Thursday, 4 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
     জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
      শঙ্খ ঘোষ
===========∆∆∆∆∆∆==============
     Doinik Sabder Methopath
     Vol -273. Dt -05.02.2021
       ২২ মাঘ ১৪২৭. শুক্রবার
++++++++++++++++++++++++++++++++++
" আমার ধর্মও নেই আমার অধর্ম নেই 
আমার মৃত্যুর কথা যদি কেউ 
দূর থেকে শোনো
জেনো – এ আমার মাটি একাল আমার
 দেশকাল ।"

                   প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ । পিতা মনীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং মাতা অমলা ঘোষ। তিনি বাংলাদেশের  চাঁদপুরে জেলায় ১৯৩২ খ্রি ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। বংশানুক্রমিকভাবে পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন পাবনায়। পিতার কর্মস্থল হওয়ায় তিনি বেশ কয়েক বছর পাবনায় অবস্থান করেন এবং সেখানকার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে অবসর নেন। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে আইওয়া রাইটার্স ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়,শিমলাতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ আডভান্স স্টাডিজ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন।
যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ করেছেন ।

উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ :

আদিম লতা গুল্মময়
মুর্খ বড়, সামাজিক নয়
কবির অভিপ্রায়
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
বাবরের প্রার্থনা
এ আমির আবরণ
জার্নাল
লাইনেই ছিলাম বাবা
ধূম লেগেছে হৃৎকমলে
গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ





১৯৭৭ খ্রিঃ "মূর্খ বড়, সামাজিক নয়" নরসিংহ দাস পুরস্কার।
১৯৭৭ খ্রিঃ "বাবরের প্রার্থনা" র জন্য সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার।
১৯৮৯ খ্রিঃ "ধুম লেগেছে হৃদকমলে" রবীন্দ্র পুরস্কার
সরস্বতী পুরস্কার "গন্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ"
১৯৯৯ খ্রিঃ "রক্তকল্যাণ" অনুবাদের জন্য সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার
১৯৯৯ খ্রিঃ বিশ্বভারতীর দ্বারা দেশিকোত্তম পুরস্কার
২০১১ খ্রিঃ ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার।
২০১৬ খ্রিঃ জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।


 বিশুদ্ধ উচ্চারণ : 
১. 
    মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
            শঙ্খ ঘোষ

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।

একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।

কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!

বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।

মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।

২.
হাতেমতাই
     শঙ্খ ঘোষ

হাতের কাছে ছিল হাতেমতাই
চূড়োয় বসিয়েছি তাকে
দুহাত জোড় করে বলেছি ‘প্রভু
দিয়েছি খত দেখো নাকে।
এবার যদি চাও গলাও দেব
দেখি না বরাতে যা থাকে -
আমার বাঁচামরা তোমারই হাতে
স্মরণে রেখো বান্দাকে!’

ডুমুরপাতা আজও কোমরে ঝোলে
লজ্জা বাকি আছে কিছু
এটাই লজ্জার। এখনও মজ্জার
ভিতরে এত আগুপিছু!
এবার সব খুলে চরণমূলে
ঝাঁপাব ডাঁই করা পাঁকে
এবং মিলে যাব যেমন সহজেই
চৈত্র মেশে বৈশাখে।

৩.
     শূন্যের ভিতরে ঢেঊ
         শঙ্খ ঘোষ

বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?

৪.
       ছুটি
 শঙ্খ ঘোষ

হয়তো এসেছিল | কিন্তু আমি দেখিনি |
এখন কি সে অনেক দূরে চ’লে গেছে?
যাব | যাব | যাব |

সব তো ঠিক করাই আছে | এখন কেবল বিদায় নেওয়া,
সবার দিকে চোখ,
যাবার বেলায় প্রণাম, প্রণাম!

কী নাম?
আমার কোনো নাম তো নেই, নৌকো বাঁধা আছে দুটি,
দুরে সবাই জাল ফেলেছে সমুদ্রে -

৫.
বাবরের প্রার্থনা
   শঙ্খ ঘোষ

এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত—
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন
কোথায় কুড়ে খায় গোপন ক্ষয়!
চোখের কোণে এই সমুহ পরাভব
বিষায় ফুসফুস ধমনী শিরা!

জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে
ধূসর শূন্যের আজান গান ;
পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

না কি এ শরীরে পাপের বীজাণুতে
কোনোই ত্রাণ নেই ভবিষ্যের
মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে ?

না কি এ প্রসাদের আলোর ঝল্ সানি
পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়
এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে
লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের ?

আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
জীর্ণ ক’রে ওকে কোথায় নেবে ?
ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।


             পঞ্চাশের কবিকুলের মধ্যে অন্যতম বর্ষীয়ান তিনি। লক্ষণীয়, পঞ্চাশের কবি হলেও মানসিকতা ও জীবনদর্শনের দিক থেকে তিনি অনেকটাই ভিন্ন। ব্যক্তিস্বর তাঁর কবিতারও নিয়ন্ত্রা; কিন্তু সমাজ সেখানে প্রাণবন্ত বাস্তব। প্রতিবাদ তাঁর অনায়াস ভুবন, মনে হয় ব্যক্তিময়তা এবং সমাজচৈতন্যের বিরুদ্ধতার ধারণায় তাঁর আস্থা ছিল না। বরং তিনি মনে করেন, এদের মধ্যেও আবিষ্কার করা যায় গহন সম্পর্কের সূক্ষ্ম সুতো। নিজস্ব সৃষ্টিতে এরই সুচারু সমন্বয়ে তিনি সর্বত্র তৎপর।

কবিতার ভাষা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শঙ্খ ঘোষের বিবৃতি :
“সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়... তখন যেটা বলতে চেয়েছিলাম তা হল নানা রকমের চমৎকৃতি থেকে বেরিয়ে আসার কথা। শব্দের ভার, ছবির জৌলুস, ছন্দের দোল এসব থেকে নিজেকে যথাসম্ভব সরিয়ে নেওয়ার কথা। দৈনন্দিন কথাবার্তার চাল, তার শ্বাসপ্রশ্বাস,যথাসম্ভব তার কাছাকাছি থেকে বলা। এসবকে বলেছিলাম সহজ। কিন্তু তার থেকে যে অনুভূতিটা পৌঁছায় তাতে হয়তো অনেক জট-জটিলতা থাকতে পারে। আসলে, ভাষার বা কথার নানা রকমের তল তৈরি হতে থাকে তখন। একদিকে সহজ সীমায় সময়টাকে ধরে রাখতে পারে যে ভাষা, সে কিন্তু অন্যদিকে আবার গড়িয়ে যেতে পারে অনেক দূরে।”
        কবির প্রজ্ঞাশাসিত মননের প্রকাশ ঘটে বাক্যালংকার (পযধরংসঁং) সৃষ্টিতে। ‘জীবনে বয়স নয়, বয়সে জীবন জুড়ে যাওয়া’ (গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ); কিংবা ‘পাথরের মুখচ্ছবি নেই কিন্তু মুখের পাথরছবি আছে’ (শিশুরাও জেনে গেছে) প্রভৃতি বাক্যালংকার কবিতাকে গভীরতার দিকে নিয়ে যায়। তাঁর কবিতায় অনুপ্রাস, ছড়ার ছন্দ যেমন শ্রুতিমধুরতা সৃষ্টি করে তেমনি বাক্যালংকার, সমাসোক্তি, রূপক, চিত্রকল্প প্রভৃতি অলঙ্কার পাঠকমনে ভাবনার উদ্রেক করে।

শঙ্খ ঘোষের কাব্যকলার উৎকর্ষ ঘটে শিল্প ও নির্মাণকৌশলের সম্মিলনে। প্রতিভাকে যথাসাধ্য পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি কবিতায় প্রয়োগ করেন। কবি শঙ্খ ঘোষের মননশক্তি, কল্পনা, অভিজ্ঞান আর জীবনবোধ কাব্যের মূলশক্তিরূপে ভর করে এবং সেগুলোর প্রকাশের জন্য তিনি টেকনিকের আশ্রয় নেন। ভাষার কারসাজি, শব্দের অনুশাসন, সহজ-সাবলীল বাক্যবন্ধ রচনা, প্রতীকী চিত্রকল্প, অলঙ্কার ব্যবহারে সচেতনতা, বিশেষ ভাব প্রকাশের জন্য বিচিত্র অভিব্যক্তির আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর কাব্যবলয়। তাঁর কাব্যে একজন শিল্পীর সঙ্গে যুক্ত হয় একজন সচেতন নির্মাতা। মার্জিত রুচির সঙ্গে ভাষাকে মিলিয়ে দেন তিনি। ফলে বস্তুপৃথিবীর ওপর ভর করে গড়ে ওঠে শিল্পঅন্বিষ্ট কাব্যভুবন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...