Thursday, 18 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

     বিশেষ আলোচনা পর্ব

         বৈদিক ও লৌকিক সরস্বতী পূজা

=================================Doinik Sabder Methopath

Vol -283. Dt -16.02.2021

৪ ফাল্গুন,১৪২৭. মঙ্গলবার

÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

পুষ্পাঞ্জলী দেওয়ার সময় সরস্বতী পুজোর যে মন্ত্র রয়েছে, তার মধ্যে এই অংশটি তাৎপর্যপূর্ণ, ' সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যেকমললোচনে, বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমস্ত‌ুতে। জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুকতাহারে। বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে। নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ। বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।। এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।'শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা। শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।। শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা। শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারব‌ভূষিতা। বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ। পূঝিতা মুনিভি: সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।। স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্। যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়ং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।।

পুরাণ মতে সরস্বতী বৈদিক দেবী৷ জানা গিয়েছে, প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতীর মতোই দেবী বাগেশ্বরীর আরাধনা করতেন। নিষ্ঠা ভরে তাঁরা বাগেশ্বরী দেবীর পুজো করতেন। আরও জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াত-কলম রেখে পুজোর প্রথা ছিল। তবে আগে সম্পূর্ণ বৈদিক মতেই দেবী সরস্বতীর আরাধনা হতো। সরস্বতী পুজোর এই বর্তমান রূপ হালফিলেই। আধুনিক সময়ে পুজোর ধরন বদলায়। আড়ম্বর আসে দেবীর আরাধনায়।

আগে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত বই, স্লেট, দোয়াত ও কলম রেখে সরস্বতীর আরাধনা করত। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। জানা যায়, শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে ধনীরাই সরস্বতীর প্রতিমা তৈরি করে পুজো শুরু করেন। বর্ধমানের রাজার উদ্যোগে আয়োজিত সরস্বতী পুজোয় বিশেষ সমারোহেরও আয়োজন করা হয়। বহু দূর থেকে রাজার সরস্বতী পুজোয় যোগ দিতে এসেছিলেন মানুষজন। পুজো উপলক্ষে সেকালে বর্ধমানের রাজার প্রাসাদে আতসবাজি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।


আধুনিক সময়ে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন শুরু হয়। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পুজো করা হয়। সরস্বতীর পূজো সাধারণ পূজার নিয়ম মেনেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পূজোর জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলেরও প্রয়োজন হয়। সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া যায় না, এমনই ধারণা যুগের পর যুগ ধরে প্রচলিত রয়েছে। এমনকী সরস্বতী পুজোর দিনে নাকি কিছু লেখাও যায় না, এটাই প্রচলিত রেওয়াজ।

সরস্বতী পুজোর দিনে ছোটোদের হাতেখড়ি দিয়ে পাঠ্য জীবন শুরু হয়। সরস্বতী পুজোর দিনে পুষ্পাঞ্জলী দেওয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি উপাচার। বাড়িতে, ক্লাবে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা এদিন দল বেঁধে অঞ্জলি দেয়। পুজোর ঠিক পরের দিন চিড়ে ও দই দিয়ে তৈরি হয় দধিকর্মা। দেবী সরস্বতীকে তা নিবেদনের পরেই অন্যদের দেওয়া হয়। এরপরেই পুজো শেষ হয়। সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।

পুরাণ অনুসারে, পরম কুস্মন্দেরে প্ৰথম অংশে দেবী সরস্বতীর জন্ম। তিনি বিষ্ণুর জিভ থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন। সরস্বতী বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ব্রহ্মা প্রথম দেবী সরস্বতীর পূজো করেন। দেবী সরস্বতী নারায়ণ থেকে সৃষ্ট, তাই তিনি নারায়ণকে স্বামী হিসেবে ভেবেছে গঙ্গার দ্বারা অভিশাপ পান ও ফের শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্টি হন ও ব্রহ্মাকেই নিজের স্বামী রূপে গ্রহণ করেন। এর পরে শ্রীকৃষ্ণ সরস্বতী পুজো শুরু করেন। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হয়।


দেবী সরস্বতীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। বৈদিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তিনি হিন্দুধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী। হিন্দুরা বসন্তপঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজো করে। বৌদ্ধ ও পশ্চিম ও মধ্য ভারতে জৈনরাও সরস্বতী পূজা করেন। জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী হিসেবে ভারতের বাইরে জাপান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মায়ানমারেও সরস্বতী পূজোর চল রয়েছে।

কৃষি নির্ভর আমাদের দেশে এই সময় থেকেই শুরু হয় সর্ষে রোপণ। তাই কৃষিকাজের ক্ষেত্রেও বসন্ত পঞ্চমী তিথিটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। হিন্দু মতে দেবী সরস্বতী হলেন বিদ্যা, জ্ঞান, শিল্পকলা, সঙ্গীত ও সাহিত্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস্বতী পুজোর দিন শিশুদের হাতেখড়ি দেওয়ার অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে। এদিন থেকেই অনেক শিশু তাদের প্রথম অক্ষর লেখে। সরস্বতী পুজোর দিন সকালে গায়ে নিম ও হলুদ বাটা মেখেও স্নান করেন অনেকে। আগেকার দিনে এই সময় বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিত। সেই কারণেও নিম ও হলুদ বাটা মেখে স্নান করা এই সময় উপকারী।

পঞ্জিকায় চোখ রাখলে দেখা যাবে দিনটি শ্রীপঞ্চমী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা জানি ‘শ্রী’হল লক্ষ্মী দেবীর অপর নাম। লক্ষ্মীদেবী ধন-সম্পদের দেবতা নন। ধনদেবতা কুবের। লক্ষ্মীদেবী জীবনের লক্ষ্য স্থির করে জীবনকে শ্রীমন্ত করে তোলেন। সরস্বতীর আশীর্বাদে বিদ্যালাভ যাতে জীবনকে শ্রীমন্ডিত করে জীবনের লক্ষ্য স্থির করে দেয় তাই সরস্বতীর হাতে যবের শিস দিয়ে তাতে লক্ষ্মীত্ত্ব অর্পণ করা হয়। তাই দিনটি শ্রীপঞ্চমী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুজনেই বিষ্ণুর পত্নী।



দ্বিতীয় মহাবিদ্যা তারা দেবীর অপর নাম হল নীল সরস্বতী। তাই তন্ত্রসাধকদের কাছে নীল সরস্বতী পুজো হল তন্ত্রসাধনার মহোৎসব। দুর্গা পুজোর সময় আমরা যে শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠ করে বা শুনে থাকি সেখানে দুর্গার কোন উল্লেখ নেই। সেখানে যে তিন দেবীর উল্লেখ রয়েছে তাঁরা হলেন মহাকালী, মহালক্ষ্মী এবং মহাসরস্বতী। বাংলা বাদে বাকি ভারতের সর্বত্রই এই মহাসরস্বতীর পুজো হয়। তিনি চতুর্ভূজা এবং ত্রিনেত্র। একমাত্র বাংলাতেই দ্বিভূজা সরস্বতীর রূপটি বহুল প্রচলিত। সরস্বতীর বর্ণনায় আমরা দেখি তাঁর গায়ের রঙ কুন্দ ফুল, চাঁদ এবং তুষারের মতন শ্বেতশুভ্র। তাঁর পরনে সাদা শাড়ি। তিনি শ্বেতপদ্মাসনা, শ্বেত পুষ্পশোভিতা, শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা। তিনি যেসব অলঙ্কার পরে রয়েছেন তারও রং সাদা। পুরাণবিদ শিবশংকর ভারতীর মতে সরস্বতী হলেন শুচিতার প্রতীক। জ্ঞান হল নিরাকার এবং জ্যোতির্ময়। আবার জ্ঞানই হল পরম ব্রহ্ম। তাই সবকিছুই রং বিহীন, শুধুই সাদা। তাঁর চার হাতের একটিতে অক্ষমালা, একটিতে বীণা, একটিতে বই এবং আরেকটি হাতে তিনি আশীর্বাদ করছেন। সরস্বতীর বাহন হিসেবে ময়ূর এবং হাঁস দুটোই বহুল প্রচলিত। ময়ূর হল সৌন্দর্যর প্রতীক আর হাঁস হল সেই পরমহংস যে কিনা দুধ এবং জল মিশিয়ে দিলে তার মধ্যে থেকে দুধটুকু আলাদা করে পান করতে পারে। অর্থাৎ জ্ঞান থেকে সার তত্ত্বটি আয়ত্ত করতে পারে।


এসবই হল পৌরাণিক সরস্বতীর কথা। এত কিছু বাদ দিয়ে যদি শুধুই ‘সরস্বতী’ শব্দের বিশ্লেষণ করি দেখা যাবে ‘সরস্বান্’ শব্দের সঙ্গে ‘স্বতী’ স্ত্রীবাচক যুক্ত হয়ে ‘সরস্বতী’ শব্দের উৎপত্তি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুসারে যার অর্থ- প্রচুর জলযুক্ত, সমুদ্র, নদ, নদী বিশেষ। ঋগ্বেদে অধিকাংশ জায়গায় ‘সরস্বতী’ শব্দ সিন্ধু নদ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘দেবনদী’ হিসেবেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ যিনি সরস ভাবে বহমান তিনিই সরস্বতী। প্রকারান্তরে তিনি হলেন জলের দেবী। এই সরস্বতী হলেন বৈদিক দেবী, যিনি নদী রূপা। তিনি লুকিয়ে থাকেন- তাই তিনি ফল্গু। প্রয়াগের ত্রিবেণী সঙ্গমে তাই গঙ্গা-যমুনা কে দেখা গেলেও সেখানে সরস্বতী কে চোখে পড়ে না।

@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@



No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...