় (বি. ১৯৬০)।
পুত্র সৌগত চট্টোপাধ্যায় এবং কন্যা পৌলমী চট্টোপাধ্যায় (বসু)।
খ্রিষ্টাব্দ নাটকের নাম
১৯৬৩ তাপসী
১৯৭৮ নামজীবন
১৯৮৩ রাজকুমার
১৯৮৭ ফেরা
১৯৮৮ নীলকন্ঠ
১৯৯০ ঘটক বিদায়
১৯৯২ দর্পণে শরৎশশী
১৯৯৪ চন্দনপুরের চোর
১৯৯৫ টিকটিকি
১৯৯৮ প্রাণতপস্যা
- শেষের কবিতা (শ্রুতিনাটক)
হোমাপাখি
রচনা কর্ম
শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩)
মানিক দা'র সঙ্গে (২০১৪)
পরিচয় (২০১৩)
অগ্রপথিকেরা (২০১০)
প্রতিদিন তব গাঁথা (২০০৯)
চরিত্রের সন্ধানে (২০০৪)
শব্দরা আমার বাগানে
কবিতা সমগ্র (২০১৪)
মধ্যরাতের সংকেত (২০১২)
নাটক সমগ্র ১ (২০১৫)
নাটক সমগ্র ২ (২০১৭)
সৌমিত্র অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র -
অপুর সংসার (১৯৫৯), ক্ষুদিত পাষাণ (১৯৬০), দেবী (১৯৬০), তিন কন্যা (১৯৬১), ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১), অতল জলের আহ্বান (১৯৬২), বেনারসী (১৯৬২), অভিজান (১৯৬২), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), কিনু গোয়ালার গলি (১৯৬৪), বাক্স বদল (১৯৬৫), কাপুরুষ (১৯৬৫), একই অঙ্গে এত রূপ (১৯৬৫), আকাশ কুসুম (১৯৬৫), মণিহার (১৯৬৬), কাঁচ কাটা হীরে (১৯৬৬), হাটে বাজারে (১৯৬৭), অজানা শপথ (১৯৬৭), বাঘিনী (১৯৬৮), তিন ভুবনের পারে (১৯৬৯), পরিণীতা (১৯৬৯), অপরিচিত (১৯৬৯), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), প্রথম কদম ফুল (১৯৭০), মাল্যদান (১৯৭১), স্ত্রী (১৯৭২), বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩), অশনি সংকেত (১৯৭৩), সোনার কেল্লা (১৯৭৪), সংসার সীমান্তে (১৯৭৪), দত্তা (১৯৭৬), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), দেবদাস (১৯৭৯), গণদেবতা (১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), কোণি (১৯৮৪), ঘরে বাইরে (১৯৮৪), আতঙ্ক (১৯৮৬), গণশত্রু (১৯৮৯), শাখা প্রশাখা (১৯৯০), তাহাদের কথা (১৯৯২), মহাপৃথিবী (১৯৯২), হুইল চেয়ার (১৯৯৪), পারমিতার একদিন (২০০০), দেখা (২০০১), আবার অরণ্যে (২০০২), পাতালঘর (২০০৩), পদক্ষেপ (২০০৬), দ্য বং কানেকশন (২০০৬), চাঁদের বাড়ি (২০০৭), নোবেল চোর (২০১২), মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড মোর (২০১২), অলীক সুখ (২০১৩), রূপকথা নয় (২০১৩), দূরবিন (২০১৪)।
পুরস্কার
প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান ১৯৯১ সালে, অন্তর্ধান চলচ্চিত্রের জন্য বিশেষ জুরি বিভাগে। ৯ বছর পরে দেখা চলচ্চিত্রের জন্য একই বিভাগে পুরস্কার পান। অভিনয়জীবনের সুদীর্ঘ পাঁচ দশক পর ২০০৬ সালে পদক্ষেপ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে সম্মানিত হন তিনি। ২০১২-এ দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৪ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন সৌমিত্র। এরপর ২০১২ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার কয়েক বছর পরে ফরাসি সরকারের দেওয়া সম্মান ‘লেজিয়ঁ দ্য নর’ এবং ‘কম্যান্দর দ্য লার্দ্র দে আর্ত্ এ দে লের্ত্র’-এ ভূষিত হন তিনি।
২০০০ - সাম্মানিক ডি.লিট., রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
২০০৪ – পদ্ম ভূষণ, ভারত সরকার
২০১২ - দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ভারত সরকার
২০১৭ – লিজিওন অফ অনার ফ্রান্স সরকার
কম্যান্দর দ্য লার্দ্র দে আর্ত্ এ দে লের্ত্র, (Commandeur de l' Ordre des Arts et des Lettres)ফ্রান্স
২০১৭ – বঙ্গবিভূষণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার (২০১৩ সালে এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন)
২০২০ সালের ১ অক্টোবর বাড়িতে থাকা অবস্থাতে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শমতে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে ৫ অক্টোবর কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। এর পরের দিন ৬ অক্টোবর তাকে বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হয়। এখানে ১৪ অক্টোবর করোনার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। এরপর সৌমিত্র খানিক সুস্থ হতে থাকেন। চিকিৎসা চলা অবস্থাতে ২৪ অক্টোবর রাতে অবস্থার অবনতি ঘটে। কিডনির ডায়ালাইসিস করানো হয়, প্লাজমা থেরাপি পূর্বেই দেয়া হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হতে থাকলে পরিবারের লোকজনকে জানানো হয়।অবশেষে ১৫ই নভেম্বর, ২০২০ তারিখে ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ অভিনেতা অঙ্গনের অনেকেই শোকপ্রকাশ করেন।গান স্যালুটে ক্যাওড়াতলায় বিদায় জানানো হয়।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment